ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে আমাদের দেশে প্রায় একশাে বছর ধরে নবজাগরণের যে প্রস্তুতি চলেছিল তার বেগমান ধারায় ছিল বাঙালির প্রচেষ্টা, আর বাংলার নবজাগরণকে সেই চেতনার সর্বাগ্র গণ্য এক ইতিহাস বলা যায়। তখন গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে জাগরণের বর্তিকা বহন করেছেন নানা মনীষী ও গুণী জনেরা;এক একজন এক একটি নিজস্ব চিন্তা ও ভাবনায়। তেমনই একজন মনিষী হলেন শরৎচন্দ্র পন্ডিত বা দাদাঠাকুর।
বঙ্গদেশ, অধুনা পশ্চিমবঙ্গ তথা মুর্শিদাবাদ জেলার শরৎচন্দ্র পন্ডিত হলেন এক অতি আদরের ও ভালোবাসার নাম। বাংলা সাহিত্য আকাশে এই উজ্জ্বল নক্ষত্রটি বিশেষ সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন। তিনি রসরাজ হিসাবে বিরাজ করছেন। শরৎচন্দ্র পণ্ডিত তার পােশাকি নাম হলেও তিনি দাদাঠাকুর নামেই সর্বাধিক পরিচিত লাভ করেছেন। শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের জন্ম ১২৮৮ বঙ্গাব্দের ১৩ই বৈশাখ (১৮৮১ খ্রীস্টাব্দের ২৭শে এপ্রিল) তার মামার বাড়ীতে বীরভূম জেলায় অন্তর্গত নলহাটী থানার সিমলান্দি গ্রামে। তার পিতার নাম হরিলাল পণ্ডিত ও মাতার নাম তারাসুন্দরী দেবী। শরৎ চন্দ্র পণ্ডিতের পিতামাতা বীরভূম জেলার আদিনিবাস ত্যাগ করে মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুর মহকুমার দফরপুর গ্রামে নতুন করে বসবাস শুরু করেন। শরৎচন্দ্র অতি শৈশবেই পিতৃ-মাতৃহারা! কাকা রসিকলাল পণ্ডিতের কাছে তাঁর স্নেহ শাসনে তিনি জীবনে চারিত্রিক দৃঢ়তা লাভ করেছিলেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি কঠিন বাস্তবের সঙ্গে লড়াই করে কৈশরে পদার্পন করেন। ছােটবেলা থেকেই শরৎচন্দ্র চালাক-চতুর ও বাস্তববাদী ছিলেন। শিক্ষিত মহলে তিনি দুইটি বিশেষরূপে পরিচিত ছিলেন। একটি বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে রসরাজ রূপে এবং আরেকটি সংবাদপত্র জগতে একাই একশাে সম্পাদক রূপে। শরৎচন্দ্র পণ্ডিত জঙ্গিপুর হাইস্কুল থেকে এন্ট্রাস পরীক্ষায় পাস করেন।
তারপর পারিবারিক কারণে পড়াশুনা করতে পারেন নি। ১৯০৩এ ২২ বছর বয়সে স্বাধীন জীবিকা গ্রহণ করার জন্য স্থাপন করেছিলেন পণ্ডিত প্রেস’। অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন কাকা রসিকলাল পণ্ডিত। যিনি চাকুরি করার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর কথায় ছিল, গো লামির চেয়ে অনাহার অনেক ভালো। দাদাঠাকুর কাকার কাছে উপযুক্ত শিক্ষাই পেয়ে ছিলেন। তিনি জঙ্গিপুর মহকুমায় প্রথম প্রেস স্থাপন করেন। শরৎচন্দ্রের সাংবাদিকতা ও সাহিত্যিক কর্মকাণ্ড তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রেসকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হতো। তার সম্পাদিত পত্রিকার নাম বিদূষক। কঠিন ও জটিল বিষয়কে পরিহাস ছলে পাঠক সমাজের কাছে উপস্থাপন করার তাঁর জুড়িছিল না। এই ধরণের বিভিন্ন রচনা থেকে তার অসামান্য চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রেসের একাই কাজ করে নেবার অভ্যেস তাকে
করে তুলেছিল বাংলার একাই একশো এডিটর বা সম্পাদক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন, এখানে একজন লোকের সঙ্গে দেখা হল তাহার নাম সোজাসুজি শরৎ পণ্ডিত। বিদুষকের সম্পাদক তিনি মুখে মুখে বাক্য লেখেন, তাঁর কাগজও পদ্যে। তিনি একাধারে এডিটর, প্রুফরিডার, কম্পোজিটার ও ডেসপাচার।
সেকালে বাংলার পল্লীগ্রামে মহামারীরূপে দেখা দিত ওলাউঠা বা কলেরা। গ্রাম দফরপুর মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুর মহকুমার মধ্যে অবস্থান এই গ্রামটির। ওলাওঠার ব্যাপক আক্রমণ এই রোগ এমনই ভয়ানক আকার ধারণ করেছে যে গােটা গ্রাম খানি হয়ত শ্মশানে পরিণত হবে। একটি মানুষের অস্তিত্ব থাকবে না। একমাত্র ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া এ আগত বিপদ থেকে উদ্ধারের কোন উপায় নেই। তবে গ্রামের অবালবৃদ্ধ সম্মিলিত হয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতে বেরিয়েছে রাস্তায় রাস্তায়। সমবেত আর্তকণ্ঠের হরিধ্বনীতে গ্রাম খানি আন্দোলিত হয়ে উঠেছে।
সংকীর্তন -সম্প্রদায়ের মানুষজন গেয়ে চলেছেন।
“ভাই হরিবল দুই বাহু তুলে।
শমন-দমন যাতে হবে রে !”
শমণ-দমণের আর দ্বিতীয় পথ নাই, হরিনাম নিষ্ঠ ভক্ত গ্রামবাসীদের এ বিশ্বাস সত্য। একমাত্র দিশা শ্রীহরিনাম সংকীর্তনের কৃপা। হরি অর্থাৎ ঈশ্বরই একমাত্র কৃপা,আর সব কিছু মিথ্যা। গ্রামবাসী হরিনাম সংকীর্তন করে চলেছেন।
“রাজার যে রাজ্যপাট
যেন নাটুয়ার নাট,ভাই রে,
দেখিতে দেখিতে কিছু নাই রে।
ভাই হরিবল দুই বাহু তুলে ….”
সংকীর্তন-দলের সকলের নজর পড়ল পিছনের দিকে এই নবীন গায়কের প্রতি। গায়ক তখন নাম সংকীর্তনে ভঙ্গ দিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাচ্ছে। তখনকার দিনের অকালপক্ক এঁচোড়ে পরিপক্ক রূপবিগ্রহ একালের ছিয়াশি বছরের বয়োবৃদ্ধ শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র পণ্ডিত আমাদের দাদাঠাকুর।
১২৮৮ বঙ্গাব্দের ১৩ বৈশাখে শরৎচন্দ্র পণ্ডিত বাংলার বীরভূমের সরস মাটিতে ভূমিষ্ঠ হন। তিনি পিতা ও মাতাকে হারিয়েছিলেন বাল্যকালেই। কাকা রসিকলালের শাসনে বড় হয়েছিলেন। রসিকলের আদেশ, রসিক লালের নির্দেশ, রসিকলের উপদেশ যেন দাদাঠাকুর সারা জীবন মেনে চলেছেন। বাল্যকালের অভ্যাস মত সারা জীবন তিনি নগ্ন পদ, নগ্নগাত্র, কচিৎ উত্তমাঙ্গে একখানি উত্তরীয়, পরনে আজানুলম্বিত ধুতি। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত সকল ঋতুতেশরৎ পণ্ডিতের একই রকমের মূর্তি। দাদাঠাকুর কিশোরকালে ভর্তি হয়েছিলেন জঙ্গিপুর হাইস্কুলে। স্কুলের মাসিক বেতন দেবার সংগতি ছিল না শরৎচন্দ্রের। স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুগ্রহে তাকে পুরো বেতন দিতে হত না, অর্ধেক বেতন দিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই সময় থেকেই তার প্রতিভার প্রকাশ হতে থাকে। হাস্যরসতার বিধিদত্ত সম্পদ ছিল। নানা প্রকার সরস কবিতা ও গান রচনা করে তিনি তার স্কুল বন্ধুদের মাঝে মাঝে আনন্দ দিতেন।তারসাথে ছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। নানা কৌশল উদ্ভাবন করে তিনি তাঁর পাঠ্য বিষয়ে অনেক দুরূহ সমস্যার সমাধানও করে ফেলতেন।
একবার তাঁর সহপাঠী খুব মুশকিলে পড়েছে, ভারতবর্ষের করদমিত্র রাজ্যগুলির নাম কিছুতেই তাঁর মনে থাকত না। দাদাঠাকুর তাঁর অপরূপ বুদ্ধি দিয়ে নতুন পদ্ধতিতে একটি পঙক্তি রচনা করে দেন বন্ধুটিকে। সংস্কৃত ব্যকরণের সূত্রের মতো পঙ্ক্তিটি করদমিত্র রাজ্যগুলোর নাম গোড়ার অক্ষর দিয়ে গাঁথা।
হগোম বজত্রিকা যোই পাউ ভভূ
হ = হায়দারাবাদ, গো =গোয়ালিয়র, ম = মহীশূর, ব= বরোদা, ই= ইন্দর, পা=পাতিয়ালা, উ=উদয়পুর, ভ=ভরতপুর, ভ=ভুপাল। দুই চার বার আবৃত্তি করে সহপাঠীবন্ধু পঙক্তিটি মুখস্থ করে ফেলল। বন্ধুকে তো বিপদ থেকে রক্ষা করলেন, কিন্তু শরৎচন্দ্র এবার নিজে বিপদে পড়লেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ইংরেজী কবিতা মুখস্থ লেখার জন্য একটি প্রশ্ন থাকত। শুধু মাত্র কবিতা লিখেই নিষ্কৃতি নেই তার সঙ্গে দাঁড়ি,কমা, সেমিকোলন প্রভৃতি উপযুক্ত স্থানে চিহ্নিত করতে হবে। এবং এক একটি নম্বর কাটা যেত এক একটি পাংচুয়েশন ভুলের জন্য। এ এক মহাসমস্যা। স্কুলের হেডমাষ্টার মশায় এক দিন ক্লাসের ছাত্রদের একটি ইংরেজী কবিতা বই না দেখে লিখতে বললেন। সব ছাত্রই লিখলেও পাংচুয়েশন কারও ঠিক হল না। হেডমাষ্টার মশায় ছাত্রদের কড়া কথায় বললেন, সাত দিনের মধ্যে কবিতা কয়টি পাংচুয়েশন মুখস্থ করা চাই, নইলে শাস্তি পেতে হবে, শরৎচন্দ্রের উপর বিশেষভাবে দৃষ্টিপাত করে তিনি বললেন,শরৎ,যদি সাত দিনের মধ্যে মুখস্থ করতে না পারো, তোমার- হাফ ফ্রি আর থাকবে না। কঠিন সমস্যায় পড়লেন শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এসে, ভেবে-চিন্তে একটি উপায় উদ্রাবন করে ফেললেন। এই জন্য তাকে নিশীথ রাত পর্যন্ত জেগে কাটাতে হল। পরদিন স্কুলে এসে হেডমাস্টার মশায়কে বললেন,বলুন স্যার কোন কবিতা মুখস্থ লিখতে হবে। আমার পাংচুয়েশন মুখস্থ হয়ে গেছে।’হেডমাষ্টার বললেন, বলিস কী, এর মধ্যে তিনটি কবিতাই পাংচুয়েশন মুখস্থ হয়ে গেল?
হ্যাঁ স্যার।
“আচ্চা লেখ দেখি ‘দি গ্রেভস অফ এ হাউ হোল্ড’ কবিতার ঠিক ঠিক জায়গায় পাংচুয়েশন বসিয়ে।”
দাদাঠাকুর প্রস্তুতই ছিলেন। খাতাখানি টেনে নিয়ে মৃদু গুঞ্জন ধ্বনি করতে করতে তাড়াতাড়ী খস খস করে লিখে হেড মাস্টারের হাতে দিলেন। পাংচুয়েশন গুলি বই এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখে হেড মাস্টার মশাই কোন ভূল খুঁজে পেলেন না। শব্দ বিন্যাসে বর্ণ বিন্যাসে বা ছেদ চিহ্নের কোথাও কোন ত্রুটি নাই। তিনি বললেন ‘এত তাড়াতাড়ি পাংচুয়েশন গুলি কি করে মুখস্থ করলি, শরৎ? শরৎ পণ্ডিতের এক সহপাঠী বন্ধু বলে উঠল, ও গান তৈরি করেছে স্যার।
‘গান! গান কী রে?’
ছাত্রটি বললে, ‘ও পাংচুয়েশনের গান লিখেছে। শরৎ পণ্ডিত একেবারে নীরব। হেড মাস্টারমশাই কিন্তু জেদ ধরলেন গান তিনি শুনবেনই। অনেকক্ষণ পর অগত্যা – শরৎচন্দ্র প্রথমেই দি গ্রেভস অফ এ হাউস হোল্ড সম্বন্ধে তার রচিত গানটিই গাইতে আরম্ভ করলেন –
মন, শুন রে পাংচুয়েশন।
আই অ্যাম্ ভেরি বোল্ড
টু পাংচুয়েট হাউসহোল্ড,
সহজ উপায় বের করেছি যখন।
কমা বসাইবে মাউন্ট-এ সাইড-এ,
কমা বসাইবে স্ট্রীম-এ ওয়াইড-এ।
গ্রি-এতে কোলন ড্যাশের সহিতে।
সী-এ ফুলস্টপ জানে সর্বজন। ইত্যাদি।
গানগুলি গেয়ে গেয়ে তিনি হেডমাস্টার মশায়কে শোনালেন। পাছে একটি সঙ্গে আর একটির গোলমাল হয়ে যায়। এজন্য প্রতিটি গানের আলাদা ছন্দ, আলাদাসুর। গান গুলি শুনে হেড মাস্টার মশায় ক্লাসের ছাত্রদের বললেন,ওরে তোরা গান গুলি সব লিখে নে, গান করতে করতে পাস হয়ে যাবি।
প্রবেশিকা পাস করে শরৎচন্দ্র ভর্তি হলেন বর্ধমান জেলার রাজ কলেজে। বর্ধমান রাজ কলেজে ছাত্রদের বেতন দিতে হয় না। এই সুবিধা টুকু তিনি রাজ কলেজে পেলেন। এক পুলিশের দারােগার ছেলেকে প্রাইভেট পড়িয়ে সামান্য কিছু উপার্জন করে আহারাদি ব্যয়ের সংস্থান করলেন।
এই প্রাইভেট টিউশনে এক কাণ্ড ঘটে গেল। একটির নামে দুইটি ছেলেকে পড়াতে হবে। প্রাইভেট টিউশনে প্রথম দিনেই ছাত্রের পিতা তার আরও একটি পাঁচ বৎসরের শিশুপুত্রকে এনে সেখানে বসিয়ে দিয়ে শরৎচন্দ্র পণ্ডিতকে বললেন ‘এ ছেলেটিকেও একটু দেখ মাস্টার। শিক্ষক মশায়ের মনে হল মূল সওদার উপরে এটি যেন ফাউ। কলেজে পড়া এবং প্রাইভেট টিউশন পড়ানো এই দুইটি প্রতিদিনের কাজ শরৎচন্দ্রের তার বর্ধমানের জীবনযাপন কষ্টকররূপে দেখা দিল। একদিন তিনি ছেলেপড়াতে গেছেন, ছেলের পড়া চলাকালীন ছেলের বাবা পড়ার ঘরে ঢুকে শরৎচন্দ্র কে বললেন, “দেখ মাস্টার বড় ছেলেটি পড়াশনায় দিন দিন উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু ছোটটির উন্নতি হচ্ছে না। প্রায় একমাস হয়ে গেল, কিন্তু ছেলেটি লিখতে শিখলে না। কাল তাকে উনআশি লিখতে বললাম, পারলে না। বললে,—গুনতে পারি। লিখতে পারিনে। ওটাকে একটু দেখ। কথাগুলি বলে চলে গেলেন। শরৎ পণ্ডিত মর্মাহত হলেন তার ভদ্র ভর্ৎসনার। এ ছেলেটিকে পড়াবার কথাও ছিল না তার দাদার সঙ্গে। প্রাইভেট টিউটর বড় ছেলের প্রতি কোন রকম ঔদাসীন্য আদৌ করেননি। তবুও অনর্থক তাকে এ আঘাত দিল। এই বাড়ীতে প্রাইভেট টিউশনির কাজ করা চলবে না। পরের দিন তিনি ছেলে দুটিকে পড়াতে এসে বড় ছেলেটাকে ছুটি দিলেন। ছােট ছেলেটি সহস্তে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, শুনলে তো, কাল তোমার বাবা কি সব বলে গেলেন? তুমি অ আ ক খ সব লিখতে শিখেছ, একটু চেষ্টা করলে এক দুই অঙ্ক গুলাে লেখাও শিখে নিতে পার! শিখবে?
ছেলেটি উৎসাহভরে বলল, “হ্যা শিখব।
একটুকরো কাগজ ট্যাঁক থেকে বের করে শরৎচন্দ্র তার সদ্যরচিত ছড়াটি আবৃত্তি করে ছেলেটিকে শোনাতে লাগলেন। কেবল শোনানোই নয় বলার সঙ্গে সঙ্গে ১,২ সংখ্যা গুলি লেখার কৌশলও স্লেটের উপর লিখে বঝাতে লাগলেন –
১ আর কিছু নয় ক এর আঁকড়া,
২ ঠিক ২ এর মত মাথাটি তার ছাড়া।
৩ ঠিক ত কেউ মাত্রা কেটে জে,
৪ যেন বিসর্গ এর মত দুটো মুখ জোড়া,
৬ ঠিক ড কিন্তু মাত্রাটি তার ছাড়া
৭ যেন মূর্ধণ্য কাটা আধখান,
৮ ঠিক চ লিখতে ডান দিকে টান।
৯ আর কিছু নয় সদ্য যেন (লি) ৯
রসগোল্লার মত দেখ শূন্য লিখেছি।
বারবার শুনে শুনে ছেলেটি ছড়া মুখস্থ করে ফেললে। কেবল মাত্র মুখস্থই নয়, শরৎচন্দ্র পণ্ডিত যেভাবে ছড়া বলার সঙ্গে সঙ্গে এক থেকে দশ পর্যন্ত সব কটি সংখ্যা অল্প সময়ের মধ্যে আয়ত্ব করে নিল। তারপর প্রাইভেট টিউটর শরৎচন্দ্র তাকে বােঝাতে বসলেন, এগারাে থেকে একশাে পর্যন্ত লেখার কায়দা-কানুন। সরস ও সরল করে বিষয়টি তার ছাত্রকে বুঝিয়ে দেন আর সেও যেন রসগােল্লার মতােই কথাগুলি সানন্দে বুঝে নেন। একশাে পর্যন্ত লেখা সে সেইদিনই শিখে নিল। প্রাইভেট শিক্ষক মশায় ছেলেটিকে বললেন,“ছড়াটি কিন্তু কাউকে বলাে না। ওটি মন্তর। মন্তর কখনও অন্য কাউকে বলতে নেই। এরপর আরও একটি মন্তর শিখিয়ে দেব। সেইটি আরও মজার।”
ছেলেটি ধরে বসল – সেটিও তখনই শিখবে। তার নির্বাতিশয্যে প্রাইভেট শিক্ষক বাধ্য হলেন আরও একটি ছড়া শেখাতে। এটি হাজার লক্ষ কোটি পর্যন্ত লেখবার ছড়া। এটিও তিনি ছেলেটির জন্য রচনা করেছিলেন। বললেন, তবে শোন-
কোটি লক্ষ হাজার শত,
লিখে রাখাে মনের মত,
ফি ঘরেতে জোড়া জোড়া
শতের ঘরে এক।
ডাই দুটো শূন্য দিয়ে
মজা করে লেখ।
শরৎচন্দ্র ছেলেটিকে বললেন, ‘কোটি ,লক্ষ,হাজার – এই তিনটির জন্যে জোড়া জোড়া শূন্য আলাদা আলাদা বসিয়ে রাখাে। জোড়া অঙ্কের জন্য জোড়া শূন্য। আর শতের জন্য একটি শূন্য বসিয়ে তার ডান দিকে দুটো শূন্য দাও। যদি পঁচিশ কোটি লিখতে হয়, তাহলে দ্বিতীয় শূন্যটির জায়গায় পাঁচ বসিয়ে গােড়ার শূন্যটি মুছে ফেল। বাঁ-দিকের এক প্রান্তে শূন্য রাখতে নাই। এইভাবে প্রাইভেট টিউটর শরৎচন্দ্র ছেলেটিকে
কোটি থেকে শুরু লক্ষ হাজার শত প্রভৃতি সংখ্যা লেখা শিখিয়ে ছিলেন। শেখানাের পরে ছেলেটিকে বললেন, ছড়া দুটো মনে মনে আবৃত্তি করাে।নাইলে ভূলে যাবে। চেঁচিয়ে বলাে না, কেউ যেন শুনতে না পায়। সারাদিন অভ্যাস করাে। কাল বাবার কাছে পরীক্ষা দিতে হবে।
পর দিন প্রাইভেট টিউটর পড়াতে এসে ছেলেটিকে দুচারটে সংখ্যা লিখতে বললেন। দেখলেন, ছেলেটি ঠিকই লিখেছে। তারপর তার বাবাকে ডেকে পাঠালেন। ভদ্রলােক পড়াবার ঘরে এলে প্রাইভেট শিক্ষক মশাই বললেন, এবার ওকে কোন সংখ্যা লিখতে বলুন তো?’
‘পারবে লিখতে? একদিনের মধ্যেই শট্কে লেখা শিখে ফেলেছে?
শটকে কেন লক্ষ কোটি দিয়ে একটা সংখ্যা লিখতে বলুন না ?
বলাে কি?’ বাবা তার ছেলেকে একটু বড় রকমের সংখ্যা লিখতে বললেন। প্রশ্ন করার আগেই বুদ্ধিমান ছেলে জোড়া জোড়া শূন্য লিখে স্লেটে লিখে রেখে প্রস্তুত হয়েই আছে। সংখ্যাটি তাড়াতাড়ি লিখে স্নেটখানি বাবার হাতে তুলেদিল।
বাবা অবাক। বললেন কি করে লিখলিরে ?
মাস্টার মশাই যে মন্তর শিখিয়েছিলেন।
‘মন্তর! কী মন্তর?
বলতে নেই,
প্রাইভেট শিক্ষক ছেলের বাবার কাছ থেকে সেইদিনই বিদায় নিলেন।
ছাপাখানার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসঃ–
শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের ছাপাখানাটির প্রতিষ্ঠার ইতিহাসও বিচিত্র। ছাপাখানা সম্বন্ধে তাঁর কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। তাঁর কেবল মাত্র মনে হত, একটা ছাপাখানা তৈরি করতে পারলে দু’পয়সা রােজগার হতে পারে। কারণ মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুর মহকুমাতে সেই সময়ে একটিও ছাপাখানা ছিল না। ১৯০২ সাল। শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের বয়স তখন একুশ-বাইশ হবে। একদা একটা শুভক্ষণে তার চোখে পড়লাে ছাপার আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি বিক্রেতাদের তালিকার মধ্যে ভােলা নাথ দত্ত, মহাশয়ের নাম ও ঠিকানা। তারপর একখানি জোড়া পােষ্টকার্ডে তিনি ভােলানাথ দত্ত মহাশয়কে লিখলেন, আমার মাত্র পঞ্চাশটি টাকা পুঁজি, এই সামান্য অর্থে একটি প্রেস আর তার আনুষঙ্গিক সাজ-সরঞ্জাম মিলতে পারে কি? যদি সম্ভব হয়, অনুগ্রহ করে পত্রোত্তরে জানাবেন। আমি নিজে গিয়ে প্রেসটি নিয়ে আসবাে। আমি কখনাে কলকাতায় যাইনি এবং হােটেলেও খাইনি। যদি কলকাতায় যাওয়া হয়, তাহলে রাত্রীতে থাকার মতাে কোথাও একটু স্থানের ব্যবস্থা হতে পারে কি?
অবিলম্বে ভােলানাথ বাবুর কাছ থেকে চিঠির জবাব এল। তিনি শরৎচন্দ্র পণ্ডিত মশায়কে কলকাতায় আসার জন্য লিখলেন এবং সেখানে থাকার ব্যবস্থাও করা হয়েছে – একথা জানিয়েছেন। চিঠি পেয়েই শরৎচন্দ্র কলকাতায় যাত্রা করলেন। এবং কলকাতায় গিয়ে ভােলানাথ বাবুর কাছে উপস্থিত হলেন। ভােলানাথবাবু সন্ধান করে একটি কাঠের পুরানাে প্রেস এবং ছাপাখানার কিছু সরঞ্জাম মাত্র চল্লিশ টাকায় খরিদ করেছিলেন। প্রায় সমবয়সী বলে ভােলানাথবাবুর ছেলে রঘুনাথ বাবুর সঙ্গে শরৎচন্দ্রের বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। রঘুনাথ শরৎচন্দ্রের প্রেস সম্বন্ধে জানতে পেরে ছ’আনা দাম দিয়ে একখানি ‘প্রিন্টার্স গাইড বই কিনে এনে শরৎচন্দ্রকে দিলেন। সেই বই এ কিভাবে টাইপ গুলি কেসের মধ্যে সাজাতে হয়, কিভাবে রােলার চালাতে হয় প্রভৃতি নির্দেশ দেওয়া আছে। শরৎচন্দ্র কম্পােজ করার নির্দেশাদি জেনে নিয়ে এবং সেই প্রিন্টার্স গাইড সমেত ছেচল্লিশ টাকার ছাপাখানা সঙ্গে নিয়ে জঙ্গিপুরের গ্রামের বাড়ী দফরপুরে প্রথম প্রেসটি চালু করলেন। পরে জঙ্গিপুর শহরে একটি ঘর ভাড়া করে প্রেসটি স্থানান্তর করলেন। এরপর ‘জঙ্গিপুর সংবাদ সংবাদপত্র খানি বের করেন। তখন আরও একটু উন্নত ধরনের প্রেসের প্রয়ােজন হয়ে পড়লাে। সামান্য কিছু অর্থ সম্বল করে তিনি পুনরায় কলকাতায় গেলেন, যদিও কম দামে হাতে চালানাে একটি পুরানাে প্রেস মেলে। কলকাতায় অনেক অনুসন্ধানের পর একটা প্রতিষ্ঠানের খবর পেলেন, সেখানে নাকি বিক্রয়ের জন্য অনেক পুরানাে মেশিন রাখা আছে, গেলেন সেখানে। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার ঘরটিতে সন্ধান করে হঠাৎ ঢুকে পড়লেন সেই ঘরের মধ্যে। ঢুকেই দেখেন কর্মকর্তা একজন সাহেব। অকস্মাৎ একটি অভিনব অভ্যাগতের আগমন এবং গুডমর্ণিং সম্ভাসনে সাহেব চমৎকৃত হয়ে উঠলেন। খালি গা, খালি পা, হাঁটুর উপড়ে কাপড় কেঁচায় কাপড় কোমরে বেড় দিয়ে জড়িয়ে বাঁধা, এক হাতে টিনের চোঙার মতাে একটা বাক্স, অন্য হাতে কালিকা শীর্ষ হুক্কা, বগলে ছাতা। চেহারা দেখে ইংরেজ সাহেবের একেবারে চক্ষু স্থির। সাহেব ইংরাজিতে বললেন, তুমি কি জঙ্গল থেকে বেড়িয়ে আসছ?
‘Are you coming from Jungle’
‘you are right, I am coming from Jungle’.
ইংরাজীতে শরৎচন্দ্র পণ্ডিত উত্তর দিলেন, ঠিক ধরেছেন, আমি জঙ্গল থেকেই আসছি। তােমার বুদ্ধির তারিফ করি সাহেব।
তুমি কি চাও।
একটা প্রেস কিনতে এসেছি।
কৌতুহলী হয়ে ইংরেজ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি করাে?
‘আমি একখানা’ জংলী কাগজের জংলী এডিটর।
সাহেবের মনােভাবের পরিবর্তন হল। একটু চিন্তায় পড়লেন তিনি। সাহেবের মনে হলাে লােকটা খাসা কথা বলছে। শরৎ চন্দ্রকে আসন গ্রহণ করতে বলে সাহেব তার সঙ্গে একটু খানি আলাপ শুরু করলেন। টিনের বাক্সটির প্রতি আঙ্গুলি নির্দেশ করে সাহেব বললেন, তােমার হাতে ওটা কি? (স্মোকিং অ্যাপারেটাস) সাহেব চমকে ওঠে ওটা দেখতে চাইলেন। শরৎচন্দ্র একে একে সেটির দুই প্রান্তের দুটি ঢাকনা খুলে দেখালেন –একটির মধ্যে গুড়-মাখানাে তামাক এবং অপরটির মধ্যে কৃষ্ণকলেবরটিকে, চোঙার মাঝখানে একটি ঢাকনা খুলে দেখলেন চকমকি, লােহা আর শােলা। সাহেবের আগ্রহ চরিতার্থ করবার জন্য উক্ত বস্তুগুলি কার্যকরিতাও প্রয়ােগ বিধি বর্ণনা করে ভারতীয় হুকো-তামাক সেবন-তত্ত্ব তাকে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। শরৎচন্দ্রের সরস বর্ণনা ভঙ্গিতে সাহেব একে বারে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে গেল। অবশেষে তাঁর সামনে বসে একটি বার হুঁকোর ধূমপান ও তামাক সেবন করার জন্য তিনি শরৎচন্দ্রকে অনুরােধ করলেন। সাহেবের সামনে বসেই শরৎ চন্দ্র হুঁকোর মাথা থেকে কলকেটি নামিয়ে সাহেব কে দেখালেন। কলকের তলা থেকে ঠিক্ রেটি বের করে সেটির উপকারীতা বেশ করে বুঝিয়ে সেটিকে যথা স্থানে স্থাপন করলেন।
সাহেব বেশ নিবিষ্টচিত্তে শরৎচন্দ্রে প্রত্যেকটি কথা শুনছেন ও দেখছেন।
তারপর তিনি টিনের চোঙাটির এক প্রান্তে ক্ষুদ্র গহ্বর থেকে ইক্ষুসার যুদ্ধ তামাক খানিকটা বের করলেন এবং সেটি দিয়ে কলকের গর্ভে যথারীতি পূর্ণ করলেন।
সাহেব একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছেন ।
এবার চকমকি ঠোকার পালা। শরৎচন্দ্রের বাঁ হাতের অর্ধমুষ্টিবদ্ধ করতলের মাঝখানে শােলা, শােলার কিছু ঊর্ধ্বে কুঞ্চিত তর্জনী ও অঙ্গুষ্ঠ দিয়ে চেপে ধরা চকমকি পাথর। ডান হাতের লৌহখণ্ডটি দিয়ে চকমকির উপরে একটি আঘাত করতেই অগ্নি স্ফুলিঙ্গ বেরিয়ে এসে ছিটকে পড়ল শােলার মাথায়। তারপর শরৎচন্দ্র শােলাটি ধরে এ-পাশ ও পাশ করে বাতাসে দোলাতে লাগলেন।
সাহেবের দৃষ্টিও যেন দুলছে।
তারপর তিনি চোঙাটির অপর প্রান্ত থেকে একখানি টিকে বের করে শােলার মাথায় আগুনের উপর বসিয়ে সেটিকে ধরে থাকলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই টিকের আগুন ধরে উঠল। এবার কলকের উপর টিকের খণ্ডগুলি ভাল করে সাজিয়ে তিনি অগ্নিদগ্ধ অংশটি স্থাপন করলেন। হুঁকোয় তামাক খাওয়ার প্রস্তুতি পর্ব শেষ করে হাত পরিষ্কার করে হাত ধােওয়ার জলের জন্য নিবেদন করলেন সাহেবের কাছে। সাহেব কলিং বেল বাজালেন।বেয়ারা এল। সাহেবের আদেশে শীঘ্র সে তােয়ালা, জল ও চিলিমচি নিয়ে সেখানে হাজির হল। শরৎচন্দ্র পন্ডিত পরিষ্কার করে হাত ধুলেন।আরাম করে বসলেন চেয়ারে। এর মধ্যে কলকের উপকার কালাে টিকে গুলি পুড়ে লাল হয়ে উঠেছে। অতঃপর হুঁকোর মুখ ওষ্ঠাধর স্পর্শ করে শরৎচন্দ্র বেশ একটু টান
দিলেন, আর তার সঙ্গে সঙ্গে হুঁকোর ডাবার জলের ভিতর থেকে জলতরঙ্গ ধ্বনিত হয়ে
উঠল।
এই ধ্বনি শুনে সাহেব চমকে উঠলেন।
হুঁকোর ডাবার মুখে দীর্ঘ টানটি দিয়ে স্বল্পক্ষর এক মুখ গালভরা ধোঁয়ার রাশির প্রতি চেয়ে সাহেব অবাক। বললেন, তুমি দেখছি বাঙালী বেনজামিন ফ্র্যাংকলিন।
অতঃপর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত ধূমপানের সঙ্গে সঙ্গে সাহেবকে আমাদের স্বদেশি-ধূমপানের তত্ত্ব বােঝাতে লাগলেন। এ দেশীয় ধূমপান কীরূপ বাস্তবে বিজ্ঞান সম্মতঃ তামাকের ধোঁয়া নল দিয়ে বেয়ে নিকোটিন মুক্ত হতে হতে ডাবার জল পরিশুদ্ধ ও পরিশ্রুত হয়ে এসে পৌছে যায় তামাকসেবীর বদন-বিবরে।
এইসব ব্যাপারটি অকাট্য যুক্তি পূর্ণ কথা শুনে সাহেব একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সাহেব শরৎচন্দ্র পণ্ডিতকে বললেন, তােমার ঐ আগুন ধরাবার উপকরণ গুলি দাও তাে, আমি একবার চেষ্টা করে দেখি, পারি কিনা। শরৎচন্দ্র সাহেবের হাতে লােহা, শােলা আর চকমকি পাথর দিয়ে আগুণের ফুলকি ফেলবার কায়দাটা ভাল করে শিখিয়ে দিলেন। সাহেব কয়েকবার চেষ্টা করলেন। আগুনের ফুলকি বেরােয় কিন্তু শােলার উপর পড়ে না। লােহার গােটা দুই ঘা সাহেব নিজের আঙ্গুলই লাগাল। তবু সাহেব ছাড়বার পাত্র নন। বহু চেষ্টার পর সফল হলেন শােলার মুখে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ পতনের সাথে সাথে সাহেবের মুখ খানিতে বিজয়ী নায়কের জয়াল্লাস দেখা দিল। সেই আনন্দের মধ্যে সাহেব শরৎচন্দ্র পণ্ডিতকে বললেন, কি রকম প্রেস তােমার দরকার ?
এস আমার সাথে। শরৎচন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে তিনি তার গুদাম ঘরে ঢুকে নানা প্রকারের পুরানাে প্রেস দেখলেন। একটি ভালাে মেসিনের প্রতি তার দৃষ্টি বিশেষরূপে আকর্ষণ করিয়ে সাহেব ওইটিকে নেবার জন্যে তাকে অনুরােধ করলেন। কিন্তু শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের যা অর্থ সম্বল সেটির দাম তার চারগুনের বেশি। সাহেবকে এ অক্ষমতার কথা জানালেন পন্ডিতমশাই।সাহেব বললেন, এখন তােমাকে টাকা দিতে হবে না। মেশিন তুমি নিয়ে যাও তােমার সুবিধা মতাে কিছু কিছু দিয়ে যতদিন পারাে টাকা শােধ করাে। আর তােমার জীবনে যদি শােধ করা না হয়, এবং আমিও ইহজগতে না থাকি, তা হলে তােমার উত্তরাধিকারীকে বলে যেয়াে, সে যেন আমার উত্তরাধিকারী টাকাটা দিয়ে দেয়। অবশ্য এজনে তােমাকে কোন দলিল পত্র লেখাপড়া কোন কিছুই করতে হবে না।
বলে সাহেব হাসতে লাগলেন এবং বারবার সনির্বন্ধ অনুরােধ করতে লাগলেন -ওই মেসিনটি নেবার জন্য। শরৎচন্দ্র সরাসরি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সবিনয়ে সাহেবকে বললেন, ক্ষমতার বাহিরে যাওয়া আমার স্বভাব নয়। আর ঋণ করাও আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। সাহেব তখনি বহু স্থানে টেলিফোন করে খোঁজ খবর নিলেন এবং সস্তায় পাওয়া যায় কিনা দেখলেন। অবশেষে এক স্থানে সন্ধান পেয়ে শরৎচন্দ্রকে নিজের গাড়িতে সেখানে নিয়ে গিয়ে নিজের নামে একশাে টাকার প্রেস কিনে দিলেন।
এইখানে শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের সঙ্গে এমন এক ব্যক্তির পরিচয় যিনি পরবর্তীকালে একজন বিখ্যাত কর্মীরূপে দেশ বরেণ্য হয়েছিলেন শরৎচন্দ্রের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের কথা আদৌ বিস্মৃত হননি, কিন্তু সেই পরিচয়কে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পরিণত করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক স্বর্গত সুরেশচন্দ্র মজুমদার।
বিদূষক দাদাঠাকুরঃ–
“জন্ম আমার জঘন্য স্থান পল্লীগ্রামের জঙ্গলে,
দেশের মঙ্গল যেমন তেমন নিজের পেটের মঙ্গলে,
আজ রাত্তিরে ভরে রাখি, খালি আবার কালকে তা,
পেটের জ্বালায় ‘বিদূষক’ চলে এলেন কলকাতা”
নিজের সম্পর্কে এ ঘোষণা বিদূষক দাদাঠাকুরের, যাঁর আসল নাম শরৎচন্দ্র পন্ডিত। গ্রাম্য স্কুলের পন্ডিত রসিকলাল ছিলেন দাদাঠাকুরের অভিভাবক। দাদা ঠাকুরের জীবনে ইনার প্রভাব অপরিসীম।
পিতৃব্যের প্রভাব অপরিসীম। সংসারের হাজারাে অস্বচ্ছলতার মধ্যেও তাঁর পিতৃব্যের সত্যবাদিতা, নীতিনিষ্ঠা; অন্যদিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস সকলের নজর কাড়ত। দাদাঠাকুরের জীবনেও এই সকল বিরল সদ্গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন মূর্ত প্রতিবাদী। তার সত্যবাদিতা, পাণ্ডিত্য, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, উপস্থিত বুদ্ধির পাশাপাশি সরল অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা তাঁকে জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তী করে তুলেছিল। পিতৃব্যের শাসন মেনে শৈশবে গড়ে ওঠা মিতব্যয়িতার আদর্শ তিনি সারাজীবন রক্ষা করেছেন। তার সুদীর্ঘ জীবনে তিনি কখনাে জুতাে পরেননি, পরিধান বলতে হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, বেশিরভাগ সময়েই নগ্নগাত্র।কদাচিৎ একটি উত্তরীয় ব্যবহার করেছেন। পল্লীগ্রামের এমন একটি গেঁয়াে লােক’ তার ধুলি-ধূসরিত পা নিয়ে রাজ্যের লাটবেলাট সাহেব সুবাের পাশাপাশি ঘােরাফেরা করেছেন, তাদের সামনে ইংরাজীর ফুলঝুরি ছুটিয়েছেন, তাদের সমীহ আদায় করেছেন ভাবতে অবাক লাগলেও বাস্তব এটাই।
ছাত্রাবস্থাতেই পিতৃব্যের ইচ্ছানুযায়ী তাকে বিয়ে করতে হয়। মাত্র ১১ বছর বয়সের বালিকা প্রভাবতী এলেন দারিদ্র লাঞ্ছিত স্বামীর ঘর করতে। সে দারিদ্র্যের পরিমাপ করাও অসম্ভব। পরবর্তীকালে দাদাঠাকুর কুচবিহারের মহারাজকে পরিহাস ছলে তার দারিদ্র্যের রূপবর্ণনা করেছিলেন। দাদাঠাকুরের সেই বর্ণনার আগে প্রসঙ্গ কথাটাও বলে নেওয়া দরকার। কুচবিহারের মহারাজের রাজভবন থেকে বহুমূল্য রত্ন অলঙ্কারাদি চুরি হওয়ায় মহারাজা বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন। শুভাকাঙ্খী বন্ধু-বান্ধবেরা পরামর্শ দিলেন মুর্শিদাবাদ থেকে ‘বিদূষক’ শরৎ পণ্ডিতকে নিয়ে আসতে তাঁর পরিহাস রসিকতায় মহারাজের বিষণ্ণতা কেটে প্রফুল্লভাব আসবে বলেই তাদের ধারণা। মহারাজার অনুরােধে দাদাঠাকুর এলেন এবং অল্প কদিনেই জয় করে নিলেন মহারাজার হৃদয়। কিন্তু মহারাজার অনুরােধেও দাদাঠাকুরের বেশিদিন কুচবিহারে থাকার উপায় নাই। কেন? দাদাঠাকুর জানাচ্ছেন, “আমার নিজের রাজধানী ছেড়ে বেশিদিন বাইরে অনুপস্থিত থাকবার উপায় নাই। আপনার রাজধানীতে যেমন অজস্র পুরাতন মুদ্রা। আর বহুদিনের বাসি খাদ্যদ্রব্য মজুত রেখেছেন, আমার রাজধানীতে কিন্তু তা রাখবার নিয়ম নেই। আমার রাজধানীতে রােজ ফ্রেশ জিনিসের আমদানি হয় – টাকা কড়িই বলুন আর খাদ্যদ্রব্যই বলুন বাসি জিনিসের সেখানে প্রবেশ নিষেধ। বহুকালের প্রথা, বংশপরম্পরা ধরে চলে আসছে। তা ছাড়া আপনার এখানে রােজ যেমন দেবপূজা হয়ে থাকে, আমার রাজধানীর ব্যবস্থা কিন্তু অন্যরকম। সেখানে স্বয়ং লক্ষ্মীনারায়ণ এসে নাচেন, তাঁদের নাচ স্বচক্ষে না দেখা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে পারিনা। অগ্নিদেবের বাজনার তালে তালে লক্ষ্মীনারায়ণ যখন একত্রে ডুয়েট নাচেন-তখন আমার মনস্কামনা সিদ্ধ হয়।”
দাদাঠাকুর এখানে রূপকছলে তার দিন আনি দিন খাই’-এর গল্প শােনাচ্ছেন মহারাজাকে। তাঁর লক্ষ্মী হচ্ছেন চাল আর নারায়ণ হচ্ছেন জল। অগ্নিদেবের বাজনার তালে তালে চাল সেদ্ধ হয়।তবেই তাদের গ্রাসাচ্ছাদন হয়। এহেন মহারাজা’ কি করে নিজের রাজধানী ছেড়ে বাইরে থাকেন! দাদাঠাকুর প্রায়ই বলতেন যাদের চেষ্ট আয়রণের মতাে শক্ত, একমাত্র তারাই আয়রণ চেষ্টে রাখার মতাে টাকা জমাতে পারে। পরিহাস ছলে এক নিদারুণ সত্যি কথা বলেছেন দাদাঠাকুর।
রসিকলালের অস্বচ্ছল সংসারে বসে বেশিদিন পড়াশােনা করার বিলাসিতা দেখানাে সম্ভব ছিল না দাদাঠাকুরের। তাই কলেজের পড়া অসমাপ্ত রেখেই দাদাঠাকুরকে জীবিকার সন্ধানে নামতে হয়। তবে চাকরি করার ব্যাপারে রসিকলালের আপত্তি। চাকরি মানেই তাে গােলামি। তিনি বলতেন It is better to starve than serve. অগত্যা স্বাধীন ব্যবসার কথা ভাবতে গিয়ে দাদাঠাকুরের মাথায় আসে পল্লীগ্রামে তখনও দুর্লভ ছাপাখানা করার ইচ্ছা। বিজ্ঞাপন দেখে তিনি ছাপাখানার অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি বিক্রেতা কলিকাতার ব্যবসায়ী ভােলানাথ দত্তর কাছ থেকে কিনলেন একটি ছাপাখানা দাম পড়ল সাকুল্যে ৪৬.০০ টাকা। সঙ্গে একটি প্রিন্টার্স গাইড নিয়ে দাদাঠাকুর ছাপাখানা সহ দেশে ফিরলেন।
এ ঘটনা ১৯০২ সালের। রঘুনাথগঞ্জে আড়াই টাকায় ভাড়া নেওয়া ঘরে যাত্রা শুরু হল পণ্ডিত প্রেসের। যার প্রােপাইটর, কম্পােজিটর, প্রুফরিডার এবং ইঙ্কম্যান স্বয়ং দাদাঠাকুর আর প্রেসম্যানটি হচ্ছেন একজন উওম্যান দাদাঠাকুরের পত্নী শ্রীমতী প্রভাবতী দেবী। পরবর্তীকালে ‘জঙ্গীপুর সংবাদ’ নামক পত্রিকা প্রকাশের আগে প্রেস পরিবর্তনের দরকার হয়ে পড়ল – একটু উন্নত যন্ত্রপাতি ছাড়া নিয়মিত পত্রিকা বের করা অসম্ভব। তার ধূমপানের যন্ত্রপাতি দেখে চমৎকৃত এক বিদেশী সাহেব ১০০.০০ টাকায় তাকে একটি প্রেস কিনে দিলেন। ১৩২১ বঙ্গাব্দের ৬ই জ্যৈষ্ঠ (ইং ১৯১৪ সাল) যাত্রা শুরু হল জঙ্গীপুর সংবাদ’-এর।
রঘুনাথগঞ্জ তথা জঙ্গীপুর মহকুমার একমাত্র প্রেস বলে সরকারী নিলাম ইস্তাহার, চেক দাখিলার বেশ কিছু কাজ পেতেন দাদাঠাকুর। কিন্তু তার পরিমাণ এমন নয় যে বৃহৎ সংসার প্রতিপালন করে কিছু সঞ্চয় করা যেতে পারে। বৃহৎ সংসার শুধু কথার কথাই নয়, আক্ষরিক অর্থেই তার সংসার ছিল বিরাট। তার আটটি সন্তান – চার পুত্র ও চার কন্যা। পুত্রদের মধ্যে সত্যেন্দ্রকুমার ও বিমলকুমার শৈশবেই মারা যায়। তার জীবিত পুত্র কন্যাদের নাম ছিল বিনয়কুমার, অনিলকুমার, ইন্দুমতী, বিন্দুবাসিনী, রেণুকা ও কণিকা।
১৩১১ বঙ্গাব্দে মারা যান তার পিতৃব্য রসিকলাল তখন থেকেই পুরাে সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে তার ঘাড়ে।
তার পত্রিকা ‘জঙ্গীপুর সংবাদ’ মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যতম প্রাচীন পত্রিকা। সরকারী বিজ্ঞাপন, নিলাম, ইস্তাহারের পাশাপাশি এ কাগজে ছাপা হত নানা ধরণের সংবাদ। স্বাদু পরিবেশনার গুণে অল্পদিনেই এ পত্রিকা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন দাদাঠাকুরও। দাদাঠাকুরের খ্যাতি ও প্রতিপত্তিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে কতিপয় ব্যক্তি বের করেন ‘জঙ্গীপুর বাণী’ নামে আরেকটি সংবাদপত্র। শুধু দাদাঠাকুরের নামে কুৎসা রটনা করাই নয়- পত্রিকার কর্তারা ষড়যন্ত্র শুরু করলেন যাতে সরকারী নিলাম, ইস্তাহার ও অন্যান্য বিজ্ঞাপন ‘জঙ্গীপুর সংবাদ’-এর পরিবর্তে ‘জঙ্গীপুর বাণী’ পায়। সরকারী কর্তাদের কেউ কেউ দাদাঠাকুরের স্পষ্টভাষণে বিরক্ত ছিলেন তাই ‘জঙ্গীপুর বাণী’-র হাত দিয়ে ‘জঙ্গিপুর সংবাদ’ তথা দাদাঠাকুরকে ভাতে মারার প্ল্যান হল। শেষ পর্যন্ত দাদাঠাকুরের ধুরন্ধর কূটবুদ্ধিতে সেই কাগজ সরকারী কর্তৃপক্ষের বিরাগ ভাজন হয় এবং কালক্রমে বন্ধ হয়ে যায়।
১৩২৯ বঙ্গাব্দের ৬ই মাঘ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। প্রকাশিত হল ধামাধরা উদারপন্থীদলের সাপ্তাহিক মুখপত্র’ সাপ্তাহিক ‘বিদূষক’। প্রথম সংখ্যায় প্রথম সংখ্যার পরিবর্তে লেখা হয়েছিল প্রথম হর্ষ আর এডিটার (Editor) -এর বদলে ‘Aideater’। প্রচ্ছদচিত্রও ছিল অবিস্মরণীয়। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ব্যঙ্গচিত্রের কপালে লেখা ‘দুঃখ’, বুকে ‘দুরাশা’ আর পেটের উপরে লেখা ‘উদররে তুহু মাের বড়ি দুশমন। এই অসাধারণ পত্রিকাটির মুদ্রক, প্রকাশক, লেখক, সম্পাদক মায় বিক্রেতা পর্যন্ত সবই ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম দাদাঠাকুর। বিদূষক’ছাপিয়ে রঘুনাথগঞ্জ থেকে দাদাঠাকুর চলে যেতেন কলকাতায়। কলকাতার ফুটপাতে ফুটপাতে ফেরি করে বেড়াতেন বিদূষক’। তখন কলকাতা পুলিশ লাইসেন্স বিহীন হকারদের খুব হেনস্থা করত। পুলিশ যাতে দাদাঠাকুরকে হেনস্থা করতে না পারে সেজন্য কলকাতা কর্পোরেশনের তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক সুভাষচন্দ্র বসু নিজের পকেট থেকে চার টাকা ছ’আনা খরচ করে এই লাইসেন্স করিয়ে দিয়েছিলেন।
বাংলা সাহিত্যে দাদাঠাকুরের আরেকটি অবিস্মরণীয় অবদান বােতল পুরাণ। বােতলের আকারে কালাে রঙের মােটা কাগজ কেটে তারই মলাট আর তার ভিতরে লাল রঙের কাগজে মাতালদের উদ্দেশ্যে ছাপানাে কবিতা। বােতলাকৃতির এই বােতলপুরাণের দাম ছিল দু’আনা। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালাে সচিত্র বিদূষক – এর দাম প্রথমে ছিল চার পয়সা, পরে দাদাঠাকুর এর দাম কমিয়ে করেন এক পয়সা। কলকাতার রাস্তায় দাদাঠাকুর গান গেয়ে গেয়ে এই বিদূষক’ আর ‘বােতলপুরাণ’ বিক্রি করতেন। তাঁর পত্রিকা ফেরির গানও ছিল বিভিন্ন ভাষায়। বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় তিনি গাইতেন—–
“আমার বােতল নিবি কে রে?
এই বােতলে নেশাখােরের।
নেশা যাবে ছেড়ে।
বােতল নিবি কেরে?”
সাহেবপাড়া বা ইংরেজ অধ্যুষিত এলাকায় তার গান –
“ হিউমার, স্যাটায়ার উইট
আর ইন মাই পাবলিকেশন।
জেন্টলম্যান টেক দি বটল
ফর ইওর রিলাক্সেশন।।
ইট ইজ অব নাইস রাইম্
দেয়ার ইজ নাে ভাইস ক্রাইম
অ্যাট ইওর লীজার টাইম
রীড ইট ফর রিক্রিয়েশন।।”
আর অবাঙালি হিন্দি ভাষাভাষী এলাকাতে তাঁর গান খােদ হিন্দিভাষাতেই-
“কালা এইসা বােতলমে
লাল রঙকে মাল
দো আনা পৈসা দেকে
পিয়ালামে ঢাল।।
ইসমে নেহী দারু,
খালি হ্যায় মিঠি ঝাড়ু
পীকে শায়েস্তা হােগা
শারাবী মাতাল।।”
মুখে মুখে কবিতা রচনার সহজাত ক্ষমতা ছিল দাদাঠাকুরের। শুধু বাংলা ভাষাতেই নয়, ইংরাজী, হিন্দি সব ভাষাতেই তিনি প্রচুর তাৎক্ষণিক কবিতা রচনা করেছেন। সমসাময়িক রাজনীতি, সমাজনীতি নিয়ে তার এই তাৎক্ষণিক রসরচনাগুলি অতুলনীয়।
তীক্ষ হুল ফোটানাে বিদ্রুপ দিয়ে তিনি স্বজাতিকে, তার নানা বিচ্যুতিতে, নানা নৈতিক স্খলনে আঘাত করেছেন, জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন স্বাজাত্যভিমান। তার কবিতা রচনার প্রক্রিয়াও ছিল অভিনব। পুরানাে ব্লক সস্তা দরে কিনে সেই ব্লকের ছবি অনুযায়ী লেখা।
হ’ত কবিতা কবিতা অনুযায়ী ব্লক নয়, ব্লক অনুযায়ী কবিতা। মফস্বলের দুঃস্থ পত্রিকার পক্ষে এর চেয়ে ভালাে কিছু করা প্রায় অসম্ভব। তবু এত প্রতিকূলতাও বিদূষক বা বােতলপুরাণের মাহাত্ম্য এতটুকু ক্ষুন্ন করতে পারেনি। বিদেশীদের অন্ধ অনুকরণ বা পণপ্রথার মত দেশীয় কুপ্রথার তিনি ছিলেন ঘােরতর বিরােধী। এনিয়ে তার রীতিমতাে স্পষ্ট মতামত ছিল। প্রাসঙ্গিকভাবে দু’একটি কবিতার কিয়দংশ উদ্ধার করা যেতে পারে। পণ নিয়ে ছেলের বিয়ে দেওয়া মা আর পুত্রবধূর সংলাপ এই ধরণের—–
শাশুড়ী
“কি কুক্ষণে লক্ষীছাড়া
ঢুলি এসে আমার ঘর
স্কন্ধে চেপে আমার অমন
সােনার বাছায় করলি পর!
মাইনে পেলে সব তােরে দেয়।
দুঃখের কথা কি আর কই
তুই হলি তার আপনজনা
আমরা বুঝি কেহই নই!”…………
বধূ
আতুড় হইতে কলেজ খরচা
হিসেব করিয়া চার হাজার,
বাবার নিকটে নিয়েছ গুনিয়া
পুত্রের দাবী কেন আবার?
সাবধান বুড়ি ! আমার সঙ্গে
ঝগড়া এরূপ করােনা আর,
তােমার পুত্রে আইনত আমি
খরিদ সূত্রে দখলিদার।”
তাঁর ভােটামৃত ছড়া, কলকাতার ভুল, টাকার উনপঞ্চাশৎ নাম প্রভৃতি কবিতা একদা অতীব জনপ্রিয় হয়েছিল। আজকের ভােট-ভিখারীদের সম্পর্কেও তার সেই ভােটের ছড়া সমান প্রাসঙ্গিক –
“ভােট দিয়ে যা।
আয় ভােটার আয়
মাছ কাটলে মুড়াে দিব,
গাই বিয়ােলে দুধ দিব,
দুধ খেতে বাটি দিব,
সুদ দিলে টাকা দিব,
ফি দিলে উকিল হ’ব,
চাল দিলে ভাত দিব,
মিটিং – এ যাব না, অবসর পাব না
কোনাে কাজে লাগবাে না,
যাদুর কপালে আমার ভােট দিয়ে যা।”
টাকার উনপঞ্চাশৎ নাম কবিতাটিও রসরচনার এক উল্লেখযােগ্য নিদর্শন——
“…….যখন টাকা জন্ম নিল টাকশাল ভিতরে।
মর্ত্যলােকে নরগণ লােভবৃষ্টি করে।।
উত্তমর্ণ রাখি আইল অধমর্ণ ঘরে।
সুদরূপে তথা প্রভু দিনে দিনে বাড়ে।।
দেনদার রাখিল নাম কর্জ আর দেনা।
মহাজন নাম রাখে দাদন লহনা।।
পশ্চিমবঙ্গের লােক টাকা নাম রাখে।
পূর্ববঙ্গবাসী সব টাহা বলে থাকে।।
সাহেব রাখিল নাম রুপি আর মনি।
বিলাতে হইল নাম পাউণ্ড শিলিং গিনি।।
রুপেয়া রাখিল নাম দেশােয়ালি ভাই।
টঙ্কা নাম রাখিলেন উড়িয়া গোঁসাই।।
তহবিল নাম রাখে সওদাগর ধনী।
ফেয়ার রাখিল নাম রেলওয়ে কোম্পানী।।
ভিজিট রাখিল নাম ডাক্তারের দলে।
ফি নাম রাখিল যত মােক্তার উকিলে।।” ..ইত্যাদি
প্রথমদিকে রঘুনাথগঞ্জের নিজের প্রেস থেকে পত্রিকা ছাপিয়ে এনে কলকাতায় তা ফেরি করতেন দাদাঠাকুর। পরবর্তীকালে তিনি বাগমারীতে ভােলানাথ দত্ত মহাশয়ের বাড়ীর নীচতলায় একটি ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানেই ছাপাখানা করেন। তাঁর দীর্ঘজীবনে তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রের বহু বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে আসেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, পণ্ডিত মতিলাল নেহেরু, নির্মলচন্দ্র চন্দ্র, রসরাজ অমৃতলাল বসু, সুগায়ক
দিলীপকুমার রায়, মহম্মদ আলি জিন্না, কাজী নজরুল ইসলাম, রাজ্যপাল হরেন্দ্রকুমার মুখােপাধ্যায় প্রমুখেরা তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন। নির্মলচন্দ্র চন্দ্রের সঙ্গে দিল্লীতে গিয়েও তিনি।
তার প্রতিভার কিরণ ছড়িয়ে এসেছেন। একদিন সরকারী মুখপাত্র স্যার বেসিন ব্ল্যাকেটের
বাড়ীতে বিরােধীপক্ষের সদস্যদের ডিনারের নিমন্ত্রণ। লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে মারামারি আর ডিনারের ‘কিসসা’ নিয়ে পণ্ডিত মতিলাল নেহেরুর অনুরােধে দাদাঠাকুর একটি অম্লমধুর ইংরাজী ছড়া রচনা করেন এবং বলা বাহুল্য এটি ছিল অনুরুদ্ধ হয়ে মুখে মুখে রচিত ছড়া যা তার ইংরাজী জ্ঞান এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচায়ক –
“ফাইটিং অ্যাট দি অ্যাসেম্বলি অ্যান্ড
ডাইনিং অ্যাট দি ডিনার,
হােয়্যার আর ইউ ভারচুয়াস অ্যাণ্ড
হােয়্যার আর ইউ সিনার ?
হােয়্যার ডু ইউ কমিট নিউসেন্স
হােয়্যার আর ইউ ক্লিনার ?
হােয়্যার আর ইউ জাইগান্টিক অ্যাণ্ড
হােয়ার আর ইউ থিনার?”
কথা নিয়ে তার কথকতা ছিল দেখার মতাে। তার ভাষায় যে rents pay করে সেই Parents বা Aided School হয় A dead school। কলকাতা বেতারের অনুষ্ঠানে তিনি তার এই অদ্ভুত ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন একাধিকবার। একসময় বেতারের ছােটদের বৈঠক ও পল্লীমঙ্গল অনুষ্ঠানে দাদাঠাকুর নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। দাদাঠাকুরের বক্তব্যের পর সেই বিষয় নিয়ে দাদাঠাকুরেরই রচিত গান গাইতেন হাসির গানের গায়ক সারদা গুপ্ত। দাদাঠাকুর একদিন তাদের অনুষ্ঠানের ভূমিকা করছেন এইভাবে, “আজকের এই অনুষ্ঠানে আমি কথা বলবাে, আর আমার হয়ে গান ধরবে সারদা। কারণ আমি যেমন সুর কানা তেমনি তাল-কানা। দুদিকেই কানা। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে আমি ধৃতরাষ্ট্রের মতাে অন্ধ—তাই আজ সারদা আমার গান-ধারী হয়ে এসেছে। ” বলা বাহুল্য এই অনুষ্ঠানগুলি সেকালে অতীব জনপ্রিয় ছিল।
কথা নিয়ে খেলার অসাধারণ নমুনা তার প্রশ্নোত্তর, যাতে প্রশ্নের মধ্যেই রয়েছে উত্তর যেমন—-
-এটা কি গ্রাম ?
– এ টাকি গ্রাম।
-এ কি মা?
-এ কিমা।
-কে সব দেবতার মধ্যে পালনকর্তা ?
– কেশব দেবতার মধ্যে পালনকর্তা।
-অরুচি হলে নিম কি রুচিকর ?
-অরুচি হলে নিমকি রুচিকর।
-নারায়ণকে গর্ভে ধারণ করে কষ্ট পেয়েছেন এর দৃষ্টান্ত দেব কি?
– নারায়ণকে গর্ভে ধারণ করে কষ্ট পেয়েছেন এর দৃষ্টান্ত দেবকি। ইত্যাদি।
দাদাঠাকুর কিছু বাংলা বাক্য রচনা করেছিলেন, যা বামদিক থেকে পড়লেও যা, ডানদিক থেকে পড়লেও তাই হয়। যেমন—
-চার সের চা।
-রমা তাে মামা তােমার।
-কীর্তন মঞ্চ পরে পঞ্চম নর্তকী।
– বেনে তেল সলতে নেবে। ইত্যাদি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধ ঋণ সংগ্রহের জন্য জঙ্গীপুর মহকুমার হাকিমের ডাকা সভায় এসেছেন প্রেসিডেন্সি বিভাগের কমিশনার। সভায় সব বক্তাদের বক্তব্য এ যুদ্ধে জয়ী হবে ইংরেজ পক্ষ জার্মানীর পরাজয় সুনিশ্চিত করার জন্য আমাদের ইংরেজ সরকারকে লােক ও অর্থবল দিয়ে সাহায্য করা দরকার । দাদাঠাকুর বলতে উঠেই উল্টো গাইতে শুরু করলেন। তার মতে এ যুদ্ধে জয়ী হবেন – জার্মান – জার্মানী।
এই বিরুদ্ধ ভাষণে সকলেই হতচকিত। মহকুমা হাকিম প্রমাদ গুনছেন, দাদাঠাকুর না জানি আরাে কি বেফাস কথা বলে ফেলেন। কমিশনার সাহেবেরও মুখ লাল। সবার প্রতিক্রিয়া দেখে নিয়ে দাদাঠাকুর বললেন “আমরা ফর্টিনাইথ বাঙালি রেজিমেন্ট তৈরী করে এই যুদ্ধে ভারত সম্রাটের লােকবল বৃদ্ধি করেছি এবার অর্থদানের পালা। তাই বলছি এ যুদ্ধে জয়ী হবে যার Man, যার Money.”
কথা শিল্পী শরৎচন্দ্রের জন্মদিনে বেতারের ‘শরৎশর্বরী’ অনুষ্ঠানেও দাদাঠাকুর এমন মজা করে অনুষ্ঠানের কর্তাদের হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বেতারের ‘লাইভ প্রােগ্রামে তিনি বলে বসলেন, “দেশশুদ্ধ লােক শরৎচন্দ্রকে বড় বলে মানলেও তিনি ছােট, নিতান্ত ছােট।” উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ঈষৎ চঞ্চল। কোন লাইনে যাচ্ছেন দাদাঠাকুর, শেষকালে না একটা কেলেঙ্কারী করে বসেন। দাদাঠাকুরের তাতে ভ্রুক্ষেপ নাই। তিনি ব্যাখ্যা করছেন শরৎচন্দ্র কেন ছােট। একদিন নারদ বৈকুণ্ঠে গিয়ে নারায়ণকে জিজ্ঞাসা করলেন “সব চেয়ে বড় কে? কেই বা সবার চেয়ে ছােট ?” নারায়ণ উত্তর দিলেন। সব চেয়ে ছােট আমি, আর নারদ তুমি সবার চেয়ে বড়। এই জল স্থল অন্তরীক্ষ — আমি সবার স্রষ্টা। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্ৰা আমি। সুতরাং তােমার মনে হতে পারে আমি সকলের বড়। আধার চেয়ে আধেয় বড় হতে পারে না। ভক্তের হৃদয়ে আমার আসন; সেখানে আমি ছােট বৈ কি!” দাদাঠাকুরের উপসংহার “অগণিত ভক্তের হৃদয়ে শরৎদার আসন আজ সুপ্রতিষ্ঠিত, সেখানে তিনি ছােটই তাে। নারায়ণের নজির একথা মানতেই হবে।”
হাস্যরসিক এই কুসুমকোমল মানুষটি নিজে হতদরিদ্র হলে কি হয় তিনি বহু অভাবী মানুষকে সাধ্যমতাে সাহায্য করতেন। আবার তার কূটবুদ্ধির কাছে হার মানতে অনেক তাবড় তাবড় মাথা। জঙ্গীপুর সংবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কাগজ ‘জঙ্গীপুর বাণী’র প্রতি কর্তৃপক্ষকে বিষিয়ে তােলা তার কূটবুদ্ধির প্রত্যক্ষ প্রমাণ। রেলের পার্শেল ভেঙে দরিদ্র ব্যবসায়ীর সুগন্ধী তেল চুরি যাওয়া আটকাতে দাদাঠাকুর যে পথ অবলম্বন করেছিলেন তা শঠের সঙ্গে শঠতার চরমতম নিদর্শন। দরিদ্র ব্যবসায়ীর সুগন্ধি কেশ তেল রেলের পার্শেল ভেঙে চুরি যাচ্ছে। দাদাঠাকুর রসায়নের অধ্যাপকের পরামর্শ নিয়ে সেই ব্যবসায়ীকে পরামর্শ দিলেন সুগন্ধি তেলে বেরিয়াম সালফেট মেশাতে। সেই পরামর্শ মতাে তেলে বেরিয়াম সালফেট মিশিয়ে পার্শেল করা হল। যথারীতি আবার পার্শেল ভেঙে চুরি হল সুগন্ধি তেল। মনে মনে হাসলেন দাদাঠাকুর। দিন দশেকের মধ্যেই ফল পাওয়া গেল।
স্টেশন মাষ্টারের পরিবারের সবার মাথার চুল উঠে যাচ্ছে। না—এর পর আর কোনদিন পার্শেল ভেঙে তেল চুরি হয়নি।
এরকম অজস্র ঘটনার কেন্দ্রীয় চরিত্র – দাদাঠাকুর, শরৎচন্দ্র পন্ডিত। তার আত্মসম্মান জ্ঞান ছিল প্রখর। কারাে কাছে হাত পাততে বা অযাচিত দান গ্রহণে তাঁর প্রবল আপত্তি ছিল। লালগােলার মহারাজা যােগীন্দ্রনারায়ণ রাও তার কাগজের জন্য উন্নত প্রেস ও অন্য সাজসরঞ্জাম কেনার জন্য তাঁকে সেইযুগে পঁচিশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন। তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন সেই প্রস্তাব। নিজের সম্পর্কে তিনি বলতেন- I first person, singular number, always capital, never takes help of another alphabet.
গরিবের বন্ধুঃ
একদিন সকাল, তার সহকর্মীদের নিয়ে ছাপাখানায় দাদাঠাকুর গল্প গুজব করছেন। এমন সময় সামনের রাস্তা দিয়ে একজন মলিন বেশে এক ভদ্রলােককে দেখতে পেয়ে দাদাঠাকুর ডাকলেন। ভদ্রলােকটি দাদাঠাকুরের বিশেষ পরিচিত। দশ বারাে বছরের একটি ছেলেকে সঙ্গে করে ভদ্রলােক ছাপাখানার ভিতরে এলেন; ছেলেটির দিকে চেয়ে দাদাঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন, এটিকে?
‘আমারই ছেলে।
‘কোথায় চলেছ?
ভদ্রলােকটি বললেন, ছেলেটিকে বাজারে নিয়ে যাচ্ছি; কোন দোকানে কাজকর্ম করে যদি দু’পয়সা আয় করতে পারে। অনন্ত ওর নিজের পেটের খরচটাও যদি রােজগার করতে পারে, তাহলে আমি বেঁচে যায়।
দাদাঠাকুর বললেন, তার মানে ওকে মেরে তুমি বাঁচবে।
ভদ্রলােক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, কী করি দাদা সংসার চালানাে যে দায় হয়েছে।
দাদাঠাকুর একটু উত্তেজিত হয়েই বললেন,তাই বলে ওইটুকু ছেলেকে দোকানে চাকরি করতে পাঠাবে। দোকান বলতে তাে এখানে কাপড়ের দোকান। কাপড়ের দোকানদাররাই এখানে মাইনে দিয়ে লােকজন রাখে। তেমনি হাড়ভাঙা খাটুনি খাটিয়ে নেয়। ও লেখাপড়া করেননি কিছু?
স্কুলে পড়েছিল তাে, কিন্তু আমি আর পড়াতে পারলাম না। দু’বেলা দুটি অন্ন জোটাই ভার। মাসে মাসে স্কুলের মাইনে জোটাই কি করে বলুন দাদাঠাকুর অনেকক্ষণ ভদ্রলােকটির সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করে বললেন। এখন ওকে কোন দোকানে-টোকানে ঢুকিয়াে না। এতদিন যেমন করে সংসার চালিয়েছ,তেমনি করে আরও একটি হপ্তা চালাও,সাতদিন পরে তুমি একবার আমার সঙ্গে দেখা করাে। দেখি যদি কিছু করতে পারি।
সপুত্র ভদ্রলােকটি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। দাদাঠাকুর নলিনীকান্ত সরকারকে বললেন, নলে ছেলেটির জন্য ভেবে একটা কিছু ঠিক কর। ওকে পড়াতে হবে। আসলে ভাবনা বাসা বেঁধেছে দাদাঠাকুরেরই মনে। নলিনীকান্তকে ভাবতে সে বললেন, সেটা তার ভাবনারই বহিঃপ্রকাশ। সেই মতাে ওই অবস্থাতেই প্রসঙ্গটি শেষ হলাে। পরের দিন দাদাঠাকুর পুনরায় ছেলেটির কথা তুললেন। বললেন, ছেলেটি আমার বাড়ীতে থেকেই জঙ্গিপুর স্কুলে পড়ুক, চলে যাবে একরকম করে, কি বলিস?
নলিনীকান্ত বললেন, আপনার চলে যাবে হয়তাে কিন্তু বৌদির চলা কঠিন।
“কেন?
‘সংসার নিয়ে দিবা-রাত্র পরিশ্রমের অন্ত নেই তার। আমরা বাড়তি দুটি জীব (আমি ও একজন কম্পােজিটর) তার স্কন্ধে ভর করেছি। আর ভার বাড়াবেন না দাদা – বৌদি মারা যাবেন। কথাটা দাদাঠাকুরের আদৌ মনঃপুত হল না। একটু জোরের সঙ্গে বললেন,তার যদি আর একটা ছেলে থাকতাে, তাহলে সেটিকে কি তিনি ভার বা বােঝা মনে করত – না সেই বােঝার ভারে মারা যেতেন?’ নলিনীকান্তও একটু জোর দিয়েই বললেন, “কি হলে কি হত, এসব যদি’ নিয়ে তর্ক করা চলে না দাদা। আসল কথা হচ্ছে বৌদির স্বাস্থ্য ভালাে নয়, এখন তার উপর সংসারের যে ভার পড়েছে তা যথেষ্ট; এর উপর আর কিছু চাপাতে গেলে তার প্রতি অবিচার করা হবে।
দাদাঠাকুর বললেন,“দ্যাখ ওদিকটা আমি যে ভাবিনি তা নয়। ভেবে ঠিক করেছি – তাের বৌদির পক্ষে যদি অসুবিধা হয়, তাহলে ওঁকে দফরপুরের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেবাে। ছেলে-মেয়ে কটি নিয়ে সেখানে তিনি একটু আরামেই সংসার চালাবেন। আর এ বাড়ীতে ওই ছেলেটি সমেত আমরা ক’জন থাকবাে।
দাদাঠাকুরের পরিকল্পনা শুনে নলিনীকান্ত মহাশয়ের হাসি পেল। বললেন, আপনি যে মতলব করেছেন, ওটি বৌদিকে বলেছেন?
বলিনি এখনও বলব।
নলিনীকান্ত বললেন— বলে দেখুন বৌদিকে; তিনি কি বলেন শুনুন। আমিই বলে দিচ্ছি—তিনি আপনার প্রস্তাবে কিছুতেই রাজী হবেন না। হাজার দুঃখকষ্টের বােঝা তার ঘাড়ে চাপালেও তিনি মুখ বুজে সহ্য করে এখানেই থাকবেন, দফরপুরের বাড়ীতে আলাদা সংসার পাততে চাইবেন না – এ আমি বলে দিলাম।
দাদাঠাকুর পুনরায় চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
নলিনীকান্তের দিবানিশার আবাসস্থলে ছিল দাদাঠাকুরের ছাপাখানাটি। একদিন রাত্রি দুটো -তিনটের সময় তন্দ্রার ঘােরে তিনি শুনলেন ছাপাখানার বন্ধ দরজার কার যেন করাঘাত। ঘুম ভেঙে গেল। কানে এল ‘নলে দরজা খােল।’ এখন দাদাঠাকুর! কোন আকস্মিক দুর্ঘটনাই ঘটেছেবা ভাবতে ভাবতে তিনি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন কী হয়েছে, এখন আপনি যে?’ ‘কিছু হয়নি। ঘুম হলাে না কিছুতেই তাই চলে এলাম। একটু তামাক খাওয়াবি?
ন’লে তামাক সেজে দিল হুঁকোর একটি টান দিয়ে বললেন,ছেলেটির সম্বন্ধে কি ভাবছিস? তার বাবা আসবে তাে, কী বলব তাকে?
নলিনীকান্ত মশায় বললেন, দাদা আপনি যে সব রাজা-মহারাজা, জমিদার বাড়ি গিয়ে নিঃস্বার্থভাবে এতদিন আনন্দদান করে এসেছেন। তাদের প্রত্যেকেরই একটি করে হাইস্কুল আছে। আপনি যদি এঁদের কাউকে বলেন, নিশ্চয় কেউ না কেউ ছেলেটির ভার নেবেন। এই দিক দিয়ে দেখুন না একটু চেষ্টা করে?
তামাক খাওয়া ক্ষনেকের জন্য বন্ধ করে দাদাঠাকুর বললেন,আবার কার খােশামুদি করতে যাব, কে কথা রাখবে,কে না রাখবে!”
বললেন, কথা না রাখার কথাটা বা আগে থেকে ভাবছেন কেন? আপনি দেখবেন, আপনার অনুরােধ কেউ প্রত্যাখ্যান করবে না।
দাদাঠাকুর যেন অনিচ্ছাসত্বেও সম্মত হলেন। ঠিক দিনটিতে ছেলেটির বাবা ছাপাখানায় এসে দাদাঠাকুরের সঙ্গে দেখা করলেন। পরদিন ভাের বেলায় ছেলেটিকে নিয়ে আসতে বললেন, দাদাঠাকুর। ছেলের বাবা চলে গেলেন। দাদাঠাকুর নলে কে বললেন,চল তাহলে তােদের নিমতিতার জমিদার বাবুদের কাছেই আগে যাই, দেখি তারা কি বলেন?
তাদের তাে হাইস্কুল বাের্ডিং সবই আছে। এখানে খুব সংক্ষেপে নিমতিতার জমিদারদের সম্বন্ধে একটু না বললে পরবর্তী ঘটনা জানার পক্ষে পাঠক- পাঠিকাবর্গের অসুবিধা হবে। তখন তারা জমিদার, তাদের জ্যেষ্ঠতাত গৌরসুন্দর চৌধুরী ও পিতা দ্বারকানাথ চৌধুরী এককালে এই জমিদারির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গৌরসুন্দর সম্বন্ধে অনেক কথা আমরা
শুনতে পায়। কিন্তু দ্বারকানাথ চৌধুরী মহাশয়ের জমিদারি পরিচালনা সময়ে আমি কৈশাের উত্তীর্ণ হয়েছি। স্বচক্ষে দেখেছি তার বহু প্রকার জনহিতকর কার্যকলাপ। এঁদের সদাব্রতের বিপুল সমারােহ ছিল দেখবার মতাে। অতিথি অনাহারে ফিরে যাবেনা না-
চাল অথবা আটা, ডাল এবং জ্বালানি কাঠ প্রভৃতি প্রত্যেকের জন্য মিলাবেই, স্থান অতিথিশালা।কখনাে কখনাে এক সাথে দুশাে-তিনশাে পথচারী সাধুর উপস্থিত হতে দেখেছি। সাধুদের প্রত্যেকের জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ ছিল নগদ চার পয়সা, গঞ্জিকার মূল্য। পরবর্তীকালে জমিদারদের আসলে সদাব্রতর এতদূর চালানাের আয়ােজন ছিল না অবশ্য।
ছেলেটি-ভােরবেলায় এল। দাদাঠাকুর নলিনীকান্ত ও ছেলেটি তিনজন ট্রেনে চেপে নিমতিতায় পৌছালাে। জমিদার বাবুর বাড়ি গিয়ে তারা সরাসরি তাদের কাছারির হলঘরে উঠলেন। জমিদার বাবুরা সকলেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। দেখা মাত্র তারা দাদাঠাকুরকে সসম্মানে অভ্যর্থনা করে জিজ্ঞাসা করলেন,’হঠাৎ আপনি পণ্ডিতমশাই?
কী ব্যাপার ?”
দাদাঠাকুর বললেন, সমন আছে। সমন জারি করতে এসেছি।
দাদাঠাকুরের রসিকতার সাথে তারা আগেই থেকেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু এই সমন জারির রহস্যটা ভেদ করতে পারলেন না। বললেন, কোথায় আপনার সমন?
দাদাঠাকুর ছেলেটিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই যে।
জমিদারের একজন বললেন, কিন্তু মােকদ্দমা কিসের?
দাদাঠাকুর বললেন, গৌরসুন্দর চৌধুরী আর দ্বারকানাথ চৌধুরী আপনাদের জন্যে যা দিয়ে গেছেন তা আপনারা স্বচ্ছন্দে ভােগ করুন আমাদের তাতে কোন আপত্তি নাই, কিন্তু আমাদের জন্যে যা রেখে গেছেন তা আমরা দাবি করতে ছাড়বাে না। সেই দাবিরই মকদ্দমা আর তারই এই সমন।
জমিদারদের ধাঁধা তবুও ঘুচল না! জিজ্ঞাসা করলেন, পণ্ডিতমশাই, একটু খুলেই বলুন না ব্যাপারটা।
এবার দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত মশাই ছেলেটির আদ্যোপান্ত ইতিহাস বললেন এবং নিজের কথা বলতেও দ্বিধা করলেন না তার নিজের বাড়িতে ছেলেটাকে রাখার পরিকল্পনার কথা নলিনীকান্তর সাথে পরামর্শ প্রভৃতি কিছুই অপ্রকাশ্য রইল না। সমস্ত ব্যাপারটা শুনে জমিদারবাবুদের একজন বললেন, ছেলেটির মাইনে না হয় ফ্রি করে দেওয়া যাবে। কিন্তু বাের্ডিং ফ্রি দেবার নিয়ম যে নেই। তবে একটা উপায় করা যায় আমাদের ঠাকুর বাড়ীতে ঠাকুরের প্রসাদ খেয়ে সে পড়াশুনা করতে পারে। কিন্তু তার একটু অসুবিধা হবে। ঠাকুরের ভােগ দেওয়া হয় দুপুরে প্রায় একটার সময়। ছেলেমানুষ সকাল থেকে বেলা একটা পর্যন্ত কিছু না খেয়ে থাকবে। কষ্ট হবে ওর।
দাদাঠাকুর বললেন,ঠাকুর বাড়িতে ও খাবার ব্যবস্থা করে দিন। কিছু মাত্র কষ্ট হবে না।
কী বলছেন পণ্ডিতমশাই,ওইটুকু বাচ্চা সকাল থেকে বেলা একটা পর্যন্ত খালি পেটে থাকবে, আর কষ্ট হবে না।
দাদাঠাকুর বললেন, খালি পেটে থাকবে কেন, ভরা পেটেই থাকবে, সেসব সুলুক সন্ধান আমি তাকে বলে দেব।
‘একটু আমাদের বলুন না, আমরাও শুনি।
দাদাঠাকুর বললেন,এ অত্যন্ত সহজ কথা। ছেলেটি দুপুরে খাবে আপনাদের ঠাকুরবাড়ি বসে আর পাঁচজনের সঙ্গে। আর রাত্রীকালের খাবারটা খাবে বাড়ীতে। সেই খাবার সে থালা বাটিতে করে বাড়িতে নিয়ে যাবে। বাড়ীতে খাবার নিয়ে গেলে খাদ্য বস্তুর পরিমাণ কিছু বেশি হয়ে থাকে। আমার মনে হয় সে রাত্রিতে সে যা নিয়ে যাবে তার অর্ধেক পরিমাণ তারপেট ভরে যাবে। বাকী অর্ধেকটা জল দিয়ে ভিজিয়ে রাখবে। তাই খেয়ে নেবে সকাল বেলায় কোন সময়ে। যখন তার খিদে পাবে। তারপর দুপুরে একটার সময় ঠাকুর বাড়িতে প্রসাদ। এই হিসেবে চললে তার কোনও কষ্ট হবে না। দাদাঠাকুরের কথায় জমিদারবাবুরা অভিভূত হলেন এবং ছেলেটির থাকা খাওয়া ও পড়ার সুব্যবস্থা করে দিলেন। তাকে বাসিভাত খেয়ে স্কুলে যেতে হত না – অনাহারে থাকতেও হত না কোন দিন সকালবেলায়।
দাদাঠাকুর রঙ্গরসিকার কথায় ওস্তাদ এবং গরিবের ভগবান। দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পন্ডিতের বহু দিক আছে। পরদুঃখ কাতরতা, সরলতা, ও আর্তজনের সেবা তার চরিত্রের এক বড় দিক। শবদাহ করাও দাদাঠাকুরের যেন পেশার মধ্যে পরিগণিত ছিল। কেবলমাত্র শবদাহ নয়, অপরের দুঃখে বােঝা হাসি মুখে নিজের স্কন্ধে তুলে নিয়েছেন বহুবার। একদিন দাদাঠাকুর কোন একটা ব্যাপার থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছাপাখানায় ঢুকলেন। ব্যাপার কি বােঝার উপায় নেই। বেশ এক ছিলিম তামাক খেয়ে যখন তিনি ধাতস্থ হলেন, তখন নলিনীকান্ত জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় গিয়েছিলেন। অন্য মনস্ক হয়ে দাদাঠাকুর উত্তর দিলেন, পাঁচশাে টাকার বড় দরকার হয়ে পড়েছে রে! কোথায় পাই বলতে পারিস? প্রেসের সহকারী নলিনী সরকার বললেন, হঠাৎ এত টাকার কী দরকার হয়ে পড়ল দাদা?’ ‘দরকারটা আমার নয় – অমুকের। দাদাঠাকুর একজন ভদ্রলােকের নাম করলেন। তার বাড়ি পূর্ববঙ্গে। সেই সময় তিনি রঘুনাথগঞ্জে থাকতেন। দাদাঠাকুর বললেন, দেশে ওর একটু তালুক আছে। প্রতি বছরের একটা নির্দিষ্ট দিনে সরকারের দপ্তরে পাঁচশাে টাকা জমা দিতে হয়। সেই দিনটি কাল, কাল যদি সেখানকার ট্রেজারিতে ওই টাকা জমা দিতে না পারে, তাহলে ওই তালুকটি নিলামে উঠবে। ওরা তালুকদার বটে কিন্তু বড়লােক নয়। ওই তালুকটির জন্যেই ওরা ভদ্র ভাবে থাকে, ওতেই ওদের মান-সম্মান। খাওয়া পরার সমাধানও হয় ওই তালুকের আয়েই। তাতেও কুলােয় না বাহিরে চাকরি করে সংসারের ঘাটতি পূরণ করতে হয়। পাঁচশাে টাকা জোগার করতে না পেরে সে মন মরা হয়ে বাড়িত বসে আছে। আমি যেতেই আমাকে সব কথা খুলে বললে। ওর মুখখানা দেখে বুকের মধ্যে মােচড় দিয়ে উঠল। আমি ওকে আশ্বাসন দিয়ে এসেছি – দেখি যদি পারি টাকাটা যােগাড় করতে। অগাধ জলে পড়েছে সে- উদ্ধারের কোন উপায় নাই। শেষ পর্যন্ত আমার মতাে তৃণতুচ্ছটিকে আঁকড়ে ধরল— যদি ডাঙায় উঠতে পারে এই ভরসায় !
কিছুক্ষণ নীরব থেকে অধস্ফুটস্বরে দাদাঠাকুর বললেন, পাঁচশাে টাকা, দুটো একটা নয়,- কোথায় পাই?
দাদাঠাকুরের অন্তরটি চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে আবার বেরিয়ে পড়লেন। ছাপাখানায় ফিরলেন প্রায় ঘন্টাখানেক পরে। ফিরে এসে বললেন টাকা পেয়েছি। টাকাটা টেলিগ্রাফ মানি অর্ডারে পাঠাবার ব্যবস্থাও করে এলাম। দাদা ঠাকুরের কথায় ধরনে মনে হলাে, তিনি দায়মুক্ত হয়ে ফিরলেন। কিন্তু পরে মনে হলাে তিনি দায়বদ্ধ হয়ে ফিরে এসেছেন। একজন ধনী ব্যক্তির কাছ থেকে দাবির অণুরূপ সুদে স্বীকৃত হয়ে। নিজ নামে স্বাক্ষর দিয়ে হ্যান্ডনােট লিখে তিনি পাঁচশাে টাকা ধার করে ভদ্রলােকটির সম্পত্তি রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন এবং দাদাঠাকুর নিশিন্ত বােধ করলেন। কিন্তু চিন্তার বােঝা চাপল তার মনের উপর, তিনি তাে ব্যক্তিটিকে অগাধ জল থেকে ডাঙায় তুললেন, কিন্তু নিজে ডুববেন না তাে? ঋণ করা দাদাঠাকুরের স্বভাববিরুদ্ধ কাজ। তার উপর এই পাঁচশাে টাকা ঋণ! যদি ঘটনাচক্রে এই ঋণ দাদাঠাকুরকেই পরিশােধ করতে হয়, তাহলে তাকে কী সমস্যারই না সম্মুখীন হতে হবে। অবশেষে বেশিদিন এই ঋণের ভার বহন করতে হল না। যার উপকার করার জন্য দাদাঠাকুর এই দুঃসাহসিক কাজ করেছিলেন, তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে দাদাঠাকুরের এই মহত্তের মর্যাদা রক্ষা করলেন। অল্পদিনের মধ্যে তিনি ঋণ পরিশােধ করে সেই ধনীব্যক্তির কাছ থেকে হ্যাণ্ড নােট খানি ফিরিয়ে এনে দাদাঠাকুরকে দিলেন।
দাদাঠাকুর ছিলেন গরিবের বন্ধু। একদিনের এক ঘটনা, পণ্ডিত প্রেসের সহকারী কর্মী নলিনীকান্তের এক তরুণ বন্ধুকলকাতায় বি.এ.পড়ে। প্রাইভেট টিউশন করে তাকে কলকাতায় থাকার ও পড়ার ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। একদিন তার কাছ থেকে একখানি চিঠি এল পঞ্চাশটি টাকার অভাবে তার বি.এ. পরীক্ষা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিপন্ন বন্ধুর জন্যে চিহ্নিত নলিনীকান্ত চিন্তিত হলেন। কিন্তু নিরুপায়, বন্ধু সাহায্য করার কিছু মাত্র শক্তি নলিনী কান্তের নেই। বন্ধুর চিঠিখানি সামনেই পড়ে ছিল, দাদাঠাকুর তখনই প্রেসে এলেন। সম্মুখে চিঠি আর তার নলের মুখে চিন্তার আভাস দেখে দাদাঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন-কার চিঠি রে। সব কিছু শুনে চুপ করে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে গেলেন এবং আবার এলেন ছাপাখানায়। এসে নলিনীকান্তের হাতে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বললেন,
‘এখনি পাঠিয়ে দে তাের বন্ধুর কাছে। পঞ্চাশটি টাকার জন্য বেচারার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে?
প্রায় চার বছর রোগভোগ করার পর ১২৮৮ সালের ১৩ ই বৈশাখ। এই শুভদিনে শরৎচন্দ্র পণ্ডিত- আমাদের দাদা ঠাকুর আত্মীয়-স্বজনের আনন্দ কল্লোল শঙ্খধ্বনির মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তার মাতুলালয় বীরভূম জেলার শিমলান্দী গ্রামে আর অগণিত অনুরাগী আত্মীয়বর্গ কে শোকাচ্ছন্ন পরিবেশের মধ্যে রেখে তিনি পরলোকগমন করলেন ১৩৭৫ সালের সেই ১৩ই বৈশাখেই। যে দিনটিতে তিনি মর্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই দিনটিতে তিনি জন্ম নিলেন ৮৭ বছরের প্রতীক্ষাকুল অমৃতলোকে।
দাদাঠাকুরের জীবদ্দশাতেই তার জীবনী নিয়ে পূর্ণ কাহিনীচিত্র (সিনেমা) তােলা হয়েছে। সেই সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র দাদাঠাকুরের ভূমিকায় অসামান্য অভিনয়ের জন্য ছবি বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পেয়েছেন। কিন্তু না, দাদাঠাকুরের জীবনে সরকারী উপাধি বা দাক্ষিণ্যলাভ করার সৌভাগ্য হয়নি। সরল অনাড়ম্বর অথচ জ্ঞানী এই মানুষটিকে মানুষ হিসাবে সম্মান জানানাের তাে অনেক সুযােগই ছিল সরকারের কথা বাদ দিলেও, আমরাই কি মনে রেখেছি সেই ‘বিদূষক’ আমাদের দাদাঠাকুরকে।
তথ্যসুত্রঃ–
১) দাদাঠাকুর। নলিনীকান্ত সরকার, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স।
২) বিস্মৃত বিদূষক দাদাঠাকুর। প্রকাশ দাস বিশ্বাস। অনন্য দাদা ঠাকুর,শিল্প নগরী প্রকাশনী।
৩)নন্য দাদাঠাকুর– কল্যান কুয়মার দাস। শিল্পনগিওরি প্রকাশনী।