Dr. Syama Prasad Mookerjee Research Foundation

নিমতিতা রাজবাড়ীর কিছু কথা

মধ্যবঙ্গে মুর্শিদাবাদ জেলার উত্তর প্রান্তে জঙ্গীপুর মহকুমার অন্তর্গত সামসেরগঞ্জ থানা বা ব্লকের অধীন নিমতিতা একটি ছোট্ট প্রাচীন গ্রাম। এর দক্ষিণ দিকে নিমতিতা গ্রাম পঞ্চায়েতের গ্রাম শেরপুর; পূর্বদিকে তিন কিলোমিটার ব্যবধানে জগতাই গ্রাম, তারই কাছে গঙ্গার ওপারে দহরপাড়া গ্রাম আর পশ্চিমে হাসিমপুর ও নলগাড়ী বা নগরবিল। এছাড়া কয়েক কিলোমিটার ব্যবধানেই আছে অরঙ্গাবাদ, ধুলিয়ান। ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান প্রাচীনতম স্থান।  নিমতিতা গ্রামটির নামকরণ নিয়ে কিংবদন্তী ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, মুঘল আমলে তখনকার মুখসুদাবাদ নামে অঞ্চলটি ছিল রাজসাহী বিভাগের অভ্যন্তরভাগ অঞ্চল। কারণ তখনও পর্যন্ত মুখসুদাবাদ মুর্শিদাবাদ নামে পরিচিতি লাভ করতে পারেনি। সেই সময় বিশেষভাবে নিমতিতা অঞ্চলটি ছিল অতিবিরল বসতিপূর্ণ, শ্বাপদসংকুল পরিবৃত, ঘন জঙ্গলে পূর্ণ অসংখ্য নিমগাছের সমারোহে ছায়া শীতল ছোট্ট একটি গ্রাম- সম্ভবতঃ এই নিমগাছের সমারোহের কারণে গ্রামটি সাধারণ্যের কাছে নিমতিতা নামে পরিচিতি লাভ করে। এছাড়া ছিল অসংখ্য কুলের গাছ। কুল গাছে লাক্ষা-কীটে বাসা বাঁধতো। সেই লাক্ষা বিক্রি করে স্থানীয় মানুষ প্রচুর অর্থ উপার্জন করতো।  নিমতিতা গ্রামের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে গঙ্গা দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়ে দু’দিকে বয়ে গেছে। পদ্মারূপে বয়ে গেছে পূর্বদিকে রাজসাহী অভিমুখে, আর ভাগীরথীরূপে দক্ষিণ দিকে নিমতিতার কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে কলকাতা অভিমুখে। সেকালে ব্যবসা-বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে তেমন কোন সড়ক পথ ছিল না, কেবল নদী পথই ছিল একমাত্র ভরসা। গঙ্গা-পদ্মার সঙ্গমস্থলের নাম ছিল ‘ছাপঘাটি’। এই ছাপঘাটি নামকরণ সম্বন্ধে প্রচলিত অধিক সমীচীন মত হল -মুসলমান-রাজত্বকালে ‘ছাপঘাটি’ নাকি ব্যবসা ক্ষেত্রে শুল্ক আদায়ের স্থান ছিল। এছাড়া সমরনীতি হিসাবে বন্দরটির সুবিধাজনকি অবস্থান হেতু স্থানটি অনেক সময় নওয়ালি বা রবিশস্যের আড্ডারূপে ব্যবহৃত হত। সে সময়ে এই স্থানে ব্যবসায় শুল্ক আদায়ের জন্যে নবাবী শিলমোহর ছাপযুক্ত রসিদ বা ছাড়পত্র দেওয়া হত বলে সম্ভবতঃ স্থানটি ‘ছাপঘাটি’ নামে জনসাধারণ্যের কাছে প্রচার হয়ে থাকবে। যাই হোক, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক পরিচিতির দিক থেকে এই হলো নিমতিতা গ্রামের মোটামুটি অবস্থান। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে নিমতিতা গ্রামটি প্রায় আড়াই’শ বছরের প্রাচীন গ্রাম।   রামচন্দ্র রায় থেকে এই বংশের নাম পাওয়া যায়। তিনি গৌড়েশ্বরের অধীনে কাজ করে নিজ বাসস্থান, অষ্টমুনিষ! (পাবনা) ত্যাগ করে, গঙ্গাতীরে গৌড়ের নিকট টাণ্ডানগরী, তৎপরে রঘুনাথপুর, লহলামারী প্রভৃতি স্থানে বাস করেন।  এঁরা ছিলেন একজন বরেন্দ্র শ্রেণির কায়স্থ সম্প্রদায়ভুক্ত শিক্ষিত ব্যক্তি। ভাগ্যান্বেষণের কারণে তিনি পরিবার সহ অষ্টমনীষা গ্রাম ত্যাগ করে রাজধানী গৌড়ের সন্নিকটে টারা নামক গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। ফার্সি, সংস্কৃত এবং বাংলা ভাষায় তিনি ছিলেন সু-পণ্ডিত। তাই সুলতানের দরবারে প্রশাসনের ক্ষেত্রে এক উচ্চপদে কাজ পেতে তার বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয়নি। যতদূর জানা যায় যে, সম্ভবত তিনি প্রশাসনিক আইন-আদালত সংক্রান্ত বিষয়ে অনুবাদকের কাজ করতেন। এইভাবে টারা গ্রামে কয়েক পুরুষ বাস করার পর ১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দে শেরশাহ কর্তৃক বাংলাদেশ আক্রমণ হলে গৌড় নগরী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়; ফলে বাধ্য হয়ে চৌধুরী বংশধর লালসুন্দর চৌধুরী এবং গৌরগোপাল চৌধুরী দুই ভাই টারা গ্রাম ত্যাগ করে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে রঘুনাথপুর গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য বেছে নিয়েছিলেন কৃষিজাত পণ্যের বাণিজ্য। কিন্তু কোন এক বন্যার সময় গঙ্গার ভাঙ্গনে তাদের বসতবাটীটিও গঙ্গায় তলিয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে পুনরায় নহলামারি গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। এখানেই লালসুন্দর চৌধুরীর পুত্র গৌরসুন্দর এবং গৌরগোপালের পুত্র দ্বারিকানাথ জন্মগ্রহণ করেন।    বৃটিশ শাসনাধীন সময়ে ইংরেজ প্রভু ভক্ত বহু শিক্ষিত ব্যাক্ত বৃটিশ সরকারের বদান্যতায় মুর্শিদাবাদ জেলার এখানে সেখানে আশাতিরিক্ত জমিদারি লাভ করে নিজেদের জমিদার বলে প্রতিপন্ন করেছিল। অবশ্য নবাব, রাজা-মহারাজার সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। সে সময় নিমতিতা জমিদারবাবুদের আয়-ব্যয় কেমন ছিল তা আমাদের পক্ষে জানা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তবে সে সময়ের প্রভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর রচনাশৈলীর বিবরণী থেকে জানা যায় যে জমিদার বাড়ির একাধিক পূজা-পার্বণ উৎসব উপলক্ষে এবং পারিবারিক উদ্বাহবন্ধন অনুষ্ঠান প্রভৃতিতে ব্যয় বাহুল্যের যেরূপ চোখ ধাঁধানো বিলাস-বহুল আড়ম্বরের দেদীপ্যমান দৃশ্য দেখা যেত সেরূপ সমারোহি সচরাচর অন্য কোথাও দেখা যেত না।
এই বিশাল জমিদার বাড়ির একপ্রান্তে থাকতেন গৌরসুন্দর চৌধুরী আর অন্যপ্রান্তে থাকতেন তাঁর খুড়তুতো ভাই দ্বারকানাথ চৌধুরী। গৌরসুন্দর চৌধুরী দুই পুত্র ও চার কন্যার পিতা ছিলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র উপেন্দ্রনারায়ণ আর কনিষ্ঠ পুত্র সুরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। কন্যাদের নাম জানা যায় না। নিমতিতায় বসবাসকারী স্থানীয় জনগণের কাছে উপেন্দ্রনারায়ণ ‘হরিবাবু’ এবং সুরেন্দ্রনারায়ণ ‘কালীবাবু’ নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু উপেন্দ্রনারায়ণের জীবনে বিধাতা পুরুষের এমনি অভিশাপ নেমে এসেছিল যে তিনি ছিলেন জন্মগত উন্মাদ। এমনই উন্মাদ ছিলেন যে এই বিশাল ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকারী হয়েও তার পরনের কাপড়খানি পর্যন্ত থাকত না। বলতে গেলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেহ। পরনের কাপড়খানি কোনরকেম গুটিয়ে নিয়ে বাঁ হাতের বগলের নীচে চেপে ধরে রাখতেন। হাজার হোক, জমিদার পুত্র, তাই তাঁর সম্মান রাখার জন্যে দিনরাত দেখাশোনা করার জন্যে সঙ্গী হিসেবে থাকত একজন ভৃত্য আর একটি কুকুর। সাধারণ জাতের দেশী কুকুর, চলতি কথায় যাকে বলে নেড়ি কুকুর। কুকুরটিকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। দেখে মনে হত  তাঁকে ছাড়া কুকুরটির আপনজন বলতে যেন কেউই ছিল না। তাই জমিদার বাড়ির মধ্যাহ্ন ভোজ ভোজনের পর তিনি বাইরে এসে সবার অলক্ষে পরনের কাপড়ের একপ্রান্ত গলার মধ্যে ঢুকিয়ে সমস্ত ভুক্ত বস্তু উদ্গিরণ করে তাঁর আদরের কুকুরটিকে খাওয়াতেন। এর থেকে স্পষ্ট অনুমান করা যায় যে, উন্মাদ হ’লে কী হবে? তাঁর অন্তরে কোনো এক স্থানে দয়া-মায়ার একটা ক্ষেত্র ছিল। সব সময় চুপচাপ থাকতেন। তাঁকে নিয়ে জমিদার বাড়ির সদস্যদের কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু এক এক সময় অন্যদের দু’একটি বিশেষ বিশেষ কদাচার অঙ্গভঙ্গি তিনি সহ্য করতে পারতেন না। গালাগালি দিতেন, তাই বলে অশ্লীল ভাষায় নয়। বেশি উত্তেজিত হলে তাড়া করে মারতে যেতেন। আবার কখনো কখনো নিজের হাতের আঙ্গুল কামড়িয়ে শরীরের উত্তেজনা প্রকাশ করতেন। আবার মাঝে মাঝে পাগলের প্রলাপের মধ্যে কচিৎ কখনো এমন দু’একটি কথাও বেরিয়ে পড়ত যা আপ্তবাক্যের ন্যায় শোনাতো। তাই এই সব কথা শুনে ধার্মিক ব্যক্তিগণ বলতেন “ইনি নিশ্চয় পূর্ব জন্মের কোন যোগ ভ্রষ্ট মুনি-ঋষি ছিলেন।”  অন্যদিকে গৌরসুন্দর চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র সুরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ওরফে কালীবাবুর চেহারা ছিল অপরূপ সুন্দর, যাকে বলে কন্দর্পকান্তি পুরুষ। তাঁর চালচলন, আচার-ব্যবহার বেশভূষা সহ বিলাস-বৈচিত্র্যে জমিদার সুলভ আভিজাত্যের আধার স্বরূপ ছিলেন তিনি। বংশরক্ষার জন্যে গৌরসুন্দর চৌধুরী বহু সমারোহে আত্মীয়-পরিজন সমভিব্যাহারে পুত্র সুরেন্দ্রনারায়ণের বিবাহ দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সুরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর পুত্রবধূ বেলারাণী চৌধুরীর কোন সন্তান না হওয়ায় বাধ্য হয়ে কল্যাণ শঙ্কর রায় নামে এক যুবককে দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। এইভাবে এখানেই গৌরসুন্দর চৌধুরীর বংশ লোপ পায়। ১৮৮৯ সালে মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে গৌরসুন্দর চৌধুরী পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর খুড়তুতো ভাই দ্বারকানাথ চৌধুরী এই বিশাল জমিদারি সহ তাঁর পুত্র ও কন্যাদেরও সকল দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন।   বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের ও লেখকদের বিবরণ থেকে এই বাড়ির পরিকল্পনা সম্বন্ধে জানা যায় – বিশাল প্রাসাদের বহির্ভাগে সিংহদ্বারের কাছে পূর্ব-পশ্চিমাভিমুখী জেলা বোর্ডের রাস্তা। সিংহদ্বার আর উক্ত রাস্তার মধ্যবর্তী পথের পাশে দু’দিকে গালিচার ন্যায় ঘন সবুজ তৃণাচ্ছাদিত মসৃণ ক্ষেত্র বা লন। সিংহদ্বার থেকে প্রাসাদে প্রবেশ পথ পর্যন্ত লাল সুড়কির রাস্তার দু’পাশে রেলিং ঘেরা সুরম্য উদ্যান; তাতে নানা বর্ণের নানা সুঘ্রাণযুক্ত পুষ্পসম্ভারে উদ্যান দু’টি সর্বদা সুরঞ্জিত ও সুরভিত থাকত। এছাড়া জমিদার বাড়ির অন্যদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশও ছিল অতি মনোরম। জমিদার বাড়ির সামনেই অনতিদূরে প্রবহমান স্রোতস্বিনী পুণ্যতোয়া গঙ্গা। তার কিনারে কাশের বন। নদীর ঘাটে পল্লীবধূর গুঞ্জন। গঙ্গা ও জমিদার বাড়ির মাঝখানে দ্বারকানাথ চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত দু’টি ফুটবল খেলার মাঠ (এখন তার কোনো অস্তিত্ব নেই)। তারপরেই একেবারে নদীর তীর পর্যন্ত চিত্তাকর্ষক দৃষ্টিনন্দন ঘন সবুজ শস্যকে শীতল সমীরণ প্রবাহিত হয়ে শ্যামল শস্যক্ষেত্রের অগ্রভাগ হিল্লোলিত করে জমিদার বাড়ির খানদানি বাতায়ণ পথে অলিন্দে প্রবেশ করত।
 প্রাসাদের অন্দর ও বর্হিভাগের বর্ণনা:
এই বিশালাকার দোতলাযুক্ত জমিদার প্রাসাদে ছিল দুই মহল। বাহিরমল ও অন্দরমহল। বাহিরমহলের প্রকাণ্ড প্রাঙ্গণের পূর্বদিকে ছিল চণ্ডীমণ্ডপ, উচ্চতায় প্রায় দোতলার সমান। তাই প্রাঙ্গণ থেকে অনেকগুলো সিঁড়ি অতিক্রম করে তবেই মন্দিরে পৌঁছানো যেত। প্রাঙ্গণের অন্য তিন দিকে (উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম) ছিল সুপ্রশস্ত বারান্দা। বৃহৎ কাছারি-বাড়িটি ছিল পশ্চিম দিকের বারান্দার ঠিক সামনে। আর উত্তর ও দক্ষিণ দিকের বারান্দার পাশে জমিদারি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিভাগের যাবতীয় দপ্তর এবং অন্যান্য কিছু ব্যবহারের জন্যে ছিল একাধিক কক্ষ। দক্ষিণ-পশ্চিম বারান্দার কোণে অর্থাৎ নৈঋত কোণে ছিল দোতলায় উঠবার প্রশস্ত সিঁড়ি। প্রাসাদের দোতলাটি একতলার অনুরূপ পরিকল্পনায় নির্মিত। একতলার কাছারি বাড়ির ঠিক উপরে দোতলায় একটি বৃহৎ হলঘর ছিল। সেকালে উক্ত হলঘরটি বহু মূল্যবান আসবাবপত্রে সুসজ্জিত থাকত। সবাই বলত পেইন্টিং হল। কারণ হলঘরের অভ্যন্তরের দেওয়ালের চারিদিকে নয়নভোলানো রঙে রঞ্জিত ও সুরুচিসম্পন্ন চিত্রাঙ্কনে সুশোভিত ছিল। তার উপর কক্ষতলটি ছিল পারস্যদেশীয় নক্সাকাটা বহু মূল্যবান গালিচায় ঢাকা। ঘরের মধ্যে শোভা পেত বেলজিয়াম কাঁচের স্বচ্ছ বড় বড় আরশি আর ছিল ছাদের কড়িবর্গা থেকে ঝুলন্ত দোদুল্যমান একাধিক ঝাড়বাতি। কক্ষে প্রবেশ করার জন্যে ছিল খানদানী আভিজাত্যপূর্ণ পেল্লায় পেল্লায় দরজা ও বাতায়ন। তখনও বিজলী বাতির প্রচলন হয়নি। তাই রাতের আঁধার অপসৃত করার জন্যে সে সময় জমিদার বাড়ির সর্বত্র একাধিক কার্বাইড গ্যাসের বাতি জ্বলতো। ফলে বেলোয়ারি কাঁচের ঝুলন্ত দীপাধারগুলো গ্যাসের উজ্জ্বল আলোয় প্রদীপ্ত হয়ে উঠলে যেন এক সম্মোহন আবেশে স্বপ্নলোকের সুষমায় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠতো হলঘরটি। এই হলঘরটিই ছিল প্রখ্যাত সাহিত্যাচার্য তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ‘জলসাঘর’ গল্পের পটভূমি। পরবর্তী পর্যায়ে জলসাঘর সম্বন্ধে আলোচনা করব। জমিদার বাড়ির গৃহদেবতা ছিলেন ‘শ্রীগোবিন্দজী’। তাঁর অধিষ্ঠান ছিল পূর্বদিকে প্রাসাদ সংলগ্ন মন্দিরে। মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন জগতাই নিবাসী মাননীয় রমেশচন্দ্র ভাদুড়ী মহাশয়। নিত্য পূজার্চনা ও সন্ধ্যারতি তিনিই করতেন। প্রতিদিন গোবিন্দজীর উদ্দেশ্যে মাত্রাতিরিক্ত ভোগের ব্যবস্থা ছিল। তার মধ্যে থাকত গোবিন্দভোগ চালের সুগন্ধি অন্ন, ডাল, পাঁচমিশেলি তরকারি, যেকোন ভাজা, শুক্তো, ডালনা, অম্বল এবং মিষ্টি। সে সময় অনেকেই এই ভোেগ খেয়েই তাদের দিন অতিবাহিত করত। মন্দিরের সামনে ছিল বিশাল নাটমণ্ডপ। শুচিশুভ্র শ্বেতপ্রস্তরের মণ্ডনকলায় শ্রীমণ্ডিত ছিল নাটমণ্ডপের তলদেশ। সর্বদা একটা সুগন্ধযুক্ত পরিচ্ছন্ন পবিত্র পরিবেশ বিরাজ করত। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি – নিমতিতা জমিদার বাড়ির পরিবারবর্গের অন্যতম দীক্ষাগুরু ছিলেন জগতাই নিবাসী পরম বৈষ্ণব পণ্ডিত প্রভুপাদ হেমেন্দ্রকৃষ্ণ গোস্বামী বিদ্যাবিনোদ মহাশয়। জমিদার বাড়ির বহির্ভাগে ছিল ঘূর্ণায়মান থিয়েটার রঙ্গমঞ্চ। কলকাতার সাধারণ রঙ্গালয়ের আদলে নির্মিত হয়েছিল। এই রঙ্গালয় সম্বন্ধে পরে বিশদভাবে আলোচনা করব। থিয়েটার বাড়ির কাছবরাবর ছিল জমিদার বাড়ির ছাপাখানা। নাম ‘গোবিন্দ প্রেস’। ১৯০২ সালে এই গোবিন্দ প্রেস স্থাপিত হয়েছিল। ছাপাখানার কর্মকর্তা হিসেবে তারাদাস চট্টোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তিকে জমিদারবাবুরা নিযুক্ত করেন। তারাদাসবাবু একাধারে প্রেসে কম্পোজিটার ও ম্যানেজার। তিনি ছাপাখানার কম্পোজিটার হলেও একজন সাহিত্যিক ছিলেন। হাওড়া নিবাসী দুর্গাদাস লাহিড়ীর সম্পাদনায় সে সময় ‘সাহিত্য সংহিতা’ নামে একটি মাসিকপত্র প্রকাশিত হত। ঐ পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লেখক ছিলেন।  ছাপাখানার পূর্বদিকে ছিল জমিদার বাড়ির আস্তাবল। সেখানে বলশালী ঘোড়া আর ঘোড়ার গাড়ির আস্তানা ছিল। রাস্তার উত্তরদিকে ছিল হাতিশালা, সেখানে একটি বৃহৎ আকারের হাতি বাঁধা থাকত। প্রাসাদের পূর্বদিকে একটি নাতিদীর্ঘ পুষ্করিণী। একদা তাতে স্ফটিকের স্বচ্ছ জল টলটল করত। বাঁধানো ঘাট। সিঁড়ি বেয়ে জলে নামতে হত। পুষ্করিণীর চারিদিকে ছিল লাল রঙের মোরামের রাস্তা। পুষ্করিণীর পশ্চিমদিকের রাস্তার অনতিদূরে ছিল জমিদার বাড়ির শস্যভাণ্ডার। সেখানে বিশাল বিশাল একাধিক গোলায় আলাদা আলাদাভাবে ধান, চাল, ডাল, গম প্রভৃতি নানাবিধ শস্য সময়ের অসময়ের জন্যে সদা-সর্বদা মজুত থাকত। জমিদার প্রাসাদের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে একটি বিশাল বাগান ছিল। সেই বাগানে নানা জাতের খানদানী আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু প্রভৃতি ফলের গাছ তো ছিলই, এছাড়া কতকগুলি দুর্লভ জাতীয় গাছও ছিল ঐ বাগানে। স্থানীয় বাসিন্দারা অনেক সময় তাদের প্রয়োজনে বাগানে ঢুকে হরীতকী গাছের তলা থেকে ঝড়তি-পড়তি হরীতকী এবং তেজপাতা গাছের তলা থেকে শুকনো তেজপাতা কুড়িয়ে নিয়ে যেত। প্রাসাদের পশ্চিমদিকে জমিদার বাড়ির পাইক-বরকন্দাজদের বসবাসের জন্য গৃহ ছিল। ভীমাকৃতি-শালপ্রাংশু দেহ-বৃষষ্কন্ধ বিশিষ্ট ছিল এক একজন বরকন্দাজ। নিজেদের দেহকে সুস্থ-সবল-সচল রাখার জন্যে তারা প্রতিদিন ডন বৈঠক, মুগুর ভাজা প্রভৃতি ব্যায়াম করত।  নাট্যচর্চা ও নিমতিতা জমিদার বাড়ি: দ্বারকানাথ চৌধুরী ছিলেন দুই পুত্রের পিতা। জ্যেষ্ঠ পুত্র মহেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী আর কনিষ্ঠ জ্ঞানেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী। ১২৮৫ বঙ্গাব্দে (ইংরাজী ১৮৭৮ সাল) মহেন্দ্র নারায়ণের জন্ম হয়। বাল্যকাল থেকেই তাঁর শখ ছিল থিয়েটার অভিনয়ের প্রতি। এই কারণে মহেন্দ্রনারায়ণের যখন উনিশ বছর বয়স সেই সময় পিতা দ্বারকানাথ চৌধুরীর পৃষ্ঠ পোষকতায় ১৩০৪ বঙ্গাব্দে তিনি একটি শখের থিয়েটার মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেন ‘হিন্দু থিয়েটার’। হিন্দু থিয়েটার-এর রঙ্গমঞ্চটি ছিল বিজলীবাতি সমৃদ্ধ এবং প্রায় তিন তলা সমান উচ্চতা বিশিষ্ট প্রকাণ্ড থিয়েটার হল। তার ভিতরে ছিল ‘ব্যালকনি’ সমন্বিত এক সুরম্য প্রেক্ষাগৃহ। জমিদার বাড়ির পূর্বদিক সংলগ্ন জায়গায় বহু অর্থ ব্যয় করে কলকাতার পাবলিক থিয়েটারের ন্যায় সর্বসুবিধাযুক্ত ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চটি স্থাপন করে নিমতিতা গ্রামসহ আশেপাশের গ্রামের শিক্ষিত অর্ধ-শিক্ষিত ছোট বড় ব্যক্তিদের নিয়ে প্রতিবছর বিশেষ করে জমিদার বাড়ির উৎসব অনুষ্ঠানের সময় মহেন্দ্রনারায়ণ একটি করে নাটক মঞ্চস্থ করতেন। নাট্যপ্রাণ মহেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীএরই  মধ্যে দিনক্ষণ ঠিক করে দ্বারকানাথ চৌধুরী শতদুবাসিনী নামে এক সর্বসুলক্ষণা রমনীর সঙ্গে পুত্র মহেন্দ্র নারায়ণের বিবাহ দেন। মহেন্দ্রনারায়ণের পুত্রবধূর নাম সবিতা দেবী (চৌধুরী)। দ্বারকানাথ চৌধুরী জমিদার বাড়ির যে অংশে থাকতেন, সেই অংশের দক্ষিণ দিকে থাকতেন মহেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী আর উত্তর দিকে থাকতেন জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। যে যুগে মহেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর ন্যায় নাট্যমোদী, নাট্যরসিক এবং নাট্যমঞ্চের হিতৈষী বন্ধু পাওয়া অত্যন্ত বিরল ছিল বললেও অত্যুক্তি হয় না। মহেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ছিলেন থিয়েটার অন্ত প্রাণ। তিনিই ছিলেন থিয়েটারের সর্বাধিনায়ক। এক কথায় নাট্যকলার ক্ষেত্রে একজন পারদর্শী সঠিক গুণীব্যক্তি। মঞ্চে অভিনয়ের জন্যে নাটক নির্বাচন, তার সাথে তাল রেখে উপযুক্ত অভিনেতা সংগ্রহ করে তাদের অভিনয়ের শিক্ষাদান, নাটকের দৃশ্যপট পরিকল্পনা প্রভৃতি গুরুদায়িত্বের ভার তিনি নিজেই বহন করতেন। বলতে গেলে তিনিই প্রযোজক, তিনিই পরিচালক, আবার তিনিই শিক্ষক। কারণ তিনি স্বয়ং একজন অভিজ্ঞ উচ্চশ্রেণীর অভিনেতা ছিলেন। মহেন্দ্রনারায়ণের বিস্ময়কর অভিনয়-নৈপুণ্য এবং নাট্য বিষয়ে শিক্ষাদান পদ্ধতির গুণে প্রধানতঃ অশিক্ষিত কিম্বা স্বল্পশিক্ষিত গ্রাম বাংলার পল্লী অঞ্চলের সহজ সরল মানুষদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক শক্তিশালী নাট্যগোষ্ঠী। এইভাবে পল্লীপ্রেমী মহেন্দ্রনারায়ণ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন পল্লীর বুকে এক সফলকাম আনন্দলোক।  নিমতিতার কয়েক মাইল ব্যবধানে অবস্থিত জগতাই এবং দহরপাড়া পল্লী। আগেই বলেছি, জগতাই নিমতিতা অঞ্চলটি মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর মহকুমার অধীন সুতি-সামসেরগঞ্জ থানার অন্তর্গত দু’টি পল্লী। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের পাশাপাশি বাস। এছাড়া কায়স্থ প্রধান এই অঞ্চলে ব্রাহ্মণের সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। এই তিন অঞ্চলের গুণী ব্যক্তিগণ মুখ্যত ছিলেন ‘হিন্দু থিয়েটার’-এর কলাকুশলী। যেমন খোদ নিমতিতা অঞ্চলেই ছিল কয়েকজন উচ্চশ্রেণীর অভিনেতা। তাঁরা হ’লেন – সতীশচন্দ্র ভাদুড়ী, বসন্ত কুমার মজুমদার, শ্রীশচন্দ্র সরকার (জমিদারদের মহাফেজ খানার কর্মচারী ছিলেন), সুরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, প্রাণহরি দাস প্রমুখ ব্যক্তিগণ।  এছাড়া জগতাই পল্লীতেও কয়েকজন সুদক্ষ অভিনেতা ছিলেন। তাঁরা হলেন – যতীন্দ্রনাথ মজুমদার, সত্যনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধারমণ নন্দী, রসরাজ ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তিগণ। এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে যতীন্দ্রনাথ মজুমদার এবং সত্যনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় উভয়েই ‘হিন্দু থিয়েটার’ মঞ্চে অভিনীত বহু নাটকের অনেক জটিল চরিত্রে রূপদান করতেন। এছাড়া অমৃতলাল বসু প্রণীত ‘কৃপণের ধন’ নাটকে হলধর হালদারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রসরাজ ঘোষ। রসরাজ ঘোষ ছিলেন সুকণ্ঠ গায়ক। নাট্যাভিনয়ের সময় তাঁর গাওয়া গানগুলি যে কেবল শ্রবণমধুর হত তা নয়, তাঁর গায়কীর গুণে গানের প্রতিটি চরণ সকল শ্রোতা-দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যেত। এই সব নাটকের প্রম্পটারের কাজ করতেন জগতাই নিবাসী অতুলচন্দ্র নিয়োগী মহাশয়। অনুরূপভাবে দহরপাড়া পল্লীতেও এরূপ দু’জনে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী শক্তিশালী পরিবর্তে সান্যাল পদবী গ্রহণ করেন) এবং চারুচন্দ্র সিংহ। নাটকে এরা দুজনেই নারী অভিনেতা ছিলেন। তাঁরা হলেন – শচীন্দ্রনাথ অধিকারী (পরে অধিকারী পদবীর পদবীর পরিবর্তে সান্যাল পদবী গ্রহণ করেন) এবং চারুচন্দ্র সিংহ নাটকে এরা দুজনেই নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন। শচীন্দ্রনাথ ছিলেন কিন্নরকণ্ঠী সংগীত শিল্পী এবং সুদর্শন যুবক। যে কোন গানের তান, মীড, গমক, মুর্ছনা- প্রতিটি উপাদান থরে থরে কণ্ঠে সাজিয়ে দিয়ে যেন বিধাতাপুরুষ তাকে মর্ত্যলোকে প্রেরণ করেছিলেন। বিখ্যাত নাট্যকার ক্ষিরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদ প্রণীত ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকে ‘বিজয়া’-র ভূমিকায় শচীন্দ্রনাথের কণ্ঠে ‘এসো ফিরে এসো, ফিরে এসো গো’ গানটি এমন মনপ্রাণ ঢেলে গেয়েছিলেন যে, সেই গানের রেশ বহুদিন পর্যন্ত সকল দর্শকের হৃদয়ে ছিল।  সে সময়ে নাটকে নারী চরিত্রে অভিনয় করার জন্য নিমতিতা অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হত কম বয়সী সুদর্শন কিশোরদের। কারণ, মহেন্দ্রনারায়ণ লক্ষ্য করেছিলেন যে বহু কিশোরের মধ্যে নৃত্যগীতের প্রতি পারংগমতা ছিল অত্যধিক। এই দলের মৃত্যুঞ্জয় নামে একটি সুদর্শন কিশোর নাচে-গানে-অভিনয়ে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছিল। এছাড়া যুধিষ্ঠির নামে আর একজন সুদর্শন কিশোর দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রণীত ‘সাজাহান’ নাটকে ‘পিয়ারী’-র ভূমিকায় নারী চরিত্রের অভিনয়ে তার প্রাণঞ্চল অভিনয় সকল দর্শককে মুগ্ধ করেছিল। সেই কিশোরদ্বয় যে শুধু অভিনয়েই পারদর্শী ছিল এমন নয়, তার সাথে সাথে তাদের গানের কণ্ঠও ছিল সুমধুর।  এছাড়া ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ প্রণীত ‘আলমগীর’ নাটকে যুধিষ্ঠিরের ‘উদিপুরী’-র চরিত্র অভিনয় হয় তো সে সময় সকল দর্শকের কাছে চিরস্মরণীয় হয়েছিল। আরো একবার স্বনামধন্য নাট্য-জগতের প্রাণপুরুষ নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ী নিমতিতা জমিদার বাড়ির দোলযাত্রা উৎসব উপলক্ষে আমন্ত্রিত হয়ে জমিদার বাড়িতে এসেছেন। চারিদিকে সাজ-সাজ হৈ হৈ রব। দোলযাত্রার নাটোৎসবে ‘হিন্দু থিয়েটার’-এ অভিনীত আলমগীর নাটকের সকল চরিত্রের অভিনেতাদের অভিনয় দেখে তিনি মোহিত হয়ে যান। কারণ তিনি কখনো কল্পনাও করতে পারেননি যে সুদূর কলকাতা থেকে কয়েক’শ মাইল দূরে মফঃস্বলের একটা অজপাড়াগাঁয়ে এরূপ সুদক্ষ অভিনেতাদের আবির্ভাবে একটা সুস্থ সবল নাটক হতে পারে। শুধু তাই নয়, নাটকে ব্যবহৃত লাইট-সাউণ্ড উপযুক্ত দৃশ্যপটগুলিকে এমন সুনিপুণতার সঙ্গে সাজানো হয়েছিল যে শিশিরবাবুর বোধের অগম্য ছিল।
 হিন্দু থিয়েটারে মঞ্চস্থ কিছু বিখ্যাত নাটক:
নিমতিতা হিন্দু থিয়েটার মঞ্চে বহু বিখ্যাত বিখ্যাত নাটকের অভিনয় হয়েছে। যেমন – গিরিশচন্দ্রের ‘শঙ্করাচার্য’, ‘বিল্বমঙ্গল’, ‘চৈতন্যলীলা’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের – ‘প্রতাপসিং’, ‘সাজাহান’, ‘মেবার পতন’, ‘দুর্গাদাস’; ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের- ‘প্রতাপাদিত্য’, ‘রঘুবীর’, ‘আলিবাবা’, ‘পদ্মিনী’, ‘চাঁদবিবি’, ‘বঙ্গোরাঠোর’, ‘ভীষ্ম’, ‘রামানুজ’, ‘আলমগীর’, ‘আলিবাবা’, ‘প্রমোদরঞ্জন’, ‘পলিন’, ‘বরুণা’; অতুলকৃষ্ণ মিত্রের – ‘শিরী-ফিরহাদ’; অমৃতলাল বসুর ‘কৃপণের ধন’, ‘হরিশ্চন্দ্র’; রাজকৃষ্ণ রায়ের ‘নরমেধ যজ্ঞ’; বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসের নাট্যরূপ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিষবৃক্ষ’, ‘মৃণালিনী’ এবং ‘বিসর্জন’ ইত্যাদি।  নিমতিতার হিন্দু থিয়েটারে অভিনীত বহু নাটক নিমন্ত্রিত হয়ে অভিনয় প্রদর্শন করে গেছে কাশিমবাজার মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর বানজেটিয়া এক্সব্জিবিশনে, গেছে বুধসিংহ দুধোরিয়ার আজিমগঞ্জের বাসভবনে, গেছে রঘুনাথগঞ্জ শহরে। প্রত্যেক স্থানেই প্রতিটি নাটকের অভিনয় ও প্রতিষ্ঠা সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। মহেন্দ্রনারায়ণের অসুস্থতা ও আকস্মিক প্রয়াণ: কিছুদিন ধরেই মহেন্দ্রনারায়ণের শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। ১৩৩২ সালের প্রারম্ভেই তিনি ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে সময় কলকাতার মেডিক্যাল কলেজের পাশ করা ডাক্তার অতুলকৃষ্ণ বসু জমিদার বাড়ির গৃহ চিকিৎসক ছিলেন। আর ছিলেন নিমতিতার তখনকার ডাক্তার মহিমচন্দ্র দাস ও দুর্গাবিলাস ধর। শ্রীপতি সেনগুপ্ত নামে একজন কবিরাজও ছিলেন। তাঁরা সকলে মিলে যুক্তি পরামর্শ করে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁর চিকিৎসা করতে লাগলেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই কিছু হল না। এদিকে দিনে দিনে মহেন্দ্রনারায়ণের শরীরের অবস্থা আরও জটিল পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। সে আমলে জমিদার বাড়ির সদস্যদের মধ্যে কারো কোন জটিল ব্যাধি হয়েছে মনে করলে কিম্বা কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শের প্রয়োজন বোধ করলে কলকাতা থেকে আসতেন ডাক্তার প্রাণকৃষ্ণ আচার্য অথবা নামকরা ধন্বন্তরি কবিরাজ যামিনীভূষণ রায় মহাশয়। সুতরাং আর বিলম্ব না করে তাঁদেরকেই আনার ব্যবস্থা করা হল। সেকালে জঙ্গীপুর মহকুমার সামসেরগঞ্জ থানার মধ্যে-ই আর রেলপথে নিমতিতা নামে কোন স্টেশন ছিল না। তাই কলকাতা থেকে নিমতিতায় আসতে হলে নিমতিতার নিকটবর্তী স্টেশন সুজনিপাড়ায় নামতে হত। পরে জমিদারের পাল্কিতে বসে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে জমিদার বাড়িতে আসতে হত। সেই মতো ব্যবস্থা করে অনেক আশা নিয়ে ডাক্তারবাবুদের আনা হল। কিন্তু আশা নিরাশায় পরিণত হল। কারণ ডাক্তারবাবুরা মহেন্দ্রনারায়ণের চিকিৎসার সকল প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রায় দিলেন তাঁর ডিপ্লেরিয়া (কণ্ঠনালীর সংক্রামক রোগ বিশেষ) হয়েছে। এ রোগের কোন চিকিৎসা নেই। অবশেষে জমিদার বাড়িতে তথা নিমতিতা অঞ্চলে সেই ভারাক্রান্ত দিনটা এসে যায়। ১৩৩২ বঙ্গাব্দে ২৬শে মাঘ (ইং- ১৯২৫) শীতের রাতে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে সকলের মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে অকালেই পরলোক গমন করেন। অপ্রত্যাশিতভাবে হিন্দু থিয়েটারের প্রধান নক্ষত্র পতনটা সেদিন অনেকেই সহ্য করতে পারেননি।  নাট্যপ্রেমী, নাট্যমোদী মহেন্দ্রনারায়ণের আকস্মিক প্রয়াণের পর কলকাতার ‘নাচঘর’ পত্রিকায় মহেন্দ্রনারায়ণের সম্বন্ধে লিখেছিল “বাংলাদেশে মহেন্দ্র নারায়ণের মতো নাট্যপ্রিয় ও নাট্যশালার পরম হিতৈষী বন্ধু আর কেউ ছিল না। অনেকেই হয়তো জানেন না যে তিনি সহায় না হলে শিশির কুমার ভাদুড়ীর পক্ষে নাট্য মন্দির স্থাপন কোনদিনও সম্ভব হতো না। (‘নাচঘর’ পত্রিকা, ১৩৩২ সাল ৭ই ফাগুন সংখ্যা)।
 খেলাধূলা ও জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ:
দ্বারকানাথ চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী কলকাতায় থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজে এফ.এ. পড়তেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁর আগ্রহ ছিল খেলাধূলার প্রতি। তাই ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস এই তিনটি খেলাই তিনি নিমতিতায় প্রবর্তন করেছিলেন। এমনিতেই তিনি নিজে খুব ভালো টেনিস খেলতে পারতেন। পরবর্তীকালে পিতা দ্বারকানাথ চৌধুরীর নামে ‘দ্বারকানাথ স্মৃতি শীল্ড’ ফুটবল প্রতিযোগিতাও তিনি নিমতিতায় প্রবর্তন করেছিলেন। সে সময় কলকাতা সহ বিভিন্ন স্থানের নামকরা ফুটবল টিমের খেলোয়াড়গণ এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন। সুরেন্দ্রনারায়ণ ও মহেন্দ্রনারায়ণ এই খেলাধূলায় জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণকে যথেষ্ট সাহায্য ও উৎসাহদান করতেন।
সমাজ কার্যে জ্ঞানেন্দ্র নারায়ণ:
কলকাতায় পড়ার সময় জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ তাঁর সহপাঠীরূপে পেয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদকে এবং শিক্ষকরূপে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অকৃত্রিম সাহচর্য লাভ করে ধন্য হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আচার্যের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নিজ গ্রাম নিমতিতায় ফিরে এসে জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ জমিদারির কার্যকলাপের পাশাপাশি স্বদেশী ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখে গ্রাম উন্নয়ণে সামিল হন এবং সাথে সাথে প্রজাদের স্বার্থে স্বদেশী ভাণ্ডারও খোলেন। এছাড়া কলকাতার বিখ্যাত সংস্থা বেঙ্গল কেমিক্যালের শেয়ার কিনে শিক্ষাগুরু আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে গুরুদক্ষিণা হিসাবে অর্পণ করেন। এরপর যুক্ত হন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সঙ্গে। পরবর্তীকালে প্রজাহিতৈষণা এবং গ্রাম উন্নয়ণকল্পের নিমিত্তে সরকার কর্তৃক রায়বাহাদুর খেতাব পান। সে সময় বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র এবং ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সহপাঠী ও বন্ধু গুরুদাস সরকার মহাশয় জঙ্গীপুর মহকুমার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। গুরুদাসবাবু শিলালিপির অন্যতম আবিষ্কারক ও অনন্য সাধারণ শিল্প ইতিহাস সমালোচক ছিলেন। জঙ্গীপুর মহকুমার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন তিনি জঙ্গীপুরের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানগুলি পরিদর্শন করেন এবং সেগুলি নিয়ে বন্ধু রাখালদাসের সঙ্গে গভীরভাবে আলোচনা করতেন। রাখালদাসের পরামর্শে হোসেন সাহের সমকালীন বিভিন্ন মসজিদ গাত্রে বা অন্যান্য স্থানে আরবী ভাষায় লিখিত বহু শিলালিপির পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সেই সকল প্রবন্ধগুলি সংকলিত করে ১৩২৫ সালে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ পত্রিকায় ‘সুতীর পুরাবৃত্ত’ নামে একখানি প্রবন্ধ লেখেন।  শোনা যায়, জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী এই বিষয়ে গুরুদাসবাবুকে সে সময় যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। কারণ কলেজ জীবন থেকেই ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব বিষয়ের উপর জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর ভীষণ কৌতুহল ও আগ্রহ ছিল। তাই এরূপ একজন ঐতিহাসিক ও পুরাতত্ত্ব পণ্ডিত ব্যক্তির সাহচর্য লাভ করার সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে চাননি। এ বিষয়ে আরও শোনা যায় যে, সময়ে অসময়ে জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী নিজের গাড়ি করে গুরুদাসবাবুকে জঙ্গীপুর মহকুমার স্থান থেকে স্থানান্তরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান প্রদর্শন ও গবেষণার জন্য নিয়ে যেতেন।   পূর্বেই বলেছি জমিদার দ্বারকানাথ চৌধুরী খুব ঘটা করে কনিষ্ঠ পুত্র জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণের বিবাহ দেন। সেই বিবাহ অনুষ্ঠান উপলক্ষে জমিদার বাড়ির উৎসব আড়ম্বরের জৌলুস স্থানীয় জনমানবের মানসপটে গেঁথে গিয়ে বহুদিন পর্যন্ত সজাগ ছিল।  কাজী নজরুল ইসলামের আগমনঃ  পরবর্তী সময়ে জমিদার জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী এক কন্যা সন্তান লাভ করেন। নাম দেন রেণুকা। রেণুকার বিবাহযোগ্য বয়স হলে তাঁর বিবাহ স্থির করেন এলাহাবাদের ভূতপূর্ব এডভোকেট, কলকাতা নিবাসী যতীশচন্দ্র রায় মহাশয়ের পুত্রের সঙ্গে। কাজী নজরুল ইসলাম সেই বিবাহে বরযাত্রীদলের সঙ্গে নিমতিতা জমিদার বাড়িতে এসেছিলেন। কারণ নজরুল ইসলামের প্রতিভার সঙ্গে যতীশবাবুর বিশেষ পরিচয় ছিল। সেই সুবাদে তিনি কাজী সাহেবের অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন। নজরুল ইসলাম সে সময় বাংলার যুব মনে অবলুণ্ঠিত দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন। তাই তিনি এসেছেন জেনে যুবকরা হয়ে উঠেছিল উৎসাহিত। দলে দলে ছুটে গিয়েছিল নিমতিতা ভবনে তাঁকে চোখের দেখা দেখতে। ভাগ্যচক্রে ঐ বিবাহ সভাতেই কাজী নজরুল ইসলাম বরদাচরণের প্রথম দেখা পান। কারণ, বরদাচরণ লালগোলা থেকে এসেছিলেন কন্যাপক্ষের আমন্ত্রণে। এই শুভ মুহূর্তের সাক্ষাতের কথাই কাজী নজরুল ইসলাম বরদাচরণের ‘পথহারার পথ’ নামক পুস্তিকার ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন নিম্নলিখিতভাবে,  “নিমতিতা গ্রামে এক বিবাহ সভায় সকলেই বর দেখিতেছে, আর আমার ক্ষুধাতুর আঁখি দেখিতেছে আমার প্রলয় সুন্দর সারথীকে। সেই বিবাহ সভায় আমার বধূরূপিনী আত্মা তাহার চিরজীবনের সাথীকে বরণ করিল। অন্তঃপুরে মুহুর্মুহু শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি হইতেছে – স্রক্-চন্দনের শুচি সুরভি ভাসিয়া আসিতেছে। নহবতে সানাই বাজিতেছে। এমনি শুভক্ষণে আনন্দ বাসরে আমার যে ধ্যানের দেবতাকে পাইলাম। তিনি এই গ্রন্থগীতার উদ্‌দ্গাতা শ্রী শ্রী বরদাচরণ মজুমদার মহাশয়।”
 সত্যজিত রায়ের জলসাঘর ও নিমতিতা রাজবাড়ী :-
 সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ গল্পের চলচ্চিত্রটি রূপালী পর্দায় প্রদর্শিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রাজস্থানে অবস্থিত জয়সলমীরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সাধারণ মানুষ যেমন অন্ধকারে ছিল, ঠিক তেমনি যশোমণ্ডিত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘জলসাঘর’ সিনেমাটি রূপালী পর্দায় নিমতিতা জমিদার বাড়িটিকে রূপায়িত করেছিলেন বলে সভ্য জগতের বিদগ্ধ ব্যক্তিদের কাছে সেই সিনেমার মাধ্যমে নিমতিতা জমিদার বাড়ি প্রচারের আলো পেয়েছিল নতুনরূপে। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত নিমতিতা জমিদার বাড়ির অস্তিত্বটাই যেন সাধারণ মানুষের কাছে ছিল অজ্ঞাত।  ‘জলসাঘর’ গল্পটি লেখালেখির পশ্চাতে যে কাহিনী লুকিয়ে আছে তা হল, সে যুগের সমাজ ব্যবস্থায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় দেখেছিলেন যে, পুরাতন গ্রামীণ জমিদারি আবহাওয়া ক্রমশ শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই সেই প্রাচীন আবহাওয়াকে ধরে রাখার জন্যে প্রাচীনকালের জমিদারদের প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি ‘জলসাঘর’ গল্পটি লিখেছিলেন।  ‘জলসাঘর’ গল্পটি সত্যজিৎ রায়কে ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল। কারণ ‘জলসাঘর’ গল্পটির মধ্যে ছিল কাহিনীর বিশাল পটভূমি ও আঞ্চলিকতা, চরিত্রের মধ্যে নানা বৈচিত্র্য, ব্যক্তির মনোদ্বন্দু এবং সামাজিক পরিবেশ ও মূল্যানুমানের সঙ্গে ব্যক্তি জীবনের স্বাতন্ত্র্যের দ্বন্দ্ব, তার ওপর অতিক্রান্ত যুগের সঙ্গে চলমান যুগের সংঘাত প্রভৃতি বিষয়গুলি সত্যজিৎ রায়কে চলচ্চিত্র রূপায়ণের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। সেই মতো চিত্র গ্রহণের স্থান নির্বাচনের জন্যে সত্যজিৎ রায় প্রথমে গিয়েছিলেন লালগোলায় মহারাজা  রাও যোগীন্দ্রনারায়ণ -এর রাজবাড়িটি দেখতে।সে সময়ে লালগোলার রাজবাড়ি সুধী সমাজে নানা বিষয়ে নানা দিক থেকে সুপরিচিত ছিল। কিন্তু সেই তুলনায় নিমতিতা জমিদার বাড়িটি প্রচারের অভাবে লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে গিয়েছিল। তাই হয়তো সত্যজিৎবাবুর চিন্তাতে একবারের জন্যে ভুলেও নিমতিতা জমিদার বাড়ির কথা মনে আসেনি। যাই হোক, লালগোলার রাজবাড়ি এবং তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ শুটিং-এর ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়ের মনঃপুত হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে পুনরায় গেলেন লালগোলার কয়েক কিলোমিটার পশ্চিমে মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলিয়ানের সন্নিকটে কাঞ্চনতলার বাবু জগবন্ধু রায় -এর জমিদার বাড়িটি দেখতে। কিন্তু সেখানেও চিত্রগ্রহণের জন্যে সুস্থ পরিবেশ এবং গল্প অনুপাতে তার লোকেশন খুঁজে পেলেন না। অবশেষে নিমতিতা। নিমতিতার জমিদার বাড়িটি একনজরে দেখেই তাঁর পছন্দ হয়ে গেল। পছন্দ হওয়ার মূল কারণ ছিল দৃষ্টিনন্দন প্রকৃতির কোলে ছায়াশীতল নির্জনতার মাঝে গঙ্গার কিনারে একাকিত্বভাবে জমিদার বাড়িটির অবস্থান। এতদিন যা মনে মনে খুঁজছিলেন এইবার তার হদিশ হাতের নাগালে পেয়ে গেলেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে কালবিলম্ব না করে জমিদার বাড়ির সদস্যদের অনুমতি নিয়ে কলকাতায় ফিরে গিয়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিমতিতা জমিদার বাড়ির কথা তাঁর কাছে ব্যক্ত করতেই তারাশঙ্কর বিস্মিত হয়ে বলেন, “নিমতিতা জমিদার বাড়িকে কেন্দ্র করেই তো ‘রায়বাড়ি’ ও ‘জলসাঘর’ গল্প দু’টি লেখা। তাঁর ‘জলসাঘর’ এই জমিদার বাড়িরই জলসাঘর”। এই ‘জলসাঘরে’র ইনডোর শুটিং ও আউটডোর শুটিংয়ের কিছু কিছু ঘটনার কথা সম্বন্ধে জানা যায় দ্বারকানাথ চৌধুরীর নাতবৌ বিরাশি বছরে বৃদ্ধা বিধবা সবিতা চৌধুরীর কাছ থেকে। সময়টা ছিল ২০০৩ সাল। তাঁর স্মৃতিচারণে জানা যায় – প্রায় একমাস ধরে জলসাঘরের শুটিং-এর কাজ চলেছিল। ১৯৫৭ সালের জানুয়ারী মাস নাগাদ শুটিং-এর সাইট নির্বাচিত হয়। চিত্রগ্রহণের পর্ব শুরু হয় ১৯৫৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে। সত্যজিৎ রায় যখন শুটিং -এর জন্য নিমতিতায় এলেন, তখন তিনি জমিদার বাড়ির বাইরের বারান্দার উত্তর দিকে রায়বাহাদুরের (দ্বারকানাথ চৌধুরীর পুত্র জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী) টব ঘরে থাকতেন। দক্ষিণ দিকে মহেন্দ্রনারায়ণের (দ্বারকানাথের অপর পুত্র সবিতা দেবীর শ্বশুর) টব ঘরে থাকতেন ছবি বিশ্বাস। সবিতা দেবী আরও জানালেন ‘তখন শুটিং চলছিল। দৃশ্যটি ছিল ছবি বিশ্বাস তার ঘোড়াকে আদর করছেন। এই সটটাই তিনবার নেওয়া হয়েছিল। ফাইনাল শট নেবার পর দেখা গেল ছবি বিশ্বাস কপালের ঘাম মুছছেন। তাই দেখে দলেরই একজন ছবি বিশ্বাসকে জিজ্ঞেস করলেন কষ্ট হচ্ছে কি না। ছবি বিশ্বাস রসিকতা করে জবাব দিলেন- মাথার ঘাম পায়ে ফেলেই তো আমাদের রোজগার। সবিতা দেবী বলতে থাকেন ছবির শেষ দৃশ্যে যখন ঘোড়া থেকে পড়ে যাচ্ছেন জমিদার বিশ্বম্ভর রায়, সেটা কিন্তু ‘ডামি’ করেছিল। ছবি বিশ্বাস শটে ছিলেন না। এছাড়া ছবিতে যে জলসাঘরের ঝাড়বাতি, মজলিশ দেখানো হয় সে সব অবশ্য এখানে শুটিং নয়। এখানে দেখানো কর্ণার ঘরের দরজা খোলা হচ্ছে, একঝাঁক চামচিকে বেরিয়ে এলো। এখানে এ বাড়ির দৃশ্য কাট। এরপর স্টুডিওর সেটে জ্বলে ওঠে ঝাড়বাতি, ঝংকার তোলে বাদ্য।’ এই ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ওস্তাদ বিলায়েৎ খান সাহেব। শুধু তাই নয় – প্রথিতযশা সানাই বাদক বিস্মিল্লাহ খান সাহেব ও হিন্দুস্থানী ধ্রুপদী সঙ্গীত শিল্পী বেগম আখতার সশরীরে অভিনয় করেছিলেন এই ‘জলসাঘর’ সিনেমায়।
 সত্যজিত রায়ের দেবী সিনেমা:
১৯৫১ সালের নভেম্বর মাস থেকে সত্যজিৎ রায়ের পরবর্তী ছবি ‘দেবী’-র শুটিং হয় এই বাড়িতেই। তবে এই বাড়ির মন্দিরের আদলেই ‘দেবী’-র সেট তৈরি হয়েছিল। ‘দেবী’-র শুটিংয়ের সময় শর্মিলা ঠাকুরের জন্য সমস্ত ইমিটেশন গয়না কলকাতা থেকে আনা হলেও কানপাশা আনা হয়নি। জমিদার বাড়িতে এর জন্য খোঁজ পড়ে। সবিতাদেবী বলেন, শাশুড়ীকে (শতদুবাসিনী চৌধুরানি) গিয়ে বললাম, আপনার শর্মিষ্ঠার (শর্মিলা ঠাকুরকে মা ও নামেই ডাকতেন) কানপাশাটা দরকার। উনি তখনই সিন্দুক খুলে সেই গয়না বের করে দিলেন। শুটিংয়ে শর্মিলা যখন দৌড়তে দৌড়তে গিয়ে পড়ে যাচ্ছেন তখন পাশ থেকে তাদেরই দলের কে যেন বলে ওঠেন, ওটা আসল গয়না যেন না হারায়। তাই সদাসতর্ক ছিলেন শর্মিলা। অভিনয়ের ফাঁকে মাঝে মাঝেই শর্মিলা কানে হাত দিয়ে দেখে নিতেন সেটা যথাস্থানে আছে তো।
 সত্যজিৎ রায়ের তিনকন্যা:-  এরপর ১৯৬০ সালে তিনকন্যা ছবির শুটিং হয় এই বাড়িতেই। ১৯৫৯ এবং ১৯৬০ সালে যথাক্রমে ‘দেবী’ ও ‘তিনকন্যা’র চিত্রগ্রহণের কাজ সমাপ্ত হয়; চিত্রগ্রহণের পাশাপাশি নিমতিতা ও নিমতিতা জমিদার বাড়ির সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয় কলাকুশলীদের। তিনখানি ছবিতে অভিনয়ের জন্য আগত অভিনেতা ছবি বিশ্বাস, তুলসী লাহিড়ী, কালী সরকার, গঙ্গাপদ বসু, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর ও অপর্ণা সেন, তৎসহ তাঁদের পরিচালকও অন্যান্যদের সঙ্গে নিমতিতা ভবনেই দিনের পর দিন বাস করেছিলেন। এই সময় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর সহধর্মিনী বিজয়া রায় ও পুত্র সন্দীপ রায়ও এসেছিলেন। চিত্রগ্রহণের প্রধান ফটোগ্রাফাররা ছিলেন সুব্রত মিত্র, সহকারী কিশোর সৌমেন্দু রায় ও শিল্প নির্দেশক ছিলেন বংশী গুপ্ত। এই প্রসঙ্গে একটি বিশেষ বিষয় উল্লেখ করি, তা হ’ল – জমিদার পরিবারের সদস্যগণ যে সানন্দে ও নিঃশর্তভাবে কেবলমাত্র শুটিংয়ের জন্যেই বাড়িটি ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন তা নয়, তার সাথে সাথে নবাগত অতিথিদের ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং দলটির কাজকর্মের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কেও যথাসম্ভব পর্যবেক্ষণ করতেন। ‘জলসাঘরের’ চিত্রগ্রহণ সূত্রে পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত ঘটেছিল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও উভয় পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক সেই সৌজন্য ও মধুর সম্পর্ক আজও অক্ষুণ্ণ আছে। শুটিং পর্বে অভিনেতা-অভিনেত্রী সহায়ক শিল্পী কুশলী, হাতি-ঘোড়া, রথ, নদীর চর, কাশবন, মাটির দেবী প্রতিমা, ফোয়ারা, হাজারো রকমের টুকিটাকি জিনিস, কৌতূহলী দর্শক সব মিলিয়ে সে সময়টায় নিমতিতা জুড়ে কী এক বিরাট আলোড়ন, হৈ হৈ এলাহি ব্যাপার ছিল। এই সময়ের ঘটনা জানা যায় চৌধুরী বংশের বর্তমান বংশধর মাননীয় রবীন্দ্রনাথ চৌধুরীর প্রণীত ‘নিমতিতায় সত্যজিৎ’ গ্রন্থের মাধ্যমে। তিনি তাঁর গ্রন্থে নিমতিতা জমিদার বাড়িকে জড়িয়ে ‘জলসাঘরের’ নানান তথ্য সুপরিকল্পিতরূপে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লেখনীর মাধ্যমে প্রস্ফুটিত করেছেন। এই গ্রন্থ পাঠ করলে শতাব্দী প্রাচীন নিমতিতা জমিদার বাড়ি সম্বন্ধে এক নবচেতনার উদ্ভব হয়। যদিও সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’, ‘দেবী’ ও ‘সমাপ্তি’-র দৃশ্যকল্পে আজও মুখরিত নিমতিতা জমিদার বাড়ির সোনালি অতীত। তবুও অস্বীকার করা যায় না যে নিষ্ঠুর কাল কেড়ে নিয়েছে তার যৌবন। আজও ঘু-ঘু ডাকা নির্জন দুপুরে জরাজীর্ণ কঙ্কালসার জমিদার বাড়ির অলিন্দে দাঁড়িয়ে একাগ্রচিত্তে কান পাতলে পাঁজর বের করা দেওয়ালের দেওয়ালে এখনো যেন প্রতিধ্বনি শোনা যায়, ” অনন্ত সানাই কোথায় বাজছে রে “।  গঙ্গা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত ধুলিয়ান, নিমতিতা, অরঙ্গাবাদ প্রভৃতি গ্রামগুলি সারা বছর বানভাসি এলাকা বলে চিহ্নিত। বিশেষভাবে যখন বর্ষায় নদী হয়ে ওঠে বেগবান। সে সময় নদীর ভাঙ্গনের কোন মতিগতি থাকে না। এক লহমায় গেরস্থালির ঘর-বাড়ি, ভিটে-মাটি, গরু-বাছুর, হাঁস-মুরগি সারা বছরের মজুত করা গোলা ভরা ধান-গম-তিল-সরষে সবটুকু গ্রাস করে নেয়। সে সময় নদীর কাছে গরীব বড়লোক বলে আলাদা কিছু থাকে না। বর্ষার ভাঙ্গনে নদী চলে আসে লোকালয়ে। তার সর্বগ্রাসী ক্ষুধার তাড়নায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে হাজার হাজার গ্রামের মানুষ। চারিদিকে হাহাকার, সব হারিয়ে কান্নার রোল। যেমন হয়েছিল ১৯৩৬ সালে। সেই সময় নিমতিতার জমিদারবাবুরা লোক-লস্কর নিয়ে নৌকায় চেপে ত্রাণ সামগ্রী বন্যাপীড়িত মানুষের হাতে হাতে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া নিরাশ্রয় গৃহহীন বহু পরিবারকে তাদের এলাকার মধ্যে আশ্রয়ও দিয়েছিলেন। এরপর আসে ১৯৪৩ সালের সেই ভয়ঙ্কর ভাঙ্গন। নদী ভাঙতে ভাঙতে একেবারে চলে আসে জমিদার বাড়ির পাদদেশে। সেই ভয়াবহ বন্যা আর ভাঙ্গনে এসে একে একে তলিয়ে নিয়ে যায় জমিদার বাড়ির সাধের ‘হিন্দু থিয়েটার’ প্রেক্ষাগৃহ, অতিথিশালা, ফুলবাগান, ঠাকুরদালান, টেনিস কোর্ট, ফুটবল মাঠ, নিমতিতা গৌরসুন্দর দ্বারকানাথ ইন্সটিটিউশন, ব্রজগোপী বালিকা বিদ্যালয়, পোষ্ট অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস। এছাড়া সেই বন্যায় তিনটি ঘাটের বিশাল অংশ বিলীন হয়ে মাঠের মতো হয়ে যায়। পরবর্তীকালে মুর্শিদাবাদ জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম বি.এস.এফ. ক্যাম্পটি জমিদার বাড়ির দান করা ঐ জমিতেই গড়ে ওঠে। এমন কি ‘নিমতিতা রেল স্টেশন’-টিও নিমতিতা জমিদারবাবুদের দান করা জমিতেই গড়ে ওঠে।  পরবর্তী সময়ে নিমতিতা জমিদারির এলাকার মধ্যে তাঁদের দান করা জায়গায় গৌরসুন্দর দ্বারকানাথ ইন্সটিটিউশন, পোষ্ট অফিস, রেজেস্ট্রি অফিস নতুন করে নতুন জায়গায় গড়া হলেও ব্রজগোপী বালিকা বিদ্যালয় আর গড়া হয়নি। এরপর ১৩৫৩ সালের ২৬শে মাঘ, জমিদারবাবুদের দান করা ৮ শতক জায়গার উপর মহেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর স্মৃতি রক্ষার্থে গড়ে ওঠে ‘নিমতিতা মহেন্দ্রনারায়ণ স্মৃতি পাঠাগার’। ১৯৬৩-৬৪ সালে জমিদার বাড়ির সদস্যগণ ও স্থানীয় মানুষের সক্রিয় সহযোগিতায় পাঠকের সুবিধার্থে পাঠাগারে আরও তিনটি ঘর তৈরি হয়। পরে রাজ্য সরকার এই পাঠাগারটিকে গ্রামীণ পাঠাগার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে অধিগ্রহণ করেন।
সর্বশেষে জানাই,  সালে মুর্শিদাবাদ জেলা ইতিহাস ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সার্ভের নিরিখে ২০২২ সালের ১ লা জুন নিমতিতা রাজবাড়ী হেরিটেজ স্বীকৃতি পায়।
গ্রন্থপঞ্জী :-
—————-
১) মুর্শিদাবাদ কথা, শ্রীশ চট্টোপাধ্যায়।
২) নলিনীকান্ত সরকার – আসা যাওয়ার মাঝখানে।
৩) অমরনাথ রায় যোগীবর বরদাচরণ।
৪) কাজী আমিনুল ইসলাম – মুর্শিদাবাদের ইতিহাস: জঙ্গিপুর
৫) নিমতিতা জমিদার বাড়ির ইতিকথা, আশীষ কুমার মন্ডল,মুর্শিদাবাদ অনুসন্ধান, পঞ্চম খন্ড,সম্পাদনা – অরিন্দম রায়।
৬) ‘গণকণ্ঠ’ – বিষয় মুর্শিদাবাদ, বিশেষ সংখ্যা
৭) ‘ঝড়’ সাহিত্যপত্র – বিষয় মুর্শিদাবাদ: ফেব্রুয়ারী – ২০০৪।
৮) ‘ঝড়’ সাহিত্যপত্র – বিষয় মুর্শিদাবাদ: সেপ্টেম্বর-২০০৪।

Author

  • Suman Kumar Mitra

    Suman Kumar Mitra is a Researcher at Murshidabad Zilla Itihas & Sanskriti Charcha Kendra. He did his MA in Bengali from Rabindra Bharati University and is a Guest Lecturer at D.I.E.T Murshidabad, Berhampur, West Bengal. Views expressed are personal.

    View all posts

(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)