অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় (১৮৮০-১৯৬৩) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর একজন প্রখ্যাত ভারতীয় ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ এবং চিন্তাবিদ। প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি ও উপনিবেশবাদের একজন গভীর পর্যবেক্ষক হিসেবে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর জীবন ছিল জ্ঞানচর্চা, গবেষণা এবং জনসেবায় নিবেদিত।
প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি:
রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় ১৮৮০ সালে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরে একটি শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান এবং সমৃদ্ধ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শ্রী গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বহরমপুর হাইকোর্টের একজন সুপরিচিত আইনজীবী ছিলেন। এই পারিবারিক পরিবেশ তাঁকে জ্ঞানার্জনের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল এবং তাঁর ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবনের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
শিক্ষা জীবন:
রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় বহরমপুরে তাঁর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯০১ সালে তিনি ডাবল অনার্স সহ বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি ইতিহাস ও অর্থনীতি বিষয়ে প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন এবং স্বর্ণপদক লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ইংরেজিতে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন এবং প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। ১৯১৫ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে, রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় সেই সময়ের সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম শিক্ষা গ্রহণ করে তাঁর শিক্ষাজীবনকে উজ্জ্বল করেছিলেন। তাঁর এই বিস্তৃত এবং গভীর জ্ঞান তাঁকে পরবর্তীকালে একজন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিল।
শিক্ষকতা জীবন:-
অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন:
১৯০৩ সালে ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় কলকাতার রিপন ও বিশপ কলেজে ইংরেজি অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর কিছু সময় জাতীয় কলেজে অধ্যাপনা করার পর তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি ও উপনিবেশের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি দক্ষিণ ভারতের মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর সফলভাবে কাজ করার পর, ১৯১১ সালে ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় উত্তর ভারতের লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন এবং অবসর গ্রহণ পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন। এইভাবে, পশ্চিম ভারত ব্যতীত, ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় পূর্ব, উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ইতিহাস এবং ভারতীয় সংস্কৃতির একজন সফল ও পরিশ্রমী অধ্যাপক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ ও আকর্ষণীয়, যা শিক্ষার্থীদের গভীরভাবে প্রভাবিত করত।
ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক অবদান:-
ডঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৬৩) ছিলেন ভারতীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং জাতীয়তাবাদের একজন অগ্রগণ্য ব্যাখ্যাকার। তাঁর লেখনী ছিল ভারতীয় সভ্যতা ও ঐতিহ্যের গভীর উপলব্ধি, বিশ্লেষণাত্মক অন্তর্দৃষ্টি, এবং এক অনবদ্য পাণ্ডিত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি কেবল একজন ঐতিহাসিক ছিলেন না, ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী চিন্তাবিদও, যাঁর রচনায় ভারতের গৌরবময় অতীতকে তুলে ধরার এবং সমকালীন ভারতীয় সমাজে আত্মমর্যাদা ও জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটানোর এক অবিচল প্রচেষ্টা প্রতিফলিত হয়েছে। প্রায় ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে বিস্তৃত তাঁর কর্মজীবনে, ডঃ মুখোপাধ্যায় প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে শুরু করে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় জীবনধারার বিভিন্ন দিক নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও লেখনী করেছেন। তাঁর রচনাগুলি আজও ভারতীয় ইতিহাসের গবেষণায় এক অপরিহার্য উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।
ডঃ মুখোপাধ্যায়ের লেখনীর মূল বৈশিষ্ট্য:-
ডঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের লেখনীর বেশ কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল, যা তাঁকে সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল:
* গভীর পাণ্ডিত্য ও মূল উৎসের উপর নির্ভরতা: ডঃ মুখোপাধ্যায় তাঁর গবেষণায় অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে মূল উৎসগুলির (যেমন – বৈদিক সাহিত্য, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থ, স্মৃতিশাস্ত্র, পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ, শিলালিপি, মুদ্রা, এবং বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ) উপর নির্ভর করতেন। তাঁর প্রতিটি বিশ্লেষণ তথ্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠতো, যা তাঁর রচনার বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করত।
* সর্বাঙ্গীণ দৃষ্টিভঙ্গি: তিনি কেবল রাজনৈতিক ইতিহাসেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তাঁর লেখনীতে প্রাচীন ভারতের সমাজ, অর্থনীতি, ধর্ম, দর্শন, শিক্ষা, শিল্পকলা, এবং প্রশাসন ব্যবস্থার মতো বহুবিধ বিষয় বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। এই সর্বাঙ্গীণ দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় সভ্যতার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরতে সহায়ক হয়েছে।
* জাতীয়তাবাদী চেতনা: ডঃ মুখোপাধ্যায়ের রচনায় এক প্রবল জাতীয়তাবাদী চেতনা বিদ্যমান ছিল। পরাধীন ভারতে তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে আত্মমর্যাদা এবং নিজেদের অতীত গৌরব সম্পর্কে সচেতনতা জাগাতে চেয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে, ভারত একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত সভ্যতা ছিল, যা বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না।
* তুলনামূলক বিশ্লেষণ: অনেক সময় তিনি ভারতীয় সভ্যতাকে বিশ্বের অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার (যেমন – গ্রিক, রোমান, চীনা) সঙ্গে তুলনা করে ভারতীয় সংস্কৃতির স্বতন্ত্রতা এবং অবদান তুলে ধরতেন।
* সহজবোধ্য ভাষা ও প্রাঞ্জল বর্ণনা: তাঁর রচনায় গভীর বিষয়বস্তু থাকলেও, তাঁর ভাষা ছিল সহজবোধ্য এবং বর্ণনা ছিল প্রাঞ্জল। এর ফলে সাধারণ পাঠক থেকে শুরু করে গবেষক – সকলের কাছেই তাঁর লেখা আকর্ষণীয় হয়ে উঠতো।
ডঃ মুখোপাধ্যায়ের প্রধান গ্রন্থাবলী ও তাদের বিশ্লেষণ:-
ডঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের কর্মজীবন ছিল অত্যন্ত ফলপ্রসূ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা বিপুল। এখানে তাঁর কিছু প্রধান গ্রন্থ এবং তাদের বিশ্লেষণ আলোচনা করা হলো:
. ১)A History of Indian Shipping and Maritime Activity from the Earliest Times (১৯১২):-
এটি ডঃ মুখোপাধ্যায়ের একটি পথিকৃৎ গবেষণামূলক কাজ। এই গ্রন্থে তিনি প্রাচীন ভারতের নৌবিদ্যা ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের একটি বিস্তারিত ইতিহাস তুলে ধরেছেন। ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিকরা যখন ভারতের সামুদ্রিক দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন, তখন ডঃ মুখোপাধ্যায় এই গ্রন্থের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন যে, প্রাচীন ভারত একটি শক্তিশালী নৌ-শক্তি ছিল এবং ভারতীয় বণিকরা বিশ্বের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সামুদ্রিক বাণিজ্য করত।
* প্রাচীন প্রমাণ: তিনি ঋগ্বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, বৌদ্ধ জাতক কাহিনি, পেরিপ্লাস অব দি এরিথ্রিয়ান সি (Periplus of the Erythraean Sea), এবং অন্যান্য বিদেশি বিবরণ থেকে নৌবিদ্যা ও সামুদ্রিক কার্যকলাপের প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন।
* জাহাজ নির্মাণ: তিনি প্রাচীন ভারতে উন্নত জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বর্ণনা দিয়েছেন, যেখানে বিভিন্ন প্রকারের জাহাজ নির্মাণ করা হতো।
* সামুদ্রিক বাণিজ্য পথ: গ্রন্থটিতে মেসোপটেমিয়া, মিশর, রোম, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এবং চীনের সঙ্গে ভারতের সামুদ্রিক বাণিজ্য পথের বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ভারতীয় বণিকরা মসলা, রেশম, মসলিন, এবং অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী রপ্তানি করত।
* উপনিবেশ স্থাপন: তিনি ভারতীয়দের দ্বারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (যেমন – জাভা, সুমাত্রা, কম্বোডিয়া) উপনিবেশ স্থাপনের বিষয়টিও আলোচনা করেছেন, যা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
এই গ্রন্থটি ভারতের সামুদ্রিক ইতিহাসের উপর একটি প্রামাণ্য কাজ এবং ভারতের গৌরবময় বাণিজ্যিক অতীতকে তুলে ধরেছে।
The Fundamental Unity of India (১৯১৪):-
এই গ্রন্থটি ডঃ মুখোপাধ্যায়ের জাতীয়তাবাদী চেতনার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই বইতে তিনি দেখিয়েছেন যে, ভারতের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক ঐক্য প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান ছিল। ব্রিটিশ শাসকরা যখন ‘divide and rule’ নীতি অনুসরণ করে ভারতের বিভেদকে প্রকট করতে চেয়েছিল, তখন ডঃ মুখোপাধ্যায় তাঁর এই রচনার মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
* ভৌগোলিক ঐক্য: তিনি দেখিয়েছেন যে, হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত ভারত ভূখণ্ড একটি প্রাকৃতিক ঐক্যসূত্র দ্বারা আবদ্ধ।
* সাংস্কৃতিক ঐক্য: বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা, এবং আঞ্চলিক বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও, ভারতীয় সংস্কৃতিতে একটি মৌলিক ঐক্য বিদ্যমান। তিনি দেখিয়েছেন যে, বিভিন্ন আঞ্চলিক উৎসব, আচার-অনুষ্ঠান, এবং বিশ্বাসে একটি সাধারণ ভারতীয় আত্মার প্রতিফলন ঘটে।
* আধ্যাত্মিক ঐক্য: বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার মতো ধর্মীয় গ্রন্থগুলি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সমানভাবে পূজিত এবং পঠিত হয়, যা ভারতের আধ্যাত্মিক ঐক্যের প্রতীক।
* ঐতিহাসিক ঐক্য: তিনি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা তীর্থযাত্রা, বাণিজ্যিক বিনিময়, এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজের ঐতিহাসিক ঐক্যের উপর জোর দিয়েছেন।
এই বইটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং আজও ভারতীয় ঐক্যের ধারণা বোঝার জন্য প্রাসঙ্গিক।
Harsha (১৯২৬):-
সম্রাট হর্ষবর্ধনের উপর লেখা এই বইটি ডঃ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণামূলক কাজের একটি চমৎকার উদাহরণ। এই গ্রন্থে তিনি সপ্তম শতকের শক্তিশালী শাসক হর্ষবর্ধনের রাজত্বকাল, তাঁর প্রশাসনিক সংস্কার, সামরিক অভিযান, ধর্মীয় উদারতা, এবং সাহিত্য ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতার একটি বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।
* মূল উৎস: হিউয়েন সাং-এর বিবরণ এবং বাণভট্টের হর্ষচরিত-এর মতো মূল উৎসগুলির উপর নির্ভর করে তিনি হর্ষের রাজত্বকালের এক বাস্তবসম্মত চিত্র তুলে ধরেছেন।
* রাজনৈতিক ইতিহাস: হর্ষের দিগ্বিজয়, তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তার এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
* প্রশাসন: হর্ষের প্রশাসনিক কাঠামো, রাজস্ব ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা এবং আইন-শৃঙ্খলার উপর আলোকপাত করা হয়েছে।
* ধর্মীয় নীতি: হর্ষের ধর্মীয় উদারতার বিশেষ উল্লেখ রয়েছে, যেখানে তিনি বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি ব্রাহ্মণ্যধর্মেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। তাঁর কনৌজের ধর্মীয় সম্মেলন এবং প্রয়াসের মহাপরিষদের বর্ণনা ঐতিহাসিকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
* সাংস্কৃতিক অবদান: হর্ষ নিজেও একজন বিদ্বান এবং লেখক ছিলেন। তাঁর রচিত নাটকগুলি – রত্নাবলী, নাগানন্দ, এবং প্রিয়দর্শিকা – সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে।
এই বইটি হর্ষবর্ধন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য একটি ক্লাসিক গ্রন্থ।
Asoka (১৯২৮)
সম্রাট অশোকের উপর ডঃ মুখোপাধ্যায়ের এই বইটি তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্ম। এই গ্রন্থে তিনি অশোকের রাজত্বকাল, কলিঙ্গ যুদ্ধের পর তাঁর হৃদয়ের পরিবর্তন, বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ, ধর্মীয় নীতি, এবং প্রশাসনিক সংস্কারের একটি বিস্তারিত ও গভীর বিশ্লেষণ দিয়েছেন।
* মূল উৎস: অশোকের শিলালিপি, স্তম্ভলিপি, এবং বৌদ্ধ সাহিত্যকে মূল ভিত্তি করে তিনি অশোকের জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন।
* ধর্মীয় নীতি (ধম্ম): তিনি অশোকের ‘ধম্ম’ নীতির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা মূলত অহিংসা, সহনশীলতা, গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা, এবং জীবের প্রতি দয়ার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। তিনি দেখিয়েছেন যে, অশোকের ‘ধম্ম’ কোনো সংকীর্ণ ধর্ম ছিল না, বরং তা ছিল একটি সার্বজনীন নৈতিক আচরণবিধি।
* প্রশাসন: অশোকের বিশাল সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থা, জনকল্যাণমূলক কাজ (যেমন – রাস্তা নির্মাণ, কূপ খনন, চিকিৎসালয় স্থাপন), এবং বিচার ব্যবস্থার উপর আলোকপাত করা হয়েছে।
* বৌদ্ধধর্মের প্রসারে ভূমিকা: ডঃ মুখোপাধ্যায় অশোকের বৌদ্ধধর্ম প্রসারে অসামান্য ভূমিকার প্রশংসা করেছেন, বিশেষ করে সিংহল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এবং মধ্যপ্রাচ্যে বৌদ্ধধর্মের প্রচারের বিষয়ে।
এই বইটি অশোকের জীবন ও দর্শনের উপর একটি প্রামাণ্য রচনা এবং আজও ঐতিহাসিকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
Chandragupta maurya and his time:-(1943):-
স্যার উইলিয়াম মেয়ার লেকচার সিরিজে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের দেওয়া বক্তৃতাগুলি একটি সংকলিত আকারে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। এখানে প্রকাশিত প্রবন্ধে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের জন্ম ও প্রাথমিক জীবন, তাঁর বিজয় অভিযান, সামরিক বিষয়াবলী, সমসাময়িক সামাজিক জীবন এবং অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, যা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনে এবং পরবর্তীতে এর স্থায়িত্ব রক্ষায় সহায়ক হয়েছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রশাসন এবং তাঁর সুপরিচিত অর্থনৈতিক নীতিগুলি সম্রাট অশোকের রাজত্বকাল পর্যন্ত অনবদ্য ছিল। অর্থনৈতিক জীবনের নিয়ন্ত্রণ এবং শিল্পের জাতীয়করণ মৌর্য যুগের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, যা এই বইয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। চতুর্থ শতাব্দী থেকে ভারতীয় সমাজের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের জন্য অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ের অধ্যয়ন ও লেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে কৌটিল্যের অর্থনীতির কিছু মূল উপাদান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা ততটা পরিচিত ছিল না বা যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। সংস্কৃত ও জৈন গ্রন্থ, অশোকের শিলালিপি এবং ধ্রুপদী রচনাগুলি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের পাশাপাশি মূল গ্রিক উৎসগুলিও তাঁর লেখায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর এই বইটি ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির উদ্ভাবনী গবেষকদের কাছে একটি মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি ইতিহাসের ছাত্র, গবেষক এবং এই গবেষণাক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িত অধ্যাপকদের জন্য একটি বৈধ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।
Ancient Indian Education (Brahmanical and Buddhist) (১৯৪৭):-
এটি ডঃ মুখোপাধ্যায়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই গ্রন্থে তিনি প্রাচীন ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, প্রাচীন ভারতে শিক্ষা কেবল জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম ছিল না, বরং তা ছিল আত্মিক উন্নতি এবং চরিত্র গঠনের একটি প্রক্রিয়া।
* গুরুকুল প্রথা: তিনি গুরুকুল প্রথার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন, যেখানে ছাত্ররা গুরুর সান্নিধ্যে থেকে জ্ঞান অর্জন করত। এই প্রথার অধীনে নৈতিকতা, শৃঙ্খলা এবং আধ্যাত্মিকতার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হতো।
* ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ শিক্ষা: গ্রন্থটিতে ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলি আলোচনা করা হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন যে, উভয় ধারাই জ্ঞানচর্চা এবং নৈতিক বিকাশের উপর গুরুত্ব আরোপ করত, যদিও তাদের পদ্ধতি এবং দর্শনে কিছু পার্থক্য ছিল।
* শিক্ষার বিষয়বস্তু: এই গ্রন্থে বেদাঙ্গ, উপনিষদ, স্মৃতিশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র, ব্যাকরণ, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, এবং শিল্পকলা সহ বিভিন্ন শিক্ষণীয় বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে।
* প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়: তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশীলা, এবং বলভীর মতো প্রাচীন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ভূমিকা এবং তাদের আন্তর্জাতিক গুরুত্বের উপরও তিনি আলোকপাত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ছিল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র এবং এশিয়া থেকে বহু শিক্ষার্থী এখানে জ্ঞান অর্জনের জন্য আসতো।
* নারী শিক্ষা: তিনি প্রাচীন ভারতে নারী শিক্ষার অবস্থান নিয়েও আলোচনা করেছেন, যদিও এই বিষয়ে প্রমাণের স্বল্পতা রয়েছে।
এই গ্রন্থটি প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার উপর একটি প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হয় এবং আজও এই বিষয়ে গবেষকদের জন্য একটি অপরিহার্য উৎস।
Some Aspects of Ancient Indian Culture (১৯৬৫):-
এই গ্রন্থটি ডঃ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। এটি তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধের সংকলন, যেখানে তিনি প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থে ভারতীয় দর্শন, ধর্ম, শিল্পকলা, এবং সামাজিক রীতিনীতির উপর আলোকপাত করা হয়েছে।
* ভারতীয় জীবন দর্শন: তিনি ভারতীয় দর্শনের মূল ধারণাগুলি, যেমন – কর্মফল, মোক্ষ, এবং পুনর্জন্মের উপর আলোকপাত করেছেন।
* সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক: এই গ্রন্থে ভারতীয় মন্দিরের স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলার ঐতিহ্য, এবং প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের (যেমন – বেদ, উপনিষদ, পুরাণ) গুরুত্ব আলোচনা করা হয়েছে।
* সংস্কৃতি ও সভ্যতা: তিনি ভারতীয় সংস্কৃতিকে একটি গতিশীল এবং বিবর্তনশীল সত্তা হিসেবে দেখেছেন, যা বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রভাবকে আত্মস্থ করে নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখেছে।
এই গ্রন্থটি প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির একটি সারসংক্ষেপ এবং তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টির প্রমাণ।
ডঃ মুখোপাধ্যায়ের লেখনীর প্রভাব ও অবদান
ডঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের লেখনী ভারতীয় ইতিহাস গবেষণায় এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর অবদানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে উল্লেখ করা হলো:
* ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি চ্যালেঞ্জ: ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিকরা প্রায়শই ভারতের ইতিহাসকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করতেন এবং ভারতীয় সভ্যতাকে স্থবির ও পশ্চাৎপদ হিসেবে চিত্রিত করতেন। ডঃ মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রামাণ্য গবেষণার মাধ্যমে এই ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, ভারত একটি গতিশীল এবং উন্নত সভ্যতা ছিল, যার নিজস্ব গৌরবময় অতীত ছিল।
* জাতীয় চেতনার উন্মেষ: তাঁর লেখনী ভারতীয়দের মধ্যে নিজেদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গর্ববোধ জাগিয়ে তুলেছিল। এটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে এক নতুন উদ্দীপনা যোগ করেছিল এবং আত্মমর্যাদা বোধ বাড়াতে সহায়ক হয়েছিল।
* নতুন দিগন্ত উন্মোচন: তিনি কেবল রাজনৈতিক ইতিহাসেই সীমাবদ্ধ না থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এবং ধর্মীয় ইতিহাসের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তাঁর এই সর্বাঙ্গীণ দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় ইতিহাস গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল।
* আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: তাঁর কাজগুলি আন্তর্জাতিক মহলেও সমাদৃত হয়েছিল এবং ভারতীয় ইতিহাসের উপর গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
* গবেষণার ভিত্তি স্থাপন: তাঁর কাজগুলি পরবর্তী প্রজন্মের ঐতিহাসিকদের জন্য একটি মজবুত ভিত্তি তৈরি করেছিল। তাঁর পদ্ধতি এবং গবেষণার বিষয়বস্তু অনেক তরুণ গবেষককে অনুপ্রাণিত করেছিল।
* পাঠ্যপুস্তকে প্রভাব: তাঁর কাজগুলি ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর লেখাগুলি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক ধারণা গঠনে সহায়ক হয়েছিল।
প্রাচীন ভারত (Ancient India):
এই বইয়ে অধ্যাপক রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত সহজ এবং স্পষ্ট শৈলীতে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। বইয়ের শুরুতে তিনি প্রাচীন ইতিহাসকে প্রভাবিত করা ভৌগোলিক উপাদানগুলি উপস্থাপন করেছেন এবং এইভাবে তিনি ঐক্যের মৌলিক উপাদানগুলি প্রদর্শন করেছেন। বিশেষত, যে উপাদানগুলি দেশের সংমিশ্রণের মৌলিক কারণ ছিল, যার কারণে ভারতের মতো একটি বৃহৎ দেশ গঠন সম্ভব হয়েছিল, সেগুলি উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি ভারতীয় প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা ও জাতীয়তার মৌলিক কারণগুলিকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং বইটিতে লিখেছেন। এর বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় শান্তিবাদী সমালোচনা প্রশংসনীয়। অধ্যাপক রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে সম্রাট হর্ষবর্ধন পর্যন্ত ইতিহাসের সময়কাল বর্ণনা করেছেন। তিনি সমসাময়িক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গঠনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও অর্জিত সাফল্যগুলি উপস্থাপন করেছেন। অধ্যাপক রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের এই বইটি এর নির্ভরযোগ্যতার কারণে গবেষকদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী, এবং একই সাথে ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী সাধারণ পাঠকদের কাছে এর সহজ ও উপস্থাপনযোগ্য লেখার শৈলীর কারণে এটি অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য। এই বইটিকে ভারতের প্রাচীন ইতিহাস উন্মোচনকারী একটি নির্ভরযোগ্য মূল্যবান বই হিসেবে গণ্য করা যায়।
প্রাচীন ভারতীয় ধারণা ও ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্ব (Ancient Indian Concepts and Divine Persons):
এই গুরুত্বপূর্ণ বইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। ‘বৈদিক’ যুগে ‘যাজ্ঞবল্ক্য’-এর বৈশিষ্ট্য, সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের উদার সাম্রাজ্যবাদ এবং সম্রাট হর্ষবর্ধন, অশোক ও সমুদ্রগুপ্তের সাধারণ চেতনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থা অশোকের মানবতাবোধ এবং সমুদ্রগুপ্তের উদার সাম্রাজ্যবাদী চেতনা প্রদর্শন করে। এই বইটিতে বৈদিক, বুদ্ধ, অশোক, সমুদ্রগুপ্ত এবং হর্ষবর্ধন যুগ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সঙ্গে হর্ষবর্ধন যুগের পাঁচটি মানচিত্র এবং সমুদ্রগুপ্ত যুগের সাত প্রকারের স্বর্ণমুদ্রার ছবি উপস্থাপন করা হয়েছে, যা এই বইয়ের নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করে।
ভারতের মৌলিক ঐক্য (Basic Unity of India):
ভারতের মৌলিক ঐক্যের নিয়মাবলী এবং এর সাংস্কৃতিক দিকগুলিকে প্রভাবিত করা উপাদানগুলি এই বইয়ে বিশেষভাবে এবং কার্যকরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের সময় অধ্যাপক রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় ভারতের বিভাজন নিয়ে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি এই বিভাজনকে একটি কৃত্রিম রাজনৈতিক বিভাজন হিসেবে দেখেন, যদিও তিনি ভারতের সমস্ত জাতি ও সম্প্রদায়কে ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের উপর মনোযোগ দিতে অনুরোধ ও জোর দিয়েছেন। অধ্যাপক রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের ভারতীয় জনগণের সাংস্কৃতিক ঐক্যের চেতনার উপর গভীর বিশ্বাস ও আস্থা ছিল।
হিন্দু সংস্কৃতি (Hindu Culture):
হিন্দু সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর এই বইয়ে অধ্যাপক রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় হিন্দু সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান এবং এর বিশেষত্বগুলি উন্মোচন করেছেন, যা হিন্দু সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর অধ্যয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গুপ্ত সাম্রাজ্য (Gupt Empire):
গুপ্ত সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ যুগ এবং এর মহান অর্জনগুলি এই বইয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। এই যুগের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অগ্রগতি এবং অর্জনগুলি বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনার সাথে উপস্থাপন করা হয়েছে। মৌলিক প্রকাশমূলক সরঞ্জামগুলির ব্যাপক ব্যবহার এই বইটিকে অসাধারণ করে তুলেছে।
ভারতের ঐক্য সম্পর্কিত গ্রন্থাবলী:-
ভারতের ঐক্য প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের লেখা গ্রন্থগুলির মধ্যে (১) ভারতের মৌলিক ঐক্য (The Basic Unity of India), (২) ভারতীয় সংস্কৃতিতে জাতীয়তা (Nationality in Indian Culture), (৩) ঐক্যবদ্ধ ভারত (United India), (৪) সাম্যবাদের উপর নতুন দৃষ্টিভঙ্গি (New Viewpoint on Communism), (৫) আমাদের সমস্যা (Our Problems) ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা ভারতীয় ঐক্যের উপর অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের অনন্য চিন্তাভাবনা উপস্থাপন করে।
অন্যান্য গ্রন্থাবলী:-
অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে (১) ভারতের আদিম শিল্পকলা বিষয়ক টীকা (Notes on the Initial Arts of India), (২) ভারতের ভূমি ব্যবস্থা (The Land System of India)। এছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলিও উল্লেখযোগ্য।
অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের জনসেবামূলক কার্যক্রম:-
একজন সফল ও বিশেষজ্ঞ শিক্ষক, অধ্যাপক এবং প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসবিদ হওয়ার পাশাপাশি, অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় তাঁর দীর্ঘ জীবনে জনসেবার জন্য অনেক সামাজিক ও শিক্ষামূলক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি উল্লেখ করা যেতে পারে:
* ১. কমিউনিস্ট বিরোধী সংগঠন: তিনি বাংলায় কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের মন্ত্রী ছিলেন, যার প্রধান আহ্বায়ক ছিলেন মহাকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সংগঠনটি বাংলার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বিকাশে কাজ করেছিল।
* ২. বাংলা আইন কমিটির সদস্য: ১৯৩৭ সালে অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় বেঙ্গল অ্যাক্ট কমিটির কংগ্রেস মনোনীত সদস্য ছিলেন, যেখানে তিনি ছয় বছর সফলভাবে কাজ করেন।
* ৩. বেঙ্গল ল্যান্ড রেভিনিউ কমিশন: ১৯৩৯-৪০ সালে তিনি “বেঙ্গল ল্যান্ড রেভিনিউ কমিশন”-এর সদস্য ছিলেন। বাংলার জমির উপর উপযুক্ত রাজস্ব নির্ধারণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
* ৪. জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO): ১৯৪৬ সালে অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় জাতিসংঘের “খাদ্য ও কৃষি সংস্থা” (FAO)-তে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং প্রশংসনীয়ভাবে সেবা করেন।
* ৫. রাজ্যসভার সদস্য: ১৯৫২ সালে তৎকালীন ভারতের রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ তাঁকে সমাজসেবায় তাঁর বিশেষ অবদানের জন্য ‘রাজ্যসভার’ সদস্য হিসেবে আমন্ত্রণ জানান, যেখানে তিনি ছয় বছর কাজ করেন।
* ৬. পদ্মভূষণ পুরস্কার: ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কারে ভূষিত করে তাঁর কাজের প্রশংসা করে।
* ৭. শিক্ষক সমিতির সভাপতি: অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন, যেখানে তিনি শিক্ষকদের এবং শিক্ষার জন্য অনেক সমস্যা সমাধান এবং উন্নয়নমূলক কাজ করেন।
* ৮. অখিল হিন্দ ইতিহাস পরিষদ: ১৯৫২ সালে অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় ‘অখিল হিন্দ ইতিহাস পরিষদ’-এর সভাপতি নির্বাচিত হন।
* ৯. হিন্দু মহাসভার সক্রিয় সদস্য: অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় হিন্দু মহাসভার একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত এর সহ-সভাপতি হিসেবে ছিলেন।
সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা:-
ডঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় একজন মহান পণ্ডিত হলেও, তাঁর কাজের কিছু সীমাবদ্ধতা বা সমালোচনার বিষয় ছিল:
* জাতীয়তাবাদী প্রবণতা: কিছু সমালোচক মনে করেন যে, তাঁর রচনায় কখনও কখনও জাতীয়তাবাদী আবেগ অতিরিক্ত মাত্রায় প্রাধান্য পেয়েছে, যার ফলে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য বা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বিঘ্নিত হয়েছে। তাঁর প্রচেষ্টা ছিল ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা, যা মাঝে মাঝে অতিশয়োক্তির রূপ নিতে পারতো।
* ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব: তাঁর লেখনীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাব সুস্পষ্ট ছিল, যা তাঁর বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কিছুটা পক্ষপাতদুষ্টতা নিয়ে আসতে পারতো।
* সামাজিক ইতিহাস: যদিও তিনি সামাজিক ইতিহাসের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তবে সমাজের প্রান্তিক গোষ্ঠী বা নিম্নবর্গের মানুষদের উপর তাঁর গবেষণার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম ছিল। উচ্চবর্গীয় বা শাসক শ্রেণীর ইতিহাসই তাঁর লেখায় বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।
* নারী ইতিহাসের অভাব: আধুনিক ঐতিহাসিক গবেষণায় নারী ইতিহাসের উপর যে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তার কিছুটা অভাব তাঁর লেখায় পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীন ভারতের নারীদের ভূমিকা ও অবস্থান নিয়ে তাঁর আলোচনা তুলনামূলকভাবে সীমিত ছিল।
* প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা: যদিও তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তবে তাঁর নিজস্ব প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা বা ক্ষেত্রসমীক্ষা (fieldwork) তুলনামূলকভাবে কম ছিল। তিনি মূলত অন্যের গবেষণালব্ধ তথ্যের উপর নির্ভর করতেন।
তবে এই সীমাবদ্ধতাগুলি সত্ত্বেও, ডঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের অবদানকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। তাঁর কাজ ভারতীয় ইতিহাসের গবেষণায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল এবং ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে মুক্ত হয়ে ভারতীয় ইতিহাসকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার পথ খুলে দিয়েছিল।
উপসংহার:
একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়তা তাঁর সমগ্র জীবন ভারতীয় ইতিহাস অধ্যয়নে নিবেদিত ছিলেন। তিনি প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য বই, গবেষণা এবং সমালোচনা লিখেছেন। তাঁর সমস্ত লেখালেখির আগে তিনি সমস্ত উপলব্ধ সহায়ক উৎসগুলি অধ্যয়ন ও ব্যবহার করতেন। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে তিনি ইতিহাসের অধ্যাপক এবং লেখক হিসেবে নিরন্তর সেবা করেছেন।
অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতার ৮৩ বছর বয়সে মারা যান। বরোদা রাজ্য একবার তাঁকে ‘ইতিহাস শিরোমণি’ উপাধিতে এবং ৭০০০ টাকা দিয়ে সম্মানিত করেছিল। তাঁর বন্ধুরা তাঁর সম্মানে অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা শুরু করেছিলেন।
একজন মহান গবেষক ও বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি, তিনি একজন সুস্পষ্ট ও স্পষ্ট বক্তা ছিলেন। তিনি ভারতের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। ১৯৫৪ সালে মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি একটি স্মরণীয় বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসবিদ। তিনি তাঁর বই, প্রবন্ধ, বক্তৃতা এবং গবেষণার মাধ্যমে ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির স্মরণীয় এবং বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। তাঁর ইতিহাস রচনা নির্ভরযোগ্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে ছিল। তিনি প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন দিক নিরপেক্ষভাবে উন্মোচন করেছেন এবং জাতীয়তা ও উচ্চ সাংস্কৃতিক বিশ্বাস ও চিন্তাভাবনা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।
“সত্যের ভিত্তি ছাড়া ইতিহাস লেখা নিরর্থক” – অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় ইতিহাসের এই ভাবনাটি প্রকৃত অর্থেই বাস্তবায়িত করেছিলেন। অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় লিওপোল্ড ভন রাঙ্কের মতো জাতীয়তাবাদী কঠোরতার চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে প্রকৃত আবিষ্কারের ভিত্তিতে ইতিহাস উপস্থাপনে বিশ্বাস করতেন। তিনি প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলি উপলব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে নির্ভয়ে উপস্থাপন করেছেন। অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় কৃত্রিম সম্পর্কের বিরোধিতা করতেন।
সংক্ষেপে, সমগ্র আলোচনা থেকে বলা যায় যে প্রয়াত অধ্যাপক ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় দেশের অন্যতম প্রধান ইতিহাসবিদ ছিলেন। ঐতিহ্যবাহী ইতিহাসবিদদের মধ্যে তাঁর স্থান অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ।
REFERENCES:
১) মুর্শিদাবাদ কথা, শ্রীশ চট্টোপাধ্যায়।
২)Karma, Kuldev Sahay Aur Shrivastav Mukundillal (Sampadak), Hindi Vishvakosh – Khand – 9. Pratham Sanskaran, Nagari Pracharini Sabha – Varanasi – 1967, p.316.
৩) Mukherjee, Bhaarat, (Dr.) Chotha Radhakumud: Prachin Sanshodhit Sanskaran, Rajkamal Prakashan, Nai Delhi – 1990, Mukh Prushth-2.
৪ Mukherjee, (Dr.) Radhakumud: Chandragupta Maurya Aur Uska Kaal, Rajkamal Prakashan, Nai Delhi-1992, Mukh Prushth-3.
৫)Mukherjee, (Dr.) Radhakumud: Ancient Indian Education, Macmillan & Co. London-1952.
৬) Vide. Mukherjee Radhakumud: The History of Indian Shipping & Maritime Activities from the Earliest Times. Macmillan & Co. London-1952.
৭) Verma, Kuldev Sahay Aur Shrivastav Mukundilal (Sampadan) Hindi Vishwakosh – Khand-9, Pratham Sanskaran, Nagri Pracharini Sama , Varanasi- 1967, Pru-316.
৮) Mukherjee, (Dr.) Radhakumud: Chandragupta Maurya Aur Uska Kaal, Rajkamal Prakashan, Nai Delhi- 1992, Mukh Prushth-3.
৯) Mukherjee, (Dr.) Radhakumud: Chandragupta Maurya Aur Uska Kaal, Rajkamal Prakashan, Nai Delhi- 1992. Page | 89 Research Guru: Online Journal of Multidisciplinary Subjects (Peer Reviewed).
১০) Historian R.K. Mukharjee,Dr. Vasant R. Patel,Research Guru,Online Journal of Multidisciplinary Subjects (ISSN: 2349-266X),Volume-13, Issue-3, December-2019
(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)