Dr. Syama Prasad Mookerjee Research Foundation

ওয়াকাফ বিল ২০২৫, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে কেন জরুরি

এলাহাবাদ হাইকোর্টের ভিতরে দীর্ঘদিন ধরে একটি মসজিদ ছিল। মুসলমান উকিলরা এখানে নামাজ পড়তেন। কোর্টে এসে একদিন সকলে দেখলো সেখানে একটি সাইনবোর্ড লাগানো আছে, মসজিদটি ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি দাবি করে। আজব কথা, এলাহাবাদ হাইকোর্টের সম্পত্তি কি করে ওয়াকফ বোর্ডের হয়ে গেল? মামলা হল। মামলা হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টের গড়ালো। সুপ্রিম কোর্ট বলল- “বোর্ড খুলে নাও, না হলে মসজিদটি ভেঙে দেয়া হবে।”

ঘটনাটি ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসের। তামিলনাড়ুর থিরুচেন্হুরাই গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক নিজের মেয়ের বিয়ের জন্য জমি বিক্রি করতে গেলেন রেজিস্ট্রি অফিসে। অফিসার জানায়, পুরো গ্রামটাই নাকি ওয়াকফ সম্পত্তি। জমির অধিকার পেতে হলে ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ জমা করতে হবে। নিজের বাপ ঠাকুরদা চৌদ্দ পুরুষের সম্পত্তি কি করে একটি ধর্মীয় সংগঠনের সম্পত্তি হয়ে যায়? তিনি এ-ও বুঝে উঠতে পারেননি স্বাধীন দেশের গণতন্ত্র, বিচার ব্যবস্থার বাইরে আলাদা কোর্ট, বিচার ব্যবস্থা অর্থ কী? আরো আশ্চর্যের বিষয় সেই গ্রামে থাকা পনের’শো বছরের প্রাচীন একটি মন্দিরও নাকি ওয়াকফের সম্পত্তি। মোহাম্মদ ঘুরীর হাত ধরে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে ভারত আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটে দেশে। অর্থাৎ এদেশে ইসলামেরই সময়কাল ১৪০০ বছরের বেশি নয়, তাহলে ১৫০০ বছরের পুরনো ‘সুন্দরেশ্বর’ মন্দির কি করে ওয়াকফের সম্পত্তি হয়ে যায়? আবার দেশে ওয়াকফ বোর্ডের আয়ু যখন মাত্র ৭০ বছর!

২০০৫ সালে ওয়াকফ বোর্ড দাবি করে বসলো তাজমহল সৌধ ওয়াকফের সম্পত্তি। মামলা গেল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। যে মামলা এখনো চলছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুলল, তাজমহলকে কবে সম্রাট শাহজাহান ওয়াকফ প্রপার্টি হিসেবে ডিট করেছিলেন? তাজমহল যদি আজ ওয়াকফের সম্পত্তি হয়ে যায় তাহলে কাল তো দাবি উঠবে লালকেল্লা, ফতেপুর সিক্রি সবই ওয়াকফের সম্পত্তি। উল্লেখ করা দরকার ৪০০ বছর আগে শাহজাহান জামা মসজিদকে ওয়াকফের সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তাই বৈধভাবে সেটি এখন ওয়াকফের সম্পত্তি।  এরই মধ্যে ২০২৪ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর দিল্লির চারটি মন্দিরকে ওয়াকফ তাদের সম্পত্তি করে ফেলেছে। ২০২১ সালে গুজরাটের সুরাট নগর নিগমের হেড অফিস ওয়াকাপের সম্পত্তি বলে ঘোষণা হয়েছে। মথুরার জ্ঞানবাপী-কৃষ্ণজন্মভূমি ওয়াকফের সম্পত্তি বলে দাবি উঠেছে। ওয়াকফ বোর্ড তাদের সম্পত্তি হিসেবে ইতিমধ্যে  দাবি করেছে মুকেশ আম্বানির বাড়ি ‘অ্যান্টিলিয়া’, প্রয়াগ রাজের কুম্ভ মেলার জমি, কলকাতা ইডেন গার্ডেনের জমি, এমনকি পার্লামেন্টের জমিও।

২০২৪ সালে বর্তমান কেন্দ্র সরকার এই বিলের সংশোধনীর জন্য প্রস্তাব আনে। আর ২০২৫ সালে রাজ্যসভা ও লোকসভাতে ভোটাভুটির মাধ্যমে এই সংশোধনী বিল পাস হয়ে যায়। লোকসভায় ২৮৮ ও ২৩২ ভোটের

ব্যবধানে এবং রাজ্যসভায় ১২৮-৯৫ ব্যবধানে পাশ হয়ে যাওয়ার পরই সারা দেশে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। বিরোধীদের দাবি এর দ্বারা মুসলমানদের ধর্মে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে, খর্ব হচ্ছে তাদের অধিকার। উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ওয়াকফের সম্পত্তি সবচেয়ে বেশি। ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৫ সালের  ৪ঠা এপ্রিল পাশ হয়ে যাওয়ার পর, উত্তরপ্রদেশে সেই অর্থে কোন হিংসাত্মক ঘটনার খবর নেই। পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসকের প্রত্যক্ষ মততে এবং পরিকল্পনামাফিক পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে  খুন করেছে হরগোবিন্দ  দাস এবং চন্দন দাস’কে। নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়েছে হাজার হাজার হিন্দুকে। সংসদের বাইরে ও ভেতরে, মুসলিম মহল্লায় এর উত্তেজনা তীব্র। বিরোধীরা যারা একটি দেশের ভেতরে আর একটি দেশ আর একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার চাইছে তারাই পরিকল্পনামাফিক গন্ডগোল তৈরি রাস্তায় হাঁটছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক ; দেশের স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা, অগ্রগতির ও সমৃদ্ধি তাদের কাছে গৌণ।  কিন্তু কেন? কী এই ওয়াকফ? সেটাই আমাদের আলোচনার।

……………………………………………………………

ওয়াকফের ইতিহাস

ওয়াকফ কি?

আরবি ভাষা ‘ওয়াকাফা’ থেকেই ‘ওয়াকফ’ শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ সম্পত্তির হাত বদল বা ফেরত না যাওয়া। মসজিদ, হাসপাতাল, এতিমখানা প্রভৃতির জন্য মুসলমান সম্প্রদায়কে জমি দান করাই হল ওয়াকফ। যিনি দান করেন দানি, দাতা বা ওয়াকফি। হিন্দুদের দেবত্ব সম্পত্তির অনুরূপ বলে একে ভেবে নেওয়া যেতে পারে।

৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম ধর্মের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর, প্রফেট হযরত মহম্মদের কাছে খাইবারে থাকা নিজের একটি জমি ভালো কোন কাজে দান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। জানতে চান কিভাবে ভালো কাজে এই জমিকে তিনি ব্যবহার করবেন। সেদিন হযরত মহম্মদ সেই জমিকে ‘সদকায়ে জারিয়া’ অর্থাৎ মানবজাতির জন্য ‘স্থায়ী ও চলমান’ ‘দান’ করে দিতে বলেছিলেন। তাতে মৃত্যুর পরও দাতা পূণ্য অর্জন করবেন। হযরত মহম্মদ নিজের জীবনে বহু জমি ‘সদকায়ে জারিয়া’ করেছিলেন। মদিনায় নির্মিত ইসলামের প্রথম মসজিদ ‘মসজিদে কুবা’ ‘সদকায়ে জারিয়া’র মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল।

সদকায়ে জারিয়া ও ওয়াকফ

‘সদকায়ে জারিয়া’ অর্থ continuous charity বা মানবজাতির জন্য ‘স্থায়ী ও চলমান’ ‘দান’। আল্লাহর নামে এই দান জমি, পুকুর, অর্থ, এমনকি লাগানো কোন গাছও হতে পারে। সন্তানকে কিংবা অন্য কাউকে দেওয়া কোন জ্ঞান যা উপকারে আসে, তা ‘সদকায়ে জারিয়া’ হয়ে যায়। হযরত মহম্মদ যে জ্ঞান বিতরণ করেছিলেন

আজও সারা বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান নিজেদের সমৃদ্ধ করে বলে দাবি করে। তাই হযরত মহাম্মদের সকল জ্ঞান ‘সদকায়ে জারিয়া’র অংশ।

কিন্তু এর শর্ত হলো সম্পত্তি যদি একবার ‘সদকায়ে জারিয়া’ করে দেওয়া হয়, কোনভাবে কোন অবস্থাতে তা আর ফেরত নেওয়া যায় না। তাকে কেনা কিংবা বেচাও যায় না। এর মালিকানা একান্তভাবে আল্লাহর। সুতরাং আল্লাহর কাছ থেকে ‘ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা’ অর্থাৎ  ‘স্থায়ী হাত বদল’ আরবি শব্দে, ‘ওয়াকফ’। ওয়াকফ নিয়ে মুসলমানদের উত্তেজিত ও বিভ্রান্ত করার অন্যতম প্রধান বিষয় এটি। উল্লেখ করা প্রয়োজন ইসলামের কোন গ্রন্থে এই ‘ওয়াকফ’-এর কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না।

ওয়াকফ-এর ধারণা ভারতে কি করে এলো

১১৯২ সালে মহম্মদ ঘোরী পৃথ্বীরাজ চোহানকে পরাজিত করে ভারতে প্রথমবার মুসলিম শাসনের সূচনা করেছিলেন। তারপর দীর্ঘ প্রায় ১২০০ বছর ধরে মুসলিম শাসন চলেছে এ-দেশে। সেই সময়কালে মুসলিম রাজা এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন সম্পতি ওয়াকফ করেছেন, ইসলামের রীতি মেনে। ঐতিহাসিকভাবে ভারতে ওয়াকফের সূচনা সুলতানি আমলে। সুলতান মুইজুদ্দিন জামে মসজিদের পক্ষে দুটি গ্রাম ভারতে প্রথম ওয়াকফ হিসেবে উৎসর্গ করেছিলেন। ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনকালে ওয়াকফকে সর্বোচ্চ সংগঠিত করার চেষ্টা হয় এবং তাঁর রাজত্বকালেই ওয়াকফনামা বা অনুদান দলিল তৈরীর প্রথা চালু হয়।  ওয়াকফ করা রাজাদের মধ্যে ইলতুতমিস, মহম্মদ-বিন-তুঘলক, আলাউদ্দিন খলজী, আকবর, শাহজাহান প্রমুখ অন্যতম প্রধান। ভারতে মুসলিম আগমনের পর রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম আগ্রাসন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ধর্মান্তকরণ চলতে থাকে থাকে দূর দূর গ্রামে-জনপদে। পূর্বের হিন্দু প্রধান এলাকায় ইসলাম ধর্ম প্রসারের পরই গ্রামের রাজস্ব থেকে তৈরি হতে থাকে মাদ্রাসা, মসজিদ প্রভৃতি। কিছু কিছু হিন্দু রাজাও মুসলিম শাসকের প্রতি আনুগত্য দেখাতে তাদের সম্পতি ওয়াকফ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। স্বীকার্য ‘ইসলামিক স্বর্ণযুগ’-এ ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানগুলি ইসলামী শিক্ষার বিস্তার ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।

ওয়াকফ বোর্ডের গঠনতন্ত্র

এই ওয়াকফের সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তরিত না করা গেলেও ভাড়া দিয়ে এখান থেকে অর্থ উপার্জনের কোনো বাধা নেই। এইসব সম্পত্তির সঠিক ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজনকে নিয়োগ করা হয়, তিনি হলেন মুতাওয়াল্লি। তিনি কেবল এই সম্পত্তির দেখাশোনা করতে পারবেন, কেনা-বেচার কোন এক্তিয়ার তার থাকবে না।  প্রতিটি জেলায় এবং রাজ্যে ওয়াকফের কত সম্পত্তি আছে তার রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং অন্য কেউ যাতে এটা দখল করে নিতে না পারে সেই বিষয়ে তদারকির জন্য প্রতিটি রাজ্যে একটি করে ওয়াকফ বোর্ড গঠিত রয়েছে। ভারতে মোট ওয়াকফ বোর্ডের সংখ্যা একত্রিশ। এদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি ‘কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল’ গঠিত হয়েছে। প্রতি রাজ্যে শিয়া ও সুন্নির পৃথক ওয়াকফ বোর্ড

রয়েছে। মোট সম্পত্তির ৭ শতাংশ ওয়াকফ বোর্ড পরিচালনা এবং কর্মচারীদের বেতনের জন্য ব্যবহার করা হয়।

ব্রিটিশ শাসনকালে ওয়াকফ

ব্রিটিশ শাসনকালে ১৮৯৪ সালে বিচারপতি আব্দুল ফাতা-র এজলাসে মহম্মদ ইসহাক ও রুশোময় ধুরের মামলায় পারিবারিক ওয়াকফ ও পাবলিক ওয়াকআপের এক্তিয়ার সংক্রান্ত বিষয়ের মীমাংসার জন্য নতুন ওয়াকফ আইনের প্রয়োজন দেখা দেয়। ব্রিটিশ আমলে গুরুত্বপূর্ণ আইনের দিকগুলি ছিল-

ক. মুসলিম ওয়াকফ বৈধকরণ আইন, ১৯১৩ : ওয়াকফের ক্ষেত্রে মুসলিম আইনকে সঙ্ঘবদ্ধ করা এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের অভিযোগের সমাধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল এটি। এই বিলের পক্ষে ছিলেন মহম্মদ আলী জিন্নাহ। মুসলিম স্বার্থ দেখার জন্য তিনি ‘ইম্পেরিয়াল ডেজিসলেটিভ কাউন্সিল’-এর সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

খ. মুসলিম ওয়াকফ আইন, ১৯২৩ : ভারতের প্রথম ওয়াকফ বিষয়টি আইনে পরিণত হয়  ব্রিটিশ শাসনে ১৯২৩ সালে। স্থানীয় মুতাওয়াল্লিদের ওয়াকফ সম্পত্তি নিজেদের স্বার্থে অপব্যবহার রুখতে এবং সম্পত্তির যথাযথ হিসেব রাখার জন্য ছিল এই আইন।  নাম ছিল- ‘মুসলমান ওয়াকফ ভ্যালিডেশন অ্যাক্ট, ১৯২৩’।

……………………………………………………………

স্বাধীন ভারতে ওয়াকফ আইন

ভারতের স্বাধীনতার পরেও ওয়াকফ আইন থেকে গেছিল,  ১৯২৩ সালের। সম্পত্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিলতা নিরসনের জন্য স্বাধীন ভারতে একটি পরিপূর্ণ আইন তৈরি জরুরী হয়ে পড়ে।

ওয়াকফ আইন ১৯৫৪

স্বাধীনতার পর ১৯২৩-এর অ্যাক্টের উপর ভিত্তি করে নতুন একটি আইন তৈরি হয়, যা ‘ওয়াকফ অ্যাক্ট, ১৯৫৪’ হিসেবে পরিচিত। এই আইনের মাধ্যমে প্রথমবার রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডগুলিকে সম্পত্তি তদারকির ক্ষমতা দেওয়া হয়। তবে এই আইনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানে চলে যাওয়া মুসলিমদের এ-দেশের সম্পত্তির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ।

ওয়াকফক (সংশোধন) আইন, ১৯৮৪

এর আগে ১৯৬৪ ও ১৯৬৯ সালে কিছুটা সংশোধন করা হলেও উদ্ভূত কতকগুলি সমস্যার সমাধানের জন্য ১৯৮৪ সালে একটি সংশোধনী বিল আনা হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ওয়াকফগুলির সঠিক গঠন

এবং তাদের অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ওয়াকফ সম্পত্তির বিরোধ নিস্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এই আইন অনুসারে ওয়াকাফ কমিশনাকে বিশেষ ক্ষমতা প্রদানের কারণে ওয়াকফ বোর্ডের স্বায়ত্বশাসন হ্রাস পায় এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

ওয়াকফ আইন ১৯৯৫

১৯৯৫ সালে পি ভি নরসীমা রাওয়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার ওয়াকফ বিলের আর একবার সংশোধনী আনেন। ওয়াকফ প্রশাসনের পরিধি প্রসারিত করা, পরিচালনাগত কাঠামো ও দক্ষতা আরও বৃদ্ধি করা ছিল এই আইনের প্রধান লক্ষ্য। ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের ব্যবস্থা যথারীতি বজায় ছিল এবং ওয়াকফ বোর্ডগুলিকে আরো বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়। যার ফলে গোটা ভারত জুড়ে বিশাল সম্পদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পেয়ে যায় বোর্ড।

সাচার কমিটির রিপোর্ট

কংগ্রেস সরকারের আমলে ২০০৫ সালে বিচারপতি রাজেন্দ্র সিং সাচারের নেতৃত্বে ‘সাচার কমিটি’ গঠিত হলো। দেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষরা সামাজিক-অর্থনৈতিক-শিক্ষা ক্ষেত্রে কেন এত পিছিয়ে রয়েছে, সে সংক্রান্ত রিপোর্ট তৈরি ছিল প্রধান লক্ষ্য। এই সংক্রান্ত সার্ভে এক বছর চলার পর যে রিপোর্ট পেশ হয়েছিল, সেটি ভয়ংকর। রিপোর্টে বলা হয় সারাদেশ জুড়ে ওয়াকফের বিপুল সম্পত্তির দাম ধরা হয়েছে মাত্র ছয় হাজার কোটি টাকা। অথচ যার মার্কেট ভ্যালু এক লক্ষ কুড়ি হাজার কোটি টাকারও বেশি। মূল পুঁজির দশ শতাংশ হারে হিসেব করলে প্রতি বছর যা থেকে আয় হওয়ার কথা প্রায় বারো হাজার কোটি টাকা। অথচ ২০০৬ সালে ওয়াকফ বোর্ড সেই আয় দেখিয়েছে মাত্র একশ তেষট্টি কোটি টাকা। এছাড়াও বহু জমি নথিভুক্ত হয়নি, প্রচুর জমি বে-দখল, রক্ষণাবেক্ষণের চূড়ান্ত অভাব, স্থানীয় মুতাওয়াল্লিরা ব্যাপক হারে দুর্নীতি প্রভৃতির অভিযোগ সামনে এসে পড়ে। কমিশনের সুপারিশ ছিল- সঠিকভাবে ম্যানেজমেন্ট করতে পারলে যে বিপুল অংকের আয় হবে তা দিয়ে দেশে পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের অগ্রগতির কাজে লাগানো যাবে।

২০১৬ সালের সাচার কমিটির রিপোর্টে এবং ২০০৮ সালের মার্চ মাসে যৌথ কমিটির প্রতিবেদনে ওয়াকফ সংক্রান্ত কিছু আইনের দ্রুত সংশোধনীর সুপারিশ করা হয়। দক্ষ পরিচালনার জন্য অমুসলিম দক্ষতা সংযুক্তি, বোর্ডগুলির জন্য একজন উচ্চপদস্থ সিইও নিয়োগ, দুর্নীতিগ্রস্ত মুতাওয়াল্লিদের জন্য কঠোর শাস্তি, জমি সংক্রান্ত মামলায় কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপের সুপারিশ, কম্পিউটারাইজেশন, কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়।

ওয়াকফ (সংশোধন) আইন, ২০১৩

মনমোহন সিং নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার আগে ২০১৩ সালে এই বিলের ব্যাপক  সংশোধন আনে। যার ফলে ওয়াকফকে বিস্তৃত ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং তাকে প্রায় অজেয় করে তোলা হয়। এক ধাক্কায় ২০১৩ সাল পর্যন্ত, দেশে মুসলিম আগমনের ১৪০০ বছরে ওয়াকফের মোট জমি যেখানে ১৮ লক্ষ হেক্টর ছিল, তারপরে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মাত্র দশ বছরে ৩৯ লক্ষ হেক্টরে পরিণত হয়ে যায়। অর্থাৎ ১০ বছরে বৃদ্ধির পরিমাণ একশ শতাংশেরও বেশি। এই সংশোধনীর মূল বিষয়গুলি হল-

ক. ওয়াকফের বর্ধিত সংজ্ঞা : দীর্ঘদিন ধরে কোন সম্পত্তি মুসলিমরা শুধু ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করলেই সেটি ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়। অমুসলিমদের সম্পত্তি ওয়াকফ হিসেবে ঘোষণার আইন অনেক সহজ ও উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

খ. ‘বাই ইউজার’ কতৃক ওয়াকফের ভূমিকা : কোন সম্পত্তি মসজিদ, কবরস্থান প্রভৃতিতে ব্যবহার হয়ে এলে তা ওয়াকফের সম্পত্তি করার সুযোগ দেওয়া হয়। এমনকি ওই সমস্ত কাজে ওই জমি দীর্ঘদিন আর ব্যবহার না হলেও তা ওয়াকফের সম্পত্তি হিসেবেই বিবেচনা করা সুযোগ থাকে।

গ. ওয়াকফ ট্রাইব্যুনাল : ১৯৫৪ সালের আইনে  ওয়াকফ সম্পত্তি  নিষ্পত্তির জন্য দেওয়ানী আদালতের ক্ষমতা হস্তান্তরিত করে ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের সংশোধনীতে ওয়াকফ  ট্রাইব্যুনালের সর্বোচ্চ ক্ষমতা সর্বোচ্চ করে দেওয়া হয়।

ঘ. জমি জরিপের খরচ রাজ্য সরকারের : এই সংশোধনী অনুসারে ওয়াকফ সম্পত্তির জরিপের সকল আর্থিক দায়ভার রাজ্য সরকারের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। যদিও রাজ্য সরকারের অর্থ সকল ধর্মের মানুষের ট্যাক্স থেকেই আসে।

ঙ. মুসলিম অধ্যুষিত ওয়াকফ বোর্ড : এই সংশোধনে ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম প্রতিনিধিত্ব প্রায় শূন্য হয়ে যায়। এর ফলে অমুসলিমদের জমি সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসায় ব্যাপকভাবে প্রক্ষপাতীত্বের অভিযোগ আসতে থাকে।

চ. ওয়াকফ সম্পত্তির দাবি : এতদিন পর্যন্ত কোন একটি সম্পত্তি ওয়াকফের কিনা প্রমাণ করার জন্য সঠিক কাগজপত্র বোর্ডকেই দাখিল করতে হতো। ২০১৩-এর সংশোধনী অনুসারে অমুসলিম কোন সম্পত্তি কিংবা বৈধ কাগজপত্রহীন কোন সম্পত্তি নিজেদের বলে দাবি করার জন্য কোন প্রমাণ ওয়াকফ বোর্ডকে দিতে হলো না। বরং ওয়াকফ কোন সম্পত্তি নিজেদের বলে ঘোষণা করে দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেই এক বছর সময়সীমার মধ্যে প্রমাণ করতে হতো যে সম্পত্তিটি তার। এক্ষেত্রে মীমাংসা হতো ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালে। যেখানে উকিল, বিচারপতি থেকে ব্যবস্থাপনার সকলেই ইসলাম ধর্মের। আইনও কেবল মুসলমানদের জন্যই তৈরী। তাই এই ট্রাইব্যুনাল মুসলমানদের পক্ষে অবৈধভাবে জমি হাতিয়ে নেওয়ার আইনি একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠল। শুধু তাই নয় দেশের আইন ব্যবস্থার কোথাও এই আইনের ধারা-অনুচ্ছেদ সম্পর্কে

পঠন পাঠনের কোন ব্যবস্থা ছিল না, সবার কাছে ছিল গোপনীয়। এমনকি দেশের সুপ্রিমকোর্ট কিংবা হাইকোর্টে এই ট্রাইবুনালের রায়ের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার অধিকার ‘স্বাধীন-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রের নাগরিকের ছিলনা।

ছ. ওয়াকফের সম্পত্তি বিক্রি : কোন অবস্থাতেই ওয়াকফের সম্পত্তি বিক্রির ক্ষেত্রে বিশেষ কড়া আইন আনা হয়। ফলে ওয়াকফ হিসেবে ঘোষণা হয়ে যাওয়া যেকোনো সম্পত্তির বিক্রি প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে এই সংশোধনীর মাধ্যমে।

জ. অমুসলিম সম্পত্তি অন্তর্ভুক্তি : অমুসলিমদের সম্পত্তি ওয়াকফ হিসেবে ঘোষণা আরও সহজ করে দেওয়া হয়।

ঝ. ওয়াকফ সম্পত্তির পুনরুদ্ধার : ২০১৩ সালের এই সংশোধনী অনুসারে ওয়াকফের জমিতে গড়ে ওঠা সরকারি সংস্থাগুলি ওয়াকব ট্রাইবুনালের নির্দেশ অনুসারে ছয় মাসের মধ্যে ফেরত দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়।

ওয়াকফের পাহাড় প্রমান দুর্নীতি

নিয়ম অনুসারে ওয়াকফের কোন সম্পত্তি অ-মুসলিম কোন কাজে ব্যবহার করা যায় না। অথচ ২০১৬ সালে বিজয় মালিয়া ওয়াকফ সম্পত্তি কিনেছিলেন মদের ব্যবসার জন্য। ২০২৪ সালে কর্নাটক ওয়াকফ বোর্ডের চিফ একাউন্টেন্ট মীর আহমেদ আব্বাস বোর্ডের প্রাক্তন সিইও জুলফিকারের নামে একটা মামলা করেন এবং অভিযোগ করেন এই জুলফিকার বিগত আট বছরে প্রায় চার কোটি টাকার হিসেব দেননি।

২০২৪ সালে মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস নেতা রিয়াজ খানকে একটি নোটিশ পাঠায় মধ্যপ্রদেশ ওয়াকফ বোর্ড। যেখানে অভিযোগ করা হয়, তিনি প্রায় সাত কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন। চুরির অপরাধে পলাতক রিয়াজ খানের নামে রাজ্য পুলিশ হুলিয়া জারি করে। উত্তরপ্রদেশের হাকিম আলী অভিযোগ করেন উত্তরপ্রদেশ ওয়াকফ বোর্ডের একটি ১৮৩ একর জমি আছে, যেখান থেকে বছরে ৫০ লক্ষ টাকা আয় হয়, বিগত কয়েক বছরে প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকার কোন হিসেব দেয়নি উত্তরপ্রদেশ ওয়াকফ বোর্ড। উত্তরপ্রদেশের এক মুতাওয়াল্লি প্রায় কুড়ি কোটি টাকার ওয়াকফ সম্পত্তি নিজের সম্পত্তি হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছেন। ২০২৪ সালে আম-আদমি পার্টির বিধায়ক আমানাতুল্লাহ খানকে ওয়াকফ দুর্নীতি মামলায় ইডি গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক তজরুপের অভিযোগ প্রায় ১০০ কোটি।

‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ অর্থাৎ কোন একটি জায়গা বহু বছর ধরে যদি ইসলামিক কাজে ব্যবহার হয়ে আসে তাহলে বোর্ড চাইলে সেই জায়গাটিকে ওয়াকফের সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। সাধারণ আইন হচ্ছে কোন এক জায়গা যদি সাধারণ মানুষ বসতি হিসেবে বারো বছর ব্যবহার করেন, তাহলে আইনগতভাবে সেই জমির উপর তার একটি অধিকার জন্মায়। সরকারের ক্ষেত্রে এই সময়কাল ত্রিশ বছর।

কিন্তু এই আইন অনুসারে কোন সম্পত্তিকে নিজের বলে ঘোষণা করতে ওয়াকফ বোর্ডের কোন সময়সীমা নেই।

দেশে বর্তমানে ওয়াকফের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৯ লক্ষ ৪০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং প্রায় ৩৮ লক্ষ হেক্টর জমি। টাকার অংকে প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার কোটি। প্রতিবছর দশ শতাংশ হারে এই হিসেব করলে আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ হাজার কোটি টাকা। অথচ কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কমিশন হিসেব দেখিয়েছে, তাদের বার্ষিক আয় মাত্র ১৬৩ কোটি টাকা। ভোট অঙ্কের বিচারে একটি সম্প্রদায়ের মুষ্টিমেয় কতকগুলি লোককে সন্তুষ্ট করার জন্য কংগ্রেস সরকারের আনা আইনের সুযোগ নিয়ে ভারতের ওয়াকফ বোর্ড দুর্নীতির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছিল।

…………………………………………………………..

ওয়াকফ বিল ২০২৫ কেন জরুরী ছিল

১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইনের উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন এনে, ২০২৪ সালের ৮ই আগস্ট লোকসভায় পেশ করা হয়। এটিই ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৪। ২০২৫ সালের ৪ঠা এপ্রিল লোকসভা এবং রাজ্যসভায় পাশ হয়ে যাওয়ার পর এটি ‘ওয়াকফ আইন, ২০২৫’ হিসেবে পরিচিত হয়ে যায়।

ওয়াকফ সম্পত্তি : আগে যে কেউ নিজের সম্পত্তি ওয়াকফ করতে পারত, কিন্তু এই আইন অনুসারে কোন ব্যক্তি পাঁচ বছর ধরে ইসলাম প্রাকটিস করলে তবেই সম্পত্তি দান করতে পারবেন।

ওয়াকফ সম্পত্তির দাবি : দীর্ঘদিন যাবত কোন একটি স্থানে ধর্মীয় কার্যকলাপের প্রমান দাখিল করলেই সেটি ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে দাবি করা যেত। নতুন সংশোধনিতে সেই ধারা বাতিল করা হয়েছে।

সরকারি সম্পত্তি এবং ওয়াকফ : এই আইন অনুসারে কেবল মৌখিকভাবে দীর্ঘদিন আগে থেকে কোন সম্পত্তি ওয়াকফ করা হলেও তা ওয়াকফের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হবে না। বৈধ ডকুমেন্টস থাকলে তবেই বোর্ড নিজেদের সম্পত্তি বলে দাবি করতে পারবে। বর্তমানে দেশে পাঁচ হাজারেরও বেশি এমন সম্পত্তি আছে, যার উপর  সরকারি কোন নির্মাণ আছে। এখন যদি ওয়াকফ বোর্ড কোন বৈধ ডকুমেন্টস না দেখাতে পারে তাহলে এই সম্পত্তিগুলো সরকারি সম্পত্তি হয়ে যাবে।

ওয়াকফ সম্পত্তি নির্ধারণের ক্ষমতা : ওয়াকফ সম্পত্তি দেখাশোনা, হস্তান্তর, বিতর্ক প্রকৃতির মীমাংসা এবং সম্পত্তির ব্যবহার নিয়ে দেখভালের জন্য জেলাশাসক পর্যায়ের কোন আধিকারিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই আইনে। জেলাশাসক বা সমতুল নিযুক্ত সেই ব্যক্তি যে রিপোর্ট দেবেন সেটাকেই ওয়াকফ বোর্ডকে মানতে হবে। এরা সরকারের লোক এবং সবাই মুসলিম নন। মুসলিমদের মূল অভিযোগ এখানে। অভিযোগ যখন সরকারের সঙ্গে কোন মামলা চলবে তখন জেলাশাসক নিরপেক্ষ না থেকে সরকারের পক্ষ

নেবেন। সুতরাং মুসলিমদের ভেতরে এই বলে আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে এই আইনের দ্বারা সরকার ওয়াকফের সম্পত্তি হাতানোর চেষ্টা করবে। বলে রাখা ভালো, যে সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তির বৈধ ডকুমেন্টস আছে তাদের উপর এই আইনের কোন প্রভাব পড়বে না। হয়তো প্রভাব পড়বে মুখে মুখে যে সমস্ত সম্পত্তিকে ওয়াকফ মান্যতা দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ ওয়াকফ বাই ইউজারের ক্ষেত্রে।

ট্রাইব্যুনাল ও আপিল : পূর্বের আইনে ওয়াকফ ট্রাইবু্নাল যে রায় দিত তার বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্ট কিংবা হাইকোর্টে আবেদন করা যেত না, সীমিত কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া । নতুন সংশোধনীতে সেই অধিকার প্রদান করা হয়েছে। ওয়াকফ ট্রাইবুনাল আইন সংশোধন করে চেয়ারম্যান করা হয়েছে জেলা বা দায়রা আদালতের একজন বিচারককে এবং আরেকজন সদস্য ঊর্ধ্বতন রাজ্য কর্মকর্তাকে। মুসলিম আইন সম্পর্কে অভিজ্ঞ সদস্যের প্রয়োজনীয়তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে এই আইনে। ট্রাইবুনালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে কোন মামলা ৯০ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে আবেদন করার অধিকার দেওয়া হয়েছে।

ওয়াকফ বোর্ড গঠন : এই আইন অনুসারে বোর্ডের দুজন অমুসলিমকে রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে মুসলিমরা সরাসরি তাদের ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ বলে ব্যাখ্যা করছে। সংশোধিত এই আইনের যুক্তি দেখভালের জন্য যে মুতাওয়াল্লি নিয়োগ করা হয় তিনি ম্যানেজমেন্ট এর ক্ষেত্রে এক্সপার্ট নন। অন্যদিকে ওয়াকফ সম্পত্তি কোন ধর্মীয় সম্পত্তিও নয়, কারণ কোরআনে এর কোন উল্লেখ নেই। পূর্বের আইন ইংরেজদের তৈরি করা। বোর্ডে শিয়া, সুন্নি, আঘাখানি এবং অনগ্রসর মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। এই আইন অনুসারে বোর্ডে দু’জন মুসলিম মহিলার প্রতিনিধিত্ব বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

সম্পত্তির ডিজিটালাইজেশন : এই সংশোধনীতে ওয়াকফের সমস্ত সম্পত্তি ডিজিটালাইজেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সমস্ত আয় ব্যয়ের হিসাব অডিট যথাসময়ে যথাসময়ে করতে হবে।

নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক ওয়াকফ বোর্ড : শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক ওয়াকফ বোর্ড গঠনের সুপারিশ করার পাশাপাশি, বোহরা ও আঘাখানি সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক ওয়াকফের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। সব সম্প্রদায়ের মুসলিম প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে সংশোধিত এই আইনে।

ধর্ম পালন ও ধর্ম প্রচারের অধিকার এ হস্তক্ষেপের মিথ্যা প্রচার

ভারতীয় সংবিধানের ২৫ ও ২৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সকল মানুষের ধর্ম পালন ও প্রচারের অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫-এ ধর্মের স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের অধিকার এবং ধর্ম প্রচারের অধিকারের নিশ্চয়তা র কথা উল্লেখ করা আছে। অনুচ্ছেদ ২৬-এ প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্ম বিষয়ে নিজস্ব বিষয়গুলি পরিচালনা করার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। ওয়াকফ বোর্ড কোন ধর্মীয় সংগঠন

নয় কিংবা ধর্ম শাখাও নয়। সুতরাং এই আইন সংবিধানের ২৫ ও ২৬ অনুচ্ছেদকে লংঘন করার অভিযোগ মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ধর্মীয় উস্কানিমূলক।

ওয়াকফ বোর্ডের প্রকৃতি : ওয়াকব বোর্ড একটি আইনগত সংস্থা, একই ধর্ম মতে বিশ্বাসী কোন একটি গোষ্ঠী নয়। একটি কোম্পানির মত এরা কাজ করে এবং একত্রিত সম্পত্তিগুলির দেখাশোনা এবং নিয়ন্ত্রণ করে। এটি কোন ধর্মীয় সংগঠন নয়, তাই এর পরিবর্তন ও পরিমার্জন সংবিধান সম্মত এবং সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৬-কে কোনভাবেই লংঘন করে না।

মৌলিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ : ওয়াকফ বোর্ড যেহেতু কোন ধর্মীয় সংগঠন নয়, তাই এই বোর্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন নিয়ম বা আইনের  সংশোধন, সংবিধানের ২৫ ও ২৬ অনুচ্ছেদের ধর্ম আচরণের মৌলিক অধিকারকে কোনভাবেই খর্ব করে না।

ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ : ওয়াকফ বোর্ডের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি এবং অমুসলিমদের অন্তর্ভুক্তি ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ বলে অভিযোগ উঠেছে। এটি একটি বিষয়-সম্পত্তি সংক্রান্ত সংস্থা, কোন ধর্মীয় গোষ্ঠী নয়। সুতরাং সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ (b) ধারায় প্রদত্ত ধর্মীয় স্বায়ত্ত শাসনের অভিযোগ মিথ্যা।

ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ : ওয়াকফ ধর্মীয় সংগঠন নয় এবং ধর্মাচরণও এদের প্রধান লক্ষ্য নয়। মুসলিম এবং অমুসলিম নাগরিকদের দান করা সম্পত্তি উপযুক্ত ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণে এদের কাজ। আরো অনেকবার সংশোধনের মতো ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৪ সংবিধান স্বীকৃত এবং কোনভাবেই মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না।

মন্তব্য

এ প্রশ্ন বরং আজ বেশি করে উঠতে শুরু করেছে  দেশে ওয়াকফ কতটা জরুরী। ভারতে ওয়াকফের সম্পত্তি ঠিক কত? নয় লক্ষ চল্লিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার। অপরদিকে একটা পাকিস্তান দেশের মোট জমির পরিমাণ নয় লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার। অর্থাৎ ভারতবর্ষের ভেতরে একটি পাকিস্তান, একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিজস্ব বোর্ড হিসেবে বসে আছে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে অন্য কোন ধর্মের ধর্মভিত্তিক আলাদা কোন বোর্ড বা সংস্থার কোন অস্তিত্ব নেই। কেবল মুসলিমদের জন্যই আলাদা ব্যবস্থা রাখা আছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ বড়ো মুসলিম রাষ্ট্রে ওয়াকফের কোন অস্তিত্বই নেই। তুরস্ক, মিশর, লেবানন, লিবিয়া, জর্ডন, সিরিয়া, ইরাক কিংবা আরবের মত দেশে ওয়াকফ সম্পূর্ণ অবৈধ। সুতরাং এখন প্রশ্ন উঠেছে ধর্মকে সামনে রেখে ওয়াকফ নামে কোন বোর্ডের অস্তিত্ব আদৌ  দেশ প্রয়োজনীয় কিনা, যা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকেই চ্যালেঞ্জ করে। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজীর নেতৃত্বে ‘ওয়াকফ আইন ২০২৫’- এর বিরুদ্ধকারীরা আসলে ওয়াকফ আইনকে শরীয়ত আইনের প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচনা করে ফেলেছিলেন।

মোদিজীর হাত ধরে দেশে ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি, তিন তালাকের অবলুপ্তি প্রভৃতির মত ওয়াকফ আইনের সংশোধনও এক ঐতিহাসিক ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। এর মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র যেমন আরো মজবুত হবে তেমনি সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে  বিবেচনা করতে হবে। নিশ্চিত করা যাবে ওয়াকফ সম্পত্তি দেশের গরীব মুসলিমদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রকৃত ব্যবহার, যা এতদিন কেবল সীমিত কয়েকজন মানুষের কুক্ষিগত ছিল। দেশদ্রোহীতা এবং রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহারকারীদের সমস্ত অপপ্রচারকে নস্যাৎ করে দিয়ে ওয়াকফ আইন, ২০২৫-এর আরও দৃঢ় ও সফল প্রয়োগের জন্য এখনই সরকারের সবরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত জরুরি।

Author

(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)