Dr. Syama Prasad Mookerjee Research Foundation

রামদাস সেন: এক বিস্মৃতপ্রায় ভারততত্ত্ববিদ

মুর্শিদাবাদের রামদাস সেন (১৮৪৫-১৮৮৭) ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর এক প্রবাদপ্রতিম বাঙালি বিদ্বান, ভারততত্ত্ববিদ, এবং শিক্ষানুরাগী। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনকালে তিনি ভারতীয় বিদ্যাচর্চা, বিশেষত প্রত্নতত্ত্ব, এবং বাংলা সাহিত্যের বিকাশে যে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন, তা আজও গবেষণার বিষয়। যদিও তাঁর কাজ পাশ্চাত্যে সমাদৃত হয়েছিল এবং তিনি ম্যাক্সমূলারের মতো পণ্ডিতদের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন, তবুও আজকের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর নাম অনেকটাই বিস্মৃত। আজ আমরা রামদাস সেনের জীবন, তাঁর শিক্ষা, সাহিত্য ও শিল্পানুরাগ, সুবিশাল গ্রন্থাগার, বিদ্যোৎসাহিতা, জনকল্যাণমূলক কাজ এবং তাঁর প্রতি দেশী-বিদেশী সম্মান নিয়ে আলোচনা করব।
বংশ-পরিচয় ও বাল্যকাল:-
পলাশীর যুদ্ধের আগে, জীবিকার সন্ধানে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ মুর্শিদাবাদের মতো সমৃদ্ধ রাজধানীতে আসতেন। তেমনই এক সময়ে, আঠারো শতকের মাঝামাঝি, ব্রজবল্লভ সেন নামে এক কায়স্থ বহরমপুরে এসে বসতি স্থাপন করেন। এই সেন পরিবার জাতিতে কায়স্থ হলেও, বল্লাল সেনের শাণ্ডিল্য কায়স্থ বংশের সঙ্গে তাঁদের যোগসূত্র নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে। এই বংশের আদিপুরুষ ছিলেন বেদচরণ সেন, যার বাসস্থান ছিল ফরিদপুর জেলার ইদিলপুর পরগনার ‘মিত্রসেন পট্টী’ গ্রামে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তিনি স্ত্রী ও পুত্র গণেশচন্দ্রকে নিয়ে ‘বংশসঞ্জয়’ গ্রামে চলে আসেন। ব্রজবল্লভ সেন, তাঁর দুই পুত্র কৃষ্ণগোবিন্দ ও কৃষ্ণকান্তকে নিয়ে বহরমপুরে আসার পর তাঁর তৃতীয় পুত্র রামকান্তের জন্ম হয়।
ব্রজবল্লভের দ্বিতীয় পুত্র কৃষ্ণকান্ত সেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কেরানির কাজ শুরু করেন এবং পরে ‘নিমক-মহাল’-এর দেওয়ানি সূত্রে প্রচুর ধন-সম্পত্তি অর্জন করেন। তাঁর সময় থেকেই সেন পরিবার বহরমপুরে খ্যাতি লাভ করে। মেজর জে. এইচ. টি. ওয়ালশ তো কৃষ্ণকান্তকেই বংশ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কৃষ্ণকান্ত নিঃসন্তান হওয়ায় তাঁর অগ্রজ কৃষ্ণগোবিন্দ সেন বহরমপুরের বসতবাড়ি ও জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পান।
জন্ম:-
কৃষ্ণগোবিন্দ সেনের ছয় পুত্র ছিল: গুরুদাস, শিবপ্রসাদ, রাধামোহন, মদনমোহন, ভুবনমোহন ও লালমোহন। কনিষ্ঠ পুত্র লালমোহনের তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী লক্ষ্মীমণির একমাত্র সন্তান ছিলেন রামদাস সেন। ১২৫২ বঙ্গাব্দের ২৬ অগ্রহায়ণ, অর্থাৎ ১০ ডিসেম্বর ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে বহরমপুরের সেন-বাড়িতে রামদাসের জন্ম হয়। মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। এই অল্প বয়সেই পিতৃবিয়োগ সম্ভবত তাঁর পরিণত মন এবং স্ব-অভিভাবকত্বের জন্ম দিয়েছিল। ছোটবেলায় রামদাস ফুলের গাছ লাগানো এবং ঠাকুর পূজা খেলতে ভালোবাসতেন। দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে গান গাওয়ার প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল, যা তাঁর কৈশোরে রচিত কবিতায় ও গানে প্রকাশিত হয়। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে, মাত্র ১৪ বছর বয়সে, তাঁর বিষ্ণুতত্ত্ব-বিষয়ক গানের সংকলন ‘তত্ত্বসংগীত লহরী’ প্রকাশিত হয়। কবি ঈশ্বর গুপ্ত এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি সংশোধন করেছিলেন। এমনকি, ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘কুসুমমালা’ কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতাও ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ প্রকাশিত হয়। সেই সময়ে দূর মফস্সল থেকে ঈশ্বর গুপ্তের মতো একজন প্রতিষ্ঠিত কবি-সাংবাদিকের সঙ্গে এত অল্প বয়সে একজন কিশোরের যোগাযোগ হওয়াটা নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে যে, সেন পরিবারে সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ ছিল এবং ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে পারিবারিক পর্যায়ে পরিচিতি ছিল।
বিবাহ ও ব্যক্তিগত জীবন:-
১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৪ বছর তিন মাস বয়সে, টাকীর জানকীনাথ রায়চৌধুরীর কন্যা দুর্গাতারিণী দেবীর সঙ্গে রামদাসের বিবাহ হয়। এই বিবাহ এতটাই আড়ম্বরপূর্ণ ছিল যে, সমসাময়িক সংবাদপত্রগুলিতেও তার খবর প্রকাশিত হয়। ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও ‘দ্য হারকারা’ পত্রিকায় এই বিবাহের জাঁকজমকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু এই বিবাহ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে, মাত্র পাঁচ বছর পর, একটি শিশুকন্যা রেখে দুর্গাতারিণী দেবী মারা যান। স্ত্রীর মৃত্যুতে শোকাহত রামদাস ‘বিলাপতরঙ্গ’ নামে একটি কাব্য রচনা করেন। যদিও পারিবারিক সূত্রে জানা যায় যে, রামদাস স্ত্রীর মৃত্যুর খবর বেশ কয়েকদিন পর জানতে পেরেছিলেন, যা তাঁর প্রতি তাঁর মায়ের প্রখর কর্তৃত্বের ইঙ্গিত দেয়। রামদাস ছিলেন কিছুটা অন্তর্মুখী ও আত্মমগ্ন মানুষ। পড়াশোনা নিয়ে এতটাই ডুবে থাকতেন যে, বহির্বাটিতে কয়েকদিন কাটিয়ে দিতেন এবং খাবারও অন্দরমহল থেকে পাঠানো হতো। এইরকম কোনো সময়েই হয়তো তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয় এবং তাঁর মা তাঁকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। এই ঘটনা সেই সময়ের অভিজাত সামন্ততান্ত্রিক পরিবারগুলির অভ্যন্তরীণ কর্তৃত্বের এক ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে।
ব্যক্তিগত জীবনে রামদাস ছিলেন একজন পরিশীলিত, মার্জিত, পরিচ্ছন্ন রুচির মানুষ, কিছুটা আত্মমগ্ন ও বিষয়-উদাসীন। তাঁর সৌম্যমূর্তি, সরল স্বভাব এবং কোমল প্রকৃতি আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধুদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিল। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ তাঁকে একজন কর্তব্যপরায়ণ পুত্র, স্নেহময় পিতা, প্রেমময় স্বামী এবং উষ্ণ হৃদয়ের বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করেছে।
রামদাস সেন সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর বিশাল জমিদারী বহরমপুর শহর এবং মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন গ্রাম ছাড়াও বীরভূম, নদিয়া, যশোহর, চব্বিশ পরগনা, হুগলি, মেদিনীপুর, দিনাজপুর এবং কলকাতা শহরের বিভিন্ন স্থানে বিস্তৃত ছিল। এই বিশাল জমিদারীর দেখাশোনা মূলত করতেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রাধিকাচরণ সেন। তবে এই বিত্তকৌলীন্য রামদাসকে অহংকারী করেনি। পণ্ডিত রামগতি ন্যায়রত্ন রামদাসের বিনয়, নিরহংকারিতা, প্রিয়ভাষিতা এবং সৎকাজের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, “রামদাস অতি বিনয়ী, নিরহঙ্কার, প্রিয়ভাষী ও সদানুষ্ঠানরত। বিদ্যানুশীলনই তাঁহার একমাত্র উপজীব্য”। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ও তাঁকে “নবীন বাংলার সমস্ত দোষমুক্ত এবং প্রাচীন হিন্দুর সমস্ত গুণাবলী সম্পন্ন” একজন নিরহংকার ও নীরব দেশপ্রেমিক হিসেবে বর্ণনা করেছে। অলসতা বা দীর্ঘসূত্রতা তাঁর জীবনে ছিল না, যা তাঁর রচনার গুণগত ও পরিমাণগত বিচারে স্পষ্ট।
পুরাতত্ত্বের অনুশীলনে যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হলেও, ব্যক্তিজীবনে রামদাস ছিলেন একান্তভাবে ধর্মপ্রাণ। সন্তানদের অসুস্থতায় তিনি শান্তি, স্বস্ত্যয়ন ও চণ্ডীপাঠের আয়োজন করতেন এবং দেবতাদের কাছে “মানত” করতেন। তাঁর ‘রত্নরহস্য’ ও ‘সংস্কার রহস্য’-এর প্রবন্ধগুলিতে যুক্তি ও প্রাচীন বিশ্বাসের এক আশ্চর্য মেলবন্ধন দেখা যায়। যে বৈষ্ণবীয় পারিবারিক পরিবেশে রামদাস বেড়ে উঠেছিলেন, সেখানে তাঁর মানসিকতায় ভাবের আতিশয্য থাকাটা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু এই পরিবেশেও স্বশিক্ষিত রামদাস ভারতবিদ্যার আলোচনায় যে যুক্তি ও বুদ্ধির চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন, সেখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য। ম্যাক্সমূলারের উপদেশ মেনে তিনি পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার গুণগ্রাহী হয়েও সম্পূর্ণরূপে ভারতীয়ত্বের পথে হেঁটেছেন। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন, “ধনীর সন্তান হইয়াও তিনি পাশ্চাত্ত্য ভাবপ্রবাহে অন্য অনেকের মত ভাসিয়া যান নাই। ভারতীয় ভিত্তির উপর দাঁড়াইয়া প্রতিষ্ঠা অর্জন করিয়াছিলেন।”
শিক্ষা, সাহিত্যানুরাগ ও শিল্প-প্রীতি:-
রামদাসের সাহিত্য-প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে খুব অল্প বয়সেই। পিতৃহীনতার কারণে তাঁর প্রথাগত বিদ্যালয় শিক্ষা কিছুটা ব্যাহত হয়েছিল এবং তিনি এ বিষয়ে অনাগ্রহীও ছিলেন। তবে কাব্য, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল। কৈশোর থেকে যৌবনের শুরু পর্যন্ত তিনি গৃহপরিবেশেই গৌরসুন্দর মাস্টার, বেণীমাধব সরকার, দীনবন্ধু সান্যাল, ভোলানাথ পাল, পণ্ডিত রামগতি ন্যায়রত্ন প্রমুখ পণ্ডিতজনের কাছে বাংলা, ইংরেজি ও সংস্কৃত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পান। এই ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্যই তাঁর সাহিত্য-প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়েছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যাচর্চার প্রতি তাঁর আগ্রহ আরও নিবিড় হয়, যা তাঁকে স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত হতে সাহায্য করে। ফলে যৌবনেই তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। সমালোচক ড. রবীন্দ্র গুপ্ত তাঁকে অক্ষয়কুমার দত্তের পর ‘যথার্থ স্ব-শিক্ষিত মনস্বী লেখক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর বহরমপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় (যা পরে রাজা কৃষ্ণনাথ কলেজ নামে পরিচিত হয়)। এই কলেজ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বিদগ্ধ গুণীজনের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক মি. রবার্ট হ্যান্ড এই কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। পণ্ডিত রামগতি ন্যায়রত্ন, অধ্যাপক রমানাথ নন্দী, স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী (পরবর্তী অধ্যক্ষ), গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ শিক্ষকের সুযোগ্য শিক্ষাদানে বহরমপুর কলেজ তখন একটি উজ্জ্বল শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এই কলেজের পাঠ্যসূচিও ছিল যুগোপযোগী, যেখানে সংস্কৃত-সাহিত্য, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, গণিত, আইন প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। শিক্ষক ও পাঠক্রমের এই মেলবন্ধন রামদাসকেও আকৃষ্ট করেছিল।
‘মুর্শিদাবাদ হিতৈষী’ পত্রিকা থেকে জানা যায়, রামদাস এই কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে সম্ভবত তিনি এখানে ধারাবাহিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি এবং শিক্ষার্থী হিসেবে কোনো পরীক্ষায় বসেননি। বরং অধ্যক্ষের অনুমতি নিয়ে এফ.এ., বি.এ. এবং আইন ক্লাসে উপস্থিত হতেন। এর ফলে তিনি পাশ্চাত্ত্য ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা আয়ত্ত করেন এবং দেশীয় সাহিত্য, শিল্প, দর্শন, ইতিহাস বিষয়ে তাঁর অনুসন্ধিৎসা আরও বেড়ে যায়।
বিদ্যাচর্চার প্রতি এই অনুরাগ রামদাস উত্তরাধিকার সূত্রেও পেয়েছিলেন। বৃন্দাবন-বাসী তাঁর পিতৃব্য রাধামোহন সেনের হাতে লেখা পুঁথি ‘পশুপাশ-মোক্ষণ’ পাঠ করে সংস্কৃত-সাহিত্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মেছিল। পরে সংস্কৃত শাস্ত্র অনুশীলনের জন্য তিনি প্রবাদ-প্রতিম পণ্ডিত শ্রীকালীবর বেদান্তবাগীশকে নিজ ব্যয়ে কাশীতে পাঠান এবং পরে তাঁর কাছেই সেই অধীত-বিদ্যা শিক্ষা করেন। সংস্কৃত সাহিত্যে তাঁর ব্যুৎপত্তি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও সমাদৃত হয়েছিল। মিসেস মিচেল তাঁর ‘In India’ গ্রন্থে রামদাসকে “very intelligent, well-educated modest man” এবং “very good sanskrit scholar” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে রামদাসের অনুরাগের পরিচয় তাঁর কাব্যচর্চার মাধ্যমে পাওয়া যায়। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে কাব্যচর্চা করেছেন। তাঁর প্রথম তিনটি কাব্য অপরিণত মনের আবেগ-প্রসূত হলেও, শেষ দুটি কাব্য, ‘কবিতালহরী’ ও ‘চতুর্দশপদী কবিতামালা’, তাঁর ঐতিহ্যানুরাগ, বাংলাভাষা-প্রেম এবং সময়-সচেতনতার পরিচয় বহন করে। পরবর্তীকালে রামগতি ন্যায়রত্নের নিবিড় সংস্পর্শে তিনি ঋজু বাংলাভাষা শিক্ষার অবাধ সুযোগ পান।
রামদাস ‘পৈতৃক পাঠাগারে’ পৌরাণিক বই এবং পাশ্চাত্ত্য জগতে আবিষ্কৃত ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব-বিষয়ক বই পড়ে এ বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। স্বদেশের অতীত গৌরব তাঁকে উজ্জীবিত করে। বঙ্কিমচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য তাঁর পড়াশোনার ক্ষেত্রকে আরও সমৃদ্ধ করে। এরপর বঙ্কিমের অনুরোধে তিনি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস-সন্ধানে ব্রতী হন। তাঁর ‘ঐতিহাসিক রহস্য’, ‘ভারত রহস্য’-এর অন্তর্গত প্রবন্ধগুলি এবং ‘বুদ্ধদেব’-বিষয়ক রচনায় তাঁর সেই সন্ধানী মনের পরিচয় ছড়িয়ে আছে। ইংরেজি ভাষায় ব্যুৎপন্ন হলেও রামদাস তাঁর প্রবন্ধগুলি ‘বঙ্গদর্শন’-এর আদর্শ মেনে বাংলাতেই রচনা করেছেন। ‘বঙ্গদর্শন’ রামদাসের মূল বিচরণক্ষেত্র হলেও, সমসাময়িক অন্যান্য পত্র-পত্রিকাতেও তাঁর বহু রচনা প্রকাশিত হয়েছে, যেমন: ‘সংবাদ-প্রভাকর’, ‘বীণা’, ‘চারুবার্তা’, ‘আর্য্যদর্শন’, ‘ভারতী’, ‘নব্যভারত’, ‘নবজীবন’, ‘জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব’, ‘প্রচার’, ‘বান্ধব’ ইত্যাদি। এছাড়া বোম্বাই থেকে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকোয়ারি’ নামে মাসিক পত্রিকাতেও তাঁর কয়েকটি ইংরেজি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, যা ইউরোপীয় পণ্ডিত সমাজের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে।
বিদ্যাচর্চা রামদাসের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় যুক্ত প্রতিভাবান বাঙালিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। সে সময় বিদ্যা ও জ্ঞানচর্চায় তিনি মুর্শিদাবাদের ‘শিরোভূষণ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জ্ঞানচর্চার সূত্রেই বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বহরমপুর ছাড়ার পরেও এই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়নি, যা তাঁদের চিঠিপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
শুধু সাহিত্য নয়, সংগীতেরও অসাধারণ সমঝদার ছিলেন রামদাস। কিশোর বয়সে তত্ত্বসংগীত রচনা করে তিনি তাঁর সংগীত-প্রীতির সাক্ষ্য রেখেছিলেন। পরিণত বয়সে লেখা সংগীত-বিষয়ক প্রবন্ধগুলি তাঁর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য সংগীত-শাস্ত্র সম্পর্কে অগাধ জ্ঞানের পরিচয় বহন করে। ‘মুর্শিদাবাদ হিতৈষী’ জানিয়েছে, “রামদাস বাবুর সঙ্গীত বুঝিবার বেশ ক্ষমতা ছিল। কেহ কোন কোন বিরল রাগ-রাগিণীর আলাপ করিলেও তিনি তাহার দোষ-গুণ ধরিয়া দিতেন।” তাঁর পারিবারিক পরিবেশেও সংগীতচর্চার একটি আবহ ছিল। তাঁর পিতৃব্য রাধামোহন সেতার ও মৃদঙ্গ ভালো বাজাতেন। তাঁর পিতৃব্য-পুত্র পুলিনবিহারী বহরমপুরে একটি সংগীত-সভা তৈরি করেছিলেন, যেখানে সমকালীন প্রথিতযশা শিল্পী ও ওস্তাদরা সংগীত-চর্চায় অংশ নিতেন। পুলিনবিহারীর পুত্র শ্রীবনবিহারীও বহরমপুরে একটি কনসার্ট পার্টি তৈরি করেছিলেন। রামদাসের আর এক ভ্রাতুষ্পুত্র নিতাইচরণ (বিশ্বম্ভর সেনের পুত্র) নগরবধূ সংগীত-শিল্পী গহরজানের প্রেমাস্পদ হিসেবেই শুধু নয়, ‘ভারতের সংগীতগুণী’ হিসেবেও গুণী-মহলে স্থান পেয়েছিলেন।
চিত্র এবং কারুকার্য-সমন্বিত শিল্পবস্তুর প্রতিও রামদাসের আগ্রহ ছিল অপরিসীম। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গ্রন্থাগার-সংলগ্ন তাঁর কিউরিও (Curio) ঘরটি ছিল দর্শনীয়। বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত শিল্পদ্রব্য সেখানে ঠাঁই পেত। ঘরটির চারদিকের দেওয়ালের কারুকার্য থেকে এবং ভগ্নাবশেষের টুকরো নিদর্শন থেকেও তাঁর শিল্প-প্রীতির পরিচয় মেলে। শ্রীশচন্দ্রও তাঁর শিল্পানুরাগের কথা উল্লেখ করেছেন, “বিদ্যালোচনা, চিত্র ও কারুকার্য্য সংগ্রহ তাঁহার জীবনের মুখ্য কার্য্য ছিল।”
গ্রন্থাগার প্রসঙ্গ ও গ্রন্থপ্রীতি:-
বিদ্যাচর্চার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে একটি গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা রামদাসের পরিশীলিত মনে অনুভূত হবে, এটাই স্বাভাবিক। বহরমপুরের বসতবাড়িতে তাঁর পূর্ব-পুরুষদের মধ্যেও পড়াশোনার চর্চা ছিল, যার উল্লেখ শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় ‘পৈতৃক পাঠাগার’ হিসেবে পাওয়া গেছে। রামদাসের জিজ্ঞাসু মনের তাগিদ সেই পাঠাগারকেই আরও সমৃদ্ধ করেছে এবং এতটাই যে, তাঁর জীবদ্দশাতেই তা মুর্শিদাবাদের অন্যান্য ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য স্থানের মতোই দর্শনীয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক স্থানগুলির পাশাপাশি রামদাস সেনের লাইব্রেরিটিও পর্যটকদের মুখে মুখে ফিরত। কথিত আছে, ‘হাজারদুয়ারী, লক্ষ্মীপত্ বাবুর বাগানবাড়ি, নসীপুর রাজবাড়ি আর রামদাস সেনের লাইব্রেরি’ এই চারটি নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হতো। ‘মুর্শিদাবাদ হিতৈষী’ পত্রিকা থেকেও জানা যায়, সে সময় পর্যটকদের মূল দ্রষ্টব্য ছিল নিজামত-প্রসাদ, কাঠগোলা বাগান এবং রামদাস সেনের লাইব্রেরি। আর শোনার বিষয় ছিল মহারানি স্বর্ণময়ীর নাম, গঙ্গাধর কবিরাজের প্রতিভা এবং রামদাস সেনের বিদ্যোৎসাহিতা। লক্ষণীয় যে, রামদাস সেন সম্পর্কে দুটি মাত্রা যোগ হয়েছে: তাঁর লাইব্রেরি দেখার বিষয় এবং তাঁর বিদ্যোৎসাহিতা শোনার বিষয়।
একটি ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার কেন সাধারণের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, তা একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন। সম্ভবত কলকাতা ও মুর্শিদাবাদের বিদ্বজ্জনদের দ্বারাই দ্রষ্টব্যের তালিকায় এই সংযোজন হয়েছিল। কারণ একটি গ্রন্থাগার শুধু দেখার জন্য নয়, বরং সংগৃহীত বইয়ের মধ্যে নিজের প্রয়োজনীয় বই খুঁজে বের করে পড়ার মধ্যেই তার সার্থকতা নিহিত। স্বভাবতই মনে হয়, জনশ্রুতির মধ্যে এই সংযোজন তাঁদের দ্বারাই ঘটেছে, যাঁরা এই গ্রন্থাগার ব্যবহার করতেন এবং সেখানে সারস্বত আলোচনায় যুক্ত থাকতেন।
রামদাস বিত্তশালী ভূস্বামী ছিলেন। সে যুগের প্রেক্ষিতে তাঁর মতো ধনাঢ্য ব্যক্তির সাহিত্যচর্চায় আগ্রহ একটি ব্যতিক্রমী ব্যাপার ছিল। তাঁর অন্যতম শিক্ষক পণ্ডিত রামগতি ন্যায়রত্ন তাঁর ‘বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৭৪ খ্রি.) গ্রন্থের ভূমিকায় রামদাসের গ্রন্থাগারের অকৃপণ সাহায্যের কথা স্বীকার করে বলেছেন, “তিনি নিজ ভবনে একটি উৎকৃষ্ট পুস্তকালয় স্থাপন করিয়াছেন, সংস্কৃত ও বাঙ্গালা যে সকল পুস্তক ক্রয় করিতে পাওয়া যায়, সেই সকল পুস্তকই প্রায় ঐ পুস্তকালয়ে সংগৃহীত হইয়াছে”।
সত্যিই রামদাসের বই সংগ্রহের নেশা ছিল প্রবল। তাঁর গ্রন্থাগারটি পূর্ববর্তী সময়ে এবং সমসময়ে প্রকাশিত দুষ্প্রাপ্য বহু সংস্কৃত, বাংলা ও ইংরেজি বইয়ের এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার ছিল। মেজর ওয়ালশও তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “He was an indefatigable collector of old and rare books, both Sanskrit and Bengali, and his library is still one of the best owned by a private gentle man.” নিখিলনাথ রায়ও উল্লেখ করেছেন যে, “বাল্যকাল হইতে তাঁহার ইংরাজী ও বাঙ্গালা পুস্তক সংগ্রহ করিবার ইচ্ছা ছিল। বাঙ্গালা পুস্তক বা সংবাদপত্র ভালোই হউক বা মন্দই হউক, বটতলার বাজে পুস্তক এবং খ্রীষ্টানদের বাঙ্গালা পুস্তক পর্য্যন্ত তাঁহার পুস্তকাগারে স্থান পাইত।”
রামদাস সেনের সংগৃহীত বইগুলির একটি পরিচয় নিলে তাঁর বিশাল সংগ্রহের বৈচিত্র্য বোঝা যায়। তাঁর সংগ্রহে বিশুদ্ধ জ্ঞান ও তত্ত্ব-বিষয়ক অসংখ্য বই ছিল, যেমন: অগাস্ট কোঁতের পজিটিভিজম্, জন স্টুয়ার্ট মিলের হিতবাদ ও যুক্তিবাদ বিষয়ক বই, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনূদিত ‘Ontology’, ডারউইন-এর মূল গ্রন্থ সহ বিবর্তনবাদের উপর রচিত বিভিন্ন বই, মনোবিদ্যা ও নীতিবিদ্যা-সংক্রান্ত পাশ্চাত্ত্য দার্শনিকদের লেখা নানা বই, ১৮৮১ ও ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের Hibbert Lectures-এর বই, বাংলা ও ভারতের দুর্ভিক্ষ-মহামারী-মন্বন্তর-বিষয়ক রিপোর্ট, মধ্যপ্রাচ্যের সভ্যতা-সংস্কৃতি ও প্রত্নতত্ত্ব-বিষয়ে মিশর, ব্যাবিলন, সিরিয়া প্রভৃতি দেশের উপর ক্রম-ভিত্তিক বেশ কিছু বই, দেশ-বিদেশের মিথ্-সংক্রান্ত নানা বই, পাশ্চাত্ত্য ও ভারতীয় দর্শনের বিপুল সংগ্রহ, ইতিহাস ও ধর্ম-বিষয়ক নানা বই, ইন্দ্রজাল ও সম্মোহনী-বিদ্যার উপর বিভিন্ন বই, এবং আবিশ্ব-সংগৃহীত বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের উপর অধিকাংশ গবেষণাধর্মী বই। এছাড়াও, উমাপতি মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রেম করা বিষম দায়’ নাটক, রাধামাধব মিত্রের ‘বনিতা-মরণ খেদের কারণ’, গোবিন্দচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কুলীন কুলাঙ্গনা কাব্য’, প্যারীমোহন সেনের ‘মাথা নাই তার মাথা ব্যথা’, শ্যামাচরণ সান্যাল-এর ‘হদ্দ মজা রবিবার’ (প্রহসন) প্রভৃতি বিচিত্র স্বাদের বইও তাঁর সংগ্রহে ছিল। আবহাওয়া বিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, মানববিদ্যা, আইনশাস্ত্র, সংগীতশাস্ত্র, ভূতত্ত্ব, আয়ুর্বেদ প্রভৃতি জ্ঞানের নানান শাখার উপর গ্রন্থও তাঁর সংগ্রহে স্থান পেয়েছিল।
রামদাসের সমকালীন পত্র-পত্রিকা সম্পর্কেও প্রবল আগ্রহ ছিল। তিনি তাঁর সময়ে প্রকাশিত ও প্রচারিত প্রায় সমস্ত পত্র-পত্রিকারই গ্রাহক ছিলেন। ‘বসুমতী’ পত্রিকার তথ্যমতে, ১৮৮৬ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকার গ্রাহক তালিকায় দেখা যায়, বিনামূল্যে যে আঠারোজন স্বনামখ্যাত বাঙালিকে সৌজন্যসংখ্যা দেওয়া হতো, রামদাস সেন তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন। এই তালিকায় ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি বিদ্যাসাগর, বিহারীলাল চক্রবর্তী, রাজনারায়ণ বসু, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন, জানকীনাথ ঘোষাল প্রমুখ সমকালীন প্রথম সারির পণ্ডিত-মনীষীরাও ছিলেন, যা রামদাসের সমসাময়িক বিদ্বৎসমাজে উচ্চ স্থান নির্দেশ করে।
এই বিপুল গ্রন্থসম্ভার এবং সেগুলির বিষয়-বৈচিত্র্য লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় কেন গঙ্গাধর কবিরাজ, রামগতি ন্যায়রত্ন, কালীবর বেদান্তবাগীশ, শ্যামধন মুখোপাধ্যায়, স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র এবং পরবর্তীকালে শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও নিখিলনাথ রায় এই গ্রন্থাগারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং এর সপ্রশংস উল্লেখ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের নির্মাণ-পর্বে এই গ্রন্থাগারটির সরব ভূমিকা তাই বিস্মরণীয় নয়।
মুর্শিদাবাদে গ্রন্থাগারের ঐতিহ্য বিরল ছিল না। বড়ো জমিদার-রাজা-মহারাজ-নবাব-বাড়িতে পারিবারিক আভিজাত্যের নিদর্শন হিসেবে একটি করে গ্রন্থাগার থাকত। তবে রামদাসের গ্রন্থাগারটির গুণগত পার্থক্য ছিল। সেন বংশ কোনো রাজবংশ ছিল না, এবং তাঁদের বার্ষিক আয়ের জমিদারির প্রেক্ষিতে একটি এত বড় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা কেবল পারিবারিক বিদ্যোৎসাহিতা এবং রামদাসের ব্যক্তিগত উৎসাহ, উদ্যম ও অনুরাগ ছাড়া সম্ভব ছিল না। রাজবাড়ির গ্রন্থাগারগুলি অনেক সময় আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, রামদাসের গ্রন্থাগারের বইগুলি কালীবর, রামগতি, শ্যামধন এবং অন্যান্য বিদ্বজ্জনদের স্পর্শে সচল ও সৃষ্টিশীল জ্ঞানের উপকরণ ছিল।
‘বঙ্গদর্শন’ ও রামদাসের গ্রন্থাগার:-
রামদাসের গ্রন্থাগার সম্পর্কে স্থানীয় সূত্র-সমর্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, এটিই ‘বঙ্গদর্শন পত্রিকা’ প্রকাশের পরিকল্পনার সূতিকাগার ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে প্রশাসনিক কাজে বহরমপুরে আসেন এবং ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন। এই পদে তিনি ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৩ মে পর্যন্ত ছিলেন। সে সময় বহরমপুর কলেজ, আদালত ও প্রশাসনিক দপ্তরের সুবাদে সেখানে নক্ষত্র-সমাবেশ ঘটেছিল। তিনটি উপন্যাসের রচয়িতা হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র এই সমাবেশের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন। এই সমাবেশের জন্য উপযুক্ত স্থান ছিল গ্রান্ট হল ক্লাব, মুর্শিদাবাদ হিতৈষী সভা, জজ-কাছারির সেরেস্তাদার বৈকুণ্ঠনাথ নাগের বাড়ি এবং রামদাস সেনের গ্রন্থাগার।
রামদাসের গ্রন্থাগারটি ছিল বঙ্কিমের অত্যন্ত প্রিয় স্থান। রামদাসের মতো একজন বিনয়ী, বিদগ্ধ, মাতৃভাষা-প্রেমী ও স্থিতধী ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য ও উৎসাহ যেকোনো সৃষ্টিকর্মেরই পরিপোষক। স্বভাবতই ‘বঙ্গদর্শন পত্রিকা’-র পরিকল্পনার সময় থেকেই রামদাস বিষয়টি নিয়ে জড়িত ছিলেন। ‘বঙ্গদর্শন’-এর প্রচার-সম্পর্কিত প্রথম বিজ্ঞাপনে সাতজন লেখকের নাম (দীনবন্ধু মিত্র, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, জগদীশনাথ রায়, তারপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, রামদাস সেন, অক্ষয়চন্দ্র সরকার) উল্লিখিত হয়েছিল, যার মধ্যে রামদাস সেন একজন। যদিও প্রথম সংখ্যায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়নি, তবুও তিনি পত্রিকার একজন নিয়মিত লেখক হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব-বিষয়ক প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে পাঠক মনকে সমৃদ্ধ করেছেন।
নিখিলনাথ রায় তাঁর ‘মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ও সাহিত্য’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, “বঙ্কিমচন্দ্র বহরমপুরে আসিলে রামদাস ও অক্ষয়চন্দ্রের চেষ্টায় ‘বঙ্গদর্শন’ প্রচারিত হয়।” অক্ষয়চন্দ্র সরকারও লিখেছেন, “মধ্যবর্তিনী ভাষা প্রচারের সূচনা হইতেই ‘বঙ্গদর্শন’-প্রচারের সূচনা আরম্ভ হইল। কতদিন কত জল্পনা চলিতে লাগিল।” এই ‘জল্পনা’ রামদাসের লাইব্রেরিতেই হওয়া সম্ভব বলে মনে করা হয়। শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও একই মত পোষণ করে লিখেছেন, “যে সময় বঙ্কিমচন্দ্র বহরমপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সেই সময়েই একদা রামদাস বাবুর বৈঠকখানায় সর্বপ্রথম ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশের প্রসঙ্গ হইয়াছিল।”
বস্তুত, বঙ্কিম-বঙ্গদর্শন-বহরমপুর-রামদাস একই শৃঙ্খলে গাঁথা। ‘বঙ্গদর্শন’-এর জন্য জমা পড়া লেখাগুলোও বঙ্কিম বহরমপুরেই সম্পাদনা করতেন। সম্পাদনার মতো কাজের জন্য যে নিভৃত, সমাহিত, বই-গন্ধী পরিবেশ প্রয়োজন, তা রামদাসের গ্রন্থাগারেই লভ্য ছিল। কাজেই রামদাসের লাইব্রেরির সঙ্গে ‘বঙ্গদর্শন’-এর যোগসূত্র অস্বীকার করা যায় না।
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি বহরমপুর থেকে বঙ্কিমচন্দ্র ‘মুখার্জিস্ ম্যাগাজিন’-এর সম্পাদক শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, “There are three good libraries in Berhampore, and I have got the books I wanted, but have seen unable to make the use of them I intended from (want) of time.” সন্দেহ নেই, বঙ্কিম-কথিত বহরমপুরের এই তিনটি উন্নতমানের লাইব্রেরির একটি অবশ্যই রামদাস সেনের গ্রন্থাগার। অপর দুটি সম্ভবত জেলা কালেক্টরেট গ্রন্থাগার এবং বহরমপুর কলেজ গ্রন্থাগার।
বৃহৎ বাংলার বৃহত্তম গ্রন্থাগার হিসেবে রামদাস সেনের গ্রন্থাগারটি তাঁর সমসময়েই স্বীকৃতি পেয়েছিল। বিদ্যাসাগরের মতো বই-প্রেমী মনীষীও তাঁর গ্রন্থাগারের সমৃদ্ধ সঞ্চয়ের অকুণ্ঠ প্রশংসা করে রামদাসকে চিঠি লিখেছেন। রামদাসের আকস্মিক মৃত্যুর পর ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-য় প্রকাশিত প্রশস্তিও তাঁর গ্রন্থাগারের সপ্রশংস উল্লেখ করেছে: “He has left a library the like of which is perhaps not to be seen in whole Bengal.”
রামদাসের গ্রন্থাগারের অন্দরসজ্জা ছিল পাশ্চাত্ত্য শিল্প ও ভারতীয় ধ্রুপদী শিল্পের মিশ্রণ-জাত। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খুবই শৌখিন ছিলেন, যার পরিচয় রয়েছে তাঁর গ্রন্থাগারের আসবাবপত্রে এবং বইয়ের মধ্যে মুদ্রিত সিলমোহরেও। উল্লেখযোগ্য হলো, তাঁর গ্রন্থাগারের তিনটি ঘরের একটি ছিল প্রত্নতাত্ত্বিক নানা নিদর্শনের সংগ্রহশালা। ঘরটির চারদিকের দেওয়াল নানা বর্ণের মিনে করা নক্সা এবং ফ্রেস্কো-র চিত্রণে চিত্রিত ছিল। দেশ-বিদেশ থেকে সংগৃহীত নানা প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুর সাথে এখানে পলাশীর যুদ্ধের অব্যবহৃত একটি কামানের গোলা ও বন্দুকের গুলিও ছিল।
রামদাসের বইগুলিতে ব্যবহৃত সিলমোহর থেকে তাঁর গ্রন্থপ্রীতি স্পষ্ট হয়। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের কিছু বইতে ব্যবহৃত গোলাকার সিলটি কালো পশ্চাৎপটে সাদা অক্ষরের লেখা ছিল, যা তখনকার রাজা-জমিদারদের ইংরেজি ভাষার সিলের তুলনায় বাংলায় লেখা হওয়ায় ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। পরবর্তীকালে ব্যবহৃত গোলাকৃতি সিলের মাঝখানে শিং-বিশিষ্ট একটি হরিণের মুখ ছিল, যা বুদ্ধদেবের মৃগদাব-এর প্রতীকী তাৎপর্য বহন করে এবং রামদাসের বুদ্ধ-অনুরক্তির পরিচয় দেয়।
রামদাস সেনের বইগুলি থেকে তাঁর পাঠ-পদ্ধতিরও একটি সূত্র পাওয়া যায়। কোনো বইয়ের সূচনা অংশে লেখা থাকত ‘৪২ পৃষ্ঠা একদিন’, বা ‘৩৮ পৃষ্ঠা একদিন’ কিংবা ‘১৭৪ পৃষ্ঠা ৪ দিন’ ইত্যাদি। এই তথ্যগুলো থেকে বোঝা যায়, রামদাস সুশৃঙ্খলভাবে তাঁর গ্রন্থাগার পরিচালনা করতেন এবং গবেষকরা শুধু পড়াশোনা করতেন না, সাধারণ গ্রন্থাগারের মতো বই নেওয়া ও ফেরত দেওয়ার বিষয়টিও এখানে প্রচলিত ছিল। এমনকি, কলকাতার বিভিন্ন লাইব্রেরির সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল।
রামদাসের গ্রন্থাগারের এই চলমান সজীবতা তাঁর মৃত্যুর পরও দীর্ঘকাল অব্যাহত ছিল। তাঁর সুবিশাল সংগ্রহের অবশিষ্টাংশ, প্রায় সাড়ে তিন হাজার (৩৫০০) বই, তাঁর উত্তরসূরি অনুত্তম সেন ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে দান করেন। এই সংগ্রহে দুষ্প্রাপ্য মুদ্রিত পুস্তক ছাড়াও ৭৫ খানি বাংলা ও সংস্কৃত হস্তলিখিত পুঁথিও রয়েছে, যার মধ্যে উল্টের মন্ত্রভাষ্য এবং শ্রীধর দাস-রচিত সূক্তিকর্ণামৃত বা সদুক্তিকর্ণামৃতের সুপ্রাচীন পুঁথি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও, ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে রেনেল-কৃত বাংলার মানচিত্রটিও এই সংগ্রহে আছে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রামদাসের জন্মশতবর্ষ উদযাপনে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রামদাস সেনের গ্রন্থাগারকে “rich collection of books on Indian antiquities” এবং “opportunity to young, aspiring scholars to carry on the work of original investigation started by him” হিসেবে বর্ণনা করেন।
বিদ্যোৎসাহিতা ও জনকল্যাণ:-
রামদাস কেবল শিক্ষিত ও পরিশীলিত মনের অধিকারী ছিলেন না, তাঁর বিদ্যোৎসাহিতা ছিল প্রায় প্রবাদের মতো। রানি স্বর্ণময়ীর পুণ্যময়ী নাম, গঙ্গাধর কবিরাজের প্রতিভা এবং রামদাস সেনের বিদ্যোৎসাহিতা এক সময় বহরমপুর-বাসীর মুখে মুখে ফিরত। মহেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্গভাষার ইতিহাস’ গ্রন্থে রামদাসের বিদ্যোৎসাহিতা, প্রকাশনা-ক্ষেত্রে সাহায্য দান এবং পত্র-পত্রিকা ও গ্রন্থ-সংগ্রহের দ্বারা লেখক ও প্রকাশকদের সাহায্য করার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। দুঃসময়ে বহু লেখকও তাঁর সাহায্য পেয়েছিলেন। শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘মুর্শিদাবাদ কথা’-য় জানিয়েছেন যে, কোনো পত্রিকা-সম্পাদক বা গ্রন্থকার সাহায্যপ্রার্থী হলে রামদাস তাঁদের কখনও বিমুখ করতেন না। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো বিখ্যাত কবিও আর্থিক সাহায্যের জন্য রামদাসকে চিঠি লিখেছিলেন, যা তাঁর বিদ্যোৎসাহিতা ও উদারতার প্রমাণ।
রামদাসের বিচক্ষণতা এবং ঔদার্যের যুগপৎ পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর মাইকেল মধুসূদনকে সাহায্যের ঘটনায়। মাইকেলের মতো বুভুক্ষা শান্ত করতে অনেককেই প্রবঞ্চিত হতে হয়েছিল। সাত হাজার টাকা ধার দিলে তা ফিরিয়ে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। জেল বাঁচিয়ে সাহায্য করে নিজে আবার জেলে দিলে আত্মপ্রসাদ লাভ হতো না। সাত হাজার টাকা দান করা রামদাসের সাধ্য ছিল না, এবং দিলেও মাইকেলের ব্যভিচারের প্রসার ও জীবনশক্তির ক্ষুণ্ণতা সাধন করা হতো। রামদাস সাধ্যমতো সাহায্য করে উভয় সঙ্কটে নিষ্কৃতি লাভ করেছিলেন।
রামদাসের গ্রন্থাগার গবেষক ও লেখকদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। রামগতি ন্যায়রত্ন, শ্যামধন মুখোপাধ্যায়, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং নিখিলনাথ রায় প্রমুখের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, যারা এই গ্রন্থাগার থেকে উপকৃত হয়েছিলেন। শ্যামধন মুখোপাধ্যায়ের ‘মুর্শিদাবাদের ইতিহাস’, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মুর্শিদাবাদ কথা’ এবং নিখিলনাথ রায়ের ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ ও ‘মুর্শিদাবাদের ইতিহাস’ প্রভৃতি আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার পথিকৃৎ গ্রন্থ নির্মাণে রামদাসের বিদ্যোৎসাহিতা এবং তাঁর গ্রন্থাগারের ঐতিহাসিক ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বাঙালি তথা ভারতীয়কে নিজেদের অস্তিত্ব, নিজেদের অতীত ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করার প্রয়োজনে রামদাস স্বরচিত প্রবন্ধের পুস্তিকা ছাপিয়ে বিনামূল্যে বিতরণ করতেন। ‘ভারতবর্ষের পুরাবৃত্ত সমালোচন’, ‘মহাকবি কালিদাস’ এবং বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে তাঁর বক্তৃতা-নিবন্ধ ‘A Lecture on modern Buddhistic Researches’ এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। একই প্রেরণায় তিনি মদনমোহন তর্কালঙ্কার-এর ‘বাসবদত্তা’, জৈনাচার্য হেমচন্দ্র-রচিত প্রসিদ্ধ জৈন কোষগ্রন্থ ‘অভিধান চিন্তামণি’ এবং ‘অগস্তিমতম্’ নামে রত্নশাস্ত্র নিজ ব্যয়ে পুনর্মুদ্রিত করেন। মদনমোহন-এর ‘বাসবদত্তা’-র শুধু প্রকাশই নয়, সেই বই-এর বিক্রিলব্ধ অর্থে প্রয়াত মদনমোহনের পরিবারের সাহায্যের ব্যবস্থাও করেছিলেন রামদাস।
তাঁর সংস্কৃত-শিক্ষক শ্রী কালীবর বেদান্তবাগীশ, যিনি মূলত রামদাসের অর্থানুকূল্যে কাশীতে উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন করেছিলেন, তিনি তাঁর প্রথম রচনা ‘অকালকুসুম’ (১৮৬৯) নামক উপন্যাসটি রামদাসকে উৎসর্গ করে তাঁর কৃতজ্ঞতাকে অমর করে রেখেছেন। মেজর ওয়ালশ রামদাসের এই বিদ্যোৎসাহিতা ও উদারতার প্রশংসা করে বলেছেন, “He was a sincere and sympathetic friend to poor Indian scholars, and a warm philanthropist.”
রামদাসের বিদ্যোৎসাহিতার পিছনে তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য এবং তাঁর প্রখ্যাত গৃহশিক্ষকদের প্রভাবও ছিল। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে, যখন তাঁর বয়স মাত্র আট-নয় বছর, তখন বহরমপুর কলেজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর নাম পাওয়া যায় এবং তিনি পাঁচশত টাকা দান করেছিলেন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে কলেজের ছাত্রদের বিশেষ পুরস্কার বিতরণের জন্য তিনি দশ টাকা দান করেন এবং ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে কলেজের আর্থিক প্রয়োজনে একশো টাকা দান করেন। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দেই মদনমোহন তর্কালঙ্কার-এর স্ত্রী শ্রীমতী মুক্তকেশী দেবী ‘বাসবদত্তা’-র স্বত্ব রামদাসকে অর্পণ করেন, এবং রামদাস সেই বইয়ের বিক্রিলব্ধ অর্থ মৃত কবির স্ত্রীকে দেওয়ার অঙ্গীকার করে বিজ্ঞাপন দেন। এই ঘটনাগুলো তাঁর আট থেকে আঠারো বছর বয়সের মধ্যেকার বিদ্যোৎসাহিতার প্রমাণ।
রামদাসের বিদ্যোৎসাহিতা এবং শিক্ষার প্রসারে তাঁর অসামান্য দূরদর্শিতার এক অকাট্য প্রমাণ মেলে ক্ষীরোদচন্দ্র রায়-এর লেখায়। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে হ্যান্ড সাহেবের অধীনে বহরমপুর কলেজের পরিচালন-ব্যবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠলে ইংরেজ সরকার কলেজটি উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। সেসময় রামদাস সেন কৃষ্ণদাস পালের সাহায্যে ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ ও অন্যান্য পত্রিকায় এমন আন্দোলন উপস্থিত করেন যে, সরকার কলেজ উঠিয়ে দিতে সাহস পায়নি। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আবার যখন কলেজের অবস্থা খারাপ হয় এবং সরকার কলেজ বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করে, তখন রামদাস সাধারণের পক্ষে প্রস্তাব করার জন্য ‘পীড়াপীড়ি’ করা হলেও মহারানি স্বর্ণময়ীর প্রস্তাবে সম্পূর্ণ অনুমোদন করেন। তাঁর এই দূরদর্শিতা, ঔদার্য এবং যথার্থ শিক্ষাবিদ-সুলভ মানসিকতার ফলেই তিনি বহরমপুর কলেজের বোর্ড অব ট্রাস্টীর সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন।
জনকল্যাণে আত্মনিয়োগ রামদাস সেনের পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল। তাঁর পূর্বপুরুষ কৃষ্ণকান্ত সেন উত্তর-কলকাতায় দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিটে শ্রীশ্রী শ্যামসুন্দর জিউ-র মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা আজও বিদ্যমান। কৃষ্ণকান্তের অগ্রজ কৃষ্ণগোবিন্দ সেন বহরমপুরে সর্বসাধারণের জন্য শ্রীশ্রী রাধা-গোবিন্দজীর মন্দির নির্মাণ করেন। কৃষ্ণগোবিন্দের তৃতীয় পুত্র রাধামোহন বৃন্দাবনে শ্রীশ্রী বলদেবজীর মন্দির ও ধর্মশালা প্রতিষ্ঠা করেন এবং জনসাধারণের পানীয় জলের অভাব মেটাতে কয়েকটি কূপ খনন করেছিলেন। কৃষ্ণগোবিন্দের পঞ্চম পুত্র ভুবনমোহন জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে জনসেবায় ‘সদাব্রত’ প্রচলন করে একটি অতিথিশালা ও ধর্মশালা স্থাপন করেন, যা তাঁর বংশধররা উনিশ শতকের শেষভাগেও পরিচালনা করতেন। পুলিনবিহারী সেন ‘পুলিনবিহারী শবদাহ ঘাট’ নির্মাণ করেন এবং শ্রীবনবিহারী সেনও জনকল্যাণের জন্য খ্যাত ছিলেন।
রামদাস সেন নিজেও প্রজাহিতৈষী, সংবেদনশীল জমিদার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। শ্রীশচন্দ্র জানিয়েছেন, “…তাঁহার সুবিস্তৃত জমিদারীর প্রজাবর্গ আপনাদিগকে রামরাজ্যের প্রজা বলিয়া মনে করিত।” বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বিস্তৃত তাঁর জমিদারির মধ্যে শিক্ষা-বিস্তার এবং পীড়িতদের চিকিৎসার জন্য তিনি অকাতরে অর্থব্যয় করতেন। পীড়িত প্রজাদের মধ্যে ওষুধ বিতরণ, দূরবর্তী রোগীদের পথ্য ও পাথেয় দান প্রভৃতির ফলেই তিনি প্রজারঞ্জক জমিদার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর খ্যাতির প্রসার ও গভীরতা এতটাই ছিল যে, ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর এগারো বছর পর বাংলার ছোটোলাট স্যার আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জী বহরমপুর পরিদর্শনে এসে তাঁকে ‘An ornament of the District’ বলে উল্লেখ করেছেন।
বিদেশি সমাদর ও প্রাপ্ত পদ-সম্মান:-
রামদাসের প্রত্নতত্ত্ব-চর্চা বিদেশেও সমানভাবে সমাদৃত হয়েছিল। তাঁর উন্নতমানের গবেষণা পাশ্চাত্ত্য গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার, ড. বেবার, কাউন্ট অ্যাঞ্জেলো-ডি-গাবারনেটিস প্রমুখ প্রাচ্যবিদদের সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিল। পণ্ডিত ম্যাক্সমূলার রামদাসের রচনার অনুরাগী ছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে পত্র-বিনিময়ের মতো ঘনিষ্ঠতা ছিল। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে অনুষ্ঠিত ‘ইন্টার ন্যাশনাল কংগ্রেস অব্ ওরিয়েন্টালিস্টস্’-এর দ্বিতীয় অধিবেশনে অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার কৃতী ভারততত্ত্ববিদদের মধ্যে রামদাসের নাম উল্লেখ করেন। এই সংস্থারই পঞ্চম অধিবেশনে (বার্লিন, ১৮৮১ খ্রি.) রামদাস আমন্ত্রিত হয়েছিলেন এবং একটি সংস্কৃত কবিতা রচনা করে পাঠিয়েছিলেন, যা লন্ডনের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার প্রয়োজনে এবং দেশ-ভ্রমণের ইচ্ছায় ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে রামদাস ইউরোপ ভ্রমণ করেন। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং ইতালি তাঁর ভ্রমণ-সূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্যারিসে থাকাকালীন তিনি মনীষী লেখক ভিক্টর হুগোর ঐতিহাসিক শবযাত্রা প্রত্যক্ষ করেন। পরবর্তীকালে তাঁর বিদেশ-ভ্রমণের এই অভিজ্ঞতা ‘বাঙ্গালীর ইউরোপ দর্শন’ নামে একটি মনোরম ভ্রমণ-কাহিনিতে লিপিবদ্ধ হয়।
লন্ডন অ্যাকাডেমি ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে ২৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর ‘ঐতিহাসিক রহস্য’ গ্রন্থটির জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানায়। ‘ঐতিহাসিক রহস্য’ বইটি রামদাস অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর গবেষণাধর্মী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ইতালির ফ্লোরেন্স নগরের ওরিয়েন্টাল অ্যাকাডেমি তাঁকে ‘ডক্টর’ অভিধায় ভূষিত করে। ইতালির এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে ‘ডিপ্লোমা’ দিয়ে সম্মানিত করে। ইতালীয় অভিধান ‘Dizionario Biografico Degli Serittori Contemporanei’ (১৮৭৯)-তে রামদাসের প্রতিকৃতি-সহ তাঁর সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ মুদ্রিত হয়। মুর্শিদাবাদ জেলায় রামদাস সেন-ই প্রথম সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রির অধিকারী।
রামদাস দেশি-বিদেশি বহু প্রতিষ্ঠানের সম্মানীয় সভ্যপদ অলংকৃত করেছিলেন। দেশীয় সংস্থাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: এশিয়াটিক সোসাইটি অব্ বেঙ্গল, দি এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড হটিকালচারাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া, দি ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব্ বেঙ্গল, দি থিওসোফিক্যাল সোসাইটি, এবং কলকাতা জ্যুলজিক্যাল গার্ডেনের আজীবন সদস্য। স্থানীয়ভাবে তিনি অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট, মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার, বহরমপুর কলেজের বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য, বহরমপুর বঙ্গ বিদ্যালয়ের সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ, বহরমপুর দাতব্য সভার সম্পাদক, বহরমপুর উন্মাদ হাসপাতালের পরিদর্শক এবং ‘মুর্শিদাবাদ সভা’র সম্পাদক ছিলেন। বিদেশি সংস্থাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: দি স্যান্‌স্ক্রিন্ট টেক্সট্ সোসাইটি অব্ লন্ডন, দি অ্যাকাডেমিআ ওরিয়েন্টাল অব্ ফ্লোরেন্স, দি সোসাইটা এশিয়াটিকা ইটালিয়ানা অব্ ইতালি, দি রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব গ্রেট ব্রিটেন, এবং দি ওরিয়েন্টাল কংগ্রেস অব্ লন্ডন।
ক্ষীরোদচন্দ্র রায় জানিয়েছেন, এই সমস্ত সংস্থার সভ্য হিসেবে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ ও পালন করতেন। তিনি কোনো সভার নীরব সভ্য বা অলঙ্কারমাত্র থাকতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। গ্রন্থকার ও পত্রিকা সম্পাদকদের সাথে, দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, গণ্যমান্য অগ্রণীদের সাথে, বিদেশীয় সাহিত্য-আচার্যদের সাথে এবং বিখ্যাত রাজপুরুষদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সর্বদা পরামর্শ ও আন্দোলন করতেন। বহরমপুর-বাসীর কাছে তাঁর এহেন ব্যক্তিত্বের প্রতিনিধিত্ব স্বাভাবিকভাবেই কাম্য ছিল। তাই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারামুক্তির দিনে (১৮৮৩ খ্রি.) বহরমপুর তথা মুর্শিদাবাদের প্রতিনিধি হিসেবে সহমর্মিতা ও আনন্দ প্রকাশের জন্য রামদাস প্রেরিত হয়েছিলেন। কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনেও (১৮৮৬ খ্রি.) তিনি মুর্শিদাবাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। ‘Bengal Tenancy Bill’ (১৮৮৫)-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুর্শিদাবাদের জমিদারদের প্রতিনিধি হয়েও কলকাতার জমিদার-সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন। এই বিষয়গুলি মুর্শিদাবাদ-বাসীর কাছে তাঁর সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার নিদর্শন।
মৃত্যু ও স্মৃতিতর্পণ:-
১২৯৪ সালের ৩ ভাদ্র (১৯ অগাস্ট, ১৮৮৭ খ্রি.) শুক্রবার, মাত্র ৪২ বছর বয়সে, নদিয়া জেলার হাটবোয়ালিয়া গ্রামে জমিদারি পরিদর্শনের সময় রামদাস হঠাৎই সন্ন্যাস রোগে (Apoplexy) আক্রান্ত হয়ে সম্পূর্ণ নির্বান্ধব অবস্থায় মারা যান। সেসময় ওই প্রত্যন্ত গ্রামে দক্ষ চিকিৎসক ছিল না। মেডিকেল কলেজের তৎকালীন খ্যাতনামা চিকিৎসক অধ্যাপক ড. কোট্‌স্-কে টেলিগ্রাম করে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়। পথ ও পরিবহন তখন সুগম না থাকায়, কলকাতা থেকে টেলিগ্রাম পাওয়া মাত্রই রওনা হয়েও ড. কোট্‌স্ সময়মতো ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারেননি। তাঁর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না; আলমডাঙা স্টেশনে মেল ট্রেন থামিয়ে তিনি বোয়ালিয়ায় উপস্থিত হয়েছিলেন, কিন্তু তার কিছুক্ষণ আগেই রামদাসের দেহান্ত হয়। চাকদহের গঙ্গাতীরে তাঁর মৃতদেহ সৎকার করা হয়। বহরমপুরে তাঁর মৃত্যু-সংবাদ প্রচারিত হলে বহরমপুর কলেজ, খাগড়া মিশনারি স্কুল-সহ অন্যান্য বিদ্যালয়গুলি একদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ রামদাসের মৃত্যুতে তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি-সহ একটি শোকার্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে তাঁকে “The Zamindar and savant of Berhampore” এবং “eminent Oriental Scholar, a learned antiquarian” হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পত্রিকা আরও লেখে, “His name will be remembered as long as the Bengali language ceases not to exist…”
ঐ বছরেই ৩ সেপ্টেম্বর ‘মুর্শিদাবাদ সভা’ বৈকুণ্ঠনাথ সেনের সভাপতিত্বে রামদাস সেনের স্মৃতিরক্ষায় তাঁর আবক্ষ মর্মর-মূর্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে অর্থ-সংগ্রহের জন্য একটি শাখা-সমিতি (Sub-committee) গঠন করে। কিন্তু দীর্ঘ সাত বছর অতিক্রান্ত হলেও এ বিষয়ে কাজ তেমন অগ্রসর হয়নি। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর আবার সভার বৈঠক বসে এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদে কমিটির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। রায়বাহাদুর মুকুন্দলাল বর্মণ ঐ কমিটির সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। মুকুন্দলালের সুচারু ব্যবস্থাপনায় অর্থ সংগৃহীত হয় এবং ইতালি থেকে রামদাসের একটি আবক্ষ প্রস্তর মূর্তি আনা হয়।
প্রস্তর মূর্তিটি তৈরি করেছিলেন ইতালীয় ভাস্কর সিপ্সর রন্ডনি (Signor Randoni)। সেসময়ের পূর্ববঙ্গ-বাসী বিখ্যাত চিত্রকর শশিকুমার হেস্ তখন রোমে বাস করতেন এবং তিনিই বিশেষ যত্নের সঙ্গে মূর্তিটি ভারতবর্ষে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুলাই মুকুন্দলালবাবুর মৃত্যু হয়। তখন কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর অনুমতি-ক্রমে তাঁকে বাবু মুকুন্দলালের স্থলাভিষিক্ত করা হয় এবং মূর্তি-প্রতিষ্ঠার সর্বময় কর্তৃত্ব মণীন্দ্রচন্দ্রকেই অর্পণ করেন ‘মুর্শিদাবাদ সভা’। মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর অনুরোধে সে-সময়ের ছোটোলাট (Lieutenant governor) স্যার জন উচ্ছ্বার্ন (কে. সি. এস. আই.) রামদাসের মর্মর মূর্তির আবরণ উন্মোচনে সম্মত হন।
স্মৃতিরক্ষা-কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর সাহেবের সম্মতিক্রমে রামদাস সেনের আবক্ষ মূর্তিটি কৃষ্ণনাথ কলেজের সামনের দিকে উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে স্থাপিত হয়। এই স্থান-নির্বাচন তাঁর শিক্ষানুরাগকে সশ্রদ্ধ সম্মান জানিয়েছে। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১ আগস্ট স্যার জন উচ্ছ্বার্ন এই মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেন। সমারোহপূর্ণ এই অনুষ্ঠানে প্রশাসনিক ব্যক্তিত্বরা ছাড়াও ‘মুর্শিদাবাদ-সভা’র পক্ষে কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, রামদাস সেনের তিন পুত্র মণিমোহন সেন, হিরণ্ময় সেন ও বোধিসত্ত্ব সেন, তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রাধিকাচরণ সেন (মুর্শিদাবাদ সভার তৎকালীন সভাপতি) বিষ্ণুচরণ সেন, নিতাইচরণ সেন, শ্রীবনবিহারী সেন এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
প্রস্তর-মূর্তিটির নিচে ফলকে উৎকীর্ণ লেখাটি ছিল: “TO THE MEMORY OF Dr. RAMDAS SEN Born-Dec. 10th 1845 An eminent Oriental Scholar, a learned antiquarian, and a staunch friend of education. This bust is raised by his admiring and grateful friends, the people of the district of Murshidabad. Died-Aug. 19th 1887 Aug. Ist, 1899.”
ঢাকা সারস্বত সভার পণ্ডিত শ্রীজগদ্বন্ধু তর্কবাগীশ এই প্রতিমূর্তিটি দেখে একটি সংস্কৃত শ্লোকে রামদাসের গৌরব-গাথা প্রচার করেন।
রামদাস সেনের মৃত্যুর পর মূর্তি-স্থাপনের প্রস্তাব ও মূর্তি-প্রতিষ্ঠার মধ্যে প্রায় তেরো বছরের ব্যবধান ছিল। এই দীর্ঘসূত্রিতা শুধু বহরমপুরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যেই নয়, অন্যান্য স্থানের বিদগ্ধজন এবং রামদাসের গুণমুগ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যেও ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। বিশিষ্টজনদের ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে এবং সমসাময়িক পত্র-পত্রিকায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ‘চারু মিহির’, ‘বসুমতী’, ‘ইউনিটি অ্যান্ড দ্য মিনিস্টার’, ‘দ্য বেঙ্গলি’, ‘হোপ’, এবং ‘দ্য অমৃতবাজার পত্রিকা’ সহ বিভিন্ন পত্রিকা এই দীর্ঘসূত্রিতার সমালোচনা করে এবং রামদাসের প্রতি সঠিক সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানায়।
মৃত্যুর সময় রামদাস তাঁর তিন পুত্র ও তিন কন্যাকে রেখে যান। তাঁর জীবিতকালেই তাঁর কনিষ্ঠা কন্যার মৃত্যু হয়। ১৩০৬ সালে তাঁর স্ত্রী ও জ্যেষ্ঠা কন্যার মৃত্যু হয়। তাঁর পুত্র এবং জামাতারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। রামদাসের প্রথম পুত্র মণিমোহন সেন নিখিলনাথ রায়-সম্পাদিত ‘ঐতিহাসিক চিত্র’ পত্রিকায় ঐতিহাসিক প্রবন্ধ-লেখকদের অন্যতম ছিলেন। দ্বিতীয় পুত্র হিরণ্ময় সেন। তৃতীয় পুত্র বোধিসত্ত্ব সেনও ‘ঐতিহাসিক চিত্র’ পত্রিকায় ঐতিহাসিক প্রবন্ধ-লেখক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই বিদ্যোৎসাহী তিন ভাইয়ের অর্থসাহায্যে বারালা গ্রামে ‘বারালা রামদাস সেন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা আজও তাঁর স্মৃতি বহন করছে। মায়ের স্মৃতি রক্ষায় এঁরা একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও স্থাপন করেন। তাঁর প্রথম জামাতা ছিলেন রাজা ভূজঙ্গভূষণ রায়। দ্বিতীয় জামাতা প্রমথনাথ রায় (সাব রেজিস্টার)। তৃতীয় জামাতা ছিলেন শ্রী নিখিলনাথ রায়, যিনি বিখ্যাত ঐতিহাসিক ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’, ‘মুর্শিদাবাদের ইতিহাস’, ‘রাজপুত কুসুম’ (কাব্যগ্রন্থ), ‘কবিকথা’, ‘মরণ রহস্য’ (গল্পগ্রন্থ) ‘ইতিকথা’ (গল্পগ্রন্থ), ‘আত্মজীবনচরিত’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তিনি ‘ঐতিহাসিক চিত্র’, ‘শাশ্বতী’ এবং ‘পল্লীবাণী’ প্রভৃতি পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন।
প্রত্নতত্ত্বের অনুসন্ধানে এবং বাংলাভাষায় তার অনুশীলনে রামদাস সেন ছিলেন অন্যতম পথ-প্রদর্শক। তাঁর অকালমৃত্যু বাংলা সাহিত্যে তথা ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব-চর্চার ইতিহাসে এক বিরাট শূন্যতা এনে দিয়েছে। পুরাতত্ত্ব-ভিত্তিক প্রবন্ধ রচনায় মৌলিক সৃজনশক্তির অবকাশ না থাকলেও, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস-উদ্ধারে তাঁর নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি, আন্তরিক নিষ্ঠা এবং নিরলস পরিশ্রমের ফসল হিসেবে মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সেই যে বিপুল সাহিত্য-কীর্তি তিনি রেখে গেছেন, সর্বোপরি তাঁর ঐতিহ্যপ্রীতি ও স্বাজাত্যপ্রেম তাঁকে ভারতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে এক অনন্য আসনে প্রতিষ্ঠিত করবে।
গ্রন্থ সহায়তা :-
১) রামদাস সেন,সময়, জীবন ও সাহিত্য,  গৌরী ঘোষ, সোপান।
২)শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-মুর্শিদাবাদ কথা ৩য় খণ্ড।
৩)শ্রীভূপতি রায়চৌধুরী কাব্যতীর্থ-বহরমপুরের পূর্ববঙ্গাগত বঙ্গস্থ কায়স্থ সেনবংশ।
৪) রামদাস গ্রন্থাবলী ১ম ভাগ, ১৩১৬, ভূমিকা অংশ, মণিমোহন সেনাদি-কর্তৃক প্রকাশিত।
৫) Compiled and Edited by Major J. H. T. Walsh-A History of Murshidabad District, 1902, P. 227.
৬) ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্যসাধক চরিতমালা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৭১ অধ্যায়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ২য় সং, ৩য় মুদ্রণ, ১৩৮৮, পৃ.-৮।
৭) রামগতি ন্যায়রত্ন-‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’, ভূমিকা অংশ, ১৮৭৪,
৮)ড. রবীন্দ্র গুপ্ত-সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’, নির্বাচিত রচনা সংগ্রহ, জুলাই, ১৯৭৫
৯)K. N. College Centenary Vol. Chapter-3.
১০)মুর্শিদাবাদ হিতৈষী’ (বৈকুন্ঠনাথ সেন-সম্পাদিত),
১১). শশাঙ্কশেখর সান্যাল, ‘সঙ্গীতে বহরমপুর ও মুর্শিদাবাদ, ‘প্রবন্ধ সংকলন’।
১২) দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়, ‘ভারতের সঙ্গীতগুণী’, ১ম খণ্ড, ১৯৭৭।
১৩). মুর্শিদাবাদ কাহিনী, নিখিলনাথ রায়।

Author

  • Suman Kumar Mitra

    Suman Kumar Mitra is a Researcher at Murshidabad Zilla Itihas & Sanskriti Charcha Kendra. He did his MA in Bengali from Rabindra Bharati University and is a Guest Lecturer at D.I.E.T Murshidabad, Berhampur, West Bengal. Views expressed are personal.

    View all posts

(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)