Dr. Syama Prasad Mookerjee Research Foundation

চিনের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে এগিয়ে থাকা প্রাথমিক শর্ত

মাও-সে-তুং তিব্বত কে চিনের হাতের তালু এবং লাদাখ, নেপাল, ভুটান, সিকিম ও অরুণাচল প্রদেশকে চিনের হাতের আঙুল বলে উল্লেখ করেছিলেন, তাই চিনের কম্যুনিস্ট পার্টির সেগুলো দখল করা আশুকর্তব্য বলে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে তিব্বত কে তারা অনেক আগেই গ্রাস করেছে এবং বাকি প্রান্তগুলোর ওপর নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তানে, যে দল বা সামরিক বাহিনীই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তারা প্রায় চিনের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশ-কে ‘সফ্ট-লোন’ র মাধ্যমে গ্রাস করার চেষ্টা করছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বা কমিউনিস্ট চিনের দীর্ঘকালীন ‘সাম্রাজ্য’ বিস্তারের নীতি নিরীক্ষণ করলে কিছু ‘প্যাটার্ন’ চোখে পড়ে। বোঝা যায় ‘প্রতিবেশী’ রাষ্ট্রগুলোর ওপর তার মূল হাতিয়ার হলো—নিরন্তর প্রচারের মাধ্যমে নিজেদের সামরিক বাহিনীর একপ্রকার ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ প্রতিষ্ঠা করা। এই সাম্রাজ্যবিস্তারের যে কৌশল, তার সিংহভাগ জুড়ে আছে, যত্ন করে গড়ে তোলা মিথ্যের ‘প্যাকেজ’, যার পোশাকি নাম ‘প্রোপাগান্ডা’, কারণ যে সামরিক শক্তি-র জুজু তারা দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সামনে প্রস্তুত করে, সেখানে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে (psychological war বা psy-war) প্রতিপক্ষের থেকে নিজেকে এগিয়ে রাখাটাই এই প্রোপাগান্ডার উদ্দেশ্য। ভারতের বিরুদ্ধেও এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চিনের মূল স্ট্র্যাটেজি, তাই আমাদের এই স্ট্র্যাটেজি টা বোঝা খুব প্রয়োজন।

এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের-র মূলতঃ তিনটি কৌশল। প্রথম, নিজের আক্রমণাত্মক নীতিকে প্রতিপক্ষের আক্রমণের প্রতিরক্ষা হিসেবে প্রচার করা, অর্থাৎ নিজেকে ‘victim’ হিসেবে দেখিয়ে নিজের আক্রমণকে ‘defence’ র নাম দিয়ে চালানো।  ১৯৬২-র যুদ্ধে তাদের ভারত আক্রমণের বৈধতা হিসেবে তারা যুক্তি দেখিয়েছিল, যে ভারত নাকি চিনের বিরুদ্ধে ‘ফরোয়ার্ড পলিসি’ গ্রহণ করেছিল। নেভিল ম্যাক্সওয়েলের ‘India’s China War’ বইটিতে, চিনের প্রত্যক্ষ মদতে, এই যুক্তিই প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে, বারটিল লিন্টনার তার ২০১৮ সালে প্রকাশিত গবেষণামূলক রচনা ‘China’s India War’ -এ প্রমাণ করেন যে ম্যাক্সওয়েল ভারতের ‘ফরোয়ার্ড’ নীতির যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন তা সর্বৈব মিথ্যে, তা একতরফা ভাবে চিনই ব্যবহার করেছিল। ২০১৭ সালের ‘ডোকলাম স্ট্যান্ডঅফ’-র সময়ে এবং গতসপ্তাহে গালওয়ান উপত্যকার বিরোধে, তাদের যুক্তি ছিল যে ভারত অবৈধভাবে চিনের ভূ-খন্ডে প্রবেশ করেছে।`দ্বিতীয় কৌশল হিসেবে নিজেদের দাবির মান্যতা স্বরূপ কিছু বাছাই করা আইন ও নৈতিকতার মিশ্রণ করে, যার প্রমাণ-স্বরূপ এরা ব্যবহার করে কিছু নথি বা ম্যাপ এবং কিছু চুক্তি, যেগুলোর একক স্বত্বাধিকারী কম্যুনিস্ট চিন।

তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তৃতীয় কৌশল যা চিনের সামরিক বাহিনী বা PLA র শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট। যার প্ৰধান উদ্দেশ্যে হলো প্রত্যেক দেশকে প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দেওয়া যে চিনের সাথে বিরোধের পরিণাম ভালো হবে না, তাই চিনের ‘ফতোয়া’ যেন পালন করা হয়। কিন্তু, এই প্রোপাগান্ডা আমাদের একটু গভীরে গিয়ে দেখার দরকার আছে। চিন-কে তার কুড়ি হাজার কিলোমিটারের দীর্ঘ ভূ-সীমানা রক্ষা করার জন্য মোট বত্রিশ লক্ষের সৈন্যবল রয়েছে। সেখানে, ভারতের প্রায় পনের হাজার কিলোমিটারের জন্য রয়েছে একান্ন লক্ষের কিছু বেশি সৈন্য। আবার, চিনের চোদ্দ’টি প্রতিবেশীর মধ্যে, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া ছাড়া প্রতিটি দেশের সাথেই চিনের ছোট-বড় সীমানা-সংক্রান্ত বিরোধ রয়েছে, যা অতীতে যুদ্ধের কারণ হয়েছে, যাতে চিনের পরাজয় হয়েছে। কাজেই, ভারতের সাথে কোনো যুদ্ধে তারা তাদের সৈন্যবাহিনীর ৫০ শতাংশের বেশী, কোনোভাবেই ভারতীয় সীমায়  নিয়োজন (Deployment) করতে পারবেনা। তবে, সমকালীন যুদ্ধে প্রযুক্তি ও মারণাস্ত্রের গুরুত্ব অবশ্যই সৈন্যবলের সংখ্যার তুলনায় বেশি। চিনের নৌ-শক্তি প্রযুক্তি ও সংখ্যার বিচারে ভারতের থেকে খুব বেশি এগিয়ে না থাকলেও, বিমান বাহিনীর মোট ঘাতক বিমানের সংখ্যা আমাদের চেয়ে বেশ কয়েকগুণ বেশি। তবে, এই সংখ্যাধিক্য যে ‘চেংডু জে-সেভেন’ যুদ্ধবিমানের ওপর ভর করে, সেটা আজকের দিনে অচল। ২০১৩ সালে চিনের সরকারই তার উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। মোটের ওপর আকাশপথের যুদ্ধে, রাফাল যুদ্ধবিমান আসার পরে চিনের দাদাগিরি বে-বুনিয়াদ হয়ে যাবে।

এই বিন্দু থেকেই আমাদের বুঝতে হবে, চিন তার যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ভাবমূর্তি তৈরি করে বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিক উপনিবেশ তৈরীর নীতি গ্রহণ করেছে, তার স্ট্র্যাটেজি টা কী? এবং ভারতে সেটা কিভাবে কাজ করে? ভারতে চিনের পক্ষে সম্মতি নির্মাণ (consent building) হয় মূলতঃ তিনটি ধাপে, যার সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্ৰ রয়েছে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্য্যায়ে, উন্নয়নের মডেল হিসেবে চিন কে ‘প্রজেক্ট’ করা হয়। দেশের মধ্যে উন্নয়নের সূত্রপাত উচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে হলে, প্রতিবাদী বাম ছাত্রসংগঠন চিনের হংকং নীতিতে মৌন থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস শাখার ছাত্রছাত্রীদের সমকালীন ভারতের ইতিহাস পড়ানোর নামে ১৯৬২-র চিনের ‘সামরিক পরাক্রম’ পড়ানো হয়। অথচ ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই ১৯৬৭ সালের ‘নাথু-লা’ এবং ‘চো-লা’-র যে যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী মাও-র সৈন্যদের দুরমুশ করেছিল—সেই পরাক্রম পাঠ্যক্রমে স্থান পায়না। ইতিহাসের নির্মাণ ও বিনির্মাণে-র যে তত্ত্ব আশীষ নন্দী দিয়েছিলেন, এ যেন তারই প্রয়োগ। ঠিক এই কারনেই, আজ দেশের অধিকসংখ্যক মানুষ যারা ১৯৬২-র যুদ্ধের কথা জানেন, তাদের কাছে ১৯৬৭তে ভারতীয় সেনার পরাক্রমের ঘটনা অজানা। শেখানো হয় যে, ‘তিব্বত’ রাজনৈতিক ভাবে চিনের অঙ্গ, অথচ ভারতের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো স্নাতক/স্নাতকোত্তর স্তরের বইতে এর উল্লেখ নেই যে দীর্ঘ সময় জম্মু-কাশ্মীরের অন্তর্গত ছিল লাসা সহ তিব্বতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

চিনের ভাবমূর্তি নির্মাণে বড় ভূমিকা নেয় বামপন্থী বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া এবং এনজিও। বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা কম্যুনিস্ট চিনের সাফল্য ও পিএলএ-র মহত্ব নিয়ে পত্রপত্রিকায় ‘কলাম’ লেখেন। সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত, তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত হওয়ায় তাদের লেখনীর দুরভিসন্ধির বিচার না করেই, তাদের বক্তব্যকে ধ্রুবসত্য বলে মনে করা হয়। কিন্তু চিনের ‘মডেল’ কে উন্নয়নের আদর্শ দাবি করা বামপন্থীরাই, উত্তর-পূর্বে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে দক্ষিণে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র—বিরোধিতা থেকে আন্দোলন সবেতেই এই বামপন্থীরা বিশেষ উৎসাহে অংশগ্রহণ করেন। সর্বোপরি, বাজেটে যখন প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ে, তখন এই তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাই কুম্ভীরাশ্রু বর্ষন করে বলেন যে মানুষ খেতে পাচ্ছেনা, সরকার যুদ্ধের জন্য ব্যয় করছে। এইবার এই তিনটি বিন্দু যুক্ত করুন, একদিকে শিল্প, বিদ্যুৎকেন্দ্র-র মতো বুনিয়াদী বিষয়ের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা আন্দোলন করে, জাতীয় অর্থনীতি তথা মানুষকে গরীব রাখতে চায়। অপর দিকে, প্রতিরক্ষায় খরচের বিরোধীতা করে সরাসরি ফায়দা পৌঁছে দিচ্ছে চিনকে—যারা প্রতিরক্ষায় নিরন্তর নিবেশ করে, সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে এবং ভারতবর্ষের অস্তিত্ব কে সঙ্কটাপন্ন করছে। বুঝতে অসুবিধে হয়না কেন রাফাল যুদ্ধবিমান নিয়ে এত বিরোধীতা। এছাড়াও, ভারতীয় কূটনীতিক মহলে তাইওয়ান-কে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হলেই, এরা ‘গেল গেল’ রব তোলেন। অথচ, সেই চিনেই যখন এক সাতবছরের বালককে শুধুমাত্র মহম্মদ নাম হওয়ার ‘অপরাধে’ কারাবরণ করতে হয়, তখন সেইসমস্ত বামপন্থীরা সমবেতভাবে নীরবতা পালন করেন।

ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে একসময়ে চিন না রাশিয়া সে নিয়ে দীর্ঘ ‘তাত্ত্বিক’ বিরোধ হলেও, আশির দশক থেকে কলকাতার রাজপথ কাঁপানো, “চিনের চেয়ারম্যান আমার চেয়ারম্যান” স্লোগান দেওয়া কম্যুনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্ক্সবাদী) বা সিপিএম নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করে। আনুগত্য এই পর্যায়ে ছিল, যে এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে রসিকতা করে বলা হতো, ‘চিন আজ যা ভাবে, বাংলা কাল তা করবে’। এই আনুগত্য সর্বৈবভাবে চিনের প্রতি; মানবতা, মুক্তি, নিপীড়িত মানুষ কোনোটাই আসল কারণ নয়। সেইজন্যই, একদা ‘আমার নাম তোমার নাম ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম’ বলতেন যারা, তারা আজ ভিয়েতনাম কে ভুলে গেছেন। ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনাম সৈন্য পিএলএ কে প্রাণভিক্ষা দিয়ে দেশে ফেরার অনুমতি দেয়। যুদ্ধের কারণ এক্ষেত্রেও চিনের ফরোয়ার্ড নীতি, যার উচিত-শিক্ষা দিয়েছিল ভিয়েতনাম। যে ভিয়েতনাম একদা দেশী কমরেডদের তীর্থক্ষেত্র ছিল, আজ যখন ভারত সেখান থেকে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে, তাতে তাদের হতাশা কেন হয়? অধুনা ভারতীয় রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া দলের নেতারা চেষ্টা করছেন ময়ূরপুচ্ছ লাগিয়ে ‘ভারতীয়’ হতে, কিন্তু দলীয় মুখপত্রে এখনও চিনের প্রতি আনুগত্যের সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

তবে, সিপিএম দুর্বল হয়েছে মানেই চিনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের কৌশল ধাক্কা খেয়েছে, সেটা ভাবা ঠিক নয়। আজও দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া, এনজিও আদর্শগত আনুগত্যের স্বার্থে চিনের প্রোপাগান্ডা অফিসের কাজ করে। এই প্রোপাগান্ডা অফিস গুলো থেকে প্রচার করা হয়, চিনের সাথে যুদ্ধ ভারতের পক্ষে আত্মঘাতী হবে, ঠিক যেমনভাবে মহাভারতের যুদ্ধে কর্ণের সারথী শল্য প্রতি মুহূর্তে তাকে নিরুৎসাহিত করতেন। নেপাল যে ভুল করেছে সে ভুল আমরা হতে দিতে পারিনা। কম্যুনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পরই, নেপালের স্কুলে ম্যান্ডারিন বাধ্যতামূলক হয়েছে, হিন্দি-ভাষী মাধেসিদের স্বার্থ ছাড়াও আপামর নেপালী-ভাষী সাধারণ মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা, কালাপানি নিয়ে নেপালের ভারত-বিরোধীতা আদতে নেপালের মাটি থেকে চিনের ছায়াযুদ্ধ, যা সম্ভব হয়েছে কম্যুনিস্টরা নেপালে ক্ষমতায় আসার পর। শুধু নেপালই নয়, চিনের পিএলএ কে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে এগিয়ে দিতে ভারতের কম্যুনিস্টরাও চিনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ। এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ আমাদের সঙ্ঘবদ্ধ জাতি হিসেবে জিততেই হবে, যা সীমান্তের যুদ্ধ জয়ের প্রাথমিক শর্ত।

Image Source: https://images.financialexpress.com

Author

(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)