ড. প্রবাল রায় চৌধুরী ও শৌনক রায় চৌধুরী
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি আসলে কী?
গত ১১ ডিসেম্বর ২০১৯, ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় ১২৫/১০৫ ভোটে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল, সংক্ষেপে সিএবি) পাশ হয়। এর পরে মহামহিম রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দ বিলটিতে অনুমতিসূচক স্বাক্ষর করায় সেটি এখন আইনে (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ২০১৯ সংক্ষেপে সিএএ) পরিণত হয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা সেটিকে ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ২০১৯’ নামেই অভিহিত করব। প্রথমে দেখা যাক, এটি আসলে কী এবং এটি কাদের জন্য।
এই ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ২০১৯’, ১৯৫৫ সালে চালু হওয়া ভারতের নাগরিকত্ব বিধির একটি সংশোধনী। এই সংশোধনীর বলে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হওয়া হিন্দু–বৌদ্ধ–জৈন–শিখ–খ্রিস্টান–পারসি, এই ছয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উদ্বাস্তু মানুষরা ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। এই সুবিধা কেবল তাঁরাই পাবেন, যাঁরা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে এসেছেন। অন্তত ছয় বছর ভারতে স্থায়ী বসবাস করলে তাঁরা ভারতের নাগরিক হতে পারবেন।
এখন প্রশ্ন হতে পারে যে এই সংশোধনীর আদৌ কোনও প্রয়োজন ছিল কিনা। এই প্রবন্ধে আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এগুলো বিচার করবো। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ২০১৯ সম্পর্কে জানতে গেলে আগে আমাদের ১৯৫৫ সালে ভারতীয় সংসদে পাশ হওয়া নাগরিকত্ব বিধি1 সম্পর্কে অবগত হতে হবে। ১৯৫৫ সালে পাশ হওয়া নাগরিকত্ব বিধিতে স্বাধীন ভারতের নাগরিক হতে গেলে কী যোগ্যতার প্রয়োজন তা সবিস্তারে বলা হয়েছে। এই বিধি অনুযায়ী নাগরিকত্ব পাবার দুটি উপায়: ১) জন্মসূত্রে নাগরিক, ও ২) উত্তরাধিকারসূত্রে নাগরিক।
১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান চালু হয়। নাগরিকত্ব বিধি ১৯৫৫ অনুযায়ী, এরপর থেকে ৩০ জুন ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ভারতে জন্মানো সকলেই জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক। এক্ষেত্রে তাঁদের বাবা–মা ভারতের নাগরিক না হলেও হবে। আবার ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি পাশ হবার আগে পর্যন্ত ভারতে জন্মানো যে কেউ ভারতের নাগরিক হবেন, যদি তাঁর জন্মের সময়ে তাঁর বাবা ও মায়ের মধ্যে কোনও একজন ভারতের নাগরিক হন। ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ২০০৩’ পাশ হওয়ার পর থেকে জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবার প্রক্রিয়া কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়। তখন থেকে আর ভারতে জন্মানো যে–কেউ ভারতের নাগরিক হতে পারবেন না। তাঁকে ভারতের নাগরিক হতে গেলে, তাঁর বাবা ও মায়ের মধ্যে যে কোনও একজনকে ভারতের নাগরিক হতে হবে; কিন্তু বাবা বা মায়ের মধ্যে কেউ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হলে চলবে না।
এরপরের আলোচ্য বিষয় হল, কীভাবে উত্তরাধিকারসূত্রে ভারতের নাগরিক হওয়া যায়। ভারতের বাইরে জন্মানো যে–কেউ ভারতের নাগরিক হবেন, যদি ২৬ ডিসেম্বর ১৯৫০ সাল থেকে ১০ ডিসেম্বর ১৯৯২–এর মধ্যে তাঁর জন্ম হয়ে থাকে এবং তাঁর জন্মের সময়ে তাঁর বাবা ভারতের নাগরিক হয়ে থাকেন। ১০ ডিসেম্বর ১৯৯২ বা তারপরে ভারতের বাইরে জন্মানো কোনও শিশুর বাবা–মায়ের যে কেউ শিশুটির জন্মের সময়ে ভারতের নাগরিক হলেই শিশুটিও ভারতীয় নাগরিক হবে। এছাড়াও নিবন্ধনের (রেজিস্ট্রেশন) এবং প্রাকৃতিকীকরণের (ন্যাচারালাইজেশন) মাধ্যমেও ভারতের নাগরিক হওয়া সম্ভব। ভারতীয় উৎসের কোনও ব্যক্তি নিবন্ধনের মাধ্যমে ভারতের নাগরিক হতে পারেন। আবার ভারতের নাগরিক যদি অভারতীয় কাউকে বিয়ে করেন, এবং সেই স্বামী/স্ত্রী যদি ভারতে টানা সাত বছর বসবাস করেন, তাহলে তিনিও নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
এই ‘নাগরিকত্ব বিধি ১৯৫৫’ হল ভারতের নাগরিকত্ব পাবার বিষয়ে মূল বিধি। এ পর্যন্ত এটি পাঁচ বার সংশোধিত হয়েছে: ১৯৮৬, ১৯৯২, ২০০৩, ২০০৫ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালে। আমরা একে একে আগের সংশোধনীগুলির বিষয়ে আলোচনা করে নেবো। শেষে বিস্তারিতভাবে ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ২০১৯’ নিয়ে আলোচনা করবো। ১৯৮৬ সালে প্রথমবারের জন্য ‘নাগরিকত্ব বিধি ১৯৫৫’ সংশোধিত হয়। তার আগে পর্যন্ত ভারতভূমিতে জন্মগ্রহণ করা প্রতিটি শিশুই ভারতের নাগরিকত্ব পেত। অর্থাৎ ভারতের কোনও হাসপাতালে কোন শিশুর জন্ম হলেই সে ভারতের নাগরিক হয়ে যেত। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সময়ে, প্রথমবারের জন্য এই বিধি সংশোধন করে নবজাত শিশুসন্তানের নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে তার বাবা–মায়ের মধ্যে একজনকে ভারতের নাগরিক হতেই হবে, এই নিয়ম চালু করা হয়।
এরপরে নাগরিকত্ব বিধি আবার সংশোধিত হয় ১৯৯২ সালে2। এই সংশোধন অনুযায়ী ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০–এর পরে, কিন্তু ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ১৯৯২’ চালু হবার আগে, ভারতভূমির বাইরে জন্মগ্রহণ করা কোনও শিশু ভারতের নাগরিকত্ব পাবে, যদি তার বাবা তার জন্মসময়ে ভারতের নাগরিক হন। এই বিধি চালু হবার পরে ভারতভূমির বাইরে জন্মানো কোনও শিশুকে ভারতের নাগরিক হতে হলে, তার বাবা–মায়ের মধ্যে যে কোনও একজনকে তার জন্মসময়ে ভারতের নাগরিক হতে হবে। তবে শিশুটির জন্মের সংবাদ তার জন্মের এক বছরের মধ্যে ভারতীয় দূতাবাসে জানিয়ে নিবন্ধীকরণ করতে হবে।
এর পরে ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে ‘নাগরিকত্ব বিধি ১৯৫৫’ আবার সংশোধিত হয়। এইবারের সংশোধনী3 অনুযায়ী ১ জুলাই ১৯৮৭ সালের আগে ভারতে জন্মানো সবাই জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিক হবেন। ১ জুলাই ১৯৮৭ থেকে ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ২০০৩’ চালু হবার আগে পর্যন্ত ভারতে জন্মানো কারোর বাবা–মা তার জন্মসময়ে ভারতের নাগরিক হলেই সেও ভারতের নাগরিক হবে। কিন্তু এরপর থেকে ভারতে জন্মানো কাউকে ভারতের নাগরিক হতে গেলে তার জন্মসময়ে তার বাবা–মায়ের মধ্যে একজনকে ভারতের নাগরিক হতে হবে, কিন্তু অন্য জন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হলে চলবে না।
এর পরে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে সংযুক্ত প্রগতিশীল জোটের (ইউপিএ) শাসনকালে ‘নাগরিকত্ব বিধি ১৯৫৫’ পুনরায় সংশোধিত হয়। এই সংশোধনীর4 বলে ভারতীয় উৎসের নাগরিকরা ভারতের ‘ওভারসীজ নাগরিক’ হতে পারবেন, যদি তিনি ভারতীয় সংবিধান চালু হবার সময়ে ভারতের নাগরিক হয়ে থাকেন, বা ভারতের নাগরিক হবার যোগ্য হন, কিংবা ১৫ আগস্ট ১৯৪৭–এর পরে ভারতের অঙ্গীভূত অঞ্চলের অধিবাসী হন। এই সব ব্যক্তিদের সন্তান–সন্ততিরাও ভারতের ‘ওভারসীজ নাগরিক’ হতে পারবেন। তবে পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আরও যে সব দেশের নাম ভারত সরকার ঘোষণা করবে, সেই সব দেশের নাগরিকরা ভারতের ‘ওভারসীজ নাগরিক’ হবার জন্য আবেদন করতে পারবেন না। এর ফলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বাদে ভারতীয় উৎসের সব নাগরিক ভারতের ‘ওভারসীজ নাগরিক’ হবার জন্য আবেদন করতে পারবেন। এই ‘ওভারসীজ নাগরিক’–রা ভারতে এই বিধি চালু হবার পর থেকে দু’বছরের জায়গায় টানা এক বছর ভারতে থাকলেই ভারতের নাগরিক হতে পারবেন।
‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ২০১৯’–এর ইতিহাস
এরপর আসি এখনও পর্যন্ত সর্বশেষ সংশোধনী—‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ২০১৯’ প্রসঙ্গে। এই বিধি বিষয়ে আলোচনার আগে এর পূর্বসূরী ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬’–র বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট বিপুল সংখ্যাধিক্যে লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে। জোটের প্রধান শরিক ভারতীয় জনতা পার্টি একাই ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ২৮২টি আসন লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, যা এর আগের সাতটি লোকসভা নির্বাচনে দেখা যায়নি। শেষবার রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল। ঐ নির্বাচনে তারা লোকসভায় ৫৪১টি আসনের মধ্যে ৪১৪টি আসন লাভ করে, যা এখনও পর্যন্ত লোকসভায় কোনও দলের পাওয়া সর্বাধিক আসন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী এবং গুজরাত প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের, যাঁরা নিজেদের দেশে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে পড়ছেন আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, খ্রিস্টান ও পারসি ধর্মাবলম্বী মানুষরা। নির্বাচনে জয়ের দু’বছর পরেই ২০১৬ সালে জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট সরকার লোকসভায় ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ২০১৬’ পেশ করে। লোকসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এই বিধি পাশ হলেও ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় সরকারপক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় তা আর পাশ করানো সম্ভব হয় না, বরং বিরোধীদের দাবিতে (রাজ্যসভায় তখন তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল) বিলটিকে আলোচনার জন্য সিলেকশন কমিটিতে পাঠানো হয়। সেই সময়ে সরকার আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদান করার সুবিধার্থে একটি ‘অধ্যাদেশ’5 জারি করে। যদিও ছয় মাস পরে নিয়ম অনুসারে তার কার্যকাল শেষ হয়ে যাওয়ায় সেই অধ্যাদেশটি শরণার্থীদের জন্য বিশেষ সুবিধা এনে দিতে সক্ষম হয়নি।
ইতি মধ্যে, ১৯৮৫ সালের অসম চুক্তি অনুসারে অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) কাজ শুরু হয়। এই নাগরিকপঞ্জিতে ভারতীয় এবং আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আগত ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হওয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেরই নাম ওঠেনি। এই নাগরিকপঞ্জির কাজে অনেক বিভ্রান্তি ঘটে, তার জন্য বর্তমানে ভারত সরকার এটাকে বাতিল ঘোষণা করেছে। আপাতত গোটা দেশের সঙ্গে অসমেও পুনরায় জাতীয় নাগরিকপঞ্জির কাজ হবে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছেন।
২০১৬–তে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সরকারপক্ষ পাশ করাতে অসমর্থ হয়। এর পরবর্তীতে অসমে নাগরিকপঞ্জিতে অনেক হিন্দুরই নাম বাদ যায়। এর পরে আসে ২০১৯–এর লোকসভা নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট আবারও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। জোটের প্রধান শরিক ভারতীয় জনতা পার্টি এককভাবে ৩০৩টি আসন পায়। ইতি মধ্যে গত পাঁচ বছরে দেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি ও তার সহযোগী দলগুলো ভাল ফল করায় রাজ্যসভায় জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটের শক্তি বৃদ্ধি পায়। নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন ভারতীয় জনতা পার্টির অধ্যক্ষ অমিত শাহ। এরপর থেকেই লক্ষ্য করা যায়, বহুবছর আটকে থাকা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের একের পর এক মহতী সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া। যেমন, জম্মু ও কাশ্মীর থেকে সংবিধানের ৩৭০ ধারার বিলোপ ঘটানো, লোকসভায় অ্যাংলো–ইন্ডিয়ানদের জন্য সংরক্ষিত আসন বাতিল করা ইত্যাদি। অন্য বিষয়ের মতোই আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়েও সরকার দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়। ৯ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৯’ পেশ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। লোকসভায় এই বিল পেশ করার জন্য আগেই ভোটাভুটি করতে হয়, যা ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে বিরল। সরকারপক্ষের বিপুল সংখ্যাধিক্যের জোরে বিলটি পেশ হয় এবং দীর্ঘ উত্তপ্ত আলোচনার পরে ৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে সেটি পাশও হয়ে যায়। এরপর ১১ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিলটি পেশ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বিলটির উপরে অনেক সাংসদই বক্তব্য রাখেন। প্রথানুসারে সবার শেষে উত্তর দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। রাজ্যসভায় তাঁর দীর্ঘ বক্তব্য ইতিহাস হয়ে থাকবে। দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার আলোচনা ও তীব্র বাদানুবাদের শেষে বিলটি ভোটাভুটিতে যায়। বিরোধীরা বিলটিতে একাধিক সংশোধনী আনার প্রস্তাব দেয়, যদিও ভোটে তা বাতিল হয়ে যায়। শেষমেশ ১২৫/১০৫ ভোটে বিলটি পাশ হয়ে যায়। এরপর সেদিন রাতেই বিলটিতে সই করেন মাননীয় রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। এরপরেই বিলটি বিধিতে পরিণত হয়। শুরু হয় স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়।
নাগরিকত্ব বিধির সংশোধন কি প্রয়োজনীয় ছিল?
এই সংশোধনী বিধি পেশ করার সময় থেকে অনেকেই বলছেন যে আদৌ এটার কোন প্রয়োজন ছিল না। এই বিধি অনুসারে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে ভারতে চলে আসা শরণার্থীরা ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য যোগ্য হবেন যদি তাঁরা অবিচ্ছিন্নরূপে ছয় বছর ভারতে স্থায়ী বসবাসের প্রমাণ দেখাতে পারেন। কোনও পরিচয়পত্র না থাকলে, তাঁদের প্রতিবেশী ভারতের দুজন নাগরিকের বিবৃতি দেখাতে পারলে তাও তাঁদের ভারতে বসবাসের প্রমাণস্বরূপ গৃহীত হবে।
এই বিধি কার্যকর হওয়ার সময় অসমে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি অনেক শরণার্থী মুক্তি পাবেন এবং তাঁরা সসম্মানে ভারতের নাগরিক হতে পারবেন। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে আগত ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হওয়া অনেক বাঙালী হিন্দু, যাঁরা বর্তমানে অবৈধভাবে পশ্চিমবঙ্গের যত্রতত্র বসবাস করছেন, তাঁরা এবার সসম্মানে ভারতীয় নাগরিক হবার অধিকার পেলেন।
দেশভাগ ও ভারতের স্বাধীনতা
‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ২০১৯’–এর আলোচনা প্রসঙ্গে বারবার আসে দেশভাগের কথা। প্রকৃতপক্ষে দেশভাগ না হয়ে ‘অখণ্ড ভারতবর্ষ’ একটি দেশ হয়ে স্বাধীনতা পেলে এই সব কিছুর প্রসঙ্গই আসত না। ১৯৪৭–এর ১৪ আগস্ট মধ্যরাত্রে ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে স্বাধীনতা পায়। দেশের পশ্চিমাংশ এবং পূ্র্বাংশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে তৈরি হয় মুসলিমদের নিজস্ব দেশ—পাকিস্তান। স্বাধীনতার পরে পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র রূপে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীকালে ১৯৭১–এর ১৬ ডিসেম্বর ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নামক আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থাকলেও, পরে জেনারেল হুসেইন মহম্মদ এরশাদের শাসনকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হয়, এবং বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা স্বভাবতঃই হয়ে পড়েন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্র বরাবরই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন করে গেছে। প্রতি বছরেই নিয়ম করে এরকম নির্যাতন হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটা বড় ঘটনার উল্লেখ করা যাক। ১৯৪৬–এর ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগ পাকিস্তানের দাবিতে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দিয়েছিল। এর ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটেছিল সাম্প্রদায়িক হানাহানি। অধুনা বাঙালী হয়তো ছেচল্লিশের দাঙ্গা বা ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’–এর রক্তাক্ত স্মৃতি থেকে বিস্মৃত। যে জাতি অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রক্রিয়াকে স্তব্ধ করে দেয়, তাদের ভবিষ্যৎ নিঃসন্দেহে কঠিন ও দুর্গম হয়ে ওঠে। দেশভাগ হয়ে ভারত স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু হিন্দুর ভারতীয় পঞ্জাবে আসা শুরু হয়ে যায়। এর বিস্তারিত বিবরণ অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায়, কিন্তু শিরোমণি গুরুদ্বার প্রবন্ধক কমিটি প্রকাশিত সর্দার গুরুচরণ সিংহ তালিব লিখিত ‘মুসলিম লীগ অ্যাটাক অন শিখস অ্যান্ড হিন্দুজ ইন দ্য পঞ্জাব ১৯৪৭’ বইটির উল্লেখ না করলেই নয়। পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতন বন্ধে ১৯৫০ সালের ৮ এপ্রিল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলি খানের মধ্যে ‘নেহরু–লিয়াকৎ চুক্তি’ সম্পাদিত হয়। যদিও এই চুক্তি অনুযায়ী উভয় দেশের সরকার নিজের নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য দায়ী থাকল, তবুও পাকিস্তানে হিন্দু–নির্যাতন চলতেই থাকল। দেশভাগের প্রাক্কালে মহম্মদ আলি জিন্না এবং ভীমরাও আম্বেদকর দুই দেশের মধ্যে জনবিনিময় করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন যেহেতু পাকিস্তান কেবল মুসলিমদের জন্যই তৈরি হচ্ছে, তাই অখণ্ড ভারতবর্ষের সব মুসলিমের পাকিস্তানে চলে যাওয়া উচিত এবং পাকিস্তানের সব হিন্দুর ভারতে এসে বসবাস আরম্ভ করা উচিত। কিন্তু জহরলাল নেহরু ও তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বের অদূরদর্শিতায় তা আর বাস্তবায়িত হয় না। ভারতের (প্রায়) সব মুসলমান ভারতেই রয়ে যায়, কিন্তু পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে হিন্দু উদ্বাস্তুদের আগমন ভারতে অব্যাহত থাকে। ১৯৫০–এও পূর্ব পাকিস্তানে (অধুনা বাংলাদেশ) ভয়াবহ হিন্দু গণহত্যা অনুষ্ঠিত হয়। তারপর ১৯৬৪ সালে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর প্রদেশের শ্রীনগরে অবস্থিত হজরতবাল মসজিদ থেকে হজরত মহম্মদের পবিত্র কেশ অপহরণের গুজব ছড়িয়ে গোটা পাকিস্তান জুড়ে বীভৎস হিন্দু হত্যা করা হয়। এরপর ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনতা থেকে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তখন এক কোটিরও উপরে শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে (মূলত পশ্চিমবঙ্গ, অসম এবং ত্রিপুরায়) আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের ভাড়াটে রাজাকার, আল বদর প্রমুখ বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নৃশংস গণহত্যা চালায়। এতে কমপক্ষে ত্রিশ লক্ষ অসামরিক মানুষের নিধন হয়। এদের সিংহভাগ ছিলেন হিন্দু। পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দুর সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার সরকারি প্রচেষ্টার অংশ ছিল এই গণহত্যা। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাহসী হস্তক্ষেপে ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করে এবং যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে তারা। স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশে কিন্তু হিন্দু নির্যাতন বন্ধ হয়নি। স্বাধীনতা লাভের পরের কয়েক বছর বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থাকলেও জেনারেল হুসেইন মহম্মদ এরশাদের সময়ে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা হয়ে যান দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক এবং তাঁদের উপর নানা রকম জোর–জুলুম, অত্যাচার–নিপীড়ন চলতে থাকে। এরপর ১৯৯০–এ অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার গুজব ছড়িয়ে এবং আবার ১৯৯২–এ বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিশোধ নিতে বাংলাদেশে শত শত হিন্দুর উপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হয়। বহু হিন্দুকেই দেশত্যাগী হয়ে ভারতে শরণার্থীরূপে আশ্রয় নিতে হয়। এর মর্মস্পর্শী বিবরণ পাওয়া যায় তসলিমা নাসরিনের লেখা ‘লজ্জা’ উপন্যাসে। উল্লেখ্য যে, এই উপন্যাস লেখার অপরাধে স্বয়ং লেখিকা তসলিমা নাসরিনকেই বাংলাদেশের ধর্মান্ধ মুসলিমদের রোষের শিকার হতে হয়। তিনি দেশত্যাগী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর ২০০১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি–জামাত জোটের বিপুল জয়ের পরে সারা দেশ জুড়ে জয়ী পক্ষ বেছে বেছে হিন্দুদের উপরে অমানবিক নিপীড়ন আরম্ভ করে। এসমস্ত হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ প্রভৃতি নির্মমতার বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে সালাম আজাদের লেখা ‘রক্তের অক্ষর’ এবং হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বইদুটিতে। এই সময়েও বহু হিন্দু দেশত্যাগী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের গবেষণা ‘বাংলাদেশে কৃষি–ভূমি–জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ অনুসারে ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মোট এক কোটি তেরো লক্ষ হিন্দু বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এই গবেষণা অনুসারে গড়ে প্রতিদিন ছশো বত্রিশ জন হিন্দু বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী তিন দশক পরে বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য হয়ে যাবে। পাকিস্তানের কথায় আর নাই বা গেলাম।
ছিন্নমূল উদ্বাস্তুরা কোথায় যাবেন?
স্বভাবতঃই প্রশ্ন আসে যে, যেসব উদ্বাস্তুরা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে ভারতে চলে এসেছেন বা আসছেন, তাঁদের প্রতি ভারত সরকারের কোনও দায়দায়িত্ব আছে কিনা। এঁরা সবাই তো অখণ্ড ভারতের সন্তান; ১৯৪৬–এ অখণ্ড ভারতের শেষ নির্বাচন, যাতে মুসলিম লীগ মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র দেশ পাকিস্তানের দাবিকেই মুখ্য করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, তাতে তাঁরা কেউই পাকিস্তানের পক্ষে মতামতপ্রকাশ করেননি। পাকিস্তান মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র রূপে সৃষ্ট হওয়ায় ভারত স্বভাবতঃই অমুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তাই এই সব মানুষ এবং তাঁদের সন্তান–সন্ততিদের প্রতি ভারত সরকার দায় এড়াতে পারে না। এঁদের নাগরিকত্ব কোনও দয়ার দান নয়, তাঁদের প্রাপ্য অধিকারই তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া।
অসমে ডিটেনশন ক্যাম্পে অনেক উদ্বাস্তু হিন্দু বিদেশী ঘোষিত হয়ে আটক রয়েছেন। ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ২০১৯’–এর ফলে তাঁদের মুক্তি পাবার পথ সুগম হবে। ২০১৪ সালে নির্বাচনী প্রচারের সময়ে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, যে তিনি ক্ষমতায় এলে ডিটেনশন ক্যাম্প বন্ধ করে দেবেন।
‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৯’ পেশ করতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন যে, নাগরিকত্ব বিধির এই সংশোধন পাশ করতেই হবে, কারণ ১৯৪৭–এ কংগ্রেস দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ করেছিল। ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে অপ্রিয় সত্য হওয়ায় তাঁরা এটা এড়িয়ে যান। কিন্তু তিক্ত সত্য এই যে, দেশভাগ মেনেই ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামকারী বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের পবিত্র জন্মভূমি চট্টগ্রামে আজ আর স্বাধীন ভারতের অশোকচক্র–সম্বলিত ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা ওড়ে না; বিপ্লবী ভগৎ সিংহের পুণ্য জন্মভূমি লাহোর, কিংবা গুরু নানক দেবের পবিত্র জন্মস্থান, বা হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মভূমির অনেকগুলোই আজ ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের ফলে স্বাধীন ভারতের বাইরে।
বিরোধিতার কারণ
‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ২০১৯’–এর বিরোধিতা কেন—এই প্রশ্নের উত্তর অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। বিরোধী নেতানেত্রীদের মত যে, এই বিলে ভারতীয় মুসলিমদের বঞ্চনা করা হয়েছে। তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে, এই সংশোধনী বিধি কেবল আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আগত ধর্মীয় সংখ্যালঘু শরণার্থীদের জন্যই প্রযোজ্য। ভারতের নাগরিকদের জন্য এই সংশোধনী বিধি আদৌ প্রযোজ্য নয়। কোনও ভারতবাসীর নাগরিকত্ব নিয়ে এই সংশোধনী বিধিটিতে কোনও কথাই বলা হয়নি। আরও উল্লেখ্য যে এই বিধিতে কারোর নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার কোনও কথাই নেই, শুধু ভারতের প্রতিবেশী তিন দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু, যাঁরা ইতিমধ্যেই নিপীড়নের শিকার হয়ে ভারতে উদ্বাস্তুর জীবন কাটাচ্ছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
তা সত্ত্বেও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি, গণমাধ্যম, স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী প্রমুখরা বিরোধিতা করেই চলেছেন। তাঁদের অনেকের দাবি যে, এতে ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা লঙ্ঘিত হচ্ছে। সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী, ভারতের কোনও বিধি ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য করতে পারে না। যেহেতু ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ২০১৯’ ভারতীয় নাগরিকদের জন্য আদৌ প্রযোজ্য নয়, তাই এক্ষেত্রে বৈষম্যের কথাই আসে না। এই বিধি পাশ হবার পরেই ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ এবং অন্যান্য সংগঠনের পক্ষ থেকে পৃথক পৃথকভাবে ভারতের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ে এই বিধির বিপক্ষে পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু মহামান্য সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় ভারতীয় সংসদ অনুমোদিত ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ২০১৯’–এর উপরে আজ পর্যন্ত কোনও স্থগিতাদেশ দেননি। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে সংসদের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। এই বিধি সংসদের উভয় কক্ষে ভোটাভুটির মাধ্যমে পাশ হয়েছে। তাই এই নিয়ে সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে উত্তেজিত করা গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে বিপজ্জনক। অসম সহ দেশের সব রাজ্যেই, এমনকি বিদেশেও নাগরিকত্ব বিধির সপক্ষে মানুষের সমর্থন প্রত্যক্ষ। রাজনৈতিক জনসভা ছাড়াও আপামর সাধারণ মানুষ এই বিধির সপক্ষে নিজেদের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
বিরোধিতায় দেশজুড়ে তাণ্ডব, আরক্ষাবাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি পাশ হবার পর থেকেই রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষ এর প্রতিবাদে নেমে পড়েন। রাজ্যসভায় বিলের উপরে আলোচনা প্রসঙ্গে কংগ্রেস সদস্য কপিল সিবাল মন্তব্য করেন যে, ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ২০১৯’ পাশ হলে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের দ্বিজাতি তত্ত্ব বৈধতা পাবে। কপিল সিবালের এই দাবি যে মিথ্যা তা নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন প্রবাসী ভারতীয় শ্রী বিপ্লব পাল6। জিন্না ও সাভারকরের দ্বিজাতি তত্ত্ব শুধু নামেই এক, ধারণা হিসেবে একেবারেই আলাদা। সাভারকরের দ্বিজাতিতত্ত্বে কোথাও দেশভাগের উল্লেখমাত্র নেই।
বিলটিতে মহামহিম রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পরপর শুক্রবার ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯ দুপুরবেলা থেকেই শুরু হয়ে যায় পরিকল্পিত বিক্ষোভ, সরকারি সম্পত্তির ধ্বংস, ট্রেনে পাথর ছোঁড়া, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি। এখানে বিস্তারিত না লিখে শুধু কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যাক। শুক্রবার ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯ হাওড়া থেকে ছাড়া করমণ্ডল এক্সপ্রেসে পাথর ছোঁড়া হয়। যাত্রীদের জোর করে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা স্টেশনে ভাঙচুর চালানো হয়, টিকিট বুকিং কাউন্টারের চারটে কম্প্যুটার লুট করা হয়। শুক্রবার থেকে টানা চারদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর দিনাজপুর জেলাগুলোর বিস্তীর্ণ অংশে সংগঠিত দুষ্কৃতী তাণ্ডব চলে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার শেষমেশ শান্তি রক্ষার্থে মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয় কয়েকটা জেলার বিভিন্ন ব্লকে। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও দিল্লী, উত্তরপ্রদেশ সহ আরও বেশ কয়েকটা রাজ্যে সংগঠিত তাণ্ডব চলে। শেষমেশ আরক্ষাবাহিনীর কঠোর পদক্ষেপের ফলে তাণ্ডব বন্ধ হয়। উত্তরপ্রদেশের আরক্ষাবাহিনী চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত নিয়ে তাণ্ডবকারীদের চিহ্নিত করে তাদের হাতে ক্ষতিপূরণের নোটিশ ধরাতে আরমভ করে।
উপসংহার
প্রতিবাদের যে হুজুগ উঠেছে দেশ জুড়ে, তার কোনও সারবত্তা নেই। অধিকাংশ মানুষই বিলটি সম্পর্কে না জেনে বা না বুঝেই এই হুজুগে মেতেছেন। তাতে আখেরে ক্ষতি হচ্ছে আমাদের এই দেশেরই। ১৯৫৫ সাল থেকে দফায় দফায় বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে যে সমস্যার সমাধান অন্বেষণ করেছেন আমাদের দেশের পূর্ববর্তী সাংসদরা, তারই একটি চিরস্থায়ী সমাধান হয়তো স্বাধীনতার এত বছর পরে পাওয়া গেছে। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের উচিত প্রথমে এই বিল সম্পর্কে যা রটানো হচ্ছে, তার সত্যাসত্য অনুসন্ধান করা এবং আপন বিবেচনায় বিলটির পক্ষে দাঁড়ানো।
স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে আমাদের পূর্বপুরুষরা যে অদূরদর্শিতার যে পরিচয় স্থাপন করে গেছেন, তার প্রায়শ্চিত্ত এভাবেই ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি ২০১৯’ দিয়ে শুরু হোক।
Reference:
1https://indiacode.nic.in/bitstream/123456789/4210/1/Citizenship_Act_1955.pdf
2http://eudo-citizenship.eu/NationalDB/docs/05_INDI_Citizenship%20Amendment%20Act%201992.pdf
3https://indiankanoon.org/doc/949775/
4http://164.100.47.4/billstexts/rsbilltexts/AsIntroduced/LXXV_2005.pdf
5অধ্যাদেশ হল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার পরামর্শে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারি হওয়া অস্থায়ী বিধি। সংসদ চালু না থাকলেই কেবল এটা জারি করা যায়। অধ্যাদেশ জারি হবার ছয় মাসের মধ্যে সংসদের অধিবেশন ডেকে তা পাশ করাতে হয়, নচেৎ তা আর বলবৎ থাকে না।
6https://www.bangodesh.com/2019/12/two-nation-theory-01/