Dr. Syama Prasad Mookerjee Research Foundation

স্বামী বিবেকানন্দের মহাপ্রয়ান উত্তর সময়কালে ভগিনী নিবেদিতা

তখন তিনি ২৮ বছর ১ মাস বয়েসের আইরিশ কন্যা মিস মার্গারেট নোবেল, তখনও হয়ে ওঠেননি ভগিনী নিবেদিতা। সমকালীন সমাজ,দর্শন ও চিন্তায় নিজেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেওয়া কিংবা পরাধীন দেশ আয়ারল্যান্ডের মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগে আলোকিত এই বিদুষী রমনীর ইতিমধ্যে দু’বার বিবাহের প্রস্তাব ভঙ্গ হয়েছে। প্রথমবার (১৮৯০) প্রনয়াস্পদ যুবকের মৃত্যু হয়েছে অকালে।‌ দ্বিতীয়বার ১৮৯৪ সালে বিবাহ ইচ্ছুক যুবকটি সহসা তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে যায়। সাংসারিক জগত, প্রেম, ব্যক্তিগত প্রাপ্তির সেই ঘোর সংশয়কালেই সাক্ষাৎ হয় দীপ্তময় যুগপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে, ইংরেজ শাসকের রাজধানী লন্ডনে আয়ারল্যান্ড তখন ইংরেজ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র। আইরিশ জাতীয়তাবাদী নেতা ও হোমরুল লীগের অন্যতম প্রবর্তক পার্নেলের (মৃত্যু – ১৮৯১) সঙ্গে সক্রিয় সংস্পর্শ আসা নিবেদিতার রক্তে ঢুকে গেছিল বিপ্লববাদ। পিতা ও পিতামহ পেশাগতভাবে ধর্মযাজক হলেও ইংরেজের শাসন থেকে মুক্তি সংগ্রামে বিপ্লবী চেতনা জন্মসূত্রে পেয়েছিলেন নিবেদিতা, তীব্রতম ছিল ইংরেজ বিরোধীতা।

স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে নিবেদিতার সাক্ষাতের ১৮৯৫ থেকে ১৯০২ এই সাত-আট বছরে রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দের ধর্মে আসক্ত হয়ে বদলে ফেলা জীবন নিয়ে হয়ত অনেক চর্চা হয়েছে। কিন্তু ১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই স্বামীজীর মহাপ্রয়াণের পর সেই ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক বন্ধনকে ছিন্ন করে ভারত নামক এই মহান দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করার ঘটনাক্রম যেমন বেশ চমকপ্রদ, তেমনি সে ইতিহাসটিও বড় শিক্ষনীয়।দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিষয়টি কম আলোকিত একটি অধ্যায়।

ভারতের জাতীয়তাবোধকে জাগ্রত করা চরমপন্থী নেতা অরবিন্দ -প্রমথনাথের ভাবশিষ্যা হওয়া সত্ত্বেও গোখলের মত নরমপন্থীদের সম্মিলিত করার মধ্য দিয়ে অখন্ড ভারতবর্ষের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তার হদিস আমরা খুব কম জনই রাখি। রজনীকান্তের “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই” উত্তাল সময় শুরুর কালে বিলেতি দ্রব্য বর্জনের আন্দোলন অগ্রগন্যা ছিলেন এই বিদেশিনী। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করার নেপথ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল নিবেদিতার। পরাধীন ভারতের প্রথম সবচেয়ে বড় আন্দোলন-জমায়েত ছিল ১৯০৬ সালের ৭ই আগষ্টে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী কলকাতা টাউন হলের সভা। সেদিনের সেই সভায় হিসেবের বাইরে এত মানুষের জমায়েত হয়েছিল যে, একটি মিটিং ভেঙে তিনটি স্থলে মিটিং এর আয়োজন করতে হয়েছিল।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সহিংস ধারার অগ্রগন্য ছিল গুপ্ত সমিতি এবং অনুশীলন সমিতি। বাংলার বাইরে গুজরাটে প্রতিষ্ঠিত গুপ্ত সমিতি অরবিন্দের হাত ধরে বাংলায় আসে নিবেদিতার সক্রিয় অংশগ্রহণে।সালটা ১৯০২। প্যারিসে গিয়ে মেদিনীপুরের হেম কানুনগোর বোমা বানানোর কৌশল শিখে আসা কিংবা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপ্লবীদের জন্য রসায়ন গবেষণাগার খুলে দেওয়ার নেপথ্যে এই বিদেশিনীর ভূমিকার কথা কোথাও গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয় না।

স্বামী বিবেকানন্দ “একাধারে শঙ্করের অদ্ভুত মস্তিষ্ক এবং অপরদিকে চৈতন্যের অদ্ভুত বিশাল হৃদয়ের অধিকারী” যুগপুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণপরমহংসদেবের ধর্ম ও দর্শন প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রামকৃষ্ণ মিশন। আর বিবেকানন্দের ভাবশিষ্যা নিবেদিতা স্বামীজীর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য বিবেকানন্দ সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দক্ষিণ ভারতের সীমাবদ্ধ কতকগুলি অঞ্চল ছাড়া কেন বেশিদূর এগোয়নি সে প্রসঙ্গ অন্য। বরং সেই ইতিহাস খুঁজে দেখা প্রয়োজন কেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ তাঁর এই উদ্যোগে অংশ নেননি, সংক্ষিপ্ত ক্ষেত্রে স্বামী সদানন্দের অংশগ্রহণ ছাড়া।

রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে মুক্ত থাকতে না চাওয়ায় নিজের ধর্মমত ও আদর্শের রামকৃষ্ণ মিশনকে পরিত্যাগ করার সুদীর্ঘ ইতিহাস আজ জাতীয়তাবাদ ও অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বপ্ন-সাধনার দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন এসেছে। প্রয়োজন এসেছে চরমমপন্থী- চরমপন্থী ধারার চেয়ে জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশ্লেষণ । নিবেদিতার জীবন চর্চায় ধর্ম চর্চায় ধর্ম প্রতিষ্ঠান বড়, নাকি স্বামী বিবেকানন্দের অমোঘ বাণী ” ভারত মাতাই তোমার একমাত্র আরাধ্যা ” – এ প্রশ্ন আজকের ভারতে অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক। ভগিনী নিবেদিতা তাঁর জীবন-দর্শনে আজীবন যাপনে সেই ধর্ম নয়, বরং ভারত মাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন রাজনৈতিক সংগ্রামের অনিশ্চিত ও বন্ধুর পথকে। নিবেদিতাকে রামকৃষ্ণ মঠ ছাড়তে বাধ্য হতে হয়েছিল, তাতে হয়ত দোষের কিছু নেই, তবে স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও মঠের অন্যান্য সন্নাসীরদের সেই আচরন – ” লেখ যে, তুমি স্বেচ্ছায় মঠ ছাড়িয়া যাইতেছ।” প্রশ্ন সেখানেই।

সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠিত ডন পত্রিকা ও ডন সোসাইটি, সন্ধ্যা পত্রিকা, যুগান্তর পত্রিকা, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মডার্ন রিভিউ পত্রিকা, বিপিনচন্দ্র পালের স্বরাজ পত্রিকা প্রভৃতি সংবাদপত্রে তাঁর বিখ্যাত লেখনি যেমন একদিকে তৎকালীন স্বাধীনতা আন্দোলনের চরিত্র বুঝতে সাহায্য করে; সেই সঙ্গে হিন্দুত্ব ও জাতীয়তাবাদ একে অপরের পরিপূরক তার প্রতিচ্ছবি আজকের ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশের বিশ্লেষণ করতে শেখায়। ঠিক একইভাবে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করা ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের হিন্দু ধর্মের প্রতি চুড়ান্ত আনুগত্য ও হাবার্ড ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু দর্শন প্রচারের নেপথ্যে খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী এক বিদেশিনীর ভূমিকা অনেকগুলি ভ্রম সংশোধনের রাস্তা খুলে দেবে। “বিবেকানন্দের জলন্ত চিতা হইতে যে দুইটি অগ্নিশিখা বাহির হইয়া আসিয়াছিল, তার একটি ভগিনী নিবেদিতা, আর একটি উপাধ্যায় ব্রহ্মবান্ধব। এই দুইটি যমজ অগ্নিশিখা কে কখনও পৃথক করিয়া কখনও বা একত্র করিয়া দেখিলে বাংলার স্বদেশী যুগকে পুরাপুরি দেখা যাইবে।”  মদনলাল ধিংরা কতৃক লন্ডনে ১৯০৯ সালে কার্জন উইলি হত্যা এবং সুদুর আয়ারল্যান্ডে তার সমর্থন ও উদযাপনে নিবেদিতার ভূমিকার অসম্পূর্ণ চর্চা ভারতের সহিংস আন্দোলনের খন্ডিত চিত্রের উপস্থাপন করে।

প্রখ্যাত চিত্রকর ওকাকুরা’র শিল্প ভাবনায় জাপানি চিত্র আদর্শের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের ভারতীয় শিল্পনীতির অভূতপূর্ব সমন্বয়ের কিংবা অজন্তার চিত্রকলার বিশ্লেষণে নন্দলাল বসু ও শিল্পী অসিতকুমার হালদারের সহায়তায় রেপ্লিকা চিত্র তৈরীর উদ্যোগের কারিগর ভগিনী নিবেদিতা কে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার অবকাশ আছে। সেইসঙ্গে ভারত আত্মা এবং অখন্ড ভারতের প্রতিভু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ‘ভারতমাতা’ র চিত্র যে নিবেদিতার ভাবনার প্রকাশ তা শিল্পী নিজেই তাঁর গ্রন্থ ‘ জোড়া সাঁকোর ধারে’ তে উল্লেখ করেছেন।

১৯১১ সালের ১৩ই অক্টোবর দার্জিলিঙে কাঞ্চনজঙ্ঘায় রাঙিয়ে যাওয়া সূর্যালোকের ছটাময় প্রত্যুষে জীবনদীপ নিভে গেল এক মহাপ্রাণার। জন্মসূত্রে খ্রীষ্টান আর অন্তর থেকে হিন্দুত্ব গ্রহণ করা এই মনীষার নশ্বর দেহ সেদিন আগুনেই ভস্মীভূত করা হয়েছিল।পড়ে থাকা কয়েক মুঠো ভস্মের কিছুটা গিয়েছিল বেলুড় মঠে, কিছুটা বাগবাজারের বশি সেনের মন্দিরে, কিছুটা আয়ারল্যান্ডের নিজ জন্ম গৃহে আর কিছুটা ভারতবর্ষের বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র বসু বিজ্ঞান মন্দিরে।

জগদীশ চন্দ্র বিজ্ঞানে নোবেল না পাওয়ায় নোবেলের মূল্য কিছুটা ফিকে হয়েছে কিনা জানা নেই। তবে নোবেল কমিটির প্রদত্ত অর্থ মূল্যের ঠিকঠাক তিনগুন অর্থ দুটি ধাপে লাভ করছিলেন এবং আর এক ভারতপ্রানা বিদেশিনী সারা বুলের কাছ থেকে। প্রথম ধাপে কেনা হয় জমি, পরের ধাপে তৈরী হয় ভারতবর্ষের বিজ্ঞান সাধনার উজ্জ্বল প্রতীক বসু বিজ্ঞান মন্দির। সময়ের অভিঘাতে হয়তো হারিয়েছে অনেক কিছুই। আজ থেকে ১১৩ বছর আগে নিভে যাওয়া জীবনদীপের সংস্পর্শ চিহ্ন আজ সেই অর্থে কোথাও নেই।এমনকি তার মৃত্যু ও দাহ স্থান দার্জিলিঙে কোন ফলক ছিল না স্বামী অভেদানন্দ মহারাজের উদ্যোগে এই কয়েক বছর আগে একটি ফলক স্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত। তবু কোন বিজ্ঞান জিজ্ঞাসু ছাত্র আজও বসু বিজ্ঞান মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালে ভালো করে অন্তত একবার লক্ষ্য করুক, সেখানে একজন নারী প্রদীপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভারতের মুক্তি সংগ্রামের অন্ধকারের পথপ্রদর্শক, জ্বলন্ত অগ্নিশিখা স্বরূপা সেই নিবেদিতাকে অন্তত একবার স্মরণ করিয়ে দিক শিক্ষিত বাঙালি। স্মরণ করুক ১৯০৯ সালে আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পরে আজীবন আন্দোলনের সঙ্গী সহিংস আন্দোলনের অগ্রমুখ বিপ্লবী অরবিন্দের ঋষি অরবিন্দ হয়ে ওঠার পেছনে আধ্যাত্মিক নিবেদিতার ভূমিকার কথা। তাঁর দর্শন ও জীবন চর্চায় আজও অনুভূত হয় ভারত মাতৃকার ঐতিহ্য- পরম্পরার মায়াবী সুর।

ঋণঃ
১. ভারত কন্যা নিবেদিতা – লিজেল রেঁমা
২. জোড়া সাঁকোর ধারে – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩. দেশ পত্রিকা লোকমাতা সংখ্যা – ১৭ই অক্টোবর ২০১৭
৪. স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি – ভগিনী নিবেদিতা
৫. নিবেদিতা লোকমাতা ১ম, ২য় ও তয় খন্ড – শঙ্করী প্রসাদ বসু
৬. মহীয়সী নিবেদিতা – মৃগেন্দ্রচন্দ্র দাস
৭. ভারত উপাসিকা নিবেদিতা – রামেন্দু বন্দোপাধ্যায়
৮. স্বামী-শিষ্য-সংবাদ – শ্রীশরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী
৯. ভগিনী নিবেদিতা ও বাংলায় বিপ্লববাদ – গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী
১০. হেম কানুনগো রচনাবলী – সম্পা. ড. স্বদেশ রঞ্জন মন্ডল