Dr. Syama Prasad Mookerjee Research Foundation

মুর্শিদাবাদ এক অতি প্রাচীন স্থান। বহু প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এ জেলা

রাজা শশাঙ্ক থেকে নবাবী আমলের শেষ পর্যন্ত সহস্রাধিক বছরের ইতিহাসে এ জেলায় স্থাপিত হয়েছে প্রচুর মন্দির। নিম্নে এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা হল।
কপিলেশ্বর:-
মুর্শিদাবাদ সদর মহকুমার (বর্তমানে বেলডাঙ্গা থানার অন্তর্গত) শক্তিপুর বা শিবপুর গ্রামে কপিলেশ্বর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত আছে। এই কপিলেশ্বরের উৎপত্তি নিয়ে নানা ধরনের মত প্রচলিত আছে।
মহালিঙ্গেশ্বর তন্ত্র নামক গ্রন্থে তাকে “কপালেশ্বর” নামে বর্ণনা করা হয়েছে। আবার অনেকের মতে, এই কপিলেশ্বর হলেন কপিল মুনির পূজিত প্রাচীন শিবলিঙ্গ। এক সময় এক কাপালিক সাধকের দ্বারাও পূজিত হওয়ায় তাকে “কপালেশ্বর” নামেও ডাকা হয়।
‘পুণ্ডরীক-কুলু-কীর্ত্তি-পঞ্জিকা’ নামে একটি পুরনো পঞ্জিকা অনুসারে, ফতেসিংহ রাজবংশের পূর্বপুরুষ রাজা জয়রাম রায় এই কপিলেশ্বর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন এবং পূজার জন্য অনেক জমি দেবোত্তর দান করেন। এক সময় ফতেসিংহ (বর্তমান জেমো-বাঘডাঙ্গা অঞ্চলের রাজা) পরিবার এই কপিলেশ্বর মন্দিরের সেবায়েত ছিলেন। পরে কোনো এক কারণে কপিলেশ্বর মন্দির নদিয়ার মহারাজার অধীনে চলে যায়।
পঞ্চানন কায়স্থের কারিকা নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ২৯৩ বঙ্গাব্দ বা খ্রিস্টাব্দ ৮৮৭ সালে আদিত্যশূর রাজত্বকালেও শক্তিপুরে কপিলেশ্বরের অস্তিত্ব ছিল। তার মানে এই শিবলিঙ্গ প্রাচীনকাল থেকেই এখানে পূজিত হয়ে আসছে।
“বাজার শক্তিপুর ডিহি গঙ্গাধারে,
কপিলেশ্বরদেব আছেন তথারে।
তৎপর ডিহি কণ্টকনগর,
ইতমধ্যে দেবভূমির না লইবে কর।”
এই ছত্রগুলি থেকে জানা যায়, শক্তিপুর বাজারের পাশে, গঙ্গার ধারে কপিলেশ্বর শিবের মন্দির অবস্থিত। এর ঠিক পাশে ডিহি কণ্টকনগর নামে একটি এলাকা ছিল। এই এলাকা দেবভূমি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায়, সেখানে কর নেওয়া হতো না।
কপিলেশ্বর বা কপিলনাথের মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। মন্দিরের পূর্ব দিকে প্রায় এক দড়ির (রশির) দূরত্বে ভাগীরথী নদী বইছে। বর্ষাকালে নদীর জল মন্দিরের পূর্বাংশ পর্যন্ত এসে পৌঁছায়।
বর্তমান মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৪০ হাত, আর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ দুটিই ১৮ হাত করে। মন্দিরের সামনে একটি খোদাই করা পাথরের ফলক থেকে জানা যায় যে, ১২৪১ বঙ্গাব্দে (খ্রিস্টীয় ১৮৩৪ সালের কাছাকাছি), শক্তিপুরের বাসিন্দা পরলোকগত মহাত্মা জগন্মোহন এই মন্দিরটি নির্মাণ করিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রতি বছর শিবরাত্রি উপলক্ষে এখানে একটি বড় মেলা বসে। প্রায় এক মাস ধরে হাজার হাজার ভক্তের সমাগম হয়। মেলা ও শিবমন্দির এলাকাটি তখন প্রাণে ভরে ওঠে। এই মেলায় নানা ধরনের দ্রব্য কেনাবেচা হয়।
কিরীটেশ্বরী
পুরাণ অনুসারে, সতী যখন আত্মাহুতি দেন (দক্ষযজ্ঞে), তখন বিষ্ণু তাঁর দেহ ৫১টি অংশে বিভক্ত করেন। যেসব স্থানে সতীর শরীরের অংশ পড়েছিল, সেগুলো পরবর্তীতে পীঠস্থান হিসেবে পরিচিতি পায়।
কিরীটেশ্বরী তেমনই একটি পীঠস্থান। এটি মুর্শিদাবাদ শহরের কাছেই, ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরে, ডাহাপাড়া গ্রামের তিন মাইল পশ্চিমে অবস্থিত একটি ছোট গ্রাম—কিরীটকণা নামক স্থানে। কথিত আছে, এখানে দেবী সতীর মুকুটের একটি কণা পড়েছিল। এখানে দেবীর নাম বিমলা, আর ভৈরব বা সঙ্গী রূপে পূজিত হন সম্বর্ধ।
এক সময় মুর্শিদাবাদ যখন বাংলার রাজধানী ছিল, তখন কিরীটেশ্বরীর গৌরব ও খ্যাতি কলকাতার কালীঘাটের মতোই ছিল।
পঞ্চানন কায়স্থের কুলপঞ্জিকায় কিরীটেশ্বরী সম্পর্কে লেখা আছে:
“ডিহি কিরীটেশ্বরী মধ্যে কিরীটেশ্বরী গ্রাম।
মহাপীঠ হয় সেই মহামায়ার ধাম।
তথিমধ্যে মহামায়ার দেবোত্তর ভূমি। তাহে হস্তক্ষেপ না করিবেন ভূস্বামী।
যৈছে সেবা ভালরূপ চলে তা দেখিবে।
পাণ্ডাগণের প্রতি সদা সুদৃষ্টি রাখিবে।
অতিথি সৎকার যৈছে চলে ভালরূপ তৈছে দৃষ্টি থাকে যেন সিংহপুরভূপ।”
১৫শ শতকের শেষদিকে মঙ্গল বৈষ্ণব ও তাঁর পূর্বপুরুষেরা এই দেবীর সেবায়েত ছিলেন বলে জানা যায়। পরে বঙ্গাধিকারি পরিবার তাঁদের প্রচেষ্টায় কিরীটেশ্বরীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে। এই বংশের লোকেরা পুরনো মন্দির সংস্কার করেন, নতুন মন্দির নির্মাণ করেন এবং সেবাপদ্ধতির অনেক উন্নতি করেন।
প্রাচীন মন্দিরটি পরে লালগোলার মহারাজ যোগীন্দ্রনারায়ণ রায় বাহাদুর অনেক টাকা খরচ করে পুনঃসংস্কার করেন, যা হিন্দু সমাজে খুবই প্রশংসিত হয়।
কিরীটেশ্বরী মৌজা ছিল বঙ্গাধিকারিদের সম্পত্তি। ১২৮০ বঙ্গাব্দে জমির দাতার নাম স্পষ্ট না থাকায় সরকার ৭৬০ বিঘা লাখেরাজ জমি বাজেয়াপ্ত করে। তখন রাজা সূর্যনারায়ণের স্ত্রী এবং তাঁর পুত্র চন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী রানী মনোমোহিনী জীবিত ছিলেন। তিনি চার বছরের জন্য জমি ইজারায় নেন, কিন্তু টাকা পরিশোধ না করায় ১৮৫১ সালে জমি নিলামে ওঠে এবং নবাব বসন্ত আলি খাঁ তা কিনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন।
এই নবাব অনেক সম্পত্তি মুর্শিদাবাদের ইমামবাড়ায় দান করেন। তাঁর ওয়াকফ এস্টেটে দেওয়ান ছিলেন কৃষ্ণমোহন ঘোষ, যিনি কায়স্থ দাতা দিগম্বরের বংশধর রামজীবনের সন্তান। তাঁদের পরিবার বর্তমানে কাটোয়ার কাছে বহড়ান গ্রামে বাস করেন। রামজীবন ১২৭২ বঙ্গাব্দে জমি ইজারায় নিয়ে পরে ১২৭৬-এ জমি কিনে নেন। তারপর থেকেই তাঁর বংশধরগণ কিরীটেশ্বরীর পূজা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই পূজার জন্য আলাদা কোনো দেবোত্তর সম্পত্তি নেই—ঘোষ পরিবার নিজের খরচেই দেবীর সেবা করে থাকেন।
এখানে একটি গুপ্ত পীঠ রয়েছে, যেখানে প্রতিদিন পূজা ও অন্নভোগ হয়। সাধারণ লোকজন সেখানে পূজা দিতে পারত না, বর্তমানে অবশ্য এ নিয়ম অনেকটা শিথিল। মূল পীঠস্থানে ফুল ও গঙ্গাজলে পূজা হয়, কোনো ভোগ দেওয়া হয় না।
পৌষ মাসের প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে এখানে মেলা বসে।
নিচে “কৃষ্ণপুরের তারা মন্দির” বিষয়ক লেখাটিকে সহজ ও চলিত বাংলায় রূপান্তর করা হলো:
কৃষ্ণপুরের তারা মন্দির
লালগোলার রাজপ্রাসাদের কাছেই অবস্থিত একটি গ্রাম—কৃষ্ণপুর। এই গ্রামে একটি প্রাচীন তারা মন্দির আছে, যেখানে দেবী তারার মূর্তি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।
লালগোলার সেই দানশীল ও দেবভক্ত মহারাজ বাহাদুর, মন্দিরটির সংস্কারের জন্য প্রায় ১৬ হাজার টাকা ব্যয় করেন। তাঁর অনুদানে এই মন্দির নতুন করে জৌলুস ফিরে পায় এবং এখনো ধর্মপ্রাণ মানুষের পূজার স্থান হিসেবে সম্মানিত।
লালগোলার কালীবাড়ি:-
১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়  ‘লালগোলা রাজ কালীবাড়ি’।১ স্বাধীন ভারতের পূর্বে লালগোলা বৃহৎ অঞ্চল ছিল। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে লালগোলার বেশ কিছু গ্রাম ও অঞ্চল চলে যায়। প্রাচীন লালগোলার সেই রকম একটি গ্রাম দেবিনগর।(অধুনা বাংলাদেশ)
 লালগোলা রাজ কালিবাড়িতে যে মূর্তি রয়েছে সেরকম একটি কালী মূর্তির পুজো করতেন দেবিনগর গ্রামের চাঁই মন্ডল গ্রামবাসীরা।সেখানে যে মূর্তি পূজিত হত সেই মূর্তি  বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার মন্ডল গ্রামের বর্ধিষ্ণু ভট্টাচার্য পরিবারের কূলদেবী ছিল। কোন কারণে সেই পরিবারের পূজা বন্ধ হয়ে যায়।আজ থেকে প্রায় আড়াইশো  বছর পূর্বে সেই পরিবারের এক পুরুষ সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করে গৃহত্যাগী হন।তিনি ভ্রমণ করতে করতে এই দেবীনগর গ্রামে এসে উপস্থিত হন এবং এখানে পারিবারিক কালী মূর্তিটি নতুন করে প্রতিষ্ঠা করে মাতৃ আরাধনা শুরু করেন। তাঁর মৃত্যুর পর সেই গ্রামের চাঁই মন্ডল গ্রামবাসীরা এই পুজো চালিয়ে যেতে থাকেন।সেই সময় লালগোলার তৎকালীন রাজা রাও রামশংকর রায় দেবিনগর ভ্রমন কালে সেই মূর্তি দর্শন করেন এবং এ বিষয়ে সমস্ত ইতিহাস শোনেন। সে সময় মূর্তিটি একটি গাছের তলায় প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং সেই কারণে মূর্তিটিরও প্রায় ভগ্নাবশেষ দেখেছিলেন রাজা রামশংকর রায়। গ্রামের অধিবাসীরা রাজার নিকট দাবি করেন এই মূর্তিটিকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করার। এর কিছুকাল পর পদ্মার করাল গ্রাসে সমস্ত দেবিনগর গ্রামটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই মাতৃ মূর্তির কাঠামোটি পদ্মার  শাখা নদী কলকলী তে প্রবাহিত হয়ে লালগোলা  রাজবাড়ীর ঘাটে এসে লাগে। কথিত আছে, রাজা রামশঙ্কর রায় পূর্ব রাত্রে স্বপ্নাদেশ পান মা কালী স্বয়ং তাঁর গৃহে প্রতিষ্ঠিতা হতে চাইছেন। পরদিন ভোরে ঘাটে কাঠামো এসে লাগার খবর তাঁকে বিচলিত করে। কাঠামো তুলে রাজবাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সঙ্গে সঙ্গে রাজা রামশংকর রায় বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার মন্ডল গ্রামে লোক পাঠান বর্ধিষ্ণু ভট্টাচার্য পরিবারকে খুঁজতে। ভট্টাচার্য পরিবারের খোঁজ মেলে। ভট্টাচার্য পরিবার থেকে আসেন মহারাজা যোগীন্দ্র নারায়ণ রায়ের সভাপন্ডিত তৈলখ্য ভট্টাচার্যের ( ত্রৈলোক্য নাথ স্মৃতি ভূষণ) পিতামহ। তাঁর নাম জানা যায় না, তবে এটুকু জানা গেছে যে তিনি একজন সিদ্ধ সাধক মানুষ ছিলেন। রাজা তাঁর কাছে দেবিনগর এর কালী মূর্তির কথা সবিস্তারে বলেন এবং  এই মূর্তির স্বরূপের বাখ্যা জানতে চান ও কলকলি তে পাওয়া কাঠামো তে সেই কালী মূর্তির মত মূর্তি ও মন্দির প্রতিষ্ঠার ইচ্ছে প্রকাশ করেন।
 শুরু হয় সেইরকম মূর্তি তৈরির কাজ।এই মাতৃমূর্তি সত্যিই অপূর্ব। সমস্ত ভূ-ভারতে এরূপ মাতৃমূর্তি দ্বিতীয় নাই।রক্তবীজ বধ করার পর মাতৃগণ যখন বীররস পান করে আনন্দে নৃত্য করছিলেন, সেই নৃত্য পরায়ণা মাতৃমূর্তি শ্রীশ্রী মহাকালী রূপে শবরূপ শিবের উপর দণ্ডায়মান।এক পাশে তাঁর শ্রীশ্রী মহালক্ষ্মী অপর পাশে তাঁর শ্রীশ্রী মহা সরস্বতী, মাতার দক্ষিণে কামদেব বা পুরুষ এবং বামে রতিদেবী বা প্রকৃতি। দক্ষিণে অপরাজিতা (জয়া) , বামে অজিতা(বিজয়া)।শ্রীশ্রী চণ্ডীর ‘ঋষিচ্ছন্দস্ত্রম’- এর সাথে এই মূর্তি বিলিয়ে সাধক পেয়েছিলেন এই অপূর্ব মাতৃমূর্তির পরিকল্পনা। মায়ের করতালিরত দুটি হাত দেখে মনে হয় যেন হাত দুটি আবদ্ধ।এ বিষয়ে স্বভাবতই একটি শ্যামাসংগীতের কথা মনে পরে যায়,’’ তুমি আপনি সুখে আপনি নাচ আপনি দাও মা করতালি।“
  পন্ডিত তৈলখ্য ভট্টাচার্যের ( ত্রৈলক্য ভট্টাচার্য) প্রতিষ্ঠিত আর তিন শরিকের নাম ছিল সুরেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য, পঞ্চানন ভট্টাচার্য ও অমর ভট্টাচার্য. এরা প্রত্যেকেই বর্ধমান জেলার কাটোয়া  মহকুমার মন্ডল গ্রামের বাসিন্দা। রাজা রাম শংকর রায় ঐ ভট্টাচার্য পরিবারের প্রত্যেক শরিক কে তিন মাস করে পুজো করবেন এই মর্মে শ্রীভট্টাচার্যকে পুরোহিত হিসেবে রাখেন। শুরু হয় লালগোলা রাজ কালী মা এর আরাধনা। কথিত আছে, প্রতিষ্ঠার রাত্রে মা কোন কারণে অসন্তুষ্ট হন এবং রাজাকে স্বপ্ন দেন তিনি মন্দির ত্যাগ করবেন । রাজা তখন ক্রোধ বশত মায়ের  মূর্তিকে পেছন থেকে লোহার শেকলে  বেঁধে দেন। সাধারণের অনুমান মাটির তৈরি প্রতিমা যাতে সামনে ঝুঁকে পড়ে ভেঙে না যায় সে জন্যই এ ব্যাবস্থা।
পরম্পরায় জানা যায় উক্ত ভট্টাচার্য পরিবারের প্রত্যেক শরিকই ছিলেন সংস্কৃত বিষয়ে সুপণ্ডিত। পন্ডিত তৈলখ্য ভট্টাচার্য পন্ডিত ও বিদ্যান ছিলেন. মহারাজা রাও শ্রী যোগীন্দ্র নারায়ন রায় এর আমলে উনি সভা পন্ডিতের আসন গ্রহণ করতেন। দ্বিতীয় শরিক সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ছিলেন গুনি একজন সংস্কৃতের শিক্ষক। তৃতীয় শরিক পঞ্চানন ভট্টাচার্য পন্ডিত ধর্ম দাস পন্ডিতের( ধর্ম দাস পণ্ডিত ছিলেন মহেশ নারায়ণ বিদ্যামন্দিরের সংস্কৃত শিক্ষক এবং কালি মন্দিরের পুরহিত।)পিতা। চতুর্থ শরিক শ্রী অমর ভট্টাচার্য ছিলেন সংস্কৃতের শিক্ষক।
লালগোলা রাজার প্রতিষ্ঠিত কালী মা এর বাড়ি আজ লালগোলা পুরা সম্পদ ।এই মন্দিরে বসে শেকল  বাঁধা কালীমূর্তি দর্শন করে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতবর্ষের প্রথম গ্রাজুয়েট বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখেন “বন্দেমাতরম্”, যা আজ ভারতীয় উপমহাদেশের জাতীয় স্তোত্র। এ বিষয়ে শ্রী সুধাকর চট্টোপাধ্যায় লিখছেন,” বঙ্কিমচন্দ্র লালগোলাতে রাজ-অতিথি হিসাবে অবস্থানকালে সেখানকার কালীমন্দির ও কালী মূর্তির সান্নিধ্যে কোনও গ্রন্থের (আনন্দমঠের?) কিয়দংশ রচনা করেন; সেই জন্যই হয়ত মাতৃ পুজা এবং বিশেষ করিয়া  শক্তিপূজার সহিত হিঁদুয়ানির ভাব বিশেষ ভাবে ধরা পরিয়াছে।“ এখানে একটি বিষয় বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয় সুধাকর বাবু আনন্দমঠের কথা লিখে প্রশ্নচিহ্ন দিলেও পরের  লাইনেই মাতৃ শক্তির আরাধনার কথা লিখেছেন, যা শুধুমাত্র আনন্দমঠেই পরিলক্ষিত হয়।
    এই মন্দিরে আসেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি এই মন্দিরে বসে কত যে শ্যামা সঙ্গীত গেয়েছেন তার হিসেব নেই।  এ বিষয়ে আমার পিতামহের নীকট বন্ধু ও লালগোলার প্রবীণ তম ব্যক্তি শ্রী রবীন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের একটি আলোচনার উল্লেখ করেছেন ছবিলাল পাল তাঁর প্রবন্ধে –“ ডঃ সান্যাল একদিন গল্পচ্ছলে বলেন- আমরা তখন স্কুল ছাত্র, শুনলাম হেডস্যারের বাড়িতে কাজী নজরুল এসেছেন। আমরা কয়েকজন বন্ধু হৈ হৈ করে ছুটলাম স্যারের বাড়ি। দেখলাম স্যারের পায়ের কাছে কাজী সাহেব বসে আছেন, আমরা গান শুনতে চাইলে তিনি আমাদের বললেন, এখন দাদা অসুস্থ আর তোমরা গান শুনতে এসেছ? বকাবকি করলেন আমাদের। আমরা ছেলের দল ক্ষুণ্ণ মনে ফিরে এলাম সেখান থেকে। পড়ে ঐ দিন বিকেলে আমরা কলকলি পাড়ে ঘুরতে বেড়িয়েছি, দেখি কাজী সাহেব  কালীবাড়ি বটতলার নীচে একা বসে আছেন। আমাদের তিনি হাতছানি দিয়ে ডেকে বসালেন এবং তিনটি গান স্বেচ্ছায় গেয়ে শোনালেন। আমাদের কে কে গান গায় জানতে চেয়ে তিনি নিশিথ রায়ের( লালগোলা এম.এন.একাডেমীর প্রাক্তন শিক্ষক শ্রী সুখেন্দু রায়ের পিতা) কন্ঠে কয়েকটি গান শুনে তাঁর তারিফ করেন।
ভারতবর্ষের ৮০ থেকে ৯০ এর দশকের প্রখ্যাত ফুটবলার ভাস্কর গাঙ্গুলি  তার ফুটবল সেসন শুরুর আগে আসতেন আমাদের লালগোলা কালী বাড়ি তে পুজো দিতে।
আমাদের লালগোলার সন্তান ওয়ার্ল্ড রেকর্ড হোল্ডার ওয়াকার তীর্থ কুমার ফনী তিনি তার জীবনীতে লিখছেন , ‘তাঁর যত সব শক্তি ও অনুপ্রেরণা লালগোলার কালী মা এর কাছে এসে।‘  মাতৃমূর্তি দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে ময়দানে নেমেছেন। সুপ্রিম কোর্ট এর প্রাক্তন বিচারপতি লালগোলার সন্তান শ্রী গুনেন্দ্র নারায়ন রায় তিনি তার চেয়ার এ বসার আগে লালগোলা র মা এর ছবিতে প্রনাম করে বলতেন তার দ্বারা যেন কোনো ভুল না হয়। শ্রী রনেন্দ্র নারায়ন রায় লালগোলার   বাসিন্দা ছিলেন। তিনি এলাহাবাদ হাই কোর্ট এর বিচারপতি নিযুক্ত হন। কুখ্যাত মাফিয়াদের রায় এর দুদিন আগে তিনি লালগোলা কালী বাড়িতে এসে শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন এটা তিনি প্রায় লালগোলার অনেক মানুষকেই বলেছিলেন। এই কালী বাড়ির ইতিহাস ও ঐতিহ্য কল্পনাতীত।
খড়শার শিবমন্দির
কান্দি শহর থেকে প্রায় এক মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম খড়শা। এই গ্রামের বাইরে রয়েছে একটি বিশাল শিবমন্দির। প্রায় আড়াইশো বছর আগে, ফতেসিংহের রাজবংশীয় ভীমরায় (রাজা জয়রামের ভাই) এবং তাঁর পুত্র সন্তোষ রায়, যথাক্রমে ১২ লক্ষ ও ২৪ লক্ষ বার শিব পূজা করেছিলেন। তাঁরা অনেক জায়গায় শিবমন্দির নির্মাণ করেছিলেন, যার মধ্যে এই খড়শার মন্দির অন্যতম।
এই শিবমন্দিরের পূজার জন্য পর্যাপ্ত জমিও দান করা হয়েছিল। বর্তমানে, খড়শার একজন ব্রাহ্মণ পূজা পরিচালনা করেন এবং সেই আয় থেকেই জীবিকা নির্বাহ করেন। জেমো রাজবংশ এখনও এই মন্দিরের সেবার দায়িত্বে আছেন।
গদাইপুরের ভগবতী মন্দির (পেটকাটি মা)
গদাইপুর একটি প্রাচীন গ্রাম, যা জঙ্গীপুর শহর থেকে প্রায় ২ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। বর্তমানে গ্রামটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত, মাত্র ৩০-৪০টি পরিবার বাস করে। এখানকার ভগবতী দেবী, যাঁকে সাধারণত “পেটকাটি মা” বলে ডাকা হয়, তাঁর অসাধারণ অলৌকিক ক্ষমতার জন্য দেশ-বিদেশে পরিচিত।
এখানকার মানুষের বিশ্বাস, যদি কোনো পাগল এই মন্দিরে আশ্রয় নেয়, তাহলে মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যে সে সুস্থ হয়ে ওঠে।
পেটকাটি মায়ের অলৌকিক কাহিনি:-
প্রায় একশো বছর আগে, দেবীর মন্দিরে এক মোহান্তের (মঠাধ্যক্ষ) ৮ বছরের সজ্জিতা কন্যা সন্ধিপূজায় যোগ দিতে আসে। পূজার শেষে, কন্যাটি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যখন মেয়েটির কোনো সন্ধান মেলে না, তখন মোহান্ত দেবীর কাছে প্রার্থনা করে চিৎকার করে ওঠেন। তখন হঠাৎ দেবীর মুখ থেকে ধ্বনি ভেসে আসে—“বালিকা আমার পেটে”।
দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখা যায় কাপড়ের একটি অংশ বেরিয়ে আছে। সেটা টেনে টেনে পুরো কাপড় বের করার পর, দেবীর পেট কেটে দেখা যায়, সেই বালিকাটি ভিতরে চুপ করে বসে আছে। কিছু সময় পর সে সুস্থ হয়ে ওঠে এবং খেলাধুলা শুরু করে দেয়। এরপর থেকেই দেবীর নাম “পেটকাটি মা” নামে প্রসিদ্ধ হয়।
পুজো ও চিকিৎসা পদ্ধতি
 ঠাকুর দ্বিজপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি সেই মোহান্তের বংশধর, মন্দিরের পূজার দায়িত্বে ছিলেন । এখানে পাগলদের চিকিৎসা বিশেষ নিয়মে হয়। মোহান্তের চিকিৎসায় পাগল সেরে যায়,এখানে একটি নাতিদীর্ঘ জলাশয় রয়েছে যা সাধারণের ব্যবহার্য নয়। রোগীদের এখানো স্নান করানো হয়। চিকিৎসার অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
মন্দির নির্মাণ ও পূজার আয়োজন:-
প্রতি বছর নবমীতে এত বেশি পূজার সামগ্রী আসে যে, সেবায়েত পরিবার সারা বছর তা বিক্রি করে সংসার চালান। প্রায় ২৫০-৩০০ জন মানুষ নিয়মিত চাঁদা দিয়ে সাহায্য করেন।
লালগোলার মহারাজ রাও যোগীন্দ্রনারায়ণ রায় বাহাদুর প্রায় ৫ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি সুন্দর মন্দির নির্মাণ করে দেন এই ‘পেটকাটি মা’র জন্য, যা আজও এলাকার মানুষের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের প্রতীক।
বড়োঞা থানার ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে চৈৎপুর গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিমে গাঁফিলা নামে একটি গ্রাম আছে। এখানে অনেকদিন ধরে চ্যাপ্টা আকারের একটি প্রাচীন শিবলিঙ্গ বিরাজ করছেন, যিনি গাঁফিলেশ্বর নামে পরিচিত।
এই শিবমন্দিরের মাটি বহুদিন ধরে এই অঞ্চলে ফোড়ার উপশমের ওষুধ হিসেবে ভক্তিভরে ব্যবহার হয়ে আসছে। আমরা নিজের চোখে দেখেছি, এই মাটির আশ্চর্য গুণ। শরীরে কোনো ফোড়া উঠলে শুরুতেই এই মাটি লাগালে ব্যথা কমে যায়। যদি একটু পরে লাগানো হয়, তবুও ফোড়া পাকিয়ে ফেটে যায়—সার্জারির দরকার পড়ে না। এই কারণেই গাঁফিলেশ্বর শিবের খুব খ্যাতি আছে। দুঃখজনকভাবে, এখনও তাঁর কোনো পাকাপোক্ত মন্দির নির্মিত হয়নি। একটি খড়ের ঘরেই তিনি বিরাজ করছেন।
জঙ্গলেশ্বর:-
বনওয়ারিয়াবাদ গ্রামের এক মাইল উত্তরে জঙ্গলেশ্বর শিব প্রতিষ্ঠিত আছেন। তিনি বনওয়ারিয়াবাদের (সোনারুন্দীর) রাজবংশের প্রতিষ্ঠিত দেবতা। অনুমান করা হয়, ১৮২৮ থেকে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই মন্দির নির্মাণ হয়েছিল।
গোবিন্দজী (জিয়াগঞ্জ-বালুচর):-
জিয়াগঞ্জ-বালুচরের অন্যতম দর্শনীয় বিগ্রহ গোবিন্দজী। এই বিগ্রহ কখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা জানা যায় না। তাঁর দুটি আবাস—একটি বেগমগঞ্জের কাছে, যাকে ‘বড় বাড়ি’ বলা হয়, এবং অন্যটি বাজারের কাছে, যাকে ‘ছোট বাড়ি’ বলা হয়।
বড় বাড়ির গোবিন্দজীর বর্তমান সেবায়েত হচ্ছেন শ্রীযুক্ত সচ্চিদানন্দ গোস্বামী, আর ছোট বাড়ির সেবায়েত হচ্ছেন শ্রীযুক্ত জগদানন্দ গোস্বামী। এখানে মাসে মাসে পালাক্রমে বিগ্রহ পূজা হয়। এই বিগ্রহের নির্মাণ বহু পুরনো, এবং বলা হয় তা বৃন্দাবনে তৈরি হয়েছিল।
বৈশাখ মাসের একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত এখানে বিশাল “ফুলদোল” উৎসব হয়, যাতে বহু ভক্ত ও বৈষ্ণব অংশ নেন। বড় বাড়িটি শ্রীমৎ নরোত্তম ঠাকুরের প্রিয় শিষ্যদের স্থাপনা, এবং ছোট বাড়িটি গদাধর প্রভুর শিষ্যদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। পূর্বে এই বাড়ির লোকেরাই খেতুর-ধামে “সোনার গৌরাঙ্গ” দেবের সেবা করতেন। এসব কারণে এই দুই জায়গা বৈষ্ণবদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র তীর্থ হিসেবে গণ্য হয়।
গোবিন্দ গোপীনাথজী (চৌরীগাছা, সাটুই):-
ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে সাটুই গ্রামের উত্তরে অবস্থিত চৌরীগাছা এক প্রাচীন গ্রাম, যা ইস্টার্ন ইন্ডিয়া রেলওয়ের চৌরীগাছা স্টেশনের কাছে। এখানে বহু বছর ধরে গোবিন্দ-গোপীনাথজীর সুন্দর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত আছে এবং তাঁদের নিয়মিত সেবা-আর্চনা চলে।
প্রায় ৮০০ বছর আগে, স্বর্গীয় ধ্রুব গোস্বামী এই বিগ্রহ দুটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে এই বিগ্রহ গঙ্গার ধারে ছিল, কিন্তু প্রায় ২০০ বছর আগে সেই স্থান গঙ্গার গর্ভে চলে গেলে গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে বাগচী পরিবারের নির্মিত মন্দিরে বিগ্রহ স্থানান্তর করা হয়।
মন্দির, নাটমন্দির, বৈঠকখানা, গোশালা ইত্যাদি এখন ভগ্নপ্রায়। ধ্রুব গোস্বামী তাঁর জীবদ্দশায় বিগ্রহের জন্য জমিদারি রেখে গিয়েছিলেন। পরে এই জমিদারি নাটোর রাজপরিবারের কাছে বন্ধক রাখা হয়। তখন নাটোর থেকে মন্দিরের ব্যয়ভার চালানো হতো। পরে বর্ধমানের মধুসূদন দাস জমিদারিটি নিজের হাতে নেন। এখন তাঁর শিষ্য মদনমোহন দাস এই দায়িত্ব পালন করছেন। জমিদারিটির বার্ষিক আয় দেড় হাজার টাকার মতো। বর্তমানে লোহাগঞ্জ থেকে কিছু টাকা চৌরীগাছার বিগ্রহসেবার জন্য পাঠানো হয়।
গোবিন্দজীর বিগ্রহ পাথরের তৈরি, আর গোপীনাথজীর বিগ্রহ কাঠের। প্রতিবছর মাঘ মাসের শুরুতে গোপীনাথদেবের উপলক্ষে একটি বড় মেলা হয়, যেখানে দশ হাজারেরও বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করে।
জয় মঙ্গলা দেবী:-
কান্দীর নিকটবর্তী নবদুর্গা-গোলাহাট গ্রামে জয়মঙ্গলা দেবী বিরাজিতা। ধারণা করা হয়, এই দেবীর মূর্তি খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দী বা তারও আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। গোলাহাট একসময় একটি বিশাল নগরী এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল, যা কিংবদন্তি বণিক চাঁদসদাগরের ব্যবসার স্থান ছিল বলে প্রচলিত। স্থানীয় লোককথা অনুসারে, তার বাণিজ্যপোত সেসময় পাটন বিলের উপর দিয়ে যাতায়াত করত।
একটি জনপ্রিয় প্রবাদ বাক্য হল, “নবদুর্গা গোলাহাট বামেতে রাখিয়া। চলিল সাধুর ডিঙ্গা পাটন বহিয়া।” এই প্রবাদ এই ঐতিহাসিক যোগসূত্রকে আরও সুদৃঢ় করে।
জয়াদেবী ও চাঁদসদাগরের উপকথা:-
মনসাদেবীর সঙ্গে বিবাদ করে জয়াদেবীর পূজা শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়। পঞ্চাননের প্রাচীন রচনায় জয়াদেবী ও গোলাহাট সম্পর্কে এরকম লেখা আছে:
“গোলাহাট ডিহিগঞ্জ সুরম্য নগরী।
যাহা চাঁদসদাগরের ব্যবসানগরী।
জয়াদেবী নামে এক দেৰী আরাধয়া
 মনসা দেবীর সহ বিবাদ করয়া
তিন্তিড়ী বৃক্ষের মূলে দেবীর দেউল।
 বহু বণিক্ পুজে দেবীকে মানে বণিককুল।।
সেই চাঁদসদাগর রাজার সমীপে।
 দেবীপূজা লাগি ভূমি মাঙ্গে ভূপে৷।
 একশত ষাটী বিঘা দেবীর কারণ।
ভূসম্পত্তি মহারাজ করিলেন দান।।
সে ভূমির কর না লইবেন আপনি।
ডিহির অন্তর্গত বিংশতি গ্রাম গণি।।
নবদুর্গা রাঙ্গাবালী করলা যসুরী।
চৌকী কাটনাদী উহানি ভিতরি।।”
রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং স্থায়ী উত্তরাধিকার:-
মহারাজ আদিত্যশূর জয়াদেবীর জন্য চাঁদসদাগরকে কেবল এই করমুক্ত গ্রামগুলিই দান করেননি, তিনি তাঁর মন্ত্রী এবং উত্তর-রাঢ়ীয় কায়স্থ সিংহবংশের আদিপুরুষ অনাদিবর সিংহকে সামন্ত-রাজ-পদে অভিষিক্ত করার সময় এই করমুক্তির বিষয়টি বজায় রাখার নির্দেশও দিয়েছিলেন। তিনি দেবীকে উৎসর্গীকৃত যেকোনো জমি থেকে কর আদায় কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন।
মন্দির এবং এর রহস্য
পাথরের তৈরি মন্দিরের ভিতরে একটি চতুর্ভুজা ভগবতী মূর্তি স্থাপন করা আছে। গ্রামবাসীরা প্রায়শই বলে থাকেন যে, রাতের বেলায় মন্দিরের ভিতরে বিভিন্ন রঙের আলো জ্বলতে দেখা যায়, যা অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছেন বলে দাবি করেন। দেবীর জন্য এখনও প্রতিদিনের পূজা ও ভোগ নিবেদন করা হয়। স্থানীয় অধিকারী বংশধররা মন্দিরটির সংস্কার করেছেন।
মন্দিরের কাছে যে প্রাচীন তেঁতুল গাছটি এখনও বিদ্যমান রয়েছে, সেটিকে চাঁদসদাগরের সমসাময়িক বলে মনে করা হয়। এবং কাছাকাছি “ছাগলে ডাঙ্গা” নামক একটি স্থানও বণিকদের স্মৃতি বহন করে। সেখানে এখনও কিছু ভাঙা ইটের স্তূপ দেখা যায়। স্থানীয় ঐতিহ্য অনুসারে, এই দেবী ও মন্দিরটি ধনপতি সদাগরের মাতা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এবং “ধনডাঙ্গা” ধনপতির স্মৃতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
জ্বালামুখী-কালী মন্দির:-
পাঁচথুপী গ্রামের উত্তর-পশ্চিমে প্রায় দুই মাইল দূরে সাবলপুর গ্রামে এই জ্বালামুখী কালীর মন্দির অবস্থিত। এটি ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দে বা তারও আগে হাড়িরাজা বা ফতেসিংহের দ্বারা অথবা তাঁর পূর্বের সামন্ত রাজা দ্বারা  প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করা হয়।
ফতেপুর গ্রাম ফতেসিংহের রাজধানী ও সাবলপুরে তাঁর দেবালয় এবং ময়ূরাক্ষীর পরপারের গ্রামে তাঁর হস্তীশালা ছিল, এইরূপ জনপ্রবাদ আছে।
ফতেসিংহ বা ফতেহাড়ী একজন দস্যুদলপতি ছিলেন এবং তার অধীনস্থ দস্যুরা ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে এই মন্দিরে দেবীর আরাধনা করত।  দেবীর প্রস্তরময়ী মূর্তির উপরের অংশ গোলাকার এবং এর কাছে একটি সপ্তাশ্ববাহন সূর্য-মূর্তি রয়েছে।
ডুমনী তলা এবং মা ডুম্নী:-
ডুন্নীতলা আশ্রম এবং মা ডুম্বীর উপাখ্যান প্রায় দুই সহস্র বছরের পুরনো। তখন গঙ্গা ন-পুকুরের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতো এবং উভয় তীর গভীর জঙ্গলে ঢাকা ছিল। এক জমিদারপুত্র তার নববিবাহিত পত্নীসহ নৌকাযোগে এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় দুর্যোগের কবলে পড়েন। দুর্যোগ পাঁচ সাতদিন স্থায়ী হওয়ার ফলে সেখানেই নোঙর ফেলতে বাধ্য হয় তারা। নৌকায় তাদের রান্নার সমস্ত উপকরণ ছিল কিন্তু কাঠের অভাবে যখন রান্নার ব্যবস্থা করা যাচ্ছিল না, দু-তিন দিন পর যখন প্রচন্ড ক্ষুধায় তারা অস্থির হয়ে পড়ল, তখন নববধূ তাঁর স্বামীকে বললেন যে কাঁচা বাঁশ যদি সংগ্রহ করতে পারেন তাহলে আমি রান্নার ব্যবস্থা করতে পারি। কাঁচা বাঁশ আনা হলে নববধূ  নিজ কটিদেশ থেকে ছুরি বের করে তা দিয়ে বাঁশকে খন্ড করে দ্রুত পাতলা চটা বের করে তা দিয়ে আগুন ধরিয়ে রান্না করেন। এই অলৌকিক কাজ দেখে জমিদারপুত্র তাকে ডোম-কন্যা সন্দেহ করে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে চলে যান। এরপর নববধূ ভয়ে, দুঃখে, শোকে ও অপমানে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন এবং তার দেহ ক্রমশ পাথর হতে শুরু করে। সেই রাতেই তিনি দেবত্ব প্রাপ্ত হয়ে এক ডোম-কন্যাকে স্বপ্নযোগে নিজের সমস্ত বৃত্তান্ত জানান এবং পরদিন থেকে তাকে “ডোমনী” দেবতা রূপে পূজা করার আদেশ দেন। সেই থেকে এই দেবীর নাম “ডোমনী” এবং বর্তমানে সাধারণ মানুষ তাকে “ডুম্নী” বলে জানে।
বেলডাঙ্গা থানার ন-পুকুর গ্রামের ডুমনীতলা আশ্রমের সঠিক প্রাচীনত্ব নির্ণয় করা যায়নি, তবে এখানকার প্রস্তর মূর্তিগুলি বৌদ্ধ-ভাস্কর্য বলে মনে হয়। এককালে এখানে সমৃদ্ধ হিন্দু জনপদ ছিল এবং ডুমনী দহ বিলে একসময় গঙ্গার প্রবাহ ছিল। সময়ের সাথে সাথে জনপদ বিলুপ্ত হয়েছে এবং গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে ডুমনীদহ বিল তৈরি হয়েছে।
এই স্থানের প্রাকৃতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলেও হিন্দু সমাজে এই দেবালয়ের মহিমা আজও অক্ষুণ্ণ আছে। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি ছাড়াও ৫-৬টি জেলা থেকে প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে বহু নারী-পুরুষ দেবীর পূজার জন্য আসেন। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, মৃতবৎসা মায়েরা এই দেবীর কাছে মানত করলে জীবিত সন্তানের মা হন। এছাড়া বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে বিশেষ কিছু উপলক্ষে হাজার হাজার মহিলা দেবীর পূজা শেষে প্রসাদ গ্রহণ করতে আসেন।
দয়াময়ী কালী:-
বহরমপুর সৈদাবাদের দয়াময়ী কালীমন্দির ১৭৫২ খ্রীষ্টাব্দে স্বর্গীয় কৃষ্ণেন্দ্র হোতা নামক একজন শক্তি-সাধক বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি কাসিমবাজারের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠির গোমস্তা ছিলেন এবং পলাশীর যুদ্ধের সময়েও জীবিত ছিলেন। তিনি সৈদাবাদের দয়াময়ীর বাড়িতে দ্বাদশ শিব, দ্বাদশ যোড়-বাংল এবং বিষ্ণু মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দুটি পঞ্চমুখ শিব, দুটি পার্থিব প্রস্তর শিব এবং একটি সুবৃহৎ মন্দিরে একটি পার্থিব প্রস্তর শিবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। দয়াময়ী এবং কৃষ্ণেন্দ্র হোতা মহাশয় সম্পর্কে বহরমপুর সৈদাবাদ অঞ্চলে বহু জনশ্রুতি প্রচলিত আছে।(৩য় অধ্যায় ‘জয়পুর’ দ্রষ্টব্য)।
দক্ষিণা কালী:-
কান্দী কোর্ট থেকে রশোড়া যাওয়ার পথের পাশে এবং কান্দীর দক্ষিণ অংশে ও দোহালিয়া গ্রামের পূর্বে এই কালীতলা অবস্থিত। এই দেবস্থানের প্রাকৃতিক দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম। দূর থেকে দক্ষিণা-কালীতলাকে তপবনের মতো মনে হয়। এই কালীবাড়ির কাছেই একটি সুন্দর ও সুবৃহৎ জলাশয় রয়েছে যার জল নির্মল, সুপেয় এবং স্বাস্থ্যপ্রদ। জনকোলাহলের বাইরে উন্মুক্ত প্রান্তরে অবস্থিত হওয়ায় সকাল ও সন্ধ্যায় কান্দীর বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, কান্দীর ছোট-বড় রাজকর্মচারী এবং সাধারণ মানুষ দলবদ্ধভাবে ভ্রমণ ও সময় কাটানোর জন্য এই দক্ষিণা-কালী মন্দিরে যেতেন। এই কালীর অঞ্জন চক্ষুর পীড়া আরোগ্য করার অলৌকিক শক্তির জন্য দীর্ঘকাল ধরে পরিচিত। মন্দির প্রাঙ্গণের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তিনটি করে ছয়টি শিব মন্দির রয়েছে, প্রতিটিতে একটি করে মহাদেবের লিঙ্গমূর্তি প্রতিষ্ঠিত।
দেবীর প্রতিষ্ঠার কথা:-
এই দক্ষিণা-কালীর আবির্ভাব সম্পর্কে এই অঞ্চলে দুটি প্রধান জনশ্রুতি রয়েছে:
১. বহু প্রাচীনকালে, বর্তমান কালীবাড়ির সংলগ্ন একটি জঙ্গলে মাটির নিচে এই কালী মূর্তি প্রোথিত ছিল। দুগ্ধবতী গাভীগণ প্রতিদিন চারণের সময় সেই জঙ্গলে প্রবেশ করে দেবীর বাসস্থানের উপর অজস্র ধারায় দুধ বর্ষণ করত। একদিন দোহালিয়ার একজন সদগোপ এই ঘটনা বারবার প্রত্যক্ষ করে সেই স্থানের মাটি খনন করে এই কালী মূর্তি আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে এর প্রতিষ্ঠা ও মন্দিরাদি নির্মিত হয়।
২. উত্তর-রাঢ়ীয় কায়স্থদের সিংহবংশীয়দের কারিকা থেকে জানা যায় যে, কান্দী রাজবংশের পূর্বপুরুষ করাতিয়া ব্যাসসিংহের পুত্র বনমালী সিংহ (যিনি বন কেটে কান্দী গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে “বনকাটি বনমালী সিংহ” নামে পরিচিত ছিলেন) এই দক্ষিণা-কালী প্রতিষ্ঠা করেন। কান্দী ছাড়াও জেমো বাঘডাঙ্গাও বনমালীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বলে কারিকায় উল্লেখ আছে।
 কুল-পঞ্জিকায় লেখা আছে যে,
“বনমালী সিংহকে রাজা বহু ভূমি দিল।
বন কাটিয়া তিহ কান্দী গ্রাম বসাইল।।
 বহু গ্রাম প্রকাশিয়া প্রজা বসাইল।
দোহালিয়া বেত্রারণ্যে দক্ষিণাকালী স্বপ্ন দিল।।
স্বপ্ন দেখি বেত্র কাটী মাটীর ভিতর।
পাইল দক্ষিণাকালী প্রতিষ্ঠা তৎপর।।
 মন্দির করিয়া রাজসেবা বসাইল।
ব্রাহ্মণ দেবল দ্বিজ তথি বসাইল।।
বহু ভূমি দান করি সেবা বসাইল।
 নানা পরিচর্য্যা সেবার করিল।।
নিত্য দশসের চাউলের ভোগ স্থাপন।
ব্রাহ্মণ দেবল করেন প্রসাদ ভোজন।।”
এটি থেকেই বোঝা যায় যে, কান্দীর রাজবংশের পূর্বপুরুষ বনমালী সিংহ স্বপ্নাদেশ পেয়ে দোহালিয়ার বেত্রারণ্য থেকে এই দক্ষিণা-কালীকে উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা করেন। ১০৬১ শকাব্দ বা ১১৩৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১১৬২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বল্লালসেনের রাজত্বকালে এবং পরবর্তীতে ব্যাসসিংহ (বনমালীর পিতা) বর্তমান ছিলেন। মহারাজ লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকালে তার সভায় প্রসিদ্ধ কবি ও গীতগোবিন্দ রচয়িতা জয়দেব গোস্বামীর সাথে বনমালী সিংহ উপস্থিত ছিলেন, যার প্রমাণ কুলপঞ্জিকায় পাওয়া যায়। বনমালী সিংহ একজন পরম বৈষ্ণব ছিলেন বলেও জানা যায়-
রাজা বনমালী পরম বৈষ্ণব হয়।
 কান্দীতে রাজধানী করি শিববিষ্ণু অতিথি সেবয়।।
মধ্যে মধ্যে যান সিংহরাজ সিংহেশ্বরে।
 ডিহি জৈনপুরী কিরীটেশ্বরী গোকর্ণপুরে।।
কখন ষাটুই কাঁঠালিয়া কণ্টকনগর।
 সর্ব্বত্রে কাছারীবাটী আছয়ে প্রচুর।।
 কভু যান নবদ্বীপে মহারাজার গোচর।
জয়দেব মহাভক্ত সঙ্গী ভূপেশ্বর।।
 সৎসঙ্গ করয়ে সিংহ থাকি নিরন্তর।
অতিশয় দয়া করেন লক্ষ্মণ নরেশ্বর।।
প্রথমে বৈষ্ণব হলেও, দক্ষিণা-কালীর উদ্ধার ও প্রতিষ্ঠার পর তিনি শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন। বিখ্যাত সেনবংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেন বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে ১২০০ খ্রীষ্টাব্দে নবদ্বীপ থেকে পালিয়ে যান। তখন তিনি আশি বছর বয়সী বৃদ্ধ ছিলেন। এটি থেকে অনুমান করা যায় যে, দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে অর্থাৎ অনুমান ১১৬১ খ্রীষ্টাব্দের পর এবং ১২০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে দোহালিয়ার দক্ষিণা-কালীর প্রতিষ্ঠা হয়। অর্থাৎ, প্রায় ৯০০ বছর আগে এই দেবী দোহালিয়ায় আবির্ভূত হয়েছেন। বর্তমানে ফতেসিংহের জমিদারগণ এই দক্ষিণা-কালীর সেবায়েত। তারা দেবীর মন্দিরাদি পুনর্নির্মাণ করে ভোগ ও সেবার সুব্যবস্থা করেছেন। অনেক সাধু সন্ন্যাসী এবং শক্তি-সাধক মাঝে মাঝে এখানে আসেন এবং প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে বহু যাত্রী পূজা দেন।
দুলাল কালী:-
জঙ্গীপুরের ৬ মাইল উত্তরে একটি বৃক্ষমূল দুলাল কালী নামে পরিচিত। দেবীর কোন মূর্তি নেই। ঐ বৃক্ষমূল এবং সংলগ্ন স্থানই সাধারণ মানুষের কাছে দুলাল কালী নামে পরিচিত।
ঐ স্থানের জমিদারগণের নিযুক্ত একজন সেবায়েত ব্রাহ্মণ দ্বারা প্রতিদিন এই দুলাল কালীর পূজা হত।এখনও প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে এই দেবস্থানে বলিদানের ব্যবস্থা আছে। ঐ অঞ্চলের অধিবাসীরা বলে যে, দুলাল কালীর মানত করলে বন্ধ্যা মহিলারা সন্তান লাভ করতে পারে এবং সন্তান হলে তার নাম “দুলাল কালী” রাখতে হয়। দুলাল কালীর অধিষ্ঠানের স্থানটি জঙ্গীপুরের প্রাচীন ক্ষত্রিয় জমিদার স্বর্গীয় মনোমোহন সিংহের বংশধরদের জমিদারীর অন্তর্গত। ঐ জমিদাররাই এই দেবীর জন্য সেবায়েত ব্রাহ্মণ নিযুক্ত করেছেন।
নরসিংহদেব:-
কান্দী থেকে বহরমপুর যাওয়ার পথের উপর গোকর্ণ নামক একটি বড় গ্রাম অবস্থিত। এই স্থানে নরসিংহদেব এবং গোকর্ণেশ্বর নামক একটি মহাদেব আছেন। খ্রীষ্টীয় নবম শতাব্দীতে রাঢ়দেশের হিন্দু রাজা আদিত্যশূরের রাজত্বকালেও এই দুটি দেবতার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। পূর্বে নরসিংহদেবের সেবার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল এবং সে সময় সপ্ত যোজন দীর্ঘ সুবিস্তৃত জনপদ গোকর্ণ রাজার অধীনে ছিল। ২০ খণ্ডে ডিহি এবং ২০ ডিহিতে এক মণ্ডল – এভাবে সপ্ত মণ্ডল গোকর্ণ নৃপতির রাজ্য ছিল। মহারাজ আদিত্যশূর এই সাতটি মণ্ডলের মধ্যে একটি মণ্ডল, অযোধ্যাগত কায়স্থ সামন্তরাজ রাণা অনাদিবর সিংহকে দুই হাজার মুদ্রা রাজস্বে বন্দোবস্ত করে তাকে সম্মানিত করেছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লিখিত আছে।
পূর্বে এই নরসিংহদেবের প্রচুর রাজদত্ত দেবোত্তর সম্পত্তি ছিল। আজও গোকর্ণ গ্রামে সেই প্রাচীন দেবতা নরসিংহদেব একটি প্রাচীন মন্দিরের মধ্যে বিরাজমান।
 নব রত্ন শিবমন্দির:-
কান্দী মহকুমার পাঁচথুপী গ্রামের উত্তর-রাঢ়ীয় কায়স্থকুলোদ্ভব দেবভক্ত স্বর্গীয় জমিদার জগন্নাথপ্রসাদ ঘোষহাজরা মহাশয়ের প্রতিষ্ঠিত নবরত্ন শিবমন্দির এদেশের একটি উজ্জ্বল ও প্রাচীন কীর্তি। এই শিবালয়ের মধ্যস্থলে একটি প্রায় ৪২ ফুট উচ্চ মন্দিরের ভেতরে চার কোণে চারটি সাদা পাথরের এবং মাঝখানে একটি বিশাল কালো পাথরের মহাদেবের লিঙ্গমূর্তি বিরাজমান। এই মন্দিরের বাইরে, চার কোণে চারটি অপেক্ষাকৃত ছোট মন্দিরে একটি করে লিঙ্গমূর্তি রয়েছে। মোট নয়টি মহাদেব এই শিবালয়ে বিরাজিত থাকায় এটি নবরত্ন-শিবালয় নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। প্রায় দুই শত বছর ধরে এই নবরত্ন-শিবালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ অঞ্চলের মধ্যে জয়যানের সোমেশ্বরের মন্দির ও পাঁচথুপীর নবরত্ন মন্দিরই সবচেয়ে উঁচু শিবমন্দির। জগন্নাথপ্রসাদের আরও অনেক সৎকীর্তি এখানে রয়েছে।
বণ্যেশ্বর শিব:-
জঙ্গীপুর উপ-বিভাগের মধ্যে জঙ্গীপুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ১০ মাইল দূরে বণ্যেশ্বর গ্রাম অবস্থিত। এই গ্রামে বাণ্যেশ্বর নামে মহাদেবের একটি প্রসিদ্ধ লিঙ্গমূর্তি বিরাজমান। এই মহাদেব বহু পুরনো প্রতিষ্ঠিত। জনশ্রুতি আছে যে, বৈদ্যনাথের প্রতিষ্ঠার সময় এই বণ্যেশ্বর শিবেরও প্রতিষ্ঠা হয়। এখানে প্রতি বছর শিবরাত্রির সময় প্রায় দশ হাজার লোকের সমাগম হয়ে থাকে।
বালুচরের দুর্গামন্দির:-
প্রায় তিন শত বছর আগে বালুচরে লোকনাথ রায় নামক একজন গৃহস্থ ব্রাহ্মণ একটি পাঠশালার গুরুমশাইয়ের কাজ করতেন। তিনি সেখানে সাধারণের সাহায্য ও সহানুভূতির উপর নির্ভর করে শারদীয়া পূজা শুরু করেন। তখন থেকে এই পাঠশালায় (অথবা লোকনাথ রায়ের বাংলা নামে পরিচিত চণ্ডীমণ্ডপে) দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ১৯০৯ বঙ্গাব্দে (১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ) বর্তমান ইঁটের তৈরি মন্দির নির্মিত হয়। প্রথমে তারাচরণ স্বর্ণকার, তারপর শ্রী মণিমোহন ঘোষ বি.এ, বি.এল প্রমুখ স্থানীয় একদল যুবকের চেষ্টা ও উদ্যোগে সাধারণের, বিশেষত লালগোলার বদান্যবর মহারাজ রাও যোগীন্দ্রনারায়ণ রায় বাহাদুরের দেওয়া ৬০০ টাকা আর্থিক সাহায্যে মন্দিরের অন্যান্য গৃহ নির্মিত হয়। ‘প্রতিভা থিয়েটার’ নামক নাট্য-সমাজের কর্তৃপক্ষ দ্বারা ‘প্রতিভা তোরণ’ নামক মন্দিরের সদর দরজা নির্মিত হয়। মন্দিরের নাট্য-মন্দিরের সমস্ত ব্যয় নেহালিয়ার সুপ্রসিদ্ধ জমিদার রায় শ্রী সুরেন্দ্রনারায়ণ সিংহ বাহাদুরের পরিবারের কোনো এক ধর্মপরায়ণা মহিলা কর্তৃক প্রদত্ত হয়েছে।
বালুচরের অষ্টভুজা দুর্গা মূর্তি:-
মহারাজ বাহাদুর সিংহের বাড়ির উত্তরে কালীবাড়ী নামক স্থানে এই দেবী বিরাজিতা। এই পাথরের অষ্টভুজা কালীমূর্তির প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে স্থানীয় জনশ্রুতি এরকম:
অনেক অতীতের এক অজ্ঞাত পশ্চিম দেশীয় ধনী মহাজন নৌকায় ভাগীরথীর উত্তরাভিমুখে স্রোতের প্রতিকূলে পাল তুলে যাচ্ছিলেন। নৌকা দ্রুতগতিতে ছুটছিল। বালুচরের এক ভদ্রপল্লীর নিচের ঘাটে এসে নৌকার গতি হঠাৎ থেমে গেল। অনেক টানাটানি, ঠেলাঠেলি করেও দাঁড়ী মাঝিরা নৌকাটিকে সেখান থেকে সরাতে পারল না। ঘাটে ৮-১০ হাত গভীর জল ছিল, কিন্তু জলের নিচে কোনো বাধার চিহ্নও পাওয়া গেল না। অগত্যা তাদেরকে বাধ্য হয়ে সেই নৌকাতেই রাত্রিযাপন করতে হলো। রাতে মহাজন দুর্গাদেবীর এই মর্মে স্বপ্নাদেশ পেলেন যে, নৌকার নিচে গঙ্গাগর্ভে অবস্থিত তাঁর পাথরের মূর্তি উদ্ধার করে একটি মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে সেবা-পূজার ব্যবস্থা করলে তাঁর ঘরে যাওয়া সম্ভব হবে। পরদিন সকালে মহাজন পল্লীবাসীদের কাছে গত রাতের স্বপ্নবৃত্তান্ত প্রকাশ করে, তাদের সাহায্যে দেবীমূর্তি সমারোহ সহকারে গঙ্গাগর্ভ থেকে উদ্ধার করেন এবং সাময়িক পূজা-অর্চনার ব্যবস্থা করে সেই নৌকাতেই দেশে চলে গেলেন। সেখান থেকে বালুচরে কর্মচারী পাঠিয়ে দেবীর মন্দির, ভাণ্ডার গৃহ ও অন্যান্য গৃহ নির্মাণ করিয়ে সেবা-পূজার জন্য স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করেন। কালের পরিবর্তনে এখন সেই ভাণ্ডার-ঘরগুলি সবই ধ্বংস হয়ে গেছে এবং দেবীর আয়ের পথও সংকুচিত হয়েছে। এখন কোনোমতে দেবীর সেবা-পূজা নির্বাহ হচ্ছে। গঙ্গার যে ঘাটে দেবী উঠেছিলেন, সেই ঘাটটি আজও ‘কালীঘাট’ নামে পরিচিত।
বড়নগর শিবালয় ও অন্যান্য দেবদেবীর মন্দির:-
আজিমগঞ্জ রেল স্টেশন থেকে এক মাইল উত্তরে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে বড়নগর নামক স্থানে নাটোরের প্রাতঃস্মরণীয়া রানী ভবানী ও তাঁর বংশীয়দের প্রতিষ্ঠিত বহু কীর্তি বিরাজমান। এই বড়নগরের চারদিক দেবমন্দিরে পরিপূর্ণ। বহুসংখ্যক দেবমন্দির প্রতিষ্ঠিত থাকায় বড়নগর “মুর্শিদাবাদের কাশীধাম” নামে পরিচিত। বড়নগর রাজবাড়িতে যে সকল দেবদেবীর মূর্তি ও মন্দির প্রতিষ্ঠিত আছে, নিচে তাদের সংক্ষিপ্ত তালিকা দেওয়া হলো:
১. রানী ভবানীর প্রতিষ্ঠিত ‘ভবানীশ্বর’।
২. ভবানীশ্বর মন্দিরের পশ্চিমে রানী ভবানীর কন্যা তারাসুন্দরীর প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণ পাথর-নির্মিত ‘গোপাল’ এর মন্দির। এই মন্দিরে মহাদেবও আছেন। গোপাল মন্দিরের উত্তরে এক প্রাচীন শুকনো বেলগাছের মূলে সাধক-প্রবর মহারাজ রামকৃষ্ণ রায়ের একটি পঞ্চমুণ্ডির আসন রয়েছে এবং সেখানে একটি বেদীর চিহ্নও আজও দেখা যায়।
৩. গোপাল মন্দিরের দক্ষিণে পিতলের দশভুজা সিংবাহিনী ‘রাজরাজেশ্বরী’ বিরাজিতা। তাঁর বামদিকে ‘জয়দুর্গা’ ও ‘করুণাময়ী’ পিতলের মূর্তিতে বিরাজিতা। এঁরাও দশভুজা।
৪. রাজরাজেশ্বরী ভবনের পূর্ব-দক্ষিণে রাজশাহীর প্রথম জমিদার প্রসিদ্ধ রাজা উদয়নারায়ণের প্রতিষ্ঠিত কাঠের ‘মদনগোপাল’, ‘মহালক্ষ্মী’ ও ‘হয়গ্রীব’ – এই তিন মূর্তি রয়েছে।
৫. মদনগোপালের দক্ষিণ-পূর্ব্বে মনোরম শিল্পকর্ম বিজড়িত ‘চারি বাংলার মন্দিরে’র চারটি মন্দিরের প্রত্যেকটিতে রানী ভবানীর স্থাপিত তিনটি করে মহাদেব আছেন।
৬. বর্তমান বড়নগর রাজধানীর উত্তরে সামান্য দূরে পাথরের ‘অষ্টভুজ গণেশের’ মন্দির। এই গজানন দেবই বড়নগরের গ্রাম্যদেবতা নামে পরিচিত। মন্দিরের বাইরে ‘হলহলি’ ও ‘কল্কলি’ দেবী শোভা পাচ্ছেন। উভয়ই সিন্দুররঞ্জিত পাথরের খণ্ড।
৭. গণেশের মন্দিরের উত্তরে মঠবাড়ী। এই বাড়ি রানী ভবানীর গুরুবংশীয়দের। এখানে যোড়-বাংলায় তিনটি মহাদেব আছেন এবং তাঁরাও রানী ভবানীর স্থাপিত। এই মঠবাড়ীর কাছে রানী ভবানীর মাতার প্রতিষ্ঠিত ‘কস্তুরেশ্বর’ শিব বিদ্যমান।
৮. মঠবাড়ীর উত্তরে ‘দয়াময়ী’র ভবন। পাথরের কালীমূর্তি দয়াময়ী নামে প্রসিদ্ধা।
৯. দয়াময়ীর ভবনের উত্তরে দেওয়ান দয়ারামের প্রতিষ্ঠিত ‘গোপাল’ মূর্তি আছেন।
এইগুলি ছাড়াও অরণ্যময় বড়নগরে বহুসংখ্যক শিবমন্দির দেখা যায়। ‘রাজরাজেশ্বরী’ ও ‘গোপালের’ দৈনিক সেবা-ভোগের সুন্দর বন্দোবস্ত রয়েছে। কেউ সেখানে আহারের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে গেলে তাকে প্রসাদ প্রদানেরও ব্যবস্থা আছে। মুর্শিদাবাদের প্রাচীন দৃশ্যাবলী দেখতে আগ্রহী হিন্দুদের অবশ্যই বড়নগর দর্শন করা উচিত।
ব্যাসপুরের শিব মন্দির:-
কাশিমবাজারের অদূরবর্তী ব্যাসপুর নামক স্থানে এই শিবমন্দিরটি শোভা পাচ্ছে। এটি খ্রিস্টীয় আঠারো শতকের প্রথম ভাগে স্বর্গীয় কৃষ্ণনাথ ন্যায়পঞ্চানন মহাশয়ের পূর্বপুরুষদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। মন্দিরটি সুন্দর কারুকার্য বিজড়িত। এই প্রাচীন মন্দিরের অবস্থা বিশেষ শোচনীয় হওয়ায় লালগোলার দানশীল মহারাজ রাও শ্রী যোগীন্দ্রনারায়ণ রায় বাহাদুর বহু অর্থ ব্যয়ে সুদক্ষ শিল্পীর দ্বারা এর সংস্কার করিয়ে দিয়ে দেবভক্তির পরিচয় প্রদানের সাথে সাথে দেশীয় প্রাচীন স্থাপত্যবিদ্যার গৌরব রক্ষা করেছেন।
বিষ্ণুপুরের কালীমন্দির:-
কাশিমবাজারের এক মাইল দক্ষিণে বিষ্ণুপুর নামক স্থানে এই সুবিখ্যাত কালী মন্দির বিরাজিত। কাশিমবাজারের ইংরেজ-কুঠির গোমস্তা বিখ্যাত শক্তি-সাধক স্বর্গীয় কৃষ্ণেন্দ্র হোতা মহাশয় এই মন্দির এবং কালীমূর্তির প্রতিষ্ঠাতা। একসময় এই দেবমন্দিরের অবস্থা শোচনীয় হওয়ায় কাশিমবাজারের স্বধর্মপরায়ণা স্বর্গীয়া রানী আন্নাকালী দেবী মহোদয়া এর সংস্কার করিয়ে দিয়েছিলেন। পরে পুনরায় লালগোলার দেশবিখ্যাত দানবীর ও দেবভক্ত মহারাজ রাও শ্রী যোগীন্দ্রনারায়ণ রায় বাহাদুর বহু অর্থব্যয়ে এই প্রাচীন জীর্ণ মন্দিরের সংস্কার করিয়ে দিয়েছেন। যে স্থানে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, তারই নিচ দিয়ে পূর্বে কাশিমবাজার নদী প্রবাহিত ছিল। প্রতিটি শনি ও মঙ্গলবার এই কালীমন্দির-প্রাঙ্গণে বহুসংখ্যক ভক্ত নরনারী দেবীর পূজার জন্য সমবেত হয়ে থাকেন। মুণ্ডমালাবিভূষিতা এই চতুর্ভুজা কালীমূর্তিটি অত্যন্ত সুন্দর।
মটুকেশ্বর:-
বরোঞা থানার কাছে পাঁচথুপীর উত্তর-পশ্চিম কোণে প্রায় তিন মাইল দূরে মটুকেশ্বর শিবমন্দির অবস্থিত। এটি ফতেসিংহের অধিপতিদের প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন কীর্তি। এই শিবের নিত্য ও নৈমিত্তিক পূজা ও সেবার জন্য যথেষ্ট ভূ-সম্পত্তি দেবোত্তরস্বরূপ দান করা আছে। প্রবাদ আছে যে, এই শিবের মানত করে কবচ ধারণ করলে মেহ ও স্ত্রীলোকদের জরায়ুর পীড়ার শান্তি হয়। সেই কারণে প্রতি রবিবার বহুসংখ্যক নরনারী মটুকেশ্বর শিবমন্দির-প্রাঙ্গণে এসে থাকে।
যোগেশ্বর শিবমন্দির:-
বরোঞার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত যুগসরা নামক গ্রামে এই মন্দিরটি রয়েছে। এই শিবালয়ে যে কয়টি মন্দির আছে, তাদের মধ্যে যোগেশ্বরের মন্দিরটিই সবচেয়ে উঁচু। যুগসরায় প্রতিষ্ঠিত এই সকল শিবমন্দির খড়গ্রাম থানার অধীন এরোয়ালী গ্রামের জমিদারদের পূর্বপুরুষ স্বনামপ্রসিদ্ধ দেবদ্বিজপরায়ণ স্বর্গীয় রাজা রামজীবনের অন্যতম কীর্তি। এই শিবালয়ের মহাদেবদের নিত্য পূজাদির সুবন্দোবস্ত রয়েছে।
বৃন্দাবনচন্দ্র:-
গোকর্ণ গ্রামের কাছে এবং কান্দী থেকে বহরমপুর যাওয়ার পথের পাশে অবস্থিত গোবরহাটী গ্রাম-নিবাসী উত্তর-রাঢ়ীয় কায়স্থবংশীয় রাধারমণ বা রাধামোহন দাস সরকার মহাশয় অনেক কাল আগে নিজ গ্রামে বৃন্দাবনচন্দ্র বিগ্রহ এবং লক্ষ্মী ও বিশালাক্ষীর পাথরের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উক্ত দেবমন্দিরের দেওয়ালে খোদাই করা লিপি পড়ে জানা যায় যে, ১১৭৪ (১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ) ৪ঠা ফাল্গুন তারিখে এই মন্দিরের নির্মাণকার্য শুরু হয়।
রাধারমণ দাস সরকার বিশেষ কীর্তিমান ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ সরকার এক সময় কলকাতার সুপ্রসিদ্ধ পামার কোম্পানির মুৎসুদ্দি ছিলেন এবং উক্ত কাজে তিনি যথেষ্ট অর্থও অর্জন করেছিলেন। তিনি কলকাতার গরাণহাটা, কম্বুলিয়াটোলা প্রভৃতি স্থানে বহু ভূ-সম্পত্তি কিনেছিলেন। তিনি বহু লোককে অন্নদানের সাথে সাথে আর্থিক সাহায্যও করতেন। প্রেসিডেন্সী কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় কিছু অর্থও তিনি সাহায্য করেছিলেন। তিনি ধর্মপরায়ণ ছিলেন এবং কলকাতার বাসভবনে রাধারমণ জীউ প্রতিষ্ঠা করে যান। ‘চন্দ্রনাথ তীর্থের’ পর্বতগাত্রে তিনি সোপানশ্রেণী নির্মাণ করে দিয়ে উক্ত তীর্থযাত্রীদের যথেষ্ট সুবিধা করে দেন। গোবরহাটী গ্রামেও তাঁর প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি জলাশয় আছে। তাঁর চার পুত্রের মধ্যে কমলাকান্তের পুত্র শিবকৃষ্ণ ও নবকৃষ্ণ পিতার অবর্তমানে বৈদেশিক বণিকদের সাথে যৌথকারবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। যা কিছু সম্পত্তি শেষে অবশিষ্ট ছিল, তাও নবকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ পুত্র মহেন্দ্রের সময়ে নষ্ট হয়ে যায়। রাধারমণের পৌত্র কৃষ্ণকিঙ্কর ক্ষমতাশালী পুরুষ ছিলেন।
একজন রাধামাধব বিগ্রহ:-
মুর্শিদাবাদ নগরীর এক মাইল দক্ষিণে মতি-ঝিলের পূর্ব্বাংশে কোঁয়ারপাড়া বা কুমারপুর নামক স্থানে এই বিগ্রহ বিরাজিত। ১৬০৯ খ্রীষ্টাব্দে সুবিখ্যাত জীব গোস্বামীর বংশধর বংশীবদন গোস্বামী এই বিগ্রহ স্থাপন করেন এবং তাঁর শিষ্যবর্গের হাতে এই বিগ্রহের সেবার ভার অর্পিত হয়। কেউ কেউ অনুমান করেন যে, ষোড়শ শতাব্দীর শেষে বা সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে উক্ত গোস্বামীগণের শিষ্যা, ব্রজধাম-প্রত্যাগত বঙ্গজ-কায়স্থ কুলোদ্ভবা হরিপ্রিয়া ঠাকুরাণীর দ্বারা বিগ্রহের মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতি বছর স্নান-যাত্রার সময় এই কুমারপুরে মেলা বসে থাকে। পূর্বে এই বিগ্রহের সেবায়েত গোস্বামীগণ অপূর্ব ক্ষমতাশালী ছিলেন বলে শোনা যায়। এক সময়ে তাঁদের আশ্চর্য শক্তি প্রত্যক্ষ করে মতি-ঝিলের প্রতিষ্ঠাতা আশ্চর্যান্বিত হন এবং তাঁদের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাবান হয়েছিলেন। এ সম্বন্ধে নিম্নোক্ত গল্প প্রচলিত আছে:
প্রতিদিন রাধামাধবের আরতির শঙ্খ-ঘণ্টার শব্দে বিরক্ত হয়ে একদা মহম্মদ খাঁ পরোক্ষভাবে সেবায়েতগণকে তাড়ানোর কৌশল উদ্ভাবনপূর্বক তাঁর ভৃত্যগণকে উক্ত মন্দিরে খানা প্রেরণের অনুমতি করেন। যথাসময়ে গোস্বামীদের নিকট খানা পৌঁছাল এবং খানার পাত্রের আবরণ খোলা মাত্রেই উক্ত খানা যুঁই ফুলের মাল্যের আকার ধারণ করল। ভৃত্য এই অদ্ভুত ঘটনা নবাবকে বললে, তিনি বিশ্বাস না করে পুনরায় স্বয়ং খানা প্রস্তুত করে প্রেরণ করেন। সেবারেও খানাগুলি যুঁই ফুলের আকারে পরিণত হতে দেখে নওয়াগেস্ মহম্মদ আশ্চর্যান্বিত হন এবং তদবধি গোস্বামীগণকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁদের অনুকূলে অনেক কার্যও করতেন।
রুদ্রদেব:-
কান্দী শহরের মধ্যস্থিত রূপপুর পল্লীর উত্তর-পশ্চিম কোণে রুদ্রদেব-মূর্তি বিরাজিত। রুদ্রদেব ধ্যানী-বুদ্ধমূর্তি। তাঁর মন্দির প্রাঙ্গণের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তিনটি করে মোট ছয়টি শিব-মন্দির রয়েছে। শিবচতুর্দশীর দিন ও চৈত্র মাসের শেষ ভাগে হোম এবং চড়ক সংক্রান্তির সময় রুদ্রদেবের ভবনে বিশেষ সমারোহের সাথে উৎসব হয়ে থাকে।
উত্তর-রাঢ়ীয় কায়স্থ বংশোদ্ভব এবং কান্দী রাজ-বংশীয়গণের পূর্বপুরুষ রুদ্রকান্ত সিংহ এই রুদ্রদেব মূর্তি ও মন্দিরগুলির প্রতিষ্ঠাতা। খ্রীষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ ভাগে রুদ্রকান্ত সিংহ বিদ্যমান ছিলেন।
উত্তর-রাঢ়ীর কায়স্থগণের সিংহবংশীয়দের কারিকা পাঠে জানা যায় যে, রাজা লক্ষ্মীধরের পুত্র রুদ্রকান্ত সিংহের সময়ে কামদেব নামক এক ব্রহ্মচারী তাঁর রাজধানীতে একটি বুদ্ধমূর্তি এবং একটি কালাগ্নিরুদ্র নামে ভৈরবমূর্তি নিয়ে আগমন করেন। রাজা রুদ্রকান্ত সিংহ জেমো-রূপপুরে এক মন্দির নির্মাণ করিয়ে ঐ বুদ্ধমূর্তির প্রতিষ্ঠা করেন এবং উক্ত বুদ্ধমূর্তিটিকে তাঁর নিজ নামানুসারে ‘রুদ্রদেব’ নামে প্রচার করেন।
কালাগ্নিরুদ্র ভৈরবমূর্তিটা কাটোয়ার অদূরবর্তী নৈহাটী গ্রামে অদ্যাপি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।
কায়স্থ-কারিকায় এই রুদ্রদেব সম্বন্ধে যা লিখিত হয়েছে  নিচে তা অবিকল উদ্ধৃত করে দেওয়া হলো:-
“কান্দীশো রুদ্রসিংহোহভূতৎ রুদ্রসেবাপরায়ণঃ।”
“রাজা রুদ্র কান্দীর রাজা রুদ্রসেবা প্রকাশিল।
ভকতি করিয়া নৃপ পূজিতে লাগিল।
রুদ্রদেবের মন্দির শিবের মন্দির।
প্রকাশিয়া নিত্যসেবা বিবিধ প্রকার।
চৈত্র মাসে বাণব্রত মহাপূজা মহোৎসব।
ময়ূরাক্ষীতে যান তথায় হোমাদিক সব।
রাত্রিদিবা রুদ্রদেব রহেন তথায়া
দেশদেশান্তর হইতে লোক দেখিতে আইসয়া
মহাধূম হয় পঞ্চদিন স্থানদ্বয়া
সংক্রান্তিতে নগর ভ্রমণ করায়া
মহাধুমধামে রাজা বাণব্রতাচরে।
দীন দরিদ্রগণেরে বিদায় করে।
সংক্রান্তির দিন নদীর পর পার।
চড়ক পূজা হয় তথি জনতা বিস্তর।
হোম রাত্রে হয় ত খেচুরি ভোগাদি।
এক ডুবে ভক্ত ধরত মৎস্যাদি।
সেই ভোগ পায় রুদ্রানুচর।
পাতার ভক্তগণ তাহার অধিকার।
বিকট বিষম বেশে মরা খেলা করে।
বহু বহু আচরণ সাজ-সজ্জা ধরে।
রাজার আদেশে বিপ্র কায়স্থগণ।
সভে মেলি করে বাণব্রতাচরণ।
সকল জাতিতে ভক্ত হয় সে সময়া
কেহ মৈলে সভে অশৌচ আচরয়।
অনেক সেবাইত তারা নিত্য সেবা করে।
যে যাহা মানস করে সেই ফল ধরে।”
রুদ্র সিংহের পুত্র গণপতি রাজা হয়েছিলেন। রাজা গণপতির মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জীবধর ও প্রভাকরাদির আর্থিক অবস্থা খর্ব হলেও তাঁরা শ্রেষ্ঠকুলীন বলে সমাজে সমাদৃত ছিলেন। “স্বরূপ ফতেসিংহ” নামক হাড়ি রাজা দুই সহস্র সৈন্য ও হাতী সহ সিংহরাজগণের সাথে যুদ্ধ করে, তাঁদের যাবতীয় সম্পত্তি অধিকার করেন। পরে সন্ধিসূত্রে পাঁচটি মাত্র গ্রাম সিংহগণকে দিয়েছিলেন। রাজা মানসিংহ এই বংশের পরিচয় পেয়ে জীবধরকে ‘মণ্ডল’ পদ বা ১০টি বিষয়ের শাসক পদে নিয়োগ করেন।
অতঃপর ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লী থেকে সবিতা রায় (জেমো বাঘডাঙ্গার রাজাদের পূর্বপুরুষ) আগমনপূর্বক মুণ্ডমালার তীরে যুদ্ধ করে হাড়িবংশ ধ্বংস করেন ও তাঁর অধিকৃত ফতেসিংহ পরগনার অধিকারী হন। সবিতা রায় মহাশয় যে সময়ে হাড়িরাজ ফতেসিংহের সাথে যুদ্ধে ব্যাপৃত ছিলেন, তৎকালে রুদ্র সিংহের পৌত্র তারাপতি সিংহ সবিতা রায়কে অনেক সাহায্য করেন। জনশ্রুতি এই যে, তারাপতি এবং সবিতা রায় রুদ্রদেবের মানসা করেই হাড়িরাজকে পরাস্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং যুদ্ধ জয়ের পর মহাসমারোহের সাথে উভয়ে রুদ্রদেবের পূজা করেছিলেন। বর্তমান কাল পর্যন্ত সবিতা রায়ের বংশধরগণই রুদ্রদেবের সেবা পূজাদি পরিচালনা করে আসছেন। উচ্চ বংশের সম্মান স্বরূপ প্রতি বছর চৈত্র-সংক্রান্তির দিনে হোমতলায় রুদ্রদেবের নীল-পূজার সময়, তারাপতি সিংহের বংশধরগণ পুরুষানুক্রমে সর্বপ্রথম পূজা এবং বলিদানের অধিকার লাভ করে আসছেন।
অনেকে রুদ্রদেবের প্রাঙ্গণে রোগশান্তির কামনায় হত্যা দিয়ে থাকে। অনেককে অম্লশূলাদি কঠিন ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ করতে দেখা যায়। ক্ষিপ্ত কুকুর ও শৃগালাদির দংশনে রুদ্রদেবের বাটীর ঔষধ বিশেষ উপকারী বলে বিখ্যাত।
শ্যামসুন্দর দেবের মন্দির :-
পাঁচথুপীর অধিকারী বংশীয় জমিদারগণের পূর্বপুরুষ সিদ্ধ শ্যামাদাস ঠাকুর ১৪৮৪ শকে আবির্ভূত হয়ে আবাল্য বৈরাগ্য ধর্মের আদর্শ অনুসরণপূর্বক সংসারত্যাগী হয়ে তীর্থ পর্যটন করতে থাকেন। পরে পাঁচথুপী গ্রামে আশ্রম স্থাপনপূর্বক শ্রীশ্রীনিবাস প্রভুর নিকট শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর পরলোকগমনের পর তদীয় পুত্র কিশোর দাসই এই শ্যামসুন্দরের প্রতিষ্ঠা করে পৈতৃক সুদর্শন চক্রসহ সেবা প্রকাশ করেন। নবাব আলিবর্দ্দদী খাঁর শাসনকালে বর্গীর হাঙ্গামায় এই বিগ্রহ অপহৃত ও মন্দির ধ্বংস হয়। তৎপরে দারুময় শ্যামসুন্দরের মূর্তি-প্রতিষ্ঠা হয়। বর্তমান মন্দিরটিতে প্রাচীন শিল্প-কলার পরিচয় পাওয়া যায়।
শিশুয়েশ্বর:-
ই. আই. রেলপথের সালার স্টেশনের দুই মাইল উত্তর-পশ্চিমে শিশুয়া নামক ক্ষুদ্র পল্লীতে শিশুয়েশ্বর নামে খ্যাত অনাদিলিঙ্গ শিব প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন। বহুকাল পূর্বে কান্দী মহকুমার ভরতপুর থানার অধীন ঘনশ্যামপুর গ্রামনিবাসী নফরচন্দ্র পাল নামক এক সদেগোপ স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে শিশুয়া গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি জঙ্গলে এই শিবমূর্তি আবিষ্কার করেন।
অনেকে অনুমান করেন যে, শিশুয়েশ্বরের আবির্ভাব-কালে শিশুয়া গ্রামের নিকট দিয়ে ভাগীরথী প্রবাহিত ছিল।
নফর পাল শিশুয়েশ্বরের প্রতিষ্ঠান্তে বর্তমান সেবায়েত বংশীয়গণেরই জনৈক পূর্বপুরুষকে সেবায়েত নিযুক্ত করেন। নফর পাল এক মাটির মন্দির নির্মাণ করে দেন। তারপর ন্যূনাধিক তিনশত বৎসর গত হল, উক্ত সেবায়েতবংশীয় কালিদাস চক্রবর্ত্তী (জটে ঠাকুর) মহাশয়ের চেষ্টায় বর্ধমানের তাৎকালীন মহারাজ বাহাদুর বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন।
মহাবিষুব-সংক্রান্তির পূর্ব দিন এবং শিব-চতুর্দশীর সময় শিবের পূজা ও হোম এবং ছাগ বলি হয়। এখানে এই উভয় পর্বের উপলক্ষে মেলা বসে থাকে।
যে স্থানে শিশুয়েশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, সেই স্থানটি বর্দ্ধমানাধিপতির জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত। এক্ষণে তালিবপুরের জমিদার শ্রীযুক্ত মুন্সী জিল্লার রহমন্ (রাজা মিক্রা) সাহেব দর-পত্তনীদাররূপে ঐ স্থানের অধিকারী। বর্ধমানের মহারাজ বাহাদুর ও কাগ্রামের জমিদারগণের নামে পূজার সময় সংকল্প হয়ে থাকে। উক্ত মহারাজ বাহাদুর শিবের সেবা অক্ষুণ্ণ রাখার নিমিত্ত ৩০-৪০ বিঘা জমি শিশুয়েশ্বরের নামে শিবোত্তর প্রদান করেছেন। সেবায়েতগণ উক্ত ভূ-সম্পত্তি লাখেরাজরূপে দখল করে আসছেন।
মৃতবৎসাদি রোগশান্তির ও অম্ল-শূলাদি ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভের নিমিত্ত অসংখ্য ব্যক্তি শিবের মানসা করে ও হত্যা দিয়ে থাকে। প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে এবং পূর্ণিমার দিন বহু লোক পূজার্থে মন্দিরে উপস্থিত হয়।
শ্যাম, সর্ব্বেশ্বর, বলরাম এবং মদনমোহন:-
জঙ্গীপুর উপ-বিভাগের মধ্যে বাজিতপুর গ্রামে এই চারটি মূর্তি বিরাজ করছেন। মূর্তি চারটি দ্বাদশ বছর বয়স্ক বালকের ন্যায় অতি সুন্দর ও মনোহর। এগুলি বহু কালের প্রতিষ্ঠিত। মুর্শিদাবাদের বহু মেলার উদ্যোক্তাগণ মেলায় লোক-সমাগমের জন্য এই শ্যামসুন্দরকে নিয়ে যান।
সর্ব্বমঙ্গলা ও সোমেশ্বর শিবমন্দির:-
ভরতপুর থানার অন্তর্গত, কান্দীর তিন মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে ও পাঁচথুপীর তিন মাইল উত্তরে জয়যান নামক প্রাচীন জনপদ অবস্থিত। কায়স্থ-কারিকায় লিখিত আছে যে, ৮০৪ শকে (৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে) বা ২৮৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে কায়স্থবংশীয় সোমঘোষ (ও অন্য চার জন কায়স্থ) মহাশয় রাঢ় দেশের তৎকালীন অধিপতি মহারাজ আদিত্যশূরের সভায় উপস্থিত হন। পরের বছর তিনি জয়যানে রাজধানী ও দেবালয়াদি স্থাপনপূর্বক আদিত্যশূরের নিকট থেকে সম্পত্তি প্রাপ্ত হয়ে সামন্তরাজরূপে বাস করতে থাকেন। এবং তথায় নিজ নামে সোমেশ্বর মহাদেবের এবং স্বপ্নাদেশে প্রাপ্ত দেবী সর্ব্বমঙ্গলার (পাষাণময়ী ত্রিনয়না দুর্গামূর্তি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সর্ব্বমঙ্গলার প্রতিষ্ঠাকাল-
সর্ব্বমঙ্গলা দেবীর বর্তমান মন্দির-গাত্রে একখানি প্রস্তর-ফলক গ্রথিত ছিল।
জয়যানবাসী কয়েকজন প্রাচীনের নিকট অবগত হওয়া যায় যে, উক্ত প্রস্তর-ফলকে ‘৭০০ শক, রামেশ্বর দত্ত, ৩৬০ বিঘা ভূমি দান’ এই তিনটি কথা মাত্র লেখা ছিল। ইহা থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, সোমঘোষ মহাশয়ের জয়যান আগমনের শতাধিক বছর পূর্বে উক্ত সর্ব্বমঙ্গলাদেবী রামেশ্বর দত্ত মহাশয় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সর্ব্বমঙ্গলাদেবী দীর্ঘকাল যাবত দেবকুণ্ডের অতল পঙ্কে নিমগ্ন থাকার পর সোমঘোষ মহাশয় স্বপ্নাদেশে তাঁকে উদ্ধার করে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অধুনা স্থানান্তরিত উক্ত প্রস্তর ফলকটাও সম্ভবত দেবকুণ্ড থেকে পেয়ে ঘোষ মহাশয় সর্ব্বমঙ্গলার নবমন্দির-গাত্রে সংলগ্ন করে রেখেছিলেন। রামদত্তকে জয়যাননিবাসী অনেকেই চাঁদসদাগরের বংশীয় বলে উল্লেখ করেন। আরও শোনা যায় যে, তিনি প্রথমে জয়যানের উত্তরে এক স্থানে সর্ব্বমঙ্গলার প্রতিষ্ঠা করেন। তথায় একটি ভগ্ন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে এবং দেবস্থান বলে উক্ত স্থান অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। জয়যান গ্রামে গন্ধ-বণিকদের মধ্যে প্রায় ৮-১০ ঘর বণিক রামদত্তের বংশধর বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন। যে সময় এ অঞ্চলে জল-বাণিজ্যের সুবিধা ছিল, সেই সময় অনেক সদাগরই এদেশে এসে অনেক স্থানে বাসস্থাপন ও দেবপ্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। গোলাহাটের জয়াদেবী বা জয়মঙ্গলাদেবী সেই সময়ের সদাগরদেরই প্রতিষ্ঠিত বলে জানা যায়।
রামেশ্বর দত্ত নামে জনৈক ধনী সদাগর বণিক জয়যানের তিন-চার মাইল পশ্চিমে অবস্থিত বোদপুর নামক স্থানে বাস করতেন, তা অনেকে অনুমান করেন। এখনও উক্ত স্থান গড়বেষ্টিত ও “রামদত্তের ডাঙ্গা” নামে অভিহিত হয়ে আসছে। সর্ব্বমঙ্গলার মন্দির-গাত্রের প্রস্তরফলকখানি উদ্ধার হলেই এ বিষয়ের শেষ মীমাংসা হতে পারবে। সর্ব্বমঙ্গলার প্রাপ্তি সম্বন্ধে কায়স্থ-কুলপঞ্জিকায় লিখিত আছে যে-
‘দেবকুণ্ড নামে এক কুণ্ড পূর্বে ছিল। মৃত্তিকাচ্ছাদিত দেবী তহি মধ্যে ছিল।
যতনে খুদিনু উদ্ধারিনু এই দেবী।
দেখান মন্ত্রীরে সোমঘোষ কুলরবি।”
সোমেশ্বর শিবমন্দির ৫০ ফুট উচ্চ। সর্ব্বমঙ্গলাদেবী ও সোমেশ্বর শিবের ভোগ ও সেবাদির চিরস্থায়ী সুবন্দোবস্ত রয়েছে। বহু লাখেরাজ জমি পাণ্ডাদের অধীনে এই পূজার জন্য বহু স্থান থেকে প্রদত্ত হয়ে রয়েছে।
সর্ব্বমঙ্গলা কালী:-
শতাধিক বছর অতীত হলো মুর্শিদাবাদ নগরে প্রস্তর-নির্মিত এই মনোহর কালীমূর্তি মন্দিরের দ্বিতলের দেওয়ালের খোলের মধ্যে বিরাজ করছেন। নিজামতের একজাই সেরেস্তাদার জয়নাথ ঘোষ ঠাকুর মহাশয় ইনি প্রতিষ্ঠাতা। নবাব নাজিম তাঁকে দেওয়ানী প্রদানে সম্মত হলে, জয়নাথ উক্ত পদগ্রহণে অস্বীকৃত হন এবং তদীয় জামাতা গঙ্গাধর রায়কে উক্ত পদ প্রদান করতে অনুরোধ করেন। পরে ‘রাজা’ উপাধি সহ গঙ্গাধরকে উক্ত পদ প্রদত্ত হয়। তাঁর দৌহিত্রের হাতেই উক্ত কালীমাতার সেবার ভার অর্পিত রয়েছে।
সিংহবাহিনী ও জনার্দ্দন:-
ন্যূনাধিক পাঁচশত বছর পূর্বে পাঁচথুপী গ্রামের উত্তর-রাঢ়ীয় কায়স্থবংশীয় রাজা নরপতির অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষ (বাঁটীর বাটীর) দেবীদাস ঘোষহাজরা মহাশয় স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে পাণ্ডুয়া গ্রামের জনৈক ব্রাহ্মণের গৃহের সিংহবাহিনীদেবীর মূর্তি লাভ করেন। পরে দেবীদাসের অধস্তন ৫ম পুরুষ হরেকৃষ্ণ ঘোষ হাজরা মহাশয় সিংহবাহিনী দেবীর বর্তমান মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন। সিংহবাহিনীদেবী অষ্টধাতু-নির্মিত পাঁচপুত্তলিকাযুক্ত। সিংহবাহিনীদেবীর নিত্যপূজা ব্যতীত দুর্গোৎসব, কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, রটন্তী পূজা, বাসন্তী প্রভৃতি নৈমিত্তিক পূজা সকল বিশেষ সমারোহে সম্পন্ন হয়ে থাকে।
জনার্দ্দন দেবের মন্দির:-
পাঁচথুপীর এই মন্দিরটাও অতি প্রাচীন। দেবীদাস ঘোষ হাজরা মহাশয়ের সমসাময়িক ও তদীয় জ্ঞাতিভ্রাতা (পুরাণ-বাটীর) স্বর্গীয় সন্তোষকুমার ঘোষ হাজরা মহাশয় জনার্দ্দনদেবের জন্য বহুবিধ শিল্পকার্য-বিজড়িত মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
খ্রীষ্টিয় নবম শতাব্দীর শেষভাগে, আদিত্যশূরের রাজত্বকালে এদেশের আরও কতকগুলি বিগ্রহ মূর্তির কথা প্রাচীন ঘটক-কারিকা পাঠে অবগত হওয়া যায়। কিন্তু আজকাল আর সে সকল দেবমূর্তির সন্ধান পাওয়া যায় না। আমরা নিচে সেই সকল বিগ্রহের নামমাত্র প্রকাশ করলাম।
জগন্নাথদেব:-
ভাগীরথীর অদূরবর্তী বহরমপুরের নিকট জগন্নাথপুর নামক স্থানে একটি জগন্নাথদেবের সেবা প্রচলিত ছিল।
কর্ণেশ্বর, কর্ণেশ্বরী:-
ডিহি রাঙ্গমাটী-চাঁদপাড়ায় গোকর্ণ রাজের প্রতিষ্ঠিত কর্ণেশ্বর ও কর্ণেশ্বরী নামে বিগ্রহ যুগল প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং উক্ত স্থানে গোকর্ণ রাজের সদাব্রতও ছিল।
গ্রন্থ সহায়তা-
১। নিখিলনাথ রায় – মুর্শিদাবাদের ইতিহাস (১ম খণ্ড)।
২। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় – বাংলার ইতিহাস (১ম খণ্ড)।
৩। শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় – মুর্শিদাবাদ কথা।
৪। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার – History of Ancient Bengal.
৫। আচার্য যদুনাথ সরকার সম্পাদিত University). History of Bengal Vol-II (Dacca-
৬। ড. নীহাররঞ্জন রায় বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদি পর্ব।
৭। R.C Majumdar -History of  Mediaevel Bengal.
৮। মুর্শিদাবাদের মন্দির, বিজয় কুমার বন্দোপাধ্যায়।
৯। মহামানব জাতক, সুধাকর চট্টোপাধ্যায়।
১০।লালগোলার টুকরো ইতিহাস, মুর্শিদাবাদ অনুসন্ধান, দ্বিতীয় খন্ড, সম্পাদনা – অরিন্দম রায়।

Author

  • Suman Kumar Mitra

    Suman Kumar Mitra is a Researcher at Murshidabad Zilla Itihas & Sanskriti Charcha Kendra. He did his MA in Bengali from Rabindra Bharati University and is a Guest Lecturer at D.I.E.T Murshidabad, Berhampur, West Bengal. Views expressed are personal.

    View all posts

(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)