Dr. Syama Prasad Mookerjee Research Foundation

ভারতীয় বিপ্লববাদের ওপর ‘আনন্দ মঠ’-এর প্রভাব

একটা জাতির উঠা-পড়া, বাঁচা-মরা কারো অনুগ্রহে হয় না, নিগ্রহেও হয় না; সে
বাঁচা-মরার একটা নিয়ম আছে; সেই নিয়মের ব্যতিক্রমে আমরা মরিও নাই, বাঁচিও না।

মৃত্যুকে বরণ করে অনেক জাতি বাঁচে, আবার বাঁচাকে আঁকড়ে থেকে অনেক জাতি মরে।
ভোগকে ত্যাগের দ্বারা সত্য করে তুলতে হয়; সেই খবর না জানলে, ভোগ সম্ভব হয় না।
উপনিষদে আছে, ‘তেন ত্যজেন ভুজীথাঃ।’১

স্বদেশীযুগের বাঙ্গালী ত্যাগের মন্ত্র উচ্চারণ করেছিল। সেই ত্যাগ-মন্ত্রে
দীক্ষিত হয়েই বাংলার যুবজন শেষে বিপ্লবের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আর সেই মন্ত্র বিপ্লবীদের হাতে তুলে সাহিত্য সম্রাট তাঁর আনন্দমঠ উপন্যাসের
মাধ্যমে।
আনন্দমঠ’ উপন্যাসের মধ্যদিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে
দেশবাসীকে বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়েছেন। সন্ন্যাসের নতুন আদর্শ প্রচার করে
তিনি মাতৃমুক্তি যজ্ঞে নিবেদিতপ্রাণ একদল রাজনৈতিক সন্ন্যাসীর কথা বলেন।
যাঁদের মূল উদ্দেশ্য হবে মানবমুক্তি, দেশমাতৃকার মুক্তি এবং মানব কল্যাণ।
যাঁদের এক হাতে থাকবে মায়ের পূজার ফুল এবং অন্য হাতে থাকবে অস্ত্র। অর্থাৎ
সন্ন্যাসীরা একদিকে যেমন মাতৃমুক্তির মাধ্যমে দেশবাসীর কল্যান করবেন অন্যদিকে
সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের পতন করবেন।বঙ্কিমচন্দ্র
বিপ্লবী এবং চরমপন্থী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।

ভারতীয় বিপ্লববাদের উন্মেষ ও বিকাশে ‘আনন্দ মঠ’ এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী।
উনিশ শতকের শেষ পাদে ঋষি বঙ্কিমের ধ্যাননেত্রে আগামী যুগের সমাসন্ন বিপ্লববাদী
কার্যকলাপ, আদর্শ ও বিপ্লবী সংগঠনের রূপ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল এবং ‘আনন্দ মঠ’-
এর সন্তানদলের অনুকরণেই পরবর্তীকালে ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নানা বিপ্লববাদী
গুপ্ত সমিতি। এইসব সমিতিগুলির আদর্শ ও কর্মপদ্ধতির সঙ্গে ‘আনন্দ মঠ’-এর এক
অদ্ভুত সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। এ দিক থেকে বলা যায় যে, বঙ্কিমচন্দ্রই হলেন
আধুনিক ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী বৈপ্লবিক আন্দোলনের প্রবর্তক, রূপকার, পুরোহিত,
মন্ত্রগুরু ও ঋষি। ভারতীয় বিপ্লবীদের কাছে ‘আনন্দ মঠ’ ছিল প্রেরণার
প্রতীক-নিষ্কাম স্বদেশপ্রেমের দীক্ষায় একটি স্বয়ং-সম্পূর্ণ গ্রন্থ-‘স্বরাজ
গীতা’। সমগ্র ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাসের প্রাণবাণী ‘বন্দে মাতরম্’ মহাসংগীত, এবং এই
মাতৃমন্ত্র কণ্ঠে নিয়েই দেশপ্রেমিক বিপ্লবীরা সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বিরুদ্ধে
মরণ-পণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, সহ্য করেছিলেন নির্মম নিষ্পেষণ এবং
হাসিমুখে গলায় তুলে নিয়েছিলেন ফাঁসির দড়ি।

আনন্দমঠ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শিক ভিত্তি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করেছিলেন। এটা শুধু একটি গল্প ছিল না; এটি মানুষকে স্বাধীনতা সম্পর্কে
দৃঢ়ভাবে চিন্তা ও অনুভব করতে বাধ্য করেছে। কারণের প্রতি চরিত্রের উৎসর্গ
পাঠকদের অনুপ্রাণিত করেছে। বইটি মানুষকে একত্রিত করেছে এবং সম্মিলিত চেতনা এবং
স্বাধীনতার জন্য একটি ভাগ করা অঙ্গীকার প্রজ্বলিত করেছে। বছরের পর বছর ধরে,
এটি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে
উঠেছে যারা চরিত্রগুলির ত্যাগ এবং দেশপ্রেমের থেকে শক্তি এবং অনুপ্রেরণা
নিয়েছিল ।

১৯১৭ সালে সিমলা থেকে প্রকাশিত উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী জেমস্ ক্যাম্পেল কার
রচিত ভারতীয় বিপ্লব আন্দোলনের গোপন দলিল ‘Political Trouble in India 1907-
17’ নামক সরকারি রিপোর্টে বলা হচ্ছে যে-“বাংলার স্কট বলে কথিত বঙ্কিমচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় লিখিত ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাসটি বাংলার বিপ্লবীদের গভীরভাবে প্রভাবিত
করেছিল।…. বাংলার বিপ্লবী সংগঠনগুলির নেতারা এই উপন্যাসের বহু চিন্তাধারা
গ্রহণ করেছিলেন। ‘আনন্দ মঠ’-এর সন্তানদলের দীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতির সঙ্গে ঢাকা
অনুশীলন সমিতির সদস্যদের ‘বিশেষ প্রতিজ্ঞা’-র এক অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। ‘বন্দে
মাতরম্’ এখন চরমপন্থী বাংলার রণধ্বনিতে পরিণত হয়েছে।” (“A work of fiction
which exercised great influence over the Bengali revolutionaries was the
novel entitled Ananda Math (The Abbey of Bliss) by Bankim Chandra
Chatterji, whom it is the fashion to call the Walter Scott of Bengal…
Many ideas were afterwards borrowed from this novel by the leaders of the
Bengal revolutionary societies, and the special vow taken by the members of
the Anusilan Samiti of Dacca was practically the same as that imposed upon
the Children. The greeting “Bande Mataram” became the war-cry of the
extremist party in Bengal….”)।২

উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী লর্ড রোন্যান্ডশ্যে (Lord Rolandshay) রচিত ‘দি হার্ট
অব আর্যাবর্ত’ (‘The Heart of Aryavarta’) গ্রন্থেও অনুরূপ মতামত প্রকাশিত
হয়েছে। বলা হচ্ছে যে, এই গ্রন্থটি দ্বারা বিপ্লবীরা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত
হয়েছিল, (“….it should have been upon this very book that the
revolutionaries should have drawn so deeply for inspiration.”)৩,এবং বাংলার
গুপ্ত সমিতিগুলি ‘আনন্দ মঠ’-এর সন্তানদলের অনুকরণে গঠিত হয় (“….the secret
societies modelled themselves closely upon the society of the children of
‘Ananda Math’.”)৪। এই গ্রন্থের একটি সম্পূর্ণ পরিচ্ছেদে তিনি ‘আনন্দ মঠ’ নিয়ে
আলোচনা করেছেন।৫ গ্রন্থের অন্যত্র তিনি বলছেন যে, বিপ্লবী দলে আনার জন্য
তরুণদের ‘আনন্দ মঠ’ পড়তে দেওয়া হত।৬ তাঁর মতে, ‘আনন্দ মঠ’ হল একটি ‘remarkable
book’।৭
পদস্থ রাজকর্মচারী স্যার ভারনি লোভেট (Sir Verney Lovett)-ও ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে
প্রকাশিত এক গ্রন্থে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে ‘আনন্দ মঠ’ সম্পর্কে আলোচনা
করেছেন।’ ৮ তাঁর মতে বর্তমানকালের বিপ্লবীদের রাজনৈতিক ডাকাতির সূচনা ‘আনন্দ
মঠ’ গ্রন্থ থেকেই। (“The methods of the Sanyasis in the famous novel of
Bankim Chandra, the Ananda Math (Monastery of Joy), vaguely foreshadow the
political robberies of the Revolutionaries of present times.”)।

ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, অন্যান্য সকল বিষয় অপেক্ষা বিপ্লববাদ
‘আনন্দ মঠ’ দ্বারাই বেশি প্রভাবিত হয়েছিল- “Anandamath….inspired and
stimulated militant nationalism more than anything else.”৯ বঙ্গীয় বিপ্লববাদ
ও বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যতম প্রবল সমালোচক বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো-ও স্বীকার
করেছেন- “আমাদের এই বিপ্লববাদে বঙ্কিমচন্দ্রের দান বিস্তর।১০ ‘সন্ত্রাসবাদ ও
সাম্প্রদায়িকতা’ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে জনৈক বামপন্থী লেখক সন্ত্রাসবাদী (?)
রাজনীতির ওপর “উনিশ শতকের সব থেকে প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবী”
(?) বঙ্কিমের প্রভাব স্বীকার করেছেন। তিনি লিখছেন, “সাধারণভাবে ভারতীয় জাতীয়
আন্দোলনের উপর বঙ্কিমচন্দ্রের যে প্রভাব ছিলো তার থেকে সে প্রভাব অনেক বেশী
ছিলো সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের উপর। “১১

বিশিষ্ট প্রবাসী বাঙালী বুদ্ধিজীবী নীরদচন্দ্র চৌধুরী কিন্তু এ বক্তব্য সমর্থন
করেন না। তিনি লিখেছেন:
” ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৮২ ইং সনে। তখন হইতে আজ
পর্যন্ত এই উপন্যাস সম্বন্ধে বাঙালীরা যাহা বলিতেছে, তাহার মতো ভিত্তিহীন বাজে
কথা কোনও বিষয়ে শোনা যায় নাই। বাঙালী বিপ্লববাদীরা ইহাকে তাঁহাদের ‘বেদ’ বলিয়া
গ্রহণ করিয়াছিল এবং ভাবিয়াছিল ইহাতে রাজনৈতিক হত্যা ও ডাকাতির সমর্থন আছে।
আশ্চর্যের কথা এই যে, এইরূপ মত পোষণ করিবার আগে বিপ্লববাদীরা ছাড়া সাহিত্য
সমালোচকেরাও বঙ্কিমচন্দ্রের নিজের উক্তিকে অগ্রাহ্য করিয়াছিলেন; এই সময়ে
বঙ্কিমচন্দ্র এই উপন্যাসটি কেন লিখিলেন তাহাও প্রণিধান করিয়া দেখেন নাই।
প্রথমে বঙ্কিমচন্দ্রের কথাই উদ্ধৃত করিব। তিনি প্রথম সংস্করণের বিজ্ঞাপনে এই
কথা লেখেন যে- ‘সমাজবিপ্লব অনেক সময়েই আত্মপীড়ন মাত্র। বিদ্রোহীরা আত্মঘাতী।
ইংরেজরা বাঙলাদেশ অরাজকতা হইতে উদ্ধার করিয়াছেন। এই সকল কথা এই গ্রন্থে বুঝানো
গেল।”১২

প্রাজ্ঞ পণ্ডিতের এই বক্তব্য সত্ত্বেও আমাদের মানতে হবে যে, বিপ্লবী আন্দোলন,
তার কর্মপন্থা, বিপ্লবী সংগঠন ও বিপ্লবীদের ব্যক্তিগত জীবনচর্যায় ‘আনন্দ
মঠ’-এর বিস্ময়কর প্রভাব দেখা যায়। আলোচ্য অধ্যায়ে এই প্রভাবের একটি রূপরেখা
তুলে ধরা হল।

লক্ষ্য: স্বৈরাচারী পরশাসনাধীনে নির্যাতিত ‘আনন্দ মঠ’-এর সন্তানদলের একমাত্র
লক্ষ্য হল দেশের স্বাধীনতা অর্জন-পূর্ণ স্বাধীনতা। ইংরেজের অধীনে থেকে
‘নিষ্কণ্টকে ধর্মাচরণ’ বা ‘জ্ঞানলাভ’ নয়-“আমি জ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষা রাখি
না-জ্ঞানে আমার কাজ নাই-আমি যে ব্রতে ব্রতী হইয়াছি, ইহাই পালন করিব।” মঠাধীশ
সত্যানন্দের প্রতিজ্ঞা-
“শত্রুশোণিতে সিক্ত করে তিনি মাতাকে শস্যশালিনী করবেন, আর একাজে ব্যর্থ হলে
“মাতৃপ্রতিমা সম্মুখে দেহত্যাগ করিব।” দেশপ্রেমিক ভারতীয় বিপ্লবীদেরও লক্ষ্য
ছিল তাই-দেশের পূর্ণ স্বাধীনতা-“absolute autonomy, free from foreign
control”- বিদেশি নিয়ন্ত্রণমুক্ত পূর্ণ স্বরাজ লাভ। বঙ্গীয় বিপ্লববাদের
দীক্ষাগুরু অরবিন্দ ঘোষের মতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা একটি জাতির প্রাণবায়ু
স্বরূপ। সর্বাগ্রে রাজনৈতিক স্বাধীনতার চেষ্টা না করে সমাজ, শিক্ষা, শিল্প ও
নৈতিক উন্নতির প্রয়াস হবে চরম ব্যর্থতা ও মুঢ়তার পরিচায়ক। (“Political freedom
is the life-breath of a nation; to attempt social reform, educational
reform, industrial expansion, the moral improvement of the race without
aiming first and foremost at political freedom, is the very height of
ignorance and futility.”)১৩। তাঁর মতে, ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের লক্ষ্য হল
‘স্বরাজ’-ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণমুক্ত পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন। (“Our ideal is that
of Swaraj or absolute autonomy free from foreign control.”)। তাঁর মতে
‘স্বরাজ’ হল জাতীয় জীবনের উন্নতির প্রথম সোপান। মানব সমাজের উন্নয়নের ঊর্ধ্বতন
স্তরে ‘স্বরাজ’ কোনো প্রকার বস্তুতান্ত্রিক সামগ্রী নয়-‘স্বরাজ’ হল
আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও যৌগিক অগ্রগতি। ‘স্বরাজ’ অর্জনের পর ভারতবর্ষ আর কোনো
বিশেষ জাতির অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য কারো ক্রীতদাস হয়ে
থাকবে না-বরং একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বমানবের আধ্যাত্মিক ও মানসিক
মুক্তিযজ্ঞে নেতৃত্ব দেবে।
কিন্তু এই ‘স্বরাজ’ অর্জনের জন্য:

“তোমার পণ কি?”

-“পণ আমার জীবনসর্বস্ব।”

-“জীবন তুচ্ছ, সকলেই দিতে পারে।”

-তাহলে?

“ভক্তি”-ভক্তি চাই।

অনুশীলন সমিতি-র অন্যতম নেতা বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী লিখছেন যে,
বিপ্লবী অনুশীলন সমিতির “নেতারা এরূপ একটি আদর্শ সমাজ কল্পনা করিয়াছিলেন যে,
সমাজের প্রত্যেকটি নরনারীর মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ হইবে।…. অনুশীলন কল্পিত
সমাজে প্রত্যেক মানুষ স্বাস্থ্যবান, কর্মঠ, বলিষ্ঠ এবং দীর্ঘায়ু হইবে।…
প্রত্যেক নরনারী বিদ্বান, চরিত্রবান, সাহসী ও দয়ালু হইবে।… মানব সমাজ হইতে
ধন-বৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক বৈষম্য, প্রাদেশিক বৈষম্য দূর করিয়া
সকল মানুষের মধ্যে সমতা আনিতে হইবে। ইহা একমাত্র জাতীয় গভর্নমেন্ট দ্বারাই
সম্ভবপর… তাই পরাধীনতার বিরুদ্ধে অনুশীলনের বিদ্রোহ ঘোষণা। অনুশীলন চায়
ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা।” ১৪ স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে বিপ্লবীরা তাঁদের
জীবন-যৌবন-ধন-মান-সবই মাতৃসেবায় উৎসর্গ করেছিলেন। মৃত্যু তাঁদের কাছে ছিল
দেহান্তর গমন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় বলছেন-“হে ফিরিঙ্গী, আমি এইখানে আমার
কন্ঠদেশ প্রলম্বিত করে দাঁড়িয়ে বলি-প্রদানের জন্য প্রস্তুত।” বিপ্লবী
বারীন্দ্রকুমার ঘোষ বলছেন-“দেশজননীর বন্ধন মোচনের জন্য নিজের প্রাণ বলি দেওয়ার
নেশাই আমাদের টেনেছিল বেশী। মৃত্যুর বুকে আছে অমোঘবীর্য্য জীবনের মন্ত্র,
পরার্থে জীবন-দানের সঙ্কল্পই আমাদের তখনকার বিপ্লবমন্ত্রকে আমাদের চক্ষে করে
তুলেছিল এতখানি শক্তি-ব্যঞ্জক ও পরম পুণ্যময় বেদমন্ত্র তুল্য।”১৬ অন্যত্র তিনি
লিখছেন-“বেদ ভুলে যাও, বেদান্ত ভুলে যাও, উপনিষদ ভুলে যাও, মাতৃভূমিকে রক্ত
দিয়ে মুক্ত করো।” দেশমাতৃকার মুক্তির উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গের জন্য সকল
বিপ্লবীই প্রস্তুত ছিলেন। বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ এবং যুগান্তর, সন্ধ্যা, বন্দে
মাতরম্ প্রভৃতি পত্রিকায় দেশবাসীকে বারংবার মৃত্যুবরণের আহ্বান জানান হয়েছে।
বাস্তবেও দেখা গেছে বিপ্লবীরা হাসিমুখে মৃত্যুর সঙ্গে মিতালি করেছেন,
মৃত্যুপথগামী ফাঁসির আসামী মাতার জয়ধ্বনি করতে করতে পরম সোহাগভরে ফাঁসির দড়ি
চুম্বন করেছেন। মাতৃমুক্তি সাধনায় জীবন-মৃত্যু তাঁদের পায়ের ভৃত্য ছাড়া অন্য
কিছু ছিল না।১৭

বঙ্কিমচন্দ্রএই উপন্যাসের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, দেশের স্বাধীনতা আসবে ত‍্যাগ
মন্ত্রে দীক্ষিত একনিষ্ঠ সন্ন্যাসী সত্যানন্দের মত প্রকৃত নেতার অধীনে এবং
সন্তানদলের আত্মবল,দেশপ্রেম ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে, আবেদন-নিবেদনের
মাধ্যমে নয়।পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্রের দেখানো পথেই ভারতবর্ষের স্বদেশী
আন্দোলনে সশস্ত্র বিপ্লবী ও অগ্নিযুগের সূচনা হয়, যাঁরা চরমপন্থায় বিশ্বাসী
ছিলেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে জন্মভূমি নিছক জনসমষ্টি বা ভৌগোলিক অঞ্চল নয়। তিনি
জন্মভূমিকে মাতৃরূপে এবং দেবীরূপে কল্পনা করেছেন। যে কারণে তিনি ভবানন্দের
জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন- “আমরা অন্য মামানি না-জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি
গরীয়সী।আমরা বলি, জন্মভূমিই জননী, আমাদের মা নাই,বাপ নাই,ভাই নাই, স্ত্রী
নাই,পুত্র নাই, ঘর নাই, বাড়ি নাই, আমাদের আছে কেবল সেই সুজলা, সুফলা,
মলয়জসমীরনশীতলা, শস্যশ্যামলা।”২বঙ্কিমচন্দ্র এই উপন্যাসের মাধ্যমে দেশবাসীকে
বুঝিয়েছেন যে, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নিচ সকলের সমবেত প্রচেষ্টা ও
জাগরনের মধ্যদিয়েই দেশমাতৃকার মুক্তির সম্ভব। তাই সত্যানন্দ সন্তানদলকে
দীক্ষিত করতে গিয়ে বলেছেন, “সকল সন্তান একজাতীয়।এ মহাব্রতে ব্রাহ্মণ শূদ্র
বিচার নাই।”

উপন্যাসের মাতৃমূর্তি :-
আনন্দ মঠ’-এর সন্তানদলের কাছে দেশই ছিল মা। এই মহাগ্রন্থে মায়ের ত্রিমূর্তি
প্রদর্শিত হয়েছে। অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ভারতবর্ষ-মা যা ছিলেন’। স্বৈরাচারী
অপশাসনে মা হৃতসর্বস্বা, দেশ শ্মশানে পরিণত হয়েছে, মা অন্ধকারসমাচ্ছন্না কালী
কালিমাময়ী ‘মা যা হইয়াছেন’। দেশপ্রেমিক সন্তানদলের ধ্যাননেত্র, স্বপ্ন, সাধনা,
ও কল্পনায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে মায়ের এক সর্বাবয়ব ঐশ্বর্যময়ী মূর্তি-বিদ্যা,
বুদ্ধি, সামরিক বল, জ্ঞানৈশ্বর্য, ধনের মহিমা ও গণশক্তির অপূর্ব সমন্বয়ে গড়ে
উঠবে আগামী দিনের নতুন ভারতবর্ষ-‘মা যা হইবেন’। অন্ধকার সমাচ্ছন্না কালিমাময়ী
মা’কে হৃত- সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করাই হল ‘আনন্দ মঠ’-এর গৈরিকধারী ত্যাগী
সন্তানদের একমাত্র ধর্ম, লক্ষ্য, সাধনা, কামনা ও বাসনা-এ লক্ষ্যেই ধাবিত হয়েছে
তাঁদের সকল কর্মপ্রয়াস। দেশের স্বাধীনতা অর্জনেই মায়ের মুক্তি এবং সন্তানদলের
মোক্ষপ্রাপ্তি। বিশ শতকের সূচনায় বাংলার বুকে যে মুক্তিপাগল তরুণদের আবির্ভাব
হল তাঁদের কাছে দেশই ছিল মা, এবং দেশের মুক্তি সাধনাই ছিল তাঁদের একমাত্র
ধর্ম, সাধনা, কামনা ও বাসনা। মায়ের মুক্তির জন্যই একদিন তাঁরা ঘর-বাড়ি
পিতা-মাতা স্ত্রী-পুত্র ধন-সম্পদ-সর্বস্ব ত্যাগ করে বিপদসঙ্কুল মৃত্যুসাগরে
ঝাঁপ দিয়েছিলেন।১৮

‘আনন্দ মঠ’-এ মায়ের ত্রিমূর্তি বর্ণনার মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র স্বাধীনতা
সংগ্রামীদের ইতিহাসচর্চার আহ্বান জানিয়েছেন। বলাবাহুল্য, বিপ্লবী সমিতিগুলিতে
দেশ বিদেশের ইতিহাস পাঠ এবং সাম্রাজ্যবাদী শাসনাধীনে দেশের অর্থনৈতিক
দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরা হত। কলকাতার বিপ্লবী ‘অনুশীলন সমিতি’-র তরুণ
সদস্যদের ব্যারিষ্টার প্রমথনাথ মিত্র সিপাহী বিদ্রোহ, শিখ অভ্যুত্থান এবং
ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস পড়াতেন। সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়াতেন ইতালি, আমেরিকা,
আইরিশ, ডাচ এবং অপরাপর নানা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। মারাঠী সখারাম
গণেশ দেউস্কর তরুণদলের সামনে তুলে ধরতেন ব্রিটিশ ভারতের আর্থিক শোষণের ইতিহাস
এবং এভাবেই তাঁর বিখ্যাত ‘দেশের কথা’ বইটি রচিত হয়। ১৯
আনন্দ মঠ’-এ বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে ‘সন্তান’ সংগ্রহ করা হত। মহেন্দ্র সম্পর্কে
সত্যানন্দ জীবানন্দকে বলছেন “যত দিন সে কায়মনোবাক্যে মাতৃভক্ত না হয়, তত দিন
তাহাকে গ্রহণ করিও না। তোমাদিগের হাতের কাজ সমাপ্ত হইলে তোমরা ভিন্ন ভিন্ন
সময়ে উহার অনুসরণ করিও, সময় দেখিলে উহাকে শ্রীবিষ্ণুমন্দিরে উপস্থিত
করিও।”-অর্থাৎ সংঘে গ্রহণের পূর্বে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিষ্ঠা ও আচরণ ভাল করে
দেখা দরকার। মহেন্দ্রর সঙ্গে আরেক ব্যক্তি সন্তানধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল।
সত্যানন্দ বলছেন- “তাহাকে সন্তানের কার্য্য শিক্ষা করাইবার ভার জীবানন্দের
প্রতি রহিল। কেন না, জীবানন্দ লোকের চিত্তাকর্ষণে বড় সুদক্ষ ।” বাংলার বিপ্লবী
সমিতির নেতারাও ঠিক এভাবেই ‘লোকের চিত্তাকর্ষণে বড় সুদক্ষ’ ব্যক্তিদের মাধ্যমে
নতুন সদস্য সংগ্রহ করতেন। বাংলাদেশে গোপন ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনা, আখড়া এবং
স্কুল-কলেজগুলোই ছিল সভ্য সংগ্রহের উর্বর ক্ষেত্র। ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের বিবৃতি
থেকে জানা যায় যে, এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত সদস্যেরা গোলদীঘি, হেদুয়া, কলেজ,
হোস্টেল বা বার-লাইব্রেরিতে গিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন।২০ স্কুল-কলেজ,
আমোদ-প্রমোদের স্থান, বিভিন্ন উৎসবে আত্মীয়ের সমাবেশ, জনহিতকর কার্য,
ছাত্রাবাস, স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও ব্যায়াম শিক্ষকদের মাধ্যমে নতুন সদস্য
সংগ্রহ করা হত। ২১ বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার বলছেন-“আমার অস্পষ্ট মনে আছে,

সখারামবাবুকে নিয়ে ছেলে-ধরার কাজে যাত্রার কথা এবং চাঁদের আলোয় আলো-করা
গঙ্গাতীরে বাঁধানো ঘাটের উপর একদল তরুণকে নিয়ে আমাদের এই প্রাণ-মাতানো আলোচনা।
সেটি বোধ হয় খড়দহের গঙ্গাতীরের ঘটনা।”২২এছাড়া, কলকাতার পার্কে পার্কে এই
ছেলে-ধরার দল সকাল-সন্ধ্যা উত্তপ্ত রাজনৈতিক আলোচনা শুরু করতেন। এর আকর্ষণে
তরুণদল সেখানে সমবেত হত এবং সেখান থেকে সংগ্রহ করা হত ভাবী বিপ্লবীদের। হেদুয়া
এবং কলেজ স্কোয়ার ছিল এর প্রধান কেন্দ্র। কলুটোলার কবিরাজ সি কে সেনদের বাড়ির
একজন বারীন্দ্রের চন্দরদা এই ছেলে ধরার কাজে খুব দক্ষ ছিলেন।২৩ পরে উপযুক্ত
মনে করলে অর্থাৎ ‘কায়মনোবাক্যে মাতৃভক্ত’ হলে, তবেই এই সব ছেলেদের দীক্ষা
দেওয়া হত।

আনন্দ মঠ’-এর সন্তানদলকে ‘স্নাত, সংযত এবং অনশন’-রত অবস্থায় দেবমূর্তির সামনে
দীক্ষা গ্রহণ করতে হোতো। তাঁরা প্রতিজ্ঞা করতেন যে, যতদিন না মাতার উদ্ধার হয়,
ততদিন তাঁরা গৃহধর্ম মাতা-পিতা ভ্রাতা-ভগিনী দারা- সুত আত্মীয়-স্বজন দাস-দাসী
ধন-সম্পদ-ভোগ এবং ইন্দ্রিয়াসক্তি ত্যাগ করবেন- উপার্জিত অর্থ জমা দেবেন সাধারণ
ধনাগারে এবং রণে ভঙ্গ দিলে বা প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করলে আত্মহত্যার দ্বারা
প্রায়শ্চিত্ত করবেন । বেইমানির শাস্তি ছিল মৃত্যু- “সন্তানেরাই বিশ্বাসঘাতী
বলিয়া মারিয়া ফেলিয়া চলিয়া যাইবে ।” বলাবাহুল্য, বাংলার বিপ্লবী সমিতিগুলিতেও
এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে নি। সিডিসন কমিটির রিপোর্ট, পদস্থ রাজকর্মচারী জেমস্
ক্যাম্পবেল কার-এর গোপন রিপোর্ট Political Trouble in India 1907-17, ঢাকার
জেলা শাসক H. C. Salkeld (Magistrate on special duty)-এর ঢাকা অনুশীলন সমিতি
সংক্রান্ত রিপোর্ট (Anushilan Samity, Dacca, Part I-IV, 1908), J. E.
Armstrong (Superintendent of Police on Special duty)- এর অনুশীলন সমিতি
সংক্রান্ত রিপোর্ট (An Account of the Revolutionary organi- sations in
Eastern Bengal with special reference to Dacca Anushilan Samiti, Vol I and
II), জীবনতারা হালদার লিখিত, ‘অনুশীলন সমিতির ইতিহাস’, ত্রৈলোক্যনাথ
চক্রবর্তীর ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’, পুলিনবিহারী
দাসের ‘আত্মকথা’, প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলীর ‘বিপ্লবীর জীবন দর্শন’, ঐতিহাসিক
রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ (৪র্থ খণ্ড) এবং তাঁর ইংরেজি
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস (২য় খণ্ড) প্রভৃতি গ্রন্থে বিপ্লবী সংগঠন, সংগঠনের
নিয়মাবলী ও দীক্ষাগ্রহণ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা আছে। ‘অনুশীলন
সমিতি’-তে ‘আদ্য প্রতিজ্ঞা’, ‘অন্ত্য প্রতিজ্ঞা’, ‘প্রথম বিশেষ প্রতিজ্ঞা’ ও
‘দ্বিতীয় বিশেষ প্রতিজ্ঞা’ নামে চার ধরনের প্রতিজ্ঞা ছিল। নতুন সভ্যরা ‘আদ্য
প্রতিজ্ঞা’ গ্রহণ করতেন এবং পরে ধীরে ধীরে তাঁরা উচ্চতর পর্যায়ের প্রতিজ্ঞা
গ্রহণ করতেন। বলাবাহুল্য, এইসব প্রতিজ্ঞার সঙ্গে ‘আনন্দ মঠ’-এর প্রতিজ্ঞার
অপূর্ব সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।২৪

H. L. Salkeld তাঁর রিপোর্টে ‘The Bisesh Pratijna and Anandamath শিরোনামায়
লিখছেন যে:

” ‘অনুশীলন সমিতি’-র ‘বিশেষ প্রতিজ্ঞা’ সম্পর্কে একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এটি সম্পূর্ণভাবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দ মঠ’ থেকে নেওয়া হয়েছে।
‘বিশেষ প্রতিজ্ঞা’ ও ‘আনন্দ মঠ’-এর দ্বিতীয় খণ্ড পঞ্চম পরিচ্ছেদের মধ্যে কতটা
ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য আছে তা পাশাপাশি ফেলে দেখানো হল। ‘আনন্দ মঠ’-এ সত্যানন্দ
বিষ্ণুমূর্তির সামনে মহেন্দ্র ও অপর একজনকে দীক্ষিত করছেন। প্রশ্ন ও উত্তর
আকারে এই প্রতিজ্ঞা রচিত হয়েছে, কিন্তু জাগতিক সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার
ব্যাপারে দুটি প্রতিজ্ঞাই এক রকম। দুটি ক্ষেত্রেই প্রতিজ্ঞাতে ব্যবহৃত
শব্দাবলী একই রকম।” (“Lastly, an important fact must be noticed regarding
the Bisesh Pratijna. It is taken bodily from the Anandamath of Bankim
Chandra Chatterjee. How closely the Bisesh Pratijna follows the fifth
chapter of the second part is shown by placing the two side by side. In the
Anandamath Satyananda administers the oath to Mahendra and another before
the image of Vishnu. Their vow is there- fore in the form of question and
answer, but the renunciation of all earthly ties is practically the same.
In two cases the words used in the two vows are identical.”)। ২৫

এ কথারই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘Freedom
Struggle and Anushilan Samiti’ গ্রন্থে। সেখানে বলা হচ্ছে যে, “অনুশীলন
সমিতি-র বিশেষ প্রতিজ্ঞা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা উপন্যাস ‘আনন্দ
মঠ’-এর সন্তানদের দীক্ষামন্ত্রের আক্ষরিক অনুসরণ ব্যতীত অন্য কিছু নয়।” (“It
is important to note that these special vows are nothing but verbatim
reproduction of the pledges taken by Santans (sons) in the Bengali novel
Anandamath of Bankim Chandra Chatterjee.”) / James Campbell Ker রচিত
‘Political Trouble in India 1907-17’ নামক গোপন রিপোর্টেও ঐ একই কথা বলা
হয়েছে-“It is interesting to notice that this special vow (প্রথম বিশেষ
প্রতিজ্ঞা) is practically a paraphrase of the vow taken by the Santans, or
Children, in Bankim Chandra Chatterji’s novel Ananda Math.”২৬

জেমস্ ক্যাম্পবেল কার-এর রিপোর্টে বলা হচ্ছে যে, অনুশীলন সমিতি-র
‘প্রতিজ্ঞা’-য় ‘আনন্দ মঠ’-এ কথিত সন্তানের সকল আয় ‘বৈষ্ণব ধনাগারে’ জমা দেওয়া,
‘ধর্ম’ রক্ষার্থে অস্ত্রধারণ ও যুদ্ধ, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন না করা প্রভৃতি
কথার কোনো উল্লেখ নেই। (“The Samiti vow does not include the promises to
hand over all earnings to the society, to take up arms and fight for
religion, and never to fly from the battlefield, which were made by the
Children in the novel, but the context, would be well known to most of the
1. embers.”)২৭

‘আনন্দ মঠ’-এ দীক্ষা-গ্রহণকারীকে স্নাত, সংযত ও অনশন-রত থাকতে হতো। সব
দীক্ষার্থীর জন্য এই একই নিয়ম। অনুশীলন সমিতিতে দীক্ষাগ্রহণকারীকে একবেলা
হবিষ্যান্ন আহার করে ও একবেলা উপবাসী থেকে পরের দিন স্নান সেরে ও শুভ্রবস্ত্র
পরিধান করে দীক্ষা গ্রহণ করতে হত। দীক্ষাগুরু ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, পুষ্প-
চন্দনাদি সাজিয়ে বেদ ও উপনিষদের মন্ত্রপাঠ করে যজ্ঞ করতেন। যজ্ঞের পর শিষ্য
‘প্রত্যালীঢ়াসন’-এ বসতেন এবং দীক্ষাগুরু শিষ্যের মাথার ওপর গীতা ও তাঁর তরবারি
স্থাপন করে দক্ষিণ দিকে দাঁড়াতেন। শিষ্য দু-হাতে ‘প্রতিজ্ঞা পত্র’ ধারণ করে
এবং যজ্ঞাগ্নির সম্মুখে দাঁড়িয়ে তা পাঠ করে শপথ গ্রহণ করতেন। তারপর শিষ্য
যজ্ঞাগ্নি ও দীক্ষাগুরুকে প্রণাম করতেন। এইভাবে অনুষ্ঠান শেষ হতো।২৮ ঢাকা
অনুশীলন সমিতির প্রধান পুলিনবিহারী দাস তাঁর নিজের দীক্ষা গ্রহণ সম্পর্কে
বলছেন-“আমাকে দীক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে স্থির হইলে পি, মিত্র মহাশয়ের নির্দেশ
মত একদিন একবেলা হবিষ্যান্ন আহার করিয়া সংযম পালন করিলাম এবং পরদিন সকালে
গঙ্গাস্নান করিয়া পি. মিত্রের বাড়ী গিয়া তাহার নিকট হইতে দীক্ষা লইলাম। ধূপ,
দীপ, নৈবেদ্যাদি সকল উপাচারে সাজাইয়া ছান্দোগ্যোপনিষদ হইতে বৈদিক মন্ত্র ২৯
পাঠ করিয়া পি. মিত্র যজ্ঞ সমাপন করিলেন। পরে আমি আলীঢ়াসনে বসিলাম, আমার মস্তকে
গীতা স্থাপিত হইল, তাহার উপর অসি রাখিয়া উহা ধরিয়া পি. মিত্র আমার দক্ষিণে
দণ্ডায়মান রহিলেন। আমি যজ্ঞাগ্নির সম্মুখে বসিয়া কাগজে লিখিত প্রতিজ্ঞাপত্র
পাঠ করিয়া প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইলাম।’৩০ অন্যকে দীক্ষা দেবার সময় পুলিন দাস পি.
মিত্রের পদ্ধতিতেই নিজ গৃহে দীক্ষা দিতেন, তবে দীক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলে
“ঢাকা নগরীর উপকণ্ঠে ঈষৎ জঙ্গলাকীর্ণ পুরাতন ও নির্জন ‘সিদ্ধেশ্বরী
কালীমন্দির’-এ যাইয়া একটু জাঁকজমক করিয়াই দীক্ষা দিতাম। দীক্ষাপ্রার্থিগণ এবং
আমি, সকলেই পূর্বদিন একবেলা হবিষ্যান্ন গ্রহণ ও যথাবিধি ‘সংযম’ করিয়া, দীক্ষার
দিনে উপবাসী থাকিয়া স্নানান্তে শুদ্ধ হইয়া পবিত্রভাবে কালীমূর্তির সম্মুখে
যজ্ঞ সম্পন্ন করিয়া প্রত্যেককে ‘প্রতিজ্ঞা-মন্ত্র’ পাঠ করাইয়া লইতাম। তৎকালে
যথাসম্ভব রুদ্রভাব অবলম্বন করিবার মানসে আমি উত্তরীয়সহ কাষায়বস্ত্র পরিধান
করিয়া মস্তকে, হস্তে, বাহুতে ও কণ্ঠে রুদ্রাক্ষের মালা ধারণ করিতাম।

প্রত্যেকেই দীক্ষান্তে কালীমূর্তিকে প্রণাম করিয়া আমাকে প্রণাম করিত।৩১
মুরারীপুকুর, ভবানীপুর এবং অন্যান্য বৈপ্লবিক কেন্দ্রে কালীর ছবি থাকত এবং
ফুল-চন্দনসহ তাঁকে নিত্যপূজা করা হত। ৩২ মেদিনীপুরে জ্ঞানেন্দ্রনাথ,
সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও হেমচন্দ্র কানুনগোর নেতৃত্বে যে গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠেছিল
তার নাম ছিল ‘আনন্দ মঠ’। মেদিনীপুরে একটি শ্রীহীন বাড়ীতে এই ‘আনন্দ মঠ’
প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং সেখানে একটি কালীমূর্তিও ছিল। এই মূর্তির সামনেই সকলে
দীক্ষিত হতেন। ৩৩ ঢাকা অনুশীলন সমিতির পুলিনবিহারী দাস ঢাকা নগরীর উপকণ্ঠে
সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে দীক্ষা দিতেন। যুগান্তর, সন্ধ্যা, বন্দে মাতরম্
প্রভৃতি পত্র পত্রিকার প্রায় প্রত্যেক সংখ্যাতেই মা কালীর আবাহন করা হত এবং
স্বদেশি যুগে বিভিন্ন কবিতা ও গানে যে মাতৃবন্দনা করা হয়েছে, তাতে দেশমাতা ও
মা কালীকে এক ও অভিন্নরূপে দেখানো হয়েছে।

অর্থাৎ এ বিষয়টি স্পষ্ট বিপ্লবীদের কাছে আনন্দমঠের কোন বিকল্প ছিল না।বিপ্লবী
সমিতিতে এটি ছিল একটি অপরিহার্য এবং অবশ্য পাঠ্য গ্রন্থ। তাই কথা বলাই যায়যে
বিপ্লববাদের সূচনা থেকে ৪৭ এর স্বাধীনতা প্রাপ্তি পর্যন্ত সম্পূর্ণ যুগটি ছিল
‘আনন্দমঠ’- এর যুগ।

গ্রন্থ-নির্দেশিকা

১। ( বাংলায় বিপ্লববাদ,নলিনীকিশোর গুহ,প্রকাশক- অমিয় রঞ্জন মুখোপাধ্যায়, এ
মুখার্জি এন্ড কোং লিমিটেড,২ কলেজ স্কোয়ার,কলকাতা ১২)
২। Political Trouble in India 1907-17, James Campbell Ker, বর্তমানে
গ্রন্থাকারে প্রকাশিত, 1973, P. 29-30;
৩। The Heart of Aryavarta, Lord Ronaldshay, London, 1925, P. 106, and
Chapter X. P. 103-15.
৪। do, P. 114.
৫।do, Chapter X, P. 103-15.
৬। do, P. 85-86.
৭।do, P. 86 foot-note.
৮। A History of the Indian Nationalist Movement, Sir Verney Lovett, Lon-
don, 1968, P. 62f. and Appendix II. P. 28If.
৯। History of Freedom Movement in India, Vol I, R.C. Majumdar, 1962,P. 447
(অতঃপর-শুধু Majumdar বলে উল্লিখিত হবে)।
১০। বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা, হেমচন্দ্র কানুনগো, ১৯২৮, পৃঃ ৭৩।
১১। অনীক, বাংলার অগ্নিযুগ সংখ্যা, ১৯৮১, পৃঃ ১০৭।
১২। আমার দেশ আমার শতক, নীরদচন্দ্র চৌধুরী, পৃঃ ১৩৩-৩৪, সত্যের সন্ধানে মুসলিম
সমাজ, আমিনুল ইসলাম, ২০০৬, পৃঃ ১১৬-১৭-তে উদ্ধৃত।
১৩। The Doctrine of Passive Resistance, Sri Aurobindo, Pondicherry, 1966,
P.2.
১৪। Bande Mataram,, 3.7. 1907.
১৫। জেলে ত্রিশ বছর ও ‘পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী,
ময়মনসিংহ, ১৯৬৮, পৃঃ ৯-১০।
১৬। অগ্নিযুগ, প্রথম খণ্ড, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ১৩৫৫, পৃঃ ৭০ (অতঃপর অগ্নিযুগ
বলে উল্লিখিত হবে)।

১৭। আনন্দমঠ ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, জীবন মুখোপাধ্যায়, ১০৩ সীতারাম গোষ স্ট্রীট,
কলকাতা-৭০০০০৯,দ্বীতীয় সংস্করণ ১৫ ই নভেম্বর,২০১০,পৃষ্ঠা -২১০।
১৮। ঐ,পৃষ্ঠা -২১১
১৯। বিপ্লবী জীবনের স্মৃতি, যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, (অতঃপর যাদুগোপাল বলে
উল্লিখিত হবে) ১৯৮২, পৃঃ ১৬৬; অনুশীলন সমিতির ইতিহাস, জীবনতারা হালদার, ১৯৭৭,
পৃঃ ১১ এবং অগ্নিযুগ, প্রথম খণ্ড, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ১৩৫৫, পৃঃ ৭২-৭৩।
২০। ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, ১৯৮৩, পৃঃ ৪৫।
২১।Sedition Committee, P. 20-22 এবং 117-18; ভারতের জাতীয়তাবাদী বৈপ্লবিক
সংগ্রাম, সুপ্রকাশ রায়, ১৯৮৩, পৃঃ ৮১-৮৭ এবং রক্ততীর্থ, পঞ্চানন চক্রবর্তী,
১৯৬৬, পৃঃ ৭৭।
২২। অগ্নিযুগ, পৃঃ ৭৬।
২৩।ঐ, পৃঃ ৭৭।
২৪।আনন্দমঠ ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, জীবন মুখোপাধ্যায়, ১০৩ সীতারাম গোষ স্ট্রীট,
কলকাতা-৭০০০০৯,দ্বীতীয় সংস্করণ ১৫ ই নভেম্বর,২০১০,পৃষ্ঠা -২১৪
২৫। Terrorism in Bengal, vol II, Compiled and Edited by Amiya K. Samanta,
Kolkata, 1995. P. 40.
২৬। Political Trouble in India 1907-17, Ker, 1973, P. 147
২৭। Do.
২৮। ভারতের জাতীয়তাবাদী বৈপ্লবিক সংগ্রাম, সুপ্রকাশ রায়, ১৯৮৩, পৃঃ ৬৬।
২৯। বিপ্লবী পুলিন বিহারী দাস-এর আত্মকথা, সম্পাদনা ভবতোষ রায়, ১৯৬৭, গ্রন্থের
পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য।
৩০। আমার জীবন কাহিনী, পুলিনবিহারী দাস, সম্পাদনা, অমলেন্দু দে, ১৯৮৭, পৃঃ
১৫৪-৫৫।
৩১।বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা, হেমচন্দ্র কানুনগো, ১৯২৮, পৃঃ ২৫৩।
৩২। স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর, প্রথম খণ্ড, বসন্তকুমার দাস, ১৯৮০, পৃঃ
১৪৬; অগ্নিযুগ, পৃঃ ৭৪-৭৫।

Author

  • Suman Kumar Mitra

    Suman Kumar Mitra is a Researcher at Murshidabad Zilla Itihas & Sanskriti Charcha Kendra. He did his MA in Bengali from Rabindra Bharati University and is a Guest Lecturer at D.I.E.T Murshidabad, Berhampur, West Bengal. Views expressed are personal.

    View all posts

(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)