বাংলাদেশের ইতিহাসে মুর্শিদাবাদ একটি বিশেষ স্থান। এই জেলার বিশেষ স্থান পাওয়ার পেছনে একটি মূল কারণ হলো তার ভৌগোলিক অবস্থান।পুণ্যতোয়া ভাগীরথী এই জেলাকে প্রায় সমদ্বিখন্ডিত করে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত। ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে জাহ্নবীর এই শাখার ও তার উপনদীর অববাহিকার ভূমিকা অনস্বীকার্য। সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভাগীরথী ও ভাগীরথীর উপনদী গুলির অববাহিকায় বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায় এই জেলার ভূখণ্ডটি বিশেষ করে রাঢ় অঞ্চল ভারতের বিশেষত উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে এক সূত্রে বাঁধা ছিল। প্রাচীনকালে হিন্দু বৌদ্ধ ও পরবর্তীকালে মুসলমান এবং সবশেষে ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল এই জেলা।
তাই ইতিহাসের মূল ধারা থেকে কখনোই এই অঞ্চল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি।
এই জেলার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে প্রাক-আর্যকাল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ সময়কাল পর্যন্ত এক অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা বজায় ধরে রেখেছে এ জেলা।
মন্দিরগুলির বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে এই সত্য অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে।
আর্য সভ্যতার নিদর্শন এই জেলার রাঢ় অঞ্চলে প্রচুর। গুপ্ত ও পরবর্তী পাল-সেন আমলের অজস্র নিদর্শনও জেলার এখানে সেখানে যথেষ্ট সংখ্যায় বর্তমান। এই সুদীর্ঘ সময়ে অজস্র মন্দির, মঠ, বিহার, স্তুপ ও চৈত্য ব্যাপকভাবে যে এই অঞ্চলে নির্মিত হয়েছিল তার বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও লিপি প্রমাণ বর্তমান। ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে উত্তরে ফরাক্কা থেকে দক্ষিণে বনওয়ারিবাদ পর্যন্ত সর্বত্র বহু হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ও অজস্র হিন্দু ও বৌদ্ধ দেবদেবীর ভগ্ন ও অখণ্ড মূর্তি ইত্যাদি পাওয়া গেছে। এই সব নিদর্শন সুনিশ্চিত ভাবে দেখিয়ে দেয়, একদিন এই জেলার বিভিন্ন স্থানে বহু হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দির নির্মিত হয়েছিল।
পরবর্তীকালে মুসলমান আক্রমণকালে (১২০২ খ্রিস্টাব্দ) ও তার পরবর্তী সময়ে বিজয়ী মুসলমান বাহিনী বিধর্মী হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরগুলিকে ধ্বংস ও লুণ্ঠন করে। সেই ভয়াবহ দিনগুলিতে বাংলার অন্য অঞ্চলের সঙ্গে মুর্শিদাবাদও রেহাই পায়নি। এর পর বহুকাল এ দেশ মন্দির নির্মাণের সুষ্ঠ পরিবেশ পায়নি। এরপর চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দী নাগাদ দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতাবস্থা ফিরে এলে এবং তৎকালীন গৌড়ের মুসলমান শাসকদের পরধর্মসহিষ্ণুতা, রাজকার্যে উচ্চপদস্থ হিন্দু কর্মচারি নিয়োগ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা প্রভৃতি কারণে দেশে আবার শাস্তি ও নিরাপত্তা ফিরে আসে। উদার, জ্ঞানী ও পরমত সহিষ্ণু, সাহিত্যরসিক ও পৃষ্ঠপোষক গৌড়ের বাদশাহ আলাউদ্দীন হোসেন শাহের সময় (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে) এই নিরাপত্তার ভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন এবং তাঁর প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্মের বিপুল প্রসার নির্যাতিত ও ভীত সন্ত্রস্ত বাঙ্গালি হিন্দুর মনে একটি আত্মবিশ্বাস ও আত্মবিকাশের প্রেরণা সৃষ্টি করে। ফলে চৈতন্যপরবর্তী যুগে বাংলায় ব্যাপকভাবে হিন্দুমন্দির নির্মিত হতে থাকে। মুর্শিদাবাদ জেলাতেও এর অতিক্রম হয়নি।
সুলতানী আমলের পর মোগল আমলেও মুর্শিদাবাদ বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলরূপে পরিগণিত হয়। মোগল শাসনের প্রথমদিকেও অনেক মন্দির এই জেলায় নির্মিত হয়েছে। মোগল আমলের শেষ দিকে ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে মুর্শিদকুলী খাঁ তৎকালীন মুকসুদাবাদে’ ঢাকা থেকে রাজধানীর রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। ঔরঙ্গজেব ছিলেন গোঁড়া মুসলিম, অন্যদিকে মুর্শিদকুলী খাঁও তাই। সেই সময়কালে হিন্দু মন্দিরগুলোর ওপর উভয়েরই শ্যেনদৃষ্টি পড়েছিল – এরকম অপবাদ রয়েছে। পাশাপাশি বর্গী আক্রমন, লুণ্ঠনের ফলে মন্দির নির্মানের উপযুক্ত পরিস্থিতি ছিল না। এদিক থেকে দেখতে গেলে ব্যতিক্রমী স্থান ছিল কিরীটেশ্বরী।১
কিরীটেশ্বরী মুর্শিদাবাদের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন, পবিত্র ও বিখ্যাত দেবস্থান। ভাগিরথীর পশ্চিম পাড়ে মন্দির অধ্যুষিত গ্রাম হলো কিরীটেশ্বরী। যদিও এর প্রাচীন নাম কিরীটকণা। রাঢ় দেশের প্রাচীন দেবস্থান গুলির মধ্যে কিরীটকণা অন্যতম।২
ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী দক্ষযজ্ঞে মাতা সতীর দেহত্যাগের পর, প্রাণ পরিত্যাগ করিলে ভগবান্ বিষ্ণু তাঁর অঙ্গ প্রত্যঙ্গাদি খণ্ড বিখণ্ড করে নিক্ষেপ করেছিলেন, যে যে স্থানে সেগুলি পড়েছিল, সেই সেই স্থান মহাপীঠ নামে চিরপূজিত হয়ে আসছে। তান্ত্রিক মতে ৫১ স্থান উক্ত মহাপীঠ বলে প্রসিদ্ধ, কিরীটকণাও তাদের অন্যতম বলে উল্লিখিত। তন্ত্রচূডামণির মতে দেবীর কিরীটপাত হওয়ায় কিরীটকণা মহাপীঠরূপে পূজিত হয়ে আসছে।৩
দেবীর আসল নাম বিমল, ভৈরব সম্বর্ত।
“ভুবদেশী সিদ্ধিরূপা কিরীটস্থ। কিরীটতঃ। দেবতা বিমলানায়ী সম্বর্তো ভৈরবস্তথা।”৪
মহানীলতন্ত্রে কিরীটতীর্থের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে,
“কালীঘটে গুহ্যকালী কিরীটে চ মহেশ্বরী।
কিরীটেশ্বরী মহাদেবী লিঙ্গাখ্যে লিঙ্গবাহিনী।”৫
সেখানে দেবীও কিরীটেশ্বরী নামে অভিহিত হয়েছেন।
দেবীভাগবতের অন্তর্গত দেবীগীতায় কিরীটেশ্বরীর স্থানে মুকুটেশ্বরী লেখা আছে, এবং মাকোট তাঁর স্থান বলে উল্লিখিত রয়েছে ।
“কুরন্ডুলে ত্রিসন্ধ্যা স্যাম্মাকোটে মুকুটেশ্বরী।”৬
উক্ত মাকোট কিরীটতীর্থের নামান্তর কি না বোঝা যায় না, তবে যদি মুকুট থেকে এই নাম হয়ে থাকে, তাহলে তা কিরীটের নামান্তর বলেই অনুমেয়।
গুপ্ত সম্রাটগণ শক্তিউপাসক ছিলেন। গুপ্তযুগে আবিষ্কৃত মুদ্রায় সিংহবাহিনী বা কমলাত্মিকা মূর্তির উপস্থিতি সেদিকেই ইঙ্গিত করে।কর্ণসুবর্ণ-রাঙামাটী থেকেও সেরূপ মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। গুপ্ত সম্রাজ্যের অধীনে রাঢ় প্রদেশ থাকায় কিরীটেশ্বরীর মাহাত্ম্য বিস্তার লাভ করে বলে অনুমান করা যায়।৭
গুপ্ত পরবর্তীকালের বঙ্গদেশের ইতিহাসে আসে শত বছরের মাৎসান্যায়,তারপর হাজার বছরের জন্য রাজত্ব করে পাল বংশ। তারপর সেন বংশ। এসময়য় কালে বৌদ্ধ ধর্ম এসমস্ত অঞ্চলে প্রাধান্য লাভ করে,তার সাথে হিন্দু আচার মিলে তন্ত্রধর্ম বঙ্গদেশে বিস্তার লাভ করে। ৮ কিরীটেশ্বরী মন্দিরের গর্ভগৃহে যে শিলামূর্তি রয়েছে,তা ভালো করে লক্ষ্য করলে সেখানে বৌদ্ধ তন্ত্রের প্রভাব অনুমান করা যায়।
দেবীর ভৈরব বলে যে-মূর্তিটি পূজা করা হয় সেটি একটি বুদ্ধমূর্তি। পূর্ণচন্দ্র মজুমদার লিখেছে,
“Old Kriteswari did not escape the influence of Buddhism, for one finds the image of Buddha, in the usual sitting posture meditation, located in one of the temples close by and now worshipped as an image of Bhoirab.”
বিনয় ঘোষ লিখেছেন,
“মূর্তিটি ছোটো একটি বুদ্ধমূর্তি সাধারণত বাইরের কাউকে দেখানো হয় না। পুরোহিতকে অনুরোধ করলে তিনি দেখান এবং আমরা তাঁকে অনুরোধ করেই দেখেছিলাম। রাঢ়ের এই অঞ্চলের সঙ্গে বৌদ্ধসংস্কৃতির সম্পর্ক থাকা আশ্চর্য নয়। অনেক জায়গায় এখানে বুদ্ধমূর্তিও পাওয়া গিয়েছে এবং সেইসব বুদ্ধমূর্তি কোথাও রুদ্রদেব, কোথাও ভৈরব সম্বর্ত প্রভৃতি দেবতারূপে সাধারণের দ্বারা পূজিত হয়ে থাকেন।”১০
মন্দির চাতালের পূর্বদিকে একটা নাতিবৃহৎ মন্দিরের মধ্যে কৃষ্ণ প্রস্তানির্মিত একটা মূর্ত্তি ছিল, তা ভৈববমুর্ত্তি বলিয়া পূজিত হত, কিন্তু প্রকৃত অর্থে সেটি কষ্টিপাথর নির্ম্মিত একটা বুদ্ধমূর্তি।
উপরে উল্লিখিত মূর্ত্তি যে ভৈরব মূর্তি নয়৷ এবং স্পষ্টতঃ বুদ্ধমূর্তি, তা একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই বেশ বুঝতে পারা যায়। বুদ্ধের যে পাঁচ প্রকার মূর্তি সচরাচর দৃষ্ট হয়ে থাকে,যথা-১) ধ্যানী বৃদ্ধ, ২) সমাধিস্থ বুদ্ধ, ৩) প্রচারক বুদ্ধ, ৪) যাত্রী বুদ্ধ, ও ৫)মুমূর্ষু বুদ্ধ।
এই মূর্তিটি তারই মধ্যে একটি ধ্যানী বুদ্ধমূর্তি বলে বিবেচিত হয়। পদ্মাসনস্থ, একহাত কোলে, অপর হাত মীর কাশেমের আদেশে মুঙ্গেরে গঙ্গাগর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল বলে জানা যায়।১১
পাঠান মোগল যুগেও এই স্থানের খ্যাতি ছিল। জনশ্রুতি এরকম যে শ্রী চৈতন্যের সমসাময়িক মঙ্গল নামে জনৈক বৈষ্ণবের পূর্বপুরুষরা কিরীটেশ্বরীর সেবক ছিলেন। চৈতন্য দেবের প্রেরণায় যিনি শাক্ত থেকে বৈষ্ণব হন।১২
পরে এখানে কিরীটেশ্বরীর মেলা বসে। কথিত আছে, দেবীর অলৌকিক শক্তির মাহাত্ম্যের কথা শুনে একবার মুর্শিদাবাদের নবাব পর্যন্ত তাঁর হিন্দু দেওয়ানের অনুরোধে কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত পান করেছিলেন। ১৩
১১৭৭ সনে, অর্থাৎ প্রায় ২০৯ বছর আগে বিজয়রাম সেন রচিত ‘তীর্থ-মঙ্গল’ কাব্যে অন্যান্য অনেক মহাতীর্থের মধ্যে কিরীটেশ্বরীর বর্ণনাও আছে:
“সেদিন মোকাম করি প্রভাতে উঠিয়া।
পালকীতে সোয়ারী হয়্যা সেফাই লইয়া ॥
কিরীটেশ্বরী পূজা দিতে গেলা শীঘ্রগতি।
কথোগুলি যাত্রী গেলা কর্তার সংহতি।
মহাসরঞ্জাম সঙ্গে গিয়া কিরীটকোণা।
দেবীকে প্রণাম কৈল দিয়া কিছু সোনা।
ষোড়শোপচারে পূজা কৈল ভগবানে।
দক্ষিণা করিলা কত কৈল বিতরণে।
যাত্রীগণ কৈলা পূজা যেবা শক্তি যার।
প্রণাম করিয়া হৈলা পালকীতে সোয়ার।
কত কত বানরগণ সেই পূজার বাড়ী।
মনুষ্য দেখিলে বানর পাড়ে রড়ারড়ি।
লাফ দিয়া বলে ধরে বায়্যা উঠে গায়।
দ্রব্য হাতে করি কেহ পলাইয়া জায়।
ছড়া ছড়া কলা দিলা সেই বানরগণে।
গুটি কথো টাকা তথা কৈলা বিতরণে।
পালকীতে সোয়ারী হয়্যা ছড়াইলে কড়ি।
কড়ির গন্ধেতে লোক পাড়ে রড়ারড়ি।
তথা হৈতে মহাশয় চলিলা ত্বরিত।
বজরার মধ্যে আসি হৈলা উপস্থিত।”১৪
কিরীটেশ্বরী একটি পীঠস্থান, মতান্তরে উপপীঠ। এখানে সতীর কিরীট পড়েছিল সেই জন্য এর নাম কিরীট কণা বা কিরীটেশ্বরী। আবার অন্যমতে কিরীট দেবীর দেহের কোন অংশ না হওয়ায় স্থানটি পুরোপুরি পীঠস্থান নয় উপপীঠ মাত্র। পূর্বেই বলা হয়েছে দেবীর নাম ‘বিমলা’ ও ভৈরব ‘সম্বর্ত’। পীঠস্থানগুলির ইতিহাস আলোচনা করে ঐতিহাসিকগণ দেখিয়েছেন এই ‘পীঠ’ গুলির সৃষ্টি সম্ভবত সতের-আঠারো শতকের আগে নয়।১৫ পরবর্তীকালে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্লাবনে যখন বাংলাদেশ প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল তখন তারই প্রতিক্রিয়া রূপে এই সব তন্ত্রোক্ত শক্তি-পীঠের উদ্ভব হয়। এই শক্তিপীঠগুলিও বাংলার ধর্মসাধনার একটি উল্লেখযোগ্য পরিচয়। কিরীটেশ্বরী শক্তিপীঠ এবং শক্তিপীঠরূপেই এই স্থানের মাহাত্ম্য ও গৌরব। আঠারো শতকের অন্যতম শক্তি সাধক রাণী ভবানীর দত্তকপুত্র রাজা রামকৃষ্ণ এই সাধন-পীঠে সাধনা করে গেছেন। তাঁর সাধনপীঠ এখনও এখানে বর্তমান।
কিরীটেশ্বরীতে নাকি এককালে লক্ষ মন্দির ছিল। অতিরিক্ত মাত্রায় অতিরঞ্জন ছেড়ে দিলেও এখানে যে বহুদিন ধরে বহু মন্দির নির্মিত হয়েছিল তার নিদর্শন কিরীটেশ্বরী গ্রামের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। অধিকাংশ মন্দির কালের গতিতে এবং অযত্ন ও অবহেলায় ধ্বংস হয়ে গেলেও আজও কিরীটেশ্বরীতে বিভিন্ন স্থাপত্যের ষোলটি মন্দির বর্তমান।
গুপ্তমন্দিরঃ-
১৪০৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত বলে কথিত ‘গুপ্তমঠ’ নামে কিরীটেশ্বরীর মূল মন্দিরটি এখন ধ্বংস প্রাপ্ত। ঐ মন্দিরের দক্ষিণ-পূর্বে বর্তমান মন্দিরটি বঙ্গাধিকারি দর্পনারায়ণের নির্মিত। দর্পনারায়ণ মুর্শিদকুলীর সাথেই ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে আসেন এবং ‘ডাহাপাড়া’য় বাসস্থান ও প্রধান, কানুনগোর কার্যালয় নির্মাণ করেন। কিরীটেশ্বরী তাঁদের জমিদারীভুক্ত হওয়ায় মন্দির নির্মাণ ও সেবার ভার প্রধানতঃ তাঁদের উপরই বর্তায়। পশ্চিমমুখী মন্দিরটিতে পাঁচটি খিলান যুক্ত তিন দিকে বারান্দা। চূড়াটি খর্ব পেঁয়াজের আকৃতির (Low Onion Shaped)। স্থাপত্যে মুসলিম প্রভাব লক্ষণীয়। অনেকবার সংস্কারের ফলে মন্দিরটি তেমন পুরোন বলে মনে হয় না। তবে মন্দিরের গর্ভগৃহে মোগল চিত্রকলার আদলে নানা কারুকার্য সমন্বিত বাঁকানো
কার্ণিশের ক্ষুদ্রাকৃতি বাংলা মন্দিরের আকারের চিত্রিত প্রস্তর খণ্ডটির গাত্রে গ্রথিত কালো পাথরের কারুকার্য করা চমৎকার পীঠিকাটি যে বেশ প্রাচীন তাতে সন্দেহ নাই। এটি সম্ভবত পূর্বতন কোন মন্দিরে ছিল, সেখান থেকে এই মন্দিরের দেওয়ালে গ্রথিত হয়েছে। ঐ পীঠিকাটিতেই দেবীর প্রতীক কিরীট স্থাপিত ছিল। সেটি এখন গ্রামের উত্তর দিকে আর একটি মন্দিরে রক্ষিত আছে। এই মন্দিরে ঐ পীঠিকাটিকেই দেবীরূপে পূজো করা হয়। বিশাল সুবা বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের সন্নিকটে অবস্থিত কিরীটেশ্বরীর একদিন খ্যাতি, সমৃদ্ধি ও জাঁকজমকের সীমা ছিল না। সেদিন কেবল মুর্শিদাবাদ নগরীর ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে হিন্দু নাগরিকগণই দেবী আরাধনার জন্য এখানে সমবেত হতেন না, দেশ-বিদেশ থেকেও বহু ভক্ত জনের সমাবেশ ঘটত তখন।
মোগল বাজত্বকালে কিরীটেশ্ববীর গৌবব যে অক্ষুণ্ণ ছিল তারও যথেষ্ট প্রমাণ আছে। তারপর খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে, যে সময়ে মুর্শিদাবাদ বাঙ্গলা, বিহার উডিষ্যাব রাজধানী হিসেবে মহিমাশালী হয়ে উঠে, সেই সমযে কিরীটেশ্বরীর গৌরব উজ্জ্বলভাবে দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে।
বঙ্গাধিকারীগণের যত্নে অষ্টাদশ শতাব্দীতে কিরীটেশ্বরীর মহিমা বিস্তৃত হয়। এঁরা রাজস্ববিভাগের প্রধান কাননগো পদে নিযুক্ত হতেন। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর সময়ে বঙ্গাধিকারীবংশীয় দর্পনারায়ণ প্রধান কাননগো পদে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি মুর্শিদকুলি খাঁর দেওয়ানী ‘অবস্থায় তাঁর সাথে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হন, ও তাঁর ‘অপর পাড়ে ডাহাপাডায় বাস করেন। উক্ত ডাহাপাড়া থেকল কিরীটেশ্বরী সার্দ্ধ ক্রোশ পশ্চিমে অবস্থিত। ডাহাপাডায় থাকাকালীন দর্পনারায়ণ কিবীটেশ্ববীর উন্নতিসাধনে যত্নবান হন। বঙ্গাধিকারীরা আগে থেকেই কিরীটেশ্বরীব সেবার ভারপ্রাপ্ত ছিলেন বলে শোনা যায়। তাঁদের পূর্ব্বপুরুষ ভগবান্ রায় মোগল বাদশাহদের কাছ থেকে যে সমস্ত দেবোত্তর সম্পত্তি জায়গীর হিসেবে পান, তারমধ্যে কিরীটেশ্বরীও অন্যতম। সেটি “ভবানী খান” নামে তাঁদের সনন্দর মধ্যে লিখিত ছিল। বঙ্গাধিকারিগণের আদি নিবাস বর্দ্ধমান জেলার অন্তর্গত কাটোয়ার নিকটস্থ খাজুরডিহি গ্রাম। ভগবান্ রায় সম্ভবতঃ শাহ সুজার সময়ে কাননগোপদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। শাহ সুজার সময় রাজমহল বাঙ্গলার রাজধানী থাকায় ও কাটোয়ার কাছে বঙ্গাধিকারিগণের বাস হওয়ায়, কিরীটেশ্বরী তাঁদের জায়গীরের অন্তর্গত হওয়া নিতান্ত অসম্ভব নয়। কিরীটেশ্বরী অনেক দিন পর্যন্ত বঙ্গাধিকারিগণের সম্পত্তিব অন্তর্ভূত ছিল, পরে তা তাদের হস্তচ্যুত হয়। দর্পনারায়ণের আগে কিরীটেশ্ববীর অবস্থা তত ভাল ছিল না। মন্দিরগুলি জীর্ণ হতে শুরু হয়, চারদিকে বনজঙ্গলে আবৃত হয়েপড়ে। বন জঙ্গল কেটে গুপ্তমঠ নামে দক্ষিণদ্বারী প্রাচীন ‘আদি মন্দিবের সংস্কার করে বর্তমান মন্দির ও কতিপয় শিবমন্দির ও ভৈরব,মন্দির নির্মাণ করান। ১৬
এ বিষয়ে মুর্শিদাবাদ কথায় শ্রীশ চট্টোপাধ্যায় লিখছেন-
“কিরীটেশ্বরী মৌজা বঙ্গাধিকারিগণের সম্পত্তি ছিল। ১২৮০ সালের তায়দাদে দাতার নাম অপ্রকাশিত থাকায় কিরীটে- শ্বরী মৌজার অন্তর্গত ৭৬০/০ বিঘা লাখেরাজ জমী গবর্ণমেন্টে বাজেয়াপ্ত হয়। সে সময় রাজা সূর্য্যনারায়ণের স্ত্রী এবং তাঁহার পুত্র রাজা চন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী রাণী মনোমোহিনী বর্তমান ছিলেন। উক্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার পর রালী মনোমোহিনী তা চারি বছরের জন্য ইজারা বন্দোবস্ত করে নেন। কিন্তু টাকা শোধ না হওয়ায় ১৮৫১ খ্রীঃ নীলামে মুর্শিদাবাদের নবাব বংশের নবাব বসন্ত আলি খাঁ এই সম্পত্তি খরিদ করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নেন। এই নবাব মুর্শিদাবাদের ইমামবাড়ার অনেক সম্পত্তি দান করে যান। এই ওয়াকফ্ফ এস্টেটে উত্তর-রাঢ়ীর কায়স্থ দাতা দিগম্বরের বংশীয় সানন্দ রামজীবনের ধারার কৃষ্ণমোহন ঘোষ দেওয়ান ছিলেন। তাঁর বংশধরেরা বর্তমানে কাটোয়ার কাছে বহড়ান-এর নিবাসী। ১২৭২ বঙ্গাব্দে রামজীবন ঐ নবাবের কাছ থেকে উক্ত সম্পত্তি পাঁচ বছরের জন্য ইজারা বন্দোবস্ত নেওয়ার পরে ১২৭৬ বঙ্গাব্দে ক্রয় করেন। সেই থেকে রামজীবনের বংশধরগণ ঐ বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি দখল করিতেছেন এবং কিরীটেশ্বরীর পূজাদি চালাইয়া আসিতেছেন। এই দেবসেবার জন্য কোন দেবোত্তর সম্পত্তি অর্পিত নাই। তাঁহারাই সমস্ত ব্যয় বহন করেন। এখানে পীঠস্থানে নিকট একটি গুপ্ত-পীঠও আছে এবং তথায় দৈনিক পূজা ও অন্নভোগাদি হইয়া থাকে। পীঠ-স্থানে কোন ভোগাদির ব্যবস্থা নাই, কেবল ফুল গঙ্গাজলে পূজা হইয়া থাকে। গুপ্তপীঠে সাধারণের পূজা দিবার অধিকার নাই। পৌষ মাসের প্রত্যেক শনি ও মঙ্গলবারে এখানে মেলা বসিয়া থাকে। এক্ষণে কিরীটেশ্বরীর সেবায়েত উক্ত কৃষ্ণমোহনের পৌত্র শ্রীযুক্ত মনোজমোহন ঘোষ এবং ভ্রাতৃগণ।”১৭
পৌষমাসের প্রতি মঙ্গলবারে দর্পনারায়ণের প্রতিষ্ঠিত যে মেলাটির সেদিন গৌরবের সীমা ছিল না তা আজও মুমূর্ষ অবস্থায় কোন রকমে টিকে আছে। এই দেবীর খ্যাতি যে একদিন কত প্রবল ছিল তা বোঝা যায় মীরজাফরের অন্তিমকালে, ‘কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত পানের জনশ্রুতি থেকে।
পূর্বে উল্লেখিত ভৈরব সম্বর্ত বলে যে বিগ্রহটির পূজো করা হ’ত সেটি আসলে পদ্মাসনে উপবিষ্ট এক ধ্যানী বুদ্ধ মূর্তি। সম্ভবত এটি অন্য কোন স্থান থেকে নিয়ে এসে মন্দির মধ্যে স্থাপন করা হয়েছিল। কারুকার্যময় প্রস্তর পীঠিকার উপর প্রায় তিন ফুট উচ্চতার এই মূর্তির ভাস্কর্য তেমন সুবিধার নয়। দর্পনারায়ণ প্রতিষ্ঠিত কালীসাগরের বাঁধাঘাটের চাতালের পূর্ব দিকে এই ভৈরব মন্দির। মন্দিরের ভিতরের দেওয়ালে অঙ্কিত কয়েকটি চিত্রের অস্পষ্ট আভাস এখনও লক্ষ্য করা যায়। এ মন্দিরটিও দর্পনারায়ণের নির্মিত। বুদ্ধ যে হিন্দু দেব-দেবীর অর্ন্তভুক্ত হয়ে পড়েছিলেন এই ভৈরবরূপী বুদ্ধ মূর্তি তার একটি নিদর্শন।১৮
কিরীটেশ্বরী একটি ছোট গ্রাম। প্রধান রাস্তাটি উত্তর-দক্ষিণে গ্রামকে দুটি ভাগে ভাগ করে চলে গেছে। গ্রামের উত্তর এবং দক্ষিণ প্রান্তেই রাস্তার পাশেই মন্দিরগুলি অবস্থিত। কিরীটেশ্বরী ও ভৈরবমন্দির সমেত অধিকাংশ মন্দিরই গ্রামেরই দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। উত্তর দিকে এখন অল্প কয়েকটি মাত্র মন্দির আছে। বিচ্ছিন্নভাবে কেবল দুটি মন্দির আছে। একটি রাস্তার উত্তর দিকে গ্রামের ভিতরে (রাস্তার উত্তর দিকেই বসতি), অপরটি গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে দক্ষিণ পূর্বে পশ্চিমে একটি দীঘির উঁচু পাড়ে ভবানী বা বাঁকা ভবানীর মন্দির। মন্দিরগুলি বিভিন্নসময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি দ্বারা স্থাপিত হয়েছিল। তবে দুঃখের বিষয় প্রতিষ্ঠালিপির অভাবে মন্দিরগুলির নির্মাতাদের সঠিক পরিচয় নিশ্চিতভাবে জানা যায় না।
কিরীটেশ্বরীতে সবচেয়ে পুরোন যে মন্দিরটির প্রতিষ্ঠালিপি পাওয়া গেছে সেটির নির্মাণকাল১৩৮৭ শকাব্দ অর্থাৎ ১৪৬৫-৬৬ খ্রিস্টাব্দে। লিপিটি এরকম-
“সাকে সপ্তাষ্ট কালেন্দু
সংখে সন্তুপ্রিয়ে পুরে
সভারাম সুতোহকার্ষী
দ্ররঘুনাথ মটং শুভং।”১৯
লিপিতে প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লিখিত সভারামের পুত্র রঘু নাথ কে তা জানা যায় না। মন্দিরটি ঘাটের চাতালের পশ্চিম দিকে ছিল, বর্তমানে মন্দিরটির ভিত্তি অবশিষ্ট আছে। মূল-মন্দির ও প্রাঙ্গণের সীমানার প্রাচীর বর্তমানে নেই। পূর্বে যে প্রবেশদ্বারটি ছিল, তার ভিতরদিকে দুই পাশে দুটি অতি জীর্ণ চারচালা শিব মন্দিরের ধ্বংসপ্রায় রূপ আজও বিদ্যমান। দক্ষিণ দিকেরটি রাজা রাজবল্লভের নির্মিত বলে কথিত। নিকটে একটি প্রস্তর স্তম্ভের উপর কালো পাথরের ছোট্ট নন্দী ছিল।
মন্দির প্রাঙ্গণের মধ্যে কালী সাগরের ঘাটের আশে পাশে এবং মন্দিরের পশ্চিম দিকে প্রশস্ত যায়গায় বহু মন্দির, গৃহের ভিত্তি ও ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। প্রাচীনতর মন্দির সংলগ্ন পশ্চিম দিকে একটি অতি বৃহৎ গৌরীপট্ট ও তার নীচে শাহ আলমের কিছু স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা সম্প্রতি মন্দির ও সংলগ্ন স্থান পরিষ্কার করার সময় পাওয়া যায়। পশ্চিম প্রান্তের ভগ্ন গৃহগুলি ভোগ মন্দির প্রভৃতি ছিল বলে নির্দেশ করা হয়ে থাকে।
অধুনালুপ্ত যে মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা লিপি পাওয়া গিয়েছে (১৪৬৫-৬৬ খ্রিস্টাব্দ) সেটি কেবল মুর্শিদাবাদেরই বর্তমান মন্দিরগুলির মধ্যে প্রাচীনতম নয় সমগ্র বাংলাদেশেরই প্রাচীনতম মন্দিরগুলির অন্যতম।২০
মন্দির প্রাঙ্গণের বাইরে মূল মন্দিরের পূর্বদিকে একটি সুন্দর স্থাপত্যের জীর্ণ মন্দির উৎসুক পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রাজা রাজবল্লভ এ মন্দিরটিও নির্মাণ করেন। মন্দিরের বৃহৎ শিবলিঙ্গটি ফেটে গেছে। কিংবদন্তী রাজা রাজবল্লভ নবাব মীরকাশিম কর্তৃক মুঙ্গেরে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হলে রাজা প্রতিষ্ঠিত শিবলঙ্গিটি আপনা থেকেই বিদীর্ণ হয়ে যায়। স্থাপত্যের দিক দিয়ে মন্দিরটি মূলত উত্তর ভারত এবং উড়িষ্যায় প্রচলিত দেব দেউল, কিন্তু বাংলা রীতির প্রভাবে বহুল পরিবর্তিত। চতুষ্কোণ সোজা কার্ণিষের গৃহের উপর পিরামিডাকৃতি চূড়া মন্দিরটিকে একটি বিরল স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য দান করেছে। পূর্বোক্ত বাঁকা ভবানীর মন্দিরটির স্থাপত্যও একই রকম। মন্দিরটি প্রায় ৩০০ গজ পূর্বে একটি উঁচু ডাঙ্গার উপর প্রতিষ্ঠিত বলে মন্দিরটির উচ্চতা অনেকটা বেশি বলে মনে হয়। ভবানী মন্দিরটির প্রবেশ দ্বারের সামনে একটি আচ্ছাদিত বারান্দা (Porch) থাকায় মন্দিরটির গঠন সামান্য পরিবর্তিত হয়েছে। মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট। ভবানী মন্দির ও তৎসংলগ্ন বৃহৎ পুস্করিণী অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের সৃষ্টি। মন্দির দুটির চিত্র প্রখ্যাত মন্দির বিশেষজ্ঞ ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন তাঁর গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন এবং মন্দির স্থাপত্যের বিভাগীকরণে বলেছেন এটি খাড়া প্রান্ত – সমন্বিত পিরামিডাকৃতি রেখদেউল (Rekha : Straightedged pyramidal) তাঁর মতে মন্দিরগুলি উনিশ শতকে নির্মিত। ২১
গ্রামের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে ‘গুপ্তমঠ’। একটি অতি সাধারণ দালান রীতির মন্দির। রাণী ভবানীর নির্মিত বলে প্রচারিত হলেও এ বিষয়ে সন্দেহ আছে। মন্দিরের অভ্যন্তরে একটি লাল রেশমি কাপড়ে আবৃত দেবীর কিরীট রক্ষিত আছে। সেটিই দেবীর প্রতীক রূপে পূজিতা। তবে এই কিরীট কাউকে দেখতে দেওয়া হয়না বলে এ বিষয়ে আলোচনার কোন সুযোগও নাই। গুপ্তমঠের আশেপাশে একটি ক্ষুদ্রাকৃতি সাধারণ রীতির দেউল শিখরযুক্ত পঞ্চরত্ন মন্দির ও কয়েকটি চারচালা মন্দির এখনও কোন রকমে টিকে আছে। তার মধ্যে একটি মন্দিরের স্থাপত্যে বৈশিষ্ট্য আছে। এটি মূলতঃ চারচালা হলেও চালাগুলিতে শীর্ষ পর্যন্ত পর পর আটটি কার্নিশ যুক্ত হয়ে একটি বিশেষ স্থাপত্যরীতির সৃষ্টি করেছে। পশ্চিম বাংলায় এই ধরনের মন্দির আর নাই। ঢাকায় বক্সীবাজার ও ‘ঢাকেশ্বরী’ মন্দিরের সীমানায় এ জাতীয় দুই একটি মন্দির আছে। দর্পনারায়ণ ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে আসেন। সুতরাং এটির নির্মাণে ঢাকার প্রভাব থাকা বিচিত্র নয়। এ মন্দিরটিও ম্যাক্ কাচ্চনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং বহু কার্নিশযুক্ত খর্বাকার (Multiple – corniced-low type) এই মন্দিরের একটি চিত্রও তাঁর গ্রন্থে দিয়েছেন।২২
ডেভিড ম্যাক্ কাচ্চনের মতে কিরীটেশ্বরীর কয়েকটি চারচালা রীতির মন্দির মোগল আমলের প্রথম দিকে অর্থাৎ ষোড়শ শতকে নির্মিত। অধুনালুপ্ত যে মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা লিপি পাওয়া গিয়েছে (১৪৬৫-৬৬ খ্রিস্টাব্দ) সেটি কেবল মুর্শিদাবাদেরই বর্তমান মন্দিরগুলির মধ্যে প্রাচীনতম নয় সমগ্র বাংলাদেশেরই প্রাচীনতম মন্দিরগুলির অন্যতম। ২৩
উত্তর-রাঢ়ীর কায়স্থ-কারিকালেখক পঞ্চাননের কুল- পঞ্জিকায় কিরীটেশ্বরীর সম্বন্ধে লিখিত আছে যে,-
ডিহি কিরীটেশ্বরী মধ্যে কিরীটেশ্বরী গ্রাম।
মহাপীঠ হয় সেই মহামায়ার ধাম ॥
তথি মধ্যে মহামায়ার দেবোত্তর ভূমি।
তাহে হস্তক্ষেপ না করিবেন ভূস্বামী, ॥
যৈছে সেবা ভালরূপ চলে তা দেখিবে।
পাণ্ডাগণের প্রতি সদা সুদৃষ্টি রাখিবে ॥
অতিথি সৎকার যৈছে চলে ভালরূপ।
তৈছে দৃষ্টি থাকে যেন সিংহপুরভূপ।।”২৪
কিরীটেশ্বরী পীঠস্থান হওয়ায়, স্থানটি সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের পরম তীর্থস্বরূপ। পূর্ব্বে অনেক সাধুসন্ন্যাসী কিরীটেশ্ববীতে সমাগত হয়ে সাধনা করতেন। ব্রহ্মানন্দগিরি প্রমুখ সন্ন্যাসীগণ এখান থেকে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন বলে প্রবাদ প্রচলিত আছে। বাজা রামকৃষ্ণ তাঁর মুর্শিদাবাদস্থ বাজধানী বড়নগর থেকে প্রতিদিন কিরীটেশ্বরীতে সাধনার জন্য আসতেন বলে জানা যায়, এবং আজ পর্যন্ত লোকে তাঁর আসনের স্থান নির্দেশ করে থাকে। মুর্শিদাবাদ যে সমযে বাঙ্গলা, বিহাব, উড়িষ্যাব বাজধানী ছিল, সেই সময়ে কিরীটেশ্বরীর গৌবব দেশ- বিদেশে বিস্তৃত হয়ে পড়ে। দেবী কিরীটেশ্ববী তৎকালে মুর্শিদাবাদের অধিষ্ঠাত্রীরূপে বিদ্যমান ছিলেন।
কিরীটেশ্বরীর মন্দিরগুলিতে উল্লেখযোগ্য কোন অলঙ্করণ নাই। পোড়ামাটির (Terracotta) অলঙ্করণের তো কথাই নাই। সামান্য অলঙ্করণ যেটুকু আছে তা কিরীটেশ্বরীর মন্দিরের ভিতরের একটা চিত্রিত প্রস্তর-খণ্ড। অবশ্য একটি সুন্দর কারুকার্যমণ্ডিত নীলাভ কালো পাথরের তৈরি মন্দিরশীর্ষের ভগ্নাংশবিশেষ কিরীটেশ্বরীতে পাওয়া গিয়েছিল। সেটা এখন বহরমপুর গার্লস কলেজের প্রাঙ্গণে প্রবেশ দ্বারের কাছে রক্ষিত আছে। সেটা কোন মন্দিরের অলঙ্করণ ছিল কিনা জানা যায় না। এটিও মুসলিম ভাস্কর্য প্রভাবিত। অথচ কাছেই বড়নগরের মন্দিরগুলিতে কিংবা ভট্টবাটির রত্নেশ্বর মন্দিরে অতি উচ্চ শ্রেণির পোড়ামাটির অলঙ্করণের বিস্ময়কর নিদর্শন আছে। কিরীটেশ্বরীর মন্দিরগুলি যে সময় নির্মিত হয়েছিল সে সময়ে বাংলাদেশের বহু স্থানে উচ্চ শ্রেণির পোড়ামাটির অলঙ্করণের প্রচলন দেখা যায়। মন্দিরগুলি যাঁরা নির্মাণ করেছিলেন, তাঁদের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং প্রশাসনিক মর্যাদা ও ক্ষমতার অন্ত ছিল না; বিত্ত-বৈভবের তো কথাই নাই। সুতরাং তাঁরা উচ্চ শ্রেণির বিশাল বিশাল মন্দির নির্মাণ করে উচ্চ স্তরের শিল্পী দিয়ে সেগুলি অলঙ্কৃত করাতে পারতেন। যেমন করেছেন বড়নগরে রাণী ভবানী বা ভট্টবাটিতে দ্বিতীয় কানুনগো কালীনারায়ণ রায়।
স্থাপত্যের দিক দিয়ে বৈচিত্র্য থাকলেও কিরীটেশ্বরীর মন্দিরগুলি আয়তন অতি সাধারণ। বিশাল আয়তন এবং উচ্চতার মন্দির কিরীটেশ্বরীতে নাই। প্রধান মন্দিরটিও অতি সাধারণ সমতল ছাদের একটি দালান মাত্র। মধ্যে নাতিউচ্চ শিখর আছে বটে তবে সেটিও মুসলিম স্থাপত্যের অনুকরণে পেঁয়াজের আকৃতির, অনেকটা গম্বুজের মত। ব্যাপারটি রীতিমত হতবুদ্ধিকর। তবে মনে হয় মন্দির নির্মাতারা নবাবদের অসন্তোষ উদ্রেকের আশঙ্কায় তাঁদের চোখের সামনে বিশাল বিশাল মন্দির নির্মাণ ও সেগুলি অলঙ্কৃত করে তাদের অপ্রীতিভাজন হতে চাননি। মুসলিম স্থাপত্য ভাস্কর্যের অনুকরণও তাঁরা সম্ভবত সচেতন ভবেই করেছিলেন।
কিরীটেশ্বরীতে বিভিন্ন সময়ে নির্মিত অসংখ্য মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ইতস্ততঃ ছড়িয়ে আছে। ফলে এখন অতীতের কিরীটেশ্বরীর একটি স্পষ্ট চিত্র চোখের সামনে ফুটে ওঠে।২৫
১৩৩৭ বঙ্গাব্দে লালগোলার প্রাতঃস্মরণীয় দানবীর মহারাজা রাও যোগীন্দ্র নারায়ণ রায় মন্দিরের পুনঃ সংস্কার করান। পুরো সংস্কারের দায়িত্ব মেন নেহালিয়ার জমিদার সুরেন্দ্র নারায়ণ সিং বাহাদুর।
পরিশেষে জানায় একটি অত্যন্ত সুখবর! দেশের ৩১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত ৭৯৫টি আবেদনের মধ্যে ২০২৩ সালের ‘সেরা পর্যটন গ্রাম’ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে মুর্শিদাবাদের কিরীটেশ্বরী। এজন্য ভারত সরকারকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ।
তথ্যসূত্র-
১)মুর্শিদাবাদের মন্দির, বিজয় কুমার বন্দোপাধ্যায়।
২)মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, নিখিলনাথ রায়।
৩)ঐ
৪)তন্ত্রচূড়ামনৌ পীঠনির্ণয়
৫)মহানীলতন্ত্র, পঞ্চম পটল
৬) দেবীগীতা। ৮ম অ।
৭) মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, নিখিলনাথ রায়
৮) ঐ।
৯) The Musuud of Mursidabad (1704-1904): Compiled by Purna Chandra Majumdar. Mursidabad 1905, р 279).
১০) বিনয় ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি ৩য় খন্ড।
১১) মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, নিখিল নাথ রায়।
১২) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, তৃতীয় খন্ড, বিনয় ঘোষ।
১৩) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, তৃতীয় খন্ড, বিনয় ঘোষ।
১৪)বিজয়রাম সেন বিশারদ প্রণীত ‘তীর্থ-মঙ্গল’: নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ,
১৩২২: পৃষ্ঠা ১৮৬-৮৭।)
১৫) The Sakta Pithas’ – Dr. D.C.Sircar, J.A.S.B 1948.
১৬) মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, নিখিলনাথ রায়।
১৭) মুর্শিদাবাদ কথা, শ্রীশ চট্টোপাধ্যায়।
১৮) মুর্শিদাবাদের মন্দির, বিজয় কুমার বন্দোপাধ্যায়
১৯) মুর্শিদাবাদের মন্দির, বিজয় কুমার বন্দোপাধ্যায়।
২০)ঐ
২১) David J.Mccutchion- late Mediaeval Temples of Bengal.
২২) মুর্শিদাবাদের মন্দির, বিজয় কুমার বন্দোপাধ্যায়
২৩)ঐ
২৪) মুর্শিদাবাদ কথা, শ্রীশ চট্টোপাধ্যায়।
২৫) মুর্শিদাবাদের মন্দির, বিজয় কুমার বন্দোপাধ্যায়।
(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)