প্রাচীন বঙ্গদেশ নদনদী দ্বারা বিধৌত। আর এই নদনদী বিধৌত দেশে সমৃদ্ধশালী মহানগর, নগর ও শাসন কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। এরমধ্যে প্রাচীন মহানগর খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত কর্ণ সূবর্ণ মহানগর।বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহর বহরমপুর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরে গড়ে উঠেছিল এই কর্ণসুবর্ণ মহানগর। সপ্তম শতাব্দীতে কর্ণসুবর্ণই সর্বাপেক্ষা শ্রীবৃদ্ধিসম্পন্ন মহানগরী ছিল। কিন্তু কোন প্রাচীন গ্রন্থে কর্ণসুবর্ণের কোন রকম উল্লেক পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র সপ্তম শতাব্দীর রচিত গ্রন্থে ও লেখমালায় কর্ণসুবর্ণের নাম রয়েছে।১
প্রাক্-কথন ; গৌড় রাজ্য:-
শশাঙ্ক ও কর্ণসুবর্ণ বিষয়ে আলোচনার পূর্বে, বঙ্গদেশে তথা গৌড়ে শশাঙ্ক পূর্ববর্তী রাজনৈতিক অবস্থা বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা বোধহয় জরুরী।
গুপ্তবংশের শেষলগ্নে পরবর্তী গুপ্ত’ বংশ নামে পরিচিত বংশের গুপ্ত উপাধিধারী রাজারা গৌড় রাজ্য অধিকার করেছিলেন।
খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ দিকে উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ এই রাজবংশের অধীন ছিল। এই সময়ে বাংলা দেশের এই অঞ্চল গৌড় নামে প্রসিদ্ধ হয়।নামে গুপ্তরাজাদের অধীন হলেও যষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগে গৌড় একটি বিশিষ্ট জনপদরূপে প্রসিদ্ধিলাভ করেছিল। তখন মৌখরি বংশ এই অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। এই বংশের পরাক্রান্ত রাজা ঈশানবর্মা সম্বন্ধে তাঁর একখানি শিলালিপিতে রয়েছে যে, তিনি গৌড়গণকে পরাজিত ও বিপর্যস্ত করে তাঁদেরকে সমুদ্রতীরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেন। এর অর্থ সম্ভবত এই যে, গৌড়ের অধিবাসীরা সমুদ্রতীরে গিয়ে আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হয়েছিলেন।
মৌখরি ও পরবর্তী গুপ্ত বংশীয় রাজাদের মধ্যে পুরুষানুক্রমিক বিবাদ চলছিল। গুপ্তরাজাদের শিলালিপি অনুসারে গুপ্তরাজ কুমারগুপ্ত ঈশানবর্মাকে পরাজিত করেন এবং কুমারগুপ্তের পুত্র দামোদরগুপ্ত মৌখরিদের সাথে যুদ্ধে জয়লাভ করেন। ঈশানবর্মার পরবর্তী মৌখরিরাজ শর্ববর্মা ও অবন্তিবর্মা সম্ভবত মগধের কিছু অংশ অধিকার করেন। এটি অনুমেয় যে, এর ফলে গুপ্তরাজগণ মগধ ও গৌড় পরিত্যাগ করে মালবে রাজত্ব করেন। কিন্তু একথা সত্য হোক বা না-হোক, ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগে যে গুপ্তরাজ মহাসেনগুপ্তের রাজ্য পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।
কামরূপের রাজা ভাস্কর বর্মার ‘দুবি’ তাম্রশাসনে রয়েছে যে গৌড়ের সৈন্যদল ওই রাজ্য আক্রমণ করে এবং রাজা সুস্থিতবর্মনের দুই পুত্র বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেও গৌড়ীয় সৈন্যের কাছে পরাজিত ও বন্দি হন। ওদিকে গুপ্তরাজ আদিত্যসেনের ‘অক্সর’ লিপিতে রয়েছে যে মহাসেনগুপ্ত ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যুদ্ধে জয়লাভ করেন এবং তাঁদের কীর্তি ওই নদীতীরে গাওয়া হয়। এই দুইটি উক্তিতে খুব সম্ভবত একটি ঘটনাই বর্ণিত হইয়াছে। যাইহোক গৌড় ও মগধ যে একসময় মহাসেনগুপ্তের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এই সিদ্ধান্ত খুবই সঠিক। তবে খুবসম্ভব গৌড় পরবর্তী গুপ্ত বংশীয় রাজাদের প্রত্যক্ষ শাসনের অধীন ছিল না। কোনো শাসনকর্তা বা সামন্ত নৃপতি তাঁদের অধীনে গৌড় ও মগধ শাসন করতেন।
অন্যদিকে মৌখরি রাজাদেরও যে মগধে কোনো আধিপত্য ছিল না এর প্রমাণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে শর্ববর্মা ও অবন্তিবর্মার পরে আর কোনো মৌখরিরাজ যে মগধের কোনো অংশে রাজত্ব করতেন এর কোনো প্রমাণ নাই। এই দুই রাজার জানা তারিখ যথাক্রমে ৫৫০-৫৪ খ্রিস্টাব্দ ও ৫৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দ। মহাসেনগুপ্ত প্রায় ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।
অর্ধ শতাব্দীব্যাপী এই সংঘর্ষের ফলে এবং উত্তর থেকে তিব্বতীয়দের ও দক্ষিণ থেকে চালুক্যরাজের আক্রমণে সম্ভবত পরবর্তী গুপ্তরাজারা দুর্বল হয়ে পড়েন, ফলে এই সুযোগে গৌড় দেশে শশাঙ্ক এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। ২
শশাঙ্ক:-
বাঙালি রাজাদের মধ্যে শশাঙ্কঔ প্রথম সার্বভৌম নরপতি। শশাঙ্কের পূর্ণাঙ্গ ইতিবৃত্ত অন্ধকারময়। বিশেষ করে তাঁর বাল্য ইতিহাস ও বংশ।
সর্বপ্রথমে শশাঙ্ক সম্ভবত পরবর্তী-গুপ্ত বা মৌখরী নৃপতিদের অধীনে একজন মহাসামন্ত ছিলেন। ইহার অকাট্য প্রমাণ আছে। বিহারের সাহাবাদ জেলায় শোনু নদীর তীরে রোহতাসগড়ের পর্ব’তগাত্রে সীলমোহরের ছাঁচ (সীল-ছাঁচ) বেগলার আবিষ্কার করেন ১৮৭৮ সালে। সীল-ছাঁচের উপরের অংশে উপবিষ্ট ষাঁড়ের প্রতিকৃতি এবং নিম্নাশে, দুই ছত্রে লেখ উৎকীর্ণঃ-
১। শ্রী মহাসামন্ত
২। শশাঙ্ক দেবস্য ॥
(অর্থাৎ, মহীয়ান মহাসামন্ত শশাঙ্কদেবের)
পুরাতত্ত্ববিদ ফ্লিট (Fleet) (১৮৮৮) সীল-ছাঁচে অঙ্কিত শশাঙ্কদেব ও কর্ণসুবর্ণে’র অধিপতি শশাঙ্ক একই ব্যক্তি বলে শনাক্ত করেছেন। বেগলার (১৮৭৮) ‘সাওসঙ্খ’ (১০০ শঙ্খ) নামে এক পরাক্রমশালী নৃপতির সম্বন্ধে প্রচলিত জনশ্রুতির কথা বলেছেন। বলা বাহুল্য ‘সাওসঙ্গ’ শশাঙ্ক নামেরই বিকৃত রূপ। কানিংহাম্ (১৮৭১) গয়া ও যশোহর জেলা থেকে আবিষ্কৃত শশাঙ্ক- নামাঙ্কিত মুদ্রার বর্ণনা দিয়েছেন। মহানাদ, বর্ধমান প্রভৃতি স্থান থেকেও শশাঙ্কের মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এই সব মুদ্রায় লিখিত আছেঃ ‘শ্রী শশাঙ্ক’। মুদ্রাঙ্কিত ‘শ্রী শশাঙ্কই’ হিউএন-সাগু কর্তৃক বর্ণিত কর্ণসুবর্ণের অধিপতি ‘রাজা শশাঙ্ক’। এই রাজা শশাঙ্কই রোহতাসগড়ের সীলের মহাসামন্ত শশাঙ্কদেব।
কানিংহামের মতে জৈন গ্রন্থে উল্লেখিত নরেন্দ্রগুপ্তও শশাঙ্ক নামে খ্যাত ছিল। হল (Hall) মনে করেন, শশাঙ্ক গুপ্তরাজবংশজাত ছিলেন এবং তাঁর পুরো নাম ছিল শশাঙ্কগুপ্ত। যশোহর জেলা থেকে আবিষ্কৃত একটি মুদ্রায় লিখিত আছে: ‘নরেন্দ্রবিনত’। প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৭১) সিদ্ধান্ত করেছেন, নরেন্দ্রগুপ্ত শশাঙ্কেরই দ্বিতীয় নাম। সিদ্ধান্তের সমর্থন পাওয়া যায় বিভিন্ন মুদ্রায় অঙ্কিত বা উৎকীর্ণ’ উক্তি থেকে। এই শশাঙ্কের ও গুপ্তরাজাদের মুদ্রার অভিন্নতার কথাও বলা হয়েছে। যশোহর জেলা থেকে পাওয়া মুদ্রায় লিখিত নামঃ ‘নরেন্দ্রাদিত্য’। ‘আদিত্য’ একাধিক গুপ্তরাজাদের নামের সঙ্গে যুক্ত। শশাঙ্ক বা নরেন্দ্র (গুপ্ত) নামের সাথেও আদিত্য যুক্ত ছিল। অনেকের মতে, শশাঙ্কও ছিলেন গুপ্তবংশজাত। প্রথমে তিনি গুপ্তরাজাদের অধীনে পূর্ব ভারতের মহাসামন্তপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাই অনেকে মনে করেন, এই নরেন্দ্রগুপ্তই পরবর্তী-গুপ্ত সম্রাট মহাসেনগুপ্তের পুত্র বা ভ্রাতুষ্পুত্র। বাণভট্টের হর্ষচরিতের একটি পাণ্ডুলিপিতে থানেশ্বরের (স্থানীশ্বর) রাজা রাজ্যবর্ধনের হন্তার নামও নরেন্দ্রগুপ্ত। কিন্তু হর্ষচরিতের অন্য পান্ডুলিপিতে ‘গৌড়াধিপতি’ (শশাঙ্ক) রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করেছিলেন। হিউএন-সাঙ্ ও বাণভট্টের বিবরণীতে কর্ণসুবর্ণের অধিপতি বা গৌড়াধিপ শশাঙ্কই রাজ্যবর্ধনের হন্তা। হর্ষচরিতের এক অংশের টীকায় এই সিদ্ধান্তের সমর্থনও পাওয়া যায়। রাজ্যবর্ধনের হত্যাকারীকে ‘শশাঙ্ক নামা’ গৌড়াধিপ বলা হয়েছে। হর্ষচরিতের অপর অংশের বিবরণ অনুসারে রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর একজন ‘কুলপুত্র’ কুনাস্থল (কান্যকুব্জ) অধিকার করেন। রাজ্য- বর্ধনের হত্যাকারী ও কুলপুত্র একই ব্যক্তি। তাই সিদ্ধান্ত করা হয়েছে: গৌড়াধিপ শশাঙ্ক, কুলপুত্র, নরেন্দ্রগুপ্ত এবং নরেন্দ্রবিনত অভিন্ন ও গুপ্তবংশজাত।৩
গৌড়াধিপতি ও কর্ণসুবর্ণের অধিপতি ভিন্ন ব্যক্তি ছিল বলে মনে করবার যুক্তিও আছে। বাণভট্ট থানেশ্বরের অধিপতি রাজ্যবর্ধনের হন্তাকে ‘গৌড়াধিপ’ বলেছেন। কিন্তু হিউএন-সাঙের ভ্রমণ-বিবরণীতে কর্ণসুবর্ণ ও পুণ্ড্রবর্ধন (উত্তর বঙ্গ) দুইটি স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল। চীন পরিব্রাজক শশাঙ্ককে গৌড়ের অধিপতি বলে উল্লেখ করেননি। উপরন্তু হর্ষচরিতের একটি পুঁথিতে রাজ্য- বর্ধনের হন্তার নাম নরেন্দ্রগুপ্ত। কিন্তু অন্য পাণ্ডুলিপিতে গৌড়াধিপ সম্ভবত নরেন্দ্রগুপ্ত এবং শশাঙ্ক কর্ণসুবর্ণাধিপতি। তা হলে, শশাঙ্ক ও নরেন্দ্রগুপ্ত ভিন্ন ব্যক্তি। কিন্তু হিউএন-সাঙের বিবরণীতে পুণ্ড্র- বর্ধনের রাজার নাম উল্লেখ করা নেই। শশাঙ্কের অভ্যুত্থানের পূর্বে নরেন্দ্র- গুপ্ত হয়তো গৌড়ের অধিপতি ছিলেন। নরেন্দ্রগুপ্তকে উচ্ছেদ করেই শশাঙ্ক গৌড়েশ্বর হয়েছিলেন। থানেশ্বরের রাজা রাজ্যবর্ধনের সঙ্গে যুদ্ধের সমর শশাঙ্কই যে গৌড়ের অধিপতি ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই জন্যই বোধহয় হিউএন-সাং গৌড়ের রাজার নাম উল্লেখ করেননি। হর্ষচরিতের পাণ্ডুলিপির সংকলকদের পক্ষে অসতর্কতাবশত নরেন্দ্রগুপ্তের নাম সন্নিবেশ করাও সম্ভব। শশাঙ্কের অধীনে নরেন্দ্রগুপ্তের গৌড়ের শাসনকর্তা হয়ে থাকাও একেবারে অসম্ভব নয়। এমন কি, নরেন্দ্রগুপ্ত হয়তো উত্তর ভারতে অভিযানের সময় শশাঙ্কের সহচর সেনাপতি ছিলেন।শশাঙ্ক ও নরেন্দ্র গুপ্তের অভিন্নতা স্বীকার করলেও কর্ণসুবর্ণের অধিপতি শশাঙ্ক যে মগধের গুপ্ত বা পরবর্তী গুপ্ত বংশজাত ছিলেন তার কোন নিশ্চিত প্রমাণ নেই। ৪
অধ্যাপক সুধাকর চট্টোপাধ্যায় (১৯৫৮) শশাঙ্কের আদি-বাসস্থান বা উদ্ভব-কেন্দ্র সম্বন্ধে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁর মতে শশাঙ্কের আদি- বাসস্থান ছিল উত্তর বঙ্গে। উত্তর বঙ্গ থেকেই শশাঙ্ক বঙ্গদেশের বিভিন্নাংশে আধিপত্য বিস্তার করে কর্ণসুবর্ণ-মহানগরীতে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায়ের মতে রোহতাসগড়ের সীল-ছাঁচ শশাঙ্কের রাজত্বের শেষ পর্যায়ে উৎকীর্ণ হয়েছিল। তিনি মনে করেন, থানেশ্বর-কনৌজের অধিপতি হর্ষ’- বর্ধনের নিকট পরাজিত হয়ে শশাঙ্ক যখন অধস্তন শাসকরূপে অধিষ্ঠিত ছিলেন তখনই রোহতাসগড়ের সীল-ছাঁচ উৎকীর্ণ হয়েছিল। তাঁর মতে, এই সময়েই মেদিনীপুরের তাম্রফলক-দানপত্র খোদিত ও প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু শশাঙ্ক যে প্রথমে উত্তর বঙ্গ থেকে নির্গত হয়ে বঙ্গদেশের অন্যান্য অংশের উপর প্রভুত্ব স্থাপন করেছিলেন তার কোন প্রমাণ নেই। হর্ষবর্ধনের সঙ্গে শশাঙ্কের কোন প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ ও হয়নি। হর্ষবর্ধনের নিকট শশাঙ্কের পরাজয়ের পক্ষেও কোন যুক্তি বা প্রত্যক্ষ ঐতিহাসিক তথ্য নেই। অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন যে, হর্ষবর্ধন ৬১৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৬২৬ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কোন এক সমমে শশাঙ্ককে পরাজিত করেছিলেন।৫ চীন পরিব্রাজকের ভ্রমণ-বিবরণের উক্তির বিরুদ্ধ। ঐ সময়ের মধ্যে হর্ষবর্ধনের কাছে শশাঙ্কের পরাজয় হয়ে থাকলে, হর্ষবর্ধনের দিগবিজয়-অভিযানের সমাপ্তি এবং শশাঙ্কের পরাজয় ১৪ থেকে ২০ বৎসরের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু চীন পরিব্রাজকের বিবরণী অনুযায়ী হর্ষবর্ধন সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে ৬ বৎসরের মধ্যে ‘পঞ্চভারত’ জয় সমাপ্ত করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, শশাঙ্কের সার্বভৌম নৃপতিপদে অধিষ্ঠিত থাকাকালেই মেদিনীপুরের তাম্রফলক-দানপত্র প্রচারিত হয়েছিল।
প্রামাণিক উপাদানের অবর্তমানে শশাঙ্কের আদি-বাসস্থান স্থির করা সম্ভব নয়। বিবিধ উপাদানের আলোচনা থেকে মনে হয়, ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে শশাঙ্ক সম্ভবত প্রথমে কোন পরবর্তী-গুপ্তনৃপতির অধীনে রোহতাসগড়ে মহাসামন্তপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। রোহতাসগড়ই মহাসামন্ত শশাঙ্কের প্রাথমিক কর্মকেন্দ্র ছিল। পতনোন্মুখ পরবর্তী-গুপ্তসাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিতে মহাসামন্ত শশাঙ্ক পশ্চাদপদ হননি। রোহতাসগড় থেকেই সার্বভৌমত্বের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবার অভিপ্রায়ে মহাসামন্ত শশাঙ্ক গৌড় আক্রমণ করেছিলেন।৬
৬০৬ খ্রিস্টাব্দের আগেই শশাঙ্ক একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শশাঙ্ক দক্ষিণে দণ্ডভূতি অর্থাৎ মেদিনীপুর জেলা উৎকল ও গঞ্জাম জেলায় অবস্থিত কোদন্ড রাজ্য জয় করেন। শৈলোৎভব বংশের রাজারা তার অধীনে সামন্তরূপে কোদন্ড শাসন করতেন। পশ্চিমে মগদ রাজ্য শশাঙ্ক জয় করেন। দক্ষিণবঙ্গের রাজ্য গুলি শশাঙ্কের অধীনতা স্বীকার করেন। কামরূপের রাজা সুস্থিতবর্মনের মৃত্যুর অবহিত পড়েই তার দুই পুত্র সুপ্রতিষ্ঠিত বর্মন ও ভাস্কর বর্মন গৌড় সৈন্যের হাতে পরাজিত ও বন্দি হন। তাঁরা কিছুকাল পরেই মুক্তি লাভ করেন।
যে গৌড় রাজার সৈন্য কামরূপ রাজকে বন্দি করেছিল,তিনি কে তা ঠিক বলা যায় না। কেউ বলেন তিনি পূর্বোক্ত মহাসেন গুপ্ত আবার কেউ বলেন শশাঙ্কই এই বিজয়ী গৌড় রাজা।
শশাঙ্কের পূর্বে আর কোনো বাঙালি রাজা এইরূপ বিস্তৃত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন বলিয়া জানা নাই। কিন্তু শশাঙ্ক ইহাতেই সন্তুষ্ট হন নাই। তিনি গৌড়ের চিরশত্রু মৌখরিদিগকে দমন করিতে কৃতসংকল্প হইলেন। কান্যকুজের মৌখরিরাজ গ্রহবর্মা পরাক্রান্ত স্থাথ্বীশ্বরের (থানেশ্বর) রাজা প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। কামরূপরাজ ভাস্করবর্মাও শশাঙ্কের ভয়ে থানেশ্বররাজের সহিত মিত্রতা স্থাপন করেন। শশাঙ্ক এই দুই মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্য মালবরাজ দেবগুপ্তের সহিত সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হন।
এই দুই দলের মধ্যে যুদ্ধের কারণ এবং যুদ্ধের প্রথম ভাগের বিবরণ নিশ্চিত জানা যায় না। শশাঙ্ক সম্ভবত প্রথমে বারাণসী অধিকার করে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হন এবং দেবগুপ্তও মালব থেকে সসৈন্যে কান্যকুব্জ (কনৌজ) যাত্রা করেন।
শশাঙ্ক সম্ভবত প্রথমে বারাণসী অধিকার করিয়া পশ্চিম দিকে অগ্রসর হন এবং দেবগুপ্তও মালন হইতে সসৈন্যে কান্যকুব্জ (কনৌজ) যাত্রা করেন। এর পরবর্তী ঘটনা সম্বন্ধে সমসাময়িক হর্ষচরিত গ্রন্থে নিম্নলিখিত বিবরণ পাওয়া যায়:
“থানেশ্বররাজ প্রভাকর বর্ধনের মৃত্যুর পর তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র রাজ্যবর্ধন সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। এমন সময় কান্যকুব্জ হইতে দূত আসিয়া সংবাদ দিল যে, মালবের রাজা কান্যকুব্জরাজ গ্রহবর্মাকে যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত করিয়া রাণী রাজ্যশ্রীকে কারারুদ্ধ করিয়াছেন, এবং থানেশ্বর আক্রমণের উদ্যোগ করিতেছেন। এই নিদারুণ সংবাদ শুনিয়া রাজ্যবর্ধন কনিষ্ঠ ভ্রাতা হর্ষবর্ধনের উপর রাজ্যভার ন্যস্ত করিয়া অবিলম্বে মাত্র দশ সহস্র অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া ভগিনীর উদ্ধারের নিমিত্ত অগ্রসর হইলেন। পথে মালবরাজের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয়। তিনি মালবরাজকে পরাজিত এবং তাঁহার বহু সৈন্য বন্দি করিয়া থানেশ্বরে প্রেরণ করিলেন। কিন্তু কান্যকুজে পৌঁছিবার পূর্বেই শশাঙ্কের হস্তে তাঁহার মৃত্যু হয়।”
হর্ষচরিতের বিভিন্ন স্থানে এই ঘটনার যেরূপ উল্লেখ আছে তাতে মনে হয়, দেবগুপ্ত কান্যকুব্জ জয় করেই শশাঙ্কের জন্য অপেক্ষা না করে থানেশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন।
শশাঙ্ক কান্যকুজে পৌঁছে এই সংবাদ শুনে দেবগুপ্তের সাহায্যে এগিয়ে যান। কিন্তু এই দুই মিত্রশক্তি মিলিত হবার আগেই রাজ্যবর্ধন দেবগুপ্তকে পরাস্ত ও নিহত করেন। দেবগুপ্তের মত রাজ্যবর্ধনও মহা আনন্দে চরম বিপদের আশঙ্কা না করে নিজের ক্ষুদ্র সৈন্যদলের কিছু অংশ বন্দি মালবসৈন্যের সাথে থানেশ্বরে পাঠান এবং অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে কান্যকুব্জের দিকে অগ্রসর হন। সম্ভবত পথে শশাঙ্কের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয় এবং তিনি পরাস্ত ও নিহত হন।
শশাঙ্ক কর্তৃক রাজ্যবর্ধনের হত্যার কথা জানা যায় তিনটি বিভিন্ন সূত্রে । হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্টের হর্ষচরিত গ্রন্থ, হর্ষবর্ধনের পরম বন্ধু চীন দেশীয় পরিব্রাজক হিউয়েন সাং- এর কাহিনি এবং হর্ষবর্ধনের শিলালিপি। বাণভট্ট লিখেছেন যে, ‘মিথ্যা উপচারে আশ্বস্ত হইয়া নিরস্ত্র রাজ্যবর্ধন একাকী শশাঙ্কের ভবনে গমন করেন এবং তৎকর্তৃক নিহত হন।’ রাজ্যবর্ধন কেন যে এরকম অসহায় অবস্থায় শত্রুর হাতে আত্মসমর্পণ করলেন বাণভট্ট সে-সম্বন্ধে একেবারে নীরব।
হিউয়েন সাং বলেন, ‘শশাঙ্ক বারবার তাঁর মন্ত্রীগণকে বলতেন যে, সীমান্ত রাজ্যে রাজ্যবর্ধনের মত ধার্মিক রাজা থাকলে নিজ রাজ্যের কল্যাণ নাই। এই কথা শুনিয়া শশাঙ্কের মন্ত্রীগণ রাজ্যবর্ধনকে একটি সভায় আমন্ত্রণ করিয়া তাঁহাকে হত্যা করেন।’ হিউয়েন সাং-এর এই উক্তি কোনোমতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ রাজ্যবর্ধন সিংহাসনে বসেই যুদ্ধযাত্রা করেন। তিনি ধার্মিক বা অধার্মিক তা বিচার করবার অথবা এ বিষয়ে বারবার মন্ত্রীগণকে বলার সুযোগ বা সম্ভাবনা শশাঙ্কের ছিল না। অন্যত্র হিউয়েন সাং লিখেছেন, ‘রাজ্যবর্ধনের মন্ত্রীগণের দোষেই রাজ্যবর্ধন শত্রুহস্তে নিহত হইয়াছেন, মন্ত্রীরাই ইহার জন্য দায়ী।’বাণভট্টের করা উক্তির সাথে এর কোন মিল নেই।
হর্ষবর্ধনের শিলালিপিতে রয়েছে যে,’ সত্যানুরোধে রাজ্যবর্ধন শত্রুভবনে প্রাণত্যাগ করিয়াছিলেন।’ এখানে শশাঙ্কের বিশ্বাসঘাতকতার কোনো ইঙ্গিত নাই।
তিনটি সমসাময়িক বিবরণে একই ঘটনা সম্বন্ধে এই এরকম পরস্পর বিরোধিতা দেখলে স্বাভাবিকভাবেই তাহার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ জন্মায়। তাাছাড়া এটিও বাস্তব যে, বাণভট্ট ও হিউয়েন সাং উভয়েই শশাঙ্কের পরম বিদ্বেষী।
বানভট্ট শশাঙ্ককে গৌরধাম গৌরভুজঙ্গ ইত্যাদি বিশেষনে ভূষিত করেছিলেন। হিউয়েন সাং শশাঙ্কের বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অত্যাচারের বহু দৃষ্টান্ত দিয়েছেন।যেমন-
১)কুশীনগর বৌদ্ধবিহার থেকে বৌদ্ধদেরকে তাড়িয়ে বৌদ্ধ ধর্ম সমূলে ধ্বংস করা।
২)পাটলিপুত্র বুদ্ধের পদচিহ্ন অঙ্কিত একখানি প্রস্তর খন্ড গঙ্গা জলে ফেলে দেওয়া।
৩)গয়ার বুদ্ধ কেটে মাটি খুঁড়ে তার শিকড় গুলি কেটে যা বাকি ছিল তা পোড়ানো।
৪) একটি বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস করার ব্যর্থ চেষ্টার ফলে শশাঙ্কের সমস্ত শরীর ক্ষত হয়ে পচে যাওয়ায় শশাঙ্কের মৃত্যু।
এক্ষেত্রে বলা আবশ্যক যে হিউয়েন সাং নিজে যখন শশাঙ্কর রাজধানী কর্ণসুবর্ণে গিয়েছিলেন তখন সেখানে অথবা সেই রাজ্যে দশটি বৌদ্ধ বিহার এবং ১০,০০০বৌদ্ধ ভিক্ষু বাস করতেন। সুতরাং কেবলমাত্র এই দুইজনের উক্তির উপর নির্ভর করে শশাঙ্ক বিশ্বাসঘাতকতা করে রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করেছিলেন এই মত গ্রহণ করা সঠিক নয়।৭
হিউয়েন সাঙের বিবরণীতে কর্ণসুবর্ণ মহানগরী:
কালের আবর্তে ধীরে ধীরে কর্ণসুবর্ণ মহানগরী জনমানসের বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেলেও তা রয়ে গিয়েছে চীনা পরিব্রাজক হিউ.এন সাঙের ভ্রমণ বৃত্তান্ত ‘সি-ইউ-কি’র পাতায়। থানেশ্বর রাজ হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে হিউ.এন সাঙ ৬২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে এসেছিলেন বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে। তিনি দীর্ঘ ১৬ বছর বৌদ্ধ ধর্ম ও বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান ও ভ্রমণ করে ৬৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন চীনা ভাষায় লিখিত তাঁর ভ্রমণকাহিনী সি.ইউ.কি থেকে জানা যায়, চৈনিক পরিব্রাজক তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে ‘কি-এ-লো-ন-সু-ফা-ল’ বা কর্ণসুবর্ণ নগরীতে আসেন। তিনি স্বচক্ষে কর্ণসুবর্ণ রাজ্যের জনগণের পর্যবেক্ষণ করেন এবং পরে তা লিপিবদ্ধ করেন। তিনি বলেছেন, রাজধানী-নগরী ছিল ঘন বসতিপূর্ণ, সাধারণ মানুষের জীবন ছিল স্বচ্ছল। জমি ছিল উর্ব্বর ও নানা প্রকার কৃষিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। জলবায়ু ছিল মনোরম ও স্বাস্থ্যপ্রদ। অধিবাসীরা ছিল সভ্য-ভদ্র ও শিক্ষানুরাগী। নগরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সহ অপরাপর ধর্মের অনেক লোক বাস করত। কর্ণসুবর্ণ নগরীর উপকণ্ঠে রক্তমৃত্তিকা (লো-টো-মো-চি বা লো-টো-বি তি) মহাবিহারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। হিউ-এন সাঙ
কর্ণসুবর্ণ নগরীর উপকণ্ঠে অশোক নির্মিত স্তূপের কথাও উল্লেখ করেছেন। এখানকার বৌদ্ধসন্ন্যাসীদের কাছ থেকে জেনেছেন, জীবদ্দশায় ভগবান বুদ্ধ এখানে সাতদিন অবস্থান করে ধর্মপ্রচার করেছিলেন। তাই বুদ্ধের স্মৃতি অনুসরণ করে রাজা অশোক এখানে স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন।৮
ড. পুষ্পা নিয়োগী Buddhism in Ancient Bengal গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “In the neighbourhood (of the capital city of Karnasuvarna) there were many stupas supposed to have been built by King Ashoka. Here also Buddha preached the low for seven days.”৯
বঙ্গদেশের প্রথম সার্বভৌম নৃপতি শশাঙ্কের জন্ম ও মৃত্যু সম্পর্কিত ইতিবৃত্ত আজও অন্ধকারময়।তবে একথা বলা যায় বঙ্গদেশের সর্বপ্রথম সার্বভৌম নৃপতি মহারাজাধিরাজ শশাঙ্ক ৬২৯ থেকে ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোন এক সময় দেহত্যাগ করেন।১০
শশাঙ্ক পরবর্তী কর্ণসুবর্ণ:
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর কর্ণসুবর্ণ কামরূপ রাজ ভাস্কর বর্মার অধীনে সম্ভবত হর্ষবর্ধন যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন পর্যন্ত শাসিত হয়েছিল। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর (৬৪৭ খ্রি.) পর সম্ভবতঃ শশাঙ্কের পুত্র মানবদেব কর্ণসুবর্ণ রাজ্য পুনরুদ্ধারের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। মানবদেবের পরে জয়নাগ নামে এক রাজার পরিচয় পাওয়া যায়। যিনি স্বল্পকাল কর্ণসুবর্ণাধিপতি হয়েছিলেন। কামরূপরাজ ভাস্কর বর্মার মৃত্যুর পর সম্ভবতঃ তিব্বতরাজ শ্রোেণ স্যান গাম্ পো (Sron-bstan-sham-po) আসাম ও ভাস্কর বর্মা কর্তৃক বিজিত কর্ণসুবর্ণ রাজ্যের এক বিরাট অংশ অধিকার করে নেন, আনুমানিক ৭০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কর্ণসুবর্ণ রাজ্য তিব্বতের অধীনস্থ ছিল। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর শক্তিশালী কোনো বাঙালি নরপতির উত্থান গোপালের আগে আর ঘটেনি। ফলে একাধিকবার কর্ণসুবর্ণ শত্রু শক্তির কবলে পতিত হয়েছিল। যথাক্রমে উড়িষ্যার শৈলবংশ, কনৌজের যশোবর্মণ ও পরে কাশীর রাজ ললিতাদিত্য কর্তৃক কর্ণসুবর্ণ রাজ্য বিজিত ও শাসিত হয়েছিল। কলহনের রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থেও এই ইঙ্গিত পাওয়া যায়।১১
কর্ণসুবর্ণের বাণিজ্য :-
বর্ষা ঋতুতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা যে স্থানে অবস্থান করতেন তাকে বলা হতো ‘আবাস’। এই আবাসগুলি ক্রমে বৌদ্ধসঙ্ঘারামে পর্যবসিত হয়। বর্ষা ঋতুতে বন্যার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য সুউচ্চভূমি খন্ডগুলির উপর নির্মিত হতো ‘আবাস’। মুর্শিদাবাদের রাঙা এলাকায় অবস্থিত রাঙামাটি অঞ্চলে উচ্চভূমি খণ্ডে সাধারণভাবে তৈরি সঙ্ঘারাম কালক্রমে ঐতিহ্যমণ্ডিত ও জাঁকজমকপূর্ণ মহাসৌধে পরিণত হয়েছিল বলে অনুমান করা যায়। বণিকদের সমাবেশ ও বৈভব, ধর্মপ্রচারকদের আগমন, শিক্ষা সংস্কৃতির চর্চা, ব্যাপক বসতি নির্মাণ, কারিগরদের সমাগম রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। ফলে কালক্রমে এই ধরণের নদী তীরে গড়ে ওঠা বাণিজ্যকেন্দ্র রাজধানী নগরে পরিণত হয়েছিল। রাজধানী শহর কর্ণসুবর্ণ মহানগরীতে বৌদ্ধ স্তূপ ও সঙ্ঘারাম গড়ে ওঠার পশ্চাতে নিশ্চয় বাণিজ্য নগরী কর্ণসুবর্ণের অবদান ছিল অনেকখানি।
এ বিষয়ে ড. দেবলা মিত্র উল্লেখ করেছেন, “The choice invariably fell on a site which fulfilled the two conditions required for an ideal monastic life, namely, proximity to a habitation where the monks could go on their begging round and at the same time a seclu- sion ensuring a proper atmosphere to meditation.”১২
পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত মঙ্গলকাব্যগুলি থেকে জানা যায় কর্ণসুবর্ণ নগরীর রাজনৈতিক গরিমা ঐ সময় লুপ্ত হয়ে গেলেও এর বাণিজ্যিক প্রখ্যাতি একেবারে বিনষ্ট হয়ে যায়নি। কর্ণসুবর্ণ নগরীর অকুস্থলে চাঁদপাড়া গ্রাম এখনও চাঁদ সওদাগরের স্মৃতি বহন করে চলেছে। কর্ণসুবর্ণের অদূরে পরবর্তীকালে গড়ে উঠেছিল উজানী রাজ্য ভাগীরথী অজয়ের সঙ্গম স্থলে কাটোয়া-কেতুগ্রাম অঞ্চলে। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের ধনপতি সওদাগরের নিবাস ছিল উজানী রাজ্যের অন্তর্গত গোলাহাট গ্রামে, একথা অনেক আধুনিক গবেষক বিশ্বাস করেন। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্য থেকে জানা যায় উজানী রাজ্যের রাজা বিক্রমকেশরীর অনুমতি নিয়ে দনপতি সওদাগর ও পরে তাঁর পুত্র শ্রীমন্ত সওদাগর সুদূর সিংহলে বাণিজ্যযাত্রা করেছিলেন। ধনপতি সওদাগরের একটি বাণিজ্য তরণী সুবর্ণ নগরে প্রস্তুত হয়েছিল বলে চণ্ডীমঙ্গলে উল্লেখিত হয়েছে।
“প্রথমে তুলিলা ডিঙ্গা নামেন মধুকর।
সুদুই সুবর্ণে যাহার রই ঘর।”- ১৩
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সিংহল যে এক গুরুত্বপূর্ণ দেশ ছিল, মঙ্গলকাব্যগুলিতে তাঁর প্রমাণ সুনিশ্চিত। কর্ণসুবর্ণ নগরের সঙ্গে সিংহলের সুসম্পর্কের কথা কিংবদন্তীরূপে আজও লোকমুখে প্রচারিত। কোনো এক অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে সিংহলরাজ আমন্ত্রিত হয়ে কর্ণসুবর্ণ নগরে এলে তিনি স্বর্ণ বৃষ্টি করেছিলেন নগরীর রাজপথে, ড. সুধীর রঞ্জন দাস তাঁর “কর্ণসুবর্ণ মহানগরী’ গ্রন্থে এই কিংবদন্তীর কথা উল্লেখ করেছেন। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে গোলাহাট গ্রামে পাটন বিল, ভান্ডার দহের বিল প্রভৃতির নাম পাওয়া যায়। এই সকল স্থান কর্ণসুবর্ণ নগরীর আশেপাশেই অবস্থিত। মঙ্গলকাব্যের উল্লিখিত ‘কর্ণপুর’ নাম থেকে অনুমান করা যেতে পারে এই সময় কর্ণসুবর্ণ একেবারেই অখ্যাত স্থান ছিল না।
“রত্নময় কর্ণপুর তিমির কর এ দূর অচঞ্চলা বিজুলি কপালে”১৪
কর্সুবর্ণ মহানগরীর সন্নিকটে সালার বা (সালিবাহন বিহার-সালার) সালিবাহন-বিহার সিংহল রাজ সালিবাহনের কথা মনে করিয়ে দেয়। মঙ্গলকাব্যের সিংহলরাজ সালিবান / সালিবাহন ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। শেষমেশ সিংহলে বাণিজ্য করতে গিয়ে সমুদ্রপথে ‘কমলে-কামিনী’ দৃশ্য না দেখাতে পারায় পিতাপুত্র (ধনপতি ও শ্রীমন্ত) সিংহল রাজ্যের ক্রোধের শিকার হন ও বন্দী হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। পরে দেবীচণ্ডীর কৃপা লাভ করে বৌদ্ধরাজের অনুকম্পা লাভে সমর্থ হয়ে সুমাত্রার শৈলেন্দ্রবংশীয় রাজা বালপুত্রদেব যেমন নালন্দায় পাল সম্রাট দেবপালের আমলে বৌদ্ধমঠ নির্মাণ করে থাকতে পারেন। অবশ্য সালারে বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের সঙ্গে সালিবাহন ছাড়া মৌর্য বংশীয় রাজ্য সালিসুখ রাজাও জড়িত থাকতে পারেন, এ বিষয়ে যে আরও বিস্তৃত গবেষণার প্রয়োজন। একদা কর্ণসুবর্ণ নগরের রাজপথে উক্ত বৌদ্ধরাজের আগমন ও এই উপলক্ষে ‘স্বর্ণবৃষ্টি’র ঘটনা খুব অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয় না। আধুনিক সালারে এখনও রয়েছে বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ। উক্ত স্থান থেকে আজও খুঁজে পাওয়া যায় অনেক বৌদ্ধমূর্তি।
চাঁদ সওদাগর, ধনপতি-শ্রীমন্তের পূর্বসূরী বণিকগণ একদা সমগ্র দক্ষিণপূর্ব এশিয়া (দূর-প্রাচ্য), মিশর, গ্রীস, রোম, মধ্য দ্রশিয়া প্রভৃতি দেশে জলপথে ও স্থলপথে বাণিজ্য যাত্রা করতেন। মহাউন্মার্গজাতক প্রভৃতি জাতক গ্রন্থগুলিতে সমুদ্রযাত্রা ও বাণিজ্যের বিস্তৃত পরিচয় পাওয়া যায়। কর্ণসুবর্ণ মহানগরী গঠনের পশ্চাতে শ্রেষ্ঠী সম্প্রদায়ের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে কর্ণসুবর্ণ যে সুদীর্ঘকাল (আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত) প্রসিদ্ধ ছিল তা মঙ্গলকাব্য ও সমসাময়িক সূত্র থেকে পরিষ্কার ও প্রমাণিত।১৫
মহাভারত ও কর্ণসুবর্ণ মহানগরী:
কর্ণসুবর্ণ নগরের উত্থান যে মৌর্যযুগের পূর্বে ঘটেছিল এই প্রবন্ধে আলোচনা সূত্রপাতে তা উল্লিখিত হয়েছে। বিশেষ করে ভৌগোলিক ও বাণিজ্যিক কারণেই খরস্রোতা ও নাব্যতা সম্পন্ন নদীর তীরে বাণিজ্য নগরী গড়ে ওঠা খুবই সঙ্গত। কিংবদন্তী, প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ও মহাকাব্যগুলি বিশেষ করে মহাভারত বর্ণিত কাহিনীর অন্তরালে লুকিয়ে থাকা ইতিহাস খুঁজে বের করতে পারলে কর্ণসুবর্ণ নগরীর প্রাচীনত্ব ও এর ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। মানব সমাজের ইতিহাসে সভ্যতার অবিচ্ছিন্নতাকে অস্বীকার করা যায় না। প্রথমে কর্ণও পরে ভীম কর্তৃক রাঙা বাংলার এতদঞ্চল বিজিত হওয়ায় কাহিনী যুক্তি তর্কের নিরিখে অসম্ভব নয়। অঙ্গাধিপতি কর্ণের অন্তর্গত কর্ণসুবর্ণ নগরীতে রাজধানীর পত্তন খুব অসম্ভব ধারণা নয়। ১৬
এই প্রকার কিংবদন্তীমূলক তথ্যের সন্ধান দেববংশের কুলজী-পঞ্জিকার বর্ণনাতেও পাওয়া যায়। ময়মনসিংহ জেলা থেকে উদ্ধৃত এবং নগেন্দ্রনাথ বসু (১৯১২) কর্তৃক সংকলিত বটুভট্টের দেববংশের কুলগ্রন্থ থেকে জানা যায়:-
“কর্ণ সৈন্যা এতে দেবাঃ খ্যাতিবন্তো মহীতলে।
হরিদ্বারাদাগতাস্তে স্থিতবস্তো মগধেষ্ণু। ক্ষত্রপ কায়স্থা দ্বিজাঃ ক্ষত্রিয়কুল সম্ভবাঃ ॥
আসীন্দ্রাজা দাতাকর্ণঃ খ্যাতিবাংশ্চ মহীতলে।
কর্ণ সেননামধেয়ঃ কর্ণপুরস্য ভূপতিঃ ॥
ক্ষত্রপঃ কায়স্থো রাজা মহাসুরো মহাবলী। কর্ণ’স্বর্ণ’রাজ্যস্থাতা উক্তণ্ড ভারতে যথা ॥ কর্ণভাগীরথী সন্ধিঃ নয়নরঞ্জনশ্চ হি।
যত্র কর্ণপুরংরাজা নিম্নমে বহুকৌশলৈঃ” ॥
দেববংশ কর্ণসেনবংশীয় ছিল। সুতরাং দেববংশকে ‘কর্ণ’সেণ্য’ বা কর্ণ সেনীয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। দেববংশের পূর্বপুরুষ হরিদ্বার থেকে এসে মগধে বাস করেছিলেন। তাঁরাই ক্ষত্রপ-কায়স্থ নামে খ্যাত। দাতাকর্ণ নামে পরিচিত কর্ণসেন কর্ণপুরের রাজা ছিলেন। এই কর্ণ’রাজই ভাগীরথীর সন্ধিস্থলে বহুকৌশলে কর্ণপুর-নগর নির্মাণ করেন। স্বর্ণপুরী-মহানগরী রাজপ্রাসাদ ও সুদৃশ্য অট্টালিকা দ্বারা শোভিত ছিল। নাগরিকরা মহাসুখে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করত। তাঁদের রক্ষার জন্য সৈন্যসামন্তগণ সর্বদাই নিযুক্ত থাকত। তাঁদের কোন শত্রু ছিলনা। উপরি-উক্ত কুলজী-সংকলনে কর্ণপুরের নাম কর্ণসুবর্ণে পরিবর্তিত হবার কারণও লিখিত আছে:-
“দেবাংশেন কর্ণ পতেঃ কুমারো জাতবানসৌ বৃষকেতুরিতি নামা প্রসিদ্ধশ্চ হি ভারতে ॥ শুভান্নপ্রাশনাদীনাগতাংশ ততঃপরং।
তস্মাদবভবত্তত্র হেমবৃষ্টিঃ সুরলোকাৎ।
পর্যায়ক্রমেন রাজা দেবাংশ বিভক্তবান ॥”
বিভীষণো লঙ্কেশ্বরো যথাগতো মহাকৃতিঃ ॥
অথ কর্ণ’স্বর্ণ’নামা রাজ্যশ্চ বভূব চেতি ॥
অনুজ্ঞয়া দেবাঃ সর্ব্বে’ কর্ণপুরে সমবেতাঃ।
এই কর্ণ বংশে বৃষকেতু নামে এক রাজপুত্র জন্মগ্রহণ করে। রাজপুত্রের অন্নপ্রাশন-উৎসবে যোগদানের জন্য লঙ্কার রাজা বিভীষণ আমন্ত্রিত হন। আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বিভীষণ কর্ণপুরে আগমন করলে স্বর্ণবৃষ্টি হয়। সেই সময় থেকেই কর্ণপুর কর্ণসুবর্ণ বা কর্ণ’স্বর্ণ’ নামে খ্যাত হয়। দেব-উপাধি- ধারী সকল কায়স্থগণ এই মহানগরীতে এসে বসবাস করতে থাকে এবং তারাই কর্ণ’স্বর্ণ বা কানসোনার দেববংশ নামে খ্যাত হয়। কুলপঞ্জিকায় লিখিত আছে যে, শাণ্ডিল্যগোত্রভুক্ত দেববংশজাত কায়স্থগণ অঙ্গ ও বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে রাজ্য স্থাপন করেছিল। ভাগলপুরের কিংবদন্তী এবং কুলজী-গ্রন্থের কাহিনীর তথ্যানুসারে প্রমাণিত হয় যে, কর্ণপুরীই কর্ণ’স্বর্ণ ও কর্ণসুবর্ণ’ নামে খ্যাত ছিল।১৭
আধুনিক সমীক্ষা:
ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে প্রাচ্য সভ্যতা সম্পর্কে ইংরাজ সরকার ও দেশীয় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা বাড়লে কর্ণসুবর্ণ নগরী ও তার রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের প্রকৃত ভৌগোলিক অবস্থান জানার চেষ্টা করা হয়। ১৮০৭ খ্রি. উইলফোর্ড ভীমকিতলা – যমুনাতল’ এলাকার উচ্চ ঢিবিগুলিতে প্রচুর সংখ্যায় বেলে পাথর নির্মিত খিলান, প্রস্তর খন্ড ও বহু প্রত্নবস্তু দেখতে পেয়েছিলেন। ১৮৩৮ খ্রি. মার্টিন, ১৮৭৩ খ্রি. কানিংহাম সাহেবও কর্ণসুবর্ণের প্রকৃত অবস্থান বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন। ১৮৬৩ খ্রি. লেয়ার্ড সাহেব তাঁর একটি প্রবন্ধ “The ancient city of Kansonapuri now called Rangamati” তে দৃঢ়তার সঙ্গে কর্ণসুবর্ণ নগরীর অবস্থান মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙামাটি অঞ্চলেই যে ছিল তা ব্যক্ত করেন। লেয়ার্ড সাহেব রাজবাড়ি ডাঙার পূর্বে বর্তমান যদুপুর গ্রামে একটি বুরুজ ও একটি তোরণের যে ধ্বংসাবশেষ দেখেছিলেন তা আজ সম্পূর্ণ অপসারিত। ১৮৯৩ খ্রি. বেভারিজ সাহেব লেয়ার্ডের মতকে গ্রহণ করে বলেন, কর্ণসুবর্ণ সম্পর্কে হিউ.এন. সাঙ এর সি.ইউ.কি-র বর্ণনাই যথার্থ। তাঁর মতে রক্তাভ মৃত্তিকা থেকে রক্তমৃত্তিকা বা রাঙামাটি নামের উৎপত্তি। এই রাঙামাটি অঞ্চল পূর্বে কানসোনা বা কর্ণবোনাগড় বা কর্ণগড় নামে খ্যাত ছিল। আজও স্থানীয় অধিবাসীরা এতদঞ্চলকে কর্ণরাজার রাজধানী বলে মনে করে। স্থানীয় ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়, কমল বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যরঞ্জন বক্সী প্রভৃতি গুণী ইতিহাসপ্রেমী পণ্ডিতগণ উপরোক্ত মতকে গ্রহণ করেছেন। কষ্টিপাথরে যাচাই না করে স্বর্ণকার যেমন সোনার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হন না, তেমনি ঐতিহাসিকেরা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন।
হিউ.এন.সাঙ খ্যাত রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার, অশোকের স্তূপ ও কর্ণসুবর্ণের রাজধানী নগরের অস্তিত্ব দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করার জন্য প্রয়োজন ছিল ব্যাপক উৎখননের। ১৯৬০-৬১ খ্রি. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের প্রতিষ্ঠা হলে এই. উৎখননের দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসেন পণ্ডিত প্রবর শ্রী সুধীর রঞ্জন দাস। বিভাগীয় প্রধান ইউ.জি.সি প্রদত্ত সামান্য অনুদান ও একদল তরুণ উৎসাহী ছাত্রদের নিয়ে কর্ণসুবর্ণ এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ক্ষুদ্র একটি অঞ্চল ‘রাজবাড়ি ডাঙা’র সীমিত জায়গায় প্রাথমিকভাবে খননকার্য শুরু করেছিলেন। খননকার্য শুরু করে তিনি অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেন। ১৮
১৯৬২ খ্রি. তিনি “Rajbadidanga-1962” নামক একটি গ্রন্থে উক্ত খনন কার্যের বিস্তৃত বিবরণ দেন। যথা –
১। রাজবাড়ি ডাঙাতে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন সময়ে সভ্যতার বিস্তার হয়েছে, যা অনুমান দ্বিতীয় তৃতীয় শতক থেকে আরম্ভ হয়ে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত চলেছিল।
২। তিনটি পৃথক সত্তায় সভ্যতার বিস্তার ঘটেছিল।
৩। একটি সভ্যতা / বসতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংস হলে পরবর্তী সভ্যতা বা বসতি ধ্বংসস্তূপের উপর পুনরায় নতুন ভাবে গড়ে উঠেছিল।
8।পাঁচটি পর্যায়ে উপরোক্তভাবে বসতির জন্য নির্মাণকার্য গড়ে উঠেছিল।
৫।বৌদ্ধবিহারের ধাঁচে নির্মাণ গড়ে উঠেছিল।
৬।প্রত্নবস্তুগুলির সঙ্গে বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিল যথেষ্ট রয়েছে।
৭।সভ্যতার দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার গড়ে উঠেছিল।
ড. সুধীর রঞ্জন দাস এইভাবে সমাপ্ত করেছেন, “That all the testimony of Hiuen Tsangs accounts, it has now become possible to fix the hitherto undermined present geographical location of Karnasuvarna. On the strength of the seal inscription and other records it may be affirmed that
the famous capital city of Karnasuvarna stood in the neighbourhood of the excavated site of ‘Rajbadidanga’. Thus on circumstantial evidance the present location of Karnasuvarna stands confirmed.”
তিনি আরও বলেছেন, “More and more diggings at this remarkable site of Rajbaridanga will certainly remove the thick fog that enve- lopes the early history of Bengal, and thereby open a new chapter of Bengal’s. say of Indian’s glorious past” ১৯
ড. সুধীর রঞ্জন দাস উপরোক্ত খনন কার্যের দ্বারা রাজবাড়ি ভাঙার প্রত্নভূমিতে পরপর পাঁচটি পৃথক বসতির স্তর খুঁজে পেয়েছেন। খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুগুলির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দ্বারা প্রাপ্ত সভ্যতার কালকে প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা:-
প্রথম স্তর-
দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দী থেকে চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দী
দ্বিতীয় স্তর-
পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে নবম-দশম শতাব্দী
তৃতীয় স্তর-
নবম-দশম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী
প্রত্নভূমি থেকে প্রাপ্ত সিলমোহর পাঠোদ্ধার করে ড.দাস নিঃসন্দেহ হয়েছেন মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙামাটি ও রাঙামাটি সংলগ্ন অঞ্চলই হলো হিউয়েন সাঙ বর্ণিত কর্ণসুবর্ণ রাজ্যের রাজধানী মহানগর যার অধিকাংশ আজ ভাগীরথী গর্ভে বিলীন হয়ে থাকবে। আর রাজবাড়ি ডাঙায় উৎখনিত স্থানেই ছিল সেই হিউয়েন সাঙ কথিত রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার যার আশীর্বাদ নিয়ে চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীতে মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের শুরু হয়েছিল সুদূর মালয়েশিয়ায় সমুদ্রপথে বাণিজ্যযাত্রা।২০
তথ্যসূত্র -:
১।কর্ণসুবর্ণ মহা নগরী, সুধীর রঞ্জন দাস, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ।
২। বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রথম খন্ড, প্রাচীন যুগ,ড:রমেশ চন্দ্র মজুমদার।
৩।কর্ণসুবর্ণ মহানগরী, ড: সুধীর রঞ্জন দাস।
৪।ঐ।
৫।Early History of Mordern India, sudhakar Chattopadhyay.
৬।কর্ণসুবর্ণ মহানগরী, ড: সুধীর রঞ্জন দাস, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ।
৭।বাংলা দেশের ইতিহাস, প্রথম খন্ড, ড.রমেশ চন্দ্র মজুমদার।
৮। বিস্মৃত মহানগরী কর্ণসুবর্ণ, গুরুপদ বায়েন,মুর্শিদাবাদ অনুসন্ধান, তৃতীয় খন্ড।সম্পাদনা-অরিন্দম রায়।
৯।ড.পুষ্পা নিয়োগী-Buddhism in Ancient Bengal.
১০। বিস্মৃত মহানগরী কর্ণসুবর্ণ, গুরুপদ বায়েন,মুর্শিদাবাদ অনুসন্ধান, তৃতীয় খন্ড, সম্পাদনা- অরিন্দম রায়।
১১। ঐ।
১২। ড.দেবলা মিত্র, Buddhist monuments.
১৩। চণ্ডীমঙ্গল, সম্পাদনা সুকুমার সেন, পৃষ্ঠা ১৯৫।
১৪। চণ্ডীমঙ্গল, সুকুমার সেন সম্পাদিত পৃ. ১৫৪।
১৫। বিস্মৃত মহানগরী কর্ণসুবর্ণ, গুরুপদ বায়েন,মুর্শিদাবাদ অনুসন্ধান, তৃতীয় খন্ড।
১৬।বিস্মৃত মহানগরী কর্ণসুবর্ণ, গুরুপদ বায়েন,মুর্শিদাবাদ অনুসন্ধান, তৃতীয় খন্ড।
১৭। কর্ণসুবর্ণ মহানগরী, ড. সুধীর রঞ্জন দাস, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ।
১৮।বিস্মৃত মহানগরী কর্ণসুবর্ণ, গুরুপদ বায়েন,মুর্শিদাবাদ অনুসন্ধান, তৃতীয় খন্ড।
১৯। Rajbaridanga 1962, ড.সুধীর রঞ্জন দাস।
২০। বিস্মৃত মহানগরী কর্ণসুবর্ণ, গুরুপদ বায়েন,মুর্শিদাবাদ অনুসন্ধান, তৃতীয় খন্ড।
(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)