উদ্বেলিত জনতার জনকল্লোলে তিনি ‘ দেশপ্রাণ ‘। ভয়ে কম্পিত ইংরেজ সরকারের ভাষায় তিনি ‘বাংলার ষাঁড় ‘। রাজনৈতিক চেতনায়, অবিচল আদর্শে, অন্যায়ের কাছে মাথা না নোয়ানো বাংলার ‘মুকুটহীন সম্রাট’ তিনি। তিনি বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক অথচ নিদারুণভাবে অবহেলিত এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবনালেখ্য। সমকালীন রাজনৈতিক জীবনে এবং ভারতের জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাসে বীরেন্দ্রনাথের আরও গুরুত্বপূর্ণ স্থান পাওয়ার সবরকম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তদানীন্তন রাজনৈতিক নেতৃত্ববর্গের দৃষ্টিভঙ্গির অস্বচ্ছতার কারণে তা হয়ে ওঠেনি। শুধু তাই নয় মুষ্টিমেয় কয়েকজন মূলধারার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচয়িতা এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত হতে পারেননি বলেই মনে হয়েছে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে। ভীষণ রকম কষ্ট তাড়িত হই, যখন দেখি উচ্চ বর্গ শহরকেন্দ্রিক ক্ষমতা দখলের পরম্পরায় এইরকম এক মহাপ্রাণ কে ইতিহাসের উজ্জ্বল আলো থেকে দূরে সরে যেতে হয়।
রাজনৈতিক আদর্শ :
জন্মে ছিলেন বাংলার মেদিনীপুর জেলার একেবারে প্রান্তিক এক গ্রাম্য প্রকৃতির কোলে,দেশপ্রাণ ব্লকের আউঁড়াই গ্রামে। মাটির গন্ধ- অশ্রু- ঘাম জীবন প্রণালীতে অভ্যস্ত হয়েই বড় হয়েছেন জমিদার পরিবারে জন্মানো এই মানুষটি। লন্ডন, আমেরিকা, জাপান প্রভৃতি উন্নত রাষ্ট্র ঘুরে এসেও তিনি উপলব্ধি করেছেন পরিপূর্ণ গ্রাম স্বরাজ এর মধ্য দিয়েই প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ সম্ভব। সেই কারণে সবার আগে জরুরী গ্রাম্য জীবনকে উদ্বুদ্ধ করা। নীতিহীন দেশপ্রেম আর উগ্র জাতীয়তাবাদ কখনোই একটি সুস্থির সমাজের জন্ম দেয় না, বীরেন্দ্রনাথ তাঁর রাজনৈতিক আদর্শে বারবার উপলব্ধি করেছেন । তাঁর স্বাধীনতার চেতনা ও পল্লী ভাবনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং গান্ধীজীর ভাবনার অনুসারী ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশী সমাজ এবং পরবর্তীকালে রবি ঠাকুরের রাষ্ট্রীয় ভাবনার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় তাঁর রাজনৈতিক আদর্শে। তাঁর মতে গ্রাম স্বরাজ ই হতে পারে স্বাধীনতার মূল ভিত্তি। রবীন্দ্রনাথের সমাজ চিন্তা ও পল্লী সংগঠন ভাবনায় এই বিষয়টি অন্যতম প্রধান স্থান অধিকার করে আছে – সেই কারণে শ্রীনিকেতন ছাড়া শান্তিনিকেতনের ভাবনা অসম্পূর্ণ। নগরায়ন নয়, বস্তুত দেশময় পল্লীতে পল্লীতে প্রসারিত এক নবজাগরণের ধারণা স্বাধীনতা আন্দোলনকে সার্থকতা দিতে পারে, স্বদেশকে দাঁড় করাতে পারে এক শক্ত ভিতের উপর; স্বদেশী আন্দোলনের মর্মকথা হলো পল্লী কে আপন করে তোলার ভিতর দিয়ে বিপ্লবের শুরু, বিশ্বকে আপন করাই তার অন্তিম লক্ষ্য।
মুক্তির পথ:
নিজে গাট্টা গোট্টা এবং সুঠাম দেহের অধিকারী হওয়ার কারণে সারা বাংলা জুড়ে পরিচিত ছিলেন ‘ কালো ষাঁড়’ হিসেবে। তবু এই মানুটিই হৃদয় দিয়ে বুঝেছিলেন, “শুধু দৈহিক বল দ্বারাই জাতির মুক্তি অসম্ভব। চাই শিক্ষা এবং জ্ঞানের উপযুক্ত প্রয়োগ।” তিনি বলেছেন- “দেহের বলে জাতি বড় হয় না। জাতি বড় হয় জ্ঞানের বলে, হৃদয়ের মহত্বে, প্রাণের অদম্য অপরাজেয় শক্তিতে।” এক ঐতিহসিক অভিব্যক্তিতে বলেছেন – “আজ শিক্ষিত বাঙালি বললে এক গুরুতর স্বার্থপর একান্ত অদূরদর্শী নিতান্ত অকর্মণ্য জীবের ছবি মনে আসে।”….. বর্তমান রাজনীতি আবহে দাঁড়িয়ে এই কথাটি ভীষণ রকম সত্য হয়ে প্রতিধ্বনি তৈরি করতে করতে সমগ্র শিক্ষিত সমাজকে স্বচ্ছ এক আয়নার সামনে দাঁড় করায় বারবার। অবাক বিস্ময়ে সমাজ লক্ষ্য করছে, যারা শিক্ষায় বুদ্ধিতে খাটো নয় তাদের চিত্তের স্বাধীনতা প্রতিদিন খর্ব হচ্ছে – সরকারি পৃষ্ঠকতা লাভের নানা প্রলোভনে। অন্ধকার হয়ে আসা এই কালবেলায় দাঁড়িয়ে সেই সমাজের স্বপ্ন দেখি, যেখানে সমাজের আত্মশক্তি পদে পদে পরাভূত হবে না রাষ্ট্রশক্তির অন্ধ ও অহংকৃত আক্রমণে।
ইউনিয়ন বোর্ড বিরোধী আন্দোলন:
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রথম ও সফল কৃষক আন্দোলনের নাম মেদিনীপুরের ইউনিয়নবোর্ড বিরোধী আন্দোলন। ইংরেজ সরকার স্বায়ত্ব মূলক ব্যবস্থাকে ইউনিয়ন বোর্ডের মাধ্যমে গ্রাম অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার নাম করে প্রকৃত অর্থে দরিদ্র জনগণের উপর গ্রামীণ মুরুব্বিদের শাসন কায়েম করার এই অপচেষ্টা সফল ভাবে প্রতিরোধ করেছিলেন বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। শাসনক্ষমতা প্রত্যাহারের দাবি করা উচ্চবিত্ত শ্রেণি সেদিন মনেপ্রাণে চায়নি ক্ষমতা দেশের সমস্ত শ্রেনীর মানুষের মধ্যে সমানভাবে বিস্তার লাভ করুক ; সর্বোপরি কৃষকরা নিজেদের জমির অধিকার সুষ্ঠুভাবে ভোগ করুক – চায়নি উচ্চবিত্ত শ্রেণি। তারা চেয়েছিল শাসন ক্ষমতা নিজেদের মধ্যে কুক্ষিগত রাখতে। সেই কারণে হয়তো উপদলীয় কোন্দল এর নাম করে প্রকৃত জননেতা হয়ে ওঠা বীরেন্দ্রনাথ শাসমলকে সক্রিয় রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে বিতাড়িত করার ষড়যন্ত্র চলে কলকাতা ও দিল্লির উচ্চবর্গের নেতাদের মধ্যে। যদিও নিজস্ব যোগ্যতায় গ্রাম স্বরাজ আদর্শে অবিচল থাকা গ্রাম বাংলার এই বিপ্লবী ভারতের রাজনীতির মঞ্চে উজ্জ্বলভাবে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে সমর্থ হয়েছিলেন জনমানসে । তাঁর দৃঢ় ও বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাখ্যায় ১৯২১ সালে বরিশালের বি পি সি সি এর সাধারণ সভায় ইউনিয়ন বিরোধী আন্দোলনের পক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কার্যকরী কমিটির সভায় সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ভাবে এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব নেওয়া হয়, আর এই জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন তৎকালীন উচ্চ পর্যায়ের এবং উচ্চবর্গের নেতারা। অথচ ঐতিহাসিক সত্য হলো এই আন্দোলন সমাজের সর্ব স্তরের মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা বিস্তৃত করেছিল, মূলত সেই কারণে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে মেদিনীপুর জেলার ভূমিকা অগ্রগণ্য ও ঐতিহাসকভাবেই উজ্জ্বল থেকেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে সমাজের সর্ব স্তরের মানুষের এই সর্বাত্মক অংশগ্রহণের নিদর্শন, সামান্য কিছুটা মহারাষ্ট্র বাদে ভারতবর্ষের অন্য কোন জেলায় ঘটেনি। পরবর্তীকালে এই ঘটনাকে স্মৃতির অতলে তলিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত হয়েছে বারবার। কোনো এক আশ্চর্য কারণে রমেশচন্দ্র মজুমদার, অমলেশ ত্রিপাঠীর মতো ঐতিহাসিকদের কলমেও এই আন্দোলন থেকে যায় অনুল্লেখিত। অথচ সেই সময়কালে গুজরাটের সুরাট জেলার বরদৌলি তালুকের পতিতদারদের তথাকথিত কৃষক আন্দোলন কে প্রথম অহিংস আন্দোলন হিসেবে উল্লেখ করেছেন ভারতবর্ষের বেশিরভাগ ঐতিহাসিক। এ তথ্য যেমন ঐতিহাসিকভাবে অর্ধসত্য, তেমনি এটি কোনোভাবে সফল আন্দোলনও নয়। ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাসে উচ্চবর্গের আধিপত্য কায়েম করার যে সুচারু প্রক্রিয়া প্রবাহমান কাল ধরে ঘটে এসেছে তা ব্যতিক্রম হয়নি ইউনিয়ন বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও। বরং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে সফল এই আন্দোলনকে কেবল ‘ মাহিস্য’ আন্দোলন বলে জাতিভেদ দৃষ্টিভঙ্গিতে সংকীর্ণ করে দেখাতে চাওয়া হয়েছে সেইসময়ে। অথচ ইতিহাস স্বীকার করেছে সারা ভারতবর্ষে ইংরেজ বিরোধীতায় কেবল এই আন্দোলনে মাহিষ্য, মুসলমান ও ‘নিচু জাতের ‘ হিন্দু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণেই সর্বাত্মক আকার নিয়েছিল। তবে ভুললে চলবেনা, মেদিনীপুরের ৮৫ শতাংশ মানুষই মাহিষ্য সম্প্রদায়ের।
অহিংস বনাম সহিংস:
ভারত তথা সারা বিশ্ব ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধী অহিংসার পূজারী হিসেবে পরিচিত। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে “আমার জীবন আমার বাণী” এই মতবাদের গান্ধীজী নিজে জীবনে বহু ক্ষেত্রে বিচ্যুত হয়েছেন তাঁর আদর্শ থেকে। বীরেন্দ্রনাথ শাসমল রাজনৈতিক আদর্শে ও জীবন চর্চায় অহিংসবাদের প্রকৃত, সফল ও সার্থক রুপায়ানকারি স্বাধীনতা সংগ্রামী। মানবিকতার অজেয় মন্ত্রে দীক্ষিত তিনি, ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। তিনি মনে করতেন, নিজের উপর যত অত্যাচারই হোক না কেন অহিংসবাদের প্রতি অটল-অবিচল থাকা উচিৎ; কিন্তু অসহায় মানুষ বিশেষ করে নারী ও শিশুর উপর অন্যায় অত্যাচারে অহিংস পথ সবসময় বাঞ্ছনীয় নয়। রাজনৈতিক আদর্শের অহিংসার প্রতি বীরেন্দ্রনাথ এর এই আত্মনিয়োগকে মান্যতা দিয়েছেন স্বয়ং গান্ধীজী। সুশীল ধাড়া, অজয় মুখার্জি, সতীশ সামন্ত এর নেতৃত্বে ১৯৪৫ সালে তাম্রলিপ্ত সরকার কে মান্যতা দিতে গিয়ে মহিষাদল এ দাঁড়িয়ে গান্ধীজী বলেছিলেন- “তোমরা অহিংস থাকলে আমি আরো খুশি হতাম।” এর মধ্যে এক ফাঁকি ও চালাকির মনোভাবই প্রকট হয় কেবল, আদর্শকে পেছনের সারিতে বসিয়ে। উল্লেখ্য স্বাধীন তাম্রলিপ্ত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিপ্লবীদের দ্বারা প্রায় ৯১ জন মানুষের হত্যা হয়েছিল।
ইতিহাস এবং হিংসা- অহিংসা :
যুগ যুগ ধরে মানুষের ইতিহাস যেন হিংসা ও যুদ্ধেরই কথা লিপিবদ্ধ করে গেছে। স্বীকার্য মানুষের ইতিহাসে অনেকটা স্থান জুড়ে আছে শ্রেণীতে শ্রেণীতে, জাতিতে জাতিতে দ্বন্দ্ব; সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সংঘর্ষ। তার পরেও একটি প্রশ্ন থেকে যায় মানুষের সমাজ যে এখনও ধ্বংস না হয়ে প্রবহমান ধারায় আরও সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে – হিংসাই প্রধান কথা হলে তা সম্ভব হতো না। সমাজকে একসঙ্গে ধরে রাখার শক্তি হিংসার নেই। হিংসার ভিতর নাটকীয়তা বেশি। আর শান্তি চলে নিঃশব্দে। কিন্তু আজও সমাজ যে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়নি, এ থেকেই প্রমাণিত হিংসার শক্তি এখনো জয়ী হয়নি। হিংসা জয়ী হলে পরিবার টিকতো না, সমাজও না। ক্ষমতাবান শ্রেণীর অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অহিংসা প্রশ্নটা তেমন জরুরি নয় – এ কথা যারা বলেন মূলত মার্কসবাদীরা, তারা দুটি কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবেন না। প্রথমত, বিপ্লবী আন্দোলন যখন হিংসার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়ে তখন সেই বিপ্লবী সংগঠনের ভিতর থেকেই অন্যায় ও শোষণের নতুন ভীত তৈরি হবার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে; লেলিন ও স্তালিন দলের মাওবাদ কিংবা নকশাল আন্দোলন এযুগের এক স্পষ্ট শিক্ষা। দ্বিতীয়ত, মানুষের ভিতরে একটা আদিম হিংসার শক্তি আছে যাকে আদর্শের মোড়ক দিয়ে উৎসাহিত করলে সমাজ জীবনে সর্বশ্রেণীর মানুষের জন্য তার পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ। সুতরাং হিংসা নিশ্চিতভাবে অহিংসার উপর জয়ী হতে পারেনি বলে সমাজ আজও টিকে আছে। একথা যদি অতীতে সত্য হয় তাহলে বর্তমানেও সত্য বলে মানতে বাধা নেই, একথা যদি বর্তমানে সত্য হয় তাহলে ভবিষ্যতেও সত্য হওয়া সম্ভব।
আধ্যাত্মবাদ ও বীরেন্দ্রনাথ:
ভারত উপমহাদেশ আজ এক কঠিন সমস্যায় বিধ্বস্ত। একদিকে উগ্র ধর্ম উন্মত্ত মানুষের আস্ফালন, অপরদিকে মেকি নাস্তিকতা মোড়কে প্রকৃত সমস্যা থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখার প্রবল ষড়যন্ত্র। এই সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল আরো বেশি করে গ্রহণীয় হতে পারেন। যা মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরি করে, মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখে, অন্যকে অসম্মান ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে শেখায়; সর্বোপরি মানবিকতা ভূলুণ্ঠিত হয় এবং মানুষের স্বাধীনভাবে বাঁচাকে অনিশ্চিত করে তাকে তিনি ধর্ম বলে মানতে চাননি। জীবনচর্চায় ধর্ম এবং ধর্ম আচরণকে পৃথকভাবে দেখতে শিখেছিলেন। আধ্যাত্বিক ভাবনায় দেবতার প্রতি ভক্তি-পূজাকে গ্রহণ করলেও তা আচার বিহীন ও ব্রাহ্মণ বর্জিত। অর্থাৎ তাঁর ভাবনায় পূজা হলো পরম করুণাময় ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সম্পুর্ন সমর্পণ এবং তা নিশ্চিত আচার বিহীনভাবে।
সাহিত্য জীবন:
বীরেনবাবু সুদীর্ঘ জীবন পাননি। রাজনৈতিক আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী এবং সামাজিক কাজে আত্ম নিয়োজিত কর্মব্যস্ত জীবনে সঙ্গত কারণেই অনেক কিছু লিখে যেতে পারেননি। জেলে থাকা অবস্থায় ১৯২২ এ ক্ষুদ্র খন্ডের আত্মচরিত ‘স্রোতের তৃণ’ প্রকাশ পায়। রাজনৈতিক জীবনে একাকী এবং আপোষহীন সৈনিক তিনি। রাজনীতির ছোট খাটো সমঝোতায় অপরাগ। সে সময়ের রাজনীতির সঙ্গে তাল রেখে দল-উপদল করতে পারেননি এবং তা কেবল মাত্র আদর্শের কারণে, নীতির প্রশ্নে। স্রোতের বিপরীতে একাকী আজীবন বিচরণ করেছেন অথচ নিজেকে বলেছেন ‘স্রোতের তৃণ’। মার্কিন দেশের গণতন্ত্রের আদর্শে উদ্বুদ্ধ মানুষটি জাতিবিদ্বেষ এর উর্ধে, জাতি বৈষম্যের ঊর্ধ্বে, ব্যক্তিত্বের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার মতো গল্প লিখেছেন – ‘নিউ ইয়র্কে পাঁচ মাস’ বা ‘অমল ও রামকৃষ্ণ’ প্রভৃতি গল্প। এছাড়াও বালির শিশু সমিতির সভাপতির ভাষণে পরাধীনতার কারণ ও তার প্রতিকার, কৃষ্ণনগর বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে স্বরাজ সম্পর্কে অসাধারণ বক্তব্য আজও সমান গুরুত্বের দাবি রাখে। এছাড়াও ছোটখাটো অসংখ্য ভাষণ, চিঠিপত্র প্রভৃতিতে ছড়িয়ে রয়েছে বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের উজ্জ্বল স্বাক্ষর ; সেইসঙ্গে আগামী ভারতের পথ নির্দেশের রূপরেখা।
বীরেন্দ্রনাথ, ‘দেশপ্রাণ’ :
অজেয় ব্যক্তিত্ব, আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্বের কারণে তিনি বাংলার ‘মুকুটহীন সম্রাট’। ইংরেজের ভয় কম্পিত নাম ‘কালো ষাঁড়’। প্রবল জনপ্রিয় এই জননেতা জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর এক তুমুল উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল সারা জেলা জুড়ে। তাঁকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে কাঁথির ঐতিহাসিক দারুয়া ময়দানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। সেই সময়ে জমায়েত হয়েছিল প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ। লাখো মানুষের সমাগমে, সমবেত জনতার উচ্চকিত ও উদ্বেলিত কল্লোলে বীরেন্দ্রনাথ শাসমাল ভূষিত হন ‘ দেশপ্রেম ‘ হিসেবে। আমৃত্যু আপোষহীন ‘ সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়,কিন্তু কোনো কিছুর জন্য সত্যকে নয় ‘, জীবন আদর্শে চালিত হওয়া এই মানুষটি মৃত্যুর পরও উচ্চশির। পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত আর কোনো দৃষ্টান্ত নেই,যেখানে একজন মানুষ সগর্বে ঘোষণা করতে পারেন ” জীবনে আমি কোথাও মাথা নোয়াই নি, তাই মৃত্যুর পরও মাথা নোয়াব না।” সেই কারণে মৃত্যুর পর কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে তাঁকে দাঁড় করিয়ে পোড়ানো হলো – সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে নতুন এক ইতিহাসের সাক্ষী হলো। সকল প্রকার রাজনৈতিক যোগ্যতা ও ক্ষমতা থাকা সত্বেও ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাসে কেবল আঞ্চলিক ইতিহাসের পাতার এক কোণে অবহেলায় ঠাঁই হয় বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের। নিজে অহিংসবাদী হলেও রাজনৈতিক কারণে সহিংসবাদী বিপ্লবীরা যখন ইংরেজ সরকারের বিচার ব্যবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে তাদের মামলা লড়েছেন। তাঁর প্রধান লক্ষ্য ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, মাতৃভূমির মুক্তি, বিদেশি শাসনের অবসান। সারাজীবন কোন অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে মাথা নত করেননি কোথাও। জাতীয় কংগ্রসের দল ও উপদলীয় কোন্দলে নিজেকে যুক্ত করেননি সচেতনভাবে। কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হতে পারেননি কলকাতা লাবির চাপে। সে বার সদ্য আইএএস চাকরি ছেড়ে আসা নেতাজী সুভাষচন্দ্র মেয়র হন। নিজের জেতা আসন চিত্তরঞ্জন দাস কে ছেড়েছেন। গান্ধীজীর বিমাতৃসুলভ আচরণের পরও তাঁর প্রদর্শিত অহিংস নীতি থেকে সারা জীবনে একবারও বিচ্যুত হননি। একটি রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকার রাজনৈতিক ভীত শক্ত করে গড়ে দিয়েছে,সারা দেশে মেদিনীপুরকে আত্মাবালিদানে ও সংগ্রামী চরিত্রে অগ্রণী করেছেন। সমাজের সকল স্তরের সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা (ইউনিয়ন বোর্ড বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে) দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই মেদিনীপুর জেলায় কখনো দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি আজও। ভারতবর্ষের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল এর জীবন ও আদর্শ বোধহয় আরোও বেশি করে প্রাসঙ্গিক। নতুন পথ খুঁজতে হবে সকলে, একসঙ্গে, একসাথে। আদর্শ খুঁজতে হবে নতুন করে। তাঁর কথায় “আদর্শ তো আকাশ থেকে বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে পড়ে না, কিংবা গাছের ফল পাড়ার বিষয়ও নয়। শিক্ষায় তার পরিকল্পনা এবং শিক্ষার উৎকর্ষে তার পরিবর্ধন। তাই সকলকে শিক্ষিত হতে হবে এই হোক চরম ব্রত।”
26শে অক্টোবর, 2022 সংক্ষিপ্ত জীবন:::: *জন্ম 1881 সালের 26 অক্টোবর( বাংলা 9 কার্তিক) শনিবার।
* স্কুলে পড়া হাইস্কুল 1891, কাঁথি হাই স্কুল। 1900 তে এন্ট্রান্স এক্সামিনেশন।
*পিতৃবিয়োগ 1897
*লন্ডন যাত্রা 1902 কর্মজীবন
*1905 সালে লন্ডনে ব্যারিস্টার হিসেবে নাম নথিভুক্ত করান। *সেখান থেকে ইউএসএ গমন এবং প্রকৃত গণতন্ত্রের অর্থ উপলব্ধি। তারপরে জাপান যাত্রা।
*বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে উত্তাল সময়কাল 1905 এ দেশে ফিরে আসা।
*1906 এ কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টার হিসেবে নতিভুক্ত হন। ঠিক তার পরের বছরই মেদিনীপুরে স্থানান্তরন।
* 1906 সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হেমন্ত কুমারী দেবীর সঙ্গে। তিনি পাঞ্জাবি ও অন্য কাষ্টের মানুষ ছিলেন। জাতপাত এবং জাতিভেদ প্রথার কতটা বিপক্ষে ছিলেন নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ দিয়েছেন।
*1913 সালে দুবদা বেসিনে ভয়াবহ বন্যার ত্রাণ বিতরণ কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। সহযোগী ছিলেন রাখাল চন্দ্র দোলাই (যিনি পরে রাখাল মহারাজ বা ‘ ইস্টানন্দ ‘ নামে খ্যাত হয়েছিলেন)।
*মাহিষ্য শিক্ষা ট্রাস্ট এর সম্পাদক 1918 সালে। *মেদিনীপুরের বি ও সি সি এর সম্পাদক 1920 সালে। *এআইসিসি খাদ্য দপ্তরের সম্পাদক 1920 তে। ওই বছরই নাগপুর এআইসিসি অধিবেশনে অংশগ্রহণ।
* 1921 – তিলক স্বরাজ এর জন্য সেই সময়ে 27000 অর্থ সংগ্রহ। ইউনিয়ন বোর্ড বিরোধী আন্দোলনে গ্রেফতার ও কারাবরণ। বীরেন বাবুর আন্দোলনের চাপে বাধ্য হয়ে সরকার 226 টি বোর্ড বাতিল করেন, কেবল গোপালপুর ছাড়া। *আত্মজীবনীমূলক বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ স্রোতের তৃণ’ প্রকাশিত হয় 1922 সালে।
*1923 – দিল্লি এআইসিসিতে স্বরাজ্য পার্টি গঠিত হয় এবং বীরেন্দ্রনাথ শাসমল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন (বাংলা ও বিহার)। ওই একই বছরে ডিস্ট্রিক বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের দুটি আসন থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এবং চিত্তরঞ্জন দাস কে কাঁথি র আসনটি ছেড়ে দেন। ওই বছরই সি আর দাসের বাড়িতে গান্ধীজী এবং ঢাকা অনুশীলন সমিতির সভাপতি পুলিন দাসের সঙ্গে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল এর বৈঠক হয়।
* এক অর্থে বীরেন্দ্রনাথের রাজনৈতিক গুরু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রয়াণ ঘটে 1924 সালে। পরের বছর 1925 সালে ফরিদপুরের বিপিসিসি র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি।
* 1926 সালে পুনরায় জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেও ঐতিহাসিক সত্য হলো, বড় নেতাদের কারচুপিতে ওই পদে বসেন দেবেন্দ্র লাল খান। এই বছরই কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা শুরু হয়, অপরদিকে মেদিনীপুরে পুনরায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়।
* 1933 সালে মিউনিসিপাল নির্বাচনে 27 নম্বর কাউন্সিলর নির্বাচিত হলেও রাজনৈতিক ভৌগলিক ও ধর্মীয় মিথ্যা যুক্তি দেখিয়ে মেয়র করে দেওয়া হয় এ কে ফজলুল হক কে।
* 1934 সালে মালব্য এর নেতৃত্বে কংগ্রেস নেশনালিস্ট পার্টির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। প্রতিপক্ষ ছিলেন কংগ্রেসের মন্মথ দাস। ভোট গণনার দিনই থ্রাম্বসিসে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন। দিনটি ছিল 1934 সালের 24 শে নভেম্বর। আজীবন অন্যায়ের কাছে মাথা না নোয়ানো দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল কে দাঁড় করিয়ে দাহ করা হয় কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। গান্ধীজী এই মৃত্যুতে কোনো শোক বার্তা প্রেরণ করেননি।
ঋণ:
THE CRACKED PORTRAIT OF PATRIOT – Dr Swadesh Ranjan Mandal
দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল রচনাবলী – স্বদেশ রঞ্জন মন্ডল স্রোতের তৃণ – বীরেন্দ্রনাথ শাসমল
দেশপ্রাণ শাসমল – প্রমথনাথ পাল
মেদিনীপুরে গান্ধীজী সুভাষচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ – হরিপদ মন্ডল স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর – ১ম,২য় ও ৩য় খন্ড
(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)