বাংলার কাব্য জগতে যে-দিন প্রথম কোকিলের স্বর শোনা গিয়াছিল, সেইদিন বাংলাভাষার এক অতি-শুভ দিন। সেই দিন বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে এক মহান্ গৌরবের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কিন্তু সে যে কত দিন পূর্ব্বে তা কেও জানে না! অনাদি অনন্ত কালগর্ভে সে-দিনের ইতিহাস নিহিত থাকলেও তার সাল-তারিখ নির্ণয় করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। কিন্তু তাহলেও সেই শুভ সূচনার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলার কাব্য-কাননে নানা পুষ্পলতার অভ্যুদয়ে ও নানা বিচিত্রবর্ণের ফুল সম্ভারে এটি পৃথিবাীতে আপন আসন গ্রহন করেছে । এ ভাষার ভাব-সম্পদের মূল রসধারায় সন্ধান করলে জানা যায় যে, বাংলার বহু মনীষী ও প্রেমের উপাসক তাঁদের অনন্তসাধারণ মনীষা ও স্ব-ভাষা-প্রেমের প্রভাবে কালের বিশাল প্রান্তরে তাঁদের কীর্তি-চিহ্ন অঙ্কিত করে গিয়েছেন। নানা অবস্থা-বিপর্যয়েও তা নষ্ট হয়নি। অনুকূল প্রতিকূল কত ভাষদ্যোতনার মধ্য দিয়ে সেই রসধারা ফল্গু-স্রোতের মত প্রবহমান। কিন্তু তার মূল উৎসের সন্ধান কলে যাঁদের চরণতলে এসে পৌঁছাতে হয়, ফুলিয়ার পণ্ডিত কৃত্তিবাস তাঁদের অন্যতম।
জন্মকাল:-
কৃত্তিবাস কোন্ সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বা তিনি কোন সময়ে রামায়ণ রচনা করেছিলেন, তার বিশেষ পরিচয় আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য ‘ গ্রন্থে কৃত্তিবাসের যে আত্ম পরিচয় অংশ তুলে ধরেছেন তার কিছুটা আলোচনা করা হচ্ছে-
“পূর্বেতে আছিল বেদানুজ মহারাজা
তাঁহার পাত্র আছিল নরসিংহ ওঝা।।
বঙ্গদেশে প্রমাদ হৈল সকলে অস্থির।
বঙ্গদেশ ছাড়ি, ওঝা আইল গঙ্গাতীর।।
***
গ্রামরত্ন ফুলিয়া জগতে বাখানি।
দক্ষিণে পশ্চিমে বহে গঙ্গা তরঙ্গিনী।।
ফুলিয়া চাপিরা হৈল তাঁহার বসতি।
ধনধান্যে পুত্র বাড়-এ সন্ততি।।
গর্ভেশ্বর নামে পুত্র হৈল মহাশয়।
মুরালি সূর্য গোবিন্দ তাহার তনয়।।
জডানেতে কুলেতে ছিল মুরারি ভূষিত।
সাত পুত্র হৈল তার সংসারে বিদিত।।
জ্যৈষ্ঠ পুত্র ছিল তার নাম যে ভৈরব।
রাজার সভায় তার অধিক গৌরব।।
মহাপুরুষ মুরারি জগতে বাখানি।
ধর্মচর্যায় রত মহান্ত যে মানী।।
****
কুলে শীলে ঠাকুরালে গোসাঞি প্রসাদে।
মুরারি ওঝার পুত্র সব বাড়য়ে সম্পদে।।
মাতার পতিব্রতার যশ জগতে বাখানি।
ছয় সহোদর হৈল এক যে ভগিনী।।
সংসারে আনন্দ সতত কৃত্তিবাস।
ভাই মৃত্যুঞ্জয় করে বড় উপবাস।।
সহোদর শান্তিমাধব সর্বলোকে খুষি।
শ্রীধর ভাই তার নিত্য উপবাসী।।
বলভদ্র চতুর্ভুজ নামেতে ভাস্কর।
আর এক বহিন হৈল সতাই উদয়।।
মালিনী নামেতে মাতা বাপ বনমালী।
দুই ভাই উপজিলাম সংসারে গুণশালী।।
****
আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পূর্ণ (পুণ্য) মাঘ মাস। তথিমধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস।।”১
এখান থেকে আমরা জানতে পারি পূর্ববঙ্গের বেদানুজ মহারাজার অমাত্য ছিলেন কৃত্তিবাসের পূর্বপুরুষ নরসিংহ ওঝা।
পূর্ববঙ্গে প্রমাদ দেখা দিলে নরসিংহ ওঝা পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গার তীরবর্তী ফুলিয়া গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। নরসিংহের পুত্র গর্ভেশ্বর। গর্ভেশ্বরের তিন পুত্র হলেন মুরারি, সূর্য এবং গোবিন্দ। মুরারি ওঝার পুত্র বনমালী। বনমালীর স্ত্রীর নাম মালিনী। বনমালী ও মালিনীর ছয় পুত্র ও এক কন্যা। ছয় পুত্রের অন্যতম হলেন কৃত্তিবাস। কৃত্তিবাসের জন্ম সময় প্রসঙ্গে বলা হয়েছে মাঘ মাসের শেষ দিন অর্থাৎ পুণ্য শ্রীপঞ্চমী তিথিতে আদিত্যবার অর্থাৎ রবিবার কৃত্তিবাস জন্মগ্রহণ করেন, ‘বঙ্গভাষার ইতিহাস’ গ্রন্থে মহেন্দ্রনাথ
চট্টোপাধ্যায় কৃত্তিবাসের জন্ম তারিখ ১৫৬৯ খ্রীষ্টাব্দ বলেছেন। ২
যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি জ্যোতিষ গণনা করে প্রথমে বলেন ১৩৭৮ শকাব্দে অর্থাৎ ১৩৭৮+৭৮ = ১৪৫৬ খ্রিষ্টাব্দে কৃত্তিবাসের জন্ম। এরপর পূর্ণ মাাঘমাস ধরে হিসেব করে বলেন ১৩৫৪ শকাব্দে অর্থাৎ ১৩৫৪ + ৭৮ = ১৪৩২ খ্রিষ্টাব্দে কৃত্তিবাস জন্মগ্রহণ করেন। নলিনীকান্ত ভট্টশালীর অনুরোধে যোগেশচন্দ্র ‘পুণ্যমাঘমাস’ ধরে হিসাব কষে পুনরায় গণনা করে বলেন কৃত্তিবাসের জন্ম তারিখ ১৩৯৮ খ্রিষ্টাব্দ। দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ‘পুণ্যমাঘমাস’ ধরে জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী বলেন করে বলেন কৃত্তিবাসের জন্মকাল ১৩৭২ খ্রিষ্টাব্দ। কৃত্তিবাসর সঠিক জন্ম তারিখ নির্ধারণ করা খুব কঠিন কাজ। আত্মবিবরণী থেকে পাওয়া যায়-
‘এগার নিবড়ে যখন করতে প্রবেশ।
হেনকালে পড়িতে গেলাম উত্তরদেশ।।’
বারোবছর বয়সে তিনি উত্তরবঙ্গে পড়তে যান। পাঠ শেষ করে তরুণ বয়সে তিনি যান গৌড়েশ্বরের দরবারে-
‘সাত শ্লোকে ভেটিলাম রাজা গৌড়েশ্বর।
সিংহসম রাজা আমি করিলাম গোচর।।’
সুখময় মুখোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ পন্ডিতেরা জানিয়েছেন, কৃত্তিবাস যে গৌড়েশ্বরের দরবারে গিয়েছিলেন সেই গৌড়েশ্বর ছিলেন রুকনুদ্দিন বারবাক শাহ। বারবাক শাহ ১৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। ১৪৫৫ থেকে ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি তাঁর পিতা নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের সঙ্গে যুক্তভাবে রাজত্ব করেন এবং ১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি তাঁর পুত্রের সঙ্গে যুক্তভাবে রাজত্ব করেন। বাকি সময় এ’কা রাজত্ব করেন। বারবাক শাহ পন্ডিত ছিলেন এবং শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এখন প্রশ্ন কৃত্তিবাস প্রকৃতই কি বারবাক শাহের সভায় গিয়েছেলেন? এখানেও বিতর্কের শেষ নেই। সমালোচক লিখেছেন, ‘তিনি যদি তরুণ যৌবনে (কুড়ি বছর বয়স ধরলে) গৌড়েশ্বরের সভায় যান, তাহলে সময়টা হবে ১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি। রাজা গণেশ তখন গৌড়েশ্বর। রাজা গণেশ ছিলেন ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানদের অন্যতম আমীর।৩ গণেশ ১৪১৪-১৫ খ্রিষ্টাব্দে আলাউদ্দীন ফিরোজশাহকে সিংহাসন চ্যুত করে বাংলার সিংহাসনে বসেন। তবে তিনি বেশীদিন রাজত্ব করতে পারেননি। যাইহোক গৌড়েশ্বর কৃত্তিবাসকে ‘পাটের পাছড়া’ দিয়ে পুরস্কৃত করেন-
‘কেদার খাঁ শিরে ঢালে চন্দনের ছড়া।
রাজা গৌড়েশ্বর দিলা পাটের পাছড়া।।
অনেকে বলেছেন গৌড়েশ্বর হলেন গণেশের পুত্র যদু অর্থাৎ জালালুদ্দিন।
কৃত্তিবাস জীবন পরিচয় প্রসঙ্গে সঠিক প্রমাণ না পাওয়া গেলেও এটুকু বলা যায় কৃত্তিবাস ছিলেন চৈতন্য পূর্বযুগের কবি। বাল্মীকির রামায়ণ অবলম্বনে তিনি ‘শ্রীরামপাঁচালি’ রচনা করেন। রাজনারায়ণ বসু ‘বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা’ (১৮৭৮) গ্রন্থে লিখেছেন, ‘কৃত্তিবাস ফুলে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৪৬০ শকে রামায়ণ রচনা করেন।’ কিন্তু এই অভিমত যথার্থ বলে আমরা মনে করি না। চৈতন্যের জন্মাবার আগে অর্থাৎ ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দের আগে কৃত্তিবাস ‘শ্রীরাম পাঁচালি’ রচনা করেন।৪
কৃত্তিবাসের আবির্ভাবকাল নিয়ে যেমন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তেমন তাঁর ব্যক্তি পরিচয় নিয়েও বিতর্কের অবসান ঘটেনি।
এ বিষয়ে ১৩০৪ বঙ্গাব্দের ২য় সংখ্যায় ‘সাহিত্য পরিষদ’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রফুল্লচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘কৃত্তিবাস পণ্ডিত’ প্রবন্ধের নির্বাচিত অংশ –
৬৫৪ শক বা ৭৩২ খৃঃঅব্দে পঞ্চব্রাহ্মণ আদিশূর কর্তৃক বাঙ্গালায় আনাত হয়েন। সেইসময় হইতে কৃত্তিবাস ২২ পুরুষ। এখন প্রতি পুরুষে ৩০ বৎসর ধরিলে, ২২ পুরুষ হইতে ৬৬০ বৎসর অতীত হয়। সুতরাং মোটামুটি কৃত্তিবাসের সময় ১৩১৪ শক বা ১৩৪২২ খৃঃ অব্দে হইতেছে। অবশ্য অন্যবিধ উপায়ে গণনা করিলে ইহা হইতে অনেকটা তফাত বাল হইতে পারে, এবং ইহাও জ্ঞাতব্য যে যেখানে অন্য কোন ভাল উপায়ের অভাব, সেখানে কাজে কাজে পুরুষ গণনার দ্বারা কাল নিরূপণ করিতে হয় L..
তাহাড়া আরও একটি বিষয় দ্রষ্টব্য। দেবীবর ঘটক যে সময়ে কুলীনদের মেলবন্ধন করেন, সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন কৃত্তিবাসের জেঠতুত ভাই লক্ষ্মীধরের পৌত্র গঙ্গানন্দ। হইলেও জানা যাইতোই দেবীবর কর্তৃক মেলবন্ধন হওয়ার অনেক আগে কৃত্তিবাস।…….ঐ একই বংশে মহাদেবের শাখায় (আয়িত শাখায় কৃত্তিবাসের উৎপত্তি, আর মহাদেব শাখায় যোগেশ্বরে উৎপত্তি সুতরাং উভয়ে ৮ পুরুষের ছাড়াছাড়ি ।) আর একজন অর্থাৎ যোগেশ্বর পন্ডিতও সেসময় মেলবন্ধনে উপস্থিত ছিলেন,তাঁহাকে লইয়াই খড়দহনমেলার সৃষ্টি! এখন কথা হইতেছে যে যোগেশ্বর পন্ডিত যে সময় জীবিত ছিলেন বলিয়া, কৃত্তিবাসকেও সেই সময়ের লোক হইতে হইবে এমন কোন কথা নাই। বংশের শাখা বিশেষে কেহ দীর্ঘজীবী, কেহ অল্পজীবী সমগণণার পুরুষেও সাংয়ের অনেক অন্তর হইতে পারে ।..
……
একদিকে যেমন এই সময়ে গঙ্গানন্দ ভট্টের রাম ও বাসু নামে দুইটি মাত্র পুত্র হইয়াছে, অন্যদিকে যোগেশ্বরের তখন ১১ কন্যা ও ১১ জামাই এবং মুকুন্দ, শঙ্কর, ত্রিবিক্রম, কমলাপতি, শত্রুঘ্ন, জানকীনাথও রুক্মিণী এই সাত পুত্র। আবার পৌত্র ও তাঁহার তখন এক এক সন্তানে কতকগুলি করিয়া হইয়াছিল দেখ। প্রথম পুত্র মুকুন্দের ৪ পুত্র, দ্বিতীয় পুত্র শঙ্করের ৫ পুত্র এবং ষষ্ঠ পুত্র জানকীনাথের ৪ পুত্র। এখন যে লোকের এতগুলি বংশাবলী, তাহার বয়স কত হইতে পারে বল দেখি? অন্ততঃ আশি বা পঁচাশি, ইহারও কম নহে। অতএব কৃত্তিবাস যোগেশ্বরের সঙ্গে সমকালে ও সমান বয়স হইলেও মেলবন্ধনের সময়ের অন্ততঃ ৮০ বৎসর আগে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু বস্তুতঃ কৃত্তিবাস যোগেশ্বরের অনেক আগের লোক, যেহেতু কৃত্তিবাস এবং তাঁহার জেঠতুত ভাই গঙ্গানন্দ ভট্টের পিতা লক্ষ্মীধর। অথবা লক্ষ্মীধরের পুত্র ও গঙ্গানন্দের পিতা মনোহর, হাঁহারা জীবিত থাকিলে ইহাঁদিগকে পরিত্যাগ করিয়া গঙ্গানন্দ ভট্টকে লইয়া কুলবিচার হইত না। অথবা দেবীবরের কুলবিচারের মধ্যে অবশ্যই ইহাদের উল্লেখ থাকিত; কিন্তু তাহা না থাকাতে ইহাই নিঃসন্দেহে অবধারিত হইতেছে যে, মেলব (ধনের বহু পূর্বেই ভাই ও ভাইপো সমেত কৃত্তিবাস গতাসু হইয়াছেন।
…..মেলবন্ধনের সময় ধ্রুবানন্দ যুবা বয়স। তাহার পর বৃদ্ধাবস্থায় তিনি দেবীবরের অনুরোধে এবং মেলবন্ধন হওয়ার কিছুকাল পরে, কুলীনদিগের বংশ এবং বিবরণ সম্বলিত মহাবংশ রচনা করেন। ঐ গ্রন্থে ঊর্ধ্বতন দশপুরুষ হইতে, ধুবানন্দের সমসাময়িক বিবরণ পর্যন্ত বিবৃত হইয়াছে। উহা হইতে যোগেশ্বরের তাদৃশ বংশবিস্তারের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে মহাবংশে কৃত্তিবাসের খুড়তুত ও জেঠতুত ভাইদের অনেকেরই উত্তরোত্তর কাহারও তিন, কাহারোও বা চারি পুরুষের পর্যন্ত বিবরণ পাওয়া যায়। যেমন গঙ্গানন্দ ভট্টের দুই পুত্র লইয়া ৪ পুরুষের হয়, কিন্তু কৃত্তিবাস ও তাঁহার সহোদর ভাইদের বংশাবলী সম্বন্ধে অনেকবারেই কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। ইহাতে কয় প্রকার সিধান্ত হইতে পারে অর্থাৎ কৃত্তিবাস ও তাঁহার ভাইদের মধ্যে কেহ হয়ত নিস্কুল হইয়াছিলেন, অথবা কেহ নিঃসন্তান অবস্থায় জীবনাতিবাহিত করিয়াছিলেন। কৃত্তিবাস সম্বন্ধে ফুলিয়া ও চতুঃপার্শ্বস্থ গ্রামের বৃদ্ধ লোকের মুখে এরূপ জনপ্রবাদ শুনিয়াছি যে, তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোক গমন করেন।
…..যাহা হউক, উপরে যাহা লেখা হইল, তদ্বারা ইহা নিঃসন্দেহ জানা যাইতেছে যে, কৃত্তিবাস পণ্ডিত দেবীবর ঘটক কর্তৃক মেলবন্ধন হওয়ার অনেক আগেকার লোক। যোগেশ্বর পন্ডিতের সমকালিক ও সমবয়স্ক হইলেও মেলবন্ধনের সময়ের অন্তত ৭০ কি ৮০ বর্ষ পূর্বে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন বলিতে হয়, কিন্তু যখন দেখা যাইতেছে যে যোগেশ্বরেরও অনেক পূর্বে অতি বৃদ্ধ বয়সেই গতাসু হইয়াছেন, তখন উহার উপরে ন্যূনকল্পে আর ২০ বৎসর চড়াইয়া, মেলবন্ধনের শতবর্ষ পূর্বে কৃত্তিবাসের জন্ম ধরিলে অযৌক্তিক হইতে পারে না। এখন মোটের উপর বলিতে গেলে, উপরে যত কিছু বলা হইয়াছে, তাহার মধ্যে কৃত্তিবাসের কাল নির্ণয় বিষয়ক কেবল এই একটি মাত্র সত্য একরূপ নিঃসন্দেহভাবেই অবধারিত হইতেছে যে, লক্ষ্মীধর কর্তৃক মেলবন্ধন কার্য্যের ন্যূনাধিক শত বৎসর পূর্ব্বে কৃত্তিবাস জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।
…….এখন দেখিতে হইবে যে, মেলবন্ধন হইয়াছিল কখন। অনেকের বিশ্বাস যে, দেবীবর চৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক লোক, সুতরাং তাঁহারই সমকালে মেলবন্ধন কার্য্য নির্বাহিত হইয়াছিল। কিন্তু এ বিশ্বসের মূল সূত্র কি? যতদূর দেখিতে পাই ও বুঝিতে পারি, তাহাতে জানা যাইতেছে যে ঘটক নূলা পঞ্চাননের একটা করিকাই তদ্রুপ বিশ্বাসের মূল সূত্র। ঐ করিকায় যে কয়টি ঘটনার উল্লেখ আছে, লেখকের লিখন ভঙ্গীতে পাঠকেরা বুঝিয়া থাকেন, যেন সে কয়টি ঘটনাই এক সময়ে ঘটিয়াছিল।
……..বস্তুতঃ দেবীবর কর্তৃক কুলীনদের মেলবন্ধনের কার্য্য চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রাদুর্ভাব হইবার খুব অনেক আগে না হউক, কতক পরিমাণ আগে যে হইয়া গিয়াছে, সে কথা নিঃসংশয়ে বুঝাইবার জন্য, আর একটি বংশাবলীর তালিকা নিম্নে উদ্ধৃত করিলাম।
আদিশূর কর্তৃক আনীত শাণ্ডিল্য গোত্রীয় ভট্টনারায়ণ বংশে এই কয়জন বল্লাল সেন কর্তৃক কুলীন বলিয়া পূজিত হইয়াছিলেন-ভট্টনারায়ণ হইতে ৯ম পুরুষে জাল্হন ও মহেশ্বর এবং ১১শ পুরুষে দেবল, বামন ও মকরন্দ। মকরন্দের বংশে বর্তমান প্রবন্ধ লেখকের উৎপত্তি। যে বাসুদেব সার্ব্বভৌম মিথিলা দেশ হইতে ন্যায় শাস্ত্রকে কণ্ঠস্থ করিয়া আনিয়া নবদ্বীপে স্থাপন করিয়াছিলেন এবং যিনি প্রথমকালে চৈতন্যের ন্যায় গুরু এবং শেষকালে চৈতন্যের ভক্ত ও শিষ্য, দেবলের বংশে সেই বাসুদেবের উৎপত্তি।… ১৪০৭ শকে চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম। উপরে দেখান গিয়াছে যে দেবীবর কর্তৃক মেলবন্ধনের সময় হইতে ন্যূনাধিক একশত বৎসর পূর্বে কৃত্তিবাসের আবির্ভাব। এখন চৈতন্য দেবের জন্ম শকের কত বৎসর পূর্বে মেলবন্ধন হইয়াছিল, তাহা যদি নিরূপণ করিতে পারা যায়, তাহা হইলে মোটামুটি অথচ নিঃসংশয়রূপে কৃত্তিবাসের কাল নিরূপিত হইতে আর কোনই প্রতিবন্ধক থাকে না। চৈতন্য দেবের জন্মের ন্যূনাধিক ৫০ বৎসর পূর্বে দেবীবর ঘটক কর্তৃক কুলীনদিগের মেলবন্ধন হইয়াছিল। পুনশ্চ, পূর্ব্বে দেখা গিয়াছে যে, মেলবন্ধনের ন্যূনাধিক একশত বৎসর পূর্বে কৃত্তিবাসের জন্ম। তাহা হইলে এই ৫০ এবং ১০০ একত্র করিয়া বলিতে হইতেছে যে, চৈতন্যদেবের জন্মের ন্যূনাধিক ১৫০ বৎসর পূর্বে অর্থাৎ আনুমানিক ১২৫৭ শকে বা ১৩৩৫ খ্রীষ্টাব্দে কৃত্তিবাস জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।” ৫
একইভাবে, ১৩৪০ বঙ্গাব্দের ১৮ আষাঢ় সাহিত্য পরিষদের দ্বিতীয় মাসিক অধিবেশনে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ‘কৃত্তিবাসের জন্মশক’ নামক যে প্রবন্ধ পাঠ করেন, তার নির্বাচিত অংশ:
আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পূর্ণ মাঘ মাস।
তথি মধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস।।
মাঘ মাস পূর্ণ, রবিবার শ্রীপঞ্চমী তিথিতে কৃত্তিবাসের জন্ম হইয়াছিল।
১৩১৮ বঙ্গাব্দের সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার ১ম সংখ্যায় এই দিন পাই নাই। তদনন্তর ১৩২০ বঙ্গাব্দের উত্ত পত্রিকার ৪র্থ সংখ্যায় লিখিয়াছিলাম, ১৩৫৪ শকে (১৪৩৩ খ্রীষ্টাব্দে) উক্ত দিনটি পাওয়া যায়। অতএব যদি পয়ারটির অর্থ বুঝিতে ভুল না হইয়া থাকে, তাহা হইলে উক্ত শকে জন্ম হইয়াছিল।
কিন্তু ঐতিহাসিকেরা এই শকে কোন হিন্দু গৌড়েশ্বরের সন্ধান পান নাই। শকটি সন্দেহাত্মক হইয়া রহিয়াছিল। তাঁহারা বলেন ‘পূর্ণমাঘ মাস’ নয় ‘পুণ্য মাঘ মাস’ এই পাঠ হইবে।
কয়েকদিন হইল, শ্রী নলিনীকান্ত ভট্টশালী কৃত্তিবাসের জন্মশক পুনর্বার গণিতে অনুরোধ করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, ‘দনুজমর্দন রাজা গণেশ ১৩৩৯ শকে ও ১৩৪০ শকে মুদ্রা প্রচার করিয়াছিলেন। এই দুই বৎসর তাঁহার পূর্ণ প্রতাপের কাল। ইহারই সভায় কৃত্তিবাস উপস্থিত হইয়াছিলেন ধরিতে হইবে। তৎকালে কৃত্তিবাসের বয়স ২০ হইতে ৩০ এর মধ্যে ছিল। অতএব ১৩০৮ হইতে ১৩২০ শকের মধ্যে এক শকে রবিবারে শ্রী পঞ্চমী হইয়া থাকিলে সে শকে কৃত্তিবাসের জন্ম হইয়াছিল।’
গণিয়া দেখিতেছি, ১৩০৮ হইতে ১৩২০শকের মধ্যে ১৩২০ শকে
১৬ই মাঘ শুক্লা চতুর্থী রবিবার ৫দং
১৭ই মাঘ শুক্লা পঞ্চমী সোমবার ৬দং
রবিবারে চতুর্থী মাত্রা ৫দং ছিল। ইহার পরে সরস্বতী পূজা হইয়াছিল ।…
১৩৫৪ শকের সহিত তুলনা করি। এই শকে মাঘ শুক্ল চতুর্থী রবিবার ২৮দং। অতএব সেদিন সরস্বতী পূজা হয় নাই, প্রকৃত শ্রীপঞ্চমীও হয় নাই। অন্য শকে ‘পূর্ণ মাঘ মাস’পাওয়া যায় নাই বলিয়া শ্রীপঞ্চমী অর্থে সরস্বতী পূজা না বুঝিয়া মাঘ শুক্ল পঞ্চমী বুঝিতে হইয়াছিল।
১৩২০ শকে রবিবারে শ্রীপঞ্চমী ও হিন্দু গৌড়েশ্বর দুই-ই পাইতেছি। কৃত্তিবাস এগারো বৎসর বয়সে পাঠার্থে উত্তর দেশে গিয়াছিলেন। সেখান হইতে রাজন্মভটে গিয়াছিলেন। নয় দশ বৎসর পাঠ করিয়া থাকিবেন। রাজভেটের সময় তাঁহার বয়স ২০/২১ বৎসর হওয়া সম্ভবপর। ইহাও মিলিয়া যাইতেছে।
অতএব এখন বলতে পারি,
কবি কৃত্তিবাস ১৩২০ শকে ১৬ই মাঘ (ইংরেজী ১৩৯৯সালে পুরাতন পাঁজির ৫ই জানুয়ারী) রবিবার শ্রীপঞ্চমী (৩৩দং) পাইতেছি। কিন্তু সে শকে কৃত্তিবাসের জন্ম হইয়া থাকিলে ১৩৫৭-১৩৬০ শকে হিন্দু গৌড়েশ্বর চাই। ঐতিহাসিকেরা এই সময়ে কাহাকেও পান নাই। অতএব কৃত্তিবাসের জন্ম ১৩২০ শকে স্বীকার করিতে হইতেছে।”৬
কৃত্তিবাসেব উপাধি:-
কৃত্তিবাসের আত্মবিবরণীর শেষে লিখিত আছে,
“মুখটী বংশ ওঝা বংশ সংসার বিদিত।
তথি উপজিল এই কৃত্তিবাস পণ্ডিত ॥”৭
সুতরাং তাঁর কুলোপধি ‘মুখটা’; তখন ‘মুখোপাধ্যায়’ লিখবার রীতি প্রচলিত হয়নি এটা বোঝা যায়। কবে ঐ রীতি প্রচলিত হল তা গবেষণাযোগ্য। নরসিংহ ওঝা ও মুরারি ওঝার নামে মুখটাবংশের এই ধারাটি “ওঝা বংশ” নামে পরিচিত হয়েছিল এবং কৃত্তিবাসের ‘ওঝা’ উপাধিই ছিল বলে কেও কেও অনুমান করেছেন। বস্তুতঃ উদ্ধৃত পয়ারে এবং ভদ্রচিত রামায়ণের শত শত ভণিতায়-‘কৃত্তিবাস মুণ্ডিত ‘মুরারি ওঝার নাতি,’ কৃত্তিবাস পণ্ডিতের কবিত্ব বিচক্ষণ,’ ‘লঙ্কাকাণ্ড গাইল পণ্ডিত কৃত্তিবাসে’ প্রভৃতিতে-কবিবর যথাযথ তাঁহার পাণ্ডিত্যের উপাধিটি লিপিবদ্ধ করেছেন। রামগতি থেকে আরম্ভ করে ডক্টর সুকুমার সেন পর্যন্ত কোন ঐতিহাসিকই বোধ হয় তা লক্ষ্য করেননি। সকলেই পণ্ডিত শব্দটিকে সাধারণ বিশেষণ পদ ধরেছেন। লক্ষ্য করতে হবে ভণিতায় কৃত্তিবাসের ‘ওঝা’ উপাধি পাওয়া যায় না। আত্মবিবরণীতে পাওয়া যায় কৃত্তিবাসের খুল্লপিতামহ সূর্য্যেরও “পণ্ডিত” উপাধি ছিল। বস্তুতঃ সার্বভৌম, শিরোমণি প্রভৃতির ন্যায় “পণ্ডিত” উপাধিও যে একসময়ে বঙ্গের ব্রাহ্মণপণ্ডিত সমাজে প্রচলিত ছিল তা অনেকের জানা নাই। রাঢ়ীয় কুলপঞ্জীগ্রন্থ পরীক্ষা করলে জানা যায় কুলপঞ্জীতে কৃত্তিবাসের নাম কি ভাবে উল্লিখিত হয়েছে-
(১) বনমালি’, সুতা মাধব-শান্তি-বলভদ্র-মৃত্যুঞ্জয়- জাগো-ভাসো-কীর্তিবাস পণ্ডিত শ্রীনাথ-শ্রীকান্ত-শ্রীকণ্ঠ-চতু র্ভুজাঃ।
কীর্ত্তিবাস পণ্ডিত রামায়ণস্য পাঁচালিকারকঃ।৮
(২) বনমালিকস্য তৎসুতাঃ কীর্তিবাস পণ্ডিৎ মৃত্যুঞ্জয় শান্তি মাধব শ্রীধর-শ্রীমানবলোকাঃ।৯
(৩). বনমালিকস্য তৎসুতাঃ কৃত্তিবাস পণ্ডিৎ শান্তিমাধব মৃত্যুঞ্জয়বলো শ্রীকণ্ঠ-শ্রীমৎ-চতুর্ভুজ মালাধর, ভাস্কবজগোভাসো শ্রীনাথ শ্রীকান্তাঃ। কৃত্তিবাস পণ্ডিৎ। রামায়ণগায়ণকর্তী।১০
(৪) কিত্তিবাস পণ্ডিত রামায়ণ রচিছিলো।১১
ঘটক গ্রন্থে প্রায় সর্বত্র পণ্ডিতগণের উপাধি যথাযথ লিখিত পাওয়া যায়। কবি কৃত্তিবাসের বিচিত্র উপাধিটিও কুলগ্রন্থে যথাযথ উল্লিখিত রয়েছ। খ্রীষ্টীয় ষোডশ শতাব্দী থেকে নব্য ন্যায়ের পূর্ণ অভ্যুদয়কালে এই সকল প্রাচীন উপাধি বিলুপ্ত হয়ে যায়। তার আগে “পণ্ডিত” উপাধিটি বহুল পরিমাণে বিদ্বৎ সমাজে প্রচলিত ছিল। আমরা একটি মাত্র উদাহরণ দিচ্ছি । পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে “পুণ্ডরীকাক্ষ বিদ্যাসাগর” নামে একজন মহা পণ্ডিত বিদ্যামান ছিলেন। তাঁর রচিত একাধিক বইয়ের পুষ্পিকায় তাঁর পিতার নাম লিখিত আছে “মহামহোপাধ্যায় শ্রীমৎ-শ্রীকান্ত পণ্ডিত” সা-প-প, ১৩৪৭, পৃঃ ১৫২, ১৫৮)। কুলপঞ্জীর উদ্ধৃত বচন থেকে প্রমাণ হচ্ছে- ভাইদের মধ্যে একমাত্র কৃত্তিবাসই উপাধিধারী ছিলেন। আত্মবিবরণীর নিম্নলিখিত পয়ারটি এরপর’ ‘আর অসংলগ্ন মনে হবে না:
কাহার নাম ফুলিয়ার পণ্ডিত কিত্তিবাস।
বাজার আদেশ হৈল করহ সম্ভাষ ॥
নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় ‘পণ্ডিত’ কাটিয়া ‘সুখটি’ করেছিলেন ।১২
কৃত্তিবাসী রামায়ণের পুঁথি:-
বিভিন্নতম স্থানে কৃত্তিবাসের প্রায় দেড়হাজার পুঁথির সন্ধান মিলেছে। তবে বেশীরভাগ পুঁথিই আঠারো শতকে বা আঠারো শতকের কাছাকাছি সময়ে নকল করা হয়েছে।
১। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭৯৪ খ্রীষ্টাব্দের পুঁথি থেকে-
‘আমরা হৈতে সিতা তুমি কত বড় সিয়ান।
তোমা হৈতে চতুর্গুণ মোর বুদ্ধিখান।।
চতুরের কাছতে চাতুরি নাহি সাজে।
অপমান করিলেও মোর জাতি বন্ধ মাঝে।।
সোকের উপর সোক মোরে করাইলি সিতা।
আমি সাপ দিব কভু নহিবে অন্যথা।।
মোরে দুখ দিঞা সিতা করিলে গমন।
নিশ্চয়েতে সাঁপ দিব লঙ্ঘে কোন জন’।।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে প্রাপ্ত পুঁথি-
‘পিতা বনমালি মাতা মেনকার উদরে।
জন্ম লভিলা কির্তিবাস ছয় সহোদরে।।
বলভদ্র চতুর্ভুজ অনন্ত ভাস্কর।
নিত্যানন্দ কির্তিবাস ছয় সহোদর।।
পঞ্চ ভাই পণ্ডিত কির্তিবাস গুণসালি।
অনেক শাস্ত্র পড়্যা রচে শ্রীরাম পাঁচালি।।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাপ্ত পুঁথি-
‘চতুৰ্দ্দিক ভাগ জানি ফুলিয়া নগরী।
উত্তর দক্ষিণ চাপি বহে সুরেশ্বরী।।
মুখুটি বংশের জন্ম সংসারে বিদীত।
তথাত্র উপজিল কির্তিবাস পণ্ডিত।।
মেদিনীপুর থেকে প্রাপ্ত পুঁথি-
‘পিতাপুত্র পক্ষরাজ গেলেন উত্তর।
কটক লয়্যা অঙ্গদ গেলা দক্ষিণ সাগর।।
তর্জে গর্জে বানরগণ ছাড়ে সিংহনাদ।
• সাগর পাথার দেখি গুণিলা প্রমাদ।।’
চট্টগ্রাম থেকে প্রাপ্ত পুঁথি-
‘বাপে পুত্রে পক্ষিরাজ গেলন্ত উত্তরে।
কটক অঙ্গদ গেল দক্ষিণ সাগরে।।
ভয়ে গর্জে বানর সৈন্য ছাড়ে সিংহনাদ।
সাগরের ঢেউ দেখি গুনেন্ত প্রমাদ।।’
বাঁকুড়া থেকে প্রাপ্ত পুঁথি-
‘বাপে পোত্র পক্ষরাজ গেল দিক উত্তর।
বানর কটক লঞা অভাদ গেলা দক্ষিণ সাগর।। তর্জে গর্জে বানর কটক ছাড়ে সিংহনাদ।
সাগর পাথার দেখিয়া বানর গুনিল প্রমাদ।।
বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত পুঁথি পরীক্ষা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন পুঁথিতে পাঠবৈষম্য আছে যথেষ্ট। লিপিকাররা তাঁদের নিজস্ব রুচি এবং দেশ ও কালের রুচি অনুযায়ী পুঁথির ভাষা অনেক সময় পরিবর্তন করেছেন এবং নিজ নিজ ভাব আবেগ এবং ভাষাকে পুঁথিতে স্থান দিয়েছেন। বর্তমানে প্রকৃত কৃত্তিবাসের রামায়ণকে খুঁজে পাওয়া যথেষ্ট কঠিন কাজ। অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘নানা পুঁথির পাঠ মিলিয়ে মূল কৃত্তিবাস পুনরুদ্ধার করা একপ্রকার অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। যদি কৃত্তিবাসী রামায়ণের সপ্তকাণ্ড পুঁথির অনেকগুলি কপি পাওয়া যেত, এবং সেগুলি পুরাতন যুগের হত, তাহলে ঐ সপ্তকাণ্ডে সম্পূর্ণ প্রাচীনতর পুঁথির পাঠ মিলিয়ে এবং সবচেয়ে পুরাতন পুঁথিটিকে মূল পুঁথি ধরে সম্পাদনা করলে কৃত্তিবাসী রামায়ণের আসলরুপ অনেকটা উদ্ধার করা যেত।’ এখন কৃত্তিবাসের নামে যে রামায়ণ চলছে, তার বেশীরভাগই বোধহয় কৃত্তিবাসের লেখা নয়। বটতলা থেকে প্রকাশিত কৃত্তিবাসী রামায়ণকে কিছুতে মূল রামায়ণ বলা যাবে না। প্রফুল্লচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘এখন বটতলায় যাহা কৃত্তিবাসী রামায়ণ বলিয়া বিক্রয় হয়, মূল কৃত্তিবাসী হইতে তাহাকে স্বতন্ত্র বলিলে অত্যুক্তি হয় না।’ উইলিয়াম কেরীর প্রচেষ্টায় শ্রীরামপুর মিশন থেকে সর্বপ্রথম কৃত্তিবাসী রামায়ণ মুদ্রিত হতে শুরু হয় ১৮০২ খ্রীষ্টাব্দে এবং ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দে পাঁচখণ্ডের কৃত্তিবাসী রামায়ণ মুদ্রিত হয়। শ্রীরামপুর মিশন থেকে ১৮০২ খ্রীঃ অব্দে প্রকাশিত কৃত্তিবাসের রামায়ণের কিছু অংশ তুলে ধরছি-
‘বান পেয়ে পক্ষীরাজ গেলেন উত্তর।
কটক লইয়া অঙ্গদ গেল দক্ষিণ সাগর।।
তর্জন গর্জন বানর ছাড়ে সিংহনাদ।
সাগরের ঢেউ দেখিয়া গণিল প্রমাদ।।
দিগ্বিদিক না চিনিল গগন মণ্ডল।
হিল্লোল কল্লোল করে সাগরের জল।।’১৩
অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “শ্রীরামপুর মিশন প্রকাশিত কৃত্তিবাসী রামায়ণের সম্পাদক মোটামুটিভাবে পুঁথির পাঠ মেনে নিলেও ছন্দ ও ভাষায় কিছু ত্রুটি সংশোধন করেছেন এবং তদ্ভব শব্দের বদলে তৎসম (অর্থাৎ সংস্কৃত) শব্দ যোগ করে পুঁথিটিকে পণ্ডিতের গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন। তবে পুঁথির পাঠ যে একেবারে বর্জিত হয়েছিল তা নয়, ছন্দের সমতা রক্ষার জন্য কিছু কিছু শব্দের অদল বদল হয়েছিল, কিছু পরিত্যক্তও হয়েছিল। কিন্তু বটতলা থেকে পরবর্তীকালে প্রকাশিত রামায়ণে যতটা স্বেচ্ছাচারিতা লক্ষ্য করা যায় শ্রীরামপুরের ১ম সংস্করণের পাঠে অতটা গোলমাল লক্ষ্য করা যায় না। এই সংস্করণটি কোন বিশেষ পণ্ডিত সম্পাদনা করেছিলেন তা জানা যায় না। যিনিই করুন, তিনি যে ‘সমুচা’ খোল-নলিচা বদলিয়ে ফেলেছিলেন তা নয়।’১৪
▲ শ্রীরাম পাঁচালী : কাহিনিবিন্যাস/বিষয়বস্তুঃ
* আদিকাণ্ড:
বিয়ুর চার অংশে প্রকাশ, রত্নাকর দস্যু ও রামনামের মাহাত্ম্য, মান্ধাতার উপাখ্যান, হরিশ্চন্দ্রের উপাখ্যান, সগরের অশ্বমেধ যজ্ঞ ও বংশনাশ, গঙ্গামাহাত্ম্য, সৌদাস রাজার উপাখ্যান, দশরথের বিবাহ, দশরথের প্রতি অন্ধকের অভিশাপ, দশরথের কৈকেয়ীকে বর দেবার অঙ্গীকার, দশরথের অশ্বমেধ যজ্ঞ ও ভগবানের চার অংশে জন্মগ্রহণ, শ্রীরামের জন্ম বিবরণ, সীতার জন্ম বিবরণ, অহল্যা উদ্ধার, রামচন্দ্রের হরধনুভঙ্গ ও বিবাহ, পরশুরামের দর্পচূর্ণ প্রভৃতি।
* অযোধ্যাকাণ্ড:
শ্রীরামচন্দ্রের অভিষেক প্রসঙ্গ, কৈকেয়ীর বর প্রার্থনা, পিতৃসত্য পালনের জন্য শ্রীরামের বনে গমনের সিদ্ধান্ত, ভরতের অযোধ্যায় আগমন, দশরথের মৃত্যু, শ্রীরাম কর্তৃক দশরথের শ্রাদ্ধ। সিংহাসনে শ্রীরামের পাদুকা রেখে ভরতের রাজ্যশাসন, দশরথের উদ্দেশ্যে সীতার পিন্ডদান, গয়া মাহাত্ম্য ইত্যাদি।
* আরণ্যকাণ্ড:
শ্রীরামচন্দ্রের চিত্রকূটে অবস্থান ও মুনিদের স্থানান্তরে যাওয়ার কল্পনা, শ্রীরামের অত্রি মুনির আশ্রমে গমন, শ্রীরামচন্দ্রের বনান্তরে ভ্রমণ, সূর্পণখার নাসাকর্ণচ্ছেদন, রাবণের সীতাহরণ, জটায়ুর সঙ্গে রাবণের যুদ্ধ, শ্রীরামের বিলাপ ও সীতা অন্বেষণ, শবরীর উপাখ্যান ইত্যাদি।
* কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড:
সুগ্রীবের আশঙ্কা ও রামের সঙ্গে মিলন, সীতা উদ্ধারে সুগ্রীবের প্রতিজ্ঞা, শ্রীরাম কর্তৃক বালি বধ, সুগ্রীবের অভিষেক, সীতা অন্বেষণে সৈন্য প্রেরণ, সম্পাতির কাছে সীতার সন্ধানলাভ ও সাগর উত্তীর্ণ হওয়ার উদ্যোগ ইত্যাদি।
* সুন্দরাকাণ্ড:
সাগর উত্তীর্ণ হওয়ার কথা, হনুমানের জন্মবৃত্তান্ত, হনুমানের সীতা অন্বেষণ, হনুমানের অশোক বনে প্রবেশ, সীতা ও হনুমানের কথোপকথন, হনুমানের লঙ্কাদাহন, বিভীষণের লঙ্কাত্যাগ, নল কর্তৃক সাগরে সেতু বন্ধন, শ্রীরামের ভস্মলোচন বধ ও সসৈন্যে লঙ্কায় প্রবেশ ইত্যাদি।
☆ লঙ্কাকাণ্ড:
রাবণের আদেশে শুক-সারণের রামসৈন্য পরিদর্শন, রামের মায়ামুণ্ড প্রদর্শনে সীতার বিলাপ, সরমা কর্তৃক সীতার সান্ত্বনা, অঙ্গদের রায়বার, রাম-রাবণের প্রথম যুদ্ধ, কুম্ভকর্ণের অকালে নিদ্রাভঙ্গ, যুদ্ধে কুম্ভকর্ণের পতন, ইন্দ্রজিতের যুদ্ধ ও সসৈন্য শ্রীরাম লক্ষ্মণের মূর্ছা, ইন্দ্রজিত বধ। রাবণের সীতাবধের সঙ্কল্প ও মন্দোদরী কর্তৃক বাধাদান, লক্ষ্মণের শক্তিশেলে শ্রীরামের বিলাপ, লক্ষ্মণের পুনর্জীবন লাভ, শ্রীরামের সঙ্গে রাবণের যুদ্ধ, শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গোৎসব, শ্রীরামের দেবীস্তুতি, রাবণ বধ, রাবণের কাছে শ্রীরামের রাজনীতি শিক্ষা, বিভীষণের শোক,
মন্দোদরীর বিলাপ ও শ্রীরামের কাছে অবৈধব্য বর লাভ, রাবণের সৎকার ও মুক্তি সীতার অগ্নিপরীক্ষা, শ্রীরামের কৈকেয়ী সম্ভাষণ ইত্যাদি।
☆ উত্তরাকাণ্ড: শ্রীরামের সভায় মুনিদের আগমন, রাবণ, কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণের জন্ম, তপস্যা ও বরপ্রাপ্তি, রাবণাদির বিবাহ ও মেঘনাদের জন্ম, কার্তবীর্যার্জনের কাছে রাবণের পরাজয়, যমলোকে রাবণের অভিযান, রাবণের কাছে যমের পরাজয়, সীতার বনবাস, শ্রীরামের সোনার সীতা নির্মাণ, শ্রীরামের অশ্বমেধ যজ্ঞ আরম্ভ, লবকুশের সঙ্গে শ্রীরামের যুদ্ধ, লবকুশ কর্তৃক পাতাল প্রবেশ, শ্রীরাম, ভরত ও শত্রুঘ্নের স্বর্গগমন।
• মূল্যায়ন:-
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় : –
“বিশ্ব-মানবের সাহিত্য-রস-পিপাসিত মনের জন্য
রাম কথা এক অক্ষয় রসভান্ডার রূপে বিরাজমান। …রামায়ণের প্রথম প্রচারের সময় হইতেই ইহার অমৃত-প্রবাহ ভারতীয় পারিবারিক জীবনকে পবিত্র ও পুণ্যময় করিয়া রাখিয়াছে। সত্যনিষ্ঠা, পিতৃভক্তি, পাতিব্রত্য, পত্নীপ্রেম, সৌভ্রাত্র, প্রভুভক্তি, আশ্রিত-রক্ষা প্রভৃতি যে-সমস্ত গুণে সমাজে মানুষের মধ্যে শান্তি ও সুখ সহজলভ্য হয়, যে-সমস্ত গুণে মানুষ দেবতার পদে উন্নীত হইতে পারে, নিখিল চিত্ত-মশ্বনকারী মনোহর উপাখ্যানের মাধ্যমে, উপাখ্যানের পটভূমিকা নগর ও অরণ্য উভয়ের পারিপার্শ্বিকে, অদ্ভুত সুন্দরভাবে সকলকে প্রীতি বিস্মিত করিবার সে সমস্ত গুণ ও আদর্শ রামায়ণে প্রতিফলিত হইয়া আছে।”
হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়: –
“তুর্কী অধিকারে গৃহের মধ্যেও বিশৃঙ্খলার উদ্ভব
ঘটিয়াছিল। অসহায় অত্যাচারিতকে উদ্বুদ্ধ করিতে জাতির সংহতির জন্য পুরুষসমাজে যে পৌরুষ, যে সততা, যে সৌহার্দ্য, যে ভ্রাতৃত্ব, তেজোবীর্য্য এবং ত্যাগের প্রয়োজন ছিল, বিধর্মীর বলাৎকার এবং প্রলোভনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার্থে বাঙ্গালার রমণীগণের মধ্যে যে দার্দ্য, যে সাহস, সহিষ্ণুতা এবং সতীত্বের মর্যাদাবোধের প্রয়োজন দেখা দিয়াছিল, কৃত্তিবাস সেই প্রয়োজনের পরিপূরক গায়ক রূপেই প্রাদুর্ভূত হইয়াছিল।”
কৃত্তিবাসী রামায়ণ: রসবিচার
• ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্’-রসসিদ্ধিই সাহিত্য সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। আলংকারিকদের মতে মহাকাব্যে একটি অঙ্গীরস থাকবে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে করুণ রসই মূল রস বা অঙ্গীরস। এই রসসিদ্ধির ক্ষেত্রে কৃত্তিবাসের কৃতিত্ব অপরিসীম। কৃত্তিবাস তাঁর মূল ঘটনাগুলিকে এমনভাবে সাজিয়েছেন যাতে ঘটনা ও চরিত্রগুলি করুণ রসের অনুসারী হয়। দশরথের মৃত্যু থেকে শুরু করে অরণ্যে সীতাহরণ এবং সীতার অগ্নিপ্রবেশ পর্যন্ত বেশির ভাগ ঘটনাতেই করুণ রসের স্ফুরণ ঘটেছে।
কৃত্তিবাসী রামায়ণে করুণ রসের যে বিস্তার তার মূলে রয়েছে বাঙালির কারুণ্যপ্রিয়তা। বাঙালির বেদনাকাতর স্বরূপকে তিনি তাঁর অঙ্কিত চরিত্রের মধ্যে উপস্থাপিত করেছেন। যেমন, ‘অরণ্যকাণ্ডে শ্রীরামের বিলাপ ও সীতা অন্বেষণ অংশে রামের যে চরিত্র পাই তাতে করুণ রসই ব্যক্ত হয়েছে:
বিলাপ করেন রাম লক্ষ্মণের আগে।
ভুলিতে না পারি সীতা সদা মনে জাগে।।
কি করিব কোথা যাব অনুজ লক্ষ্মণ।
কোথা গেলে সীতা পাব কর নিরূপণ।।
রামের অভিষেকের প্রাক্কালে কৈকেয়ীর বর প্রার্থনায় দুর্দশার যে ছবি এঁকেছেন তার মধ্যে রয়েছে করুণ রসের উপাদান:
কৈকেয়ীর পায়ে রাজা লোটে ভূমিতলে।
সর্বাঙ্গ তিতিল তাঁর নয়নের জলে।।
কিম্বা, সীতার অগ্নি পরীক্ষার সময়ে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে সীতাকে না দেখে
রামের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তাতে করুণরস জাগ্রত হয়।
কুণ্ডমধ্যে চাহি তবে সীতারে না দেখি।
ঝরিতে লাগিল তার দুটি পদ্ম আঁখি।।
দেখেন সংসার শূন্য যেমন পাগল।
ভূমে গড়াগড়ি যান হইয়া বিকল।।
বীররসের প্রকাশেও কৃত্তিবাস দৃঢ়তা দেখাতে পারেননি। কারণ, বীরত্ব প্রকাশ করবেন তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভক্ত। তাছাড়া যুদ্ধ বর্ণনার মধ্যেও মধ্যযুগীয় গতানুগতিকতা যথেষ্ট। তাই বীরবাহু, রাবণ, ইন্দ্রজিৎ প্রভৃতি চরিত্রের মধ্যে খুব বেশি বীরত্ব প্রকাশিত হয়নি। যেমন, ‘লঙ্কাকাণ্ডে’ ‘রাবণের দ্বিতীয়বার যুদ্ধে গমন’ অংশে দেখা
যায়-
ধনুর্ব্বাণ লয়ে রাবণ যায় মহাক্রোধে।
রাণী মন্দোদরী আসি পশ্চাতে বিরোধে।।
আপনার দোষে রাজা কৈলে বংশনাশ।
রামের সীতা রামে দেহ থাক গৃহবাস।।
মন্দোদরী পানে রাজা ফিরিয়া না চায়।
মৃত্যুকালে রোগী যেন ঔষধ না খায়।।
হাস্যরস বা কৌতুকরস সৃষ্টিতে কৃত্তিবাস প্রশংসনীয় কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। যেমন, ‘সুন্দরকাণ্ডে ‘হনুমান কর্তৃক লঙ্কা দহন’ অংশে কৌতুকরসের পরিচয় পাই:-
কেহ বা পুড়িয়া মরে ভার্য্যা পুত্র ছাড়ি।
কাহারো মাকুন্দ মুখ দগ্ধ গোঁফ দাড়ি।।
লঙ্কা মধ্যে সরোবর ছিল সারি সারি।
তাহাতে নামিল যত রাক্ষসের নারী।।
সুন্দর নারীর মুখ নীরে শোভা করে।
ফুটিল কমল যেন সেই সরোবরে।।
দূরে থাকি দেখে হনুমান মহাবল।
লেজের অগ্নিতে তার পোড়ায় কুন্তল।।
কিম্বা, ‘লঙ্কাকাণ্ডে’ ‘অঙ্গদের রায়বার’ অংশে কৌতুককর ঘটনার উপহার দিয়েছেন কৃত্তিবাস (ইন্দ্রজিতকে দেখে অঙ্গদের অভিব্যক্তি)।
অঙ্গদ বুঝিল এই বেটা মেঘনাদ।
আকার ইঙ্গিতে তারে পুছিল সংবাদ।।
অঙ্গদ বলে সত্য করে কওরে ইন্দ্রজিতা।
এই যত বসি আছে সব কি তোর পিতা।।
ধন্য নারী মন্দোদরী ধন্য রে তোর মাকে।
এক যুবতী এত পতি ভাব কেমনে রাখে।।
‘উত্তরাকাণ্ডে’ ‘সীতার বনবাস’ অংশে সীতার কাছে অন্তঃপুরে লক্ষ্মণ দুঃসংবাদ বহন করে নিয়ে গেলে সীতা লৌকিক নারীর মতো যেভাবে দেবরের সঙ্গে আলাপ করেছেন তাতে কৌতুক জাগ্রত হয়:
চৌদ্দ বর্ষ একত্রেতে বঞ্চিলাম বনে।
রাজ্যশ্রী পাইয়া তুমি পাসরিলে মনে।।
কহিয়াছি কত মন্দ কথা অবিনয়।
তেকারণে দেবর হে হয়েছ নিৰ্দ্দয়।।
কৃত্তিবাসী রামায়ণে ভক্তিরসের উদাহরণও যথেষ্ট। বাঙালি স্বাভাবিক ভাবেই ভক্তিপ্রবণ বলে কৃত্তিবাস তাঁর কাব্যে ভক্তিবাদের স্বরূপকে তুলে ধরেছেন। তাই রামনামের মহিমা কীর্তন করে লিখেছেন:
“রামনাম লৈতে ভাই না করিও হেলা।
সংসার তরিতে রাম নামে বান্ধ ভেলা।।
রামনাম স্মরি যেবা মহারণ্যে যায়।
ধনুর্বাণ লয়ে রাম পশ্চাতে গোড়ায়।।”১৫
মৌলিকতা:-
বাল্মীকি রামায়ণ এবং অন্যান্য রামায়ণ থেকে কাহিনী সংগ্রহ করে কৃত্তিবাস যেভাবে ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ রচনা করেছেন, তা একপ্রকার মৌলিক সৃষ্টি বলা চলে। বাঙালী জীবনের নানান দিককে উপস্থিত করেছেন তিনি এখানে। সংস্কৃত ভাষার গহ্বর থেকে উদ্ধার করে এনে শ্রীরামকথাকে কৃত্তিবাস বাঙালীর প্রাণের সামগ্রী করে তুলেছেন। মূল রামায়ণে কার্তিকের জন্ম, বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের বিরোধ, বিশ্বামিত্রের আখ্যান, অম্বরীষ রাজার যজ্ঞ ইত্যাদি সব আখ্যান কৃত্তিবাস বর্জন করেছেন। বিভিন্ন পুরাণ থেকে বিভিন্ন কাহিনীও সংগ্রহ করেছেন।
আদিকাণ্ডে দেখা যায়, মূল রামায়ণের বালকাণ্ডের দস্যু রত্নাকর প্রসঙ্গকে কৃত্তিবাস বর্জন করেছেন। অধ্যায় রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ডকে অনুসরণ করে বিষ্ণুর রাম-ভরত-লক্ষ্মণ-শত্রুঘ্ন এই চার অবতার রূপে জন্মগ্রহণের বিবরণ দিয়েছেন। রামনামের মাহাত্ম্যের কথা কৃত্তিবাস প্রচার করেছেন। দস্যু রত্নাকরের বাল্মীকি মুনিতে রূপান্তরিত হওয়া এবং রামায়ণ রচনার জন্য ব্রহ্মার আদেশ বিবৃত হয়েছে। ভাগবত ও পুরাণ থেকে কৃত্তিবাস হরিশ্চন্দ্র আখ্যান সংগ্রহ করেছেন। যোগ-বশিষ্ঠ রামায়ণ এবং পদ্মপুরাণ থেকে সংগ্রহ করেছেন ভগীরথের জন্ম আখ্যান। কাণ্ডার মুনির আখ্যান সংগ্রহ করেছেন স্কন্দপুরাণ থেকে। পুরাণ থেকেই তিনি সংগ্রহ করেছেন অযোধ্যায় শনির দৃষ্টি বর্ণন।
কৃত্তিবাস মৌলিক প্রতিভায় অনেক আখ্যান সংযুক্ত করেছেন। সৌদার্স-দিলীপ-রঘুর আখ্যান, জটায়ু ও মনির অভিভাবলে করেছেনবার ভাল প্রসঙ্গ, গৃহকের সঙ্গে মিত্রতা প্রসঙ্গ, হত্যা মাম্যান, ঘটায় ও মৌলিক প্রতিভাবলে সৃষ্টি করেছেন। বাঙালী জন মানসের দিকে তাকিয়ে কৃত্তিবাস রামায়ণ রচনা করতবাস
লঙ্কাকাণ্ডে দেখা যায়, মূল রামায়ণের অনেক আখ্যান বর্জন করে কৃত্তিবাস নতুন নতুন আখ্যান সংযোগ গাধন করেছেন। অনেক আখ্যান তিনি বিভিন্ন পুরাণ ও বিভিন্ন রামায়ণ থেকে সংগ্রহ করেছেন, তেমন মৌলিক প্রতিভাবলে অনেক আখ্যান সৃষ্টিও করেছেন। চন্ডীকার অকাল বোধনের আখ্যান কৃত্তিবাস পুরাণ থেকে সংগ্রহ করেছেন। অদ্ভুত রামায়ণ থেকে কবি সংগ্রহ করেছেন মেঘনাদের সঙ্গে লক্ষ্মণের যুদ্ধে লক্ষ্মণ অচৈতন্য হয়ে পড়ার পর হনুমানের ঔষধ সংগ্রহ প্রসঙ্গ, গন্ধমাদন পর্বত থেকে বিশল্যকরণী গাছ আনার সময় কলনেমিয় বাধাদান প্রসঙ্গ। রামচন্দ্রের সীতাকে উদ্ধারের পর হনুমানকে স্বর্ণহার উপহার প্রদান প্রসঙ্গ ইত্যাদি নানান
প্রসঙ্গ। মৌলিক প্রতিভায় কৃত্তিবাস সৃষ্টি করেছেন তরণী সেন, বীরবাহু, ভস্মলোচন বধ প্রসঙ্গ মহীরাবণ অহিরাবণ ২৫ প্রসঙ্গ, কক্ষতলে হনুমানের সূর্যকে ধারণ প্রসঙ্গ, অকালবোধন প্রসঙ্গ, হনুমানের ছদ্মবেশে মন্দোদরীর কাছ থেকে রাবণের মৃত্যুবাণ হরণ প্রসঙ্গ, সীতাকে মন্দোদরীর অভিশাপ প্রসঙ্গ ইত্যাদি।
বাংলার লোক মানসের প্রতি দৃষ্টি দিয়েই কৃত্তিবাস রামকথা পরিবেশন করেছেন। বাঙালীর কোমল স্বভাব ও আবেগময়তা তাঁর কাব্যে প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়। সীতাকে বিসর্জন দিতে গিয়ে বাঙালী প্রেমিকের মতই বিলাপ করেছেন রামচন্দ্র-
‘আজি হৈতে গেল মোর ভোগ অভিলাষ।
আর না যাইব আমি সীতার নিবাস।।
আজি হৈতে দূরে গেল সে সুখ সম্মান।
আর না যাইব আমি জানকির স্থান।।।
আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, ‘এই কাব্যের আশেপাশে বাঙ্গালাদেশের মল্লিকা ও যুথিকা ফুটিয়া আছে। বাংলাদেশের পরিচিত ‘বারমাসিয়া ফল আম কাঁঠাল,’ পরিচিত সব পাখীদের ভিড় দেখা যায় কৃত্তিবাসী রামায়ণে-
‘বাউই পাউই শিখী পক্ষী হরিতাল।
পায়রা প্রক্ষীবাজ এর শিকরী সঞ্চাল।।
বকবকী বাদুড় বাদুড়ী নুরি টিয়া।
ঝাঁকে ঝাঁকে চামচিকা কাষ্ঠ ঠোকরিয়া।।’
বাঙালীর ভক্তিভাবকে প্রচার করেছেন কৃত্তিবাস। রামভক্তির মহিমা প্রচার করতে অধ্যাত্ম রামায়ণ থেকে রত্নাকরের কাহিনীকে তিনি বাংলায় পরিবেশন করেছেন। কৃত্তিবাসের রামায়ণে ব্রহ্মা ইন্দ্রকে রাম নাম জপেরই উপদেশ দিয়েছেন। উত্তরাকাণ্ডে দেব ও রাক্ষসের যুদ্ধে চণ্ডীদেবীর চৌষট্টি যোগিনীদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণের চিত্র কৃত্তিবাসের মৌলিক সৃষ্টি। রাবণের রাক্ষস সৈন্য নিয়ে স্বর্গ আক্রমণে ইন্দ্র ভয় পেয়ে চন্ডীর স্তব করে বলেছেন-
‘তোমা বিদ্যমানে পুত্র দেবতা সংহার।
রাবণে মারিয়া কর সভার উদ্ধার।।
দেবী তখন সিংহের হুঙ্কার দিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন-
‘আপনি চণ্ডিকা যুঝে চৌষট্টি অক্ষরে।
কোপে অগ্নিমূর্তি হৈয়া রাক্ষসে সংহারে।।
বিপদ বুঝে রাবণ তখন চন্ডীর স্তব শুরু করেছেন-
‘মহাদেবের সেবক আমি তুমি ত ঈশ্বরী
সেকারণে তোমার সনে যুদ্ধ নাই করি।
আমারে জিনিলে মাতা কিছু নাহি কার্য
আমি মরিলে পরে শিবের হবে লাজ।
এই চণ্ডীই তো বাঙালীর আরাধ্যা। তাঁর স্তব করলেই তিনি তুষ্ট হন।
প্রসাদ দামের মত রামায়ণ গায়েন বলেছেন-
‘মহামুনি বাল্মীকি বন্দো হাথে করি তাল।
শ্লোক ছন্দে রামায়ণ রচিল রসাল।।
সে সকল কবিত্ব লোকে বুঝিতে বিষম।
কৃত্তিবাস করিল সরস মনোরম।।
বাল্মীকি রামায়ণের কাণ্ডগুলির নাম হল-বাল, অযোধ্যা, অরণ্য, কিষ্কিন্ধ্যা, সুন্দর, যুদ্ধ, উত্তর। অপরদিকে কৃত্তিবাসী রামায়ণের কাণ্ডগুলির নাম-আদি, অযোধ্যা, অরণ্য, কিষ্কিন্ধ্যা, সুন্দরা, লঙ্কা, উত্তরা। অধ্যাপক জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তী বলেছেন-‘বাল্মীকি রামায়ণের সূচনা কোন ব্যক্তি লোকমধ্যে বীর্যে ও ক্ষমায়, ঐশ্বর্যেও দীনতায় এবং চরিত্র গুণে শ্রেষ্ঠ-এই প্রশ্ন লইয়া; কৃত্তিবাসী রামায়ণের সূচনা বৈকুণ্ঠপতির এক অংশ চারি অংশে প্রকাশের বৃত্তান্ত লইয়া। বাল্মীকি রামায়ণের বহির্ভূত বহু আখ্যান কৃত্তিবাসে স্থান পাইয়াছে। তন্মধ্যে হরিশ্চন্দ্রের উপাখ্যান, দিলীপের অশ্বমেধ যজ্ঞ, রঘুর দিগ্বিজয়, অজ বিলাপ, তরণীসেনের কাহিনী, অহিরাবণ-মহীরাবণ বৃত্তান্ত, রাবণের চন্ডীপাঠ, রামচন্দ্রের অকালবোধন, লব-কুশের যুদ্ধ, প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাহা ছাড়া কাহিনী বিশেষের নব-রূপান্তর সাধন, কাহিনী বিন্যাসে ক্রমভঙ্গ এত আছে যে,তাহা গণনা করাও কঠিন। কোথাও আবার লোকপ্রসিদ্ধ পৌরাণিক নামগুলিও পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে।’ উত্তরাকাণ্ডে লক্ষ্মণের চোদ্দ বছরের ফল আনয়ন বিবরণ, শিবের বিবাহ ও লঙ্কারজন্ম, গরুড় ও পবনের যুদ্ধ, দেবতাদের সঙ্গে রাবণের যুদ্ধে চৌষট্টি যোগিনীদের আবির্ভাব, অযোধ্যায় বিশ্বকর্মার অশোকবন সৃষ্টি, সীতা নির্বাসনের পর স্বর্ণসীতা নির্মাণ, লব-কুশের যুদ্ধ প্রভৃতি ঘটনা এক প্রকার কৃত্তিবাসের মৌলিক সৃষ্টিই বলা চলে। সীতার পাতাল প্রবেশে সীতা যে ত্রিসত্য বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন তা বাল্মীকি রামায়ণের সঙ্গে কৃত্তিবাসের রামায়ণে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বাল্মীকি রামায়ণে সীতা বলেছেন-
‘যথাহং রাঘবাদন্যং মনসাপি ন চিন্তয়ে।
তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমইতি।।
মনসা কর্মণা বাচা যথা রামং সমর্চয়ে।
তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমইতি।।
যথৈতৎ সত্যমুক্তৎ মে বেস্মি রামাৎ পরংন চ।
তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমইতি।।’
কৃত্তিবাসের সীতা সেখানে বলেছেন-
‘মা হইয়া পৃথিবী মায়ের কর কাজ।
এ ঝিরের লাজ হৈলে তোমার যে লাজ।।
কত দুঃখ সহে মাগো আমার পরাণে।
সেবা করি থাকি সদা তোমার চরণে।।
উদরে ধরিলে মোরে তা কি মনে নাই।
তোমার চরণে সীতা মাগে কিছু ঠাঁই।।’
এই রকম অনেক পার্থক্যই লক্ষ্য করা যায়।
অনেকে জানিয়েছেন, বাল্মীকি রামায়ণে উত্তরকাণ্ড প্রক্ষিপ্ত, যুদ্ধ কান্ডেই তার সমাপ্তি ঘটেছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রথম ভাগ অতীত কথা এবং পরবর্তী ভাগ বর্তমান কথা। অতীতকথায় আছে রাক্ষসদের কাহিনী। এখানে রাবণের দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে নানান বর্ণিত হয়েছে। বর্তমান কথায় বলা হয়েছে ‘উত্তররামচরিত’। এখানে অযোধ্যার অশোকবনে রাম-সীতার পরিভ্রমণ, সীতার বনবাস, রবণ বধ, শম্বুকবধ, অশ্বমেধ যজ্ঞ, লব-কুশের রামায়ণ গান, সীতার পাতাল প্রবেশ, লক্ষ্মণ বর্জন, ইত্যাদি আখ্যান পরিবেশিত হয়েছে।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের চরিত্রগুলি মূল রামায়ণ থেকে অনেকক্ষেত্রে আলাদা হয়ে বাঙালী জীবনাদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। বাল্মীকির রামের মধ্যে মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠ গুণ লক্ষ্য করা গেছে। কৃত্তিবাসের রাম বালি বধ, সীতা বর্জন, শম্বুক বধের মত অন্যায় কাজ করেছেন। কৃত্তিবাসের রামায়ণে ভক্তিরসই প্রাধান্য লাভ করেছে। কৃত্তিবাসের রাবণ রামের হাতে মরতে ভয় করেন না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কৃত্তিবাসের ভক্তবাৎসল রাম,তিনি অধর্ম, পাপী সকলকেই উদ্ধার করেন। তিনি গুহক চণ্ডালকে মিত্র বলিয়া সম্বোধন করেন। বনের পশু বানরদিগকে তিনি প্রেমের দ্বারা ধন্য করেন। বিভীষণ তাঁর ভক্ত। রাবণ শত্রুভাবে তাঁহার কাছ হইতে বিনাশ পাইয়া উদ্ধার হইয়া গেল। এ রামায়ণের ভক্তিরই লীলা।’১৬
• কৃত্তিবাসী রামায়ণের জয়প্রিয়তার কারণ ও বাঙালি জীবনে তার প্রভাব:
কৃত্তিবাসের রামায়ণ ধনীর প্রাসাদ থেকে মুদির দোকান পর্যন্ত সমানভাবে সমাদৃত হয়ে আসছে। সময়ের পরিবর্তনেও বাঙালি কৃত্তিবাসী রামায়ণকে ভোলেনি। কবির গৌরব মহাকালের কষ্টিপাথরে খাঁটি সোনার মতো সমুজ্জ্বল। সমাজের সর্বস্তরে বাঙালির হৃদয়ে এত শ্রদ্ধা, গৌরব ও সহমর্মিতা খুব কম কবি লাভ করতে পেরেছেন। কবি কৃত্তিবাসের জনপ্রিয়তার প্রথম ও প্রধান কারণ-সমগ্র বঙ্গভূমির সঙ্গে তিনি আর্য রামায়ণের যথাযথ পরিণয় সাধনে সার্থক। রামকথাকে তিনি বাংলার কোমল মাধুর্যে, সহজ লাবণ্যে, ভক্তির সৌরভে শোধন করে একান্তভাবে বাঙালির প্রাণের কথারূপে প্রচার করেছেন।
দ্বিতীয়ত, কৃত্তিবাসের কাব্যে বাঙালির গৃহজীবনের প্রতিচ্ছবি সুস্পষ্ট। এর মধ্যে সীতা দেবর লক্ষ্মণের সঙ্গে রসিকতা করেন; সীতা মুনিপত্নীদের সম্মুখে স্বামীর নাম উচ্চারণ করেন না। কৃত্তিবাসের সীতা বঙ্গবধূর আদর্শে চিত্রিত।
তৃতীয়ত, কৃত্তিবাসের রামায়ণে বিভিন্ন রসের মিশ্রণ-তার মধ্যে করুণ রসে কবির সৃষ্টি প্রতিভা অনন্য। সীতা হরণের পর রামচন্দ্রের বিলাপ অংশে কবি মানুষের দুঃখকে প্রকৃতির দর্পণে প্রতিফলিত করেছেন। তিনি কাতরভাবে বলেছেন-
হে অরণ্যধন্য তুমি ধন্য বৃক্ষগণ।
কহিয়া সীতার বার্তা রাখহ জীবন।।
মণিহারা ফণীর ন্যায় সীতাহারা রামচন্দ্র। কৃত্তিবাসের শ্রীরামচন্দ্র বঙ্গযুবকের ন্যায় কোমল এবং ক্রন্দনপরায়ণ। বাংলার মানুষের কাছে সর্বযুগে বাল্মীকি-সৃষ্ট রামচন্দ্র অপেক্ষা কৃত্তিবাসের রামচন্দ্র অনেক বেশি আপনার।
চতুর্থত, কৃত্তিবাসের কাব্যে ফল্গুধারার ন্যায় সর্বব্যাপ্ত এক ভক্তির ভাগীরথী প্রবাহ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “কৃত্তিবাসের রাম ভক্তবৎসল রাম। তিনি অধম পাপী সকলকেই উদ্ধার করেন। তিনি গুহক চণ্ডালকে মিত্র বলিয়া আলিঙ্গন করেন। বিনয়, নম্রতা, দয়ার জীবন্ত বিগ্রহ রামচন্দ্র। কৃত্তিবাসের সীতা ও রামচন্দ্র বাঙালির বড়ো প্রিয়জন, আত্মীয় অপেক্ষাও আত্মীয়।”
পঞ্চমত, কৃত্তিবাস পুরাণ অনুবাদের মাধ্যমে বাঙালির জীবন-রস পরিবেশন করেছেন। বাঙালি জীবনের কালনিরপেক্ষ সর্বকালীন ভাবসুন্দর রূপটি এই কাব্যে পাওয়া যায়। পিতৃভক্তি, ভ্রাতার প্রতি স্নেহ, পাতিব্রত্য, ন্যায়-বোধ ইত্যাদির দ্বারা কবি বঙ্গ-গৃহস্থের রূপ অঙ্কন করেছেন।
ষষ্ঠত, বাঙালির জীবন-জীবিকা, নিসর্গ-প্রকৃতি, আচার-প্রথা, বেশভূষা ও রীতিনীতি সমকালীন অন্য কোনো কবির কাব্যে এভাবে আত্মপ্রকাশ করেনি।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙালি জাতির ‘হৃৎপদ্মসম্ভব’ ও ‘হৃপদ্মবাসী’। জাতীয় জীবনের কথা যেমন রামায়ণে ঠাঁই পেয়েছে, তেমনি কৃত্তিবাসী রামায়ণ জাতীয় জীবনকেও প্রভাবিত করেছে। কৃত্তিবাসের রচনার মধ্যে রয়েছে বাংলার সমাজ-সংসার ও প্রকৃতি ভুবনের চিত্রকল্প। তাই বাঙালি জীবনের আহার-বিহার, আনন্দ-বেদনা, ভক্তি-মুক্তি বাঙালির ভাব ও ভাবনায় রচিত কৃত্তিবাসের রামায়ণী কথা চিরকাল প্রাণের কাব্য।১৭
তথ্যসূত্র-
১।দীনেশ চন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য।
২। বঙ্গভাষার ইতিহাস,মহেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।
৩। সুখময় বন্দোপাধ্যায়, বাংলাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ) সম্পাদনা -রমেশচন্দ্র মজুমদার।
৪। রাজনারায়ণ বসু ‘বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা’ (১৮৭৮)।
৫।১৩০৪ বঙ্গাব্দের ২য় সংখ্যায় ‘সাহিত্য পরিষদ’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রফুল্লচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘কৃত্তিবাস পণ্ডিত’ প্রবন্ধের নির্বাচিত অংশ।
৬।১৩৪০ বঙ্গাব্দের ১৮ আষাঢ় সাহিত্য পরিষদের দ্বিতীয় মাসিক অধিবেশনে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ‘কৃত্তিবাসের জন্মশক’ নামক যে প্রবন্ধ পাঠ করেন, তার নির্বাচিত অংশ।
৭। ভারতবর্ষ, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৫৯, পৃঃ ৫৫৬।
৮। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ২১০২ সংখক পুথিব ৪২৭ খ পত্র।
৯।অস্মন্নিকটে রক্ষিত পুথির ৭৫ ক পত্র।
১০।রাজসাহী মিউজিয়ামে রক্ষিত বিক্রমপুর থেকে সগৃহীত পুথির ৩১৬ ক’পত্র।
১১। আড়িয়াদহেক ঘটক গৃহে রক্ষিত একটি পুথির ৩৫৯ : ক পত্র।
১২। কৃত্তিবাস পন্ডিত, অধ্যাপক শ্রীদীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, সাহিত্য সৈকত পত্রিকা, রামায়ণ সংখ্যা, পঞ্চম বর্ষ, ডিসেম্বর ১৯৮৫।
১৩।আদি-মধ্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, তপন কুমার চট্টোপাধ্যায়।
১৪। বাংলাসাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়।
১৫। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, আদি ও মধ্য যুগ, ড: দেবেশ কুমার আচার্য্য।
১৬।আদি-মধ্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, তপন কুমার চট্টোপাধ্যায়।
১৭।বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, আদি ও মধ্য যুগ, ড: দেবেশ কুমার আচার্য্য।
(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)