Dr. Syama Prasad Mookerjee Research Foundation

ইতিহাসের পুনর্দর্শনে শ্যামাপ্রসাদ – কিছু ভ্রান্তি, কিছু সত্য

১৯৪০ সালে, হিন্দু মহাসভার সভাপতি হলে পর স্বয়ং গান্ধীজি তাঁর গলায় স্তুতির মালা পড়িয়ে বলেছিলেন – এদেশে হিন্দুদের নেতা হিসেবে আপনিই হলেন মালব্যজীর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী – আপনার জয় হোক। পরবর্তীকালে , ১৯৪৭ সালে জাতির জনক , তাঁকে স্বাধীন ভারতের প্রথম জাতীয় সরকারে অন্তর্ভুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। প্যাটেলের সঙ্গে তুলনামূলক বিচার করে বলেছিলেন – Patel is a Congressman with a Hindu mind, you are a Hindu Sevaite with a Congress mind | আবার ১৯৪২ সালে কবি নজরুল মধুপুর থেকে তাঁকে চিঠিতে লেখেন – এই কোয়ালিশন মিনিস্ট্রির একমাত্র আপনাকে আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি , ভালোবাসি – আর কাউকে নয়। আমরাই ভারতবর্ষকে পূর্ণ স্বাধীন করবো – সেদিন বাঙালির আপনাকে ও সুভাষ বোসকে সকলের আগে মনে পড়বে – আপনারাই হবেন এদেশের সত্যিকারের নায়ক।’ ।

তিনি , হুগলির জেলার , জিরাট গ্রামের গঙ্গাপ্রসাদ মুখার্জীর পৌত্র , কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ব কনিষ্ঠ উপাচার্য , শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি : যিনি ১৯৩৪ সালে , বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে , আমন্ত্রিত কবি রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে প্রথা ভেঙে বাংলা ভাষায় ভাষণদান করান ; উদ্দেশ্য – বঙ্গজাতির আত্মসম্মান পুনরুদ্ধার ; যিনি দেশ ভাগের পরে সদর্পে পন্ডিত নেহেরুকে বলেছিলেন – কংগ্রেস দেশ ভাগ করেছে , আমি পাকিস্তানকে ভাগ করেছি ; যিনি ১৯৫২ সালের লোকসভা নির্বাচনে দক্ষিণ-পূর্ব কলকাতা থেকে নির্বাচিত সাংসদ হয়ে , বাস্তবিক একজন ‘ওয়ান ম্যান পার্টি ‘ স্বরূপ , পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন – কংগ্রেসের একনায়কতন্ত্র ভাঙতে , দেশে চাই সংঘটিত বিরোধী শক্তি যাকে দেখে আম জনতা গণতন্ত্রের একান্তরী পথের নির্দেশ পেতে পারেন ; যিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকৃত বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তরের কালে ‘বেঙ্গল রিলিফ ফান্ড ‘ গঠন করে সাহায্যের আবেদন করে পেয়েছিলেন দেশব্যাপী উপচে পড়া সাড়া ; সংগৃহিত অর্থ ছিল আট লাখের উপর , সংগৃহিত চাল ডালের পরিমান -পঁয়তিরিশ মণ ছাপিয়ে;ত্রাণ বন্টন হয়েছিল রাজ্য জুড়ে প্রায় ৩০০ অস্থায়ী কেন্দ্র থেকে। বঙ্গ ইতিহাসের নিরিখে, সেই চরম ক্ষুধার্ত , নিপীড়িত সময়ে, খোয়াজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার, ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যে শুধু এই দুর্ভিক্ষের খবর, উদ্দেশ্য প্রনোদিত ভাবে, বিশ্বের কাছে গোপন করেছিল, তাই নয় , নাগরিক সরবরাহ মন্ত্রী সুরাবর্দির তত্ত্বাবধানে, নিরীহ , সরল সাধারণ্যের ভাঁড়ারে ঢুকে, হুমকি দিয়ে, বর্ষাকালের জন্য সঞ্চিত ধান কেড়ে নিয়ে , মিথ্যে প্রচার করলে : সবটাই রটনা; বঙ্গের ভাঁড়ারে এখনো অনেক শস্য; উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। ইতিহাসের পরিহাস , ঠিক সেই সময় কম্যুনিস্ট পার্টির তরফ থেকে ইংরেজদের পোঁ ধরে যুদ্ধরত মিত্রবাহিনীকে খাদ্যশস্য পাঠানোর জন্য প্রচার করা হচ্ছিলো কেননা সোভিয়েত আক্রান্ত , তাকে অক্ষ শক্তির হাত থেকে বাঁচাতেই হবে ;তাছাড়া নেতৃত্বের কাছে যেনতেনপ্রকারেন পার্টির সরকারি বৈধ্যকরণও ছিল বাধ্যতামূলক।

প্রসঙ্গক্রমে , ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল রেজিস্টার ১৯৪৬ , ভলিউম ১’এ প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী – চিত্তরঞ্জন , রবীন্দ্র , সুভাষহীন বাংলায় , নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে একমাত্র বাংলার বাঘের মেজো বাচ্চাই ছিলেন যাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠ ভারতবর্ষের সর্বত্র প্রতিধ্বনিত হয়ে বলেছিলো – বাংলাকে এই সমূহ ধ্বংসের হাত থেকে , এই পরিকল্পিত গণহত্যার নাগপাশ থেকে আপনারা সম্মিলিত ভাবে বাঁচান। এর সঙ্গে স্মর্তব্য , ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদারের উক্তি : সেই ঘোর জাতীয় দুর্দশার দিনে , রামমোহন , বিদ্যাসাগর , বিবেকানন্দের প্রবাদগত প্রগতিশীল বাংলার রেনেসাঁর ভুলুন্ঠিত ধ্বজা কেউ যদি চেটো ঠুকে তুলে নেবার চেষ্টা করে থাকেন সুভাষ বোসের পর , তিনি – শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি।

প্রত্যক্ষ বঙ্গ রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ ১৯৩৯ সালে। একদিকে তখন সুভাষ বোস সভাপতি থাকা সত্বেও গান্ধীজী ও তাঁর সমর্থকদের যৌথ চাপে, অতীব কোণঠাসা। অন্য দিকে পার্টিতে মহাত্মার স্নেহধন্য গোবিন্দবল্লভের, পন্থ-প্রস্তাব পাশ । তার মূল সুর : কংগ্রেস সভাপতি যেই হোন না কেন তাঁকে ওয়ার্কিং কমিটি করতে হবে শ্রী গান্ধীর মতে। আর এ হেন তৈলাক্ত পিষ্টকের ওপর গ্লেজ দিতে গান্ধী বচন : Working committee should be homogeneous whole |একদিকে গান্ধীজীকে লেখা সুভাষের চিঠি : ‘আপনি বরাবর কংগ্রেস – ফজলুল হকের ,কৃষক প্রজা পার্টির, যুক্ত মন্ত্রীসভা সমর্থন করিয়াছেন। ওয়ার্ধার সাক্ষাতের পর কি কারণে আপনার মতের এই রূপ গুরুতর পরিবর্তন হইয়াছে তাহা জানি না। বেশ বোঝা যাইতেছে আজাদ , নলিনী , বিড়লার সহিত কথাবার্তার ফলেই আপনার মতের এই পরিবর্তন ঘটিয়াছে। তাহা হইলে ব্যাপারটা দাঁড়াইতেছে এই যে যাহাদের ওপর বাংলাদেশের কংগ্রেস চালাইবার দায়িত্ব অর্পিত হইয়াছে তাহাদের চেয়ে উল্লিখিত তিন জনের মতই আপনার কাছে বেশি মূল্যবান। আমি মনে করি যে বাংলাদেশের বর্তমান সাম্প্রদায়িক মন্ত্রিসভাকে যত শীঘ্র সম্ভব দূর করা উচিত। এই প্রতিক্রিয়াশীল মন্ত্রিসভা যতদিন থাকিবে, ততদিন বাংলায় সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি বাড়িতে থাকিবে এবং মুসলিম লীগের তুলনায় কংগ্রেসের প্রভাব প্রতিপত্তি কমিতে থাকিবে।’ অন্যদিকে , কৌশলী মুসলিম লীগের , ফজলুল হকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘ খওয়াজা – প্রজা কোয়ালিশন’ গঠন ; ক্ষমতার অলিন্দে প্রতিক্রিয়াশীল জিন্নাহ পন্থীদের শাখা বিস্তার ; একদল প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ,বাংলার বুকে হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক অনৈক্য স্ব- স্বার্থে জিইয়ে রাখার সফল প্রয়াস ; গুটি পায়ে সাভারকারের ১৯৩৯ সালে বাংলায় প্রবেশ ; ওই সালে উপাচার্য স্যার আজিজুল হকের এবং লীগের দাবিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমব্লেম থেকে ‘শ্রী’ শব্দের অপসারণ ; কলকাতার বুকে ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভা সম্মেলন। এবং ১৯৩৯ – ১৯৪১ সাল , এই দু বছরে , বাংলার বুকে ৫৪টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এক কথায় , অফলপ্রসূ কংগ্রেসিদের আর অস্থিরমতি দিশাহীন কম্যুনিস্টদের রাজনীতির পাকচক্রে ছেড়ে যাওয়া ফাঁকা মাঠে , এক বৃন্তে দুই ফুলের, ক্ষমতা লিপ্সায় আধিপত্য বিস্তারের গৃহযুদ্ধে, নেমে পড়া । বলতে দ্বিধা নেই , যে বিভাজনের মাটি স্ব-স্বার্থে ইংরেজরা তৈরী করেছিল , কংগ্রেস, কম্ম্যুনিস্টরা আত্মমর্যাদাহীন ,স্বেচ্ছাচারী , স্বার্থসিদ্ধির লাঙ্গল চালিয়ে তাকে উর্বর থেকে উর্বরতর করেছিল। আর শেষে ক্ষতবিক্ষত শরীরে ঘরে তুলেছিল দেশ ভাগের ছিন্নমূল ফসল।
অপক্ষবাদী সুভাষ , শ্যামাপ্রসাদরা , ভারতের মুক্তিসংগ্রামের স্বার্থে , গান্ধী পরিচালিত কংগ্রেসের- মুসলমানদের অতিরিক্ত , অবান্তর ,তুষ্টি বিধানের নীতির পরিপন্থী ছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন মুসলিম লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী এবং বাংলাদেশের রাজ্য শাসনে তাদের আধিপত্য বা প্রভাব ঘোর অনিষ্টকর। আর তাই কংগ্রেস তথা গান্ধীর থেকে আত্মমর্যাদা সামলাতে , ১৯৩৯’এ সুভাষ গড়লেন ফরওয়ার্ড ব্লক। মিটিং বসলো জে সি গুপ্তর বাড়িতে , তৈরী হলো প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টি , শের -ই-বেঙ্গল ফজলুল হক হলেন সভাপতি , সুভাষ অগ্রজ শরৎ বোস হলেন সহ সভাপতি , কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে ফরোয়ার্ড ব্লক যুক্ত হলো ২৮ জন সদস্য নিয়ে। ভেঙে গেলো ‘ খওয়াজা – প্রজা কোয়ালিশন’ তৈরী হলো নতুন মন্ত্রীবর্গ। সেদিন শ্যামাপ্রসাদ ডাইরির পাতায় লিখেছিলেন – ফজলুল হকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেকদিনের। সেই যখন থেকে উনি পিতৃদেবের কাছে আর্টিকলশিপ করতেন। আমাদের মধ্যে মতের পার্থক্য নিশ্চিত প্রচুর। তবু আমরা আজ হাত মিলিয়েছি কারণ রামসে মেকডোনাল্ডের ‘ কম্যুনাল অ্যাওয়ার্ড ‘ বাংলাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই রাজ্যকে রক্ষা করতে আমাদের আশু কর্তব্য , হিন্দু এবং সেই সব মুসলমানরা – যাঁরা লীগের সংকীর্ণ রাজনীতির জালে আবদ্ধ নয় , তাঁদের এক জোট করে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে রাজ্যের উন্নয়নমূলক কাজ করা। অন্যদিকে ফজলুল হক বললেন – এই নতুন পার্টির উদ্দেশ্য : ধর্মীয় তুচ্ছতাকে দূরে রেখে , বিভিন্ন সুশীল শক্তিকে একত্রিত করে জাতীয় স্তরে একে টেকসই উদাহরণ স্বরূপ উপস্থাপন করা; সাম্প্রদায়িক কলহের উর্দ্ধে উঠে এই কোয়ালিশনের মাধ্যমে গড়ে তোলা সাধারণ্যের ভালোর জন্য গঠনমূলক কার্যক্রম।

কিছুটা হলেও মনে আসে ১৯২৩ সালের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ এর ইতিহাস। সেই যখন অসহযোগ আন্দোলনের হঠকারী সমাপ্তিতে , হিন্দু মুসলিম প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক মতপার্থক্য নিরসনের উদ্দেশ্যে, দেশবন্ধু বলেছিলেন – ‘গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া এক্ট’এর দ্বৈত – শাসনতন্ত্রের পন্থা দেশের পক্ষে বিপজ্জনক। বঙ্গ সমাজকে বিভাজন করবার এই ব্রিটিশ নীতির যোগ্য জবাব আমরা দিতে পারি যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক উপায়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগ করে নিয়ে শাসনক্রম চালাতে সক্ষম হই। এক্ষণে স্বরাজ আনতে অতিশয় প্রয়োজন দেশে হিন্দু – মুসলমান’এর ঐক্যবদ্ধ সামাজিক তথা রাজনৈতিক সমঝোতা।’ দেশবন্ধুর সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন শিষ্য সুভাষ , বীরেন্দ্র শাসমল , মতিলাল নেহেরু , জ্যোতিন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত। বাদ সেধে গর্জে উঠেছিলেন গান্ধীজি , বিপিন পাল , সুরেন ব্যানার্জি। ১৯২২’এর , ডিসেম্বরে , গয়ায় বার্ষিক জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’কে খারিজ করে দেওয়া হয়। ১৯২৩’এর জানুয়ারিতে , দেশবন্ধু , কেলকার , মতিলাল নেহেরু গঠন করেন কংগ্রেস খিলাফত স্বরাজ্য পার্টি । হতোদ্যম মুসলমানরা – ফজলুল হক , সুরহাবর্দি , খান বাহাদুর আজিজুল হকেরা , তাঁদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করে সরে এসে গঠন করেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টি , ১৯২৬’এ ; অতঃপর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পুনরুজ্জীবিত হয়ে বঙ্গ আকাশে নতুন করে ফণা তোলে।

বহু বছর পর , ২০১৮’তে , রাজধানীতে কোনো এক বক্তৃতায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের সুরে সুর মিলিয়ে প্রণববাবুকে বলতে শুনেছিলাম – ১৯২২ সালে দেশবন্ধুর বেঙ্গল প্যাক্টের বাস্তবায়ন হলে পরবর্তীকালে দেশ ভাগের অবকাশ হয়তো থাকতো না।
প্রসঙ্গ ক্রমে , কিছু প্রশ্ন জাগে : বাংলার রেনেসাঁ – নবজাগরণ , কি সত্যিই সাধারণ ঘর পোড়া গরুর মন থেকে ধর্ম , বর্ণ , জাতি সংক্রান্ত নানা সন্দেহ দূর করতে পেরেছিলো ? জনমানসে অতীতমুখী ভাবনার মোড় কি এক চিলতেও ঘুরেছিল ? নাকি সে সীমাবদ্ধ রয়ে গেলো কিছু মিল , বেনথাম পড়া প্রগতিশীল বর্ণ হিন্দুদের, রাডিয়ার্ড কিপলিঙের আবেগী ‘হারি চান্দার মুকারজি’দের , সম্বন্ধযুক্ত সামাজিক ক্রিয়াকর্মে ? রেনেসাঁসের ইতিহাসে, কাউন্টার – রেনেসাঁস অজানা নয়। এর অনিবার্য প্রসার ঘটে যখন ইডিওলজি থিওলজির স্থান নেয় ও ফিলোসফির সঙ্গে এক হয়ে গিয়ে একাকারত্বের দাবি করে। শেষ বয়সে প্রায় নিরীশ্বরবাদী হয়ে যাওয়া গান্ধীজির হত্যা , এই ব-কলমে লালিত পালিত বর্ণাশ্রমবাদী কাউন্টার – রেনেসাঁর কাল ছোবল নয় কি ? জাতীয়তাবাদের বাঘের ঘরে ধর্মবাদের ঘোঘের বাসা যে কি ভয়ঙ্কর , জাতির জনক মৃত্যুকালে বুঝেছিলেন কি ?

১৯৪১’এ , নবগঠিত কোয়ালিশনের শ্বাসরোধ করতে শুরু থেকেই উদ্যত হয়েছিলেন , তদানীন্তন গভর্নর স্যার জন হার্বার্ট , স্থায়ী ইংরেজ আমলা সম্প্রদায়। শ্যামাপ্রসাদ প্রতিবাদ করে চিঠি লিখলেন – আপনারা অহরহ জিগির তোলেন , হিন্দু ও মুসলমান নেতারা একযোগে শাসনকার্য পরিচালনায় ব্যর্থ হওয়ায় ভারতের রাজনীতির অগ্রগতি হচ্ছে না।আজ যখন , গণতান্ত্রিক সংবিধানে শত ত্রুটি বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও , কোয়ালিশন সেই কাজে সচেষ্ট হয়েছে , তখন আপনি ও আপনার স্থায়ী ইংরেজ আমলারা এই প্রদেশে শাসনতন্ত্রের মধ্যে আরো একটা শাসনতন্ত্র কায়েম করেছেন; ফজলুল হক ও তাঁর সহকর্মীদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার পরিবর্তে , সময়ে অসময়ে মুসলিম লীগের পক্ষে বিশেষ ওকালতি করছেন।

চিঠির উত্তরে গভর্নর লিখলেন : বর্তমান সংবিধান অনুসারে তাঁর প্রস্তাবগুলি যুক্তিগ্রাহ্য নয়। অনমনীয় শ্যামাপ্রসাদ ভাইসরয় লিনলিথগোকে লিখলেন : ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’ আজ আমাদের ‘জাতীয় দাবী ‘। স্বাধীনতার এই দাবীর অনুকূলে জনমত গঠনের কাজে আত্মোৎসর্গ করার জন্য আমি গভর্নরের কাছে আমাকে মন্ত্রিত্ব পদ থেকে অব্যাহতি দেবার জন্য অনুরোধ করছি।‘ গভর্নরের কায়েমী স্বার্থের ক্রীতদাস হয়ে থাকতে অপারগ, শ্যামাপ্রসাদ মন্ত্রিত্ব ছাড়লেন , ১৯৪২ ‘এ।

প্রতিবাদী পদত্যাগ। প্রতিবাদ আমলাতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে। সেই আমলাতন্ত্রীরা যারা ১৯৪২’এর আন্দোলন দমনের জন্য বিদ্রোহী মেদিনীপুর ও অন্যান্য আগ – জ্বলন্ত স্থানে সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল , গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়েছিলো , ঘরের মেয়ে বৌদের নির্লজ্জ হিংসায় ধর্ষণ করেছিল ; সেই আমলাতন্ত্রীরা যারা সরকারকে লিখেছিলেন : সাইক্লোনে মেদিনীপুর বিধস্ত। প্রায় দশ হাজার লোক মৃত। গবাদি পশুর প্রায় তিন চতুর্থাংশ নিহত। প্রায় এক লক্ষ বাড়ি ধ্বংস। কিন্তু এখানকার মানুষেরা সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছে তার শাস্তি স্বরূপ সরকার কোনো রকম ত্রাণ কার্য চালাবে না , কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও ত্রাণ কার্য চালাতে অনুমতি দেবে না।

শ্যামাপ্রসাদ এই সরকারি অমানবিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে গঠন করলেন – বেঙ্গল সাইক্লোন রিলিফ কমিটি। কোষাধ্যক্ষ হলেন বিধানচন্দ্র রায়। মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রন জানিয়ে চিঠি লিখলেন – আপনি দেখে যান কেমন করে আনুমানিক দেড়শো জনের সরকারি সশস্ত্র বাহিনী মহিষাদল থানার অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলিতে খুন , লুঠ , ধর্ষণ চালিয়েছে। কোনো একজন মন্ত্রীকে নির্দেশ দিন এদের পাশে দাঁড়াতে , এই জঘন্যতম পাশবিকতার তদন্ত করতে। এই উপদ্রুত গ্রামবাসীরা অসহায় , ভীত।

কিন্তু হায় ! ততদিনে গভর্নরের রচিত চক্রব্যূহে কোয়ালিশন সরকারের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। প্রত্যাশিত ভাবে ইংরেজ , মুসলিম লীগ এবং ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর চক্রান্তে ১৯৪৩’এর ,মার্চ মাসে ফজলুল মন্ত্রিসভার পতন ঘটলো। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের রাজনৈতিক তথা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে নাজিমুদ্দিনের হাত ধরে ফিরে এলো মুসলিম লীগ আর পায়ে পায়ে চার্চিল , লিও আমেরি স্পন্সরড , মন্বন্তর – গণহত্যা।

আর এই সব কপটতার অন্তরালে রচিত হলো আরও এক কালনির্ণয়ক প্রতারণার কথকথা। আসরে নামলেন মহাত্মাজীর বিবেক রক্ষক , রাজাগোপালাচারী হাতে নিয়ে সি আর প্ল্যান ; মূল বিষয়বস্তু : দেশ ভাগ অনিবার্য। লীগ যদি বিভাজন চায় কংগ্রেস তার বিরোধিতা করবে না। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কোনো এক নির্দিষ্ট কমিশন মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ রাজ্যগুলির সীমা নির্ধারণ করে দেবে। গণভোটে স্থির হবে ঐসব রাজ্য ভারতবর্ষীয় থাকবে কি না।

যদিও পার্টি এই প্ল্যান প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দিয়ে খারিজ করেছিল তবু জেল ফেরত মহাত্মাজী একেই সঙ্গী করে বসলেন জিন্নাহ সঙ্গে মিটিং’এ , ১৯৪৪ সালে।
প্রতিবাদী শ্যামাপ্রসাদ চিঠিতে , মহাত্মাকে তাঁর অবস্থান ব্যক্ত করলেন : আপনি জানিয়েছেন যে , আপনি যখন আপনার শর্ত নিয়ে আলোচনা করবেন , তখন একজন ভারতীয় হিসেবে করবেন , হিন্দু হিসেবে নয়। নিশ্চই। কিন্তু একজন ভারতীয় হিসেবে আপনি যখন শুধু মুসলমানদের দাবি নিয়েই চিন্তা করেন এবং এই ব্যাপারে জিন্নাকেও তোষণ করতে প্রস্তুত , তখন আমিও একজন ভারতীয় হিসেবে হিন্দুদের ন্যায্য অধিকার তুলে ধরতে পারবো না কেন ? যদি একজন ভারতীয় হিসেবে আপনি আপনার পরিচয় দিতে চান, তবে আমার অনুরোধ একজন ভারতীয় হিসেবে কেবলমাত্র ভারতীয়দের কথাই চিন্তা করুন। মাত্র কয়েকদিন আগেই আপনি হরিজন পত্রিকাতে লিখেছেন , দেশভাগের যে কোনো চিন্তা ভাবনা আমাদের মধ্যে নতুন ধরণের বিবাদ এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করবে। তাহলে আজ এই মনের ভ্রম কেন , কোন অন্তরাত্মার চাপে ? দেশপ্রেম কোনো খোলা বাজারে নিলাম ডেকে খরিদ করা যায় না। জাতীয় ঐক্য ও আত্মমর্যাদাকে মুসলিম লীগের সমর্থনে বিকিয়ে দেওয়াকে ঘৃণা করি ‘।

চিঠিটি তাৎপর্যপূর্ণ কেননা প্রযুক্ত শব্দবন্ধ , আবেগ , যুক্তি বুঝিয়ে দেয় ঠিক কোন পরিকল্পিত চরিত্রহনন কল্পে শ্যামাপ্রসাদের গায় কম্যুনাল তকমা উঠেছিল ; ঠিক কোন দ্বিচারিতার মাছ ঢাকতে ইতিহাসের পাতায় তার নামের ওপর মৌলবাদী শাক চাপানো হয়েছিল। ঠিক কোন কারণে , গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’এর দাঙ্গাকালে , লীগের গুন্ডাদের হাত থেকে পাড়া বাঁচাতে হিন্দু যুবকটি শরৎ বোসের কাছে ধমকি খেয়ে , প্রফুল্ল ঘোষের কাছে অহিংসার বাণী শুনে , শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো ৭৭ নম্বর আশুতোষ মুখার্জী এভেন্যুয়ের বাড়িতে ; শুনেছিলো চাণক্যবাণী : শুধু প্রতিবাদ , প্রতিরোধ নয় , কৌশলগতভাবে তোমাদের প্রতিশোধ নেবার মনোভাবও থাকা উচিত ।

বাস্তববাদী শ্যামাপ্রসাদ বুঝেছিলেন রাজনৈতিক ধানাই পানাই সার , দেশ ভাগ হচ্ছেই। ১৯৪৬’এর , জানুয়ারী মাসে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির তরফ থেকে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে যে মন্তব্য করা হয়েছিল সেখানে কংগ্রেস শাসিত অসম সীমান্ত প্রদেশ এবং শিখদের প্রসঙ্গ থাকলেও মুসলিম লীগ শাসিত বাংলার ৪৫% হিন্দু অধিবাসীদের কথা বলা হয়নি। বরং গান্ধী অসমকে কংগ্রেসের মতের বিরুদ্ধে মিশনের বৈঠকে যোগদান না করে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিলেও বাংলা সম্পর্কে নীরব রইলেন। যেমনটি রইলেন সেদিন উপস্থিত বাংলার প্রতিনিধিরা।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের প্রেক্ষাপটে বাংলা তথা বাঙালি চিরকালই ব্যতিক্রমী – আত্মত্যাগের , আত্মসমর্পণ না করার নীতির , লড়াই করার প্রবণতার, নিরিখে। এই বাংলা থেকেই প্রশ্ন উঠেছিল গান্ধীর মহত্ব নিয়ে। এই বাংলাই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল নেহেরুর নৈতিকতা নিয়ে। সেই বাংলার বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা আবার গর্জে উঠলো কংগ্রেসের , লীগের যৌথ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। ১৫’ই মার্চ , ১৯৪৭ তাঁরা – সুনীতি চ্যাটার্জি , রমেশ মজুমদার , মেঘনাদ সাহা , যদুনাথ সরকারেরা শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন – পূর্ব অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত পাকিস্তানে হিন্দুরা সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে না। তাদের জন্য আলাদা হোম ল্যান্ড তৈরী না হলে অত্যাচারিত হয়ে তারা অন্য কোথাও আশ্রয়ের অধিকার দাবি করতে পারবে না। তাই বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের স্বপক্ষে জনমত তৈরী করার জন্য ব্যাপক প্রচার চালানো হোক।

প্রচারে অপরিমেয় সাড়া মিলেছিল। তেইশে মার্চ , অমৃত বাজার পত্রিকার , গ্যালাপ পোলে দেখা গেলো , ৯৮ % বাঙালি হিন্দুই বঙ্গভঙ্গের পক্ষে। ‘শনিবারের চিঠি’ লেখে , ‘ পৃথক হইয়া যাওয়াই ভালো’ ; ‘প্রবাসী’ : দুই সম্প্রদায়ের মিলনের আশা সুদূরপরাহত। বঙ্গবিভাগের প্রস্তাব স্থিরভাবে বিচার করার প্রয়োজন হইয়াছে ‘। সুর মেলালেন দুই কংগ্রেস নেতা – বিধান চন্দ্র এবং কিরণশঙ্কর রায় ; জানালেন – ওয়ার্কিং কমিটিতে এই দাবি মেনে নেওয়ার জন্য আবেদন করবেন।

বাঙালি জাতের একটা বদগুণ আছে। সে ভাবের ঘরে অযাচিত সুড়সুড়ি খেয়ে অনুভূতি আশ্রিত হয়ে পরে। খলিফা বুদ্ধিসম্পন্ন ,নোয়াখালীর হত্যালীলার নায়ক ,’ শহীদ সাহেব’ সুরাবর্দি এটা জানতেন। তিনি সুযোগ বুঝে শরৎ বোস ও কম্যুনিস্টদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন : বিভক্ত বাংলা ভারতের অন্যান্য আগ্রাসী প্রদেশের হাতে সহজ শিকার হয়ে উঠবে;চিরদিন শোষিতই রয়ে যাবে। কম্যুনিস্টরা ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় লিখলেন – বঙ্গভঙ্গ রোধ করুন। ঐক্যবদ্ধ ভারতে স্বাধীন বাংলা গড়ুন। আর বাংলাকে স্ব-শাসিত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বানানোর স্বপ্নে শরৎ বোস , বল্লভভাই প্যাটেলকে লিখলেন : ভবিষ্যত প্রজন্ম এই দেশ ভাগ , এই বাংলা তথা পাঞ্জাবের পার্টিশনের জন্য আমাদের ক্ষমা করবে না। আম বাঙালি হিন্দু ,বঙ্গ ভাগ চায় না। এ শুধু কিছু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দাবি। অবিভক্ত বাংলাকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা হোক।

বাংলাকে আরো একটা কাশ্মীর করলে পরবর্তীকালে কি হোত জানা নেই। তবে নির্মল বোস’এর ‘মাই ডেইজ উইথ গান্ধী ‘তে তার কিছুটা আভাস পাওয়া যেতে পারে। যা লিখেছেন তার মর্মার্থ : সুরাবর্দির উদ্দেশ্য ছিল অন্য। তিনি চাইছিলেন প্রথমে স্বাধীন বাংলাদেশ হোক , পরে কোনো এক ছুতোয় তাকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে।
শরৎ বোসের আবেদন ধোপে টেকেনি। প্যাটেলের অন্তরঙ্গ ,ভি পি মেনন, ছকে ফেললেন পার্টিশনের চূড়ান্ত নকশা। তড়িৎ গতিতে তার ওপর পড়লো সরকারি সিলমোহর। তেসরা জুন ঘোষিত হল ভারত বিভাজন বার্তা।

কোজাগরী পূর্ণিমার দিন , দু হাজার বর্গ মাইল জুড়ে গণহত্যা,দাঙ্গায় কেঁপে উঠলো নোয়াখালী। সংখ্যাগরিষ্ঠের রোষের কোপ পড়লো সংখ্যালঘুর উপর। বার এসোসিয়েশন , হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরী’র কাটা মুন্ড প্লেটে করে এলো গোলাম সারওয়ারের সামনে , তার দুই মেয়েকে বন্দি করে উপহার দেওয়া হলো লীগ সেনাপতিদের। সুচেতা কৃপালিনী রাজেনবাবুকে তুলনা করেছিলেন শিবাজী , গুরু গোবিন্দ সিংয়ের সঙ্গে। গান্ধীও এসেছিলেন। বলেছিলেন : আজ আমার অহিংসাধর্মের চরম পরীক্ষা। যদি তার ন্যায্যতা হারিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আমিই তার অর্থশূন্যতা ঘোষণা করব। ক্ষুব্ধ হয়ে সুরাবর্দিকে বলেছিলেন – হিন্দু হোক বা মুসলিম , প্রত্যেক খুনের জন্য তুমি দায়ী।

স্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন শিল্প মন্ত্রী। স্থাপন করেছিলেন চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানা , হিন্দুস্থান এরোনোটিক্স , সিন্ধ্রি ফার্টিলাইজার ইত্যাদি ভারী শিল্প। স্বীকৃতি দিয়েছিলেন সমবায়ের মাধ্যমে শিল্প পরিচালনার। আবার কোনো এক ক্যাবিনেট বৈঠকে নেহেরুর কাছে শুনেও ছিলেন – ডিপার্টমেন্টটা তো পশ্চিমবঙ্গ বানিয়ে ফেললেন। চটজলদি উত্তর ছিল – এই ব্যাপারে আমি রাজাজীকে অনুসরণ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করি।

দুই নেতায় ঠুকঠাক লেগেই থাকতো পার্লামেন্টে | নেহেরুর সমঝে চলার পাত্র বলতে ছিল প্যাটেল আর শ্যামাপ্রসাদ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর শিল্পমন্ত্রীর মধ্যে অমিলের মতো মিলও ছিল লক্ষণীয়।। দুজনই গান্ধীর বশংবদ ছিলেন না। শিখ শরণার্থীরা যখন দিল্লির মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিল গান্ধীর নির্দেশ ছিল ধর্মস্থল খালি করার। প্যাটেল মানেননি। পদত্যাগের হুমকি দিয়েছিলেন। দুজনই নেহেরুপন্থীদের কাছে ছিলেন ব্রাত্য , কম্যুনিস্টের কাছে প্রতিক্রিয়াশিল। আর তাই বুঝি প্যাটেল মারা যাবার পরে লেখা হয়েছিল – Mantle of Sardar Patel had fallen on Dr.Shyamaprosad Mookherjee |

যাইহোক , নেহেরু – শ্যামাপ্রসাদের ঠুকঠাক আটুই এপ্রিল , ১৯৫০’এর নেহেরু – লিয়াকত চুক্তির পর , বিস্ফোরণের আকার নিলো। শ্যামাপ্রসাদ মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। বিদায়ী ভাষণে বললেন : দেশভাগ অবশ্যম্ভাবী দেখে আমি বাংলা ভাগ করার পক্ষে জনসমর্থন সংগ্রহ করেছিলাম। নইলে জানতাম, সমগ্র বাংলা এমনকি অসমও পাকিস্তানে চলে যেত। আমি পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের আশ্বাস দিয়েছিলাম ভবিষ্যতে পাকিস্তান সরকার দ্বারা অত্যাচারিত হলে , নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে , জীবন ও সম্মানের ওপর অসম্মান নেমে এলে , ভারতবর্ষ দর্শক হয়ে থাকবে না। কিন্তু গত আড়াই বছর ধরে তাদের ওপর অকথ্য নিপীড়ণের ঝড় বয়ে গেছে। আমি প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারিনি। তাই এই সরকারে থাকার নৈতিক দ্বায়িত্ব আমার নেই। … লক্ষ্য করে দেখুন , পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এক জায়গায় বলছেন – ‘Protection of Minority rights ‘ , আবার অন্য জায়গায় সুর পাল্টে , – ‘ The principles of democracy , freedom, equality, tolerance, special justice as enunciated by Islam shall be fully observed | এর অর্থ কি ? এই ধরণের সমাজে কোনো হিন্দু কি তার ধর্মীয়, সাংষ্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে নিরাপদ বোধ করতে পারেন ? সংখ্যালঘুরা ন্যূনতম নিরাপত্তার আশ্বাস নিয়ে পাকিস্তানে বসবাস করতে পারেন ? আমি মনে করি এই চুক্তি দেশের মূল সমস্যার , ক্ষুধা দারিদ্র অপশাসন দুর্নীতিমূলক সমস্যার ,কোনো সমাধান করবে না। পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের জীবন হয়ে দাঁড়াবে আরো ‘brutish, nasty and short’ |

আলোড়ন সৃষ্টি হলো রাজনৈতিক মহলে। প্রশ্ন উঠলো – তবে কি শ্যামাপ্রসাদ রাজনীতি ছেড়ে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে মন দেবেন ? বক্তৃতায় সেই রকম কিছু বললেন মনে হলো ! কিন্তু না। নেহেরুর অ্যান্টি থিসিস হয়ে তিনি ফিরে এলেন , নব কলেবরে , জনসংঘি হয়ে। তিন জন নির্বাচিত সংসদ নিয়ে যোগ দিলেন সংসদ অধিবেশনে। অচিরে বাকবলে হয়ে উঠলেন বিরোধী শিবিরের মধ্যমনি , একান্ত মুখপাত্র। জন স্বীকৃতির মাধ্যমে জানানো হলো – Pandit Nehru may rule the country but Dr.Mookerjee rules the Parliament |ক্ষিপ্ত নেহেরু বললেন – I will crush the Jan Sanghis | উত্তরে শুনলেন – I will crush the crushing mentality |

ভিন্ন মতাবলম্বী শিবিরে অনলস প্রচার চললো – শ্যামাপ্রসাদ সাম্প্রদায়িক। কিন্তু কেউ বললেন না :

১) তিনি সাভারকারের অন্ধ ভক্ত ছিলেন না। চেয়েছিলেন লিবারাল মুসলমানরাও হিন্দু মহাসভার সদস্য হোক। সাভারকার চাননি।ইংরেজ দেশের পূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করলে, তিনি পার্টির পক্ষ থেকে স্থির করেছিলেন প্রত্যক্ষ সংগ্রামের । সাভারকার চাননি।নেতৃত্বের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক তথা রক্ষণশীল মনোভাবের প্রতিবাদে দলে ইস্তফা দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন :I had joined Mahasabha in the full belief that I would not hesitate to fight the government at the right moment and thus pave the way ourselves towards national freedom,”

২) ১৯৪২’র ‘ ভারত ছাড়ো আন্দোলন’এর সালে কংগ্রেস পার্টিকে যখন বেআইনি ঘোষণা করে টপাটপ নেহেরু গান্ধীদের জেলে ভরা হচ্ছে , কর্মীদের ওপর পুলিশের অকথ্য অত্যাচার চলছে , তিনিই হক মন্ত্রিসভার একমাত্র সদস্য যিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। ইস্তফা পত্রে লিখেছিলেন : It is essential to appeal both to people and British government through the Viceroy. The attempt might fail but it would be a noble failure. And if the ministers fail, they might have to resign .
হয়তো এই সব কারণে নেহেরুর উল্টো পথে হেঁটে হীরেন মুখার্জি লিখেছিলেন : “Mookerjee could not be glibly branded as a mere communalist, though in the heat of politics he often was. One could always discern the catholicity and, also within limitations, the rationality of his outlook. He was a champion of civil liberties and kept himself above the narrowness of communal chauvinism.”

২৬’শে অক্টবর , ১৯৪৭ জম্মু-কাশ্মীর নিঃশর্তে ভারতবর্ষে যোগদান করে। পরে পরেই নেহরুর প্রস্তাব অনুযায়ী ভূস্বর্গে বলবৎ করা হলো আলাদা আইন , আলাদা পতাকা এমনকি আলাদা প্রধানমন্ত্রীও।সংযুক্ত থাকা সত্ত্বেও সেখানে প্রবেশ অনুমতিপত্রের বিধি কায়েম করা হলো যার আওতায় পড়লেন ভারতের রাষ্ট্রপতিও। ভীষণ এক ভবিষ্যতের রক্তক্ষয়ী চিত্র দেখে শিউরে উঠলেন শ্যামাপ্রসাদ। শেখ আব্দুল্লাহকে লিখলেন : You are now developing a three-nation theory, the third being the ‘Kashmir nation’. These are dangerous symptoms and not good for your state or the whole of India”. পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে নেহেরুকে প্রশ্ন করলেন : “Are Kashmiris Indians first and Kashmiris next, or are they Kashmiris first and Indians next, or are they Kashmiris first, second and third and not Indian at all?” তারপর নেহেরুর নিরুত্তর অবস্থান দেখে বলেছিলেন : “Nehru claims to have discovered India. But he has yet to discover his mind”
সেই সময় আব্দুল্লাহর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে , কেন্দ্রের ৩৭০ ধারার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী জম্মু প্রজা পরিষদের আন্দোলনে উপত্যকা উত্তাল। পুরোভাগে প্রেমনাথ ডোগরা। ধরপাকড় , নৃশংস অত্যাচার চলছে চতুর্দিকে। শামিল হতে শ্যামাপ্রসাদ বেরিয়ে পড়লেন ৮’ই মে , ১৯৫৩। সঙ্গে অটলবিহারী বাজপেয়ী , বলরাজ মাধক , টেক চাঁদ , গুরু দত্ত বৈদ্য। উদ্দেশ্য : সমস্ত কিছু সরেজমিনে দেখে শেখ আব্দুল্লাহর সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে দুই যুযুধান দলের মধ্যে হিতকর সমঝোতা সূত্র বের করা। প্রথমে অমৃতসর , তারপর পাঠানকোট হয়ে পৌঁছুলেন উধমপুর।

সেখান থেকে জম্মু সীমান্তে ঢুকতেই, সুপ্রিম কোর্টের অধিক্ষেত্র পেরোতেই, তাওয়াই ব্রিজের ওপর গ্রেপ্তার। অপেক্ষমান সমর্থকদের চোখের সামনে দিয়ে জীপে করে শ্রীনগর সেন্ট্রাল জেল। সেখান থেকে ডাল লেকের পাশে ছোট্ট একটা কটেজ , ১০’ বাই ১১’ বর্গফুটের ঘর। হাঁটা চলার জায়গা বলতে এক চিলতে উঠোন। নেহেরু যদিও পুত্রহারা যোগমায়া দেবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন – আপনার ছেলে ছিল রাজ্ সমাদরে।শুনেছি বিলাস ব্যাসনের আয়োজন ছিল ত্রূটিহীন।

আব্দুল্লাহর রাজ্যে বন্দি হলেন সংসদের বিরোধী নেতা তথা প্রধান মুখপাত্র। কারণ : কাশ্মীর পাবলিক সেফটি এক্ট লঙ্ঘন। অতঃপর শরীর খারাপের শুরু। পায়ে ভেরিকোজ ভেনের অসহ্য ব্যাথা। কাতর বন্দির বারম্বার ব্যক্তিগত চিকিৎসক বিধান রায়’এর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবার , আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবার একান্ত প্রার্থনা। এবং বারম্বারই নাকচ। এলার্জির কারণে রোগীর অসম্মতি ছিল স্ট্রেপ্টোমাইসিন ওষুধে। জেলের ডাক্তার আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘ভ্রান্ত ধারণা’। অবস্থার অবনতি হতে থাকলো ক্রমশ। দুটো হার্ট এটাক আগেই হয়েছিল। এবার হলো তৃতীয়টি। সেই মুমূর্ষু অবস্থায় , ‘উন্নত’ চিকিৎসার জন্য তাঁকে খাড়াই লম্বা সিঁড়ি হাঁটিয়ে তোলা হলো সরকারি হাসপাতালের ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডে। এবং সেখান থেকেই সহকর্মী ব্যারিস্টার ত্রিবেদী,সহবন্দী টেক চাঁদ,গুরু দত্ত খবর পেলেন ২৩’শে জুন ভোরে , শ্যামা প্রদীপ নেভার মুখে। পরের দিনই ছিল আদালতে তাঁর কৃত হাবিয়াস কর্পাস মামলার চূড়ান্ত শুনানি তথা বিচারপতির অবিলম্বে ‘বন্দিমুক্তি’র রায়ে দেবার কথা।

ব্যারিস্টার চোখ মুছতে মুছতে বাইরে এলেন। স্মৃতি জুড়ে তখন তাঁর সেই নিদৌ হোটেলে আসা জ্যোতিষীর মুখ। সে বলেছিলো :ওনার ঘোর বিপদ। যত সত্বর পারো মুক্ত করে নিয়ে যাও। আর ডায়েরিতে সেই কথাগুলো: তিলে তিলে, ভুগে ভুগে মরতে চাই না,কাজ করতে করতে সংগ্রামের ভিতর যেতে যেতে ,সত্যকে বরণ করতে করতে জীবনদ্বীপ নিভে যাক , এই আমার কাম্য।

মরদেহ দমদম বন্দরে পৌঁছুতে দেরি করেছিল ছ ঘন্টা। রাত গভীর হলেও অপেক্ষায় ছিল রাজ্যবাসী , কাতারে কাতারে , দোকান অফিস সিনেমা থিয়েটার বন্ধ করে। সবাইকার মুখে একটাই কথা – আমরা সুভাষকে হারিয়েছি , কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ ছিল মাথার ওপর। এই মহামরণ , একি স্বাভাবিক মৃত্যু নাকি আরো এক পরিকল্পিত রাজনৈতিক অপসারণ। বাঙালির পিঠে আবার ছুরি ?

ডুকরে উঠেছিলেন ৮২ বছরের মা-যোগমায়া দেবী। বিধান রায়ের হাত ধরে বলেছিলেন – বিধান তুমি আমার শ্যামার মতো। তুমি তো ছিলে তবু আমার ছেলে কি করে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলো ? পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হলো – আজ শোকে মুহ্যমান হইয়া বাংলার দুর্ভাগ্য ও বাঙালি সমাজের দুর্ভাগ্য সমস্ত মন দিয়া অনুভব করিয়াছি। হায় অভিশপ্ত ভূমি ! তোমার নেত্রী স্থানীয় সন্তানদের জীবন কোনোক্রমে পঞ্চাশের সীমানা অতিক্রম করিতে চাহে না।

শেষ করি একটু অন্য নিরিখে। কিছু কিছু মৃত্যু আসে আশীর্বাদক রূপে। শ্যামাপ্রসাদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিলো। তাঁর জীবনাবসানের কিছু দিনের মধ্যে ভারত সরকার , কাশ্মীরে প্রবেশ করার পারমিট সিস্টেম রহিত করা হলো । এংলো – মার্কিন ব্লকের পৃষ্ঠপোষকতায় শেখ আব্দুল্লাহ’র ‘ আজাদ কাশ্মীর’এর ডাক নেহেরুকে প্রকৃত শত্রুর মুখ দেখালো। আর এই বঙ্গে , নবজাতক জনসংঘের হাত ফস্কে , পূর্ব পাকিস্তানের উপদ্রুত উদ্বাস্তু তথা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোট ব্যাংক কমিউনিস্টদের বাক্সে এলো ; এ যেন মেঘ না চাইতে জল কিংবা বলা যেতে পারে , পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা।

(লেখক কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও কলেজের ছাত্র। পরবর্তীকালে ফ্রীলান্স সাংবাদিকতা স্টেটসম্যান তথা হিন্দু পত্রিকায় এবং প্রযোজক শ্রী প্রণবেশ সেনের অধীনে কলকাতা দূরদর্শনে বিভিন্ন তথ্যমূলক ছবির নির্মাতা। ১৯৯৩ সালে দিল্লিতে সাহিত্য আকাদেমির ‘ন্যাশেনাল কোলোকুইম অফ ইয়াং রাইটার্স’এ অন্যতম প্রধান বক্তা হিসেবে নিমন্ত্রিত। ওই বছরই মার্কিন দেশে লেখক দ্বারা অনুদিত শ্রী সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা এবং উপন্যাসের প্রকাশ। এ ছাড়াও রয়েছে চিত্রসাংবাদিক হিসেবে দুই দশক জুড়ে লেখকের গ্রাম বাংলা তথা ভারতবর্ষের বিভিন্ন ধর্মীয় রিচুয়ালসের ফটো ডকুমেন্টেশানের প্রয়াস যার বিশেষ কিছু প্রতিফলন রয়েছে ‘ন্যাট জিও’র পত্রিকায়। পেশায় স্কুল ও ইউনিভার্সিটিতে মানব সম্পদ প্রশাসকের পদাধিকারী, লেখকের জ্ঞানপ্রসূত অভিজ্ঞতা অন্বেষণের পরিধি ইতিহাস, দর্শন ও সমাজ সংস্কৃতির বিভিন্ন বিস্তারে, নব নির্মিতির নিরিখে।)