Dr. Syama Prasad Mookerjee Research Foundation

সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ, সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মৃত্যু-হাহাকার

সাম্প্রতিক মুর্শিদাবাদের বীভৎস ঘটনা কোন অর্থে দাঙ্গা বা Riot নয়, বরং একতরফা হিংসা আক্রমণ বা Pogrom। ধর্মীয় উন্মাদনাকে একমাত্র লক্ষ্যতে পরিণত করে ‘অ-ইসলামী শূন্য’,  ‘হিন্দু শূন্য’ করার ঐতিহাসিক পরম্পরা। তবে এইসব আক্রমণ, হত্যা-খুন-সন্ত্রাস চালিয়ে যাওয়া লোকগুলোও একটি  আদর্শে (কোরআন) অনুপ্রাণিত- “তারা ইসলামীয় কর্তব্য সম্পাদন করছে এবং পুরস্কার হিসেবে তারা জান্নাতে যাবে এবং ‘হুর’ (আনত নয়না অনাঘ্রাতা মেয়ে, যৌনসঙ্গমের জন্য) উপভোগ করা সুযোগ পাবে।” এ সমস্যা মুর্শিদাবাদ, মালদা কিংবা পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরীণ নয়। বিষয়টি আন্তর্জাতিক। বিশ্ব জুড়ে ইসলামিক আগ্রাসনের পরিকল্পিত প্রক্রিয়ার একটি অংশ এটি। ঘটনার সঙ্গে ওয়াকফ বিষয়ের কোন সংযোগই নেই। এই হত্যা, ধ্বংস, ভয়, সন্ত্রাস সৃষ্টির কেবল একটি ইস্যু এই ওয়াকফ।

গোটা বিশ্ব জুড়ে খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন নেই। সাম্প্রতিক ভারত পার্শ্ববর্তী ভূখন্ডের ঐতিহাসিক  পরম্পরা দেখলেই স্পষ্ট হবে এদের আসল উদ্দেশ্য। ১৯৪১ সালের বাংলাদেশের ২৮ শতাংশ হিন্দু কমতে কমতে আজ মাত্র ৭.২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ধর্মীয় হিংসার কারণে স্বাধীনতার পরেই প্রায় ৫ কোটি হিন্দু বিতাড়িত নিজের জন্ম ভিটে বাংলাদেশ থেকে। এপার বাংলার ১৯৫১ সালের ১৯ শতাংশ মুসলমান আজ বাড়তে বাড়তে ৩৫ শতাংশ।

কোন ভূখণ্ডে মুসলমান সংখ্যায় কম থাকলেই সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্মীয় উদারতা, কমিউনিজম, ফুল-মিষ্টি আর সংখ্যা বেড়ে গেলে খুন, হত্যা, ইট-বৃষ্টি! ‘এশিয়ার প্যারিস’ কাবুল আজ ধ্বংসস্তূপ। পাকিস্তানের সংখ্যালঘু প্রায় শূন্য, হরপ্পা মহেঞ্জোদারো হাজার বছরের সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন। সনাতন সংস্কৃতির বাহক, অগ্নির উপাসক ইরানের নিজস্ব অস্তিত্বটুকু বেঁচে নেই ইসলামিক আগ্রাসনে। ১৯৪৬ সালে বিশ্বের ছটি নথিভুক্ত মুসলিম রাষ্ট্র বাড়তে বাড়তে আজকের সংখ্যা ৬১। পৃথিবীর কোন সংখ্যাগুরু ইসলামিক রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতা নেই, নেই অন্য ধর্মকে গ্রহণ করার বা সহ্য করার নূন্যতম মানবিক চিহ্ন। ভারতের মানচিত্রের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে-সমস্ত এলাকায় মুসলমান কলোনি আজ ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে, সেইসব স্থানে  একসময় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য। নির্দিষ্ট কোন একটি ধর্ম নয়, অ-ইসলামিক সমস্ত মানুষকে জিহাদিরা কাফের হিসেবে গণ্য করে। খুন-হত্যা-ধ্বংসের মাধ্যমে তাদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াকে পবিত্র কর্তব্য বলে বিশ্বাস করে।

সুরাবর্দির নেতৃত্বে মুসলিম লীগ মহম্মদ আলী জিন্নাহ’র- “ইসলামিক পাকিস্তান চাই, নয়তো ধ্বংস হওয়া ভারত” স্লোগানকে সামনে রেখে সেদিন শুরু হয়েছিল একতরফা হিন্দু হত্যা। লক্ষ্য ছিল হিন্দু শূন্য কলকাতা। ইতিহাসের পাতায় সেটি কুখ্যাত ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’, ১৬ই আগস্ট, ১৯৪৬।

স্বাধীনতার পূর্বেই পূর্ববঙ্গের হিন্দু অধ্যুষিত জেলাগুলোকে হিন্দু শূন্য করতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে ধর্মীয় একাধিপত্য। চাই একটি ইস্যু। কলকাতার বন্দর এলাকায় কাজ করতে আসা মুসলমানরা নোয়াখালীতে ফিরে গিয়ে পরিকল্পনামাফিক প্রচার করল, কলকাতা দাঙ্গায় অসংখ্য মুসলমানকে খুন করেছে হিন্দুরা। অথচ প্রকৃত ঘটনা এর ঠিক উল্টো, এগারো হাজারের বেশি হিন্দু কোতল হয় এই হত্যাকাণ্ডে। এই গুজবকে সামনে রেখে ১৯৪৬ সালের ১০ই অক্টোবর লক্ষ্মী পূর্ণিমার রাতে নির্বিচারে ধর্ষিত হলো অসংখ্য হিন্দু নারী, ধর্মান্তরিত হলো আরো বেশি; লাখো লাখো হিন্দু গৃহহীন ও ভিটেহীন হলো। কয়েক লক্ষ লোক দেশ ছেড়ে শরণার্থী হলেন ভারতে। ইসলামিক জিহাদিদের লক্ষ্য পূরণ হল।

১৯৫০। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান টার্গেট করলেন ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, সিলেট, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও যশোর প্রভৃতির মত হিন্দু ও বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকাগুলোকে। ১৯৪৯-এর আগস্ট থেকে ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত পাকিস্তানিদের হাতে ৫ লক্ষ হিন্দু খুন হয়েছিল। দেশ ছেড়ে পালিয়ে বেঁচে ছিল  প্রায় ৪৫ লক্ষ।

ঢাকা থেকে কাশ্মীরের দূরত্ব প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার। এত দূরের বাংলাদেশের হিন্দু প্রধান ঢাকা, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, সিলেট ও ময়মনসিংহ প্রভৃতি এলাকায় হঠাৎ গুজব রটানো হলো- ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে ‘হজরতবাল তীর্থক্ষেত্র’ থেকে হযরত মহম্মদের সংরক্ষিত চুল নাকি চুরি হয়ে গেছে। এই অজুহাতেই শুরু হলো ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া। খুন হলেন কয়েক হাজার হিন্দু,  দেশ ছাড়া হলেন কয়েক লক্ষ। এই ঘটনার পরে  পঁচাত্তর হাজার আদিবাসী উপজাতি এবং পঁয়ত্রিশ হাজার খ্রিষ্টানকে বাংলাদেশ ছেড়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল আসামে। সামান্য একটা চুল হারানো গুজবের এত মূল্য!

আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার। চলছিল পাকিস্তানিদের হাত থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরীর প্রচেষ্টা। একটি দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে হঠাৎ কেন বেছে বেছে সংখ্যালঘু হিন্দুরাই ধর্ষণ-খুনের শিকার হলো? তার উত্তর ইতিহাস আজও স্পষ্টভাবে দেয়নি। ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর সময়কালে পাকিস্থানের সশস্ত্র বাহিনী, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস ও জমায়েত ইসলামির টার্গেট ছিল মূলত বাঙালি হিন্দু। খুন হয়েছিল ৩ লক্ষ বাঙালি, ধর্ষিত হয়েছিল ৪ লক্ষ নারী এবং উদবাস্তু হয়েছিলেন প্রায় ৩ কোটি হিন্দু।

আজকের দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের হিন্দুদের অবস্থা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই কোথাও। খালেদা জিয়া, সেক হাসিনা কিংবা সাম্প্রতিক তদারকি সরকারের সময়কালে বাংলাদেশকে ‘হিন্দু শূন্য’ করার পরিকল্পিত ইসলামিক জিহাদ বিন্দুমাত্র লক্ষ্যচ্যুত হয়নি। বরং সময়ে সময়ে আরো বেশি উৎসাহিত হয়েছে। সারা পৃথিবীর ইতিহাসও একই প্রমান দেয়।

মুসলমান সংখ্যাগুরুর মুর্শিদাবাদ, মালদা, দিনাজপুর হিন্দু সংখ্যাগুরু পশ্চিমবঙ্গে ইসলামিক জিহাদকে আরও শক্তপোক্ত করবে, তা ইতিহাসের এক অনিবার্য সত্য। তাই ইস্যু এখানে মুখ্য নয়। সময়ের সময়ে ইস্যু পরিবর্তিত হয়েছে। কখনও ধর্মীয় গুজব, কখনও বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান মন্দিরে অস্ত্র মজুতের মিথ্যা আতঙ্ক, কখনও হযরত মহম্মদের চুল, কখনো সিএএ-এনআরসি-ওয়াকফ। লক্ষ্য স্থির রেখে সকল প্রস্তুতি নিয়ে ইসলামিক জিহাদিরা ঘাপটি মেরে বসে থাকে, শুধু একটি উপযুক্ত ইস্যুর অপেক্ষায়।

সংখ্যাগুরু হিন্দুদের দেশে সংখ্যালঘু  মুসলমানদের  আক্রমণে ও আতঙ্কে ভিটে মাটি ছেড়ে পালাতে দেখেও চুপ করে থাকা মানুষগুলোকে নপুংসক নামে ডাকতে ইচ্ছে করে। গভীর থেকে উঠে আসা তীব্র এক যন্ত্রণা চিৎকার করে জানতে চায়- “এ লড়াইটাও কি কেবল ভাতের, ধর্মের নয়?” গভীর বেদনা, চোখের জল লুকিয়ে ক্যাম্পে দাঁড়িয়ে দু’মুঠো অন্নের জন্য হাহাকার, মৃত সন্তানের লাশ লুকিয়ে একটা বেলার খাবারের জন্য হন্যে হওয়া নির্বাক মায়ের ছবিগুলো ভয়ঙ্কর এক ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড় করায় আর একবার।

ওয়াকফ বিল নিয়ে কোন বক্তব্য নেই। কারণ আমি নিশ্চিত যারা এই খুন, প্রপাকান্ডা ঘটালো তারা এর একটি অক্ষর পড়ে দেখেনি কখনও। যারা করালো নিখুঁত পরিকল্পনায়, তারাও এটাকে কেবল একটি ইস্যু হিসেবে নিল। শাসক যে-ভাবেই বলুক, যে উদ্দেশ্য সামনে রেখে  রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করুক, সত্য কখনো মিথ্যা হয়ে যাবে না। এখনও এই ঘটনাকে যদি ইসলামিক জিহাদিদের ‘আন্তর্জাতিক লক্ষ্য’ হিসেবে ব্যাখ্যা না করে কেবল একটি ‘ছোট ঘটনা’, ‘আঞ্চলিক বিষয়’, ‘স্থানীয় কিছু লোকের উস্কানি’ প্রভৃতি ইত্যাদি বলে চালানোর চেষ্টা চলে, তাহলে শাসকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক স্বার্থে রাষ্ট্র বিরোধিতার যে অভিযোগ উঠেছে তা সত্য বলেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

১৬ই এপ্রিল, ২০২৫

Author

(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)