Dr. Syama Prasad Mookerjee Research Foundation

বাংলায় দুর্গা পূজার ইতিহাস

 হিন্দু বাঙালির প্রিয় উৎসব দুর্গা পূজা। শাস্ত্রে যেমন এর উজ্জ্বল বিস্তার পাওয়া যায় তেমনি বাংলায় এর একটি আধ্যাত্মিক পরম্পরা রয়েছে, রয়েছে দুর্গা সাধনার উজ্জ্বল ইতিহাস। মায়ের উপাসনার মূল ভিত্তি কালিকাপুরাণ, দেবীভাগবৎ এবং বৃহৎনন্দীকেশ্বর পূরাণ। উল্লেখ্য রামকৃষ্ণ মিশনের পূজা শেষোক্ত বৃহৎনন্দীকেশ্বর পূরাণ অনুসারে হয়। দুর্গাপূজার আচারের শাস্ত্রগত উল্লেখ মূলত বাসন্তকালের শুক্লা তিথির, শরৎকালের শ্রীরাম চন্দ্রের অকাল বোধনের নয়। শরৎকালের অকালবোধনে এই পূজার উল্লেখ রয়েছে বাল্মিকীর সংস্কৃত রামায়ন রচনা থেকে অনুদিত প্রায় ৩৮ ভাষার মধ্যে কেবল বাংলায় কৃত্তিবাসকৃত রামায়ণে। চর্যাপদের সময়কাল ( ৮ম – ১২শ শতাব্দী ) পেরিয়ে এর রচনাকাল মোটামুটি ১৪০০-১৫০০ খৃষ্টাব্দ। তবে কৃত্তিবাস বিরোচিত রামায়ণের আখ্যান বাংলার সংস্কৃতি চরিত্র ও ভৌগলিক প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। রামায়ণের রচনা মূলত পুঁথি নির্ভর। সারা বাংলায় ২০২২টি পুঁথির সন্ধান পাওয়া গেছে। বাংলায় লিখিতভাবে এই রামায়ণের প্রকাশ ঘটে ১৮০২ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে উইলিয়াম কেরির বদান্যতায়। তবে অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত বাল্মিকীর মূল রামায়ণের রচনাকাল যীশু খ্রীষ্টের জন্মের আগে, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ১০০ শব্দের মধ্যে।
 আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই পূজা কে কেবল উৎসবে, আরাধনা কে উন্মাদনায় পরিবর্তিত করে দেওয়ার পেছনে আসলে এর ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়ার অভিসন্ধি বলে ভয় হতে শুরু করেছে। তাই মহালয়ার ভোরে কিংবা নব পত্রিকার স্নানে যারা ভিতরের ক্লেদ ধুয়ে যাওয়ার পবিত্রতা অনুভব করেন তারা কখনওই পিতৃপক্ষে পূজার শুভারম্ভ কিংবা দশমির পরও মন্ডপে দেবী প্রতিমার দাঁড়িয়ে থাকা মানতে পারেননা। পেরিয়ে আসা পথ ধ্বংস করে দিয়ে যেমন করে ফেলে আসা জনপদের স্মৃতি মুছে ফেলা যায় না, তেমনি হিন্দু সংস্কৃতি, পরম্পরা ও ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়া খুব সহজ নয় বলে প্রতিজ্ঞ অনেকেই।
 ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আজকের দিনের দুর্গাপ্রতিমার বিবর্তনের একটি নির্দিষ্ট ধারা এই বঙ্গদেশে লক্ষ্য করা গেলেও তার মূল পূজাপদ্ধতি প্রায় অপরিবর্তিত। মায়ের মহিষমর্দিনী রূপ মূলত কুষাণ যুগের। চালুক্য যুগে তার সিংহবাহিনী রূপ পূজিত হতো এবং মহিষাসুরমর্দিনী রূপটি পল্লব যুগে খুঁজে পাওয়া গেছে।সপরিবার দুর্গা প্রতিমার পূজার প্রচলন বাংলায় প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহীর জেলার তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়নের পূজায়। রাজা কংস নারায়ন ছিলেন মনুসংহিতার টীকাকার কুল্লুক ভট্টের পুত্র। দুর্গাপূজার রীতি-মন্ত্র ও সামগ্রিক নির্মাণ করেন কংসনারায়ণের কুল পুরোহিত রমেশ শাস্ত্রী। বাঙালি পন্ডিত রঘুনন্দন তাঁর ‘তিথিতত্ত্ব’ গ্রন্থে দুর্গাপূজার সম্পূর্ণ বিধি বর্ণনা করেছেন। মিথিলার প্রসিদ্ধ পন্ডিত বাচস্পতি তাঁর গ্রন্থে দুর্গা প্রতিমার পূজা পদ্ধতির সবিস্তার বর্ননা দিয়েছেন।এই রচনার সময়কাল ১৪২৫ খৃষ্টাব্দ – ১৪৮০ খৃষ্টাব্দ।তবে শরৎকালীন দুর্গাপূজার সর্বোচ্চ প্রসার ও প্রচার লাভ করে ১৭৫৭ সালে কৃষ্ণনগরের অধিপতি নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর এবং শোভাবাজার রাজবাড়ীর পূজা আয়োজনের পর থেকেই। জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছায় যে পলাশীর যুদ্ধ জয়ের পরে ক্লাইভ গির্জায় না গিয়ে আনন্দ উৎসবের জন্য দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। ইংরেজদের সন্তুষ্ট করার জন্য সেই সময়েই প্রথম দুর্গা পূজায় অহিন্দু সুলভ আচরন ঢুকে পড়ে, আয়োজন করা হয় বাইজি নাচের। মাঝে ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহারের রাজা বিশ্ব সিংহের প্রতিষ্ঠিত ‘দুর্গাবাড়ি’ বা ‘দেবীবাড়ী’র দুর্গাপূজা অন্যতম প্রসিদ্ধ হয়ে ছিল।
 বাংলায় পারিবারিক দুর্গাপূজার প্রচলন মোটামুটি ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে বড়িশার সাবর্ন রায়চৌধুরী বাড়ীর পূজা আয়োজনের মাধ্যমে। সেই জমিদার বাড়ীর লক্ষীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের পুজো তাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল। যদিও অন্যমতে পারিবারিক দুর্গা পুজার সূচনা হয় ১৬০৯ সালে কাশীশ্বর দত্ত চৌধুরীর হাত ধরে। তখনও দুর্গাপূজা ছিল পুরোপুরি জমিদারের ঠাকুরদালান অথবা নাটমন্দিরে সীমাবদ্ধ।
 ১৭৯০ সালে হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার বারো জন ব্রাহ্মণ যুবকে যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছিল দুর্গাপূজার। বারো ইয়ার বা বন্ধু মিলে ওই পুজো ‘বারোইয়ারি’ বা ‘বারোয়ারি’ পূজা নামে খ্যাত হয়ে আছে। সেই থেকেই আজকের বারোয়ারি পুজোর বিবর্তন। আর কলকাতায় ‘বারোয়ারি’ দুর্গাপূজার প্রচলন রাজা হরিনাথ রায়ের হাত ধরে কাশিমবাজার রাজবাড়ীতে।সেদিনের সেই ‘বারোয়ারি’ কথাটি ধীরে ধীরে আজকের ‘সর্বজনীন’ কিংবা ‘সার্বজনীন’ এ রূপান্তরিত।
ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস চর্চায় জাগ্রত প্রতীক হিসেবে দেবী মা দুর্গা প্রজ্জ্বলিত। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করতে এর সর্বজনীন পূজা ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল সেই পরাধীন দেশেই। দেবী দুর্গা কে আরাধ্য করেই ভারতমাতার জাগ্রত চেতনা মূর্তিরূপ লাভ করে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ কিংবা অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ প্রতিরূপ দেবী দুর্গার বন্দনা গীতের আরেকটি প্রতিচ্ছবি। স্বাধীনতাকামী অসংখ্য যুবকের অফুরন্ত প্রাণশক্তির সম্মিলিত উপাদান আর শক্তি ও সুন্দরের অসীম ভান্ডার যে দেবী দুর্গার মধ্যে নিহিত তা স্পষ্ট করে প্রকাশিত হয়েছিল ঋষি অরবিন্দের সেই বিখ্যাত ‘দুর্গাস্তোত্র’ তে। ১৯০৯ সালে নিজের সম্পাদিত ‘ধর্ম’ সাপ্তাহিক পত্রিকায় সেটি প্রকাশ পায়। ১৯০৫ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সহিংস ধারার গুপ্ত সংগঠনের, ‘অনুশীলন’ ও ‘যুগান্তরের’ এর হাজার হাজার যুবকের ‘জীবন মৃত্যু কে পায়ের ভৃত্য’ করা প্রেরণার উৎস ছিলেন অসুরনাশিনী মা দুর্গা। মৃত্যুকে তুচ্ছ করা এইসকল অজেয় বীর বিপ্লবীরা মা দুর্গা অথবা কালী মূর্তির সামনে আত্ম বলিদান শপথ গ্রহণ করতেন। কাজী নজরুল ইসলামকে দুর্গা মাতার শক্তি বন্দনার মাধ্যমে সহিংস বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করার কারনে ইংরেজ সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছিল। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সর্বজনীন দূর্গা পূজার সঙ্গে যুক্ত থাকার ইতিহাস পাওয়া যায়।
স্বাধীনতা উত্তর ভারতে এই পূজার প্রচার ও বিস্তার আরও ব্যাপকতা লাভ করেছে। একসময়ে জমিদার বনেদি বাড়ী কিংবা রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবশালীদের পূজা ক্রমে সর্বসাধারণের হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে প্যান্ডেল-আলো- থিম- বিনোদন সর্বস্ব আজকের আয়োজনে তার আধ্যাত্মিক ও অন্তরের প্রাণশক্তি ক্রমশ ফিকে হচ্ছে।মনে রাখা প্রয়োজন হিন্দু ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ কোনটাই শাস্ত্র বহির্ভূত নয়। আজকের দিনে চারদিকের আয়োজন দেখে মনে হয় সকল বিষয়টিকে শাস্ত্রের নিরিখে না বুঝে ব্যাবসায়িক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝে নিতে চাইছেন কেউ কেউ; সংযমের ধর্মীয় দুর্গাপূজা বিনোদন আর উশৃংখলের রঙ্গমঞ্চ হয়ে উঠছে দিন দিন। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ আদর্শে কয়েক হাজার বছর ধরে টিকে যাওয়া হিন্দু ধর্মকে ভাতৃত্ববোধের পাঠ শেখানো প্রয়োজনহীন। যে বৈদিক সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণে দেবীর আরাধনা হয় সেই সংস্কৃত শব্দকোষে ‘বাতিল’ বা ‘exclusion’ বলে কোন শব্দই নেই। স্মরণ রাখা উচিত সেই সনাতন ধর্মের পূজা কিংবা মাঙ্গলিক কর্মে নিজ গোষ্ঠীর মঙ্গল প্রার্থনার কোন মন্ত্রই নেই। আছে সারা জগতের মঙ্গল কামনার পবিত্র আকাঙ্ক্ষা। সেই সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণে কেবল সকল মনুষ্য জাতির নয়, জগতের সকল পশুপাখি এবং গাছপালা সহ সকলের মঙ্গল কামনার উদাত্ত প্রকাশ। তাই আজকের দিনে তথাকথিত ‘সমন্বয়’ কিংবা ‘ভাতৃত্বের’ নাম করে দুর্গাপূজার আধ্যাত্মিক বিষয় দূরে সরিয়ে চাপিয়ে দেওয়া অশাস্ত্র সুলভ ও অভিসন্ধিমূলক এই সকল কর্মকান্ড, নিশ্চিতভাবে রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়।

Author

(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)