মুর্শিদাবাদ, আধুনিক ভারতের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাম। মধ্যযুগের সমাপ্তি, আধুনিক যুগের সূচনা এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ এই পুণ্যভূমি থেকেই অঙ্কুরিত হয়েছিল। এর বর্তমান আকৃতি ভৌগোলিক নয়, বরং প্রশাসনিক বিন্যাসের ফল। ২৩°৪৩” – ২৪°৫২” উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৭°৪৯” – ৮৮°৪৪” পূর্ব দ্রাঘিমার মধ্যে অবস্থিত মুর্শিদাবাদ উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, মুর্শিদাবাদের আয়তন ৫৩২৪ বর্গ কিমি, মোট জনসংখ্যা ৭১,০৩,৪০৭ জন এবং সাক্ষরতার হার ৬৬.৫৯%। ভাগীরথী নদী এই জেলাকে রাঢ় (পশ্চিমাংশ) ও বাগড়ি (পূর্বাংশ) অঞ্চলে বিভক্ত করেছে, যেখানে ভৌগোলিক প্রকৃতি, আবহাওয়া, অর্থনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার ধরনে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিমাংশ রাঢ় অঞ্চলের অবিচ্ছেদ্য অংশ, আর পূর্বাংশ বা বাগড়ি অঞ্চল নদিয়া ও বাংলাদেশের সমতল ভূমির অংশ।
প্রাচীনকাল থেকেই মুর্শিদাবাদ শিক্ষা ও সংস্কৃতির এক ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। বহরমপুরের কাছে অবস্থিত কর্ণসুবর্ণ একসময় ভারতের অন্যতম উল্লেখযোগ্য শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ ধর্মীয় ও শিক্ষাকেন্দ্র “রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার”-ও এখানে অবস্থিত ছিল, যার উল্লেখ বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন-সাং-এর লেখায় পাওয়া যায়। ১৯৬০-এর দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্ণসুবর্ণে খননকার্য চালিয়ে ছাত্রাবাস ও অধ্যয়ন কেন্দ্রের প্রচুর প্রমাণ খুঁজে পায়। পালদের রাজত্বকালে জেলার উত্তর-পশ্চিম দিকে (বর্তমান জঙ্গিপুর মহকুমা) কয়েকটি বুদ্ধ বিহার ও অধ্যয়ন কেন্দ্র ছিল। এমনকি সেন রাজবংশের সময়েও মুর্শিদাবাদ শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল, যেখানে প্রাকৃত, পালি ও সংস্কৃত ভাষার অধ্যয়ন হতো।
মধ্যযুগে সুলতান ও মুঘলদের রাজত্বকালে আরবি ও ফারসি ভাষার প্রসার ঘটে। মুসলিম শাসকরা বুদ্ধ বিহার ও টোলগুলির বদলে মাদ্রাসা ও মক্তব স্থাপন করে ইসলাম ও ফারসি ভাষার অধ্যয়ন ছড়িয়ে দেন। সময়ের সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একে অপরের কাছাকাছি আসে, যা শিক্ষার উন্নতিতে সাহায্য করে। এর ফলস্বরূপ, মধ্যযুগে মুর্শিদাবাদে আরবি, ফারসি ও সংস্কৃতের মতো ভাষার ব্যাপক প্রসার ঘটে।
ব্রিটিশ শাসনের আগমন ও শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন
পলাশীর যুদ্ধ ভারতের ইতিহাসে মধ্যযুগের অবসান ঘটিয়ে আধুনিক যুগের সূচনা করে এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠা হয়। শিল্প বিপ্লব, পাশ্চাত্য শিক্ষা, উদারনৈতিক চিন্তাভাবনা এবং মুদ্রণ যন্ত্রের বিকাশ এই পরিবর্তনে সাহায্য করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের ঔপনিবেশিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে সাহায্য করে। ১৮১৩ সালে ব্রিটিশ সরকার চার্টার আইন পাশ করে ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থা ও এর উন্নয়নে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৩৫ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক উইলিয়াম অ্যাডামকে বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা জরিপ করে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করার নির্দেশ দেন। এই প্রতিবেদন থেকেই প্রথমবারের মতো মুর্শিদাবাদের শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র আমাদের সামনে আসে।
উইলিয়াম অ্যাডাম ১৮৩৫ থেকে ১৮৩৮ সালের মধ্যে তাঁর প্রতিবেদন তিন দফায় পেশ করেন। ১৮৩৮ সালের প্রতিবেদনটি ক্ষেত্র সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল। অ্যাডাম মুর্শিদাবাদ ও দৌলতাবাদের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছিলেন। তাঁর প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, “মুর্শিদাবাদের ২০টি থানায় মোট ৬৭টি স্কুল আছে। এর মধ্যে ৬২টি বাংলা মাধ্যম এবং বাকি ৫টি হিন্দি মাধ্যম। হিন্দি মাধ্যম স্কুলগুলো পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা লোকেদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।” তিনি আরও জানান যে, “১১টি গ্রাম, মহল্লা বা বাজারে দুটি করে স্কুল আছে, তাদের মোট ২২টি স্কুল আছে। এর মধ্যে ২০টি বাংলা মাধ্যম এবং ২টি হিন্দি মাধ্যম। বাকি গ্রামগুলোতে মোট ৪৫টি স্কুল আছে।”
শিক্ষকতার পেশায় সকল বর্ণের মানুষ নিযুক্ত ছিলেন, তবে হিন্দু কায়স্থরা সংখ্যায় বেশি ছিলেন। সেই সময় মুর্শিদাবাদে ৩৯ জন হিন্দু কায়স্থ শিক্ষক ছিলেন যারা মনে করতেন শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা এবং তারা এটি তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পেয়েছেন। ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, সদগোপ এবং ক্ষত্রিয়রাও শিক্ষকতা পেশায় জড়িত ছিলেন। মুসলিম শিক্ষকও ছিলেন। নিম্ন বর্ণের লোকেরা শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করলেও সমাজে তাদের সম্মান বৃদ্ধি পেত এবং অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের সেইসব স্কুলে পাঠাতে দ্বিধা করতেন না।
অ্যাডামের প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায় যে, বাংলার অন্যান্য জেলার মতো মুর্শিদাবাদের স্কুলগুলোর নিজস্ব কোনো ভবন ছিল না। ভবনগুলো ধনী পরিবারের দান বা তহবিল সংগ্রহ করে এবং কখনো কখনো শিক্ষকদের খরচে তৈরি করা হতো। স্কুলগুলো শিক্ষকের বাড়ি, গ্রামের মন্দির, গ্রামের মসজিদ, কোনো একজন অভিভাবকের বাড়ি বা গাছের নিচে পরিচালিত হতো। জেলার ৬৭টি স্কুলে মোট শিক্ষকের সংখ্যা ছিল ১০৮০ জন। সকল জাতি ও ধর্মের ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে আসত এবং ১০ বছর ধরে পড়াশোনা ও যোগ্যতা অর্জন করত। মুর্শিদাবাদ জেলার বিখ্যাত আইনজীবী এবং জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ব্রজভূষণ গুপ্ত একটি স্কুলের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যেখানে ছাত্রছাত্রীরা মাটিতে বসে তালপাতার বই থেকে শিখছিল। এই বর্ণনা উইলিয়াম অ্যাডামের বর্ণনার সাথে মিলে যায়। উনিশ শতকের শুরুতে ইংরেজি শিক্ষা শুরু হলেও এটি ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে দিতে পারেনি। প্রাথমিক শিক্ষায় ভারতীয় পদ্ধতিই ছিল শিক্ষার একমাত্র উৎস।
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ও প্রাথমিক প্রতিবন্ধকতা
উইলিয়াম অ্যাডাম তাঁর ১৮৩৫ সালের প্রথম প্রতিবেদনে বলেছিলেন যে মুর্শিদাবাদে ‘বেঙ্গলি অক্সিলিয়ারি মিশনারি সোসাইটি’ দ্বারা পরিচালিত একটি ইংরেজি স্কুল ছিল। কিন্তু, ভালো ও যোগ্য শিক্ষকের অভাব এবং স্থানীয় মানুষের অনীহার কারণে স্কুলটি সফল হতে পারেনি। তাঁর ১৮৩৮ সালের তৃতীয় প্রতিবেদনে অ্যাডাম নিজামত কলেজের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি আরবি ও ফারসি শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষার কথাও উল্লেখ করেছেন। লন্ডনের মিশনারি সোসাইটির রেভারেন্ড পিটারসন দ্বারা পরিচালিত একটি মাত্র ইংরেজি স্কুল ছিল। এটি একটি ফ্রি স্কুল ছিল। পিটারসন সপ্তাহে তিন দিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা তাঁর নিজের বাড়িতে ছাত্রদের পড়াতেন। মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১৩ জন। সেখানে মুরের ব্যাকরণ, দি ইংলিশ রিডার এবং গোল্ডস্মিথের হিস্টরি অফ ইংল্যান্ড পড়ানো হতো। অ্যাডাম তাঁর প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেছেন যে ভারতীয় ও ইউরোপীয় উভয় পক্ষ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চলছিল।
বিভিন্ন সূত্র থেকে অনুসন্ধানের পর জানা গেছে যে, ১৮৩৫ সালের আগে ব্রিটিশ সরকার বাংলায় শিক্ষার উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অ্যাডামের প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকার পদক্ষেপ নেয়। স্যার চার্লস উড মেকলের ‘ফিলট্রেশন থিওরি’ বাতিল করে ‘গণশিক্ষা’র পক্ষে মত দেন। তিনি সরকারের সাহায্যে এটি প্রসারিত করারও সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলস্বরূপ ১৮৫৭ সালে কলকাতা, বোম্বে এবং মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকার প্রাথমিক শিক্ষায়ও অর্থায়ন শুরু করে, তবে তা পর্যাপ্ত ছিল না। একটি সরকারি প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৮৮১-৮২ সালে জেলার মোট জনসংখ্যা ছিল ১২০,১০০। কিন্তু বার্ষিক শিক্ষা বাজেট ছিল মাত্র ১০,০০০ টাকা। সেই সময় মুর্শিদাবাদ জেলায় মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১২,০০০।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রসার ও নারী শিক্ষা
মুর্শিদাবাদে শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে ১৮৪৬ সালে সৈদাবাদ ও জঙ্গিপুরে এবং ১৮৪৮ সালে কান্দিতে নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। হার্ডিংয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সরকার শিক্ষকদের বেতন সরকারি কোষাগার থেকে দিত। ১৮৫৬-১৮৬৪ সালের মধ্যে বহরমপুর গোরাবাজার, জিয়াগঞ্জ ও আজিমগঞ্জে তিনটি স্থানীয় স্কুল খোলা হয়। শিক্ষকরা বাংলা ও হিন্দিতে উভয় ভাষায় ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন। ১৮৫৬ সালে স্থানীয় জমিদার এবং অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কাশিমবাজার, শক্তিপুর, খাগড়া, পঞ্চথুপী ও রাজারামপুর সহ বিভিন্ন স্থানে ছয়টি নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। ১৮৬৬ সালে সরকার বহরমপুর, তেঁইয়া, দহপাড়া, ভগবানগোলা, সুতি, জয়পুর, মালিহাটি, এরোয়ালি এলাকায় আটটি ভারতীয় স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। এই স্কুলগুলিতে বর্ণপরিচয়, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল এবং নৈতিকতা পড়ানো হতো।
স্বামী অখানন্দ স্মৃতির বিবরণ থেকে জানা যায় যে, ১৮৯৭-১৮৯৮ সালের দিকে পলাশী থেকে সারগাছি পর্যন্ত কোনো স্কুল ছিল না। সারগাছি রামকৃষ্ণ মিশন কিন্ডারগার্টেন স্কুল ১৮৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুলটি সেই এলাকার শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দিত। ১৮৭৪-১৮৭৫ সালের একটি সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুর্শিদাবাদে ২৫১টি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল এবং ২৫০টি পাঠশালা ছিল। মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১৬০০।
উনিশ শতকের শুরুতে, লন্ডন মিশনারি সোসাইটি প্রেরিত একদল ধর্মপ্রচারক বহরমপুরে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। এই দলে ড. স্টিফেন সাটান, মিস পিটারসন, মিস মেকাইয়া প্রমুখ মিশনারিরা ছিলেন। ১৮০৯-১৮২৪ সালের মধ্যে তারা বহরমপুর, কালীকাপুর, ফরাসডাঙ্গা, দৌলতাবাদ এবং লালবাগ-এর মতো এলাকায় ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। নবাব পরিবারের সন্তানদের জন্য ১৮১৫ সালে নিজামত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুলে আরবি, ফারসি ও ইংরেজি পড়ানো হতো। পরে এটি হিন্দুদের জন্যও উন্মুক্ত করা হয়। ১৮৩৭-১৮৩৮ সালে সৈদাবাদে একটি ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু সেটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৮৩৮ সালে জঙ্গিপুরে আরও একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৪৫ সালে মিস মিকাইয়া খাগড়ায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যা এখন খাগড়া গুরুদাস তারাসুন্দরী ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল ১৮৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কুলের বর্তমান ভবনটি মহারাজা মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দীর আর্থিক সহায়তায় ১৯৯১ সালে নির্মিত হয়। এই স্কুলটি এখন মুর্শিদাবাদের অন্যতম সেরা স্কুল হিসেবে বিবেচিত।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে মুর্শিদাবাদে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ও উন্নয়নে কাশিমবাজারের তরুণ রাজা কৃষ্ণনাথ রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন যে কেবল পাশ্চাত্য শিক্ষাই এই দেশের মানুষকে মুক্ত করতে পারে। তিনি মুর্শিদাবাদে একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং এই উদ্দেশ্যে একটি উইলও করেছিলেন। তাঁর স্বপ্ন সত্যি হয় যখন তাঁর বিধবা স্ত্রী মহারানী স্বর্ণময়ী ১৮৫৩ সালের ১লা নভেম্বর তৎকালীন বহরমপুর কলেজ (বর্তমানে কৃষ্ণনাথ কলেজ) প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেন। এই কলেজ গত ১৫০ বছর ধরে মুর্শিদাবাদ ও বাংলায় জ্ঞান ছড়িয়ে দিচ্ছে। ১৯৬৩ সালে কমার্স কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি রাতে কৃষ্ণনাথ কলেজের ভবন ব্যবহার করে ক্লাস চালাত। পরে এটি অন্য একটি স্থানে স্থানান্তরিত হয় যা এখন বহরমপুর কলেজ নামে পরিচিত। ১৮৫৩ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত মুর্শিদাবাদের একমাত্র কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির চাপ ছিল। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তৎকালীন মুর্শিদাবাদ জেলা কালেক্টরের স্ত্রী শ্রীমতী অমিয়া রাও ১৯৪৬ সালে মাত্র ২৬ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বহরমপুর গার্লস কলেজ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেন। খ্রিস্টান মিশনারিরা ১৯৩৮ সালে ইউনিয়ন ক্রিশ্চিয়ান ট্রেনিং কলেজ নামে মুর্শিদাবাদে প্রথম শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রশিক্ষণ কলেজটি জেলার ভেতরে ও বাইরে উভয় স্থানেই সুপরিচিত।
মুর্শিদাবাদে নারী শিক্ষার অবস্থাও বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। ১৯৫০-১৯৫১ সালে জেলার সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১২.৬৮%, যেখানে মহিলাদের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ০৬.৮০%। গ্রাম ও শহরের সাক্ষরতার হারে ব্যাপক পার্থক্য ছিল, যা মূলত সুযোগ-সুবিধার পার্থক্যের ফল। নারী সাক্ষরতার হার কম হওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের অনগ্রসরতা। আঠারো ও উনিশ শতকে নারী শিক্ষার জন্য ব্যবস্থা ছিল। অভিজাত হিন্দু ও মুসলিম উভয় পরিবারের মেয়েরা বাড়িতেই শিক্ষা গ্রহণ করত। খ্রিস্টান মিশনারিরাই মুর্শিদাবাদে নারী শিক্ষার পথ খুলেছিলেন। তারা ১৯৩০-এর দশকে মহিলাদের জন্য নিউক্যাসেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, কিন্তু সেটি বেশিদিন টেকেনি। প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর মহাকালী পাঠশালা ১৯৪৯ সালে সরকারি অনুমোদন পায়। মহারাজা মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দী এবং আরও কয়েকজন মিলে ১৯২৭ সালে ৭ জন ছাত্রী নিয়ে বহরমপুর গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্কুলটি প্রথমে কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলে এবং পরে সেন্ট্রাল কারেকশনাল হোমে চলত। ১৯৩৪ সালে সরকারি অনুমোদন পাওয়ার পর এই স্কুলটির মহারাজার স্ত্রীর নামে মহারানী কাশীশ্বরী গার্লস হাই স্কুল নামকরণ করা হয়। একই বছরে শ্রীমতী সুষমা সিংহ গোরাবাজারে শিল্পমন্দির গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ১৯৪৭ সালের পর এই স্কুলটি উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হয় এবং মুর্শিদাবাদে নারী শিক্ষার পথ দেখায়। ১৯৪৬ সালে বহরমপুর গার্লস কলেজ প্রতিষ্ঠার পর মেয়েরা ব্যাপক সংখ্যায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়। মুর্শিদাবাদে স্বাধীনতার পর মেয়েদের স্কুলের সংখ্যা বাড়লেও, উনিশ শতকে নারী শিক্ষার জীর্ণ দশা এখনও দৃশ্যমান।
নবাবী আমলে শিক্ষা ব্যবস্থা:-
শিক্ষা সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক উন্নতির একমাত্র উপায়। ভারতীয় সমাজে মুসলিমরা সবচেয়ে কম শিক্ষিত অংশ, এবং পশ্চিমবঙ্গে তাদের অবস্থা অন্যান্য রাজ্যের চেয়েও খারাপ। মুর্শিদাবাদের মুসলিমদের অবস্থা বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো। মুর্শিদাবাদের শিক্ষাব্যবস্থা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে গেলে, প্রথমে নবাবদের সময়কার শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা দরকার।
নবাবরা বিদ্বান ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কিছু নবাব নিজেরাও খুব জ্ঞানী ছিলেন। নবাব মুর্শিদ কুলি খান বিদ্বান ও অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তিদের বৃত্তি বাড়িয়েছিলেন। কথিত আছে, তিনি প্রায় ২৫০০ ক্বারী (যারা কুরআন পড়েন) এবং অন্যান্য পুণ্যবান ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। নবাব আলীবর্দি খান নিজেও একজন বড় পণ্ডিত ও সুবক্তা ছিলেন। তিনি পণ্ডিতদেরও খুব পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং সংস্কৃতিবান ব্যক্তিদের সঙ্গে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনার ব্যবস্থা করতেন। তাঁর সময়ে ইসলামিক জ্ঞান, ফারসি ভাষা এবং গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো অন্যান্য শিক্ষাধারা বিকাশ লাভ করেছিল। জায়েত হুসেইন খান, তাকি কুলি খাঁ, আলী ইব্রাহিম, হাজী মোহাম্মদ খান, মীর মোহাম্মদ আলী ফাজিল ছিলেন কিছু পণ্ডিত, যাঁরা আলীবর্দির দরবারকে উজ্জ্বল করেছিলেন। মীর মোহাম্মদ আলীর নিজস্ব একটি বড় গ্রন্থাগার ছিল, যেখানে প্রায় ২০০০ বই ছিল। নবাব আলীবর্দি মীর মোহাম্মদ আলীকে খুব শ্রদ্ধা করতেন।
নবাবের দরবারে কিছু মহান চিকিৎসকও ছিলেন, তাঁদের মধ্যে হাকিম তাজউদ্দিন, হাকিম হাদী আলী খান অন্যতম। আলীবর্দি হাকিম হাদী আলী খানের ওপর অগাধ আস্থা রাখতেন এবং তাঁকে খুব প্রশংসা করতেন। আমরা সেই যুগের কিছু বিখ্যাত ঐতিহাসিককেও নবাবদের দরবারে দেখতে পাই। ইউসুফ আলী, গোলাম হুসেইন খান তাবাতাবাই, করম আলী ছিলেন আমাদের আলোচনার সময়ের কিছু মহান ঐতিহাসিক।
পুরো নবাবী আমল জুড়েই বাংলা সাহিত্যেরও বিকাশ ঘটেছিল। এই সময়ের বিদ্বান ব্যক্তিরা উর্দু, হিন্দি, ফারসি সাহিত্যেও বড় অবদান রেখেছিলেন। এই সময়ের সুফি সাহিত্যের কথা বলা উচিত। ইসলামের প্রসারের জন্য সুফি সাহিত্যিকরা সাধারণ মানুষকে ইসলামিক জ্ঞান ও শিক্ষা বোঝানোর জন্য বাংলায় বই লিখেছিলেন। এটি প্রমাণ করে যে নবাবদের অধীনে শিক্ষার অবস্থা ভালো ছিল। এই সময়ে বাংলা ভাষার একটি ভিন্ন ধারা এখানে তৈরি হয়েছিল, যাকে ‘মুসলমানী বাংলা’ বলা হয়, যা ফারসি, উর্দু আর বাংলা ভাষার মিশ্রণ। এই মিশ্র ভাষাগুলো থেকে এক ভিন্ন ধরনের সাহিত্যের জন্ম হয়েছিল, যা সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল। উচ্চ শ্রেণী এই সাহিত্য দ্বারা কম প্রভাবিত হয়েছিল।
সেই সময়ে ফারসি ছিল দাপ্তরিক ভাষা। মুসলিম ও হিন্দু উভয়ই এই ভাষা অনুশীলন করত, কারণ এটি তাদের সরকারি বিভাগে চাকরির সুযোগ করে দিত। নবাবদের অধীনে মুর্শিদাবাদ শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক বিশিষ্ট স্থান লাভ করেছিল। গোলাম হুসেইন বিদ্বান ব্যক্তি, চিকিৎসক, গণিতবিদ এবং অন্যান্য পণ্ডিত ব্যক্তিদের একটি দীর্ঘ তালিকা দিয়েছেন। এর থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে, পর্যালোচনার সময় মুর্শিদাবাদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। মুর্শিদ কুলি খান শিক্ষার উন্নতির জন্য একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি ‘কারা মাদ্রাসা’ নামে পরিচিত ছিল, কারণ এটি অতিথি নিবাস হিসাবেও ব্যবহৃত হত এবং নবাব এটি রক্ষণাবেক্ষণ করতেন।
কিন্তু আমরা বলতে পারি যে, এই সময়ে শিক্ষার কোনো সুসংগঠিত ব্যবস্থা ছিল না। পুরো শিক্ষাব্যবস্থা কেবল নবাব, জমিদার ও অভিজাতদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও অনুপ্রেরণায় পরিচালিত হত। মুসলিম ও হিন্দু উভয় শিক্ষার্থীর জন্য পাঠশালা ও টোলখানা ছিল। মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য মক্তব ও মাদ্রাসা ছিল এবং হিন্দু শিক্ষার্থীদের জন্য টোল ও চতুষ্পাঠী ছিল। মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা নবাব এবং অন্যান্য সম্পন্ন মুসলিমদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল। মক্তবগুলো কেবল মুসলিম ছেলেদের জন্য ছিল। এই মক্তবগুলোর শিক্ষকদের আখুঞ্জি বলা হত। তাঁরা আরবি, উর্দু ও ফারসি শেখাতেন। তাঁরা প্রাথমিক গণিতও শেখাতেন এবং শিক্ষার্থীদের ইসলামিক শিক্ষা দিতেন। শিক্ষার্থীরা লেখার জন্য কলাপাতা এবং দেশীয় কাগজ ব্যবহার করত। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পারিবারিক কাজে যোগ দিত এবং কিছুজন কৃষিকাজকে জীবিকা হিসাবে বেছে নিত। উজ্জ্বল ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার জন্য মাদ্রাসায় যেত। মাদ্রাসাগুলো মূলত মসজিদ বা ইমামবাড়ির পাশে অবস্থিত ছিল এবং সবই সরকারি আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত হত। শিক্ষাব্যবস্থা চালানোর জন্য করমুক্ত জমিও এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া হত। এছাড়াও বৃত্তিও দেওয়া হত। শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসায় বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার সুবিধা দেওয়া হত এবং তাদের শিক্ষার জন্য কোনো খরচ দিতে হত না। মৌলভি এবং ইসলামিক জ্ঞানের বিদ্বান ব্যক্তিরা শিক্ষা দিতেন। পাস করা শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরি পেত এবং কেউ কেউ শিক্ষকতা শুরু করত। নিম্ন শ্রেণীর মেয়েরা মাদ্রাসায় বা এমনকি মক্তবেও যেত না। কিন্তু উচ্চ শ্রেণীর মুসলিম মেয়েরা বাড়িতে শিক্ষা নিতে পারত। আমরা দেখতে পাই যে, রাজপরিবারের কিছু মহিলা অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত ছিলেন, এমনকি প্রশাসনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন, যেমন মুর্শিদ কুলি খানের কন্যা জিনাতুননেসা, আলীবর্দি খানের স্ত্রী সরফুননেসা।
সুতরাং, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, নবাবদের অধীনে মুর্শিদাবাদ শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি উচ্চ স্থান অর্জন করেছিল। শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল ঐতিহ্যবাহী, কেবল শরিয়তের জ্ঞান দেওয়া হত এবং উচ্চ শ্রেণী সেই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত। নিম্ন শ্রেণী বা সাধারণ মানুষ এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দূরে ছিল।
ব্রিটিশ শাসনের অধীনে মুসলিম শিক্ষা এবং তাদের পিছিয়ে পড়া:–
পলাশীর যুদ্ধের পর মুর্শিদাবাদ তার গৌরব হারাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সচ্ছলতা বিলুপ্ত হয়। শিক্ষা ও সংস্কৃতির অবনতি হয় এবং মানুষের সামাজিক জীবন গভীর খাদে পড়ে যায়। ব্রিটিশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পর কলকাতা তার যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অন্যান্য অনেক কারণে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে গুরুত্ব পেতে শুরু করে। সব গুরুত্বপূর্ণ অফিস মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব নিয়ম প্রয়োগ করতে শুরু করে। ভারতে তাদের শাসন চালানোর জন্য কিছু ভারতীয় কেরানির প্রয়োজন হওয়ায় তারা পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু করতে চেয়েছিল। মুসলিমরা পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করেনি, কারণ তারা ব্রিটিশদের কাফের মনে করত। ফলস্বরূপ, তারা পিছিয়ে পড়েছিল এবং হিন্দুরা যারা পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করেছিল, তারা এগিয়ে গিয়েছিল। এটি একটি সুপরিচিত বিষয় যে, পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ না করা মুসলিম সম্প্রদায়ের ভারতে পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।
ব্রিটিশ শাসনের অধীনে মুর্শিদাবাদে শিক্ষার অগ্রগতি বিশ্লেষণ করতে, প্রথমে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রচারে নিজামত কলেজের ভূমিকা আলোচনা করা উচিত। ১৮২৪ সালের ৩১শে আগস্ট, উইলিয়াম লক, ভারতের গভর্নরের প্রতিনিধি, নবাব পরিবারের যুবকদের জন্য একটি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রচলিত দুর্নীতি ও নৈরাজ্য দূর করতে চেয়েছিলেন। লক ১৮২৪ সালের শেষের দিকে মারা যান এবং ১৮২৫ সালের ২৫শে মে সরকার লকের প্রস্তাব অনুমোদন করে এবং মুবারক মহলে একটি অস্থায়ী স্কুল শুরু হয়।
১৮৩১ সাল পর্যন্ত, নিজামত পরিবারের যুবকদের কেবল ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা দেওয়া হত। ১৮৩১ সালে ক্যাপ্টেন থ্রেসবি ইংরেজি শেখানোর জন্য একটি বিভাগ অনুমোদন করেন। উল্লেখ্য, নিজামত পরিবার ছাড়াও হিন্দু ও মুসলিম ছেলেরাও এই স্কুলে আসত এবং ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসত। যদিও কলেজটি নিজামত পরিবারের ছেলেদের শিক্ষিত করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এর অগ্রগতি খুব খারাপ ছিল। ১৮৩৫ সালে মাইকেল হিল কলেজটি পরিদর্শন করেন এবং কলেজের ফলাফল, বিশেষ করে ইংরেজির ফলাফলে তিনি হতাশ হন। তিনি মনে করেন এর কারণ ছিল হিন্দুদের ‘জাতীয় বিদ্বেষ’। গভর্নরের প্রতিনিধি মুসলিম শিক্ষার্থীদের এই পিছিয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান করেন এবং তিনি দেখতে পান যে, দক্ষ পরিদর্শকের অভাব, বাইরের শিক্ষার্থীদের ভর্তি, হিন্দু শিক্ষার্থীদের প্রতি বেশি মনোযোগ এবং দক্ষ শিক্ষকের অভাবই ছিল প্রধান কারণ। সুতরাং, নিজামত কলেজ তার উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেনি। এই কলেজটি একটি উদার প্রতিষ্ঠান হিসাবে পূর্ব ভারতে শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগ নিতে পারত।
উইলিয়াম অ্যাডাম হিলের শিক্ষার উপর তৃতীয় রিপোর্ট (১৮৩৮) থেকে আমরা মুর্শিদাবাদের মুসলিম শিক্ষার একটি স্পষ্ট চিত্র পাই। এতে বলা হয়েছে যে, মুর্শিদাবাদে ৩৭টি থানা ছিল, যার মধ্যে ১৯টি শহরে ছিল। ১৪টি থানার অধীনে স্থানীয় স্কুলের সংখ্যা ছিল ৬৭। শিক্ষকরা ছিলেন হিন্দু। কেবল একটি বাংলা স্কুলে একজন মুসলিম শিক্ষক ছিলেন। এই স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১০৮২ জন। তাদের মধ্যে ৯৯৮ জন ছিল হিন্দু শিক্ষার্থী এবং ৮২ জন ছিল মুসলিম শিক্ষার্থী।
অ্যাডামের রিপোর্ট অনুযায়ী স্কুলের ধরন ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা:
| স্কুলের ধরন | স্কুলের সংখ্যা | হিন্দু শিক্ষার্থী | মুসলিম শিক্ষার্থী |
|—|—|—|—|
| ফারসি স্কুল | ১৭ | ০ | ০ |
| আরবি স্কুল | ০২ | ৬২ | ৪৭ |
| বাংলা স্কুল | ৬২ | ০ | ০ |
| হিন্দি স্কুল | ৫ | ৯৯৮ | ৮২ |
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আরবি স্কুলগুলোতে মুসলিম শিক্ষার্থীদের চেয়ে হিন্দু শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। হান্টারের তথ্যেও এই চিত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায় না।
হান্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী শিক্ষার্থীর সংখ্যা:
| সাল | হিন্দু শিক্ষার্থী | মুসলিম শিক্ষার্থী |
|—|—|—|
| ১৮৫৬-৫৭ | ৬৬৮ | ২৩ |
| ১৮৭০-৭১ | ৩৮৮১ | ৯৯০ |
| ১৮৮১-৮২ | ৯২৯৭ | ৩৩৩৯ |
| ১৮৯০-৯১ | ১৫০৫২ | ৬৫৬৬ |
উপরের তালিকা প্রমাণ করে যে, মুসলিম শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত উন্নতির হার কমছিল। ১৯০১ সাল থেকে এই জেলায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষাগত অগ্রগতি সন্তোষজনক ছিল না।
১৯০১ সালের জনসংখ্যা ও শিক্ষার পরিসংখ্যান:
| সম্প্রদায় | মোট জনসংখ্যা | মোট শিক্ষিত | মোট পুরুষ | শিক্ষিত পুরুষ | মোট মহিলা | শিক্ষিত মহিলা |
|—|—|—|—|—|—|—|
| হিন্দু | ৬৪৩৪৭৪ | ৫৩৩১৯৯ | ৩১৭৯৭৯ | ৫০০৭২ | ৩২৫৪৯৫ | ৩৩২৭ |
| মুসলিম | ৬৭৬৮৯৯ | ১৯৩২১ | ৩২৮৯২৮ | ১৮৯০৯ | ৩৪৭৯৭১ | ৪২০ |
এই তালিকা থেকে দেখা যায়, মুসলিম মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার অগ্রগতিও খুব খারাপ ছিল।
শিক্ষিত জনসংখ্যা (ধর্ম অনুযায়ী):
| ধর্ম | মোট শিক্ষিত | পুরুষ | মহিলা | মোট ইংরেজি শিক্ষিত | পুরুষ (ইংরেজি) | মহিলা (ইংরেজি) | শিক্ষার শতকরা হার |
|—|—|—|—|—|—|—|- –|
| হিন্দু | ৫৬৩৪৫ | ৫১১৮৭ | ৫১৫৬ | ৮৮৪৪ | ৮৬৯৬ | ১৪৮ | ৯% |
| মুসলিম | ২২৩৯২ | ২১৭১০ | ৬৮২ | ১৪২১ | ১৩৮৯ | ৩২ | ৩% |
বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ এই জেলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রচারে বড় অবদান রেখেছিল। এই কলেজের অনেক শিক্ষার্থী দেশে ও বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। এই কলেজ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের শতকরা হার থেকে আমরা মুসলিম শিক্ষার অগ্রগতির একটি চিত্র পেতে পারি। ১৮৬৭-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই কলেজ থেকে অনার্সে (কলা) মাত্র ১৫৯ জন মুসলিম শিক্ষার্থী পাস করেছিল এবং ১৯১০-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানে মাত্র ২৯ জন শিক্ষার্থী পাস করেছিল।
ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে পুরো মুসলিম সমাজ একটি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। ব্রিটিশ নীতির কারণে তাদের জীবন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল। ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকার ইংরেজিকে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ঘোষণা করে, যা আনুষ্ঠানিকভাবে এ দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার শুরু ছিল। ১৮৩৭ সালে ফারসিকে দাপ্তরিক ভাষা থেকে বাতিল করা হয় এবং ঘোষণা করা হয় যে, ইংরেজি ও মাতৃভাষা হবে দাপ্তরিক ভাষা। মুসলিমরা ব্রিটিশ শিক্ষানীতির প্রতি বিদ্বেষ দেখিয়েছিল এবং ধীরে ধীরে তারা পিছিয়ে পড়েছিল, কেবল শিক্ষায় নয়, সামাজিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবেও। মুসলিমরা তাদের পিছিয়ে পড়ার জন্য সরাসরি ব্রিটিশদের দায়ী করেছিল। হান্টার তাঁর ‘ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ বইয়ে বলেছেন যে, “তারা অভিযোগ করে যে, যারা গতকাল দেশের বিজয়ী ও শাসক ছিল, তারা আজ এখানে জীবিকা খুঁজে পায় না। কারণ তাদের অধঃপতন আমাদের রাজনৈতিক অজ্ঞতা ও অবহেলার ফল মাত্র। দেশ এক শাসনের অধীনে আসার আগে মুসলিমরা একই বিশ্বাস পোষণ করত, একই খাবার খেত এবং সব দিক দিয়ে এখনকার মতোই জীবনযাপন করত। আজও তারা তাদের পুরনো তীব্র জাতীয়তাবাদের অনুভূতি এবং যুদ্ধ-সক্ষমতা প্রদর্শন করে; কিন্তু অন্য সব দিক থেকে তারা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি।”
হান্টারের মতে, মুসলিমদের পতনের কারণগুলো ছিল:
১. মুসলিমদের সব সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল এবং ব্রিটিশ শাসন এর জন্য দায়ী ছিল।
২. তাদের শাসক শ্রেণী হওয়ার অনুভূতি ছিল এবং ব্রিটিশদের আনা নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে তারা মানিয়ে নিতে পারেনি।
৩. ইংরেজি দাপ্তরিক ভাষা হওয়ার পর তারা তাদের সুযোগ হারায়।
৪. তারা ইংরেজি ভাষার প্রতি বিদ্বেষ দেখিয়েছিল।
উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, নবাবী আমলে এবং প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগে মুর্শিদাবাদে শিক্ষা প্রসারে দেশীয় সম্ভ্রান্ত পরিবার এবং শিক্ষিত ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এমন নয় যে সরকারি উদ্যোগ একেবারেই ছিল না। নবাবরা সরকারিভাবে কিছু শিক্ষা নীতির প্রসারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তবে তা কেবল নবাব ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, সাধারণ মানুষের জন্য নয়। ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশ সরকার শিক্ষা প্রসারে কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম ছিল।
এই জেলার মুসলিমরা অন্যান্য সম্প্রদায়ের চেয়ে পিছিয়ে আছে এবং শিক্ষা এর অন্যতম প্রধান কারণ। নবাবী আমলে তারা কেবল ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল, কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা শত বছরেরও বেশি সময় ধরে বিচ্ছিন্ন ও অস্পৃশ্য ছিল। ফলস্বরূপ, তারা শিক্ষা, সরকারি চাকরিতে পিছিয়ে পড়েছিল এবং আমাদের স্বাধীনতা পর্যন্ত এই পরিস্থিতি বদলায়নি। এটি স্পষ্ট যে, ব্রিটিশ সরকারের নীতি এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি মুসলিমদের বিদ্বেষ উভয়ই এই পিছিয়ে পড়ার কারণ ছিল। মুর্শিদাবাদের শিক্ষা ব্যবস্থার এই ঐতিহাসিক অনুসন্ধান আমাদের এই জেলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে বুঝতে সাহায্য করে এবং ভবিষ্যতের শিক্ষানীতি নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে।
গ্রন্থপঞ্জী :-
১)বিজয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাচীন মুর্শিদাবাদ কর্ণসুবর্ণ ও মহিপাল, রেডিক্যাল, কলকাতা, পৃষ্ঠা-৯।
২)সুশীল চৌধুরী, নবাবী আমলের মুর্শিদাবাদ, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা,পৃ:-৪।
৩) West Bengal Gazetteers, Department of higher secondary education. Government of West Bengal, Govt. Of West Bengal.
৪) LSS. O’Malley, Bengal District Gazetteers Murshidabad Higher Education Department, Govt, of West Bengal.
৫)এম.এ রহিম, বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, বাংলা একাদেমি,ঢাকা।
৬)Abdul Karim Murshid Quli Khan And His Times,pp 238.
৭) দেবশ্রী দাস,মুর্শিদাবাদ জেলায় সাংস্কৃতিক মুক্তধারা, ঐতিহাসিক সমীক্ষা, প্রভা প্রকাশনী,২৪ পরগণা,২০০২.পৃঃ-১১২-১১৫।
৮)সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, প্রাক পলাশী বাংলা, কে.পি বাগচী এন্ড কোং, কলকাতা,১৯৮২,পৃ:-১০৬-৭।
৯)Nizamat College,Murshidabad, Under G.C.PL. Correspondence, Section 2.pp 429,537.General Department, Vol 95, Section 1.pp 265.
১০)সৌমেন্দ্র কুমার গুপ্ত, পরিবর্তনের সন্ধানে মুর্শিদাবাদের বাঙালী মুসলমান,উদার আাকাশ,২৪ পরগণা, ২০১৩,পৃ-৯৪-৯৫।
১১)District Gazzetteer Berhampore, 2003,11 Chapter,pp 409 [19].
১২)K,N.College 150 years Commemoration Volume 1853-2003, Berhampore, 2003.pp203-339.
১৩)মঈনুদ্দিন আহমেদ খান, মুসলিম ধর্ম সংস্কার আন্দোলন, সিরাজুল ইসলাম,বাংলাদেশের ইতিহাস, ১৭০৪-১৯৭১,vol 3,ঢাকা১৯৩৩।
১৪)মহ:আব্দুল -আল-মাসুম, বাংলার মুসলিম সমাজে আধুনিক শিক্ষার অগ্রগতি, ১৮৮৫-১৯২১,ঢাকা,২০০৭।
১৫)ওয়াকিল আহমেদ,উনিশ শতকে বাঙালী মুসলমানের চিন্তা ও চেতনার ধারা, ঢাকা,১৯৯৭।
১৬)W.W.Hunter. The Indian Mussalmaqus, Dhaka, 1999.pp 135 [27]. W.W Hunter, The Indian Mussalmaqns, Dhaka, 1999 Chapter 4.
১৭) Rakibul Islam, Education System of Murshidabad District in the Colonial Era: A Historical Investigation.
Research Guru,Online Journal of Multidisciplinary Subjects (ISSN: 23-49-266X),Impact Factor:4.081, Volume-12, Issue-4, March-201Review,
১৮)Emili Rumi, Muslim Education in Murshidabad, a Bengal District during 1704-1947: A Review,
IRA-International Journal of Management &Social Sciences
ISSN 2455-2267; Vol.11, Issue 03 (June 2018)
১৯) Assistant Professor, Sripat Singh College, Jiaganj, Murshidabad, West Bengal, India.
(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)