তৎকালীন বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাস সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে একটু পূর্বধারণা থাকলে এই সিদ্ধান্তে পৌছাতে দেরি হওয়ার কথা না যে, ভারতবর্ষ এবং প্রধানত বাংলাকে এক নিমিষে তীব্র অন্ধকার থেকে আধুনিকতার অত্যুজ্বল আলোকে পৌছে দেওয়া মনীষীদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রই সর্বপ্রধান, অগ্রগণ্য, এবং সর্বশ্রেষ্ঠ। যদি বলা হয় বাংলা ভাষায় উপন্যাস, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি-তত্ত্ব, সাহিত্য সমালোচনা, ধর্মতত্ত্ব, রসরচনা- এ সবকিছুর প্রথম সার্থক লেখক বঙ্কিমচন্দ্র, তাহলে মোটেই অত্যুক্তি হয় না। বঙ্কিম একাই বাংলা ভাষায় জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাতে এমন চিন্তার প্রসারণ ঘটালেন যে, বাংলা ভাষা রাতারাতি একটি অসংস্কৃত ভাষা থেকে উন্নত যেকোন ধরণের চিন্তা ধারণ করার উপযোগী ভাষা হিসেবে পরিণতি প্রাপ্ত হলো।
ভারতবর্ষ তথা বাংলায় অন্য অনেক কিছুর মতো নারীবাদী চিন্তার উন্মেষেও বঙ্কিমচন্দ্রই অগ্রগণ্য। তার নিজের সমাজ ও সময় থেকে তিনি কতটুকু এগিয়ে ছিলেন, তা তার নারীবাদী রচনার সময়কাল ও বিষয়বস্তুর দিকে তাকালেই আমরা নিঃসন্দেহ হতে পারি।
জাতীয় জীবনের চরম অবক্ষয়ের দিনে নানা প্রকার অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও কুসংস্কারে দেশের নারী সমাজ যখন আচ্ছন্ন, পর্দাপ্রথা ও নানা সামাজিক অনাচার যখন জগদ্দল পাথরের মতো তাদের পিষে মারছে, রান্নাঘর এবং আতুর ঘরের মধ্যেই যখন তাদের জীবন সীমাবদ্ধ –এ রকমই একদিনে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র ব্রীড়াবনতা দীর্ঘ-অবগুণ্ঠিতা ভারতীয় রমণীকে রণরঙ্গিনী বেশে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত করেছেন। জাতীয়তার মহাগ্রন্থ ‘আনন্দ মঠ’ মারফত তিনি জানালেন যে, নারী ‘বোঝা’ নয়, পথে নারীকে বর্জন করার প্রয়োজন নেই, নারী ‘নরকের দ্বার’-ও নয়—নারী যথার্থভাবে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে পারে। এভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীর স্থান নির্দিষ্ট হল। দেশপ্রেম, পতিপ্রেম, ধর্মনিষ্ঠা, বীরত্ব, পাণ্ডিত্য, বুদ্ধিমত্তা, রসিকতা ও সপ্রতিভতায় মণ্ডিত তেজোদৃপ্ত শান্তি চরিত্র বঙ্কিমচন্দ্রের এক অনন্য সৃষ্টি। সন্তানধর্ম-ত্যাগেচ্ছু স্বামী জীবানন্দকে তাই তিনি অনায়াসে বলতে পারেন—“আমার পৃথিবীতে বড় সুখ যে, আমি বীরপত্নী। তুমি অধমস্ত্রীর জন্য বীরধর্ম ত্যাগ করিবে? তুমি আমায় ভালবাসিও না—আমি সে সুখ চাহি না—
কিন্তু তুমি তোমার বীরধর্ম কখনও ত্যাগ করিও না (১।১৬)।” এ নিশ্চয়ই সাধারণ কোনো স্ত্রীলোকের কথা নয়। এই শান্তিই আবার যুদ্ধের আবহ-সংগীত কণ্ঠে নিয়ে সন্ন্যাসীর বেশে যাত্রা করছেন ‘আনন্দ মঠ’-এ এবং সেখানে ইস্পাতের ধনুকে অবহেলাভরে গুণ দিয়ে তাঁর শারীরিক বলের প্রমাণ দিলেন। মঠাধীশ সত্যানন্দকে তিনি জানালেন যে, ‘তাঁর দক্ষিণ হস্ত’ জীবানন্দের বলবৃদ্ধির জন্য, সন্তানধর্ম পালনের উদ্দেশ্যেই তিনি ‘আনন্দ মঠে’ এসেছেন।
বীরাঙ্গনা পত্নী বীর স্বামীকে সন্তানধর্মে উদ্দীপ্ত করে বলছেন—“আমি তোমার ধর্ম্মপত্নী, সহধর্ম্মিনী, ধৰ্ম্মে সহায়। তুমি অতিশয় গুরুতর ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছ। সেই ধর্ম্মের সহায়তার জন্যই আমি গৃহত্যাগ করিয়া আসিয়াছি। তোমার ধর্ম্মবৃদ্ধি করিব। ধর্ম্মপত্নী হইয়া, তোমার ধর্ম্মের বিঘ্ন করিব কেন? বিবাহ ইহকালের জন্য, এবং বিবাহ পরকালের জন্য। ইহকালের জন্য যে বিবাহ, মনে কর, তাহা আমাদের হয় নাই (৩।৪)।” মঠাধীশ যখন জীবানন্দের আত্মবিসর্জনে বাধা দেবার জন্য শান্তিকে অনুরোধ করেছেন তখন শান্তি দৃপ্তকণ্ঠে তাঁকে বলেন—“আমার স্বামীর ধর্ম্ম আমার স্বামীর হাতে ; আমি তাঁহাকে ধৰ্ম্ম হইতে বিরত করিবার কে ?” শান্তি অনায়াসে ক্যাপ্টেন টমাসের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে
নিতে পারেন, তার সঙ্গে রসিকতা করেন (৩।২), বৈষ্ণবীর বেশে মেজর এডওয়ার্ডসের শিবিরে সংবাদ সংগ্রহ করেন, বিপদ বুঝে কৌশলে লিণ্ডসের আরবী ঘোড়ায় চড়ে তীব্রবেগে জীবানন্দের কাছে হাজির হন (৪।৬) এবং এইভাবে শান্তির প্রচেষ্টার মাধ্যমেই
সন্তানদল যুদ্ধে জয়লাভ করে। বলাবাহুল্য, উপরিউক্ত কথাবার্তা এবং শান্তির বীরত্বব্যঞ্জক
আচরণ নিছক স্বামী-সঙ্গলিপ্সার পরিচায়ক নয়—তিনি যথার্থ বীরাঙ্গনা, দেশপ্রেমিক ও সহধর্মিণী।
কল্যাণী আদর্শ ভারতীয় গৃহবধু। ত্যাগ, তিতিক্ষা, সহনশীলতা, ধর্মনিষ্ঠা, পাতিব্ৰত্য, সংযম ও শিষ্টাচারের প্রতীক তিনি। স্বামীর সন্তানধর্ম পালনের পথে তিনি বিঘ্ন নন—তাই অনায়াসে তিনি বিষপান করতে পারেন এবং বলতে পারেন—“তুমি যে ব্রত গ্রহণ করিয়াছ, কায়মনোবাক্যে তাহা সিদ্ধ কর (১।২)।” চরম দুঃখের মধ্যেও কল্যাণী ধর্মনিষ্ঠা ও সংযমের পরিচয় দিয়েছেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অনন্তকালের (“মরিলে কি সম্বন্ধ যায়?”) এবং এজন্যই ভবানন্দের কুপ্রস্তাবের জবাবে দৃপ্তকণ্ঠে তিনি বলতে পারেন যে, ভবানন্দকে তিনি “ব্রতচ্যুত অধৰ্ম্মী বলিয়া মনে” রাখবেন। প্রত্যক্ষ সংগ্রামে যোগ না দিলেও, পরোক্ষে তিনি সন্তানদলকে সাহায্য করেছেন—স্বামীকে এগিয়ে দিয়েছেন ধর্মাচরণের পথে।
‘দেবী চৌধুরাণী’-তেও দেখা যায় সাধারণ নারী প্রফুল্ল-র ‘দেবী চৌধুরাণী’-তে উত্তরণ,দস্যুদলের নেতৃত্ব গ্রহণ, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন।
‘আনন্দ মঠ’-এর প্রথমবারের ‘বিজ্ঞাপনে’ বঙ্কিমচন্দ্র বলেন যে “বাঙ্গালীর স্ত্রী অনেক অবস্থাতেই বাঙ্গালীর প্রধান সহায়। অনেক সময় নয়।” বলাবাহুল্য, গ্রন্থমধ্যে এ উক্তির সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। শান্তি ও কল্যাণী তাঁদের স্বামীকে নানাভাবে সহায়তাই করেছেন, কিন্তু অনিষ্ট করার সম্ভাবনাও যথেষ্ট ছিল। সত্যানন্দ শান্তিকে বলছেন—“সামান্য মনুষ্যদিগের মন স্ত্রীলোকে আসক্ত এবং কার্য্যে বিরত করে। এজন্য সন্তানের ব্রতই এই যে, রমণী জাতির সঙ্গে একাসনে উপবেশন করিবে না (২।৭)।” তিনি আবার বলছেন “মা ভবানীর মত তোমারও ললাটে আগুন আছে, সন্তান সম্প্রদায় কেন দাহ করিবে?” সত্যিই তো তাই–কল্যাণীর রূপের মোহ ভবানন্দের মনে আগুন ধরিয়েছিল—এ আগুন শান্তিও ধরাতে পারতেন। শুধু ভবানন্দ কেন, সমগ্র সন্তানদলই তো—এ আগুনে ধ্বংস হতে পারতো। আসলে আগামী দিনের রাষ্ট্রবিপ্লবের সৈনিকদের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের সতর্কবাণীউচ্চারিত হয়েছে সত্যানন্দের মাধ্যমে, এবং ভবানন্দের স্খলনের মাধ্যমে তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে নিষ্ঠাবান ও কতর্ব্যনিষ্ঠ শীর্ষস্থানীয় সৈনিকেরাও সাময়িক মোহে ব্রতভঙ্গ
করতে পারেন।
পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে শান্তি “ঠিক বাঙ্গালার নহে…..বাঙ্গালায় এমন চরিত্র ফুটিবার নহে।” তাঁর মতে, শান্তি “বাঙ্গালার নহে, ভারতবর্ষের নহে।” অনেকের মতে শান্তি ‘বাঙ্গালীর মেয়েই নয়।’ ‘নব্যভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত (নব্যভারত, ১২৯০, মাঘ) এক সমালোচনায় বলা হচ্ছে যে, “শান্তি দেবী, দানবী, মানবী, পিশাচী, রাক্ষসী যাহা খুশী তাহা হইতে পারে কিন্তু বাঙ্গালীর মেয়ে নন।” সমকালীন বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক পূর্ণচন্দ্র বসু শান্তি চরিত্রের আলোচনায় উচ্ছ্বসিত। তাঁর মতে “শান্তি বীরত্বের উপন্যাস, উপন্যাসের শিরোভূষণ এবং কল্পনার পরিপূর্ণতা। তারা খচিত আকাশের পূর্ণশশী। তাঁহার জ্যোৎস্নায় আনন্দমঠ-এর সমুদায় বেশ আলোকিত হইয়াছে।” তাঁর মতে শান্তি চরিত্র ‘রমনীরত্ন’। চন্দ্রনাথ বসুর মতে বঙ্কিমচন্দ্র “শান্তিকে লইয়া কিছু বাড়াবাড়ি করিয়াছেন। বঙ্কিমবাবু যখন হস্তলিপি হইতে আমাকে আনন্দমঠ পড়িয়া শুনাইয়া ছিলেন, তখন আমিও তাঁহাকে এই কথা বলিয়াছিলাম। কিন্তু তিনি শুনেন নাই। বোধহয় তাঁহার মত আমার মতের সহিত মিলে নাই।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই মতের পরিপোষক। বলাবাহুল্য, প্রথম সংস্করণের ‘গেছো মেয়ে’ শান্তির ‘বাঁদরামী’ পঞ্চম সংস্করণে অনেক সংযত করা হয়েছে। এ সম্পর্কে “পঞ্চম বারের বিজ্ঞাপন”-এ বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই বলছেন “শান্তিকে অপেক্ষাকৃত শান্ত করা গিয়াছে”—কিন্তু এ সত্ত্বেও শান্তি চরিত্রের বীরত্ব ও তেজস্বিতা বিন্দুমাত্র খর্ব হয়নি—বরং তা আরও সুসংবদ্ধ ও গৌরবমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। শান্তি চরিত্রের বাঙালিয়ানা, ভারতীয়ত্ব ও বাস্তবতা সম্পর্কে আমরা বলি যে, শান্তি চরিত্রের পটভূমি হল তাঁর অতীত জীবন, ভাগ্যবিপর্যয় এবং সমাজ ও সংসারের নিষ্ঠুর অবহেলা (২।১)। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে শান্তি পূর্ণতা পেয়েছেন—আনন্দ মঠ’-এ তাঁর চরিত্র স্বাভাবিক এবং বাস্তব-সম্মত। বঙ্কিম-সুহৃদ চন্দ্রনাথ বসু বলেন যে, “শান্তি ব্যতীত আনন্দমঠ হয় না। স্ত্রী Patriotএবং বীর না হইলে পুরুষ বীর এবং Patriot হয় না। তাই শান্তির সৃষ্টি। অতএব শান্তি স্ত্রী—প্রকৃত স্ত্রী—যেমন দুর্গাবতী, জয়াবতী, মীরাবাঈ ইত্যাদি। তবে আনন্দমঠের কার্যক্ষেত্র নির্দিষ্ট। সে নির্দিষ্টরূপে শান্তি শান্তিরূপে বই অন্যরূপে দেখা দিতে পারে না। তাই বলিয়া কি তাহাকে সেরূপে দেখিব না? সকলের সকল রূপই দেখিতে হয়, নইলে দেখাই হয়
না, সংসারও বুঝা হয় না। পারিবারিক জীবন আনন্দমঠের উদ্দেশ্য হইলে, আনন্দমঠের শান্তিকেও নিমাইমণির মতন ঘরের জিনিস দেখিতাম এবং সন্ন্যাসিনী শান্তিকে যেরূপ অগাধ প্রেম, পতিভক্তি, আত্মোৎসর্গবৃত্তি এবং চপলতা, হাস্যময় ভাব, রসাধিক্য, sprightliness প্রভৃতি গুণ মিশ্রিত দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাতে নিশ্চয়ই বোধহয় যে, আনন্দমঠ পারিবারিক উপন্যাস হইলে তাহাতে শান্তিকে বঙ্কিমবাবুর সূর্যমুখী, ভ্রমর, মৃণালিনী, কমলমণি প্রভৃতি সকল শ্রেণীর রমণীর এক অদ্ভুত অনুপম ঐন্দ্রজালিক সংযোগরূপে দেখিতাম।”
বিশিষ্ট সমালোচক অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত বলছেন যে, “শান্তি একালেরও নয়, সেকালেরও নয় ; ভবিষ্যতের স্বদেশসেবাব্রতা বাঙ্গালী নারী অথবা ভবিষ্যতের ত্যাগী স্বদেশসেবীর যোগ্যা সহধর্মিনী। পত্নী যদি কেবলই পতিকে গৃহসুখের দিকে টানিতে থাকে, তবে সে দেশের সেবা কখন করিবে? শান্তি পত্নী হইয়া পতিকে ব্রহ্মচর্যে অবিচলিত থাকিবার উৎসাহ দিতেছে। এমন কি স্বয়ং ব্রতের উদযাপনে সাহায্য করিতেছে।”
‘দেবী চৌধুরাণী’-তে বঙ্কিমচন্দ্র দেখালেন যে, সুযোগ পেলে নারী রাজ্য শাসনের দক্ষতা দেখাতে পারে। সুলতানা রাজিয়া, রাণী দুর্গাবতী, চাঁদবিবি, তারাবাঈ, রাণী ভবানী যদি সত্য হন, তবে শান্তিও সত্য। আসলে, যুগ প্রয়োজনে বঙ্কিমচন্দ্র গৃহবন্দী ও পর্দানশীন নারী সমাজকে বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করে জানাতে চেয়েছিলেন যে, মাতৃমুক্তিযজ্ঞে নারীদেরও যথেষ্ট গুরুদায়িত্ব আছে, তাঁদের দেশহিতৈষণায় অবতীর্ণ হতে হবে, উপযুক্ত শিক্ষা পেলে তাঁরা দেশহিতৈষী সন্তানদের প্রকৃত সহধর্মিণী হয়ে উঠবেন এবং যুগপ্রয়োজনে রাষ্ট্রবিপ্লব ও রাষ্ট্র-পরিচালনার কাজেও তাঁরা যথেষ্ট দক্ষতা দেখাতে পারেন। একথা সারা বাংলা—এমনকি সারা ভারত সম্পর্কেই প্রযোজ্য এবং ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তরাঙা দিনগুলিতে হাজার হাজার শান্তি-কল্যাণী-প্রফুল্ল নিষেধের বেড়াজাল ছিঁড়ে জাতীয় জীবনে নানা বর্ণাঢ্য ইতিহাস রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন।
সামগ্রিকভাবে এই উপমহাদেশে নারী পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা প্রথম বঙ্কিমচন্দ্রেরে লেখনীতেই ঘোষিত হলো। যদিও তৎকালীন বাংলা বা ভারতবর্ষ তৎকালীন ইউরোপ থেকে বৌদ্ধিক চর্চায় যোজন পরিমাণ পিছিয়ে ছিলো, বঙ্কিমচন্দ্রের মানস ছিলো তৎকালীন শ্রেষ্ঠ ইউরোপীয় চিন্তকদের সমতুল্য ও সমসাময়িক। এ কারণে মিলের বৈপ্লবিক ধারণাকে সংশ্লেষিত করে নিমিষেই সে ধারণার একটি স্বদেশী সংস্করণ নির্মাণ করার আপাত অসম্ভব কাজ বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষে ছিলো অনায়াসলব্ধ। আরেকটি বিস্ময়কর ব্যাপার, বঙ্কিমচন্দ্র যে বছর বাংলার প্রথম নারীবাদী সাহিত্য লিখলেন (১৭৭৯), তার ঠিক পরের বছরেই (১৭৮০) বাংলার প্রথম নারীবাদী নারী বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন। বেগম রোকেয়ার লেখা প্রকাশিত হওয়ার আগে সুদীর্ঘকাল ধরে বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রই ছিলেন নারীবাদী সাহিত্যের একমাত্র নিঃসঙ্গ রচয়িতা।
১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের সামাজিক পটভূমির সাথে বর্তমান কালের সামাজিক পটভূমির অমিল অনেক বেশি হওয়াই স্বাভাবিক, তাই সাম্য এর বক্তব্য বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক হওয়ার কথা। কিন্তু মহৎ চিন্তক-দার্শনিক-সাহিত্যিকদের রচনার প্রধান দুই বৈশিষ্ট্য চিরন্তনতা ও সার্বজনীনতা। এ দুই গুণ বঙ্কিমচন্দ্রের প্রায় সব লেখাতেই উপস্থিত; তাই সাম্য প্রায় দেড়শো শতাব্দী পূর্বে রচিত হলেও এর অনেক বক্তব্য সে সময় ও স্থানকে অতিক্রম করে চিরকালের সব মানুষের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
বঙ্কিমচন্দ্রের অধিকাংশ লেখাই বাংলা সাহিত্যে অবিস্মরণীয় বিভিন্ন কারণে; তবে এদের মধ্যে ‘সাম্য’ কিছুটা হলেও অসাধারণ।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম সাম্যবাদী (Communism নয়, Equality অর্থে) রচনা এটি। এই প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র দার্শনিকভাবে সাম্যের মূলনীতি প্রমাণ করেন। সাম্য গ্রন্থের পঞ্চম পরিচ্ছেদই বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারীবাদী রচনা।
সব মানুষের সমান অধিকার থাকা আবশ্যক, এই তত্ত্ব সুপ্রমাণ করার পর সাম্য গ্রন্থের পঞ্চম পরিচ্ছেদে বঙ্কিম নারী পুরুষের ক্ষেতেও এ মূলনীতিকে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিলেন। প্রথমেই তৎকালীন সময়ে নারী পুরুষের চারটি বৈষম্যকে তিনি চিহ্নিত করেনঃ
“১ম। পুরুষকে বিদ্যাশিক্ষা অবশ্য করিতে হয়; কিন্তু স্ত্রীগণ অশিক্ষিতা থাকে।
২য়। পুরুষের স্ত্রীবিয়োগ হইলে, সে পুনর্বার দারপরিগ্রহ করিতে অধিকারী। কিন্তু স্ত্রীগণ বিধবা হইলে, আর বিবাহ করিতে অধিকারিণী নহে; বরং সর্বভোগসুখে জলাঞ্জলি দিয়া চিরকাল ব্রহ্মচর্যানুষ্ঠানে বাধ্য।
৩য়। পুরুষে যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাইতে পারে, কিন্তু স্ত্রীলোকে গৃহপ্রাচীর অতিক্রম করিতে পারে না।
৪র্থ। স্ত্রীগণ স্বামীর মৃত্যুর পরেও অন্য স্বামীগ্রহণে অধিকারী নহে, কিন্তু পুরুষগণ স্ত্রী বর্তমানেই, যথেচ্ছ বহুবিবাহ করিতে পারেন।”
পরবর্তীতে এই চারটি বৈষম্যের ক্ষেত্রে বিস্তারিত আলোচনা করে এই চার ক্ষেত্রেই সকল ধরণের বৈষম্য দূর করা আবশ্যক মর্মে ঘোষণা দিয়ে বঙ্কিম উক্ত পরিচ্ছেদ সমাপ্ত করেন।
এই অনুচ্ছেদের অনেক অংশই এমনকি বর্তমান সময়েও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এই প্রবন্ধে আমরা মূলতঃ এই অনুচ্ছেদ হতে বিভিন্ন অংশ নির্বাচন করে বর্তমান সময়ের সাথে এদের প্রাসঙ্গিকতা নির্ণয়ের চেষ্টাই করবো।
একঃ নারীশিক্ষা প্রসঙ্গে বিরুদ্ধ এক পক্ষের যুক্তি, নারীরা যদি বাইরে বিদ্যাশিক্ষায় ব্রতী হয়, তাহলে ঘর সামলানোর কাজ করবে কারা? এর উত্তরে বঙ্কিম বলেন,
“সাম্যতত্ত্বান্তর্গত সমাজনীতি সকল পরস্পরে দৃঢ় সূত্রে গ্রন্থিত, যদি স্ত্রী পুরুষ সর্বত্র সমানাধিকারবিশিষ্ট হয়, তবে ইহা স্থির যে, কেবল শিশুপালন ও শিশুকে স্তন্যপান করান স্ত্রীলোকের ভাগ নহে, অথবা একা স্ত্রীরই ভাগ নহে। যাহাকে গৃহধর্ম বলে, সাম্য থাকিলে স্ত্রী পুরুষ উভয়েরই তাহাতে সমান ভাগ। একজন গৃহকর্ম লইয়া বিদ্যাশিক্ষায় বঞ্চিত হইবে, আর একজন গৃহকর্মের দুঃখে অব্যাহতি পাইয়া বিদ্যাশিক্ষায় নির্বিঘ্ন হইবে, ইহা স্বভাবসঙ্গত হউক বা না হউক, সাম্যসঙ্গত নহে।”
এ কথা সত্যি যে, নারীর সার্বজনীন শিক্ষার অধিকার এখন মোটামুটি স্বীকৃত। তবে এখানেও কথা থাকে। বর্তমান সময়ে নারীর শিক্ষার উদ্দেশ্য কী এ প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে গেলে খুব একটা আশাবাদী এখনও হওয়া যায় না। এখনও অনেকেই নারী শিক্ষাকে কেবল বিয়ের বাজারে অধিক যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবেই বিবেচনা করেন। এ কারণে দেখা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পরও অধিকাংশ নারী মূলত গৃহকর্মেই নিযুক্ত থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই, গৃহকর্মের ভার যদি একা নারীর উপর পড়ে, তাহলে তার পক্ষে বিয়ের পরে বিদ্যাশিক্ষা বা তাকে কাজে লাগানোর পথ ও উপায় অনেক সংকুচিত হয়ে পড়ে। এ কারণেই বঙ্কিমের সমাধান গৃহকর্মে নারী পুরুষের সমান ভাগ হওয়া আবশ্যক- এ মূলনীতি এখনও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
দুইঃ আমাদের সমাজে এখনও বিধবাবিবাহ প্রায় অনুচ্চারিত একটি শব্দ। যদিও বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে শিক্ষিত সমাজ প্রকাশ্যে কিছু বলার স্পর্ধা আর রাখে না, তথাপি বিধবার পুর্নবার বিয়ে করাকে এখনও বৃহত্তর সমাজ মন থেকে মেনে নিতে পারে না। নারীর কাছে পুরুষকেন্দ্রিক সমাজের দাবি সবসময়ই বেশি; তাই পতির মৃত্যুতে পত্নীর যে পরিমাণ শোকাবিহ্বল হওয়ার আশা এ সমাজ করে, পত্নীর মৃত্যুতে পতির সমপরিমাণ শোকাবিহ্বল হওয়ার দাবি এ সমাজ করে না। বঙ্কিমের সময় অপেক্ষা বিধবাবিবাহের প্রচলন ও অনুমোদন আমাদের সময়ে অধিক হলেও বঙ্কিমের নিম্নোক্ত প্রশ্নকে তাই এখনও আমরা প্রাসঙ্গিক বলতে বাধ্য :
“বিধবার চিরবৈধব্য যদি সমাজের মঙ্গলকর হয়, তবে মৃতভার্য পুরুষের চিরপত্নীহীনতা বিধান কর না কেন? তুমি মরিলে, তোমার স্ত্রীর আর গতি নাই, এজন্য তোমার স্ত্রী অধিকতর প্রেমশালিনী; সেইরূপ তোমার স্ত্রী মরিলে, তোমারও আর গতি হইবে না, যদি এমন নিয়ম হয়, তবে তুমিও অধিকতর প্রেমশালী হইবে। এবং দাম্পত্য সুখ, গার্হস্থ্য সুখ দ্বিগুণ বৃদ্ধি হইবে। কিন্তু তোমার বেলা সে নিয়ম খাটে না কেন? কেবল অবলা স্ত্রীর বেলা সে নিয়ম কেন?”
তিনঃ বঙ্কিম কর্তৃক উল্লেখিত তৃতীয় বৈষম্য অবশ্য এখনও আমাদের সমাজে প্রবলভাবে বিদ্যমান। নারীকে এখনও গৃহপ্রাচীরের মধ্যে বন্দী রাখার সকল ব্যবস্থা রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার সকলেই বিভিন্নভাবে করে যাচ্ছে। এই ব্যবস্থার স্বপক্ষে যুক্তি এতোটাই দুর্বল যে, বঙ্কিম একে ‘জঘন্য অধর্মপ্রসূত বৈষম্য’ বলতে তাই বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি:
“পুরষের যত প্রকার দৌরাত্ম্য আছে, স্ত্রীপুরুষে যত প্রকার বৈষম্য আছে, তন্মধ্যে আমাদিগের উল্লিখিত তৃতীয় প্রস্তাব, অর্থাৎ স্ত্রীগণকে গৃহমধ্যে বন্য পশুর ন্যায় বদ্ধ রাখার অপেক্ষা নিষ্ঠুর, জঘন্য অধর্মপ্রসূত বৈষম্য আর কিছুই নাই। আমরা চাতকের ন্যায় স্বর্গমর্ত্য বিচরণ করিব, কিন্তু ইহারা দেড় কাঠা ভূমির মধ্যে, পিঞ্জরে রক্ষিতার ন্যায় বদ্ধ থাকিবে। পৃথিবীর আনন্দ, ভোগ, শিক্ষা, কৌতুক, যাহা কিছু জগতে ভাল আছে, তাহার অধিকাংশে বঞ্চিত থাকিবে। কেন? হুকুম পুরুষের।”
এভাবে এই বৈষম্যের মূলনীতি সাধারণ যুক্তিবোধ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার পর নারীর বাইরে বের হওয়ার বিভিন্ন বাধা নিয়ে বঙ্কিম আলোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে বিরুদ্ধপক্ষের একটি যুক্তি এবং সে সম্পর্কিত বঙ্কিমের যুক্তিখন্ডন নিয়ে একটু আলোচনা করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না।
পুরুষের মতো নারীরও যত্রতত্র ভ্রমণের অধিকার আছে, এ ঘোষণা দেওয়ার পর বঙ্কিম বিরুদ্ধপক্ষীয়দের একটি বক্তব্যের অবতারণা করেন। এ পক্ষের বক্তব্য, নারীগণ বাইরে বের হলে পুরুষের সাথে যথেচ্ছ মেলামেশার প্রভাবে ধর্মভ্রষ্ট হবেন। এ প্রসঙ্গে ইউরোপীয় নারীদের যথেচ্ছ ভ্রমণের অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে এ পক্ষ বলে ওঠেন, “সে সকল সমাজের স্ত্রীগণ, হিন্দুমহিলাগণ অপেক্ষা ধর্মভ্রষ্ট এবং কলুষিতস্বভাব বটে।” এই কথার জবাব দিতে গিয়ে বঙ্কিম যে উক্তিটি করেন, সেটি চিরস্মরণীয়ঃ
“ধর্মরক্ষার্থ যে স্ত্রীগণকে পিঞ্জরবদ্ধ রাখা আবশ্যক, হিন্দুমহিলাগণের এরূপ কুৎসা আমরা সহ্য করিতে পারি না। কেবল সংসারে লোকসহবাস করিলেই তাহাদিগের ধর্ম বিলু্প্ত হইবে, পুরুষ পাইলেই তাহারা কুলধর্মে জলাঞ্জলি দিয়া তাহার পিছু পিছু ছুটিবে, হিন্দু স্ত্রীর ধর্ম এরূপ বস্ত্রাবৃত বারিবৎ নহে। যে ধর্ম এরূপ বস্ত্রাবৃত বারিবৎ, সে ধর্ম থাকা না থাকা সমান—তাহা রাখিবার জন্য এত যত্নের প্রয়োজন কি? তাহার বন্ধনভিত্তি উন্মূলিত করিয়া নূতন ভিত্তির পত্তন কর।”
যে ধর্ম নারীর যথেচ্ছ ভ্রমণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় না, প্রয়োজনে সেই ধর্মকে বিলুপ্ত করা হোক, তথাপি নারীর প্রাপ্য অধিকারের স্বীকৃতি প্রদানে কোন শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে না- অচল অনড় প্রাচীন হিন্দুসমাজের প্রতি বঙ্কিমের এহেন উক্তি নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক ও দুঃসাহসিক। মূলতঃ বঙ্কিমচন্দ্রের এ উক্তি, সকল সময়ের সকল সমাজের জন্যই প্রাসঙ্গিক। যে ভিত্তি মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার দেয় না, সে ভিত্তির সমূল বিনাশই একমাত্র সমাধান। অথচ আমরা এখন বঙ্কিমচন্দ্রের এহেন উক্তি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে যা প্রাচীন, পুরাতন, প্রতিক্রিয়াশীর ও প্রগতিবিরুদ্ধ, তাকেই আরও প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরি। আমাদের সমাজে ও সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যা্ওয়াকে তাই আর অবিশ্বাস্য মনে হয় না। এই সমাজ পুরাতন সঙ্কীর্ণ ডোবাতে গড়াগড়ি খেতেই অভ্যস্ত, সাগরের মতো বিশাল ও অভিনব বঙ্কিমচন্দ্রে অবগাহন করতে গেলে তাই এ সমাজের নাভিশ্বাস উঠার উপক্রম হয়।
তথ্যসূত্রঃ-
১। নারায়ণ, ১৩২২, বৈশাখ।
২। কাব্যসুন্দরী, পূর্ণচন্দ্র বসু, ২য় সংস্করণ, ১৩০৫, পৃঃ ১৫৮-৫৯।
৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লিখিত চন্দ্রনাথ বসুর পত্র, ১ কার্ত্তিক, ১২৯১, বিশ্বভারতী
পত্রিকা, ১৩৫১, দ্বিতীয় বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, বৈশাখ-আষাঢ় পৃঃ ৪২৫-২৬।
৩। মানসী ও মর্মবাণী, ফাল্গুন, ১৩২৩।
৪। বিশ্বভারতী পত্রিকা, ২য় বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, বৈশাখ-আষাঢ়, ১৩৫১, পৃঃ ৪২৬।