Dr. Syama Prasad Mookerjee Research Foundation

ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী’র জনসংঘের মেদিনীপুর ও উত্তরাধিকার

রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে বিরত না থাকার অভিযোগে ১৯৪৮ সালে হিন্দু মহাসভা ত্যাগ করেছেন শ্যামাপ্রসাদ। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া পাকিস্তানে হিন্দু  নিধনযজ্ঞ চলছে তখন। ১৯৫০ এর ১৫ই ফেব্রুয়ারি শুরু হলো ভয়ংকর সেই দাঙ্গা। ৪৫ লক্ষেরও বেশি হিন্দু বাঙালি সীমানা পেরিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন এপার বাংলায়, এ-সব কিছুর একমাত্র কারণ ধর্ম এবং ইসলামিক আগ্রাসন। খুন হয়ে গেল কয়েক লক্ষ মানুষ, তাদের  সকলের পরিচয় ধর্মে তারা হিন্দু। লুণ্ঠন করা হলো হিন্দুদের ঘরবাড়ি, হাজার হাজার হিন্দু নারীর ধর্ষণ-খুনের নারকীয়তার সাক্ষী থাকলো গোটা দেশ। উদ্বাস্তু সমস্যা জিইয়ে রাখা ও হিন্দুদের সুরক্ষা না দেওয়ার ১৯৫০ এর নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি এবং নেহেরুর মুসলিম তোষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ১৯৫০ এর ৮ই এপ্রিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ। আত্মনিয়োগ করলেন উদবাস্তুদের সেবায়, সাহায্যে এবং পুনর্বাসনে। কংগ্রেসের নীতিহীন মুসলিম তোষণ এবং কমিউনিস্টদের জাতীয়তাবাদ বিরোধী উদ্ভ্রান্ত রাজনৈতিক অন্ধকার আবহাওয়া দাঁড়িয়ে তৈরী করলেন একটি রাজনৈতিক দল, নাম দিলেন ভারতীয় ‘জনসংঘ’। শুভ সেই দিনটি ছিল ২১শে অক্টোবর, ১৯৫১। এই দলের আদর্শ ছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ। সেদিনের প্রধান সহযোগীরা হলেন বলরাজ মাধক, দীনদয়াল উপাধ্যায়, লালা হংসরাজ গুপ্ত, লালা বলরাজ, শ্রী ধরমবীর, পন্ডিত মৌলিক চন্দ্র শর্মা, সুন্দর সিং ভান্ডারী, অটল বিহারী বাজপেয়ি এবং চৌধুরী শ্রীচন্দ্র প্রমুখ। দলের মূলনীতি ছিল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন এবং অনৈতিক পাকিস্তান তোষণের বিরোধিতা করা। দলের মূল  লক্ষ্য হিন্দু জাতীয়তাবাদ, হিন্দুত্ব, অখণ্ড মানবতাবাদ এবং অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা। নব গঠিত দলটির রাজনৈতিক লক্ষ্য ‘এক দেশ এক নিশান’, ‘এক দেশ এক সংবিধান’, ‘এক দেশ এক আইন’ এবং অবশ্যই ৩৭০ ধারার দ্রুত অবলুপ্তি। ওই ১৯৫১ তে দিল্লিতে দলের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম সভাপতি হন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী।

১৯৫১ সালে তৈরি হওয়া সেই ভারতীয় জনসংঘ ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার পর একাধিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিশে গঠন করলো ‘জনতা পার্টি’ । সদ্য গঠিত সেই সংযুক্ত জনতা দল ১৯৭৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জাতীয় কংগ্রেসকে পরাজিত করে সরকার গঠন করতে সক্ষম হলো। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের মর্যাদা অর্জন করলো তারা। তারপর প্রবহমান ধারায় দলকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরোতে হয়েছে। দেশের প্রয়োজনে এবং ভারত মাতার দুঃখ মোচনকে সামনে রেখে নিজেদের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থকে দূরে সরিয়ে অসম্ভব ঝুঁকি নিয়ে ১৯৮০ সালে ‘জনতা পার্টি’র অবলুপ্তি ঘটিয়ে  জনসংঘের প্রাক্তন সদস্যরা গঠন করেন ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। শ্যামাপ্রসাদজি’র জনসংঘের নীতি, আদর্শ ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে গঠিত হওয়া বিজেপি দলটি প্রথমের দিকে তেমন সফল হতে পারেনি। ১৯৮৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি মাত্র দুটি আসনে জয় লাভ করেছিল। একটি অন্ধ্রপ্রদেশের হানামকোন্ডা থেকে সি জঙ্গরেড্ডি এবং অপরটি গুজরাটের মেহেসানা থেকে এ কে প্যাটেল। ভারত মাতার উজ্জীবন মন্ত্রকে বুকের গহীনে জাপটে ধরে জাতীয়তাবাদ, হিন্দুত্ব এবং রাম জন্মভূমি আন্দোলনের হাত ধরে দলের শক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। নীতি-আদর্শ ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি গঠিত হওয়ার মাত্র ষোলো বছরের মধ্যে, ১৯৯৬ সালে ভারতীয় সংসদে বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পূর্ণ মেয়াদের জন্য ভারতীয় জনতা পার্টির প্রধানমন্ত্রী হলেন অটল বিহারী বাজপেয়ি। মাত্র ৪০ বছর আগে তৈরি হওয়া ভারতীয় জনতা পার্টি  আজ সারা পৃথিবীর বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন। নথিভূক্ত মোট সদস্য  ১২ কোটি, দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ চিনা’র প্রায় দ্বিগুণ। ১৯৫১ সালে তৈরি হওয়া সেই ‘অখিল ভারতীয় জনসংঘ’ ১৯৫১-৫২ সালে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।  শতাংশের বিচারে ৩% ভোট নিয়ে প্রথম থেকেই জাতীয় দলের মর্যাদা পাওয়া ‘জনসংঘ’ তিনটি লোকসভা আসন জেতে। দক্ষিন কলকাতা আসনে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সেই সঙ্গে বাংলা থেকে  দুর্গাচরণ ব্যানার্জি এবং রাজস্থান থেকে নির্বাচিত হন উমা শঙ্কর ত্রিবেদী। লোকসভায় বিরোধী দলনেতা নির্বাচিত হন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী।

আজ ভারতবর্ষের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন অতিক্রান্ত।  যে স্বপ্নকে সামনে রেখে শ্যমাপ্রসাদ মুখার্জি, দীন দয়াল উপাধ্যায়’রা অখিল ভারতীয় জনসংঘ তৈরী করেছিলেন, সেই দলের যোগ্য উত্তরসূরীরা ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি ঘটিয়ে কাশ্মীরকে ভারতে সম্পূর্ণ অন্তর্ভুক্তী আইনি বৈধতা দিয়েছে, ভারতীয় হিন্দু পরম্পরা ও ঐতিহ্য স্থাপন করে অযোধ্যায় রাষ্ট্র মন্দির নির্মান করেছে, তিন তালাক নিষিদ্ধ করে নারীদের সম্মান দিয়েছে। দেশে তৃতীয় বারের মতো প্রধান মন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত  হয়েছেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। ভারতের গণতন্ত্রের ইতিহাসে জওহরলাল নেহেরুর মতই তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী তিনি। তবে পার্থক্য একটা আছে। জওহরলাল যতবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ততবার দেশে বিধানসভা ও লোকসভার ভোট একসঙ্গেই করিয়ে ছিলেন।  আর নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বার প্রধান মন্ত্রী হয়ে কেবল সে-ই নিয়ম পূনরায় কার্যকর করতে চলেছেন; সেই প্রতিশ্রুতির নাম – ‘এক দেশ এক নির্বাচন’। জহরলালের প্রথম মন্ত্রীসভা ঘোষণা করেছিল দেশে যতটা সম্ভব দ্রুত কার্যকর হবে এন আর সি – নির্দিষ্ট হয়ে যাবে ভারতীয় আর অনুপ্রবেশকারীর সীমারেখা, আজ তা নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে এগিয়েছে অনেকটাই। ‘এক দেশ এক নিশান’ (৩৭০ ধারা বিলুপ্তি) হয়েছে, ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ হবে এবং ‘সিভিল ইউনিক কোড’ এর মাধ্যমে ‘এক দেশ এক আইন’ও চালু হবে নিশ্চিতভাবে। ভারতীয় সংবিধানের মূল ভাবনা পরিপূর্ণভাবে কার্যকর হবে, সম্পূর্ণ হবে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী-বল্লভ ভাই প্যাটেল-দীনদয়াল উপাধ্যায় প্রমূখদের স্বপ্ন।

সদ্য সমাপ্ত অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে অখন্ড মেদিনীপুর বিশেষ করে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় বিধানসভা নিরিখে ভারতীয় জনতা পার্টি অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যাবে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী প্রতিষ্ঠিত জনসংঘ (১৯৫২) এর প্রথম নির্বাচন, পরবর্তীকালে জনতা দল (১৯৭৭) এর প্রথম নির্বাচন এবং আজকের বিজেপির (২০২৪ এর লোকসভা) নির্বাচনী ফলাফলের পরম্পরা ও উত্তরাধিকার, এক সোনালী স্বাক্ষর স্বপ্রতিভ  আলো হয়ে পথ দেখাচ্ছে।

১৯৫২ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার মোট আসন ছিল ২৩২। স্বাধীন ভারতের প্রথমবার সেই নির্বাচনে ‘অখিল ভারতীয় জনসংঘ’ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় জিতেছিল মোট ন’টি আসন। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে সারাদেশে রাজস্থান বিধানসভা থেকেই আট’টি আসন ছিল জনসংঘের। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ১৯৫২র সেই নির্বাচনে কিষান মজদুর প্রজা পার্টি ১৫ টি, হিন্দু মহাসভা ৪টি, ফরওয়ার্ড ব্লক ১৩ টি, কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া ২৮ টি এবং কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পেয়েছিল ১৫০ টি আসন। স্বাধীন দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নবগঠিত অখিল ভারতীয় জনসংঘের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ন’টি আসনের মধ্যে আট’টি আসনই ছিল অখন্ড মেদিনীপুরের।

অখিল ভারতীয় জনসংঘের সেদিনের যুদ্ধ জয়ের সৈনিকরা ছিলেন ১. বিনপুর থেকে নৃপেন্দ্র গোপাল মিত্র, ২. ঝাড়গ্রাম থেকে মদনমোহন খান, ৩. নারায়ণগড় থেকে কৃষ্ণচন্দ্র শতপতি, ৪. পিংলা থেকে পুলিনবিহারী মাইতি, ৫. দাঁতন থেকে যোগেন্দ্র কুমার চৌধুরী, ৬. পটাশপুর থেকে জনার্দন সাউ, ৭. মোহনপুর থেকে বসন্তকুমার পানিগ্রাহী এবং ৮. ভগবানপুর থেকে রামেশ্বর পন্ডা। অখন্ড মেদিনীপুরের বাইরে কেবল কুলপি থেকে ৯. রামকৃষ্ণ কুমার জয়যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মৃত্যুর পরের পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ নির্বাচনগুলোতে জনসংঘ  সেইভাবে কোন দাগ কাটতে পারেনি। কেবল ১৯৬৭ সালে সাধারণ নির্বাচনে গোসাবা কেন্দ্র থেকে ভারতীয় জনসংঘের প্রার্থী হিসেবে জি এন মন্ডল জয় যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৭২ এর সাধারণ নির্বাচনে জনসংঘের কোন প্রার্থী পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ছিল না।

এরপর এলো ১৯৭৭ এর নির্বাচন। জনসংঘ ভেঙ্গে সদ্য তৈরি হয়েছে ‘জনতা দল’। লড়াইয়ের মাঠে নামলেন মেদিনীপুরের জাতীয়তাবাদী ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির উত্তরসুরি নেতৃত্বরা। গোটা পশ্চিমবঙ্গে সেবার জনতা দলের আসন সংখ্যা দাঁড়ালো ২৯। মোট ২৯৪ আসনের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায়  সিপিআই ছাড়া বামফ্রন্ট পেল ২৩১টি আসন। জাতীয় কংগ্রেসকে পেছনে ফেলে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায়  সেই প্রথম, দ্বিতীয় বৃহৎ দলের মর্যাদা অর্জন করল ‘জনতা দল’। বিরোধী দলনেতা হলেন প্রফুল্ল সেন। ১৯৭৭ এর সেই নির্বাচনে গোটা মেদিনীপুর জেলা জুড়ে অভূতপূর্ব ফলাফল করলো শ্যামাপ্রসাদের আদর্শে ও আবেগে তৈরি জনতা দল। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মোট ১৬ টি বিধানসভা আসনের তমলুক (বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়) ও ময়না (পুলক বেরা) বামফ্রন্ট জিতলেও ১৪টি আসনেই জয়যুক্ত হয় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির প্রতিষ্ঠাতা ‘জনসংঘ’র উত্তরসূরী ‘জনতা দল’। বর্তমান ভৌগোলিক মানচিত্রে পূর্ব মেদিনীপুরে জনতা দলের দখলে যাওয়া ১৪টি আসন হল – পাঁশকুড়া পূর্ব (স্বদেশ মাঝি), মহিষাদল (শাশ্বতী বাগ), সুতাহাটা (শিবনাথ দাস), নন্দীগ্রাম (প্রবীর জানা), নরঘাট (বঙ্কিম বিহারী মাঝি), ভগবানপুর (হরিপদ জানা), খেজুরি (সুনির্মল পাইক), কাঁথি  উত্তর (রাসবিহারী পাল), কাঁথি দক্ষিণ (সত্যব্রত মাইতি), রামনগর (বলাইলাল দাস মহাপাত্র), এগরা (প্রবোধ চন্দ্র সিনহা), মুগবেড়িয়া  (কিরণময়ী নন্দ) এবং পটাশপুর (জন্মেনজয় ওঝা)। সদ্য সমাপ্ত অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফলে পূর্ব মেদিনীপুরের জনগন ১৬ টি আসনের মধ্যে ১৫ টি আসনই ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কে উপহার দিয়েছে। ১৯৭৭ থেকে ২০২৪, ‘ফিরে ফিরে আসা ইতিহাস’ আবারও বীরদর্প প্রত্যার্পনের নজির সৃষ্টি করলো। জয় হল রাষ্ট্রবাদের, পূর্ব মেদিনীপুরের মাটিতে আরও একবার তোষণহীন রাজনীতির ধ্বজা উত্তোলিত হল সগর্বে।

সব প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের পেছনেই লুকিয়ে থাকে সলতে পাকানোর একটি গল্প। প্রথম নির্বাচনে এই বিপুল জয়ের পেছনে ১৯৪২ সালে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মেদিনীপুরের জন্য আত্মত্যাগই আজকের এই সোনালী সকালের মহামূল্য রসদ। ১৯৪২ সাল। মেদিনীপুরে তখন এক উত্তাল সময়। ‘ভারতছাড়ো’র উন্মত্ততায় গোটা মেদিনীপুর জেলা তখন প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, পিকেটিং, অবরোধ, হরতাল, পুলিশের নির্যাতন, ধড়-পাকড়, জেল বন্দী প্রভৃতিতে উত্তপ্ত। পরপর তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট খুন করে ইংরেজের হাঁটুতে কম্পন ধরিয়ে দেওয়া মেদিনীপুরে, আসার সাহস দেখাচ্ছেন না কেউ। অন্যদিকে সতীশ সামন্ত, সুশীল ধাড়া, অজয় মুখার্জিদের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ‘স্বাধীন তাম্রলিপ্ত’ সরকার। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মেদিনীপুরে, বিশেষ করে কাঁথির সেই ভয়াবহ বন্যা ও সাইক্লোন পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ  সরকারের চূড়ান্ত নিষ্ক্রিয়তার এবং সংগ্রামী-দেশপ্রেমী মেদিনীপুরবাসীর উপর চূড়ান্ত দমন-পীড়নের প্রতিবাদে এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করলেন শ্যামাপ্রসাদ। প্রত্যন্ত সব এলাকার বন্যা কবলিতদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে  গঠন করলেন ‘বন্যা মোকাবিলা কমিটি’। সভাপতি হলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী এবং কোষাধক্ষ্য হয়েছিলেন পরবর্তীকালে ‘বাংলার রূপকার’ খ্যাত মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধান চন্দ্র রায়। কাঁথির সাতমাইল উচ্চ বিদ্যালয়ে সত্যাগ্রহী ও স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গভুষণ ভক্ত ও মতিলাল প্রধানের নেতৃত্বে ত্রান শিবিরে নিজের হাতে ত্রাণ বিতরন করেন শ্যামাপ্রসাদ। মেদিনীপুরের মাঠে প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে সংগঠন করা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সেই পদচিহ্ন ধরেই আজকের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির এই জয়যাত্রা – ১৯৫২ র জনসংঘ এবং ১৯৭৭ এর জনতা দলের সাফল্যের এক ঐতিহাসিক পরম্পরা।

মেদিনীপুরের মাটি সংগ্রামের মাটি, বিপ্লবের মাটি, নতুন ইতিহাস লিখে যাওয়ার মাটি। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বৌদ্ধ ধর্মের অগ্রগণ্য প্রধান পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল তাম্রলিপ্ত শহর (ক্লডিয়াস টলেমি’র ‘পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থ)। মেদিনীপুরের মাটিতে দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের ইউনিয়ন বোর্ড বিরোধী আন্দোলন শুধু সারা দেশের প্রথম সফল কৃষক আন্দোলনই নয়; বরং ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে উজ্জ্বল অক্ষরে মেদিনীপুর ভূখণ্ডের নাম লেখা থাকবে, কখনোই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না হওয়ার কারনে। অবশিষ্ট ভারতবর্ষে স্বাধীনতার পতাকা উঠেছিল, ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট। মেদিনীপুরের মাটিতে সুশীল ধাড়া -সতীশ সামন্ত -অজয় মুখার্জিদের হাত ধরে ‘তাম্রলিপ্ত স্বাধীন সরকার’ গঠিত হয়েছিল ১৯৪২ এ। এই বাংলায় প্রায় সব সূচনার উজ্জ্বল পথ মেদিনীপুরই বরাবর তৈরি করেছে। মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামের হাত ধরে বামফ্রন্ট শাসনের একটা যুগের অবসানের সাক্ষী থেকেছে গোটা দেশ। আর এবারের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল, আর এক শুভ সূচনার ভিত্তি স্থাপন করলো, নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে এ জেলার প্রায় সবগুলো বিধানসভা আসনে বিজেপির জয়লাভের মাধ্যমে। লোকসভা নির্বাচনের বিধানসভার ফলাফলের নিরিখে পূর্ব মেদিনীপুরের এই জয়যাত্রা ইতিহাসের কোন মাইলস্টোন কিনা অপেক্ষা করবে গোটা দেশ।

তাং – ৬ই জুলাই,২০২৪।

বিশেষ কৃতজ্ঞতা ডক্টর অনির্বাণ গাঙ্গুলি মহাশয়কে। যিনি এইরকম একটি বিষয়ে গবেষণার জন্য আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন।

তথ্য ঋণ:

  1. ভারত কেশরী যুগপুরুষ শ্যামাপ্রসাদ – তথাগত রায়
  2. অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় – কমল মুখার্জী
  3. কাশ্মীর মঞ্চে শ্যামাপ্রসাদ – রুদ্র প্রতাপ চট্টোপাধ্যায়
  4. শ্যামাপ্রসাদের ডায়েরি মৃত্যু প্রসঙ্গ – উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত
  5. রাষ্ট্র সংগ্রামের এক অধ্যায় – শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
  6. বাঙালি পরিত্রাথা শ্যামাপ্রসাদ – ড. দীনেশচন্দ্র সিংহ
  7. Election Commission of India. STATISTICAL REPORT ON GENERAL ELECTION, (1952, 1957, 1962, 1967, 1972 & 1977) TO THE LEGISLATIVE ASSEMBLY OF WEST BENGAL
  8. বাংলাদেশের ইতিহাস – রমেশ চন্দ্র মজুমদার
  9. স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের পরিকল্পনা; প্রয়াস ও পরিণতি – অমলেন্দু দে
  10. স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫ – ১৯৪৭) -অমলেশ ত্রিপাঠি
  11. ভারতীয় জনতা পার্টি, পশ্চিমবঙ্গ- প্রতাপ ব্যানার্জি
  12. Bhartiya Janata Party the rise of Modi and Indian Foreign Policy – Raja Qaizer Ahmed
  13. Google

Author