Dr. Syama Prasad Mookerjee Research Foundation

‘সংবিধান দিবস’ ও আজকের ভাবনা

ভারতের পবিত্র সংবিধান গৃহীত হওয়ার স্মরণে প্রতি বছর ২৬শে নভেম্বর ‘সংবিধান দিবস’ পালিত হয়। ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর গণপরিষদে ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়েছিল, যা   কার্যকর হয় ২৬শে জানুয়ারী ১৯৫০ থেকে। দেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার সেই ২৬শে নভেম্বর দিনটি ভারতের ‘সংবিধান দিবস’। সংবিধানের খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান ড. ভীমরাও আম্বেদকরের ১২৫ তম জন্মবার্ষিকীতে এই দিনটি ‘সংবিধান দিবস’ হিসাবে ঘোষনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেটা মোদীজি’র নেতৃত্বে ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার ক্ষনতায় আসার ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে। তার আগে এই দিনটি ‘আইন দিবস’ হিসেবে পালিত হত।

 ১৯৪৭-এর ১৫ই আগস্টে পর স্বাধীন দেশের গণপরিষদ বি আর আম্বেদকরের সভাপতিত্বে গঠিত একটি কমিটির কাছে সংবিধানের খসড়া তৈরির দায়িত্ব অর্পণ করে। ১৯৪৬ সালে স্থাপিত সেই গণপরিষদের সভাপতি ছিলেন প্রবল জাতীয়তাবাদী ও হিন্দুত্ববাদী নেতা ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ। সংবিধান প্রণয়নের খসড়া কমিটির মুখ্য দায়িত্বে ছিলেন মোট সাত জন সদস্য। তবে সামগ্রিক কাজে ২৭১ জন পুরুষ ও মহিলার অংশগ্রহণ করেছিলেন। ড.  বি আর আম্বেদকর ছাড়াও এই কমিটির অন্যতম প্রধান ছিলেন- মাদ্রাজের এডভোকেট জেনারেল  আল্লাদি কৃষ্ণস্বামী আয়ার;  কাশ্মীর বিষয়ে অভিজ্ঞ, রাজ্যসভার নেতা, রেলমন্ত্রী ও আইন বিশেষজ্ঞ  এন. গোপালস্বামী; গুজরাটের অন্যতম প্রধান স্বাধীনতা সংগ্রামী রাজনীতিবিদ লেখক ও শিক্ষাবিদ আইন বিশেষজ্ঞ, কংগ্রেস নেতা ও পরবর্তীকালে ভারতীয় জনসংঘে যোগদান করা কে এম মুন্সি, আসামের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও উত্তর-পূর্ব ভারতের একমাত্র প্রতিনিধি মহম্মদ সাদুল্লা, ভারতের প্রিন্সলি স্টেটগুলিকে একত্রীভূত করার অন্যতম নেতৃত্ব  বি এল মিত্তর এবং ভারতের প্রাচীন আইন সংস্থাগুলির অন্যতম খৈতান অ্যান্ড কোং এর প্রতিষ্ঠাতা  ডি পি খৈতান প্রমূখ। এই খসড়া কমিটি  ১৯৪৭ সালের ৩০শে আগস্ট তাদের প্রথম বৈঠকে বি আর আম্বেদকর খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে।

১৯৪৮ সালের শুরুতে, ডঃ আম্বেদকর সংবিধানের খসড়াটি সম্পূর্ণ করেন এবং এটি গণপরিষদে উপস্থাপন করেন। খুব সামন্য সংশোধন মাধ্যমে ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর গৃহীত হয় ভারতীয় সংবিধান, পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি লিখিত সংবিধান। ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী সেটি কার্যকর হয় সারা দেশে। সেই ২৬শে জানুয়ারী বিশ্বের ‘বৃহত্তম গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ ভারতের ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’।

স্বাধীন ভারতের সংবিধান প্রণয়নের এই গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে ঐতিহাসিক কাজটি সম্পন্ন করতে সময় লেগেছিল প্রায় তিন বছর। তৈরী হয়েছিল হিন্দি ও ইংরেজিতে হাতে লেখা দুটি কপি। ভারতে শিল্প-সংস্কৃতি’র এক অলঙ্করণের এক সমৃদ্ধ উপস্থাপন রয়েছে। ইংরেজি সংস্করণ অনুযায়ী ১,১৭,৩৬০ শব্দ সমন্বিত এই ভারতীয় সংবিধান বিশ্বের বৃহত্তম লিখিত সংবিধান।

সংবিধান দিবস উদযাপনের প্রধানতম উদ্দেশ্য সংবিধান খসড়া প্রণয়নকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। লক্ষ্য ভারতে কোটি মানুষের কয়েকশো বছরের বৈষম্য দূরীকরণ এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন ও দূরত্বের অবসান ঘটিয়ে শক্তিশালী মুক্তির ঘোষণার সেই বিশ্বাসকে প্রতিজ্ঞায় রুপান্তরিত করা, তার উৎকৃষ্টতার সামনে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাথা নত করার অভ্যেস যাপন, ভাবনার মূল সুরটিকে গায়ে জড়িয়ে চুড়ান্ত দায়বদ্ধতার প্রদর্শন।

ভারতবর্ষের এই সংবিধান, তার গনতন্ত্রের সুদৃঢ় কাঠামো একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পরম গৌরবের। এর সন্মান, মর্যাদা রক্ষা করার দায়িত্ব যেমন প্রতিটি নাগরিকের তেমনি তার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করার দায়ও মূলত শাসকের। স্বয়ং আম্বেদকর লিখেছেন, “সংবিধান যতই ভালো হোক, যারা তা বাস্তবায়ন করছে তারা ভালো না হলে সেটা খারাপ প্রমাণিত হবে; সংবিধান যতই খারাপ হোক না কেন, যারা বাস্তবায়ন করছে তারা ভালো হলে সেটাই ভালো।”

গনতন্ত্রের মূল সুর হলো- তুমি নাগরিক, তোমার কথা নাও গৃহিত হতে পারে, মান্যতা নাও পেতে পারে শাসকের বিচারে; কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার নিরন্তর মান্যতা দেবে রাষ্ট্র।

আজ যখন  শাসক তার সিদ্ধান্ত গ্রহনে এবং ক্ষমতা দখলের সুতীব্র আকাঙ্খাকে চরিতার্থ করতে ব্যক্তি স্বার্থ ও ক্ষুদ্র রাজনৈতিক লাভকে প্রধান উপজীব্য করে; কেবল ভোট ব্যাঙ্ক নিশ্চিত করার উদগ্র বাসনায় বিশেষ ধর্মকে তোষণ-উস্কানি, জাতিতে জাতিতে দূরত্ব তৈরিকে ‘সংস্কৃতি’ বলে অস্থিরতার আবহে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করছে, সংবিধানের সাম্যতার মূল সুরকে ভেঙে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা চালায়- তখন এই সংবিধান দিবসই কেমন ম্লান হয়ে যায়, কোটি কোটি রাষ্ট্রবাদী ভারতীয়ের কাছে।

এক বাঙালি শিল্পী নন্দলাল বসুর অলঙ্করণ করা সংবিধান তৈরির সেই গৌরবজনক ইতিহাস অন্তত একবার ফিরে দেখুক আজকের প্রজন্ম। আর জ্যোতির্ময় পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৫ স্তবকের যে কবিতার প্রথম স্তবক আমাদর ‘জাতীয় সঙ্গীত’, তার অন্তত ২য় স্তবকটি পড়ে দেখার প্রয়োজন অনুভব করুক আজকের সময়; তার প্রতিটা শব্দে ভারত আত্মার মূল সুরটি অনুরণিত।

অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী

হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী

পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে

প্রেমহার হয় গাঁথা।

জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!

জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে॥”

২৬শে নভেম্বর, ২০২৪

Author