ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাছে রাধাকমল মুখার্জি (১৮৮৯-১৯৬৮) লখনউ স্কুলের সোনালী অতীত এবং তার অসামান্য অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। বহুল আলোচিত লখনউয়ের ‘ত্রয়ী’ – ডি.পি. মুখার্জি এবং ডি.এন. মজুমদার – এর অপর দুই স্বনামধন্য সদস্যের সাথে রাধাকমল মুখার্জিকে সাধারণভাবে সমাজবিজ্ঞান এবং বিশেষ করে সমাজতত্ত্বের বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক ভূমিকা পালন করার জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে, তিনি তাঁর উজ্জ্বল শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে ফলপ্রসূ বছরগুলি লখনউতেই অতিবাহিত করেন। প্রথমে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে, তারপর লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে এবং পরবর্তীকালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের জে.কে. ইনস্টিটিউট অফ সোশিওলজি অ্যান্ড হিউম্যান রিলেশনস-এর আজীবন পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়, তিনি বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যা নিয়ে গবেষণামূলক কাজের এক ঈর্ষণীয় ভাণ্ডার তৈরি করেন।
তাঁর বহুমুখী অবদান শুধুমাত্র একাডেমিক পরিসরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। রাধাকমল মুখার্জি জওহরলাল নেহরুর সভাপতিত্বে গঠিত জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি সহ অসংখ্য কমিটি ও কমিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নীতি-ভিত্তিক এই সংস্থাগুলিতে তাঁর মূল্যবান অবদান দার্শনিক ও তাত্ত্বিক চিন্তা-ভাবনা এবং অভিজ্ঞতাভিত্তিক সমস্যা সমাধানের গবেষণার উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর সমান দক্ষতা প্রমাণ করে। তাঁর কিছু নীতিগত সুপারিশ কেবল সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণই হয়নি, বরং ছিল অত্যন্ত দূরদর্শী এবং শক্তিশালী। উদাহরণস্বরূপ, জমি অধিগ্রহণে সর্বোচ্চ সীমা আরোপের তাঁর ধারণা; পরিবার পরিকল্পনা এবং সামাজিক উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক কর্মসূচির সাথে উর্বরতা আচরণের উপর প্রভাব ফেলার জন্য কর্ম-ভিত্তিক কর্মসূচির সংযোগ স্থাপন; এবং সমন্বিত গ্রামীণ ও নগর পরিকল্পনা, যা ‘রুরবানাইজেশন’ ধারণার মাধ্যমে মূর্ত হয়েছিল, এগুলি তাঁর দূরদর্শী চিন্তাভাবনারই প্রতিফলন।
তাঁর রচিত পঞ্চাশটিরও বেশি গ্রন্থের শিরোনামগুলি তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বহন করে। ‘অর্থনীতি থেকে সমাজবিজ্ঞান, এবং অবশেষে অধিবিদ্যা’ পর্যন্ত বিস্তৃত তাঁর যাত্রাপথে, মুখার্জির বৌদ্ধিক আগ্রহগুলি ভূমি সমস্যা, শ্রমিক শ্রেণী, নগর ও গ্রামীণ জীবন, বাস্তুবিদ্যা, খাদ্য পরিকল্পনা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক ইতিহাস, অভিবাসন, সামাজিক মনোবিজ্ঞান, বিবাহ, পরিবার ও যৌনতা, গণতন্ত্র, নৈতিকতা, সংস্কৃতি ও শিল্প, মূল্যবোধ, সভ্যতা, মানবতাবাদ, রহস্যবাদ এবং আধ্যাত্মিকতার মতো বিচিত্র বিষয়ে তাঁর বিশাল রচনায় সূক্ষ্মভাবে প্রকাশিত হয়েছে। স্পষ্টতই, তাঁর কাজগুলি কেবল অসংখ্য একাডেমিক শাখা ও সীমানা অতিক্রম করেছে তাই নয়, বরং এর পদ্ধতিগত বহুত্ববাদ এবং দৃষ্টিভঙ্গির সার্বজনীনতা দ্বারাও এটি স্বতন্ত্র।
মুখার্জির জীবন ও সময়ের প্রেক্ষাপট:-
রাধাকমল মুখার্জির জন্মস্থান ছিল বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর নামক শহরে। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে (বর্তমানে কলকাতা) যোগ দিয়েছিলেন, যা তৎকালীন মধ্যবিত্ত বাঙালি যুবকদের জন্য একটি সুপ্রতিষ্ঠিত পথ ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করার পর, তিনি বহরমপুরে ফিরে এসে স্থানীয় কৃষ্ণনাথ কলেজে (১৯১০-১৯১৫) অর্থনীতি পড়াতে শুরু করেন। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর তিনি জন্মভূমি ছেড়ে লাহোরের একটি কলেজের অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। লাহোরে সংক্ষিপ্ত সময় থাকার পর ১৯১৭-২১ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে প্রায় চার বছর কাজ করার পর, ১৯২১ সালে তিনি লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা-প্রধান হিসেবে যোগদান করেন।
অন্যান্য অনেক স্বদেশীর মতোই,রাধাকমল মুখার্জির চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর সময়ের সামাজিক সমস্যাগুলির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিল। সেই সময় শিক্ষিত ভারতীয়দের পক্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রামের প্রতিধ্বনিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা অসম্ভব ছিল। এটি লক্ষণীয় যে, মুখার্জির প্রজন্মের কাছে জাতিসত্তা কোনো তৈরি পণ্য হিসাবে আসেনি; এটি ছিল একটি আধ্যাত্মিক ঘটনা যার উপস্থিতি, সাংস্কৃতিক প্রতিফলন এবং সক্রিয় আত্মোপলব্ধির উপর নির্ভর করত। রাজনৈতিকভাবে অধিকার করার আগে এটিকে বৌদ্ধিকভাবে উপলব্ধি করা জরুরি ছিল। স্বাভাবিকভাবেই,রাধা কমল মুখার্জি তাঁর সমসাময়িকদের সাথে ভারতের গৌরবময় অতীতের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যে গভীরভাবে প্রবেশ করে তাঁদের জাতিসত্তার সারমর্ম অনুসন্ধানে যোগ দিয়েছিলেন। জাতির আত্মা, যা তখনো পুরোপুরি জন্ম নেয়নি, তার প্রাচীনতম ও বিশুদ্ধতম অভিব্যক্তিগুলি ইতিহাসের গভীরে চাপা পড়েছিল, যা পুনর্গঠন করে জনগণের কাছে উপলব্ধ করা প্রয়োজন ছিল।
প্রত্যাশিতভাবেই, ভারতীয় জাতীয় জাগরণ প্রথমে সাহিত্যিক, শৈল্পিক, বৌদ্ধিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রকাশ পায়, এবং কেবল পরবর্তীতে রাজনৈতিক অঙ্গনে। বাংলা নবজাগরণ ছিল এই সাংস্কৃতিক উন্মাদনার উৎস। ১৯ শতকের শেষ এবং ২০ শতকের শুরুর দিকে বাংলা ইতিমধ্যেই বৌদ্ধিক আলোড়ন এবং রাজনৈতিক উত্থানের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন সামাজিক ও বৌদ্ধিক শক্তিকে মুক্ত করেছিল, যা স্বদেশী ও স্বরাজ-এর পথ প্রশস্ত করে। মুখার্জি এই শক্তিগুলির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারেননি। তিনি নিজেই তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন কীভাবে ১৯০৫ সালের গণ-অভ্যুত্থান তাঁর জীবনে প্রভাব ফেলেছিল, যা তাঁকে সমাজসেবা এবং শিক্ষা কার্যক্রমে জড়িত করেছিল।
রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সক্রিয় (বিশেষ করে সমবায় সংগঠন ও উচ্চ শিক্ষায়) হওয়া সত্ত্বেও, মুখার্জি তৎকালীন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে সরাসরি জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত ছিলেন। এটি সেই সময় ছিল যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তখনও গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়নি। তিনি ১৯১৫ সালে বিপ্লবী সন্ত্রাসীদের সহায়তা করার সন্দেহে একদিনের জন্য আটক থাকা ছাড়া, ঔপনিবেশিক দমনের সরাসরি আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে এটি একটি কাকতালীয় ঘটনা যে তিনি রাজনীতিতে না গিয়ে একাডেমিয়ায় তাঁর জীবনের কাজ খুঁজে পেয়েছিলেন।
সাহিত্য জগতেও রাধা কমল মুখার্জি সমান সক্রিয় ছিলেন। তিনি মুর্শিদাবাদ জেলা সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক এবং সুপরিচিত বাংলা মাসিক পত্রিকা ‘উপাসনা’-এর সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও তিনি একটি বাংলা উপন্যাস শাশ্বত ভিখারি (Eternal Beggar) এবং একটি ছোট বাংলা নাটক নিদ্রিত নারায়ণ (God Asleep) রচনা করেন। তাঁর মণিমেখলা (The Temple Girl of Kanya Kumari), যা দেবী পার্বতীর মন্দিরের মেয়ে রূপে যন্ত্রণা ও রোগ গ্রহণের একটি দক্ষিণ ভারতীয় কিংবদন্তির বাংলা পুনর্গঠন, তাঁর আরেকটি সাহিত্যিক কৃতিত্ব। একজন সাহিত্য সমালোচক হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং প্রমথনাথ চৌধুরীর মতো সাহিত্যিক দিকপালদের সাথে তাঁর সময়ের অনেক সাহিত্য বিতর্কে অংশ নেন। এই আলোচনার মাধ্যমে, মুখার্জি বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন গণচেতনার পক্ষে সওয়াল করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সাহিত্যকে যুগের সামাজিক ও নৈতিক সমস্যাগুলির সমাধান করতে হবে এবং সমাজের সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখকে তুলে ধরতে হবে।
এই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবগুলি ছাড়াও, রাধা কমল তাঁর দুই সহকর্মী সমাজবিজ্ঞানী বিনয় কুমার সরকার এবং ব্রজেন্দ্রনাথ শীল-এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, যারা তাঁর জীবন ও কর্মে এক অমোঘ ছাপ ফেলে গেছেন। এই সংক্ষিপ্ত জীবনীমূলক চিত্রটি আমাদের বোঝানোর জন্য যথেষ্ট যে রাধা কমল মুখার্জি সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞান উভয় ক্ষেত্রেই সক্রিয় এবং উৎপাদনশীল ছিলেন, এবং ‘সাহিত্যকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক বাস্তবতার বোধ দান করেছেন এবং সমাজবিজ্ঞান গবেষণাকে সাহিত্যিক সংবেদনশীলতা ও কল্পনা দান করেছেন’ ।
এই বহুমুখিতা এবং বৌদ্ধিক আগ্রহ ও উদ্বেগের পরিসর রাধা কমল মুখার্জিকে তাঁর সমসাময়িক এবং শিষ্য উভয়ের ঊর্ধ্বে স্থাপন করেছিল।
লখনউ স্কুল এবং ‘ভারতীয় অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান ও সংস্কৃতির স্কুল’ এর অনুসন্ধান
রাধাকমল মুখার্জির দূরদর্শী নেতৃত্বে, লখনউ স্কুল আধুনিক ভারতের সমাজবিজ্ঞানের বিবর্তনে এক অত্যন্ত সৃজনশীল অধ্যায়ের সূচনা করে। অনেকের মতে, এই স্কুলটি ভারতের ঔপনিবেশিক অধীনতা এবং সাংস্কৃতিক পরাধীনতার প্রতি একটি বৌদ্ধিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে গড়ে উঠেছিল (সরণ ১৯৫৮; যোশী ১৯৮৬a, ১৯৮৬b; মাদান ১৯৯৪)। এর বিকাশের ধারায়, ভারতীয় ঐতিহ্যের সমৃদ্ধির প্রতি এর সংবেদনশীলতা, ‘দার্শনিক তাত্ত্বিক অভিমুখ’-এর প্রতি এর প্রবণতা, বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতির কঠোরতা, এর স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সমালোচনার শৈলী, একদম তৃনমূলীয় স্তরের অন্তর্দৃষ্টি এবং ক্ষেত্রকর্মের উপর ভিত্তি করে সামাজিক রূপান্তরের সমস্যা ও প্রক্রিয়াগুলির এর গভীর উপলব্ধি, এবং মূল্যবোধ-ভিত্তিক ও অখণ্ডিত সমাজবিজ্ঞান দৃষ্টিভঙ্গিতে এর দৃঢ় অবস্থান লখনউ স্কুলকে এক শক্তিশালী বৌদ্ধিক শক্তিতে পরিণত করে।
লখনউ স্কুলের বিস্তৃত দর্শন এবং সেখানে অনুসৃত তাত্ত্বিক ও শিক্ষাগত পদ্ধতির একটি গভীর পরীক্ষা মুখার্জির সমগ্র জীবনের কাজ, তাঁর দর্শন এবং প্রতিশ্রুতির সাক্ষ্য বহন করে। এই স্কুল দ্বারা উত্থাপিত প্রশ্নগুলি এবং দেশের সমস্যাগুলির উপর উদ্ভূত দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্তর্দৃষ্টিগুলি, মূলত এর প্রতিষ্ঠাতাদের মূল্যবোধের প্রতিশ্রুতি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। জীবনের খুব প্রথম দিকে, অর্থনীতির ছাত্র হিসাবে, মুখার্জি ভারতের মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধান হিসাবে ‘পশ্চিমা শিল্প পদ্ধতির অন্ধ অনুসরণ’-এর বিপদ উপলব্ধি করেছিলেন। পরবর্তীতে, তাঁর সম্পাদিত Fields and Farmers of Oudh (1929) -এর ভূমিকায়, যা ভারতীয় গ্রামগুলির উপর তাঁর ছাত্র ও সহকর্মীদের দ্বারা অভিজ্ঞতামূলক গবেষণার সংকলন ছিল, তিনি একাডেমী এবং বাস্তব জীবনের মধ্যে তফাৎটা তুলে ধরেন এবং একটি ‘ভারতীয় অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান স্কুল’ এর মাধ্যমে এই বিচ্ছেদ সংশোধনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। মুখার্জির মতে, ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অর্থনীতি পাঠ্যক্রমে অর্থনৈতিক জীবনের বাস্তবতাগুলি যথেষ্ট অবহেলিত ছিল। তিনি একটি এমন স্কুলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন যা সমাজবিজ্ঞানকে ভারতীয় জীবন ও শ্রমের চাহিদা এবং আদর্শের সাথে সম্পর্কিত করতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলি তদন্ত করার কৌশল ও পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দিতে পারে।
১৯১৭ সালের নভেম্বরে, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভারতীয় অর্থনীতি’র বিশেষ প্রভাষক হিসাবে দশটি বক্তৃতা প্রদানের সময় মুখার্জি পশ্চিমা অর্থনৈতিক মডেলগুলির ভারতীয় বাস্তবতার সাথে অসমতার বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। তাঁর মতে, ‘পশ্চিমা অর্থনীতির অনুমানগুলি ভারতীয় অর্থনৈতিক বিন্যাসের বাস্তবসম্মত অধ্যয়ন থেকে প্রাপ্ত অনুমানগুলি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল’ ।
একই বছর তিনি দিল্লির সেন্ট স্টিফেনস কলেজে ‘কৃষি ও শিল্পবাদ’ বিষয়ে মহাত্মা গান্ধীর সাথে মঞ্চ ভাগ করে নেন, যেখানে গান্ধী মুখার্জির অর্থনৈতিক অবদানের প্রশংসা করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, ‘পশ্চিমা অর্থনীতির নীতিগুলি ভারতীয় পরিস্থিতিতে ঠিক সেভাবে প্রয়োগ করা যাবে না যেভাবে একটি ভাষার ব্যাকরণ ও বাক্য গঠনের নিয়ম অন্য ভাষার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না’।
ভারতীয় পরিস্থিতির জন্য পশ্চিমা অর্থনৈতিক পদ্ধতির অনুপযুক্ততা সম্পর্কে মুখার্জির দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর সমগ্র শিক্ষাজীবনে তাঁর বক্তৃতা এবং লেখায় ক্রমাগত প্রকাশিত হয়েছে। ১৯১৯ সালে মাদুরাইতে তাঁর একটি বক্তৃতায় তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন যে,
পশ্চিমা শিল্পবাদের দুটি ফল হল বিচ্ছিন্ন গ্রাম এবং নোংরা ও জনাকীর্ণ শহর, এবং ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারের এমন একটি ধারা প্রয়োজন যা আমাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অর্থনৈতিক অভ্যাস ও প্রতিষ্ঠান, আমাদের গ্রাম ব্যবস্থা এবং আমাদের কৃষি অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে।
উপরোক্ত আলোচনার উদ্দেশ্য হল এই সত্যটি তুলে ধরা যে, মুখার্জি যখন লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন, তখন অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের একটি ভারতীয় স্কুলের জন্য একটি নতুন অভিমুখ তাঁর মনে ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। লখনউতে, তিনি ‘জীববিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানের মতো প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মধ্যে সেতুবন্ধন; অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান এবং অন্যান্য মানব বিজ্ঞানের মধ্যে; তত্ত্ব গঠন এবং তথ্য অনুসন্ধানের মধ্যে; সামাজিক চিন্তাভাবনা এবং সামাজিক কাজের মধ্যে’ তাঁর ধারণাগুলিকে সুসংহত করেন। এর বহু-বিষয়ক অভিযোজনের কারণে, লখনউ স্কুলের অনেক প্রাক্তন ছাত্র দাবি করেছেন যে এটিকে অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির লখনউ স্কুল বলা আরও উপযুক্ত হবে। এই স্কুলটি ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে সংগ্রামরত দেশের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার সাথে সমাজবিজ্ঞানের ধারণাকে অভিমুখী করার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিল। এটি জাতীয় মুক্তি এবং ব্যাপক অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা ও দারিদ্র্যের স্থায়ী সমাধানের জন্য একটি বৌদ্ধিক অনুসন্ধানকে মূর্ত করেছিল।
উন্নয়নের এশিয়ান পথ এবং পশ্চিমা গণতন্ত্রের সমালোচনা:-
রাধাকমল মুখার্জির অর্থনৈতিক প্রশিক্ষণ এবং মুর্শিদাবাদ জেলার গ্রাম ও কলকাতার বস্তিগুলিতে তাঁর সমাজসেবামূলক কাজের মাধ্যমে দারিদ্র্য ও দুর্দশার সাথে প্রাথমিক সংস্পর্শের কারণে, তিনি উন্নয়ন এবং গণদারিদ্র্যের সমস্যাগুলির প্রতি একটি গভীর আগ্রহ পোষণ করতেন। পশ্চিমা অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং শিল্পোন্নতির মডেলগুলির একটি ভারতীয় (এশিয়ান) বিকল্পের বিষয়ে মুখার্জির দৃষ্টিভঙ্গির প্রথম প্রকাশ তাঁর অর্থনৈতিক লেখায় পাওয়া যায়। তাঁর মূল অবদান ছিল অগ্রগতির নামে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান এবং মূল্যবোধের সম্পূর্ণ আমদানিকে প্রশ্ন করা। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে আধুনিকীকরণের পথটি অনিবার্যভাবে প্রাচ্য মূল্যবোধ এবং প্রতিষ্ঠানগুলিকে পশ্চিমা দ্বারা প্রতিস্থাপন করা বোঝায়। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে ভারতের মতো এশীয় দেশগুলি তাদের সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানগুলির সম্ভাবনা সংরক্ষণ ও ব্যবহার করে একটি দেশীয় অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথ তৈরি করতে পারে যা এশীয় পরিস্থিতির জন্য আরও উপযুক্ত। এই অর্থে, মুখার্জি সম্ভবত প্রথম সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি উন্নয়নের প্রতি ইউরোসেন্ট্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং ইউরোপীয় পথের একটি বিকল্পের প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন যা এশীয় পরিস্থিতি এবং ঐতিহ্য উভয়ের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
****************
একটি ভারতীয় বিকল্পের সন্ধানে, রাধা কমল প্রায়শই ভারতীয় গ্রামগুলির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কথা উল্লেখ করেছেন, যা ভূমি এবং অন্যান্য গ্রাম্য সাধারণ সম্পদের (যেমন সেচ খাল, চারণভূমি, শ্মশানঘাট) সম্পত্তি কাঠামো এবং পারস্পরিক সহায়তা ও পারস্পরিকতার একটি সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে। তাঁর মতে, ভারতীয় গ্রাম সম্প্রদায়ের এই বিশেষত্বগুলি, যা প্রাকৃতিক সম্পদ ও সম্পত্তির সম্প্রদায়ের রক্ষণাবেক্ষণ এবং কৃষক, কারিগর, শ্রমিক ও সেবাকারী জাতিগুলির একটি সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্তির উপর জোর দেয়, নির্দিষ্ট এশীয় ভৌগোলিক ও পরিবেশগত পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে উদ্ভূত হয়েছিল।
পশ্চিমা আধুনিকতার উপর মুখার্জির সবচেয়ে শক্তিশালী সমালোচনা নিহিত ছিল পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধারণার সম্পূর্ণ নিন্দা করার মধ্যে। তিনি জোর দিয়েছিলেন যে, ভারতের অতীতের জীবন্ত অভিজ্ঞতায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধের অস্তিত্ব ছিল, যদিও ভিন্ন চরিত্রের। ‘পূর্বের গ্রামীণ সাম্প্রদায়িকতার মৌলিক কারণগুলির একটি নিরপেক্ষ অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তার উপর তাঁর জোর’ (১৯২৫a: ৮৮) এখনও পর্যন্ত পশ্চিমা আধুনিকতার সমালোচনার ক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তিনি এশীয় সাম্প্রদায়িকতাকে ‘মূল্য’ এবং ‘তথ্য’-এর মিশ্রণ হিসাবে উপস্থাপন করেছেন, উভয়ই আদর্শগত এবং অভিজ্ঞতাভিত্তিক ঘটনা হিসাবে। তাঁর মতে, পশ্চিমা অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীগণ ডারউইনীয় জীববিজ্ঞানের প্রভাবে অতিরিক্ত প্রভাবিত ছিলেন, যে কারণে তারা ‘অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম’-এর উপর অতিরিক্ত জোর দিয়েছিলেন।
সমাজ, সংস্কৃতি এবং ব্যক্তি:
একটি সমন্বিত পদ্ধতির দিকে মুখার্জির বেশিরভাগ লেখা পশ্চিমা পণ্ডিতদের বিবর্তনবাদী হ্রাসবাদী কাঠামোতে ভারতীয় বাস্তবতা ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টাকে খণ্ডন করে। মুখার্জি ভারতীয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে অনন্য বলে মনে করতেন এবং ভারতীয় বাস্তবতার ব্যাখ্যার জন্য পশ্চিমের সমাজতাত্ত্বিক বিভাগগুলিকে অপর্যাপ্ত বলে মনে করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি প্রথম কয়েকজন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানীর মধ্যে একজন যিনি তাঁর সময়ের পশ্চিমা তাত্ত্বিকদের সমতুল্য একটি স্বাধীন সাধারণ সমাজতত্ত্ব তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে আগ্রায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় সর্বভারতীয় সমাজতাত্ত্বিক সম্মেলনে তাঁর সভাপতির ভাষণ এবং পরবর্তীতে তাঁর দ্য ফিলোসফি অফ সোশ্যাল সায়েন্স (১৯৬০)-এ, তিনি সামাজিক বাস্তবতা ব্যাখ্যা এবং বোঝার জন্য একটি সাধারণ সমন্বিত সমাজবিজ্ঞান মডেল প্রস্তাব করেন।
মুখার্জি ধারণার সর্বজনীন সিরিজ এবং সাধারণ শ্রেণীগুলির কথা বলেন, যার উদ্দেশ্য কেবল আন্তর্জাতিকভাবে সমাজতত্ত্বকে একীভূত করা নয়, বরং প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞান উভয় ক্ষেত্রেই অন্যান্য শৃঙ্খলাকেও অন্তর্ভুক্ত করা। তিনি বাস্তবতার প্রতিটি স্তরের জন্য, শারীরিক থেকে আধিভৌতিক পর্যন্ত, একটি ঐক্যবদ্ধ ত্রিবিধ দ্বান্দ্বিক নীতি অনুমান করেন যা বাস্তবতার একটি স্তরকে অন্য স্তরের সাথে সংযুক্ত করে। এই নীতি থেকে তাঁর জ্ঞানের সংকীর্ণ একাডেমিক গর্তে অখণ্ডিতকরণের আবেদন উদ্ভূত হয়। তাঁর ধারণাগত যন্ত্রপাতিতে, দ্বন্দ্ববিদ্যা একটি স্তরকে অন্য স্তরের সাথে সংযুক্ত করার এবং এটিকে গুণগত এবং আত্ম-উত্তরণের শক্তি দিয়ে সজ্জিত করার মৌলিক ভূমিকা পালন করে। এই আত্ম-উত্তরণের শক্তি, মুখার্জির কাছে, মানুষ হিসাবে হোমো সিম্বলিকাস-এর অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য।
এভাবে, মুখার্জি হেগেল, বেদান্ত, বৌদ্ধধর্ম এবং তাওবাদ থেকে তাঁর দ্বন্দ্বের ধারণা তৈরি করেন। তিনি পশ্চিমা উদার গণতান্ত্রিক ধাঁচ এবং মার্কসবাদী উভয় মডেলকেই অপর্যাপ্ত বলে মনে করেছিলেন। তাঁর অপরিহার্য লক্ষ্য ছিল একটি মধ্যম মার্গ (মাঝারি পথ) খুঁজে বের করা। তিনি মার্কসবাদী দ্বন্দ্বের ধারণার বিরুদ্ধে ছিলেন কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আজ বৈশ্বিক বিপ্লব ও যুদ্ধের সংগ্রাম ও সংঘাতের মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নের অনিবার্য প্যাটার্নের সর্বজনীন ধারণাকে উৎসাহিত করে এবং অর্থনৈতিক আন্দোলনের দ্বন্দ্বের মধ্যে সমস্ত মানব অগ্রগতিকে অন্তর্ভুক্ত করে’ (মুখার্জি ১৯৬০: ১১৮)।
মুখার্জি অবিচ্ছিন্নভাবে এক-বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাস্তবতাকে মূল্যায়নের ত্রুটি উন্মোচন করেছেন। আন্তঃবিষয়ক পদ্ধতির পর্যাপ্ততা সম্পর্কেও তিনি খুব বেশি নিশ্চিত ছিলেন না। শৃঙ্খলাগত সীমানা এবং সামাজিক বাস্তবতার একটি স্পষ্ট মূল্যায়নের উপর তাদের সীমাবদ্ধ প্রভাবের আচরণবাদীদের সমালোচনাকে সমর্থন করার সময়, তিনি সমস্ত ‘শৃঙ্খলার’ একক ভিত্তির উপর জোর দেন। শৃঙ্খলাগুলির মধ্যে তৈরি কৃত্রিম দেয়ালগুলি অপসারণের জন্য, মুখার্জি (১৯৬১) সামাজিক বাস্তবতার একটি দ্ব্যর্থহীন এবং ব্যাপক মূল্যায়নের জন্য আন্তঃবিষয়ক পদ্ধতির প্রস্তাব করেছিলেন। তাঁর সমন্বিত পদ্ধতি অনুসারে, শৃঙ্খলা-নির্দিষ্ট সীমানা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায় কারণ সমাজবিজ্ঞানের একটি একক ভিত্তি তার ক্ষেত্রে সমস্ত বিশেষীকরণের সমান গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মুখার্জি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, কর্তব্য, প্রেম এবং সদ্বিবেচনা একটি সভ্যতার উচ্চতর আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধগুলি দৈনন্দিন জীবনের কাজে ব্যক্তিত্বকে পরিচালিত ও রূপ দেয়। মানব ব্যক্তিত্ব সমাজে এই মূল্যবোধগুলির সন্ধানে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত থাকে। তাঁর কাছে, সমাজ বিভাজ্য নয়; এটি অভ্যাস, মূল্যবোধ এবং প্রতীক সমন্বিত একটি সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান। তিনি সমাজের একটি মাস্টার বিজ্ঞান কল্পনা করেন যা মানব পরিবেশগত তত্ত্ব, সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব এবং মূল্যবোধ ও প্রতীকের তত্ত্বকে অন্তর্ভুক্ত করে। তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য হল একটি অসীম, অতিমানবীয় এবং অতি-সামাজিক রেফারেন্স ফ্রেমের উপর ভিত্তি করে সমাজবিজ্ঞানগুলির একটি ঐক্য অর্জন করা। এইভাবে, মুখার্জির সমাজ, সংস্কৃতি এবং ব্যক্তির অধ্যয়নের প্রতি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর বৌদ্ধিক পরিধি এবং দূরদর্শিতার প্রশস্ততার সাক্ষ্য বহন করে।
পশ্চিমা আধুনিকতা এবং ভারতীয় মনের দ্বিধা:
একটি বিশ্লেষণ আশ্চর্যজনকভাবে, মুখার্জির লেখাগুলি পশ্চিমের, বিশেষত আমেরিকার, সমাজতাত্ত্বিক লেখার প্রবণতার সাথে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে মিলে যায়, যদিও তিনি পূর্বের মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে সমাজের একটি ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার সাহসী চেষ্টা করেছিলেন (যোগেন্দ্র সিং ১৯৮৪: ১৫৭)। এটি সত্য যে, তিনি পশ্চিমা ধারণাগত ব্যাগের তাত্ত্বিক জটিলতায় বিমোহিত হননি এবং পশ্চিমা সমাজবিজ্ঞানের আদর্শগত চরিত্রের প্রতি অনুকরণীয় সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করেছেন। তাঁর একটি পূর্ববর্তী কাজ, দ্য ফাউন্ডেশনস অফ ইন্ডিয়ান ইকোনমিক্স-এ, তিনি জ্ঞানের সিস্টেমগুলির সাংস্কৃতিক নির্দিষ্টতা সম্পর্কে এমনকি সুনির্দিষ্টভাবে জোর দিয়েছিলেন: ‘শিল্প সংগঠন, অর্থনৈতিক বিন্যাস এবং প্রতিষ্ঠানের এমন সিস্টেম এবং পদ্ধতি চাপানোর চেষ্টা যা একটি ভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশে চমৎকারভাবে উপযুক্ত হয়েছে, তা সর্বদা নিরর্থক হবে’ (১৯১৬: ৩৩০)।
তবে, একজন সমাজবিজ্ঞানী যেমন মুখার্জি, যত বিখ্যাতই হন না কেন, তাঁর কাছ থেকে পশ্চিমা আধুনিকতার একটি সম্পূর্ণ দেশীয় বিকল্পের প্রত্যাশা করা আধুনিক ভারতের বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মূলধারার বিরুদ্ধে যায়। এটি যুক্তিযুক্ত যে, ‘ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা ভারতের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতি যে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল, তা পেশাদার সমাজবিজ্ঞানীরা নয়, বরং সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনকারীরা মোকাবেলা করেছিলেন’ (যোগেন্দ্র সিং ১৯৮৪: ১৫৬)। ভারতে সমাজবিজ্ঞান এই চ্যালেঞ্জের প্রতি প্রতিক্রিয়া জানাতে কেবল পিছিয়ে ছিল না, বরং দীর্ঘকাল ধরে এটি এড়িয়েও গিয়েছিল। সমাজবিজ্ঞানীদের অবশ্য এর জন্য দায়ী করা যায় না, যেহেতু সমাজবিজ্ঞান একটি পেশা হিসাবে নিজেই ঔপনিবেশিক প্রভাবের একটি উপজাত ছিল, ঔপনিবেশিক বিরোধী সংগ্রামের নয়।
পশ্চিমা সমাজবিজ্ঞানের প্রতি গভীর দ্বিধা মুখার্জির পাশাপাশি তাঁর সমসাময়িক এবং অনুসারীদের জন্যও সত্য। উনিশ শতকের ভারতে পশ্চিমা উৎস থেকে উদ্ভূত বেশিরভাগ সমাজবৈজ্ঞানিক গবেষণা ভারতের একটি জাতি হিসাবে পরিচয়কে অস্বীকার করার প্রবণতা ছিল। এই ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার না করে, মুখার্জি এবং তাঁর সহযোগী সমাজবিজ্ঞানীরা পশ্চিমা মহানগর কেন্দ্রগুলির দ্বারা নির্ধারিত সমাজবিজ্ঞানের বিস্তৃত প্যারামিটারের মধ্যেই কাজ চালিয়ে গেছেন। এভাবে, আমরা একদিকে জাতীয় আত্ম-সচেতনতা এবং অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানের পশ্চিমা ঐতিহ্যের উপর নির্ভরতার প্যারাডক্স দেখি, যা মুখার্জির সহ ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানীদের অবদানের একটি কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য।
ঔপনিবেশিকতা যত এগোতে থাকে, পশ্চিম এবং দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি একটি দ্বৈত টানাপোড়েন দেখা দেয়। বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংঘাত তীব্র হওয়ার সাথে সাথে সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তির মানসিক প্রয়োজন গভীর হয়। একই সাথে, এবং বিপরীতভাবে, দেশীয় সংস্কৃতির সাথে পরিচিতি ক্রমশ হ্রাস পায়। অধিকাংশ ‘আলোকিত’ ভারতীয়দের কাছে, আধুনিকতার নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান বা দেশীয় সংস্কৃতির অন্ধ সমর্থন – কোনটিই তাদের ঔপনিবেশিকভাবে পরাধীন হিসাবে বসবাস করা এবং অনুভব করা সাংস্কৃতিক অচলাবস্থা থেকে মুক্তির পথ বলে মনে হয়নি। তারা পশ্চিম দ্বারাও বিমোহিত ছিলেন না এবং পুরোপুরি দেশীয় সাংস্কৃতিক মূলের দ্বারাও নন, যদিও তারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে তীব্র বিচ্ছিন্নতা অনুভব করতেন। মূল কথা হল, তারা যে ঐতিহ্যকে নিজেদের বলে মনে করতে চেয়েছিলেন তা কোনো আদিম ও বিশুদ্ধ ঐতিহ্য ছিল না, বরং একটি নতুন সৃষ্ট ঐতিহ্য – এমন একটি ঐতিহ্য যা তারা বিদ্যমান ঐতিহাসিক পরিস্থিতির ভারে সচেতনভাবে তৈরি করেছিলেন।
উপসংহার:-
রাধাকমল মুখার্জি নিঃসন্দেহে পশ্চিমা সমাজবিজ্ঞানের বিশ্লেষণাত্মক সর্বজনীনতার দাবিকে প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির বিশ্লেষণের জন্য নতুন ব্যাখ্যামূলক পদ্ধতি এবং বিভাগ প্রস্তাব করেছিলেন। তাঁর বিশাল কাজের ভাণ্ডার দেশীয় সাংস্কৃতিক ধারণার প্রতি তাঁর আগ্রহ প্রদর্শন করে। ভারতীয় বাস্তবতার নির্মাণের জন্য পশ্চিমা মডেলগুলির ব্যবহার (এবং অপব্যবহার)-এর গভীর প্রভাবগুলি কাজ করার ক্ষেত্রে তিনি ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন। তিনি কেবল ভারতের মতো ঐতিহাসিকভাবে স্বতন্ত্র সত্তার অধ্যয়নের জন্য পশ্চিমা উৎস থেকে প্রাপ্ত ধারণা এবং পদ্ধতির প্রয়োগের সমালোচনাই করেননি, বরং পশ্চিমা সামাজিক তত্ত্বের জাতিগত-কেন্দ্রিকতাও তুলে ধরেছিলেন যা ভারতকে পশ্চিমের তুলনায় সাংস্কৃতিক নিকৃষ্টতা এবং নির্ভরতার সম্পর্কে স্থাপন করেছিল।
যাইহোক, যোগেন্দ্র সিং (১৯৮৪) যেমন বলেছেন, মেটা-তাত্ত্বিক স্তরে, ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে ভারতীয় সংশোধন সহ পশ্চিমা ধারণাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টাই সবচেয়ে সাধারণ অভ্যাস। মুখার্জি এই প্রবণতার ব্যতিক্রম নন। তাঁর মধ্যে পশ্চিমা ধারণাগুলিকে দেশীয়করণ করার প্রচেষ্টা, পশ্চিমা আধুনিকতার উত্তরাধিকার সম্পর্কে একটি আদর্শগত আত্ম-সচেতনতা এবং পশ্চিম থেকে প্রাপ্ত ধারণার শ্রেণী এবং কাঠামোর প্রতি দেশীয় প্রতিক্রিয়ার একটি পরীক্ষামূলক রূপরেখা খুঁজে পাওয়া যায়। এটি স্পষ্টতই তাঁর লেখায় অনেক জ্ঞানীয় এবং দৃষ্টান্তমূলক টানাপোড়েন তৈরি করেছে।
রাধাকমল মুখার্জি ছিলেন একজন মৌলিক ও সৃজনশীল চিন্তাবিদ। তাঁর বিশাল লেখাগুলি চিন্তা এবং তথ্য অনুসন্ধানের মিশ্রণ প্রদর্শন করে। পশ্চিমা আধুনিকতার সমালোচনার অংশ হিসাবে, মুখার্জি ভারতীয় মূল্যবোধ ব্যবস্থার অনন্যতা, ভারতীয় সংস্কৃতি ও রাজনীতির কেন্দ্রাতিগ সাম্প্রদায়িক অ-সুখবাদী চরিত্রের উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি পশ্চিমা মানুষ এবং সামাজিক ব্যবস্থার ধারণাগুলির, যার মধ্যে মার্কসীয় শ্রেণী সংঘাত এবং সাম্যবাদের ধারণাও রয়েছে, একটি স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান নিয়ে এসেছিলেন, যার জন্য তিনি সংঘ বা সমষ্টির বিকল্প ধারণা প্রস্তাব করেন। মুখার্জির মতে, সংঘ অ-সুখবাদ দ্বারা চিহ্নিত এবং এটি একটি বস্তুবাদী মানব ও সমাজ ধারণার উপর ভিত্তি করে না হয়ে একটি আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য দ্বারা সমর্থিত (যোগেন্দ্র সিং ১৯৬৭: ১৬৬-৬৭)। সমাজবিজ্ঞানের জন্য সাম্রাজ্যবাদী ইতিবাচক পদ্ধতির উপযোগিতা প্রত্যাখ্যান করে এবং ধর্ম, সংঘ এবং ট্রান্সেন্ডেন্টাল মূল্যবোধ-এর দেশীয় ধারণাগুলি নিয়ে এসে, মুখার্জি পশ্চিমা আদর্শগত আধিপত্য এবং সাংস্কৃতিক কর্তৃত্বের প্রতি চলমান ভারতীয় চ্যালেঞ্জের জন্য এক অসামান্য পরিষেবা প্রদান করেছেন।
রাধাকমল মুখার্জির কাজগুলি ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি স্থাপন করেছে এবং উপনিবেশিকতার প্রেক্ষাপটে কীভাবে দেশীয় জ্ঞানকে একটি স্বতন্ত্র পরিচয়ের সাথে একত্রিত করা যায়, তার একটি পথ প্রদর্শন করেছে। তাঁর অবদান ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের জন্য আজও অনুপ্রেরণার উৎস।
গ্রন্থপঞ্জী :-
১)মুর্শিদাবাদ কথা, শ্রীশ চট্টোপাধ্যায়।
২) Mukerjee, Radhakamal. 1916. The foundations of Indian economics. London: Longmans, Green and Co. Ltd.
৩) Joshi, P.C. 1986a. “Lucknow school of economics and sociology and its relevance today: Some reflections”, Sociological bulletin, 35 (1): 1–28.
৪) Chatterjee, Partha. 1986. Nationalist thought and the colonial world: A derivative discourse?. London: Zed Books.
৫) Chandra, Sudhir. 1992. The oppressive present: Literature and social consciousness in colonial India. New Delhi: Oxford University Press.
৬) 1986b. “Founders of the Lucknow school and their legacy – Radhakamal Mukerjee and D.P. Mukerji: Some reflections”, Economic and political weekly, 21 (33): 1455–69.
৭) Madan, G.R. and V.P. Gupta (eds.). 2000. Integral sociology: An anthology of the writings of Prof. Radhakamal Mukerjee (4 volumes). New Delhi: Radha Publications.
৮)––––. 2011. ‘Radhakamal Mukerjee and his contemporaries: Founding fathers of sociology in India’, Sociological bulletin, 60 (1): 18–44.
৯)Marriott, McKim. 1990. ‘Constructing an Indian ethnosociology’, in McKim Marriott (ed.): India through Hindu categories (1–39). New Delhi: Sage Publications.
১০) Madan, T.N. 1994. Pathways: Approaches to the study of society in India. New Delhi: Oxford University Press.
১১) Mukherjee, Ramkrishna. 1989. ‘Radhakamal Mukerjee: A note’, Sociological bulletin, 38 (2): 261–65.
১২) Manish. K. Thakur, Radhakamal Mukerjee and the Quest for an Indian Sociology Article in Sociological Bulletin · January 2012
১৩) ––––. 1921b. Principles of comparative economics (Vol. 2). London: P.S. King and Son. ––––.
১৪)––––. 1921a. Principles of comparative economics (with a preface by M. Raphael Georges-Levis) (Vol. 1). London: P.S. King and Son.
১৫) ––. 1925b. Borderland of econoঝmics. London: George Allen and Unwin.
১৬) ––––. (ed.). 1929. Fields and farmers of Oudh. London: Longmans, Green and Co. Ltd.
১৭)1925a. Groundwork of economics. London and New York: Longmans, Green, and Co.
১৮) ––––. 1955a. ‘Faiths and influences’, in Baljit Singh (ed.): The frontiers of social science: In honour of Radhakamal Mukerjee (6–20). London: Macmillan.
১৯) ––––. 1955b. ‘A general theory of society’, in Baljit Singh (ed.): The frontiers of social science: In honour of Radhakamal Mukerjee (21–74). London: Macmillan.
২০)––––. 1960. The philosophy of social science. London: Macmillan.
২১)––––. 1961. ‘A philosophy of social science’ (Presidential address to the third All India Sociological Conference, Agra, 1958), in R.N. Saksena (ed.): Sociology, social research and social problems in India (46–52). Bombay: Asia Publishing House.
২২) ––––. 1997. India, the dawn of an era: An autobiography. New Delhi: Radha Publications.
২৩)Saran, A.K. 1958. ‘India’, in Joseph Roucek (ed.): Contemporary sociology (1013–34). New York: Philosophical Library.
২৪) Singh, Baljit. 1955. ‘Mukerjee as a pioneer in Indian economics’, in Baljit Singh (ed.): The frontiers of social science: In honour of Radhakamal Mukerjee (1–5). London: Macmillan.
২৫)Singh, Yogendra. 1967. ‘Sociology for India: The emerging perspective’, in T.K.N. Unnithan, Yogendra Singh, Narendra Singhi and Indra Deva (eds.): Sociology for India (165–83). New Delhi: Prentice-Hall of India.
২৬)––––. 1984. Image of man: Ideology and theory in Indian sociology. Delhi: Chankya Publications.
২৭) ––––. 1986. Indian sociology: Social conditioning and emerging concerns. Delhi: Vistaar Publications.
২৮)––––. 2004. Ideology and theory in Indian sociology. Jaipur: Rawat Publications. Sundar, Nandini; Satish Deshpande and Patricia Oberoi. 2000. ‘Indian anthro-pology and sociology: Towards a history’, Economic and political weekly, 35 (24): 1998–2002.
(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)