Dr. Syama Prasad Mookerjee Research Foundation

মুর্শিদাবাদে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু

এক স্বীকৃতিহীন বীর যোদ্ধা, যাঁর বহু অজ্ঞাত অধ্যায় আজও রয়ে গেছে। যাঁর মূল্য নির্ধারণ আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, যিনি মূল্যের জন্য  আসেনওনি বরং বলা যেতে পারে তিনি এসেছিলেন এক মহান ব্রত পালনের জন্য। যিনি ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে গিয়েছেন নিঃশব্দে ক্ষত চিহ্নের গৌরব নিয়ে, সেই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের নাম সুভাষচন্দ্র বসু, যাকে আমরা অন্তরের অন্তঃস্থল  থেকে নোতাজী নামে ডাকি।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এক মহাসমুদ্র!  তাঁর জীবন নিয়ে লেখার ধৃষ্টতা আমার নেই,তাই তাঁর জীবনের একটি ক্ষুদ্র অধ্যায় নিয়ে আজ আমার এই প্রচেষ্টা।

মুর্শিদাবাদে প্রথম আগমন:-

বালক সুভাষের হৃদয়ে তাঁর বাবা মার প্রভাব ও পারিবারিক প্রভাবের সাথে সাথে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ও তাকে ভবিষ্যতের এক মহানায়কের অভিযাত্রার দিকে পৌছে দিতে সাহায্য করেছিল। এবং সে কারণে ১৯১৩-১৪ খৃঃ নাগাদ সুভাষচন্দ্র তার ছাত্র জীবনে প্রথম মুর্শিদাবাদে আসেন।খ
১৯১৩ খৃঃ সুভাষচন্দ্র ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তাঁর ছাত্র জীবনের সহপাঠী ছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীত সাধক দিলীপ কুমার রায়।
এই সময়ে তরুণ সুভাষ বন্ধুদের নিয়ে দেশকে জানবার জন্য বিশিষ্ট জনদের কাছে যাবার জন্য হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে পড়তেন। এবং সে কারণে তাঁর জীবনের প্রথম দিককার যাত্রা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার স্মৃতিবিজরিত ও ভারত ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত মুর্শিদাবাদ নগরীতে প্রথম পদার্পন করেন। এখানকার প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থানগুলি পরিদর্শন করে তাঁর মনে স্বাধীনতালাভের স্পৃহা ও দেশপ্রেম তীব্র হয়ে ওঠে।
সুভাষচন্দ্রের লেখা আত্মজীবনী ‘ভারত-পথিক’-এ লিখেছেন:- “অনেকে আবার প্রকৃত ইতিহাসের সন্ধানে ঐতিহাসিক জায়গাগুলিতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করত। আমি এমনি একটি দলের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলাম। সাতদিন ধরে পরিভ্রমণ করার ফলে প্রাক্ ব্রিটিশ যুগের বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ সম্বন্ধে বহু মুল্যবান তথ্য আমরা আবিষ্কার করেছিলাম- –
স্কুল কলেজে মাসের পর মাস পড়লেও যা কখনও সম্ভব হত না।১

সুভাষচন্দ্র যখন প্রথম মুর্শিদাবাদে আসেন তখন তাঁর বয়স ১৬/১৭ বছর। তিনি মুর্শিদাবাদ ৭ দিন ধরে ঘুরে ছিলেন একটি বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে। এই সময়েই তাঁর জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই সময়েই তিনি ১৯১৪ খৃঃ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ করেন – রবীন্দ্রনাথ সে সময় তাঁদের পল্লী সংস্কার বিষয়ে নানা উপদেশ দিয়েছিলেন।২
সুভাষচন্দ্রের বাল্যকালের বন্ধু ও পরামর্শদাতা কৃষ্ণনগরের হেমন্ত কুমার সরকার  লিখছেন,-

“ পরীক্ষার পর সুভাষচন্দ্র কৃষ্ণনগরে এলেন। আমাদের বাড়ীতে উঠলে- সুরেশদা ঠিক করেছিলেন সদলবলে কৃষ্ণনগরে এসে পলাশী, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি ঐতিহাসিক স্থানগুলি দেখতে যাবেন। কৃষ্ণনগর থেকে ট্রেণে আম পলাশী গেলাম। ষ্টেশন থেকে পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্র মাইল তিনেক হবে। পলাশীর সে আম্রকানন আর নাই। দর্শকদের জন্য একটি ডাক বাংলা ও যুদ্ধের বিজয় স্মৃতিস্তম্ভ মাঠের মাঝখানে লর্ড কার্জনের আদেশে তৈরি হ’য়েছে।

যুদ্ধক্ষেত্রে ভ্রমণ করতে করতে আমি কবি নবীন সেনের “পলাশীর যুদ্ধ” স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করেছিলাম মনে আছে। সেনাপতি মোহনলালের মুখে যে শেষ কথাগুলি কবি শুনিয়ে- ছেন, তার আবৃত্তি শুনে সুভাষচন্দ্র চোখের জল ফেলেছিল।
পলাশীর স্মৃতিস্তম্ভের মার্বেল ফলকের গায়ে সুরেশদা খড়িমাটি দিয়ে লিখে দিলেন- “Monument of gloring Treachery।” চৌকিদার এসে ধমক দিয়ে তৎক্ষণাৎ সেটা সযত্নে মুছে দিল।

পলাশী দেখে আমরা চললাম মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে। বহরমপুরে গিয়ে উঠলাম আমার সম্পর্কীয় এক মামার বাড়ীতে। শ্রীযুক্ত অমূল্য উকিল, অধ্যাপক গুরুদাস গুপ্ত, যুগলদা প্রভৃতি আমরা ছয় জন ছিলাম। মামীমা অতি আদর করে আমাদের খাওয়ালেন। বহরমপুর থেকে মুর্শিদাবাদ মাইল ছয়েক হবে। আমরা হেঁটে যাত্রা শুরু করলাম। সঙ্গে ছিল নিখিলনাথ রায়ের “মুর্শিদাবাদ কাহিনী”। মধ্যে মধ্যে পড়া হতে লাগলো।

মুর্শিদাবাদ শহরে গিয়ে আমরা উঠলাম ডাঃ ছবিরুদ্দিন আমেদের বাসায়। সুরেশদা ও যুগলদার এঁর সঙ্গে মেডিকেল কলেজ থেকেই পূর্ব্ব হতে আলাপ ছিল। অসময়ে উপস্থিত হই-তখন গৃহস্থের খাওয়া দাওয়া শেষ হয়েছে। তবুও ডাঃ আমেদ ছাড়লেন না- আলুভাতে ভাত ঘি দিয়ে খাওয়া হ’ল। এই ডাঃ আমেদই পরবর্তীকালে মেডিকেল কলেজের প্রিন্সি- প্যাল হয়েছিলেন। তাঁর সাহায্যে নবাবের প্রাসাদ, মোতি- ঝিল, হাজার দুয়ারি, নবাব সিরাজ উদ্দৌলার কবর, প্রভৃতি দেখার সুবিধা হ’ল। বড়নগরে রাণী ভবাণীর মন্দির পর্যন্ত দেখে আমরা ফিরলাম। তখন জ্যৈষ্ঠ মাস-রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত মিষ্টি আম খেতে খেতে গিয়েছিলাম।

খোশবাগে সিরাজ উদ্দৌলার কবরের অনাড়ম্বর সজ্জা দেখে আমাদের প্রাণ খুবই ব্যথিত হয়েছিল। সন্ধ্যায় একটি মাত্র রেড়ির তেলের প্রদীপ দেওয়া হ’ত।

এই ভ্রমণ কাহিনী লিখতে গিয়ে আজ একটি ব্যথাময় স্মৃতির কথা মনে পড়ছে। আমরা হেঁটে চলেছি-মাঠের দু’ধারে অড়রের ক্ষেত। সুভাষের জীবনে পল্লীর সঙ্গে এই প্রথম পরিচয়। অত বড় সবুজ ক্ষেত দেখে সে আনন্দে আত্ম- হারা হ’য়ে আমায় জিজ্ঞাসা করলো-এটা কিসের বন? আমি উত্তর করলাম-অশ্বত্থ গাছের বন! খানিক দূর এগিয়ে আর একটী অড়হর ক্ষেত দেখে সুভাষ বললো, কত বড়  একটা অশ্বত্থ বন, দেখ। সঙ্গীরা সকলে হেসে উঠলেন।

সুভাষ হাসির কারণ বুঝতে না পেরে ছলছল চোখে আমায় জিজ্ঞাসা করলো-ওরা হাঁসলো কেন? আমি বললাম- ওগুলো অশ্বত্থ গাছ নয়, অড়হর গাছ। সুভাষ আমায় শুধালো- তুমি আমায় এমন অপ্রস্তুত করলে কেন? বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে ধারা ব’য়ে জল পড়তে লাগলো। এই নিষ্ঠুর পরিহাসের ব্যথা আজও যেন আমার বুকে কাঁটা হ’য়ে আছে। সেই থেকে আর কোনও দিন আমি তার সঙ্গে পরিহাস করিনি।”
“সুভাষ সব সময়ে ঠাট্টা বুঝত না। তাব সরল কোমল প্রাণে এই আঘাত দেওয়ার কথা আমি ভুলতে পারিনি। সুভাষ কথা কইতো কম তার মনটা যে কত নরম ছিল তার পরিচয় আমি কতই না পেয়েছি এবং তার সঙ্গে কথা কইতে গিয়ে আমি ভবিষ্যতে অত্যন্ত সাবধান ছিলাম। ছেলেবেলায় ক্ষিদে পেলে সে মুখ ফুটে কখনো বলত না। হাতের বুড়ো আঙুলটি মুখে দিয়ে হেলান দিয়ে চুষতে থাকত। তার এক বুড়ি ঝি ছিল- সে বুঝতে পেরে তখনি দুধ খাবার এনে খাওয়াতো।”

“মুর্শিদাবাদ থেকে আমরা একখানি নৌকা ভাড়া করে ফিরলাম বহরমপুরে বর্ষার গঙ্গা জ্যোৎস্না রাত। দাড়িরা তালে তালে দাঁড়ের শব্দ ও তার প্রতিধ্বনি তুলে চলেছে। আমরা নৌকার ছাদে বসে। সুভাষকে অনেক কাকুতি মিনতি করে বললাম- একখানি গান করতে সে আমার কথায় রাজি হল- গাইলো-

দূরে হের চন্দ্র কিরণে
উদভাসিত গঙ্গা
ধায় মত্ত হরষে সাগর পদ পরশে
কূলে কূলে করি পরিবেশন
মঙ্গলময়ী বরষা-
শ্যাম ধরনী সরসা-“।৩

মুর্শিদাবাদে (লালবাগে):-

১৯৩১ খ্রীঃ সুভাষচন্দ্র পুনরায় মুর্শিদাবাদে (লালবাগে) এসেছিলেন তখন সুভাষচন্দ্র পরিণত রাজনীতিবিদ ও দেশের অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব।
১৯৩১ এ মেয়র থাকাকালীন সময়ে কলকাতায় একটি ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের (স্বাধীনতা দিবস) মিছিলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি ঘোড়সওয়ার পুলিশের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বন্দী হন। ২৪ ঘন্টা বিনা চিকিৎসায় বিনা আহারে তাকে বন্দী রাখা হয় ও তার পরে ছয় মাস কারা দন্ড হয়। এই ১৯৩১ খ্রীঃ গান্ধী আরউইন চুক্তি কংগ্রেসের আপোষকামিতাকে প্রকট করে এবং জহরলাল নেহেরু একে সমর্থন করলেও সুভাষচন্দ্র কার্যত তার বিরোধিতা করেন। দক্ষিণপন্থী কংগ্রেসীদের কাছে তিনি বাম পন্থার সমর্থক হিসাবে ক্রমে ক্রমে চিহ্নিত হন এবং কংগ্রেসের একাংশের সঙ্গে তাঁর বিরোধ দানা বাঁধতে শুরু করে।

মহাত্মা গান্ধী গোলটেবিল বৈঠক সেরে ১৯৩১ ডিসেম্বরে শেষদিনে শূন্যহাতে দেশে ফেরেন। ঐ সময় বিনা প্ররোচনায় হিজলী বন্দী নিবাসে তারকেশ্বর সেন ও সন্তোষ মিত্রকে ব্রিটিশ পুলিশ হত্যা করে। সুভাষচন্দ্র তাঁদের মৃতদেহ কলকাতায় নিয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথ তখন ৭০ বছরের বৃদ্ধ অসুস্থ। সুভাষচন্দ্রের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ কলকাতার সভায় এসে এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেন।
১৯৩১ খ্রীঃ ডিসেম্বরে ৮/১২/৩১ তাং তিনি পুনরায় লালবাগে আসেন।
এই প্রসঙ্গে শশাঙ্ক শেখর সান্যাল মহাশয় এর প্রতিবেদন- ” ৮/১২/৩১ সুভাষকে নিয়ে ছত্রপতি (ভম্বলদা) অবিনাশ ভট্টাচার্য্য (বর্তমানে কলকাতা করপোরেশনে) ও আমি মুর্শিদাবাদ নগরী (নবাব রাজধানী) ও আশেপাশে ইতিহাসের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গেলাম। ফিরে এলে আমার মার হাতে, খেয়ে দুপুরের ট্রেনে তাঁকে খাগড়া ঘাট হয়ে কাটোয়া যেতে হবে- সেখানে বৈকালের জনসভা।”

” বেলা সাড়ে নয়টা- নবাব প্রাসাদের সম্মুখে ক্ষীন স্রোত জীর্ণ ভাগীরথী মনে হচ্ছে যেন অতীতের স্মৃতিটুকু আগলে থাকার জন্যই তার অস্তিত্ব। ঘাসের উপর আছাড় খেয়ে বসে পড়েছেন। মাঝে মাঝে এক আধ টুকরা প্রশ্ন, আবার মর্মাহত সম্মুখে ওপারে নাতিদূরে সিরাজের কবর। তারই পাশে লুৎফা। শেষ স্বাধীন নৃপতির অতৃপ্ত আখাঙ্খার ডালি নিয়ে যেন লুৎফার ক্রন্দন সুভাষের কানে আছড়ে পড়ছে। সম্মুখে আরো দূরে- কিরিটেশ্বরী মন্দির ৫২ পীঠের অন্যতম।”

“আদ্যাশক্তি যেন সুভাষকে বলছে “উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত” কিছু দূরে উত্তরে বরাহনগরে (বড়নগরে) রানী ভবানীর রাজরাজেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গনে পঞ্চমুন্ডাসনের হাওয়া যেন সুভাষের বুলবুল্ডলিনীকে জাগিয়ে তুলেছে। দুচোখে তার জল বাহ্যজ্ঞান শূন্য। আমরা তিন জন প্রেত প্রহরীর মতো অবান্তর হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, বেশ কিছুক্ষণ অন্য রাজ্য থেকে ফিরে বল্লেন, “ওপারে আমার ১২ বিঘা জমি চাই আশ্রম করব।

এই মহা শ্মশানে আমরা স্বাধীনতা হারিয়েছি। এখানেই পুনরুদ্ধার। এই বলে কাজী নজরুল ইসলাম- এর কবিতা আবৃত্তি করলেন-

এই গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর হে- উদিবে সে রবি আমাদের খুনে রাঙিয়া পুনর্বার হে।”

“অনেক সময় কেটে গেল। তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া হল যে বহরমপুরে ফিরে স্নান আহার সেরে তাকে নদী পার হয়ে খাগড়াঘাট ষ্টেশনে ট্রেন ধরতে হবে। তাড়াতাড়ি না গেলে ট্রেন ফেল। সুভাষ স্থির গম্ভীর-কোন চঞ্চলতা নেই। অল্পক্ষণ পরে বললেন, শশাঙ্ক বাবু আমি ট্রেন ফেল করি না।” আমি তখন থেকেই অস্থির। আমার প্রধান আশঙ্কা – আমার মায়ের আহারের আয়োজন হয়ত পন্ড হবে- সুভাষের খাওয়াই হবে না। ফেরবার পথে মোটরের একটি চাকা নিশ্বাস ত্যাগ করায় আর এক চাকা লাগাতে বেশ সময় লাগল। আমরা সময়ের চাপে আরও অস্থির। কিন্তু তিনি পথের ধারে তাকিয়ে লঘু রসালাপে ব্যস্ত- যেন ট্রেন ধরা কোন সমস্যায় নয়।”

“বাড়ী এলে আমাদের তাড়াতাড়ি কিন্তু তার কিছুই না। সংক্ষিপ্ত স্নানের পর ভোজন পর্ব্ব। প্রতিটি জিনিসের স্বাদ গ্রহন এবং তৃপ্তি চর্চা যেন খাদ্য পরীক্ষক। মাঝে মাঝে আমাদের ঠাট্টা করেন, ” ভোজনে নৃত্যন্তি বিপ্র”। আহারান্তে মাকে প্রণাম করে বললেন “মা আজ তবে যাই। মা তাড়াতাড়ি আশির্ব্বাদ সেরে বললেন, শীঘ্র এসো বাবা নইলে ট্রেন পাবে না।” উনি বললেন, মা আমি ট্রেন ফেল করি না।”

বাড়ী থেকে একমাইল যেতে হবে। আমরা সকলেই বললাম ট্রেন ধরা যাবে না। তিনি তখনও অবিচলিত। শুধু বললেন-“আমি চলন্ত গাড়ীতে উঠব অবিনাশ জিনিসপত্র নিয়ে পরের গাড়ী বা মালগাড়ীতে যাবে। কাটোয়া আমাকে পৌছতেই হবে।”

“আমাদের স্নায়বিক অস্থিরতা চরম। সেই অবস্থায় আমরাও ষ্টেশনে ঢুকলাম। ট্রেনও এসে দাঁড়াল। সুভাষ যেখানে দাঁড়িয়ে ঠিক তারই সামনে যেন পূর্ব্বে ব্যবস্থামত দ্বিতীয় শ্রেনীর কামরা প্ল্যাটফরমে ভিড়ল। তিনি সাধারনত দ্বিতীয় শ্রেণীই ব্যবহার করতেন। গাড়ী ছাড়ল। অবিনাশ হাঁপাতে হাঁপাতে মরি কি ধরি করে কোন রকমে চলন্ত ট্রেনে অন্য এক কামরাতে বিছানা বাক্স নিয়ে উঠল। সুভাষ মুখ বাড়িয়ে বললেন, “সান্যালবাবু, আমি ট্রেন ফেল করি না।”

“অনন্ত আত্মপ্রত্যয়ের অধিকারী সুভাষ কি ট্রেন ফেল করতে পারেন? ৪

সুভাষ চন্দ্রের ঐ সময়কার লালবাগ দর্শনের ভিন্নতর বর্ণনা তাঁর আর একটি লেখায় পাওয়া যাচ্ছে। সেটাও ১৯৩১ এর শেষাশেষি সময়কার।

“এর ২/৩ দিন পরে সুভাষকে নিয়ে যাচ্ছি নবাব বাড়ী দেখতে। সেইমত আশে পাশে প্রায় মুছে যাওয়া ইতিহাসে আল্পনার রেখা। এসে পড়লাম কেল্লা নিজামতের মধ্যে ভাগীরথীর পূর্ব পাড়ে। ওপারে দক্ষিণদিকে নবাব আলিবর্দির ও সিরাজদ্দৌলার কবর। কিছু দুরে উত্তরে রানী ভবানীর ও তাঁর মন্ত্রশিষ্য রাজা রামকৃষ্ণের ভজন পীঠের পঞ্চ মুন্ডাসন।”

“বড়নগর নদীতীরে সুভাষ বসে পড়লেন। সম্মুখে অনতিদুরে মহাপীঠ কিরিটেশ্বরীর সতীমন্দির। অনাদি অতীতের আধ্যাত্ম অন্তঃস্থল নিংড়ে অঝোরে অশ্রু গড়াচ্ছে। বহির্জগত থেকে সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন দুপাশে বসে নীরব বিমুঢ় দর্শক। আমি ও আমার দাদা (ভোম্বলদা) সম্বিত হারিয়ে নিষ্প্রাণ পুতুলের মত বেশ কিছুক্ষণ পরে শুনতে পেলাম শশাঙ্কবাবু আমার ওপাড়ে জমি চাই – আশ্রম করব। ধ্যানী ঋষির কাছে আসমুদ্র হিমাচল সমগ্র ভারতটি আশ্রম। কোন কোনে আশ্রমের নীড়ে সুভাষ অনাগত দিনে আশ্রয় নিচ্ছেন কে জানে।”

“প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয় বামা ক্ষ্যাপার একমাত্র মন্ত্র শিষ্য তারা ক্ষ্যাপা বহরমপুরের শহর পূর্বলাগা উমাবনে বানপ্রস্থ নিয়েছিলেন। তিনি সুভাষের জন্মের অনেক আগেই সন্ন্যাসী। রাজবন্দী হয়ে সন্দীপ উপদ্বীপে অন্তরীন ছিলেন।” “…. একদিন আমার বাসায় তখন রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে ছিলেন। তারা ক্ষ্যাপা লিখে পাঠালেন- তোমার কর্মস্থল ইউরোপের রণাঙ্গনে। সেখানে অষ্টবক্র সম্মেলন যেখানে তোমাকে যেতে হবে। সুভাষ বার বার পড়ছেন তাঁর মুখে বিন্দুমাত্র বিস্ময় বা অবাকের ছাপ দেখলাম না। এখন বুঝি তিনিও তাই জানতেন।”

“আরো জানা দরকার মুর্শিদাবাদের লালগোলার উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীর্ঘদেহী বরদা মজুমদারের কথা। যোগ সাধনায় তাঁর প্রসিদ্ধি উৎকর্ষ ছিল। তাঁর কাছেও দীর্ঘদিন সুভাষ যোগাভ্যাসের পাঠ নিয়েছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামও নিয়েছিলেন”।৫

শশাঙ্ক শেখর সান্যাল মহাশয় সুভাষ চন্দ্রের আধ্যাত্মিকতার দিকে যে ঝোঁক ছিল উল্লিখিত আলোচনায় তার প্রতি আমাদের দৃষ্টিপাত ঘটিয়েছেন। অরবিন্দ ঘোষ রাজনৈতিক জীবন থেকে পুরোপুরি আধ্যাত্মিকতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন কিন্তু সুভাষ চন্দ্রের আধ্যাত্মিকতা ছিল নিজের আত্মিক উন্নয়নের আত্মশক্তি সঞ্চয়ের উপায় মাত্র। তিনি আধ্যাত্মিক জগতের সন্ন্যাসী ছিলেন না ছিলেন রাজনৈতিক সন্ন্যাসী।

হরিপুরা কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচিত হবার পর ১৯৩৯ খৃঃ সুভাষ চন্দ্র বসু জেলার বেলডাঙা, বহরমপুর, জিয়াগঞ্জ ও রঘুনাথগঞ্জ এর সঙ্গে সঙ্গে লালবাগও গিয়েছিলেন এবং সেখানে বিশেষ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঞ্চার হয়েছিল। এবং ১৯৩৯ খৃষ্টাব্দের কথা ” লালবাগ থেকে তখন ‘তরুণ পত্র’ (সম্পাদক ভজনানন্দ লাহিড়ী) প্রকাশিত হচ্ছে পুরোন ল্যাম্পোট (Lampot) থানার কাছে জুবিলি হলে সুভাষকে তরুনের আবেগ জড়িত সেই পত্রিকা দেখালে সুভাষ উচ্ছ্বসিত হয়ে ঐ পত্রিকার জন্য দু কলম লিখেন-

“হে তরুন। তরুনের ধর্ম পালন কর। তরুনের ধর্ম কি? হিসাব না করা। হিসাব না করে এগিয়ে যাও। তরুণ কে এগিয়ে চলতে হবে। চলার পথে বিরাম নাই। পথে কাঁটা আছে দুঃখ আছে, ত্যাগ আছে কিন্তু সঙ্গে আছে বিপুল এবং অফুরন্ত আনন্দ। তাই আনন্দের আস্বাদ পেয়ে পথের কাঁটা পদদলিত করে আমাদের সামনের দিকে চলতে হবে। প্রয়োজন হলে একলা চলতে হবে দীপ হস্তে যাতে সেই আলোকে পথ আলোকিত হয়।

স্বাঃ শ্রী সুভাষ চন্দ্র বসু

৩০-১১-৩৯( ৬)

জঙ্গীপুরে/ রঘুনাথগঞ্জে:- 

রঘুনাথগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ থেকে আশিস রায় সম্পাদিত পাক্ষিক বাণীকণ্ঠ পত্রিকার প্রতিবেদন নিম্নে আলোচিত হলো-
“যতদুর জানা যাচ্ছে ১৯২৯ সালের মার্চের পর ১৯৩০ এর মধ্যে নেতাজী জঙ্গীপুরে প্রথমবার এসেছিলেন। ১৯৩৭ সালে তাঁর এখানে আসার ঘটনা অনেকের স্মৃতিতে ধরা আছে। জঙ্গীপুরের মানুষ এখনও মনে করতে পারেন সে বছর এখানকার সুপরিচিত ঘোতাদার স্মরণে নির্মিত জঙ্গীপুর হাই স্কুলের কাছে রমণী মোহন স্মৃতি তোরণে নেতাজী মাল্যদান করেছিলেন। মানুষে টানা একটা রিকসায় তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছিল। সেই রিকসা টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন সেকালে রঘুনাথগঞ্জের সকলের পরিচিত এক কংগ্রেস কর্মী-শম্ভু রায় (কাগজওয়ালা)। সরস্বতী লাইব্রেরীর দক্ষিন দিকের বারান্দায় নেতাজীকে নিয়ে সভাও হয়েছিল। তখন ঐ স্কুলের হেড মাষ্টার অঘোর নাথ হালদার। সরকারী বিধিনিষেদের দায়ে তিনি ছাত্রদের সুভাষ বোসের সভায় যেতে নিষেধ করা সত্বেও গঙ্গার হাঁটু জল পেরিয়ে তারা রঘুনাথগঞ্জে জনসভা দেখতে গিয়েছিল। জঙ্গীপুরে আগত নেতাজীর ছবিতে আমরা দেখেছি ১৯৩৭ এর আগেও সুভাষ চন্দ্র জঙ্গীপুরের জমিদার ভজহরি নাথের বাড়ীতে কয়েক ঘন্টা থেকেছিলেন। জমিদার পুত্র বিমলেন্দু শেখর নাথের (৭৬) কথায়- সুভাষ বোস আসবেন বলে বাড়ীতে সাড়া পড়ে গিয়েছিল।
ভরা গ্রীষ্মের এক বিকেলে গান্ধী টুপি পড়া দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোককে সঙ্গী করে সুভাষ যখন তাঁর বাড়ীতে আসেন তখন তাঁদের সঙ্গে অনেক লোকজনের মধ্যে ছিলেন জঙ্গীপুরের জেলখাটা মানুষ ঘোতাদা, সত্যেন্দ্রনাথ বড়াল, রঘুনাথগঞ্জের অমিয় রায় সাকেত রঞ্জন সেনগগুপ্ত, তারা প্রসন্ন রায়। খুব ভিড় হয়েছিল। তাঁকে ঘর থেকে তিন তলায় ছাদে নিয়ে যাওয়া হয়। কালী রায় তখন জমিদার ষ্টেটের ম্যানেজার। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় কয়েকটা হ্যাচাগ জ্বালানো হয়েছে। ঘরের মেঝেতে লাল কার্পেটের সামনে নেতাজী খেতে বসেছিলেন। খদ্দরের ধুতি পাঞ্জাবী পরে। সরকারী ডাক্তার ক্যাপ্টেন সরকার বসেন বারান্দায়।”
ভজহরি নাথের বংশধরদের হিসেবে এই ঘটনা বাংলা ১৩৩৬ সালের মার্চ-এপ্রিলের। বিমলেন্দু শেখরের বয়স তখন ৮৯। দেশবন্ধু পাঠাগারের প্রাক্তন কর্মচারী শিব শঙ্কর মন্ডল ও ঐ পাঠাগারে একদা রক্ষিত ভিজিটার্স বুকে ১৯৩৯ এর আগে নেতাজী এখানে ২ বার আসার প্রমাণ স্বরূপ তার দুটি স্বাক্ষর নিজের চোখে দেখেছেন।”
জঙ্গীপুরের জমিদার ভজহরি নাথের বর্ষীয়ান বংশধর বা শিব শঙ্কর মন্ডলের স্মৃতি যদি তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করে থাকে তবে ১৯২৯/৩০ সালের মধ্যে সুভাষচন্দ্র প্রথম বার জঙ্গীপুর এসেছিলেন।
সুভাষ চন্দ্র ব্যস্ত ও অতি ব্যস্ত কর্মজীবনের যে বিক্ষিপ্ত খতিয়ান পাওয়া যাচ্ছে তাতে জানা যাচ্ছে – ১৯২৯ সালের ১৬ মার্চ তিনি বিদেশী বস্ত্র বর্জনের আন্দোলন সফল করে তুলতে জনসাধারনের কাছে অর্থ সাহায্যের আবেদন জানান। ঠিক তার পরেই শুরু হয় তাঁর বঙ্গ পরিক্রমা। এবছর মার্চ থেকে অক্টোবর ও নভেম্বর পর্যন্ত পূর্ব্ব বাংলার রঙপুর মৈমনসিংহ, শ্রীহট্ট, যশোহর, পাবনা, বরিশাল, খুলনা রাজশাহী, প্রভৃতি নানা জায়গায় বহু জনসভা করেছিলেন।
বিপুল জন প্রিয়তার জন্য কোথাও কোথাও কংগ্রেস কর্মীদের ডাকে তাঁকে অনেক গাঁয়ে গঞ্জে যেতে হয়। আমরা অনুমান করি সেই বঙ্গ পরিক্রমার অতিব্যস্ত সময়কালের মধ্যে (১৯২৯) – এ জঙ্গীপুরের মাটিতেও তিনি পা রেখেছিলেন। দেশের মুক্তি আন্দোলনেএ অঞ্চলের মানুষদের উদ্দীপনা তাঁকে আরো অন্তত দুবার এখানে টেনে আনে। একবার ১৯৩৭ একবার ১৯৩৯ -এ জঙ্গীপুরের মত প্রত্যন্ত একটি মফঃস্বল শহরে নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের মত মহান দেশ নেতার তিন তিন বার আগমন আমাদের পক্ষে শ্লাঘার বিষয় বৈকি। “৭

১৯৯৭ সালে বিনতা কুমার বন্দোপাধ্যায় বাণীকণ্ঠে লেখেন-

বঙ্গবন্ধু সুভাষ চন্দ্র বসু। তখনও তিনি ভারত বন্ধু হননি। তিনি আসছেন রঘুনাথগঞ্জে একথা শুনেছিলাম। সাল বলতে পারব না। ব্রিটিশ পিরিয়ড এটুকু বলা চলে।
আমাদের একটি ছোট ক্লাব ছিল। নাম হীন ক্লাব। সাকেতবাবু তার কমান্ডার পেনী বাবু তার প্রাণ। তারই নিমতলার কুঠিতে আমাদের ক্লাব। ছোট ছেলেদের মিলন মেলার স্থান। সুভাষ বোস আসছেন একথা শুনেছিলাম। আরও শুনেছিলাম- তিনি বালিঘাটায় বিদগ্ধ গোপাল দােেসর বাড়ীতে থাকবেন।
সে দিন আমরা ছেলেরা তাঁকে আনতে গেলাম শোভাযাত্রা করে। তিনি রাজার বেশে রাজপুত্রের মত ট্যাক্সিতে, আমরা সামনে পিছনে। ধ্বনি- বন্দে মাতরম্।
তার মধ্যে তিনি সদর ঘাটে উত্তর দিকে এখন যে পুকুর রয়েছে সেখানে মঞ্চ হয়েছিল সেখানে এলেন মঞ্চে তিনি দাঁড়ালেন। মালা দেওয়া হল টুনু মাসির বাগানের লাল গোলাপের মালা সাদা ধপধপে খদ্দরের জামার উপর শোভিত হল। দুঃখ ভঞ্জন স্যান্যাল মহাশয় বন্দে মাতরম্ গান গাইলেন। ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষে কেনারাম চন্দ্র ৫১ টাকা
তুলে তাঁর হাতে দিলেন। বার লাইব্রেরীর পক্ষে দ্বিজলাল বাবু একটি লাল থলিতে ৫১ টাকা তাঁর হাতে দিলেন। সভা আরম্ভ হল তিনি কি বললেন তা বোঝার সময় আমার নয় তবুও যেন একটি তাপ অনুভব করেছিলাম। সে তাপ আজও বৃদ্ধ বয়সে রয়ে গেছে আমার হাড় ও মাংসে।
মঞ্চের আগে পরে বিজয় ঘোষাল, দুর্গাশঙ্কর শুকুল, জেলার শ্যামাপদ ভট্টাচার্য, কান্তার শ্যামাবাবু উকিল, কাগজ ওয়ালা শম্ভুদা, সর্ব্বময় সরকার, ফেজ টুপি পড়া এক ভদ্রলোককেও দেখেছিলাম। পেনিদাই এসবের সংগঠক। তিনি কিন্তু নেপথ্যেই ছিলেন। আর ছিলেন সেকালের কংগ্রেসী মৃনাল দেবী- তার গৃহ ধন্য হয়েছিল সুভাষ বাবুর উপস্থিতিতে।৮

জিয়াগঞ্জে সুভাষ:-

সেবার জিয়াগঞ্জ থেকে সুভাষের ডাক পড়ল। ১৯৩৯ সালের বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনের দামামা বেজে উঠেছে। কংগ্রেস মনোনীত প্রার্থীর অনুকূলে তাঁকে প্রচার কার্য্য চালাতে সেখানে যেতে হবে। নির্বাচনী পরিবেশ বেশ সরগরম। বংগ্রেস পক্ষে প্রার্থী স্থানীয় জমিদার তাজ বাহাদুর দুগর। আর বিরোধী দলে বৃটিশ অনুগ্রহ পৃষ্ঠ নেহালিয়ার জমিদার রায় বাহাদুর সুরেন্দ্র নারায়ন সিংহ। ভোট রাজনীতিতে সুরেন্দ্রনাথ অনেক বেশী কূট কৌশলী। তাই কংগ্রেস প্রার্থীর জয়ের জন্য সুভাষের প্রয়োজন অপরিহার্য্য। তাঁর গভীর ব্যক্তিত্ব আর উন্নত চরিত্রের প্রভাব জনমানসে আলোড়ন তুলেছে। তাজ বাহাদুরের হলঘরে নির্বাচনী জনসভা আয়োজন করা হয়েছে। তুমুল উত্তেজনার মধ্যে সকলেই অপেক্ষমান।

স্বেচ্ছাসেবী স্কুল ছাত্রের দল হল ঘরের প্রবেশ দ্বারে থেকে ব্রীজ ঘাট পর্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সুভাষ এই এখনই এসে যাবেন। এইরকম মুহুমুহু ঘোষনায় জনতা অধীর। তাঁর সন্ধ্যে বেলাতেই তো এসে যাবার কথা তবু বেলা গড়িয়ে যায়, আসলে পথের মধ্যে আসতে আসতে বহরমপুর, লালবাগ এই রকম বহু জায়গাতেই তো তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। পরিবর্তে তাকে ভাষনও দিতে হচ্ছে। আর বিলম্বের কারণ সেটাই। রাত বাড়ছে। আর আশে পাশে বাড়ীর ছাদে, বারান্দায়, রাস্তায় ততই জনসমাগম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সকলেই দেখতে চান তাঁকে। ভাষন শুনতে চান তাঁর। অবশেষে সুভাষ চন্দ্র প্রবেশ করলেন শহীদ যতীন্দ্র নাথ দাসের ভাই বিপ্লবী কিরন চন্দ্র দাসকে সঙ্গে নিয়ে। সভামঞ্চে তারা উপস্থিত। একটা থমথমে ভাব। শ্রী বগলা রঞ্জন ভট্টাচার্য্য (পরবর্তীতে নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য্য) উদ্বোধনী সঙ্গীত গেয়ে উঠলেন- “দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরী”। নির্বাচন বিষয়ক আলাপ আলোচনা হল।
সভাশেষে সুভাষ চন্দ্র বসুর প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা স্থাপনের উদ্দেশ্যে সভার পক্ষ থেকে একটি কোষ মুক্ত রূপোর ছোট পিরিচ উপহার দেন ভগৎ সিং লোরা। উপহার দেওয়া পিরিচ খানি যখন তাঁর বাঁদিকের কোমরের নিচে শোভা পাচ্ছিল তখন মনে হল নব ভারতের নতুন শিবাজী, নতুন গুরু গোবিন্দ, মরনজয়ী টিপু সুলতান, রানা প্রতাপ, মীর কাশিম, প্রতাপাদিত্য আর তিতুমির ব্রহ্ম দেশের অলিঙ্গ ফায়া বেন একজনের মধ্যে রূপায়িত হয়েছে। সুভাষ হাসি মুখে সেই কৃপান বা তরবারি গ্রহণ করে বললেন- -“তরবারির শোভা বীর সৈনিকের হাতে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরূদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রামে আমিও যেন একজন প্রকৃত সৈনিক হতে পারি।” সুভাষ চন্দ্র সেদিন রাত্রে সুকুমার অধিকারীর ভট্টপাড়ার বাড়ীতেআতিথ্য গ্রহন করেন। নির্বাচনের দিন তাঁকে একটি ভোট কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হল। নির্বাচনী অফিসারেরা তাকে বসবার জন্য তাড়াতাড়ি একটি চেয়ার এগিয়ে দিলেন ঐ বুথের মধ্যেই। সৌজন্যের খাতিরে সুভাষ আসন গ্রহণ করলেন। কিন্তু সুরেন্দ্র নারায়নের কর্মকর্তারা অযাচিত ভাবে সুভাষকে অপমান করলেন। ঐ সংবাদ দাবানলের মত চারিদিকে ছড়িয়ে গেল দেশ নায়কের হেনস্তা। দ্রুত ভোট পড়তে লাগল তাজ বাহাদুরের পক্ষে। সুরেন বাবুদের আর নির্বাচনী জয় সম্ভব হল না।” ৯

লালগোলায় নেতাজী:-

সময়টা ১৯৩৯ সালের শেষের দিক। মুর্শিদাবাদ এলেন সুভাষ। প্রথমে বহরমপুর তারপর জিয়াগঞ্জে মিটিং সেরে জিয়াগঞ্জে অধিকারী ভবনে রাত্রিবাস করলেন। জিয়াগঞ্জ থেকে গোদাগাড়ী ঘাট হয়ে তিনি মালদা জেলার কানসাটে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মিটাতে সুভাষ বাবু  মালদা অভিমুখে যাত্রা করবেন। পথে লালগোলা স্টেশনে বিরতি।

সুভাষ চন্দ্র প্রথম শ্রেণীর বিশ্রাম কক্ষে অপেক্ষমান। এক উচ্চ পদস্থ খাস বিলেত থেকে আগত রাজ প্রতিনিধিও ঐ ষ্টেশনে এসেছেন। তিনি বিশ্রামাগারে ঢুকতে গিয়েই এক ভারতীয়কে দেখে থমকে গেলেন। হয়তো বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটায় রেগে গেলেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের কাছে তিনি অজ্ঞাতে পরাজয় স্বীকার করে ভেতরে গিয়ে বসলেন। শুরু হল আলাপ – একথা সেকথার পর জিজ্ঞেস করলেন –

তুমি থাক কোথায় ?

এই বাংলাদেশেই।

এখন যাবে কোথায় ?

বেড়াতে।।

তুমি কি কাজ কর ?

ঘুরে বেড়াই।।

শুধু ঘুরে বেড়াও। দেখছি ভাল ইংরেজী জান। যদি কাজ চাও তো এই আমার ঠিকানা থাকল দেখা করো চাকরি দোব।

সুভাষ চন্দ্র হেসে বললেন – “আমি চাকরি চাইনা।” ইংরেজরাজ পুরুষের আত্মাভিমানে ঘা লাগল। এই জন্যই তো তোমরা ভারতীয়রা কিছু করতে পার না। উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াবে কিছু করবেনা। সুভাষ চন্দ্রের মুখ রক্তিম হয়ে উঠল – তিনি বজ্র  কণ্ঠে বলে।

উঠলেন – “The sole aim of my soul is to liberate India from the opressive hands of the foreigners” সাহেব ঠিকরে ঘর থেকেবেরিয়ে গেলেন।১০
গোদাগাড়ী যেতে হলে পদ্মা পার হতে হয়। লালগোলা স্টিমারঘাটে এসে পৌঁছলেন সুভাষ চন্দ্র। স্বল্পকালের তাঁর অবস্থানে তাঁকে স্বাগত জানাবার জন্য এবং দর্শনের জন্য এ অঞ্চলের সর্বত্র প্রচুর উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা দেয়।

মহারাজা রাও যোগীন্দ্র  নারায়ণ রায়ের দৌহিত্রের পুত্র ২০১৭ সালে যাঁর বয়স ছিল ৯১ বছর সেই জ্ঞানেন্দ্র নারায়ণ রায় স্মৃতিচারণে বলছেন,” আমাদের ছাত্রাবাসের ও ছাত্র খুব ভোরে নেতাজির ট্রেন পৌছাবার পূর্বেই লালগোলা ঘাট রেলস্টেশন পৌঁছেছিলেন। আমার ও আমার বন্ধুদের  উপর ধর্ম কাকা অর্থাত স্বদেশী যুগ এর বিশিষ্ট নেতা বিনয় কুমার মিত্র মহাশয় যিনি আমার পিতার সহপাঠী বন্ধু হিসেবে প্রথম যুগের ছাত্র ছিলেন এম এন একাডেমির, দায়িত্ব দিয়েছিলেন  লালগোলা রাজ গেস্ট হাউসের ফুল বাগান হতে সংগ্রহ করে পৌঁছে দেওয়ার।  আমরা সে দায়িত্ব পালন করেছিলাম। “১১
লালগোলা স্টিমার ঘাট এর আমবাগানে কয়েক মিনিটের জন্য সুভাষ বসুর ভাষণ দেন। সেখানে তিনি সাক্ষাৎ করেন লালগোলার স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রী বিনয় কুমার মিত্রের সাথে।

এই বিষয়ে ২০১৯ সালে ৮৭ বৎসর বয়সে প্রয়াত প্রবীণ ব্যক্তি নিশীথ রায় জানাচ্ছেন, “ তখন কলকলি নদী আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পদ্মায় মিশত। আমরা কলকলির পাড়ে খেলা করতাম একদিন দেখি কাঁধে একটি ঝোলা নিয়ে পান চিবোতে চিবোতে বিনয় মিত্র এলেন , আমরা তাঁকে চিনতাম । আমাদের খেলার স্থান ছিল লালগোলা জাহাজ ঘাটে পরিত্যক্ত জাহাজে। সেখানেই দেখলাম একটি জাহাজে বিনয় মিত্র উঠলেন এবং একজন খোলের মধ্যে থেকে বেড়িয়ে তাঁকে নমস্কার করে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁকে দেখেই আমি চিনতে পারি তিনি সুভাষ চন্দ্র বসু।১২

বহরমপুরে সুভাষচন্দ্র :-

মুর্শিদাবাদের সদর শহর বহরমপুরে তিনি প্রথমে এসেছিলেন প্রথম মুর্শিদাবাদ (লালবাগ) দর্শনের সময়, পরে একজন রাজবন্দী হিসেবে- বহরমপুর কারাগারে। কলকাতায় তাকে ৩ নং রেগুলেশন আইনের বন্দী হিসেবে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে স্থানান্তরিত করা হয় বহরমপুর জেলে। তিনি কলকাতায় বন্দী হন ১৯২৩ এ। বহরমপুরের জেলে ৭ নং ঘরে রাজবন্দী হিসেবে আসেন ১৯২৪ এ। ঐ কারাগারে এখন সরকারী মানসিক হাসপাতাল। তার বন্দী জীবনের সহ বন্দী ছিলেন পন্ডীচেরী খ্যাত অনিল বরন রায়, হেমন্ত সরকার প্রমুখ একান্ত সুভাষ অনুরাগীরা। বহরমপুর জেলে সুভাষকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে রাখা হয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ তার অনুরোধে টেনিস খেলার বন্দোবস্ত করে দেন। বিকেলের দিকে ছোট ছেলেরা গঙ্গার বাঁধে দাঁড়িয়ে থাকলে সুভাষ তাদের প্রাচীর ডিঙিয়ে নতুন দামী বিলিতি টেনিস বল পাঠিয়ে দেন। ছেলেরা তার দেখা না পেলেও তার নেপথ্য উপস্থিতি তরুনদের রোমাঞ্চিত করত। রাজবন্দী হিসেবে আটক থাকার সময়ে সুভাষচন্দ্রের অগ্রজ সুরেশ চন্দ্র বসু এবং অনিল বরন রায় এর মাতৃদেবী তাদের দেখতে ব্রজ ভুষন গুপ্তের বাড়ীতে উঠেছিলেন। ১৩

বহরমপুর থেকে সুভাষ চন্দ্রকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। রাজবন্দী সুভাষচন্দ্র কারাগারের অভ্যন্তরে দুর্গাপূজার দাবি জানান। সরকার প্রথমে আপত্তি জানালেও তার দৃঢ় মানসিকতার কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন। প্রতিমা নির্মান করে মহাসমারোহে দুর্গা প্রতিমা আরাধনা করা হয়। শহরের স্বনামখ্যাত চিকিৎসক সুরেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য্য তখন জেলের ডাক্তার ছিলেন। স্বনাম খ্যাত সাংসদ ও আইনবিদ শশাঙ্ক শেখর সান্যালের সহধর্মিনী উষা দেবী ডাক্তার ভট্টাচার্য্যের কন্যা। তখন তার বয়স ১১ / ১২ বছর। উষা দেবী জেদ ধরেন জেলখানার সুভাষ চন্দ্রের দুর্গাপূজা দেখতে যাবেন। ডাক্তার ভট্টাচার্য্য বালিকা কন্যার সাধ পূরণ করেন। উমাদেবীর জীবনে ভবিষ্যতে বহুবার সুভাষ দর্শনের সৌভাগ্য হলেও দেবী দুর্গার সামনে আরাধনারত ধ্যান মগ্ন সুভাষের প্রথম ছবি আজও অম্লান হয়ে আছে।

দুর্গাপূজার পুরোহিত ছিলেন ঈশান ভট্টাচার্য্য। সেই সময় বাইরের কেউ কেউ জেলখানায় ঢুকে দুর্গাপূজা দেখার অছিলায় সুভাষ চন্দ্রকে দেখতে গিয়েছিলেন।

১৯৪২ এ শশাঙ্ক শেখর সান্যাল এখানে ৭ নং ঘরে বন্দী ছিলেন তখনও সেই দুর্গাপূজা হত জেলখানায়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য সুভাষচন্দ্রের স্বগ্রাম ২৪ পরগনার কোদালিয়া গ্রামে বসু পরিবারে প্রতি বৎসর দুর্গাপূজা হত, এখনো হয়। সুভাষ চন্দ্র স্বগ্রামে গিয়ে দুর্গাপূজায় অংশগ্রহণ করতেন ও মাতৃপদে অঞ্জলি দিতেন।

শঙ্করী প্রসাদ বসু মশাই তাঁর লেখা ‘সমকালীন ভারতে সুভাষ চন্দ্র’ পুস্তকে আলিপুর ও বহরমপুর জেলে সুভাষ চন্দ্রের বন্দী জীবন প্রসঙ্গে লেখেন:-

“সুভাষ চন্দ্রের গ্রেপ্তারে দেশবন্ধু চূর্ণ হয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ চালের ছড়া কবিতায় কিছু উদ্বেগ প্রকাশ করলেন এবং সরকার বাহাদুর সুভাষ চন্দ্রকে প্রথমে আলিপুরে নিউ সেন্ট্রাল জেলে তারপরে বহরমপুর জেলে কিছুদিন আটকে রেখে (দুই জেল মিলিয়ে মাস তিনেক) তার পর সোজা চালান বর্মার মান্দালয়ে, “দেশ প্রেমিক হওয়া মানে কি বোঝাবার জন্য “সোজা চালান “চালান কথাটা আক্ষরিক সত্য নয়, কারন যাত্রাপথে একরাত্রি লালবাজারে পুলিশ খোলসে কাটাতে হয়েছিল- তাকে জানতে হয়েছিল সুপরিচ্ছন্ন ব্রিটিশ শাসন মানে কি? একটি নোংরা গর্ত্তঘর মশা ও ছারপোকার প্রিয় বাসস্থান শৌচক- শৌচ ব্যপারে সেখানে লাজ লজ্জার ব্যাপার নেই। নিদ্রাহীন রাত্রি কাটিয়ে সুভাষ চন্দ্র সম্ভবতঃ গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠেছিলেন:- “নরক যদি কোথাও থাকে তা এখানেই আছে”। নরকের প্রহরীদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত অবশ্য তার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা নয়। আলিপুর জেলে থাকার সময়ে দু একজন ছেচড়িয়া সি.আই.ডি. র মোলাকাত তাকে করতে হয়েছিল, তাদের সায়েস্তা করা কল।

সেই খেঁকিদের গলার শিকল যাদের হাতে ধরা সেই সাহেব প্রভুরা সুভাষ চন্দ্রকে পাঠিয়ে দিলেন বহরমপুরে, যাতে বেশী লোক তার কাছে হাজির হয়ে ওদের চরিতকথায় কান ভারী না করতে পারেন। বহরমপুর জায়গাটা ভাল ছিল, নদীর ধারে মস্ত দোতলা বাড়ীতে জেলখানা সঙ্গীও যথেষ্ট, বেঙ্গল অর্ডিন্যান্সে আটক বিশজন এবং ১৮১৮ র তিন আইনে আটক পাঁচ জন। মার্কামারা লোকগুলি মানে সুস্থির শাসন ও শোষনের ক্ষেত্রে আপদের দল সুতরাং জেল সুপারিনটেন্ডেন্টের সঙ্গে ঘটাঘটি লাগতেই পারে, বিপ্লবী যোগেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (রেভেলিউশনারী স্যোসালষ্টি পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা) প্রমুখের সঙ্গে তা লেগেছিল। তারা জেলে একটু আনন্দ করিবার জন্য সরস্বতী পূজা করিবার আগ্রহ প্রকাশ করিয়াছিলেন। কিন্তু তার খরচ সরকার বহন করবেন কিনা, যদি না করেন তাহলে কি করা যাবে এই বিষয়ে সুভাষ চন্দ্রের কাছে পরামর্শ চাইলেন এবং পুলকিত হয়ে সুভাষের কথা শুনলেন, আমরা অনশন ধর্মঘটের আশ্রয় গ্রহন করিব। জেলে অন্য আনন্দের সুযোগ ছিল অর্ডিন্যান্সে বন্দী ও তিন আইনে বন্দী এই দুই দলের মধ্যে ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা হয়েছিল, যোগেশ বাবুরা সুভাষ চন্দ্র ও অনিলবরন রায়কে সহজেই হারিয়ে দেন, তাতে সুভাষ চন্দ্র এত খুশি যে, যখন তিনি জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি তখন যোগেশ চন্দ্র সম্বন্ধে এক ঘরোয়া ভোজ সভায় স্ফুর্তিতে সার্টিফিকেট দিয়ে ফেলেছিলেন- যোগেশ বাবু ওই
লাইনে থাকলে ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন হতে পারতেন।
কিন্তু হায়, আরও বড় নেশা দেশ স্বাধীন করার নেশা। যোগেশ চন্দ্রকে পাকড়ে ধরেছিল ফলে তাদের জেলে জেলেই ঘুরতে হোলো তার সেই অভিজ্ঞতায় মানুষ চিনতে দেরী হয় নি। বহরমপুর জেলে রাখলে সুভাষ চন্দ্রকে যথেষ্ট সৎ শিক্ষা দেওয়া যাবেনা বিবেচনা করে সদাশয় সরকার তাকে ২৫ শে জানুয়ারী ১৯২৫ স্থানান্তরের ব্যবস্থা করেন। বিদায় কালে একটি সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন রাজবন্দীরা।

“তাহাকে আন্তরিক বিদায় অভিনন্দন জানাইবার জন্য” যোগেশ চন্দ্র লিখেছেন, “আমরা সেই দিনই একটি সভার আয়োজন করেছিলাম। সুভাষ চন্দ্রই ভারতের উদীয়মান সূর্য্য’ অনিল বরন রায়ের উক্তিটি আমার কানে বাজিতেছে। তিনি নিঃসন্দেহে ভারতের রাজনীতি গগনের উদীয়মান সূর্য্য ছিলেন।”

২৫ শে জানুয়ারী মধ্য রাত্রে কলকাতার লালবাজারী নরকে থেকে ২৬ শে জানুয়ারী অন্ধকার থাকতে থাকতে তাকে বন্দুক ধারী পুলিশের প্রহরায় পুলিশ ভ্যানে তুলে দিয়ে নদীর ঘাটে দাঁড়ানো মোটর বোটে উঠিয়ে দেওয়া হল। তার পর ঘন্টা তিনেক বোটে করে নদীতে মুক্ত বায়ু সেবন সহ ঘুরপাক খাইয়ে চুপি-চুপি মাঝ নদীতে দাঁড় করানো জাহাজে হাজির করানো হল উল্টো দিক দিয়ে। জাহাজে পাহারার ভালোই বন্দোবস্ত ছিল, মুখ্য পাহারাদার মিঃ লোম্যান, পুলিশের এ্যাসিস্টান্ট ইন্সপেক্টর জেনারেল। লোকটি মন্দ নয়, একটু আমুদে, গল্প গুজব ভালোবাসে। কলকাতা থেকে রেঙ্গুন পর্যন্ত চারদিনের সমুদ্র যাত্রা। ” রেঙ্গুন থেকে মান্দালয় কুড়ি ঘন্টার দীর্ঘ যাত্রা। সঙ্গে বিরাট পুলিশ বাহিনী। পথে যেখানেই গাড়ী থেমেছে সেখানেই ট্রেনের দুই ধারে তারা সার দিয়ে দাঁড়িয়েছে। যে বিরাট হৈ-চৈ কান্ড তারা করছিল তাতে অপরের মনে হতে পারে হয় আমরা বিরাট কোন রাজপুরুষ না হয় খাঁচার বন্য জন্তু”।১৪

লোকসংস্কৃতি গবেষক পুলকেন্দু সিংহ ‘মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র’ গ্রন্থে লেখেন,
“শশাঙ্ক শেখর সান্যাল ও শঙ্করী প্রসাদ বসুর দুটি লেখার মধ্যে দুটি বড় গরমিল বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। শশাঙ্ক শেখর সান্যাল ও তাঁর সহধর্মীনি উষারানী সান্যাল দু-জনেই কারাগারে দুর্গোপূজার উল্লেখ করেছেন, বর্ননা দিয়েছেন শুধু তাই নয় শশাঙ্ক সান্যাল মশায় বলেছেন পরে তিনি যখন সেই জেলে ১৯৪২ এ বন্দী হয়ে যান তখন সেখানে সুভাষ চন্দ্র প্রতিষ্ঠিত দূর্গাপূজা হতো। অপর পক্ষে শল্পী প্রসাদের লেখায় দূর্গাপূজার কোনো উল্লেখ নাই তিনি বরং সরস্বতী পূজার উল্লেখ করেছেন। কোনটা ঠিক? নাকি সরস্বতী পূজা ও দুর্গাপূজা দুই পূজায় হয়েছিল। সে কারাগার আর নাই সমসাময়িক লোকজনও আর কেও বেঁচেনাই। এতৎ বিষয়ে সঠিক তথ্য আর কেউ জানলে আশা করি আলোকপাত করবেন। শঙ্করী প্রসাদ বসু বহরমপুর কারাগারে টেনিস নয় ব্যাডমিন্টন খেলার কথা বলেছেন অপর পক্ষে শশাঙ্ক সান্যাল মশাই টেনিস এর উল্লেখ করেছেন তবে শশাঙ্ক বাবু বহরমপুরে সুভাষ চন্দ্রের একজন ঘনিষ্ঠ জন ছিলেন সুতরাং তার পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে যতখানি জানা সম্ভব শঙ্করী বসুর পক্ষে ততখানি নয়। যদি না শশাঙ্ক শেখর সান্যাল মশাই এর স্মৃতি সঠিক তথ্য দেয় তবেই। বহরমপুর জেল থেকে সুভাষ চন্দ্র এঁর অগ্রজ শরৎ চন্দ্র বসুকে বেশকয়েকটি পত্র লিখেছিলেন।
বহরমপুর জেল থেকে ৮/১২/২৪ তাং সোমবার তিনি লিখেছেন -” গত বুধবার আমি এখানে এসে পৌঁচেছি। অর্থাৎ তিনি বহরমপুর জেলে এসেছিলেন ৩/১২/২৪ তাং বুধবারে এখান থেকে তিনি যান ২৫/১/২৫ তাং। তিনি মোটামুটি দুই মাস বহরমপুর কারাগারে ছিলেন। এরমধ্যে অর্থাৎ ডিসেম্বর- জানুয়ারীতে দুর্গাপূজা হওয়া সম্ভব নয়। মাঘ মাসে সরস্বতী পূজা হওয়া সম্ভব। অর্থাৎ সুভাষ চন্দ্র দুর্গাপূজা নয় সরস্বতী পূজা করেছিলেন। সম্ভবতঃ সরস্বতী পুজাকে শশাঙ্ক বাবু তাঁর পত্নী ভুল ক্রমে দুর্গাপূজা হিসেবে উল্লেখ করে থাকবেন।” ১৫

আমি তথ্যগত দিক থেকে যা পাচ্ছি তাতে সুভাষ চন্দ্র বসু ২৬ /১/১৯২৫ তারিখে বহরমপুর জেল থেকে চলে যান,  প্রথমে কলকাতা তারপর মান্দালয় জেল। অন্যদিকে ১৯২৫ সালে সরস্বতীপুজোর তিথি ছিল ২৮ /১/১৯২৫।  তাহলে বহরমপুর জেলে কি পুজোর আয়োজন করেছিলেন নেতাজী? এ বিষয়ে আরও গভীর গবেষণা প্রয়োজন।

বহরমপুর জেল থেকে লেখা দাদা শরৎ চন্দ্র বসুকে লেখা পত্র:-

বহরমপুর জেল

সোমবার

৮/১২/২৪

পরম পূজনীয় মেজদাদা,

গত বুধবার আমি এখানে এসে পৌঁছেছি – অথবা বলা যায় আমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। আমি এখানে ভালোই আছি।

ইংলিশম্যান ও ক্যাথলিক হেরাল্ডের বিরুদ্ধে মানহানির মামলার বিষয়ে আমার সলিসিটরদের কোন নির্দেশ পাঠাতে বা মামলার অগ্রগতি সম্বন্ধে খবরাখবর করতে আমি অসমর্থ বলে দুঃখিত। আমাকে এখানে বদলি করার উদ্দেশ্য দিনের আলোর মতোই পরিস্কার।

অনুগ্রহ করে রামিয়াকে বলবেন, আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আমি যে সেক্রেটারিয়েট টেবিল ও চেয়ার ব্যবহার করতাম তা যেন তিনি সরিয়ে নিয়ে যান। আগের ইচ্ছামত এটি

আমি সঙ্গে করে নিয়ে আসিনি। পৌর শাসন সংক্রান্ত কিছু কিছু বইও আমাকে পাঠাতে বলবেন। কর্পোরেশনের লাইব্রেরীতে বইগুলি হয়তো থাকতে পারে।

গরম পোষাকের ব্যাপারে আর কোন পরিবর্তন হয়নি এবং আমার অবস্থা একই রকম। এখন কিছুদিন আপনাদের কারুর সঙ্গে দেখা হবে না। সপ্তাহে মাত্র দুটি চিঠি আমাকে লিখতে দেওয়া হয়, তবে আমার কাছে যতখুসি চিঠি লেখা যেতে পারে।

মা এখন কোথায় আছেন? বাবা কটকেই আছেন বোধহয়। আপনারা সকলে কেমন আছেন? Statesman এ প্রকাশিত প্রবন্ধটি সম্পর্কে উকিলদের অভিমত জানবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি। মিউনিশিপ্যাল গেজেটের চতুর্থ সংখ্যা আমি পাইনি। এটি যেন আমাকে নিয়মিত পাঠানো হয়।

আমি এখানে ভালোই আছি।

ইতি

আপনার স্নেহের সুভাষ

(স.চ.ব.)
দ্বিতীয় চিঠি:-

বহরমপুর জেল

১৬/১২/২৪

পরম পূজনীয় মেজদাদা,

আপনার ৫/১২/২৪ তারিখের চিঠি কয়েকদিন আগে এবং ১২/১২/২৪ তারিখেরটি গতকাল পেয়েছি।

১) গরম পোষাকের বিষয়ে গভর্ণমেন্ট আমাকে জানিয়েছেন যে, নির্দিষ্ট বরাদ্দের কোন পরিবর্তন তারা করবেন না। বন্দীদের প্রতি তাদের মর্যাদার অনুরূপ আচারনের এটিই নমুনা।

২) আমি আলিপুরে এই কয়েকটি জিনিস ফেলে এসেছি ১। কমোড ২। এ্যালুমিনিয়ামের বাটি শুদ্ধ টিফিন বাক্স ৩। টাইপ রাইটার। সেগুলি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জেল থেকে সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করেন। আমি জেলারকে বলেছিলাম এই জিনিসগুলি সম্বন্ধে আপনাকে জানাতে। আশা করি সে আপনাকে ইতিমধ্যে খবর দিয়েছে। এছাড়া আমি একটি সেক্রেটারিয়েট টেবিল, রিভলভিং চেয়ার ও ম্যাপ রেখে এসেছি, আমার অফিসে পাঠিয়ে দেবার জন্য।

৩) আমি গভর্নমেন্টকে আমার খরচের বিষয়ে আরেকটি আবেদন পত্র পাঠিয়েছি এবং উত্তরের অপেক্ষায় আছি।

৪) আশা করি আপনি বিড়লা ব্রাদ্রার্স ও মিঃ এইচ.এন. দত্ত সলিসিটর সংক্রান্ত ব্যাপারগুলি দেখতে ভুলবেন না। এবং দেখবেন যেন কিছু একটা করা হয়।

৫) এখানে আসার পর আমি মিউনিসিপ্যাল গেজেটের কোন কপি পাইনি। আমি প্রথম তিনটি সংখ্যা আলিপুরে থাকতে পেয়েছিলাম। অনুগ্রহ করে রামিয়াকে বলবেন গেজেট এখানে সোজা পাঠিয়ে দিতে।

৬) আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের একটি অনুলিপি পাঠাবার জন্য আমি বাংলা গভর্ণমেন্টকে লিখেছি। যে অভিযোগগুলি আমাকে পড়ে শোনানো হয়েছে সেগুলির একটি অনুলিপি পাঠাতে তাদের কি আপত্তি থাকতে পারে জানিনা।

৭) আমার অনুপস্থিতিতে একজন অস্থায়ী সি.ই.ও. নিয়োগ করা হয়েছে জেনে আনন্দিত হলাম।

কর্পোরেশনের কাজ কোন ক্রমেই বাধাপ্রাপ্ত হওয়া উচিৎ নয়। অনুগ্রহ করে মেয়রের সঙ্গে আলোচনা করবেন এবং মৌখিক যেসব কথা হয়েছিল তা সমর্থন করে লিখিতভাবে ছুটির আবেদন করতে হবে কিনা জানবেন। মিঃ জে.সি. মুখার্জীর জায়গায় মিঃ ডি.সি.দত্ত কালেকটার অস্থায়ী ডেপুটি একজিকিউটিভ অফিসার পদে নিয়োজিত হলে আমি বেশী খুশি হতাম। তিনি নিঃসন্দেহে কর্পোরেশনের সবচেয়ে দক্ষ অফিসারদের অন্যতম।

আমি আপনাকে সপ্তাহে একটি করে চিঠি লেখার চেষ্টা করব কিন্তু আপনি তো জানেন আমি সপ্তাহে মাত্র দুটি চিঠি লিখতে পারি, যদিও পেতে পারি যেকোন সংখ্যা।

৮) আপনি আমার বাগানের উন্নতির জন্য চেষ্টা করছেন জেনে আমি আনন্দিত বোধ করছি। বাগানের ঠিক মাঝখানে একটি ব্যাডমিন্টন কোর্ট করবার আমার ইচ্ছে ছিল। আপনি নিশ্চয়ই সমস্ত জমিটা কাজে লাগিয়েছেন। তবে তাতে কোন অসুবিধে হবে না। কারন ৩২/৮ নং বাড়ির পিছনে যে খালি জায়গাটুকু পড়ে আছে তা ঠিকমত পরিস্কার করে নিতে পারলে সেখানে ছেলে মেয়েদের জন্য একটি ব্যাডমিন্টন কোর্ট করা যেতে পারে।

৯) মাদক বর্জন সংক্রান্ত আপনার প্রস্তাবটি বারবার মুলতুবি রাখা হচ্ছে শুনে আমি দুঃখিত।

প্রস্তাবটি কি হয় তা জানবার জন্য আমি উদ্বিগ্ন। আশা করি স্টেটস্ম্যানে এ বিষয়ে খবর পাব। ১০) ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাষ্ট সংক্রান্ত মিঃ এল.এন. সেনের প্রস্তাবটির কি হল জানার জন্যও উৎকণ্ঠা বোধ করছি। এখনও কি সেটি বিরক্তিকর ভাবে ঝুলে আছে?

১১) সন্তোষবাবুকে বলবেন যে আমি তাঁর দীর্ঘ চিঠি আলিপুরে থাকতে পেয়েছিলাম। আমি তাকে শীঘ্রই চিঠি দেব। যে Loans Statement আমি তৈরী করেছিলাম সেটির কি হল? সেকি E.G.P. বা কর্পোরেশন কোন ভাবে পরিবর্তন করেছেন? আশা করি মনসা তলা পরিকল্পনা টি ঠিকই আছে।

১২)………( অস্পষ্ট লেখা)।

১৩) গভর্নমেন্ট এখানে সমস্ত বন্দীর বইপত্র! ইত্যাদি কিনবার জন্য ৩০ টাকার বিরাট এক মাসিক ভাতা মঞ্জুর করেছেন। জানিনা এতগুলি প্রানীর মানসিক ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য এই সামান্য টাকায় কি বই কেনা যেতে পারে বিশেষতঃ যখন ভিন্নরুচিহি লোকাঃ।

দিলীপ ও ক্ষিতিশ অনায়াসেই বিভিন্ন লেখকের কাছ থেকে কিছু কিছু বই সংগ্রহ করে এখানকার রাজবন্দী দের জন্য পাঠাতে পারে। আরও অসুবিধে এই যে, এই জেলের নিজস্ব কোন লাইব্রেরী নেই। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জলধর সেন ও অন্যান্য লেখকদের অনুরোধ করা হলে তাঁরা কিছু কিছু বই উপহার দিতে পারেন।

১৪) সরকার আমার খাওয়ার জন্য প্রতিদিন ছয় টাকা থেকে দশ টাকা মঞ্জুর করেছেন। এটি আমার মতে যতেষ্ট অপর্যাপ্ত। আমি যখন আলিপুর জেলে ছিলাম অনেক বেশী ব্যয় করতাম। আমার ভাতা বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করব।

১৫) ন দাদা এখন কোথায় আছেন? and has he been fixed up? সেজ দাদা কি আমার গ্রেপ্তারের পর কলকাতায় এসেছেন? জেনে খুশি হলাম বড় মামাবাবু (শ্রী জে.এন.দত্ত) আমার খোঁজ খবর নিচ্ছেন। এবং তাঁর পরিচিত উদ্ধৃতি আওড়ে চলেছেন। কিন্তু এই সুপরিচিত প্রবাদ বাক্য সম্পর্কিত আপনার ব্যাখ্যার সঙ্গে আমি এখনও একমত নই। তিনি এখন কেমন আছেন? মামীমাই বা কেমন?
আমি এখানে ভালই আছি। Stone walls do not a prison make, nor iron bard a cage— কবির এ উক্তি সত্যিই বটে।
সমসাময়িক ইংরেজী ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের কিছু কিছু বই (অনুবাদ অবশ্যই) পেলে ভাল হয়। আশা করি আপনারা ভালই আছেন। ইতি-

আপনার স্নেহের

সুভাষ (স.চ.ব.)১৬

১৯২৫ সালে সুভাষচন্দ্র বহরমপুর ছেড়ে যান।
এর  পরে তিনি ১৯২৯ সালে কংগ্রেসের স্বরাজ্য দলের প্রার্থী তেজ বাহাদুরের সমর্থনে বহরমপুরে এসে কান্দী-পাঁচথুপি-জিয়াগঞ্জ প্রভৃতি নির্ব্বাচনী কেন্দ্র গুলি ব্যাপক সফর করলেও কোন প্রকাশ্য জনসভায় ভাষণ দেননি।

প্রাদেশিক সম্মেলন:- “পরের বছর ১৯৩০ সনে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন উপলক্ষে সুভাষ চন্দ্র বহরমপুরে আসেন। হরদয়াল নাগের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে কংগ্রেসের দক্ষিনপন্থি গোষ্ঠী সুভাষকে প্রকাশ্য সমাবেশে বক্তৃতা দিতে না দেবার জন্য সর্বপ্রকারে
সচেষ্ট হন। অধুনা নেতাজী রোডে মহাকালী পাঠশালা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রায় সামনে সঙ্গীতাচর্য্য গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর বাড়ীর প্রায় পাশেই গঙ্গার তীরে যাবার গলিপথ শেষে ডান দিকের মাঠটি ছিল কংগ্রেস অধিবেশনের স্থল। সেবার আলি ভাতৃদ্বয় সৌকত আলি, ছায়াৎ আলি, ডাঃ প্রতাপ চন্দ্র গুহ রায় এসেছিলেন সম্মেলন উপলক্ষ্যে।” ১৭

“১৯৩১ সাল। কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে বহরমপুরে। স্থান রাধারঘাটের কাছে ‘সিরাজ নগর’ এক বিশাল মন্ডপ। বৈকুণ্ঠ তোরণ নামে প্রধান তোরন ও তৈরী করা হয়েছে সম্মেলন উপলক্ষ্যে জাতীয় শিল্প প্রদর্শনী ব্যবস্থা হয়েছে, তার নাম ‘মনীন্দ্র প্রদর্শনী’। কংগ্রেসের সর্ব্বভারতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে ডাঃ রাজন্দ্র প্রসাদ, দেশবন্ধুর ভগিনী উর্মিলা দেবী, লাল মিঞা, এম. এস. আনে, ডাঃ প্রফুল্ল ঘোষ, কে. এফ. নরীম্যান প্রমুখ অনেকেই সম্মেলন প্রাঙ্গনে হাজির। আর আছেন সুভাষ চন্দ্র। গোটা অনুষ্ঠানের আকর্ষনটাই যেন তিনি। সম্মেলনের প্রথম দিন ৩১ শে ডিসেম্বর। যুবক ও তরুনদের কুচকাওয়াজের মধ্যে দিয়ে নেতারা বহরমপুর কোর্ট ষ্টেশন থেকে ‘সিরাজনগর’ পর্যন্ত পথ পরিক্রমা করলেন। সভা প্রাঙ্গনে নরীম্যান জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন। লাল পাড় হলুদ রঙের খদ্দরের শাড়ী পরিহিতা মেয়েরা সারিবদ্ধভাবে ঐ পতাকাকে অভিবাদন জানায়। গান্ধীবাদী প্রেসিডিয়ামের প্রেসিডেন্ট নির্ব্বাচিত হন চাঁদপুরের (চট্টোগ্রাম) হরদয়াল নাগ। বন্দেমাতরম উদ্বোধনী জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হল। জেলার সুগায়ক রাধাকান্ত সরকারের কন্ঠে। সাবিত্রী প্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় গাইলেন, “উর্দ্ধে তুলিয়া বৈজয়ন্তী উন্নত রাখি শীর।” হিজলী জেলে বন্দীদের উপর নির্মম গুলি চালনার প্রতিবাদে প্রস্তাব উত্থাপিত হল। উল্লেখযোগ্যযে মৃতদের মধ্যে কলকাতার সন্তোষ মিত্রও ছিলেন। দ্বিতীয় দিনে বক্তারা তাঁদের বক্তব্য রাখলেন। কিন্তু সেখানে সুভাষের নাম কই? বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেড়হাজার প্রতিনিধি উপস্থিত। সমবেত হয়েছে উৎসাহী স্রোতৃমন্ডলী। সভা প্রাঙ্গনের কাছেই দেবেন্দ্র নাথ দত্তের বাড়ী থেকে অসহিষ্ণু সুভাষ সম্মেলনের গতি প্রকৃতির সংবাদ নিচ্ছেন। কিন্তু বক্তৃতা মঞ্চে সুভাষকে আনা হচ্ছে না কেন? জনতার মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল। বেগতিক দেখে সুভাষকে এনে মঞ্চের এক কোনায় বসিয়ে দেওয়া হল। তাতে জনতা বিরক্ত। এমন সময় অনুষ্ঠানের প্রচার সম্পাদক শশাঙ্ক শেখর সান্যাল একটি দৃষ্টি আকর্ষনী প্রস্তাব আনলেন। As the Hamlet can- not be played without the Prince of Denmark, so the provincial conference cannot be performed without Subhas. We want to hear to him. করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠল সভা। স্রোতার আসন থেকে প্রতিবাদ ধ্বনিত হতেই সভাপতি সুভাষ বোসকে দশ মিনিট বলার জন্য অনুমতি দিলেন। কিন্তু সুভাষ চন্দ্রের দৃঢ় ও উদাত্ত কণ্ঠের ভাষন উপস্থিত জনগণকে কত দশ মিনিট বিহ্বল হয়ে শুনল, যা তাদের চেতনায় নতুন এক জোয়ারের উন্মাদনা জাগিয়ে দিয়ে গেল। ১৮

– “১৯৩১ সাল।” বহরমপুরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের চত্বরে এসে পড়েছি আমরা। না বহরমপুরে নয়, সিরাজ নগর, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা বিদেশীর চক্রান্তে এই মুর্শিদাবাদের মাটিতেই নিহত হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে স্বাধীনতার শেষ সূর্য্য অস্তমিত হয়েছিল। রাধার ঘাটের কাছে বিরাট এক চত্বরে মস্ত এক এলাকা জুড়ে হয়েছিল বিরাট এক প্রদর্শনী নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বৈকুন্ঠ প্রদর্শনী’।

১৯৩১ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর বহরমপুরে বংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন ছিল নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। হিজলী বন্দী নিবাসে গুলি চালনার নির্মম আঘাত তখনও সারা বাংলাদেশ সামলে উঠতে পারে নি। দুদিনের প্রাদেশিক সম্মেলনে মূল প্রস্তাবটাই তাই ছিল হিজলীর পৈশাচিক হত্যা কান্ডকে নিন্দা করে। সম্মেলনের সভাপতি হরদয়াল নাগ স্বয়ং সেই প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। মুর্শিদাবাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এই সম্মেলন আজও আমাদের সকলের মনে অম্লান হয়ে আছে। আজও চোখের সামনে ভাসছে বহরমপুর কোর্ট স্টেশন থেকে সিরাজনগরী যেতে দেখেছি সেদিন। ডাঃ নলিনাক্ষ সান্যাল কার্যত সেই বাহিনীর জেনারেল অফিসার কম্যান্ডিং ছিলেন বটে কিন্তু স্বেচ্ছা সেবকদের পরিচালনা করা, শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং প্রদর্শনী সংগঠনের কাজে দুর্গাপদ সিংহ, সনৎ রাহা প্রভৃতি কয়েকজনের বিশেষ ভুমিকা ছিল। হ্যাঁ, সেই সময় দেখলাম জেলার তরুনীরা লালপাড়, হলুদ রঙের খদ্দরের শাড়ী পড়ে দাঁড়িয়ে পতাকা অভিবাদন করছেন। কে. এফ. নারিম্যান সেই পতাকার উত্তোলন করেছিলেন। সোনালী বর্ণের উজ্জ্বল রোদ এসে পড়েছে, সিরাজনগরীর আনাচে কানাচে আর তেমন এক গম্ভীর পরিস্থিতি, এরই মধ্যে বিউগল, বন্দেমাতরম, লং লিভ রেভেলিউসন ধ্বনির মধ্যে নরিম্যান পতাকা তুলেছিলেন। সেই স্মৃতি আজও মনের মধ্যে অম্লান হয়ে রয়েছে। স্বেচ্ছা সৈনিকের সারিতে দাঁড়িয়ে সেদিন মনে হয়েছিল, দেশ সংগ্রামে প্রস্তুত বলিদানের অকুণ্ঠিত মায়েরা।

অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি মৌলবী আব্দুস সামাদের সেই ভাষণের পর মুর্শিদাবাদ জেলা যে কোন দিন সাম্প্রদায়িকতার পাঠ গ্রহন করতে পারে তাকে ভেবেছিলেন? অথচ ১৯৩৭ সালে এই বহরমপুরে কুমার হোষ্টেলে সারা ভারত মুসলিম লীগ সম্মেলন সম্ভব হয়েছিল এবং সেই সম্মেলনের পর থেকে ধীরে ধীরে জেলার মুসলমান সম্প্রদায় মহম্মদ আলি জিন্নার দ্বিজাতি তত্বে মেতে উঠেছিলেন। বহরমপুরে সারা ভারত মুসলিম সম্মেলনে – বন্দেমাতরমের বিরুদ্ধে অনেকেই বক্তৃতা করেছিলেন।

স্মরণ থাকে যেন পরে ওয়ার্কিং কংগ্রেস ও ওয়াকিং কমিটিতে ‘বন্দেমাতরম’ এর অঙ্গচ্ছেদ করা হয়েছিল। সুভাষ চন্দ্র সেদিন নেতাজি হননি কিন্তু তবু গোটা সম্মেলনের আকর্ষনটাই যেন তিনিই ছিলেন। বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ, তুলসী গোস্বামী, দেশবন্ধুর ভগিনী উর্মিলা দেবী, লাল মিঞা, নরেন চক্রবর্তী, সামসুদ্দিন আমেদ, এম. এস. এ্যানে, জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী, লাবণ্য প্রভা দত্ত এবং আরও অনেকে সেই সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। প্রায় দেড়হাজার প্রতিনিধি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছিলেন। বঙ্কিমবাবু রাজসাহী থেকে ছাড়া পেয়ে এসে সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন এবং তিনিই বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের প্রস্তাব এনেছিলেন। যতদুর স্মরণ হচ্ছে অলবেঙ্গল স্টুডেন্টস এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে শ্রী অজিত দত্ত সেই প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু সর্ব্বসম্মত ভাবে তা পাশ হতে পারেনি।
জেনারেল সেক্রেটারী শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য, জয়েন্ট সেক্রেটারী জ্ঞানেন্দ্র নাথ সেনগুপ্ত, কোষাধ্যক্ষ বাসরী সেন, এবং এদের সকলের অমানুষিক পরিশ্রমে এবং সহযোগিতায় সম্মেলন সাফল্যমন্ডিত হয়েছিল।
সম্মেলনের শেষে সেই মন্ডপেই ছাত্র সম্মেলন হয়েছিল। সভাপতি হয়েছিলেন লাল মিঞা। সুভাষ চন্দ্র, নরিম্যান, হরদয়াল নাগ, এবং আরও অনেকেই সেই সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ছাত্র কনফারেন্স অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন জ্ঞানেন্দ্র নাথ সেনগুপ্ত এবং অনন্ত ভট্টাচার্য্য ও দুর্গা সরকার ছিলেন জয়েন্ট সেক্রেটারী। ১৯

১৯৩১ এর পরে মাঝে মাঝে সুভাষ চন্দ্র বহরমপুর আসতেন কর্মী বৈঠক করতে কিংবা সভাসমিতিতে অংশ নিতে। শশাঙ্ক শেখর সান্যাল ছত্রপতি রায়, ব্রজ ভূষন গুপ্ত, দেবেন্দ্র দত্ত এঁরা ছিলেন সুভাষের খুবই ঘনিষ্ঠ। বহরমপুর এলে তিনি এঁদের বাড়ীতে থাকতেন।

কংগ্রেসের মধ্যে সুভাষের নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়েও বিষদ আলাপ আলোচনায় অংশ নিতেন তাঁরা। পূর্ণ স্বাধীনতার দাবীতে সোচ্চার সুভাষ চন্দ্র কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরে আরো সমর্থন আদায়ে প্রস্তুত ছিলেন। ২০

কৃষ্ণনাথ কলেজে:-

কৃষ্ণনাথ কলেজে ইউনিয়নের উদ্যোগে গৃহীত অনুষ্ঠানে ১৯৩৯ এর ১৪ ই জুন সুভাষ চন্দ্রকে বহরমপুর আসতে হয়েছিল। ফরওয়ার্ড ব্লক নামে নতুন দল তিনি গঠন করেছেন তাঁর নতুন দলের কর্মসূচী ঘোষনা ও অর্থসংগ্রহের নিমিত্ত এই আগমন।
গ্রীষ্মের ছুটিতে কলেজ বন্ধ থাকলেও কলেজ অধ্যক্ষ শ্রী যতীন্দ্র চন্দ্র মৈত্রের নেতৃত্বে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। একদল স্বেচ্ছাসেবক ছাত্র কলেজ গেট থেকে ব্যান্ড বাদ্য সহযোগে তাদের কমনরূমে সুভাষকে নিয়ে যায়। সুভাষকে খাগড়ার কাঁসার বাসনে খোদিত একটি কবিতায় মানপত্র দেওয়া হয়। কবিতাটি লেখেন কলেজ ছাত্র শ্রীননী ভট্টাচার্য্য। শ্রী ভট্টাচার্য্য পরবর্তীকালে আর. এস. পি দলের নেতা, পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী ও লোকসভার সদস্য হয়েছিলেন।
আন্দোলন তহবিলে একান্ন টাকা তার কাছে ছাত্রদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়।
সুভাষ চন্দ্র তার আড়াই ঘণ্টার বক্তৃতায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। তিনি কংগ্রেস কর্তৃপক্ষ ও মহাত্মা গান্ধীর তোষণ নীতি মূলক কর্ম পন্থার তীব্র সমালোচনা করে বলেন যে, তৎকালীন অবস্থায় কোন প্রকারের আপোষের কথা চিন্তা করা উচিৎনহে। তিনি দেশবাসীকে স্বাধীনতা লাভের জন্য আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানান।
ছাত্রদের মধ্যে প্রচন্ড উদ্দীপনার সাড়া পড়ে যায়। কলেজ অধ্যক্ষ যতীন বাবুর তিনি যথেষ্ট প্রসংসা করেন।২১

বেলডাঙায় সুভাষ:-

১৯৩২ সালের ২রা জানুয়ারি জেলা কংগ্রেসের সহ সম্পাদক ছত্রপতি রায় এবং   শেখর সান্যালকে সঙ্গে নিয়ে সুভাষ বাবু দুপুরের দিকে বেলডাঙ্গার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বেলডাঙ্গার পুরাতন বাজারের কাছে হাজরা বাবুদের প্রাঙ্গনে সভামঞ্চ তৈরী করা হল। দেশ নায়কের আগমনে বেলডাঙ্গা বাসীরা উচ্ছ্বসিত। অভিনন্দন জানাতে সদর রাস্তায় কলাগাছ ও পুষ্প সমাহারে বড় বড় তোরণ সজ্জিত হয়ে উঠল। সকলেই কিছু করতে চায়। বেলডাঙ্গার জনগন তাঁকে মান পত্র প্রদান করে সংবর্ধনা জানাল। সুভাষের বক্তৃতায় উষ্ণতা সমাবেশের চর্তুদিকে ছড়িয়ে যেতে লাগল। তৎকালীন খ্যাতনামা জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতা লাল মিঞা, জামালউদ্দিন হাসেমি, মোহন মিঞা এঁরাও এঁদের বক্তব্যে সুভাষের প্রতি আস্থা প্রকাশ করলেন। জয়ধ্বনি উচ্চারিত হয়ে উঠল। বেলডাঙ্গার ঠিকাদার ভ্রাতৃদ্বয় হাজী ইউসুফ ও হাজী আয়ুব মিঞাদের আগ্রহ আতিশয্যে সে রাত্রে তাঁদের অতিথি হলেন সুভাষ চন্দ্র।

কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধী সুভাষকে আপ্যায়নের অপরাধে পুলিশ পরে হাজী ভ্রাতৃদ্বয়ের বাড়ী তল্লাশি চালায় এবং তাঁদের তিরস্কার করে। সম্ভবত ২২৩১৩২ সুভাব চন্দ্রকে বেলডাঙ্গার সুগার মিল পরিদর্শনে নিয়ে যান মিলের মালিক রাধা কিষেন ঝাঁঝারিয়া। মিলে উৎপাদন শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর শুভাগমনে মিলের প্রধান ইঞ্জিন সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়। সুভাষ চন্দ্র বিয়ারিং ঘুরিয়ে পুনরায় মিল চালু করলেন। মিল নতুন উদ্যমে চলতে শুরু করল। ২২

শীতল চৌধুরী, দেবেন্দ্র দত্ত, ছত্রপতি রায়, রাধাপদ প্রামাণিক, শশাঙ্ক শেখর সান্যাল প্রভৃতিদের নিয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠিত হয়েছে। বেলডাঙ্গায় আহুত হয়ে সুভাষ প্রায় শেষ রাতে বেলডাঙ্গায় পৌছলেন। কিন্তু অত রাতেও সব সম্প্রদায়ের মানুষ সুভাষকে সংবর্দ্ধনা জানাতে প্রস্তুত।

‘সুভাষ বোস কি জয়’ ধ্বনি দিতে দিতে তারা এগিয়ে গেল। ডাঃ রাধাপদ প্রামানিকের বাড়ীতে সে রাত্রে তিনি আশ্রয় গ্রহণ করলেন। পরের দিন (৩০ শেনভেম্বর, ১৯৩৯) ডাঃ প্রামণিকের বৈঠক খানায় একটি কর্মী বৈঠক ডাকা হয়। কিন্তু কার্যত তা জনসভায় পরিগনিত হয়। ১৬ জানুয়ারী ১৯৩৯ বেলডাঙ্গায় সুভাষ চন্দ্র বসুকে এক অসাধারন সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়- বেলডাঙ্গাবাসীদের পক্ষ থেকে এতদবিষয়ে একটি প্রতিবেদন-

সুভাষ চন্দ্রের সংবর্দ্ধনা:-

বেলডাঙ্গার হাজরা মশাইদের বাড়ীতে সামনের প্রাঙ্গনে ভারতমাতার বীর সন্তান সুভাষচন্দ্রের সংবর্ধনায় যাঁরা উদ্যোক্তা ছিলেন তাঁরা কেউই আজ নেই। সেদিনের অভ্যর্থনার জন্য অভ্যর্থনা কমিটিতে যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন ১। ক্ষিতিশ চন্দ্র ঘোষ ২। দ্বিজপদ বন্দ্যোপাধ্যায় ৩। ছত্রপতি রায় ৪। নলিনাক্ষ সান্যাল ৫। তারাপদ মাহাতো ৬। তারাপদ রুজ ৭। অহিভূষন মুখার্জ্জী ৮। প্রয়াত সাংসদ শশাঙ্ক শেখর সান্যাল ৯) ডাঃ বলরাম সেনগুপ্ত।

সংবর্দ্ধনা উপলক্ষ্যে সারা বেলডাঙ্গাকে সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছিল। তাঁকে যে অভিনন্দন পত্রটি দেওয়া হয়েছিল সেটি নিন্মরূপ:-

বন্দেমাতরম্
সুপ্রসিদ্ধ জননায়ক,

বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সভাপতি শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র বসু মহাশয় এর বেলডাঙ্গা শুভাগমন উপলক্ষ্যে অভিনন্দন।

হে সৌম্য, হে জন মাননীয়, হে মহাপ্রাণতার নিত্য সাধক, হে দেশ মাতৃকার দয়িত নন্দন, জাতীয় বিবর্তের অগ্রদূত স্বরূপ আপনাকে সংবর্দ্ধনার জন্য আমরা কেন আমাদিগের অতীত বুলকোটি পিতৃপুরুষের সাধনার স্বর্ণবেদীতে সমবেত হইয়াছি, তাহা আপনি অবগত আছেন।
তথাপি আমাদিকের স্পন্দিত হৃদয়ের নিখিল ভাব শিথিল ভাষায় ব্যক্ত করিবার ব্যর্থ প্রয়াস তাহা চাপল্য প্রণোদিত হইলেও জীবনের এই শুভ মুহূর্তে সেই চাপল্য হইতে বিরত থাকা মানুষের পক্ষে একান্ত অসম্ভব। বিচারপটু এই অসম্ভত্বের গুরু লাঘব বিবেচনা করিয়া আমাদিগের ধৃষ্টতা ও মুখরতা মার্জনা করিবেন। আপনার অনুগত জনগণের ইহাই বিনীত অনুরোধ।
হে ত্যাগী সত্বম, আমাদিগের প্রগাঢ় প্রীতি ও শ্রদ্ধার তুচ্ছ নিদর্শন রূপ এই দীনোপায়ন লইয়া নিঃসম্বল আমরা আপনার সামনে উপস্থিত হইয়াছি, ইহা ভবাদৃশ মহনীয় অতিথির পক্ষে অতীব অযোগ্য ও অকিঞ্চিৎকর হইলেও ধীমান আন্তরিকতার পুত ধারায় অবস্থিত বলিয়া আশা করি উপাচার বোধে উপেক্ষিত হইবে না।
হে স্বসুখ নিস্পৃহ, হে পুণ্য স্মৃতি দেশবন্ধুর প্রিয় শিষ্য, আপনি সেবাব্রতে দীক্ষিত হইয়া আপনার কুসুমায়িত আরতিকে কণ্টকাকীর্ণ করিয়াছেন। হে বীর, আপনি যে জাতির মুক ভাবকে মুখর করিয়া তুলিয়াছেন বাংলার পল্লীর প্রাণে প্রাণে যে নবজীবনের মূর্ছনা আনয়ন করিয়াছেন, এযাবৎ পথহারা ভারতের ভাবী ভরসার ‘স্থল’ তরুণ সংঘের মনঃ চক্ষুর সম্মুখে যে মহান আদর্শের বিপদ লক্ষ্য করিয়া দিয়াছেন, নির্মূল অন্তঃসারশূন্য, অগ্রসরণে বাধাভূত প্রতিষ্ঠান সমূহকে ভূমিসাৎ করিয়া জাতীয় সৌধ নির্মাণ দক্ষ কারূকরগণের অপরিহার্য সহায়ক রূপে যে পরম সত্যকে জীবনের চরম সাধ্য জ্ঞানে বরণ করিয়াছে উহা হে অক্লান্ত কস্মিন, জাতীয় জীবনের ইতিবৃত্তে হীরকাক্ষরে লিখিত হইয়া আপনার পবিত্র কীর্তিকে প্রম্বল ও চিরমধুর করিয়া রাখিবে।
Bengal has a messege of her own to deliver in the world হে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা প্রার্থনা করি শ্রী ভগবান আপনার এই অভয়বাণী সার্থক করুন।
বিশ্বজন সংসদে আত্ম প্রতিষ্ঠার বিজয়মালা লাভ করিয়া যেদিন আমাদিগের স্বর্গাদপী গরীয়সী জন্মভূমি তাহার সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা মাতৃভূমিতে আকাশে বাতাসে সুখের সম্ভার ছড়াইয়া দাগা পাওয়া দুলালের নিপীড়িত বক্ষে আশার স্নেহ প্রলেপ লাগাইয়া, অনন্ত নির্ভরতার আনন্দে জাতীয় ইহ পরকাল উন্মুক্ত করিয়া দেশের তাপসী যামিনীকে শুভ্র জ্যোৎস্না পুলকিত করিয়া তুলিবেন।

হে নির্ভীক, জাতীয় সেই জয়যাত্রার পুরভাগে গৌরব কেতন আপনি বহন করিয়া
নব প্রেরণায় এই মুহ্যমান জাতি উদ্বুদ্ধ হইয়াছে- হে আমাদের প্রিয়তম, সাহসের অবগমন- হে অনন্তশক্তিমান, সর্ব্বকরণ কারণ আপনার মঙ্গল করুন।
হৃদয়ের অতি অন্তঃস্থল হইতে স্ফুরিত হইতেছে যে স্নেহাশীষ তাহা সাফল্য মন্ডিত হউক, ‘পন্থান সন্তুতে শিবায়ঃ।”

ভবদীয় গুণমুগ্ধ বেলডাঙ্গাবাসী বৃন্দ

১৬ ই জানুয়ারী ১৯৩৯

উপরোক্ত সংবর্ধনা পত্র রচনা করেছিলেন আজাদ হিন্দ মন্ত্রীসভার সদস্য দেবদাসের সুযোগ্য ভ্রাতা তদানীন্তন হরেকনগর হাইস্কুলের বিশিষ্ট শিক্ষক শ্রী শম্ভুদাস ও সার্ব্বিক সহযোগিতা করেছিলেন প্রয়াত সাংসদ শশাঙ্ক শেখর সান্যাল।
সংবর্দ্ধনার উত্তরে সুভাষ চন্দ্র বসু সেদিন বলেছিলেন রামগড়ে তিনি কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন, মহাত্মা গান্ধীর মনোনীত প্রার্থী পট্টভী সীতারামাইয়া পরাজিত হয়েছিলেন। ফলে মহাত্মাজী ভীষণ মনোকষ্টে ভুগছিলেন। মহাত্মাজীকে দুঃখ কষ্ট দিয়ে তিনি তাকে ছোট করতে চাননি- তাছাড়া রামগড় অধিবেশনে ভারত ছাড় আন্দোলন স্বীকৃতি পায়নি। তিনি কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
তারপর ফরওয়ার্ড ব্লক গঠনের জন্য বেলডাঙ্গা আসেন। হাজরা মশাইদের বাড়ীর সম্মুখস্ত প্রাঙ্গনে তিনি জাতিকে বলেছিলেন, অবিলম্বে ইংরেজকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে আমাদের সংগঠিত হয়ে- ভারতমাতার মুক্তিকে ত্বরান্বিত করার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।২৩
১৯৪০ সনে ভারত পরিত্যাগের আগে শেষবারের মত সুভাষ চন্দ্র এসেছিলেন বেলডাঙ্গার তাঁর বিশ্বস্ত সহকর্মী রাধাপদ প্রামানিক মশাই এর গৃহে।  সেখানে রাত্রিবাস পরদিন লোঢ়া পার্কে জিয়াগঞ্জে এক জনসভায় ভাষন দেন।” ২৪

গোকর্ণে:-

কান্দী মহকুমার গোকর্ণ গ্রাম তার প্রাচীন নানা ঐতিহ্যের মতই স্বদেশী আন্দোলনের কৰ্ম্মযজ্ঞে মুর্শিদাবাদ জেলার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট ও উজ্জ্বল পরিচ্ছেদ অধিকার করেছিল এবং কান্দী মহকুমা শহরের প্রান্ত থেকে শুরু করে বহরমপুর সদর শহরের গঙ্গার পশ্চিম তীর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় দেশ প্রেমিক ও রাজনীতি সচেতন প্রায় প্রত্যেকটি মানুষই একসময় গোকর্ণ গ্রামের আন্দোলনের ধারার সাথে নিগুঢ়ভাবে প্রতিটি অঞ্চল ও গ্রামের কর্মধারা সংযুক্ত করেছিলেন। গোকর্ণ গ্রামের রাজনৈতিক হাওয়ার উপর সংলগ্ন আরও চারটি অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বহুলাংশে নির্ভর করতো। গোকর্ণে কোন বড় রাজনৈতিক সভা হলে আশেপাশের গ্রাম থেকে স্বেচ্ছাসেবক ও কংগ্রেসকর্মীরা দলে দলে যোগদান করতেন। এইসব স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক ছাড়াও জেলার খ্যাতনামা নেতারা আসতেন মদের দোকানে পিকেটিং করতে। এই পিকেটিং এর কাজে অনেক সেচ্ছাসেবক কারাবরণ করেছিলেন। এই গ্রামের জগবন্ধু দাস, “বলরাম চক্রবর্তী, “ভক্তি ভূবন ধর, বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পার্শ্ববর্তী খোসবাসপুর গ্রামের সৈয়দ আব্দুর রহমান ফেরদৌসী কারা বরন করেন এবং আন্দোলনে যুক্ত থাকার অপরাধে ভোলানাথ রায়চৌধুরী ও কোমল লোচন রায় চৌধুরী, হৃষিকেশ সাহা প্রভৃতির বন্দুকের লাইসেন্স বাতিল হয়।

সম্ভবতঃ ১৯২৯ বিধানসভার নির্ব্বাচন। কংগ্রেসের প্রার্থী তাজ বাহাদুর সিং। অন্য পক্ষে সুরেন্দ্র নারায়ণ সিংহ। নির্ব্বাচনের হাওয়ায় সারা গ্রাম চঞ্চল। কংগ্রেসের পক্ষে গ্রাম্য যুবকেরাও জাতীয়তাবাদী সকল মানুষ। অপর পক্ষেও বেশ কিছু মানুষ ছিলেন। স্বেচ্ছাসেবকরা দলবদ্ধভাবে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গেয়ে চলেছেন গ্রামের রাস্তায় কংগ্রেস পক্ষের প্রার্থীর জন্য প্রচারে-

কংগ্রেস জয়যুক্ত হোক- কংগ্রেস জয়যুক্ত হোক
হে ভগবান,
দাঁড়ালেন যিনি দেশের তরে
ভোট দিয়া সেই তেজ বাহাদুরে
রাখো দেশের মান।

ভোট গ্রহণ হয়েছিল গোকর্ণের পুলিশ থানাতে। তখন জেলা বোর্ডের রাস্তা ছিল থানা ও পোষ্ট অফিসের পাশ দিয়ে। বেলা তখন দুপুর হয়তো দেড়টা দুটো হবে। জেলা বোর্ডের রাস্তায় সুভাষ চন্দ্র এলেন একটা ট্যাক্সিতে বহরমপুরের দিক থেকে। সঙ্গে কারা ছিলেন। ফাঁড়ি ও পোষ্ট অফিসের সামনে নামলেন সুভাষ চন্দ্র ট্যাকসি থেকে। জনতা উল্লসিত হয়ে উঠল তার দর্শনে। একজন অপরূপ সুন্দর মানুষ। যেমন তার রং তেমন তার উজ্জ্বলতা যার সঙ্গে কারোর কোন তুলনা চলে না। তিনি এলেন। সকলকে কিছু বললেন। মুগ্ধ করলেন। মোহিত করলেন। তারপর মিনিট কুড়ি পরে আবার চলে গেলেন কান্দীর দিকে। ২৫

কান্দীতে:-

১৯২৬ ও ১৯২৯ সালে বঙ্গীয় পরিষদ নির্ব্বাচন উপলক্ষে কান্দী মহকুমার বিশেষ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ১৯২৬ সালে সর্ব্বভারতীয় নেতা যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত কংগ্রেস প্রার্থী ব্রজভূষণ গুপ্তর পক্ষে কান্দী শহর সহ মহকুমার বিভিন্ন স্থানে জনসভায় ভাষণ দেন। বিরোধী প্রার্থী মহারাজ কুমার মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী জয়লাভ করেন। ১৯২৯ খৃঃ ভগ্ন স্বাস্থের জন্য ব্রজভূষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন নি।

তাজ বাহাদুর সিং কংগ্রেস প্রাথী ছিলেন আর সুরেন্দ্র নারায়ণ সিংহ কংগ্রেস প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিতহন। নির্ব্বাচনী প্রচারের জন্য সুভাষ চন্দ্র বসু ও দেশ প্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত কান্দী এসেছিলেন তারা কান্দি শহরে গোকর্ণে ও পাঁচথুপিতে জনসভায় বক্তৃতা করেন।

জেমোর খাদি প্রতিষ্ঠান থেকে সুভাষ চন্দ্র বসুকে কিছু উপহার প্রদান করা হয়। ১৯৩১ সালের ১৮ জানুয়ারী বহরমপুরে সুভাষ চন্দ্র গ্রেপ্তার হন। ১৯৩২ সালে সুভাষ চন্দ্র মালদহ যাবার পথে কান্দী এসে ঘন্টা তিনেক ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে দেওয়ান খানায় একটি সভার আয়োজন করা হয়। বিশিষ্ট স্বদেশী প্রচারক জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগী তিরিশ শতকে কান্দী শহরে তার ম্যাজিক লণ্ঠন দিয়ে স্লাইড সহযোগে প্রচার অভিযান চালান। বিশেষভাবে কান্দি শহর ও বড়ঞা থানার পাঁচথুপিকে কেন্দ্র করে।

১৯২৯ খৃষ্টাব্দে সুভাষ চন্দ্র যখন কান্দীতে এসেছিলেন তখন তিনি কংগ্রেস বিরোধী কিছু অপশক্তির কাছে লাঞ্ছিত হন। সেদিনের লাঞ্ছনাকারী বৃন্দ পরবর্তী সময়ে স্বাধীনোত্তর কালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে আসেন।

১৯২৯ খ্রীঃ সম্ভবতঃ মে মাসে সুভাষচন্দ্র বহরমপুর থেকে কান্দী হয়ে পাঁচথুপি যান। ২৬

জেমোতে:-

জেমোর প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী অন্যতম গান্ধীবাদী অধুনা প্রয়াত পতিত পাবন মিশ্র মশাই দাবী করেছেন-

“ইংরেজী ১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেসে সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। ইংরেজী ১৯২৯ সালে কুমিল্লার সুভাষচন্দ্রের মধ্যস্থতায় বাংলার বিপ্লবীগণ মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগী আন্দোলনের মধ্যে মিলন সেতু আনার প্রয়াস করেন আমি সেই কনভেনসনে মুর্শিদাবাদ জেলার প্রতিনিধি ছিলাম।
সুভাষ চন্দ্র যখন কর্পোরেশনের মেয়র সেই সময় তিনি আমার জেমোর বাড়ীতে কংগ্রেসের কাজকর্মের সূত্রে এসেছিলেন। তিনি হঠাৎই দুপুরের দিকে আমার বাড়ীতে এসেছিলেন। আমার দিদি সন্দেশ বানিয়ে তাঁকে দিয়েছিলেন। সুভাষ চন্দ্র চায়ের কথা বললেন কিন্তু সে সময় তার বাড়ীতে চায়ের চল ছিল না। এর পর থেকে তার বাড়ীতে চায়ের প্রচলন হয়। সুভাষ চন্দ্র যখন তার জেমোর বাড়ীতে আসেন তখন তিনি কান্দী কংগ্রেসের সহ- সম্পাদক।”
“১৯৩২ খৃঃ সুভাষ চন্দ্র বহরমপুর আসেন। তাঁকে সংবর্দ্ধনা দেওয়া হয়। সেই সংবর্ধনা সভায় শশাঙ্ক শেখর সান্যাল ওরফে সম্বলদার পাশে আমি ছিলাম। সেই সময়ের গ্রুপ ফটো আমার বাড়ীতে আছে এখনো।” ২৭

পাঁচথুপিতে:-

১৯২৯ খৃঃ মে মাসে সুভাষ চন্দ্র পাঁচথুপি আসেন। গাড়ীতে করে বহরমপুর থেকে কান্দী হয়ে পাঁচথুপি আসেন। সেখানে তিনি তার তরুন অনুরাগীও কংগ্রেস কর্মী সুনীল মোহন ঘোষ মৌলিকের গৃহে কিছুক্ষণ কাটান।
পাঁচথুপি গ্রামে কয়েকটি স্থান ঘুরেই তিনি ফিরে যান। সভা না হলেও তাঁকে ঘিরে যে জমায়েত হয় তা প্রায় সভার মত হয়ে যায়। সুনীলবাবু কলকাতা গেলে সুভাষ চন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন ও তার ফলে তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা জন্মায়। সুনীল বাবু সুভাষচন্দ্রকে নিয়মিত পত্র দিতেন এবং সুভাষচন্দ্র সে পত্রের উত্তর দিতেন সে সব পত্রে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ যেমন থাকত তেমনি থাকত সমসাময়িক রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের নানা খন্ড চিত্র। সুভাষচন্দ্রের চিন্তা ভাবনা সে সব পত্রে প্রতিফলিত হয়েছিল। সে কারণে এই পত্রগুলি সুভাষ জীবনের দলিল হিসাবে গণ্য হতে পারে।
একটি পত্রের অনুলিপি নিম্নে দেওয়া হলো।
গবেষক পুলকেন্দু সিংহ লিখছেন-
সম্প্রতি প্রয়াত পাঁচথুপি গ্রামের আর একজন প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী গোপীকান্ত
চট্টোপাধ্যায় মশাই তাঁর মৃত্যুর কয়েকদিন আগে (২৩/৮/১৯৯৯) পাঁচথুপিতে সুভাষচন্দ্র প্রসঙ্গে কিছু বলেন তখন তিনি নব্বই উত্তীর্ন ও রোগে শয্যাশায়ী।
সুভাষ চন্দ্রের গায়ে সাদা পঞ্জাবী মাথায় টুপি ছিল। তিনি সতীশ ত্রিবেদীর ফোর্ড গাড়ীতে কান্দী থেকে বহরা হয়ে চারা বটতলা হয়ে পাঁচথুপি যান। সুনীল বাবু গ্রামে তাঁকে অভ্যর্থনা করেন। তাঁর সঙ্গে বহরমপুর থেকে কয়েকজন সঙ্গী ছিলেন। তিনি সুনীল বাবুর বাড়ী থেকে পাঁচথুপি বাণী মন্দিরে যান। সুনীল বাবুর বাড়ীতে তিনি জলযোগ করেন।

পাঁচথুপির সে সময়কার যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা হলেন সরসী ঘোষ হাজরা, ডাঃ বিমলা পদ ঘোষ হাজরা, রঘু খলিফা, শান্তি ভট্টাচার্য্য কংগ্রেস কৰ্ম্মী ভোলানাথ ঘোষ হাজরা, নরেন সিংহ, ব্রজেন্দ্র দুলাল অধিকারী (গন্ডী বাবু) প্রমুখ।২৮(ঐ)

পাঁচথুপির সুনীল মোহন ঘোষ মৌলিক মহাশয়কে প্রদও সুভাষ চন্দ্র বসুর পত্রাবলীর একটি

KURHANS KORIGIN

Alexandia
Karlsbag
Czechoslovakia
5.8.35

প্রীতিভাজনেষু,

তোমার দুইখানি চিঠি আমি যথা সময়ে পেয়েছি। একখানি ফেব্রুয়ারি মাসে ও অপর খানি জুন মাসে। উত্তর দিতে পারিনি বলে কিছু মনে করো না।

একমাসের উপর হলো আমি এখানে এসেছি – Operation এর পর। এখন শরীর পূর্ব্বাপেক্ষা ভাল, তবে ভেতরে দুর্ব্বলতা আছে। (যেখানে অস্ত্রোপচার হয়েছিল) এবং তার ফলে মধ্যে বেদনা হয়। পূর্ব্বেকার বেদনা আর হয় না তবে হজম এখনও ভাল হয় না। মোটের উপর বলতে পারা যায় শরীরটা আস্তে আস্তে সারছে।
তোমার প্রথম চিঠি এমনভাবে লিখেছিলে যেন তৃতীয় পক্ষ ও চিঠি পড়ে না। তোমার মনে রাখা উচিৎ যে আমার চিঠিগুলি তৃতীয় পক্ষের চোখ এড়াতে পারে না।
তোমার শরীর কেমন আছে। আজকাল কি করছ? মুর্শিদাবাদেরই বা খবর কি?

সম্প্রতি আমি আর একখানি পুস্তক লিখবার চেষ্টা করছি। প্রথম পুস্তকটির অশাতীত সমাদর হওয়াতে আমি এ কাজে হাত দিয়েছি। আমি চাই আমাদের জাতীয় আন্দোলনের একটা ব্যপক ইতিহাস লিখতে- বিদেশীদের জন্য।
তুমি একখানি ছবি চেয়েছ- সঙ্গে পাঠাচ্ছি। আমার শরীর সম্পূর্ন সুস্থ হলেই আমি দেশে ফিরব – এইরূপ আমার অভিপ্রায়।
তোমার বাবার শরীর অসুস্থ একথা লিখেছিলে। এখন তিনি কেমন আছেন জানাবে।
আশা করি তুমি ভাল আছ। আমার ভালবাসা জানবে।

ইতি তেমাদের
শ্রী সুভাষ চন্দ্র বসু ২৯ ( ঐ)

 

তথ্যঋণ:-
১) ভারত পথিক, সুভাষচন্দ্র বসু।
২) মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র, পুলকেন্দু সিংহ।
৩)সুভাষের সাথে বারো বছর, হেমন্ত কুমার সরকার।
৪)প্রবন্ধ সংকলন, শশাঙ্ক শেখর সান্যাল সুভাষ প্রসঙ্গ ৬
৫) প্রবন্ধ সংকলন শশাঙ্ক শেখর সান্যাল সুভাষ নেপথ্যে। (৩২-৩৩ পৃষ্ঠা)
৬) মুর্শিদাবাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সুভাষ চন্দ্র সংকলন অমর মন্ডল। তথ্য সংগ্রহ স্নিগ্ধা সেন – ঝড়। শারদ সংখ্যা ৯৬ (বহরমপুর / মুর্শিদাবাদ)।
৭)বিশেষ প্রতিবেদন আশিস রায় ও শক্তি সাধন মুখোপাধ্যায়,জঙ্গীপুরে নেতাজী প্রথম আসেন ১৯২৯?, বাণীকণ্ঠ পত্রিকা, ৩১ জানুয়ারী ১৯৯৭ সম্পাদনা- আশিস রায়।
৮)একদা সুভাষ চন্দ্র এখানে আসিয়াছিলেন’ ,বিনতা কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়,বাণী কন্ঠ’ পত্রিকা(রঘুনাথগঞ্জ) মুর্শিদাবাদ, সম্পাদক, আশিস রায়, ১৫ জানুয়ারী ১৯৯৭ সংখ্যা।
৯)ঝড় পত্রিকা,  শারদ সংখ্যা- ১৯৯৬,বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ।
১০) মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র, পুলকেন্দু সিংহ।
১১)লালগোলা মহেশ নারায়ণ একাডেমী পত্রিকা, ১৯৬৪।
১২) ২০১৮ সালে ৮৭ বছর বয়সের প্রবীণ ব্যক্তি  নিশীথ কুমার রায়-এর সাক্ষাৎকার।
১৩) মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র, পুলকেন্দু সিংহ।
১৪) সমকালীন ভারতে সুভাষচন্দ্র, শঙ্করীপ্রসাদ বসু,কলিকাতা।
১৫) মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র,  পুলকেন্দু সিংহ।
১৬) সুভাষ চন্দ্রের পত্রাবলী, শ্রী সুভাষচন্দ্র বসু রচনাবলী, প্রথম খন্ড।
১৭) জনমত, ২৫ বর্ষ ২৫ সংখ্যা। সম্পাদক রাধারঞ্জন গুপ্ত, খাগড়া, মুর্শিদাবাদ।
১৮) ঝড়,শারদ সংখ্যা ৯৬, মুর্শিদাবাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সুভাষচন্দ্র, সংকলন অমর মন্ডল, স্নিগ্ধা সেন।বরহমপুর, মুর্শিদাবাদ।
১৯) স্বাধীনতা সংগ্রামে মুর্শিদাবাদ, প্রফুল্ল কুমার গুপ্ত। প্রাদেশিক সম্মেলনের চত্বরে (৭৩, ৭৪, ৭৫, ৭৬ পৃষ্ঠা) বুক সেন্টার। ৮বি/১ টেমার লেন। কলি-৯
২০)মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র,  পুলকেন্দু সিংহ।
২১)১/ কৃষ্ণনাথ কলেজে সুভাষ চন্দ্র। শোভেন্দ্র মোহন সেন-প্রাক্তন ছাত্র। KRISHNANATH COLLEGE CENTENARY VOLUME Page – 289.
২২)ঝড় পত্রিকা। শারদ সংখ্যা ৯৬ মুর্শিদাবাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সুভাষ চন্দ্র। সংকলন- অমর মন্ডল। মুর্শিদাবাদ।
২৩)মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র, পুলকেন্দু সিংহ।
২৪) জনমত পত্রিকা। ৩৫ বর্ষ, ২৫ সংখ্যা। শ্রী রাধা রঞ্জন গুপ্ত। খাগড়া, মুর্শিদাবাদ, ৩ পৃষ্ঠা।
২৫)মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র,  পুলকেন্দু সিংহ।
২৬) ঐ।
২৭)ঐ।
২৮) ঐ।
২৯)ঐ।

ঋণ স্বীকার-
আমার এই প্রবন্ধটি লিখতে গবেষক পুলকেন্দু সিংহের ‘মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র ‘ বইটি বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছে।

Author

  • Suman Kumar Mitra

    Suman Kumar Mitra is a Researcher at Murshidabad Zilla Itihas & Sanskriti Charcha Kendra. He did his MA in Bengali from Rabindra Bharati University and is a Guest Lecturer at D.I.E.T Murshidabad, Berhampur, West Bengal. Views expressed are personal.

    View all posts

(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)