বড়নগর, এক শান্তির স্থান, ঈশ্বরের আশীর্বাদ। মুর্শিদাবাদ জেলার আজিমগঞ্জ সিটি থেকে ১ কিলোমিটার দূরত্বে এক সময়ের বিশাল এক গঞ্জ ছিল এই বড়নগর। একসময় কাঁসা শিল্পের কারণে এই অঞ্চলের খ্যাতি ছিল প্রভূত। রাজশাহীর জমিদার রাজা উদয় নারায়ণের আমলে বড়নগর সর্বপ্রথম গৌরব ও মর্যাদা লাভ করে। মুর্শিদকুলি খানের সাথে যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হন।
মুর্শিদকুলির প্রিয়পাত্র নায়েব কানুনগো রঘুনন্দন মুর্শিদকুলির অনুগ্রহে রাজশাহীর বিস্তৃত জমিদারি লাভ করেন। তিনিই নাটোর রাজবংশের আদি পুরুষ। রঘুনন্দনের ছোট ভাই রামজীবনের নামেই জমিদারির মালিকানা গৃহীত হয়। তাঁর পুত্র কালিকা প্রসাদ অল্প বয়সেই মারা যান। কালিকা প্রসাদের দত্তক পুত্র রামকান্তের পত্নী রাণী ভবানী (১৭১৪ – ১৭৯৩, মতান্তরে ১৭১৬ – ১৭৯৫)। রাণী ভবানীর রাজত্বকালে তাঁর জমিদারি বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর এবং পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এজন্য তাঁকে ‘অর্ধ-বঙ্গেশ্বরী’ বলা হত।
বড়নগরের সঙ্গে প্রাতঃস্মরণীয়া রাণী ভবানীর নাম অচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত। বাস্তবিক বড়নগরের যে গৌরব তার মূলে রাণী ভবানী। নাটোরের রাণী ভবানী নবাব আলিবর্দীর রাজত্বকালে বড়নগরে গঙ্গার তীরে স্থায়ীভাবে বসবাসের নিমিত্ত আগমণ করেন। ভবানী বড়নগরে বহু মন্দির প্রতিষ্ঠা করে বড়নগরকে ‘বাংলার বারানসী’তে পরিণত করেছিলেন। তবে রানী ভবানীর আগমনের আগে থেকেই বড়নগরের খ্যাতি ছিল। বড়নগর তখনকার মুর্শিদাবাদ নগরীর উত্তরতম প্রান্তে অবস্থিত ছিল। নিকটেই আজিমগঞ্জ-জিয়াগঞ্জও তখন বৃহত্তম মুর্শিদাবাদ নগরীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। বড়নগর ছিল একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য কেন্দ্র। অজস্র কাঁসারীর বাস থাকায় পূর্বে উল্লিখিত কাংস্য-শিল্পের একটি প্রধান কেন্দ্ররূপে বড়নগরের খ্যাতি ছিল। তা ছাড়া এখানে নানাবিধ পণ্যসামগ্রী ক্রয়-বিক্রয়ের একটি বড় কেন্দ্র ছিল। সেইজন্য এখানে অনেক ইউরোপীয় বাণিজ্য প্রতিনিধিদেরও যাতায়াত ছিল।
রাণী ভবানী ও বড়নগর ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে থাকায় আজকের এই আলোচনায় তাঁর প্রসঙ্গ বারবার এসে পড়বে। প্রজা সাধারণের কল্যাণের জন্য সুদীর্ঘ ৫০ বছর দক্ষতার সাথে জমিদারী পরিচালনার পর ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর দত্তক পুত্র রামকৃষ্ণের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে বড়নগরে তাঁর গঙ্গাতীরবর্তী রাজপ্রাসাদে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেন। সে সময় বাংলার মসনদে নবাব আলীবর্দী। মসনদে নবাব আলিবর্দী। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই রাজা রামকৃষ্ণের বিষয়বিমুখতা ও ইংরেজ বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রতিকূলতায় রাজশাহী জমিদারি খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যায়। রাণী ভবানী শেষ জীবনে অতিশয় দুর্ভোগ ভোগ করে ১২০০ বঙ্গাব্দে (১৭৯৩ খ্রিঃ, মতান্তরে ১৭৯৫ খ্রিঃ) মারা যান।
বড়নগরের মন্দির নিয়ে আলোচনার আগে ঐ সময়ের অর্থাৎ সতের-আঠার শতকের বাঙালির ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণের সংক্ষিপ্ত পরিচয় আবশ্যক।
বঙ্গদেশ মুসলমান অধিকারের পর (ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভকালে) বাংলার ধর্ম ও সমাজ-জীবনে এক প্রচণ্ড বিপর্যয়ের সূচনা হয়। প্রথমে ব-ইয়ার খিলজীর সঙ্গে আগত যে বাহিনী বাংলা অধিকার করে তাঁদের আক্রমণ ও ধ্বংসলীলা থেকে কোন হিন্দু বা বৌদ্ধ মন্দির, মঠ ইত্যাদি রক্ষা পায়নি। বিজয়ী মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে ইসলাম ধর্মের বিস্তার হয়। একদিকে অভিজাত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অবজ্ঞা ও সামাজিক অত্যাচার, অন্যদিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন এবং প্রধানতঃ বর্ণভেদবিহীন মুসলমান সমাজের প্রতি বৌদ্ধ ও নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা আকৃষ্ট হন এবং ব্যাপকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। আবার উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা তাঁদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য অভূতপূর্ব কঠোরতা অবলম্বন করেন। তবে হিন্দুদের পক্ষে প্রকাশ্যে ধর্মাচারণ বহুল পরিমাণে বাধা প্রাপ্ত হয়। পরে অবশ্য এই অবস্থার পরিবর্তন হয়। ক্রমশঃ বিজয়ী মুসলমান এবং বিজিত হিন্দু সম্প্রদায় উভয়েই উপলব্ধি করেন পরস্পরের সহযোগিতার গুরুত্ব। হোসেনশাহ্ প্রভৃতি উদার ও পরমতসহিষ্ণু সুলতানদের দ্বারা বহু উচ্চপদস্থ হিন্দু রাজকর্মচারি নিয়োগ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা এবং সুফী মতবাদ ও চৈতন্য-প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতেই বাংলার সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে একটি অপেক্ষাকৃত সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব বাঙালি হিন্দুর জীবনে একটি দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরতা এনে দেয়। বৈষ্ণবধর্মের উদারতা ও সহজ সাধন-প্রণালী সমাজের নিম্নস্তরের মানুষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে এবং ধর্মান্তর গ্রহণও বহুল পরিমাণে হ্রাস পায়। তাছাড়া সমাজের উচ্চ স্তরের এবং উচ্চ বর্ণের মানুষেরাও তাঁদের ধর্মের বিপদ উপলব্ধি ক’রে ও নিম্ন বর্ণের মানুষের প্রবল চাপে প’ড়ে তাঁদের উপাসিত শাস্ত্রবহির্ভূত বহু দেব-দেবীকে নিজেদের ধর্মোপাসনার অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হন। এইভাবে হিন্দুধর্মের দেবদেবী ও ধর্মাচরণ পদ্ধতিতে একটি বিরাট পরিবর্তন আসে।
এখানে বাংলার তন্ত্র সাধনার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও সাধনপদ্ধতি বহু প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় চলে আসছে। বিশেষ করে বৌদ্ধযুগের শেষ দিকে বৌদ্ধ তান্ত্রিক আচার আচরণ সমাজ ও ধর্মকে বিশেষভাবে আচ্ছন্ন করে। বৌদ্ধ সমাজের অন্তর্গত নানা তান্ত্রিক সম্প্রদায় ও তান্ত্রিক দেবদেবীর প্রচলন হয়। কালক্রমে হিন্দু ও বৌদ্ধ তান্ত্রিক ভাবধারা একত্রে মিশে যায়। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যেই এই মিলন সংঘটিত হয়ে যায়। ফলে সমাজে তন্ত্রোক্ত দেবদেবীর প্রতিষ্ঠা হয়। বর্তমান কালের দুর্গা, কালী প্রভৃতি শক্তি-পূজার প্রচলন প্রধানতঃ তন্ত্রশাস্ত্রের উপর ভিত্তি করেই প্রবর্তিত হয়। তন্ত্রোক্ত সাধন পদ্ধতির এই প্রভাব সমাজকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে আদিতে তন্ত্র বিরোধী বৈষ্ণব ধর্মও পরবর্তী কালে এই তন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়। শিব-শক্তি (দুর্গা), লক্ষ্মী নারায়ণ এবং রাধা-কৃষ্ণের উপাসনার মধ্যে এই তন্ত্রের প্রাধান্যই পরিলক্ষিত হয়। ফলে বাঙালি সমাজে প্রাচীন পঞ্চপোসনার (বিষ্ণু, শিব, শক্তি, সূর্য ও গণপতি) পরিবর্তে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় শিব-দুর্গা (বা কালী), লক্ষী-নারায়ণ এবং রাধা-কৃষ্ণের পূজা। এইভাবে পূর্বতন বৈষ্ণব ও শৈব ও শাক্ত সম্প্রদায় এক সূত্রে আবদ্ধ হন। হিন্দু সমাজের উপর তলায় ধর্মের শ্রেণি বিরোধ এইভাবে বহু পরিমাণে লুপ্ত হয়ে যায়। মধ্যযুগের শেষ দিকে দেখা যায় একই বাড়িতে দুর্গা, কালী, শিব ও রাধাকৃষ্ণের পরস্পর সহাবস্থান। ফলে শাক্ত পরিবারের মানুষের বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ এবং বৈষ্ণবধর্মের অনুগামীর দ্বারা শাক্ত দেবদেবীর প্রতিষ্ঠার প্রচলন দেখা যায়। মন্দির প্রতিষ্ঠায় ও মন্দির গাত্রের অলঙ্করণে এই সমন্বয়ের নিদর্শন বাংলার সর্বত্র লক্ষ্য করা যায়। বড়নগরের মন্দিরগুলিতেও এই সমন্বয়ের প্রভূত নিদর্শন বর্তমান। মধ্যযুগে বাঙালির ধর্ম সাধনা ও হিন্দু ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে এই ঘটনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। হিন্দু সমাজের বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে এই সমন্বয় পরবর্তীকালে আরও প্রবল হয়ে হিন্দু সমাজের ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে আরও ব্যাপকতা এনে দিয়েছে। এই সময়ে একদিকে যেমন ধর্মবোধ ও ধর্মসাধনায় সমন্বয় সাধিত হয় অপরদিকে মন্দির নির্মাণ পদ্ধতিতেও একটা পারস্পরিক প্রভাব ও সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়। এই প্রসঙ্গে মধ্যযুগের শেষার্দ্ধে বাংলার স্থাপত্যরীতির পরিবর্তনও লক্ষণীয়।
বড়নগরের মন্দিরগুলি আঠার শতকে প্রতিষ্ঠিত। বড়নগরের বৈশিষ্ট্য এই যে মুর্শিদাবাদের অন্যান্য স্থানের মত এই মন্দিরগুলি বিভিন্ন ব্যক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রায় সব মন্দির নাটোরের রাজবংশের ধারা অনুযায়ি নাটোর রাজবংশের বধূরাণী ভবানীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। কেবল ‘মদন গোপাল-এর মন্দিরটি বড়নগরের পূর্বতন অধিপতি রাজা উদয়নারায়ণের প্রতিষ্ঠিত।
নাটোরের রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা রঘুনন্দনের উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। মুর্শিদকুলি খাঁর উচ্চ পদস্থ কর্মচারি ও প্রিয়পাত্র রঘুনন্দন মুর্শিদকুলীর অনুগ্রহেই তাঁর প্রভুভক্তির পুরষ্কার স্বরূপ বিস্তীর্ণ রাজশাহী জমিদারি লাভ করেন। রঘুনন্দনের অনুজ রামজীবনের নামেই জমিদারির মালিকানা গ্রহণ করা হয়। রামজীবনের পুত্র কালিকা প্রসাদ অল্প বয়সেই মারা যান। কালিকাপ্রসাদের দত্তকপুত্র রামকান্তের পত্নী রাণী ভবানী।
রাজশাহী জেলার ছাতিমগ্রামের আত্মারাম চৌধুরির কন্যা ভবানীর জন্ম ১১২১ বঙ্গাব্দে (১৭১৪ খ্রিস্টাব্দ)। ৩২ বৎসর বয়সে তিনি বিধবা হন এবং স্বামী রামকান্তের বিশাল জমিদারির (তৎকালীন বাংলার প্রায় অর্দ্ধাংশ) অধিকারিণী হন। অপুত্রক রাণী দত্তক গ্রহণ করেন রামকৃষ্ণকে। রামকৃষ্ণ সে যুগের প্রখ্যাত তান্ত্রিক ও শক্তিসাধক ছিলেন। নাটোরের রাজবংশ এবং ভবানীর পিতৃ বংশও শাক্ত ছিলেন। শ্বশুরকুল ও পিতৃকুলের ধারা অনুযায়ি রাণীও ছিলেন শাক্ত। বস্তুতঃ তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রায় সব মন্দিরই শাক্ত দেব-দেবীর। স্বাভাবিক কারণেই অধিকাংশ মন্দিরই শিব মন্দির। নাটোরের রাজবংশ গোঁড়া শাক্ত ছিলেন। কিন্তু রাজা রামকৃষ্ণের পুত্র রাজা বিশ্বনাথ বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথমা পত্নী রাণী জয়মণি এই ঘটনায় এতই ক্ষুব্ধ হন যে তিনি নাটোর ত্যাগ করে বড়নগরে এসে বসবাস করেন ও রাণীর সমস্ত দেবোত্তর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হন। এরপর থেকে নাটোরের রাজবংশ দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। বড় তরফ বৈষ্ণব ও ছোট তরফ শক্তি উপাসক। অবশ্য তখনকার নিয়মানুসারে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে নাটোর রাজবংশেও শাক্ত ও বৈষ্ণব মতবাদের সহাবস্থান সম্ভব হয়েছিল। বড়নগরের মন্দিরগুলিই তার প্রমাণ।
রাণী ভবানীর জীবিতকালেই বিশাল রাজশাহী জমিদারি খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। রাজা রামকৃষ্ণের বিষয় বিমুখতা ও ওয়ানের হেষ্টিংসের প্রতিকূলতায় হেস্টিংসের শাসনকালের মধ্যেই (১৭৭২ -১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে) নাটোর জমিদারির এই অবস্থা। রাণী ভবানী শেষ জীবন আর্থিক দুর্গতি ও শোচনীয় মানসিক অবস্থায় অতিবাহিত করে ১২০০ বঙ্গাব্দে (১৭৯৩ খ্রিস্টব্দে) পরলোক গমন করেন। রাণীর মৃত্যুর পরে বড়নগরের গৌরব ক্রমশঃ লুপ্ত হয়ে যায়।
মদন গোপাল মন্দির:-
বড় নগরের প্রাচীনতম মন্দির ‘মদন গোপাল-এর মন্দির। বড়নগরের পূর্বতন অধিপতি রাজা উদয়নারায়ণ এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মুর্শিদকুলি খাঁর সমসাময়িক। উদয়নারায়ণ
বৈষ্ণব ভাবাপন্ন ছিলেন এবং মদনগোপালের মন্দির ছাড়াও তিনি সাঁওতাল পরগণার বীরকিটিতে রাধা গোবিন্দ এবং বন নওগাঁ গ্রামে গিরিধারী মন্দির প্রতিষ্টা করেন। আবার বীরভূমের কনকপুরে স্থাপিত অপরাজিতারও (দুর্গা) তিনি সেবাইত ছিলেন। উদয়নারায়ণ স্থাপিত মদনগোপাল মন্দির তাঁর বৈষ্ণব ধর্ম প্রীতিরই পরিচায়ক। এই মন্দির ‘রাজরাজেশ্বরী’ মন্দির অঙ্গনের দক্ষিণপূর্ব দিকে প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু এখন মন্দিরটি সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত। নিখিলনাথ রায় মদনগোপাল মন্দিরটি সম্ভবতঃ অটুট অবস্থায় দেখেছিলেন কিন্তু তিনি মন্দিরের স্থাপত্য বা ভাস্কর্যের কোন বিবরণ দিয়ে যান নি। সম্ভবতঃ মন্দিরটি একটি ‘দালান-মন্দির’ ছিল। মন্দিরের বিগ্রহ দারুময় ‘মদনগোপাল’ ও ‘মহালক্ষ্মী’র অতীব সুন্দর মূর্তি দুটি এখন রাজরাজেশ্বরী মন্দিরে রক্ষিত আছে। মদনগোপাল মন্দিরে রক্ষিত ‘কুসুমখোলা’ থেকে আনীত ‘কুসুমেশ্বর’ বা ‘হয়গ্রীব’ মূর্তিটিও এখন রাজরাজেশ্বরী মন্দিরে রক্ষিত আছে। এই মূর্তিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ হয়গ্রীব মূর্তি অত্যন্ত বিরল। বেদ অপহরণকারী ‘হয়গ্রীব’ নামক দৈত্যকে নিধন করার জন্য বিষ্ণু এই ‘হয়গ্রীব’ রূপ পরিগ্রহ করেছিলেন বলে পুরাণে উল্লিখিত আছে। সম্ভবতঃ পাল আমলে কৃষ্ণপ্রস্তরে নির্মিত অশ্বমুণ্ড-সমন্বিত চতুর্ভুজ এই বিষ্ণুমূর্তিটির গঠন ও ভাস্কর্য অতীব সুন্দর। রাজা উদয়নারায়ণের আর কোন কীর্তি বর্তমানে বড়নগরে নাই।
গনেশ মন্দির:-
বড়নগরের রাজবাড়ীর সামান্য উত্তরে অষ্টভুজ গণেশ মন্দিরটিকে ঠিক মন্দির বলা চলে না। একটি ক্ষুদ্রগৃহকে মন্দির আখ্যা দেওয়া হয়েছে। নিখিলনাথ রায় এই গণেশ মূর্তিকে বড়নগরের ‘গ্রামদেবতা’ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু গণেশ গ্রামদেবতা হতে পারেন না। এককালে গণেশ শাস্ত্রীয় পঞ্চদেবতার অন্যতম ছিলেন এবং সে সময় সর্বত্র গণেশমূর্তি পূজিত হত। বহু স্থলেই গণেশের প্রাচীন মূর্তি পাওয়া গেছে। নিখিলনাথ রায়ের বিবরণ অনুসারে এই মূর্তিটি প্রস্তর নির্মিত এবং ‘অতীব রমনীয়’ ছিল। বর্তমানে মূর্তিটি অপহৃত। মন্দিরে অবস্থিত প্রস্তরখণ্ডদ্বয় ‘হলহলি-কল কলি’ই সম্ভবতঃ গ্রামদেবতা। মন্দিরটিও সম্ভবতঃ আদিতে একটি ‘থান’ (দেবস্থান) ছিল, পরে একটি গৃহ নির্মাণ করে থানটিকে মন্দির আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এটিও সম্ভবতঃ রানী ভবানীর আগমনের আগে থেকেই বিরাজিত ছিল।
রানী ভবানী ও নাটোর রাজবংশ-প্রতিষ্ঠিত মন্দিরগুলিকে স্থাপত্য অনুসারে চারভাগে ভাগ করা যায়- ১) এক বাংলা বা দোচালা মন্দির, ২) চারচালা মন্দির, ৩) দালান মন্দির ও ৪) উল্টান পদ্মের আকার বিশিষ্ট চূড়াসমন্বিত অষ্টকোণ মন্দির। এগুলির মধ্যে প্রথম তিনটি বিভাগের মন্দিরগুলির স্থাপত্যরীতি বাংলাদেশের নিজস্ব স্থাপত্যরীতি। চতুর্থ বিভাগের মন্দিরগুলির স্থাপত্য অভিনব ও মুর্শিদাবাদের নিজস্ব। প্রথম তিন ধরনের মন্দির বাংলার সর্বত্র নির্মিত হয়েছে। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণির মন্দির দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া একমাত্র মুর্শিদাবাদ জেলাতেই দেখা যায়, তাও আবার কান্দি মহকুমায় এধরনের মন্দির নাই। মুর্শিদাবাদে বহরমপুর, লালবাগ ও জঙ্গীপুর মহকুমায় এধরনের বহু মন্দির আছে। মুর্শিদাবাদের বাইরে রাজশাহী, পাবনা প্রভৃতি জেলায় দু’একটি মাত্র দেখা যায়। সেগুলিও নাটোর রাজাদের কীর্তি বলেই মনে হয়।
রামেশ্বর মন্দির:-
বড়নগরের নাটোর রাজবংশ-নির্মিত প্রাচীনতম মন্দিরটি একটি বৃহৎ চারচালা মন্দির, নাম ‘রামেশ্বর’। (নামান্তরে রামানাথেশ্বর) নির্মাণকাল ১৬৬৩ শকাব্দ বা ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দ। মন্দিরটি কে নির্মাণ করেছিলেন সঠিক বলা যায় না। তবে নাটোর রাজবংশের প্রথম পুরুষ রামজীবন অথবা তাঁর পুত্র কালিকাপ্রসাদের হতে পারে। ‘রামেশ্বর’ শিব যে রামজীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত এবিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই। মন্দিরের সম্মুখভাগ এককালে অতি উচ্চাঙ্গের পোড়ামাটির (Terracotta) অলঙ্করণে সজ্জিত ছিল। কিন্তু সম্মুখস্থ খিলানের যাবতীয় অলঙ্করণ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তবু মন্দিরগাত্রে এখনও যেগুলি অবশিষ্ট আছে সেগুলির মূল্যও কম নয়। মন্দিরের দু’পাশে দুটি করে মোট চারটি সারিতে (Panel) অতি সুন্দর পোড়া মাটির অলঙ্করণ এখনও বর্তমান। বাঁদিকে ভিতরের সারিতে কৃষ্ণলীলা ও ডানদিকের ভিতরের সারিতে রামলীলা অতি সুন্দরভাবে রূপায়িত হয়েছে। এছাড়াও আছে দশাবতার, সপ্তমাতৃকা, গরুড়ারূঢ় বিষ্ণু, বৃষবাহন শিব, সপরিবার দুর্গা প্রভৃতি দেব-দেবীর মূর্তি। প্রত্নতত্ত্ববিভাগ এই মন্দিরটিকে সংরক্ষিত ঘোষণা না করায় প্রখ্যাত মন্দির বিশেষজ্ঞ ডেভিড্ ম্যাকাচ্চন পরম বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। মন্দিরাভ্যন্তরে বিশাল শিবলিঙ্গটিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মন্দিরটি পরিত্যক্ত ও পার্শ্বস্থ অধিবাসীদের নানাবিধ প্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানেই আশে পাশে আরও চারটি অতি সাধারণ ক্ষুদ্রাকৃতি চারচালা মন্দির আছে। এই পাঁচটি ছাড়া আর চারচালা মন্দির বড়নগরে নাই। এই মন্দিরগুলি বড়নগরের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে ভাগীরথী থেকে অনেকটা দূরে অবস্থিত।
রাজরাজেশ্বরী মন্দির:-
রাজবাড়ীর কিছুটা দক্ষিণে ‘রাজরাজেশ্বরী’ ভবন। এটি রাজবংশের ঠাকুরবাড়ি। বিরাট এলাকা নিয়ে এই ঠাকুরবাড়ি। উত্তরদিকে দীর্ঘ দালান মন্দির বা ‘ঠাকুর-দালান’। পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণদিকে নাটমন্দির, ভোগমন্দির ও অন্যান্য গৃহাদি ছিল কিন্তু সেগুলি বহু পূর্বেই ধ্বংসপ্রাপ্ত। কেবল উত্তরদিকে রাজরাজেশ্বরী’ মন্দিরটি জীর্ণাবস্থায় এখনও টিকে আছে। ঠাকুরবাড়ির উত্তর পূর্বদিকের প্রবেশ দ্বারটিও এখনও পর্যন্ত কোনরকমে দাঁড়িয়ে আছে। রাজরাজেশ্বরী-ভবনের স্থাপত্যের কোন বৈশিষ্ট্য নাই, একটি সাধারণ একতলা দালান মাত্র। কোন ভাস্কর্যও নাই। মুর্শিদাবাদের অন্যান্য জমিদারবাড়ির ‘ঠাকুরবাড়ি’র তুলনায় নিতান্ত নিষ্প্রভ। মন্দিরাভ্যন্তরে রাণীভবানী-প্রতিষ্ঠিত অষ্টধাতুনির্মিত সিংহবাহিনী দশভুজা রাজরাজেশ্বরী মূর্তি। মূর্তিটি কিছুদিন পূর্বে অপহৃত হয়েছিল, পুনরায় উদ্ধার করা হয়েছে। রাজরাজেশ্বরীর বাঁ দিকে (পূর্বদিকে) রাজা রামজীবন প্রতিষ্ঠিত ‘জয়দুর্গা’ ও ভবানীর পিত্রালয় থেকে আনীত ‘করুণাময়ী’ মূর্তি।
উভয় মূর্তিই দশভূজা দুর্গার ও পিতল নির্মিত। এ মন্দিরে রক্ষিত মদনগোপাল ও হয়গ্রীব মূর্তি-দুটির কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
গোপাল মন্দির:-
রাজ রাজেশ্বরী মন্দিরের অব্যবহিত উত্তরে রাণী ভবানীর বিধবা কন্যা তারাদেবীর প্রতিষ্ঠিত ‘গোপাল’ মন্দির। বাল্যবিধবা ও নিঃসন্তানা তারা মায়ের সঙ্গে বড়নগরেই বসবাস করতেন। গোপাল মন্দিরটিও একটি বিরাট চত্বরের উত্তরদিকে অবস্থিত। এটিও দালান মন্দির কিন্তু এখন ভগ্নস্তুপে পরিণত। মন্দিরের গর্ভগৃহটির (অভ্যন্তর ভাগ) অবস্থান এখনও অনুভব করা যায়। মন্দির প্রাকারের বাইরে প্রবেশদ্বারের পাশে স্তম্ভের উপর স্থাপিত একটি সুন্দর দ্বিতল দোলমঞ্চ আছে। সেটির স্থাপত্যে তৎকালিন ইউরোপীয় স্থাপত্যের প্রভাব পড়েছে। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়, ইংরেজ অধিকারের পর বংলার গৃহ ও মন্দির স্থাপত্যে ব্যাপকভাবে ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতির প্রচলন হয়। প্রধানতঃ উনিশ শতকে বাংলার জমিদারবাড়ি এবং বহুক্ষেত্রেই তাঁদের ঠাকুর দালান এই স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত হয়। দোলমঞ্চটি অত্যন্ত জীর্ণ। প্রবেশ পথের দুপাশে দুটি অষ্টকোণ উল্টান পদ্মের মত চূড়া বিশিষ্ট শিবমন্দির। নাম ‘তারেশ্বর’ গোপাল মন্দিরের কৃষ্ণপ্রস্তর নির্মিত অতি মনোরম গোপাল মূর্তিটি (বাল গোপাল বা নাড়ুগোপাল) বর্তমানে রাজবাড়িতে ঠাকুর ঘরে রক্ষিত ও পূজিত। মন্দিরটি নির্মিত হয় ১৭০০ শকাব্দ অর্থাৎ ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে।
গোপাল মন্দির এবং রাজবাড়ির মধ্যস্থলে রাজা রামকৃষ্ণের ‘পঞ্চমুণ্ডি’ আসন বর্তমান বলে জনশ্রুতি।
দয়াময়ী কালী:-
গ্রামের উত্তরপ্রান্তে ‘রামেশ্বর’ মন্দিরের নিকটেই ভাগীরথীর সন্নিকটে ‘দয়াময়ী’ কালী মন্দির। কালীর সুন্দর নাতিউচ্চ দালান মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে গেছে। কেবল বেদিটি এবং দক্ষিণ দিকের বারান্দা ও দু-একটি অলঙ্কৃত স্তম্ভমাত্র বর্তমান। মন্দির পাশ্চাত্য নব্য-ধ্রুপদীরীতিতে (Western neo-classical style Mc-cutchion) নির্মিত হয়েছিল। পোড়া মাটির পরিবর্তে ব্যাপকভাবে চূর্ণ বালিতে নির্মিত (Stucco) ও অন্যান্য দৃশ্যাবলীর অলঙ্করণ ছিল। তার কিছু নিদর্শন অবশিষ্ট দেওয়াল এবং স্তম্ভগাত্রে আজও দেখা যায়। অতি সুন্দর দয়াময়ী মূর্তিটিও অপহৃত। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা রামকৃষ্ণের পরম বন্ধু ব্রহ্মানন্দ নামক জনৈক সন্ন্যাসী। মন্দিরটি এখন একটি পরিবারের বাসগৃহে পরিণত হয়েছে।
দয়াময়ী মন্দিরের উত্তরে দেওয়ান দয়ারামের স্থাপিত গোপাল মন্দির ও মূর্তির কথা নিখিল রায় তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু এখন তার চিহ্নমাত্র নাই।
বড়নগরে পাঁচটি এক বাংলা ও একটি জোড় বাংলা মন্দির আছে। দক্ষিণ প্রান্তে ভাগীরথীর তীরে এক বাংলা মন্দিরটি পঞ্চানন শিবের। খিলানের ওপর যুদ্ধদৃশ্য ও কোণের কিন্নর মূর্তি ছাড়া এতে পোড়ামাটির কোনো অলংকরণ নেই। এর প্রতিষ্ঠালিপি পাওয়া যায়নি। তবে ১৯৪০ সালে আজিমগঞ্জের ধনী ব্যবসায়ী ধনুলাল নওলাক্ষা এটির সংস্কার করেন, সে তথ্য মন্দিরে বিরাজমান।
চারবাংলা:-
বড়নগরের ‘চারবাংলা’ মন্দিরগুচ্ছটি ভাস্কর্যের দিক থেকে মুর্শিদাবাদে অতুলনীয়। প্রতিটি মন্দিরেই তিনটি করে প্রবেশদ্বার ও প্রত্যেকটি দ্বারের দু’পাশে সুন্দর কারুকার্যময় স্তম্ভ ও উপরে তিনটি করে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। এগুলির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা যথাক্রমে ৩১, ১৫ ও ১৬১/ ফুট এবং ভিত্তির উচ্চতা প্রায় ৫ ফুট। উত্তরের দক্ষিণমুখী মন্দিরটির অলংকরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। পৌরাণিক দেবদেবী, পৌরাণিক যুদ্ধদৃশ্য,
রামলীলা, কৃষ্ণলীলা অঙ্কিত আছে। বামদিকের খিলানে আছে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা, মধ্যস্থলে রাম-রাবণের যুদ্ধ এবং ডানদিকের খিলানে কৃষ্ণের কংসবধ। এর পূর্বদিকের দেওয়ালে ধ্যানমগ্ন মহাদেবের অপরূপ মূর্তি আছে। স্তম্ভগুলিতে ও খিলানের দুই দিকে শতাধিক সারিতে অসংখ্য মূর্তি ও দৃশ্যাবলি খোদিত আছে। এর মধ্যে বরাহ অবতারের মূর্তি বা পাল্কী বাহনের মূর্তি দুটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পূর্বদিকের মন্দিরের অলংকরণ অপেক্ষাকৃত কম। এখানে পোড়ামাটির অলংকরণের বদলে চুনবালির সূক্ষ্ম অলংকরণ বা পঙ্কের কাজ লক্ষ্য করা যায়।
দক্ষিণ দিকের মন্দিরে তেমন অলংকরণ নেই, প্রতিষ্ঠানলিপি অনুসারে এই মন্দিরগুচ্ছ রাণী ভবানী ১৭৬০ সালে গড়ে তোলেন।
জোড়বাংলা:-
রাণী ভবানী একটি অপূর্ব জোড়-বাংলা মন্দিরও স্থাপন করেন, যা হলো ‘গঙ্গেশ্বর’ শিবমন্দির। রাণী তাঁর গুরুদেব রুদ্রনাথের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যই এই মন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন বলে ড. বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত। এই মন্দিরে রয়েছে তিনটি খিলান ও তিনটি শিবলিঙ্গ। মন্দিরের সম্মুখভাগের স্তম্ভ ও খিলানগুলি অতি উৎকৃষ্ট পোড়ামাটির অলংকরণে সমৃদ্ধ। এখানে দশমহাবিদ্যা, সিংহের মুখ ও অন্যান্য দৃশ্যাবলি খোদিত হয়েছে। এর স্থাপত্য ও ভাস্কর্য এতই সুন্দর ছিল যে বিশিষ্ট পন্ডিত ডেভিড ম্যাককাচ্চন তাঁর ‘Late Mediaeval Temples of Bengal’ বইয়ের প্রচ্ছদ হিসেবে এটিকে ব্যবহার করেন।
ভবানীশ্বর :-
স্থাপত্যের দিক দিয়ে বড়নগরের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ বিশাল সুউচ্চ ‘ভবানীশ্বর’ মন্দির। এই মন্দিরের স্থাপত্য অভিনব ও অনন্য সাধারণ। অষ্টকোণ অতি উচ্চ মন্দিরটির চূড়ার সর্বোচ্চ অংশটি একটি পদ্মের উল্টান চাকির মত। চূড়া থেকে নেমে আসা একটি বিশাল পদ্মের আটটি পাপড়ি আটদিকে বিস্তৃত। পাপড়িগুলির ঠিক উপরে সমগ্র চূড়াটিকে বেষ্টন করে ছোট ছোট পাপড়িগুলি বিপরীত দিকে ঘোরান। প্রতিটি বড় পাপড়ির প্রান্ত থেকে আটটি বাঁকান-কার্ণিশযুক্ত চাল নেমে এসে মন্দিরের ছাদটি নির্মাণ করেছে। চূড়াটি নির্মিত হয়েছে গম্বুজ নির্মাণ পদ্ধতিতে এবং আকারও অনেকটা গম্বুজের মতই। এ পদ্ধতি মুসলিম স্থাপত্য রীতিদ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত। পূর্বে এদেশে মন্দিরের চূড়া নির্মিত হত ধাপে ধাপে ইঁট গেঁথে ক্রমশঃ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর করে শেষে একটি বিন্দুতে মিলিত করে। এ পদ্ধতিকে ধাপ পদ্ধতি (Corbel) বলা যায়। কিন্তু পরবর্তীকালে মুসলিম স্থাপত্যের প্রভাবে দেওয়ালের কোণে লহরার (Squinch) বিন্যাস করে অষ্টকোণ বা বৃত্তাকার গম্বুজদ্বারা মন্দিরের চূড়া নির্মাণ করা হতে থাকে। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত গোকর্ণের নৃসিংহদেবের অতি প্রাচীন চারচালা মন্দিরের চূড়া নির্মাণেও এই লহরার উপর গম্বুজ নির্মাণ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। মধ্যযুগের শেষ পর্বে প্রায় সকল চারচালা, আটচালা এবং রত্নমন্দিরের চূড়াগুলি এইভাবেই নির্মাণ করা হয়েছে। তবে ভবানীশ্বর মন্দিরের চূড়া চারচালা বা রত্নমন্দিরের মত ক্রমশঃ সূক্ষ্ম করা হয়নি, একটি উল্টান পদ্মের আকার বিশিষ্ট অষ্টকোণ গম্বুজের রূপ দেওয়া হয়েছে। ডেভিড ম্যাককাচ্চন এই রীতিকে বলেছেন উল্টান পদ্মের মত গম্বুজ বিশিষ্ট (inverted Lotus domed)। এই রীতির উদ্ভব মুর্শিদাবাদে, আঠার শতকে। MC Cutchion এই পদ্ধতিকে বলেছেন ‘হিন্দুস্থাপত্যে মুসলিম গম্বুজের পরিগ্রহণ” (Hindu adaptation of the Muslim dome)। মনে হয় এই ‘পরিগ্রহণ’ সজ্ঞানে এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয়েছে। রাণী ভবানীর (এই ধরনের মন্দির বিশেষ প্রিয় ছিল এবং মুর্শিদাবাদ ও রাজশাহী অঞ্চলে তাঁর বিশাল জমিদারির নানা স্থানে এই ধরনের মন্দির বহু সংখ্যায় নির্মিত হয়েছে। পরবর্তী কালেও এই ধরনের মন্দির মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর, লালবাগ ও জঙ্গীপুর মহকুমায় ব্যাপকভাবে নির্মিত হয়। এই ধরনের মন্দির বাংলার সামান্য কয়েকটি জায়গা ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। সেইজন্য এই রীতিকে মুর্শিদাবাদ রীতির (Murshidabad type) মন্দির বলা যায়।
অষ্টকোণ মন্দিরটির আট দিকেই ঘেরা বারান্দা এবং একটি করে প্রবেশদ্বার আছে। প্রধান প্রবেশ দ্বারটি দক্ষিণমুখী। মন্দিরের উচ্চতা প্রায় আশি ফুট। এটি মুর্শিদাবাদের সর্বোচ্চ মন্দির তো বটেই, সমগ্র বাংলায় এত উঁচু মন্দির খুব কমই আছে। ভিতরের শিবলিঙ্গটিও বিশাল। মন্দিরটি যে রাণী ভবানীর কত প্রিয় ছিল তা এটির নামকরণ থেকেই বোঝা যায়। বস্তুতঃ বিশাল আকার এবং নিখুঁত স্থাপত্যও এই মন্দিরের প্রাধান্য ঘোষণা করছে।
তবে স্থাপত্যের তুলনায় এ মন্দিরের ভাস্কর্য ততটা উন্নত ধরনের নয়। অলঙ্করণে পোড়ামাটির ইঁটের বদলে এখানে চুন-বালির অলঙ্করণ (পঙ্ক বা পন্থের কাজ) ব্যবহৃত হয়েছে এবং খুব স্বাভাবিক কারণেই এগুলি চারবাংলা মন্দিরের অলঙ্করণের উচ্চতম দক্ষতা স্পর্শ করতে পারেনি। কারণ সেই সময়ে পোড়ামাটির অলঙ্করণ বাংলার সর্বত্র অতি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং বাংলার বিভিন্ন স্থানে এই পোড়ামাটির ইট তৈরি করার শিল্পকেন্দ্র ও উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। সুতরাং পোড়ামাটির অলঙ্করণ ব্যক্তিগত দক্ষতার পর্যায় অতিক্রম করে ব্যবসায়িক ও পেশাগত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। প্রয়োজনীয় ভাস্কর্য সমন্বিত ইঁট বরাত দিয়ে বাইরের উৎপাদন কেন্দ্র থেকেও আনা যেত বা ইট তৈরি করার অজস্র পেশাদার শিল্পী ও শ্রমিক থাকায় তাদের আনিয়ে নিয়ে ইচ্ছেমত উন্নতমানের ইট তৈরি করা যেত। কিন্তু চুন-বালির কাজে (পন্থের কাজ) শিল্পী বা রাজমিস্ত্রির ব্যক্তিগত দক্ষতা প্রয়োজন। সুনিপুণ ভাস্কর ছাড়া একাজ সম্ভব নয়। বিশেষ করে অতটা উঁচুতে চুনবালির কাজ করার মত দক্ষ ভাস্কর শিল্পী খুব কমই পাওয়া যেত। ফলে চুন-বালির অলঙ্করণগুলির জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পেশাদার রাজমিস্ত্রিদের উপরেই নির্ভর করতে হত। ‘ভবানীশ্বর’ বা পরবর্তীকালে নির্মিত মন্দিরগুলির প্রায় সর্বত্রই (অন্ততঃ মুর্শিদাবাদ জেলায়) এই জন্য পঙ্কের কাজ খুব একটা উচ্চমানে পৌঁছতে পারে নি। একমাত্র ব্যতিক্রম কাশিমবাজারের বড় রাজবাড়ির লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের কাজ। তবুও মূর্তি ভাস্কর্যগুলি যে অন্যান্য কাজের সমপর্যায়ে পৌঁছায়নি তাও লক্ষ্য করা যায়। হাজারদুয়ারি
প্রাসাদের ‘দরবারকক্ষেও অতি উৎকৃষ্টমানের পঙ্কের কাজ আছে। তবে মনে রাখতে হবে এইগুলি প্রায় শতাব্দী কাল পরে নির্মিত হয়েছে। তখন পঙ্কের কাজের দক্ষ শিল্পী গোষ্ঠির আবির্ভাব হয়েছে।
যাইহোক ভবানীশ্বর মন্দিরের কাজগুলিও সেদিনের বিচারে কম আকর্ষণীয় নয়। দক্ষিণমুখী প্রধান প্রবেশদ্বারের খিলানের উপরে মধ্যস্থলে রাধাকৃষ্ণ, ডান ও বাঁ পাশে যথাক্রমে হস্তির সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ ও অপ্সরা মূর্তি। দ্বিতীয় খিলানে এইভাবে রাধাকৃষ্ণ, কালীয়দমন এবং বস্ত্রহরণ। পূর্বদিকে অর্থাৎ তৃতীয় খিলানে গৌরাঙ্গ ও দুটি বৈষ্ণব মূর্তি। উত্তর-পূর্বে তিনটি দীর্ঘকেশ পুরুষ মূর্তি। উত্তরে কালী মূর্তি, অস্ত্রধারী নারী ও পুরুষ মূর্তি। উত্তর-পশ্চিমে বৃষারূঢ় মহাদেব, বামে পুরুষ মূর্তি, দক্ষিণের সম্ভবতঃ নারীমূর্তিটি বর্তমানে লুপ্ত। পশ্চিম কোণে রামচন্দ্র, বামে হনুমান, দক্ষিণে পদ্মাসনে উপবিষ্ট মূর্তিটির মস্তক ভগ্ন। দক্ষিণ পশ্চিমে অসুর নিধনরতা সিংহবাহিনী দুর্গা, বামে স্ত্রী ও দক্ষিণে পুরুষ মূর্তি। প্রধান প্রবেশদ্বারের খিলানটি নানা দেব দেবীর মূর্তিতে আকীর্ণ।
এই পর্যায় অনুসারে অপরাপর খিলানে অঙ্কিত দৃশ্যাবলি নীচের সারণীতে বর্ণিত হলো –
খিলান —– বামপার্শ্ব—— মধ্যস্থল ——ডানপার্শ্ব
দ্বিতীয় খিলান—-বস্ত্রহরণ—রাধাকৃষ্ণ—কালীয়দমন
তৃতীয় খিলান—বৈষ্ণব মূর্তি–গৌরাঙ্গ—বৈষ্ণব মূর্তি
উত্তর-পূর্ব খিলান–দীর্ঘকেশ পুরুষ–দীর্ঘকেশ পুরুষ
উত্তর খিলান—পুরুষ মূর্তি—-কালী—অস্ত্রধারী নারী
উত্তর-পশ্চিম খিলান-পুরুষ মূর্তি–বৃষারুঢ় মহাদেব-নারী মূর্তি (বর্তমানে বিলুপ্ত)
পশ্চিম খিলান–হনুমান–রামচন্দ্র–ভগ্ন-মস্তক পদ্মাসনে উপবিষ্ট মূর্তি
দক্ষিণ-পশ্চিম খিলান–নারী মূর্তি–সিংহবাহিনী দুর্গা-
পুরুষ মূর্তি।
মন্দিরের নির্মাণকাল প্রত্ন তত্ত্ব বিভাগের পরিচয়লিপি অনুসারে ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু নিখিলনাথ রায় কৃত ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ গ্রন্থে বলা হয়েছে মন্দিরের নির্মাণ কাল ১৬৭৫ শক বা ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দ। একই সময়ে রাণী ভবানী কাশী ধামেও একটি ‘ভবানীশ্বর’ মন্দির নির্মাণ করেন। প্রতিষ্ঠালিপি অনুসারে কাশীর মন্দিরের নির্মাণকাল ১৬৭৫ শকাব্দ। এ মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপি না থাকায় এ মন্দির এবং কাশীর মন্দির একই সময়ে নির্মিত হয়েছে কিনা সুনিশ্চিতভাবে বলা যায় না। সুতরাং কাশীর মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ও বড়নগরের মন্দির প্রতিষ্ঠা একই সময়ে হয়েছে বলে নিখিলনাথ রায় যে অনুমান করেছেন তা যুক্তিসিদ্ধ নয়। তাছাড়া প্রত্নতত্ত্ববিভাগ নিঃসন্দেহ হয়েই যে ঐ তারিখ নির্ধারণ করেছেন তা ধরে নিতে পারা যায়। সুতরাং ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দই মন্দির প্রতিষ্ঠার সময়রূপে অধিকতর গ্রহণযোগ্য।
বড়নগরে আরও তিনটি এই ধরনের মন্দির ছিল। গোপাল মন্দিরের প্রবেশপথের দু’দিকে ‘তারেশ্বর’ মন্দিরগুলির কথা আগেই বলা হয়েছে। ঐ মন্দির দুটির বৈশিষ্ট্য হল মন্দিরের সম্মুখে একটি করে ঢাকা বারান্দা (Porch)। চতুর্থ মন্দিরটি বর্তমানে লুপ্ত।
বড়নগরের মন্দিরগুলি মুর্শিদাবাদের গর্ব। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অধিকাংশ মন্দিরই বর্তমানে হয় লুপ্ত নতুবা ধ্বংস্তুপে পরিণত। কেবলমাত্র চারবাংলা, ভবানীশ্বর এবং গঙ্গেশ্বর মন্দিরগুলি প্রত্নতত্ত্ববিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত ও কিছুটা সংস্কৃত। সেজন্য ঐগুলি আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে আপাততঃ রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু সরকারি ব্যবস্থা সত্ত্বেও উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এগুলির অবস্থাও তেমন আশাপ্রদ নয়। বিশেষ করে চারবাংলা মন্দিরের অতি উন্নতমানের পোড়ামাটির কাজগুলি যেভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তা অতীব বেদনাদায়ক এবং আশঙ্কাজনক। তাছাড়া ভাগীরথীর ভাঙ্গনে চারবাংলা মন্দিরটি সাংঘাতিকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে কেবল সরকারি ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়, স্থানীয় জনসাধারণ ও পর্যটক এবং সাধারণভাবে মুর্শিদাবাদ জেলার অধিবাসীদেরও কর্তব্য আছে। যদি অবহেলায় এবং অব্যবস্থায় বড়নগরের ধ্বংসাবশিষ্ট এই অমূল্য মন্দিরগুলিও নষ্ট হয়ে যায় তবে মুর্শিদাবাদবাসী তথা বাংলার রসিকজনকে স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও শিল্পকলার এক পরমসম্পদ হারাতে হবে।
পরিশেষে জানাই এক অত্যন্ত সুখবর, দেশের মধ্যে সেরা পর্যটন গ্রামের (Best Tourism Village) শিরোপা জিতে নিয়েছে মুর্শিদাবাদের (Murshidabad) জিয়াগঞ্জ ব্লকের লালবাগ মহকুমার অন্তর্গত ছোট্ট এই গ্রাম বড়নগর (Baranagar village)। নবগ্রামের কিরীটেশ্বরীর পর এবার দেশের সেরা পর্যটন গ্রাম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে তাকে। কেন্দ্রের পর্যটন মন্ত্রকের কৃষি-পর্যটন বিভাগে এই শিরোপা পেয়েছে এই গ্রাম। এজন্য কেন্দ্র সরকারকে অন্তর থেকে জানাই ধন্যবাদ।
গ্রন্থ সহায়তা-
১।নিখিলনাথ রায় – মুর্শিদাবাদ কাহিনী
২। R.C.Majumder – History of Mediaeval Bengal
৩। David J.Mc Cutchion, ক) Late Mediasval Temples of Bengal, খ)Notes on some old temples and mosque in Murshidabad District -District Hand Book, Census 1961.
৪)মুর্শিদাবাদের মন্দির – বিজয় কুমার বন্দোপাধ্যায়
৫)ডিস্ট্রিক্ট্র গেজেটিয়ার রাজশাহী এল.এস.এস.ও.ম্যালি
৬) মুর্শিদাবাদ অনুসন্ধান ৪র্থ খন্ড।
(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)