প্রবল মুসলিম বিদ্বেষ ছাড়াও ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাস এবং দেশবন্দনার মহাসংগীত ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীত ও ধ্বনির বিরুদ্ধে পৌত্তলিকতার অভিযোগ উঠেছে। বলা হয় যে, ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীত ‘আনন্দ মঠ’-এর মুসলিম বিদ্বেষের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই সংগীতে দেশকে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবীর সঙ্গে এক করে দেখানো হয়েছে। সংগীতে বলা হচ্ছে :
ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী
কমলা কমলদলবিহারিণী
বাণী বিদ্যাদায়িনী
নমামি ত্বাং।
দেশকে হিন্দু দেবী দশপ্রহরণধারিণী দুর্গা, কমলদলবিহারিণী কমলা বা লক্ষ্মী এবংবিদ্যাদায়িনী বাণী বা সরস্বতী বলা হয়েছে। এই গানে পৌত্তলিকতা বিদ্যমান—এর মধ্যে প্রতীক পূজার কথা বলা হয়েছে। এসব কোনো মুসলিমের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু এর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা কোথায়, হিন্দুদের দেবীর বন্দনাই বা কোথায়? বলা হচ্ছে যে, সন্তানদলের জীবন-যৌবন, কামনা-বাসনা, সুখ-শান্তি এক লক্ষ্যাভিমুখী এবং তা হল দেশমাতৃকার মুক্তি। দেশই তাঁদের মা, একমাত্র ঈশ্বর, দেশই দুর্গা, কালী ও জগদ্ধাত্রী এবং দেশচর্চাই তাঁদের একমাত্র ধর্ম। এর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা কোথায়? দেশচর্চার এমন তুলনাহীন নজির বিশ্বের আর কোথাও নেই। পৌত্তলিকতার জয়গান নয়—হিন্দু দেবদেবী অপেক্ষা দেশই যে শ্রেষ্ঠ সে কথাই ‘আনন্দ মঠ’ ও ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীতে পরিস্ফুট হয়েছে। ড. রেজাউল করীম বলছেন যে ,
“ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী’ হইতে আরম্ভ করিয়া সঙ্গীতের সর্বশেষ কলিটির বিরুদ্ধে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক আপত্তি উঠিয়াছে। বলা হইতেছে—কোন মুসলমানই ইহা গাহিতে বা বলিতে পারে না। কিন্তু জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি, যাঁহারা এরূপ অভিযোগ করেন, তাঁহারা এই কলিগুলির অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিবার একটুও প্রয়াস পাইয়াছেন? এই কলিগুলিতে কি আছে? ইহার অর্থ যদি এই হয়—
মাতঃ দুর্গে, মাতঃ লক্ষ্মী, মাতঃ সরস্বতী! তোমায় আমি পূজা করি, তোমায় আমি বন্দনা করি, স্তব করি, তবে বলিব নিশ্চয়ই ইহা মুসলমানের নিকট আপত্তিকর। কিন্তু উহাতে এরূপ কোন কথাই বলা হয় নাই। ইহা পৌত্তলিকতার জয়সূচক বাণী নহে। পৌত্তলিকতার মহিমার গানও ইহা নহে। হিন্দু দেব- দেবীর স্তুতিবাদও ইহা নহে। বরং ইহা প্রকারান্তরে পৌত্তলিকতার প্রতি বক্রোক্তি, হিন্দুর দেব-দেবীর প্রতি ব্যঙ্গের ইঙ্গিত। ইহাতে দেশ-মাতাকে দেব-দেবী অপেক্ষাও বড় বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। হিন্দুরা যে দেব-দেবী, দুর্গা, কমলা, ও বাণী দেবীর পূজা করেন, এই সঙ্গীতে বলা হইয়াছে, তদপেক্ষাও বড় হইতেছে দেশ-মাতা। দেব-দেবী অপেক্ষা আমার কাছে বড় দেশ,—দেশই আমার দুর্গা, দেশই আমার লক্ষ্মী, দেশই আমার
সরস্বতী। এই ভাবটাই অতি পরিষ্কার ভাবে ও দৃপ্তকণ্ঠে ইহাতে ঘোষণা করা হইয়াছে। উহারা আমার নিকট কিছু নয়—দেশই আমার নিকট সব—সব সাধনার শ্রেষ্ঠ ধন। তিনি বলছেন—“আজ মুসলমানগণ ‘বন্দেমাতরমে যে আপত্তি করিতেছেন, অর্থের দিক দিয়া তাহা অযৌক্তিক। কিন্তু পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী ও তেত্রিশ কোটী দেবতার পূজক হিন্দুগণ যদি ইহাতে আপত্তি করেন, তবে তাহা কতকটা শোভা পায়। তাঁহারা হয়ত বলিতে পারেন, কি ! দেবতা আমার কিছুই নয়, দুর্গা আমার কিছুই নয়, দেশ আমার সব!—না, তাহা হইতে পারে না, দেশ অপেক্ষা দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতীই আমার (হিন্দুর) নিকট অধিক বড়।
কিন্তু তাঁহারা সেরূপ কোন আপত্তি করেন নাই, দেশমাতাকে দেবতারমতই পূজা করিতে, ভক্তি করিতে সম্মত হইয়াছেন। দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতীর সিংহাসনে দেশ-মাতাকে বসাইয়া তাঁহারা উহারই বন্দনা করিতেছেন। ত্বং হি দুর্গা ইত্যাদি যে দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতীর পূজা নয়, বরং দেশ-মাতৃকারই বন্দনা, তাহা ‘আনন্দমঠের’ মহেন্দ্রের আচরণ হইতে বুঝা যাইবে। মহেন্দ্রের সম্মুখে যখন এই মায়ের বর্ণনা করা হইল, তখন তিনি স্তম্ভিত হইয়া গেলেন, বলিলেন, “এ ত দেশ, এ ত মা নয়!” হিন্দুর জ্ঞান, বিশ্বাস, সংস্কার ও ধর্ম্মমত অনুযায়ী মহেন্দ্র ঠিক কথাই বলিয়াছিলেন, সন্ন্যাসীরা যে স্তোত্র গাহিতেছিল, তাহা দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতীর স্তোত্র নয়—তাহা দেশের স্তোত্র। তাঁর মতে—“নিরপেক্ষ কোন লোকই ‘বন্দেমাতরম্’ সঙ্গীতকে পৌত্তলিক বলিয়া অভিহিত করিবেন না। কারণ ইহার মূল উদ্দেশ্য পৌত্তলিকতার জয় ঘোষণা করা নয়। বরং পৌত্তলিকদের পূজার আস্পদ দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতী অপেক্ষা দেশ-মাতাই যে বড়,
এই সঙ্গীতে তাহারই ইঙ্গিত দেওয়া হইয়াছে।”
ডঃ. রাজেন্দ্র প্রসাদ-এর মতে, “এই গানে মূর্তিপূজার কোনো নির্দেশ নেই (“It did not urge idol worship”)। তিনি বলছেন যে, “এখানে দুর্গা কোনো দেবীর মূর্তি নয়। দুর্গা এখানে দেশমাতৃকার নামান্তর মাত্র।” (“Durga did not mean any idol but was another name for the mother country”.)। জওহরলাল নেহরু বলেন যে,
“আমার মতে সমগ্র সঙ্গীতটির ভাব ও ভাষা সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং এর অর্থ সম্বন্ধে কারো কোনো আপত্তি হওয়া উচিত নয়।” (I think that the whole song and all thewords in it are thoroughly harmless and nobody can take exception to their meaning”.)। মৌলানা সৈয়দ ফজলুল রহমান বিহারের মুসলিম সমাজকে বলেন যে, এই গানটির মধ্যে ‘বাত-প্ৰুস্তি’ (‘does not smack of But-Prusti’) অর্থাৎ মূর্তিপূজার
কোনও কথা নেই। গানটি ‘ওয়াতন’ বা মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ মাত্র (‘an
expression of the love of Watan.’) বস্তুতঃ ‘বন্দে মাতরম্’ গান হিন্দু ধ্যান-ধারণা ও সংস্কারের পরিপন্থী, এবং যে-কোনো নিষ্ঠাবান হিন্দুর কাছে এই সংগীত চরম ধর্মদ্রোহিতা। বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্য সমালোচক
মোহিতলাল মজুমদার-এর মতে : ‘বন্দেমাতরম্’-গানে হিন্দুর ধর্ম্মঘটিত সংস্কারে আঘাত লাগিবারই কথা—সে গানের ভাষা মাত্র হিন্দু, হিন্দুয়ানির লেশমাত্র তাহাতে নাই। দেশকে দেবতা কল্পনা করিয়া তাহাকেই একমাত্র আরাধ্য দেবতা বলিয়া ঘোষণা করা হিন্দু সংস্কার বিরুদ্ধ ; কেবল তাহাই নয়, শক্তি-উপাসক হিন্দুর ইষ্টদেবতার নাম তাহাতে আরোপ করা, এবং অন্য কোনও ঐ নামে দেবতার অস্তিত্ব অস্বীকার করা ভক্তসাধকের পক্ষে যে কতখানি ক্লেশকর—তাহার ধর্ম্মবিশ্বাসে সে যে কত বড় আঘাত, তাহা আমাদের মত হিন্দু বুঝিতে না পারিলেও, যাহারা ‘ধাৰ্ম্মিক’ হিন্দু তাহারা বিলক্ষণ বুঝিতে পারে। তথাপি ‘বন্দেমাতরম্’
গানের ভাষা হিন্দু, তাহার ভাব ও আদর্শ হিন্দু—কিন্তু কোন্ অর্থে? তাহা বুঝিতে পারিলে বঙ্কিমচন্দ্রের এই জাতিপ্রেমমূলক নবধৰ্ম্ম যে সাম্প্রদায়িক নহে, পরন্তু খাঁটি ভারতীয় অর্থে হিন্দু, সে বিষয়ে সন্দেহ করিবার কারণ থাকিবে না।….এই হিন্দুত্ব যদি দোষের হয়, তবে ভারতবাসীর ভারতীয় হওয়াও দোষের, অথচ ইহার চেয়ে সত্য ও স্বাভাবিক জাতীয়তার মন্ত্র তাহার পক্ষে আর কিছুই হইতে পারে না; ইহার বিরুদ্ধ যাহা, তাহাই অসত্য ও অস্বাভাবিক।”রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. মযহারুল ইসলাম জানাচ্ছেন যে, ইসলাম একেশ্বরবাদী ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও ইসলামে প্রতীকবাদ নেই একথা ঠিক নয়। ‘মুছা’ এবং মহম্মদ যে আল্লাহর দর্শন পেয়েছিলেন তিনি নিশ্চয়ই নিরাকার নন। ‘আল্লাহ’ শব্দটিও নিরাকার কোনো অস্তিত্বের সঙ্গে নয়—সাকারের সঙ্গেই জড়িত। ফারসি ‘খোদা’ শব্দটিও প্রতীকবাদী। কোরান এবং হাদিসেও “দেশকে জননী হিসেবে কল্পনা করবার প্রয়াস প্রচ্ছন্নভাবে” বিদ্যমান। তিনি বলেন যে, ইসলাম কোথাও বলেন নি যে, দেশকে জননী হিসেবে চিন্তা করলে নিরাকারত্বে আঘাত লাগবে—এ শিক্ষা গোঁড়া মোল্লাদের। তিনি বলছেন যে, “দেশপ্রেম ইসলাম ধর্মের একটি বড় স্তম্ভ, একটি মহান শিক্ষা। বঙ্কিম বন্দেমাতরম্ সঙ্গীতের মাধ্যমে এদেশের মুসলমানদের সেই শিক্ষাতেই দীক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। দেশকে ভালোবাসা ইমান বা খোদাত্বে বিশ্বাসেরই একটি অঙ্গ, এও ইসলামেরই কথা। বন্দেমাতরমের মধ্যে তারই প্রতিধ্বনি আছে।” নানা উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখান যে, মধ্যযুগের মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্যে প্রতীকত্ব নিয়ে মুসলিমদের
কোনো গোঁড়ামি ছিল না এবং এ সম্পর্কে তিনি বিখ্যাত কবি দৌলত উজির বাহারাম খান,
শা’ বিরিদ খান, দৌলত কাজী, আলাওল প্রমুখের উদাহরণ দিয়েছেন। কেবলমাত্র মধ্যযুগেই নয়, তিনি জানান যে, “একালের মুসলমানগণও বন্দেমাতরমের চেয়েও অনেক বেশী প্রতীকধর্মী-সংগীতকে প্রাণের সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করেছেন।” ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র-সংগীতের মধ্যেও প্রতীকত্ব বিদ্যমান। বাংলাদেশের এককোটি হিন্দুর সঙ্গে আট কোটি মুসলিম দেশকে ‘জননী’ বলে তাঁর চরণে মাথা পেতে দিতে আপত্তি করেননি। ‘সোনার বাংলা’-কে ভালবাসতেও তাঁদের আপত্তি নেই। পৌত্তলিকতার কথা বললে রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতাই অভিযুক্ত হতে পারে।
“তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে
তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে
তোমার এই শ্যামল বরণ কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা
*
*
*
ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।”
বাংলাদেশের হৃদয় হতে বেরিয়ে আসা বঙ্গজননীর মূর্তি গড়েছেন রবীন্দ্রনাথ –
“ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,
দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুন বরণ…।”
অথবা ঃ
“আজি কি তোমার মধুর মুরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে।
হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শোভাতে।……”
এছাড়া, তথাকথিত মূর্তিপূজা বিরোধীদের মধ্যেও তো প্রতীকের প্রচলন দেখা যায়। উপাসনাগৃহে বেদী, স্মারক চিহ্ন, পতাকা, প্রার্থনাকালীন দিগ্নির্দেশ—এ সবের অর্থই বা কী?প্রখ্যাত রেজাউল করীম জানান যে, আরবি ও ফারসি সাহিত্যের বহু কবি দেশকে মা বলেছেন, এবং তাঁদের লেখা পৌত্তলিক-ভাবাপন্ন বহু কবিতা আছে। এ সম্পর্কে তিনি ইকবাল, হাফিজ, রুমী, ওমর খৈয়াম প্রমুখের নাম উল্লেখ করেছেন।২৭ তিনি বলেন, ‘কিউপিড’ (প্রেমের দেবতা’), ‘জোহরা’ (সংগীতের দেবী), ‘আজরাইল’ (মৃত্যুর দূত) এবং
‘মিকাইল’ (বর্ষের দূত) প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করে কেউ যদি পৌত্তলিক না হন, তবে দুর্গা, কমলা, বাণী প্রভৃতি উপমা ব্যবহার করলেও পৌত্তলিক হবার কোনো আশঙ্ক নেই। ২৮ ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীতের প্রধানতম বিরোধী মৌলানা মোহম্মদ আকরম খাঁ তাঁর ‘মুস্তাফারচিত’ গ্রন্থে আরব দেশকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেছেন। রেজাউল করীম বলেন যে, আমাদের সত্যিকারের মাকে মা বলে ডাকলে যদি দোষ না হয়, তাহলে রূপকভাবে দেশকে মা বলে ডাকলে কোনো দোষ হয় না। “দেশ-ভক্তি, দেশ-পূজা, দেশ-বন্দনা,
দেশমাতৃকা একই প্রকার শব্দ ব্যবহার ইসলামের দৃষ্টিতে একটুও নিন্দনীয় নহে। সুতরাং ‘বন্দে মাতরম্’ সঙ্গীত কোন দিক দিয়া ইসলাম-বিগর্হিত কাজ নহে।”২৯ প্রখ্যাত মুসলিম সাহিত্যিক সৈয়দ এসমাইল হোসেন সিরাজির একাধিক রচনায় দেশকে ‘জননী’ বলা হয়েছে। ‘নবনূর’ ‘কোহিনূর’ প্রভৃতি মুসলিম পত্রিকাতেও এ ধরনের কথা দেখা যায়।উনিশ শতকের সেই ঘনান্ধকার দিনে দেশচর্চা যখন একরকম অনুপস্থিত, ধর্মই যখন মানুষের সব—সেই দিনে হিন্দু দেবদেবীর সঙ্গে দেশের একত্ব সাধন করে বঙ্কিমচন্দ্র
ভারতবাসীকে দেশধর্মে দীক্ষিত করতে প্রয়াসী হন। অনেকে অভিযোগ যে, ভারতীয় সন্ন্যাসীদের তিনি আদর্শভ্রষ্ট করে রাজনৈতিক কর্মে নিয়োজিত করেছেন।” রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষে এসব নিশ্চয়ই চরম দুঃসাহসিক কর্ম ও চরমধর্মদ্রোহিতা। আসলে ধর্মের চেয়েও তাঁর কাছে দেশ বড় এবং এজন্যই তিনি এইদুঃসাহসিক কর্মে ব্রতী হয়েছিলেন। ‘আনন্দ মঠ’ ও ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীতে বঙ্কিমচন্দ্রের যে মূর্তি ফুটে উঠেছে তা দেশপ্রেমিকের মূর্তি, ঋষির মূর্তি এবং সংকীর্ণ ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে
বিদ্রোহী যুগস্রষ্টার মূর্তি। ‘বন্দে মাতরম্’-এর ‘সপ্তকোটি কণ্ঠ’ শুধু তো হিন্দুর কণ্ঠ নয়— এর ভেতর মুসলিমও আছেন। দেশ সে দিনই জাগবে—“যবে মা’র সকল সন্তান মা’কে মা বলিয়া ডাকিবে”—মুসলিমদের তিনি বাদ দেন নি। বিভিন্ন প্রবন্ধে বারংবার তিনি হিন্দু- মুসলিম ঐক্যের কথা বলছেন। তিনি বলছেন যে, হাসিম শেখ এবং রামা কৈবর্তদের উন্নতিব্যতীত দেশের উন্নতি হবে না। ‘আনন্দ মঠ’-এ তিনি লিখেছেন যে, ১১৭৬ বঙ্গাব্দের দুর্ভিক্ষে “বাঙ্গালায় বড় কান্নার কোলাহল পড়িয়া গেল”—এ কান্না কি শুধু হিন্দু সমাজের? মহম্মদ রেজা খাঁ “একেবারে দশটাকা রাজস্ব বাড়াইয়া দিল”—এতে কী কেবলমাত্র হিন্দু
প্রজারাই পীড়িত হয়েছিল? ‘আনন্দ মঠ’-এ (১।১০) ভবানন্দ মহেন্দ্রকে বলছেন—“দেখ যত দেশ আছে মগধ, মিথিলা, কাশী, কাঞ্চী, দিল্লী, কাশ্মীর কোন্ দেশের এমন দুর্দশা, কোন্ দেশের মানুষ খেতে না পেয়ে ঘাস খায়….” ইত্যাদি। ভবানন্দ-কথিত সব দেশগুলিই তখন মুসলিম শাসনাধীন। বঙ্কিমচন্দ্র কিন্তু মুসলিম শাসকদের প্রশংসাই করলেন।
জনচিত্তে সাড়া জাগাবার জন্য ধর্ম একটি প্রধান হাতিয়ার। দেশে দেশে রাজনৈতিক আন্দোলনে অতীতে ধর্মকেই ব্যবহার করা হয়েছে, এখনও করা হয়—ভারতবর্ষও তারব্যতিক্রম নয়। ধর্মের নামে মানুষ এদেশেও সাড়া দিয়েছে—তবে অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের পার্থক্য অনেক, এবং ধর্মকে ব্যবহারের সমস্যাও যথেষ্ট। ভারতে নানা ধর্মমতপ্রচলিত, প্রচলিত নানা জাত-পাতের সমস্যা। এ ছাড়া, বঙ্কিম সমসাময়িক যুগে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ (Secularism)-র আদর্শও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয় নি। ধর্মই সেদিন
মানুষের সব। ধর্মান্ধতার সেই দিনে বঙ্কিমচন্দ্র ভারতে যে জাতীয়তাবাদ প্রচার করতে সচেষ্ট হন তাও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, তবে তা হল দেশধর্ম—দেশচর্চাকে সেদিন তিনি ধর্মের স্তরে উন্নীত করেছিলেন। এখানে কোনো প্রকার সাম্প্রদায়িকতা নেই, বিশেষ কোনোসম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত বা বিদ্বেষ নেই—বিদ্বেষ যা আছে তা হল সমকালীন স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে।
তথ্যসূত্রঃ-
১। India Wins Freedom, Abul Kalam Azad, 1967, P. 4.
২। do, P. 4.
৩। গুলিন দাসের আত্মকথা, সম্পাদনা ভবতোষ রায়, ১৯৬৫, পৃঃ ৫৪-৬৪।
৪। বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ, রেজাউল করীম, ১৩৬১, পৃঃ ১১৬-১৭।
৫। ঐ, পৃঃ ১১৭।
৬। ঐ, পৃঃ ১১৮।
৭। Amrita Bazar Patrika, Sept, 27, 1937.
৮। Modern Review, Oct., 1937.
৯। Amrita Bazar Patrika, 9 Oct, 1937.
১০। বঙ্কিম-বরণ, মোহিতলাল মজুমদার, ১৩৮৫, পৃঃ ১২৩-২৪।
১১। শিলাদিত্য, অক্টোবর, ১৯৮১, পৃঃ ৫৯-৬০।
১২। বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ, রেজাউল করীম, পৃঃ ১১২।
১৩। ঐ, পৃঃ ১১৯।
১৪। ঐ, পৃঃ ১১১।
১৫। স্বাধীনতার ফাঁকি, বিমলানন্দ শাসমল, ১৩৭৪, পৃঃ ৩৩-৩৪।