পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সবচেয়ে গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাবগুলির মধ্যে একটি ছিল ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন। আপাতদৃষ্টিতে এটি শুধুমাত্র একটি নতুন ভাষা বা জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম ছিল না, বরং এর মাধ্যমে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন এবং রাজনৈতিক চেতনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল। এই নতুন শিক্ষার সংস্পর্শে এসে বাঙালি সমাজে এক অভূতপূর্ব জাগরণ দেখা দেয়, যা কেবল ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং অচিরেই রাষ্ট্র-চেতনা এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে প্রবলভাবে জাগিয়ে তোলে। এই প্রবন্ধে আমরা পরাধীন ভারতে ইংরেজি শিক্ষার ক্রমবিকাশ, এর বিস্তার, এর সঙ্গে বাঙালির রাষ্ট্র-চেতনার সম্পর্ক এবং এর সামগ্রিক প্রভাব ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ঔপনিবেশিক ভারতে ইংরেজি শিক্ষার সূচনা ও প্রাথমিক দ্বিধা
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন এদেশে তাদের শাসন ক্ষমতা বিস্তার করতে শুরু করে, তখন শিক্ষা বিস্তারের বিষয়ে তাদের মনোভাব ছিল বেশ রক্ষণশীল। শুরুর দিকে তারা ভারতে ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনের পক্ষপাতী ছিল না। এর পেছনে দুটি প্রধান কারণ ছিল:
১. রাজনৈতিক আশঙ্কা: কোম্পানির ভয় ছিল, পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এলে ভারতীয়দের মধ্যে স্বাধীনতাবোধের উন্মেষ ঘটবে। তারা আশঙ্কা করেছিল যে, এর ফলে ভারতীয়রা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে, যা কোম্পানির জন্য ক্ষতির কারণ হবে।
২. ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবেই দেখত। তাই শিক্ষা বিস্তারের মতো একটি অলাভজনক খাতে অর্থ ব্যয় করার কোনো যৌক্তিকতা তারা খুঁজে পেত না। তাদের কাছে মুনাফা অর্জনই ছিল প্রধান লক্ষ্য।
এই মনোভাবের কারণে ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে চার্লস গ্রান্ট যখন সর্বপ্রথম এদেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনের প্রস্তাব দেন, তখন ইংল্যান্ডের কমন্স সভা এবং কোম্পানির ডাইরেক্টর সভা তা নাকচ করে দেয়। এই অনীহা এতটাই প্রকট ছিল যে, ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার আইনে ভারতীয় রাজস্ব থেকে প্রাপ্ত অর্থের এক লক্ষ টাকা শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করার নির্দেশ দেওয়া হলেও, ১৮১৩ থেকে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রথম ১০ বছরে, কোম্পানি শিক্ষা খাতে একটি টাকাও খরচ করেনি। এমনকি ১৮২৩ থেকে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে কোনো নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও সরকার গড়ে তোলেনি। এই সময়ে শিক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের বেশিরভাগটাই প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার প্রতিষ্ঠানগুলির উন্নয়নে খরচ করা হয়েছিল।
কেরানি তৈরির মিথ ও মেকলের প্রভাব
একটি প্রচলিত ধারণা হল যে, ব্রিটিশরা ভারতে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তন করেছিল মূলত কেরানি তৈরির উদ্দেশ্যে। তবে উপরোক্ত তথ্যপ্রবাহ থেকে বোঝা যায়, এই ধারণাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়, বরং এটি একটি অতিকথা। যদি সত্যিই কেরানি তৈরির এত তাগিদ থাকত, তাহলে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলনে কোম্পানি এত গড়িমসি করত না। মেকলে মিনিটের আগেও অন্তত সামান্য কিছু তাগিদ লক্ষ্য করা যেত।
আসলে, ইংরেজি শিক্ষার প্রচলনে কোম্পানির যথেষ্ট সদিচ্ছা এবং উৎসাহেরও অভাব ছিল। তাদের সবচেয়ে বড় বাধা ছিল ইংরেজি শিক্ষার ফলাফল সম্পর্কে এক অজানা আতঙ্ক। এই আতঙ্কই ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষার সরকারি উদ্যোগকে আটকে রেখেছিল।
১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে থমাস ব্যাবিংটন মেকলে তাঁর বিখ্যাত “মেকলে মিনিট”-এ ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ও বিস্তার সম্পর্কে কোম্পানির আধিকারিকদের সকল সংশয় ও আশঙ্কাকে দূর করে দেন। মেকলে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে, ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ঘটলে আখেরে সরকারেরই লাভ হবে। কারণ ইংরেজি শিক্ষার মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় সংস্কৃতিরও প্রসার ভারতে ঘটবে। তাতে মন-মানসিকতায় একদল ইংরেজ তৈরি হবে, যাদের দ্বারা কোম্পানি প্রভূত লাভবান হতে পারে। তারা ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অনুগত থাকবে এবং প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করবে।
এই মিনিটের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চ সরকারিভাবে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের কথা ঘোষণা করেন। এরপর থেকেই ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে সরকারি উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। এই সিদ্ধান্তের পর ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে একটি জোয়ার দেখা দেয়, কারণ সরকারের অজানা আশঙ্কা সম্পূর্ণরূপে দূর হয়ে গিয়েছিল।
সরকারি উদ্যোগের ওপর চাপ সৃষ্টি: মিশনারি ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা
তবে সরকারি উদ্যোগে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের জন্য শুধুমাত্র মেকলে মিনিটকে একক কৃতিত্ব দিলে সত্যের অপলাপ হবে। ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারে সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে খ্রিস্টান মিশনারি এবং বেশ কিছু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এরা প্রবলভাবে সোচ্চার হয়েছিলেন। তাদের নিরন্তর চাপ এবং জনমতের প্রভাবেই শিক্ষা সংক্রান্ত নানা নীতি-নির্দেশিকা ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে তৈরি হয়ে এদেশে এসেছিল, এবং এগুলি এখানকার ঔপনিবেশিক সরকারের ওপর একটি চাপ সৃষ্টি করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার আইন এবং ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের উডের নির্দেশনামার কথা বলা যায়। এই চাপগুলি না থাকলে হয়তো সরকারের দিক থেকে এত দ্রুত ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ আসত না।
ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ: বেসরকারি ও সরকারি পর্যায়
ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারকে মূলত দুটি পর্বে ভাগ করে আলোচনা করা যায়:
(ক) ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বেসরকারি উদ্যোগ, এবং
(খ) ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে সরকারি উদ্যোগ।
(ক) বেসরকারি উদ্যোগ
ঔপনিবেশিক আমলে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণের আগে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে যতটুকু কাজ হয়েছিল, তার সবটাই হয়েছিল বেসরকারি উদ্যোগে। এই উদ্যোগগুলিকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়:
১. বিদেশীয় ব্যক্তিগত উদ্যোগ:
প্রথম দিকে এদেশে ইংরেজি বিদ্যালয় খুলতে এগিয়ে এসেছিলেন বেশ কিছু ইউরোপীয় ব্যক্তি। তৎকালীন সময়ে ইংরেজি শিক্ষার চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার দিকটি পূরণের জন্যই তারা সেই সব বিদ্যালয় খুলেছিলেন।
ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনের আগে ভারতে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল অনেকটাই গতানুগতিক ধাঁচের। হিন্দুরা পাঠশালা আর টোলে পড়াশোনা করত। মুসলিমদের জন্য ছিল মক্তব আর মাদ্রাসা। কিন্তু যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এই সব দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি রাজা-মহারাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধুঁকতে থাকে এবং কোনো রকমে টিকে থাকে। ভারতে কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ফার্সি বা সংস্কৃত শিখে সরকারি চাকরি লাভের কোনো সম্ভাবনাও আর তেমন ছিল না।
ইতিমধ্যে কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্রে ইংরেজি ভাষা জানাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে হলো। ইংরেজদের বাণিজ্য কুঠি ও প্রশাসনিক দপ্তরগুলোতে ইংরেজি জানা কাজের লোকেরও দরকার ছিল। এই সুযোগে অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ইংরেজি শিক্ষা লাভ করতে চাইছিলেন। কারণ ইংরেজি শিক্ষা লাভের সঙ্গে চাকরি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে সুবিধা, দুটো দিকই জড়িত ছিল।
সময়ের এই চাহিদা পূরণের জন্য বেশ কিছু অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ব্যক্তি এই সময় কলকাতায় ইংরেজি বিদ্যালয় খুলে বসলেন।
* ডেভিড ড্রামন্ড “ধর্মতলা অ্যাকাডেমি” স্থাপন করেন।
* জোড়াসাঁকোতে শেরবোর্ন একটি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
* এছাড়া বাউল, আরটুন পিটারস প্রমুখ ব্যক্তিরাও একটি করে বিদ্যালয় খুলেছিলেন।
এই সমস্ত বিদ্যালয়গুলিতে হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামগোপাল ঘোষের মতো নবজাগরণের কাণ্ডারিরা ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ লাভ করেছিলেন।
২. খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগ:
ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারে খ্রিস্টান মিশনারিরা দুটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন:
(ক) সরকারি উদ্যোগে যাতে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ঘটে, সেইজন্য ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরে তারা একটি চাপ ও জনমত তৈরি করেছিলেন।
(খ) সরকারি উদ্যোগের অপেক্ষায় না থেকে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে একাধিক ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। এই সব খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগের ফলে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে বেশ কিছু ইংরেজি বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল।
মিশনারিদের এই প্রয়াসের ফলে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছিল। যেমন:
* শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন-এর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ১২৬টি বিদ্যালয়ে ১০,০০০ ছাত্র ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ লাভ করেছিল।
* ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে এই মিশন উচ্চশিক্ষার জন্য শ্রীরামপুরে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিল।
* লন্ডন মিশনারি সোসাইটি-র উদ্যোগে আয়োজিত ৩৬টি স্কুলে বহু ভারতীয় ইংরেজি শিক্ষার অধিকার লাভ করেন।
* চার্চ মিশনারিরা কলকাতা, বর্ধমান, কালনা এবং দক্ষিণ ভারতে অনেক গুলি ইংরেজি বিদ্যালয় খোলেন।
* স্কটিশ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা আলেকজান্ডার ডাফ বেশ কয়েকটি ইংরেজি বিদ্যালয় খোলেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত “জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন” (বর্তমান নাম স্কটিশ চার্চ কলেজ)।
৩. দেশীয় ও বিদেশীয়দের সম্মিলিত উদ্যোগ:
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কয়েকজন উদার, মুক্তমনা ভারতীয় ও বিদেশী ব্যক্তির সম্মিলিত উদ্যোগে বেশ কিছু ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
* ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায় নিজ উদ্যোগে কলকাতায় “অ্যাংলো হিন্দু স্কুল” নামে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় খোলেন।
* ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ডেভিড হেয়ার, রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট প্রমুখের উদ্যোগে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দু সমাজের যে-সব ছাত্র পরে বিভিন্ন কার্যে নেতৃত্বভার গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই মেধাবী, অথচ দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এ ধরনের সাহায্য পেয়েই তাঁদের উচ্চ শিক্ষা লাভ সম্ভব হয়েছে।
* ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ডেভিড হেয়ার পটলডাঙ্গা অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন, যার পরে নাম হয়েছিল – “হেয়ার স্কুল”।
* হেয়ারের উদ্যোগেই পাঠ্যপুস্তক রচনা ও ইংরেজী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে “স্কুল বুক সোসাইটি” এবং ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে “কলকাতা স্কুল সোসাইটি” প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দুটি প্রতিষ্ঠানে হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টান সমাজের গণ্যমান্য সুশিক্ষিত লোকেরা একযোগে কাজ করেছেন। সরকারি কর্মচারীদেরও এতে যোগদান করতে আপত্তি হয়নি। স্কুল সোসাইটির অন্তর্গত পাঠশালায় কুড়ি থেকে ত্রিশ জন মেধাবী ছাত্রকে মাসিক বৃত্তি দিয়ে হিন্দু কলেজে পাঠানো হতো।
এই সময় রাজা রাধাকান্ত দেব, রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, ডেভিড হেয়ার, বর্ধমানের রায়বাহাদুর তেজচন্দ্র রায় প্রমুখ ব্যক্তিরা পাশ্চাত্য ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারে একে অপরের উদ্যোগে পাশে এসে দাঁড়ান। এমনকি তারা খ্রিস্টান মিশনারিদের ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগেও নানারকম সহায়তা করেন।
(খ) সরকারি উদ্যোগ
ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারে সবার শেষে এসেছিল সরকারি উদ্যোগ। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ভারতে শিক্ষা খাতে কোম্পানিকে বার্ষিক এক লক্ষ টাকা খরচ করবার নির্দেশ দেওয়া হলে, কোন শিক্ষা খাতে এই টাকা খরচ হবে তা নিয়ে দীর্ঘদিন প্রাচ্য-পাশ্চাত্য শিক্ষা বিতর্ক চলে। অবশেষে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে মেকলে মিনিটে এই বিতর্কের অবসান ঘটানো হয়, এবং ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চ সরকারিভাবে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের কথা ঘোষণা করা হয়।
এই সময় সরকারি উদ্যোগে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এগুলি হল:
* কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ
* থমাসোন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ
* মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি হাই স্কুল
* বোম্বাইয়ের এলফিনস্টোন ইনস্টিটিউশন
কাউন্সিল অব এডুকেশন গঠন:
১. ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে সরকার যে সব উদ্যোগ গ্রহণ করছিল, তার মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না।
২. এই কারণে জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন বা জনশিক্ষা কমিটিকে নতুন করে পুনর্গঠন করে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে “কাউন্সিল অব এডুকেশন” গঠন করা হয়।
৩. এই সংস্থার উদ্যোগে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ১৫১টি ইংরেজি বিদ্যালয়ে ১৩ হাজারের বেশি ছাত্রের ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
৪. ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে বড়লাট হার্ডিং সরকারি চাকরিতে ইংরেজি ভাষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ঘোষণা করলে, ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ এবং উৎসাহ অনেকখানি বেড়ে যায়।
ইংরেজি শিক্ষাকে সুসংবদ্ধকরণের উদ্যোগ:
ভারতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও, সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলি পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যায়:
* শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে পাঠ্যক্রম ও পঠন-পাঠন রীতির মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য ছিল না।
* শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না।
* অনেক বিদ্যালয় আর্থিক কারণে ধুঁকতে থাকে।
* শিক্ষা বিস্তারে সরকারের উদ্যোগ ভারতের সব জায়গায় একই রকম ছিল না।
* শিক্ষা গ্রহণের স্তর বা শ্রেণী সম্পর্কে কোনো স্বচ্ছ ধারণা ছিল না।
* সর্বোপরি, ভারতে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ছিল না।
উডের নির্দেশনামা:
১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতের ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও প্রধান সমস্যাগুলিকে সামনে নিয়ে আসা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এগুলির সমাধানের জন্য শিক্ষা সংক্রান্ত এক খসড়া পত্র লিখে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এই খসড়া পত্রটি রচনা করেছিলেন বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড। তাই তার নাম অনুসারেই এই খসড়া পত্রকে “উডের ডেসপ্যাচ” বা “উডের নির্দেশনামা” বলা হয়ে থাকে।
এই নির্দেশনামাতে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বুনিয়াদকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানোর জন্য চার্লস উড বেশ কিছু সুপারিশ করেন। যেমন:
* একটি পৃথক শিক্ষা দপ্তর গঠন।
* সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে ৫টি স্তরে ভাগ করা।
* কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন।
* সরকারি উদ্যোগে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মডেল স্কুল স্থাপন।
* বিদ্যালয়গুলিকে আর্থিক অনুদান প্রদান।
* শিক্ষক-শিক্ষণ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।
* নারী শিক্ষার প্রসার করা।
* শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা।
ইংরেজি শিক্ষার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি:
উডের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটে।
* ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারি শিক্ষা দপ্তর “ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন” প্রতিষ্ঠিত হয়।
* ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ২১৯টি উচ্চ ও মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয় সরকারি আর্থিক অনুদান লাভ করে।
* শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেকটাই সামঞ্জস্য ও শৃঙ্খলা স্থাপিত হয়।
* ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারের বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়।
ডিরোজিও ও ইয়ং বেঙ্গল: নবজাগরণের এক নতুন ধারা
হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পনের বছরের মধ্যেই ইংরেজি শিক্ষার ফল সমাজে প্রকৃষ্টরূপে অনুভূত হতে শুরু করে। কলেজের প্রথম দিকের ছাত্রদের মধ্যে প্রসন্নকুমার ঠাকুর, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, শিবচরণ ঠাকুর ও কাশীপ্রসাদ ঘোষের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁদের মধ্যে কাশীপ্রসাদ ঘোষ ইংরেজিতে কবিতা লিখে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর কবিতার মধ্যে দেশপ্রেম সুব্যক্ত ছিল।
তবে সত্যিকারের দেশপ্রেম এবং রাষ্ট্র-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন হিন্দু কলেজের পরবর্তী যুবক ছাত্রগণ, এবং এই ধারা বহু বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এই দেশপ্রেম-শিক্ষায় প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করেন একজন যুবক শিক্ষক। তিনি জাতিতে ফিরিঙ্গি, নাম – হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। ফিরিঙ্গি হলেও তিনি জন্মভূমি ভারতবর্ষকেই স্বদেশ বলে মনে করতেন। তিনি ছিলেন স্বভাবকবি। ১৮২৬ সালের মে মাসে হিন্দু কলেজে কর্মগ্রহণকালেই, মাত্র সতেরো বছর বয়সে, তিনি বহু কবিতা লিখেছিলেন। তাঁর স্বদেশপ্রেমব্যঞ্জক কবিতা ‘ফকির অফ জাংঘিরা’ নামক কাব্যের মুখবন্ধ। এই কবিতাই স্বদেশপ্রেমের প্রথম কবিতা।
শিক্ষাদানের সুযোগ পেয়ে যুবক ডিরোজিও ছাত্রদের মনে দেশপ্রেমের বীজ প্রথমেই বপন করেছিলেন। স্বাধীনতা ছিল তাঁর জীবনের মূল মন্ত্র। ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র সব বিষয়ে ছাত্রদল যাতে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখে, ডিরোজিও এই শিক্ষাই তাঁদের দিতেন। কলেজে ইংরেজি সাহিত্য ও দর্শনের মূল কথা তাদের অন্তরে গেঁথে দিলেন। কিন্তু এমন অনেক বিষয় আছে যার শিক্ষাদান কলেজ-গৃহে বসে সম্ভব নয়। এজন্য তাঁর নেতৃত্বে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন নামে এক বিতর্ক সভার সৃষ্টি হলো। ডিরোজিও-র সভাপতিত্বে ছাত্রগণ সাহিত্য, দর্শন, কাব্য প্রভৃতি বিষয়ক আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র বিষয়ক নানা প্রশ্ন, যেমন পৌত্তলিকতা, ঈশ্বরের অস্তিত্ব, নাস্তিক্যবাদ, সত্যবাদিতা, জাতিভেদ, স্বদেশপ্রেম প্রভৃতি সম্বন্ধেও প্রবন্ধ পাঠ ও বক্তৃতাদি করতেন।
তাঁর এই ছাত্রদলের মধ্যে রামগোপাল ঘোষ, রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ী, প্যারীচাঁদ মিত্র, শিবচন্দ্র দেব, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, এবং যারা তাঁর নিকট কলেজে পড়েননি অথচ তাঁর নিকট হতে প্রেরণা লাভ করেছিলেন, তাঁদের ভিতরে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, হরচন্দ্র ঘোষ প্রভৃতি দেশের নানা কার্যে পরবর্তীকালে নেতৃত্ব করে গেছেন। বাঙালিকে স্বদেশপ্রেম শেখাবার কৃতিত্ব বঙ্কিমচন্দ্র যে দু’জনকে অর্পণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে ডিরোজিও-শিষ্য রামগোপাল ঘোষ একজন।
নূতন শিক্ষার প্রেরণা পেয়ে ছাত্রদল সমাজের ও ধর্মের প্রচলিত সকল বিধির উপর বিরূপ তো হলেনই, উপরন্তু তা ভঙ্গ করতেও লেগে গেলেন। সে-যুগে বিজাতীয়ের নিকট হতে আহার্য গ্রহণ, গো-মাংস ভক্ষণ প্রভৃতি কর্ম কতখানি সাহসের বিষয় ছিল, আজ হয়তো আমরা তা কল্পনাও করতে পারব না। এই নব্যদলের ধর্মহীনতা প্রগতিপন্থী রামমোহনের প্রাণেও ব্যথা দিয়েছিল।
প্রাচীন হিন্দু সমাজ এই সব অনাচার দেখে কেঁপে উঠল। যে ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তনে হিন্দু-প্রধানগণ একদিন অগ্রণী হয়েছিলেন, তার ফল দেখে তারা চমকে উঠলেন। কলেজ কমিটির অধিকাংশ হিন্দু সভ্যরা এজন্য ডিরোজিও-কে দোষী সাব্যস্ত করলেন। হিন্দু কলেজ থেকে ডিরোজিও ১৮৩১ সালের ২৫শে এপ্রিল অপসৃতও হলেন। তখনকার দিনের হিন্দু-প্রধানেরা ডিরোজিও-র শিক্ষার সুদূরপ্রসারী ফল কল্পনাও করতে পারেননি। হিন্দু যুবকগণ ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস ও রাষ্ট্রনীতি চর্চা করে সকল বিষয়ে স্বাধীন মতামত গঠন করলেন। এ সবের নিরিখে স্ব-সমাজের হীন দশা যাচাই করে তার উন্নতি করতেও তাঁরা তৎপর হয়েছিলেন খুব। আর এ সকলেরই মূলে ছিল ডিরোজিও-র শিক্ষা।
রাধানাথ শিকদার তাঁর আত্মচরিতে যথার্থই লিখেছেন: “ডিরোজিও দয়ালু ও স্নেহশীল শিক্ষক ছিলেন। তিনি প্রথমতঃ জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আমাদের উপদেশ দিতেন। এ শিক্ষা অমূল্য। তাঁর শিক্ষাগুণে সাহিত্যিক যশোলাভের আকাঙ্ক্ষা আমার মনে এমনিভাবে নিবদ্ধ হয়েছে যে, তা আজও আমার সকল কর্মকে নিয়মিত ও অনুপ্রাণিত করছে। তাঁরই নির্দেশে আমি দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে আরম্ভ করি। তাঁর নিকট হতে এমন কতকগুলি উদার ও নীতিমূলক ধারণা লাভ করেছি, যা চিরকাল আমার সকল কর্ম প্রভাবিত করবে। বড়ই দুঃখের বিষয়, ভারতবর্ষের উন্নতির নানারূপ জল্পনা-কল্পনার মধ্যে যৌবনে পদার্পণ করতেই তিনি প্রাণত্যাগ করেন। নিশ্চিত বলতে পারি, সত্যানুসন্ধিৎসা ও পাপের প্রতি ঘৃণা – যা সমাজের শিক্ষিত জনের মধ্যে এখন এত অধিক দেখা যায় এবং যা ভারতবাসীর পক্ষে হিতকর না হয়েই যায় না – এ সকলের মূলে ছিলেন একমাত্র তিনিই।”
কর্ম থেকে অপসৃত হবার পর ডিরোজিও স্ব-সমাজের সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন। ১৮৩১ সালের ১লা জুন তিনি ‘ঈস্ট ইন্ডিয়া’ নামক দৈনিক কাগজ প্রকাশ করেন। কিন্তু এ কাজ তিনি বেশিদিন করতে পারেননি। ঐ সালের ২৬শে ডিসেম্বর তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন।
ডিরোজিও-র শিষ্য-দলের যে উচ্ছৃঙ্খলতা দেখে হিন্দু সমাজ এতটা বিচলিত হয়েছিল, তা কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আলেকজান্ডার ডাফ প্রমুখ খ্রিস্টান পাদ্রীগণ এই সুযোগে তাদের খ্রিস্টান করবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু একমাত্র কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া আর কেউ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণও করেননি। এতদিন পরে আজ একথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, কৃষ্ণমোহনের উপরে হিন্দু সমাজ অযথা খড়গহস্ত না হলে তিনিও স্ব-ধর্ম ত্যাগ করতেন না। অন্যান্য সকলে সমাজে রয়ে গেলেও তাদের বিপ্লবী মন কিন্তু বহুদিন সক্রিয় ছিল।
কৃষ্ণমোহন ‘দি পারসিকিউটেড’ নামে পঞ্চাঙ্ক ইংরেজি নাটক লিখে হিন্দু-সমাজে প্রচলিত ভণ্ডামি জনসমক্ষে ধরে দিলেন। তাঁর ‘একোয়ারার’ সাপ্তাহিক হিন্দু সমাজের দোষ-ত্রুটি উদ্ঘাটন করে দেখাতে কসুর করত না। দক্ষিণারঞ্জন ও রসিককৃষ্ণ পর পর ‘জ্ঞানান্বেষণ’ নামে – প্রথমে বাংলা, ও পরে ইংরেজি-বাংলা – দো-ভাষী একখানা সাপ্তাহিক প্রকাশ করলেন। এ কাগজখানিরও অন্যতম মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজসংস্কার। তবে এ ক্রমে নব্যদলের রাজনৈতিক মুখপত্রে পরিণত হয়। তাঁদের প্রগতিশীল মতামতই এতে স্থান পেত। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে এ কাগজখানির সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। জ্ঞানান্বেষণ পত্রের মটো বা শিরোভূষণ ছিল: “এহি জ্ঞান মনুষ্যানামজ্ঞানতিমির হর। দয়া সত্যঞ্চ সংস্থাপ্য শঠতামপি সংহর ॥” এই কবিতার বঙ্গানুবাদ ছিল: “বাঞ্ছা হয় জ্ঞান তুমি কর আগমন। দয়া সত্য উভয়কে করিয়া স্থাপন ।। লোকের অজ্ঞানরূপ হর অন্ধকার। একেবারে শঠতারে করহ সংহার ।।” জ্ঞানান্বেষণের কর্মী-সম্পাদক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য্য (গুড়গুড়ে ভট্টাচার্য্য) তাঁদের নির্দেশে এই মটোটি ও তার বাংলা লিখে দেন। এই গৌরীশঙ্কর ‘সম্বাদ ভাস্করের’ সম্পাদকরূপে পরে বিশেষ খ্যাতিলাভ করেন। তিনিও ছিলেন প্রগতিপন্থী।
ডিরোজিও-শিষ্যদল এই আদর্শ সম্মুখে রেখে সমাজ ও স্বদেশ সেবায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, তাঁরা নিজেরা দরিদ্র হলেও যে জ্ঞান অর্জন করেছেন, স্বদেশবাসীদের ভিতর সেইরূপ জ্ঞান বিতরণ করা। ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁরা এ কার্যে ব্রতী হন। ১৮৩০ সাল থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত কলকাতায় ও কলকাতার আশেপাশে বহু অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। আর এ কার্যের প্রধান উদ্যোক্তা ও পথপ্রদর্শক ছিলেন এই ডিরোজিও-শিষ্যদল। তাঁদের অনেকেই এই সময়ে বিস্তর স্কুল-পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করে স্বয়ং ছেলেদের শিক্ষাদান করতেন।
ইংরেজি শিক্ষার ফলাফল ও রাষ্ট্র-চেতনার উন্মেষ
ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের দরজা ভারতীয়দের কাছে উন্মুক্ত হয়ে যায়। ভারতীয়েরা ইংরেজি শিক্ষার সংস্পর্শে এসে পাশ্চাত্য সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মানবতাবোধ, ইত্যাদি আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়। পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ভারতীয়রা নিজ সমাজ, দেশ ও জাতির দুর্বলতাগুলি বুঝতে পারে। এগুলি দূর করবার জন্য তারা পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের আদর্শে সমাজ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলন শুরু করে।
ইংরেজি ভাষা শিক্ষিত ভারতবাসীকে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করে এবং ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটায়। রামমোহন রায়, ডেভিড হেয়ার এবং অন্যান্যদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এবং ডিরোজিওর মতো শিক্ষকদের প্রভাবে তরুণদের মনে প্রশ্ন করার এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা তৈরি হয়। তারা প্রচলিত কুসংস্কার, সামাজিক বৈষম্য এবং ব্রিটিশ শাসনের স্বৈরাচারী নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে।
মেজর জেনারেল স্যার লায়ওনেল স্মিথ নামে একজন ইংরেজ কর্মচারী ১৮৩১ সালের ৬ই অক্টোবর পার্লামেন্টারী কমিটির সম্মুখে সাক্ষ্যদান-কালে ইংরেজি শিক্ষার ফল সম্পর্কে যা বলেন, তা আজকের দিনেও খুবই শিক্ষাপ্রদ। তিনি এই মর্মে বলেন, “ইংরেজি শিক্ষার ফলে ভারতবাসীর মনে একদিন আত্মকর্তৃত্ব লাভের বাসনা জাগবে, এবং তখন আমাদের ভারতবর্ষ থেকে চলে আসতে হবে। এতে আমাদের ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নাই বরং কিছু লাভেরই আশা করা যেতে পারে। আমেরিকা যখন ব্রিটেনের অধীন একটি উপনিবেশমাত্র ছিল, তখনকার চেয়ে সে এখন স্বাধীন অবস্থাতেই আমাদের বেশি উপকারে আসছে। ভারতবাসীরা স্বভাবতঃই স্বাধীন হতে চাইবে। মুসলমান আমলে যে তারা স্বাধীন হতে চায়নি তার কারণ, তখন তাদের শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ইংরেজি শিক্ষার ফলে সুতরাং তারা তা চাইবেই। নিজেদের শক্তি সম্বন্ধেও তারা সচেতন হবে ও নিজ শক্তির পরিমাণ বুঝতে পারবে। এর ফল হবে এই যে, তারা স্বদেশ থেকে প্রত্যেক শ্বেতকায় ব্যক্তিকে বের করে দিতেও স্বভাবতঃই দ্বিধাবোধ করবে না।”
এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মন্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, ব্রিটিশরাও জানত ইংরেজি শিক্ষা শেষ পর্যন্ত তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। কিন্তু তাদের দীর্ঘমেয়াদী ঔপনিবেশিক স্বার্থ, যেমন প্রশাসনিক সুবিধা এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা, তাদের এই ঝুঁকি নিতে উৎসাহিত করেছিল।
ইংরেজি শিক্ষার ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং সীমাবদ্ধতা
ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার একটি অংশের ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে পারলেও, সাধারণ ভারতবাসী এর সুফল থেকে বঞ্চিতই ছিলেন।
* প্রাথমিক শিক্ষার উপেক্ষা: ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে উচ্চ ও মধ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দিকে যতটা জোর দেওয়া হয়েছিল, প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দিকে তা একেবারেই করা হয়নি। তার ফলে ইংরেজি শিক্ষার সুফল সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। প্রাথমিক বিদ্যালয় যথেষ্ট না থাকায় সাধারণ মানুষ ইংরেজি শিক্ষা লাভের পর্যাপ্ত সুযোগ লাভ করতে পারেনি।
* কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার অভাব: ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারের ক্ষেত্রে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হয়। তার ফলে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ইংরেজি শিক্ষিত ভারতবাসীর মধ্যে চাকরি না পাওয়ার ক্ষোভ এবং তীব্র হতাশা দেখা যায়।
* মুসলিম সমাজের অনীহা: ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে মুসলিমদের আকৃষ্ট করা যায়নি। তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ এই শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্রিটিশ আগ্রাসনের অংশ হিসেবে দেখত এবং নিজেদের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিই বেশি আগ্রহী ছিল।
* স্ত্রী শিক্ষার অনগ্রসরতা: স্ত্রী শিক্ষারও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেনি। যদিও উডের নির্দেশনামায় নারী শিক্ষার প্রসারের কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এর বাস্তবায়নে তেমন জোর দেওয়া হয়নি। সামাজিক রক্ষণশীলতাও এর একটি বড় কারণ ছিল।
উপসংহার
পরাধীন ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন একটি দ্বিমুখী তলোয়ারের মতো কাজ করেছিল। একদিকে, এটি ভারতীয়দের মধ্যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়। এই শিক্ষার হাত ধরেই বাঙালি সমাজে এক অভূতপূর্ব রেনেসাঁস আসে, যা সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং আত্ম-অনুসন্ধানের পথ খুলে দেয়। ডিরোজিও ও তাঁর শিষ্যরা এই জাগরণের পথিকৃৎ ছিলেন, যারা তরুণদের মধ্যে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন।
অন্যদিকে, ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার সমাজের একটি সীমিত অংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এর সুফল থেকে বঞ্চিত ছিল। ঔপনিবেশিক শক্তির নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে এই শিক্ষা প্রবর্তন করা হলেও, এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল ব্রিটিশদের নিজেদেরই ধারণার বাইরে ছিল। ইংরেজি শিক্ষা ভারতীয়দের মধ্যে যে ঐক্য ও আত্ম-সচেতনতা তৈরি করেছিল, তা পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে। তাই, পরাধীন ভারতে ইংরেজি শিক্ষার ইতিহাস কেবল একটি শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস নয়, বরং এটি বাঙালির রাষ্ট্র-চেতনার জাগরণ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি রচনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
গ্রন্থপঞ্জী:-
১) Ramesh chandra Majumdar, H.C.Roychowdhury, Kalikinkar Dutta, An Advanced History of India.
২) বাংলার রেনেসাঁস, সুশোভন সরকার।
৩) Emergence of Indian Nationalism, Anil shil.
৪) ভারতের জাতীয় আন্দোলন, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়।
৫) History of Political thought from Rammohan to Dayanand.(1821-84), Biman Bihari Majumder.
৬) Bengal under Lieutenant -Governors(vols.1&2),C.E.Buckland.
৭) Rise & fulfilment of British rule in India, Thompson & Garrat.
৮) মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত,নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়.
৯) Henry Derozio: The Eurasian Poet, Teacher, and Journalist, Thomas Edward.
১০) ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্ট।
১১)১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের মেকলে মিনিট।
১২) বিভিন্ন পত্রিকা ও জার্ণাল,যেমন- The Amritabazar Patrika, Calcutta journal,The Bengal Hurkara,The Hindu Patriot. বঙ্গদর্শন, আর্য্যদর্শন,যুগান্তর, বসুমতী।
১৩) মুক্তির সন্ধানে ভারত, শ্রীযোগেশ চন্দ্র বাগল।
(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)