Dr. Syama Prasad Mookerjee Research Foundation

‘বঙ্কিম আন্দোলন’ ও সরকারি নিষেধাজ্ঞা:

স্বদেশি আন্দোলনের কিছু পূর্বে ১৯০৪ সালে ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত ডেরাইসমাইল খাঁ-এর এক ক্ষুদ্র জমিদার টহলরাম গঙ্গারাম কার্জনের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে কলকাতায় এক ব্যাপক জনমত গড়ে তোলেন। ছাত্র সমাজের ওপর তাঁর ব্যাপক প্রভাব ছিল। কৃষ্ণকুমার মিত্রের লেখা থেকে জানা যায় যে, তাঁর অন্যতম প্রধান শাগরেদ হেমচন্দ্র সেন ও দলবল নিয়ে প্রতিদিন বিকেলে টহলরাম কলেজ স্কোয়ার ও কলকাতার অন্যান্য রাস্তায় ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীত গেয়ে বেড়াতেন। “যে বন্দে মাতরং সঙ্গীত বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠে’ লিপিবদ্ধ ছিল, হেমচন্দ্রই প্রথমে সেই সঙ্গীত কলেজ স্কোয়ারে গান করিয়া সহস্র লোককে স্বদেশপ্রেমে মাতোয়ারা করিত।”১

১৯০৩ সালের ৩ ডিসেম্বর-জাতীয়তার উত্তাল তরঙ্গে উদ্বেলিত বাংলাদেশকে দুর্বল
করার উদ্দেশ্যে, শাসনতান্ত্রিক সুবিধার মিথ্যা অজুহাতে ভারতের বড়োলাট লর্ড
কার্জন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব করলেন। প্রতিবাদে মুখর হল সারাদেশ।
গ্রামে-গঞ্জে-শহরে, গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা-ধলেশ্বরীর দু-কূল ছাপিয়ে নিভৃত পল্লীর
বুকেও উঠল প্রতিবাদের ঝড়। ১৯০৫ সালের ১৯ জুলাই জাতির সমবেত প্রতিবাদকে উপেক্ষা
করে সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গের কথা ঘোষণা করা হল এবং বলা হল যে, ১৬ অক্টোবর থেকে
বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হবে।
সেদিন দেশাত্মবোধক সংগীত, বক্তৃতা ও রচনায় মেতে উঠেছিল সারা দেশ। বাংলার
আকাশ-বাতাস সেদিন মুখরিত ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিতে। দীর্ঘদিনের স্থবিরত্বের
গ্লানি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে হাতে ব্রিটিশ-বিরোধী অস্ত্র ও কণ্ঠে রণহুংকার
মাতৃমন্ত্র ‘বন্দে মাতরম্’ নিয়ে দেশ সেদিন মেতে উঠেছিল সৃষ্টির নব-আনন্দে।
জাতীয় সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিক্ষা, শিল্প, চিত্রকলা নতুন এক সঞ্জীবনী মন্ত্রে
উদ্বুদ্ধ হয়েছিল-বিদেশি বস্তু ও ভাবধারা ‘বয়কট’ এবং স্বদেশিয়ানার মন্ত্র
বাংলার রুদ্ধ যৌবনকে গতি-প্রকৃতি দিয়ে নতুন এক অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল।
বলাবাহুল্য, বঙ্কিমচন্দ্রই হলেন বাংলার এই স্বদেশি যুগের অন্যতম প্রধান
স্রষ্টা এবং প্রধান রূপকার- “Of the new spirit which is leading the nation
to resurgence and independence, he (বঙ্কিমচন্দ্র) is the inspirer and
political guru. “২
বঙ্কিমচন্দ্রের ভাবৈশ্বর্য, ‘আনন্দ মঠ’-এর মহান শিক্ষাধারা ও আদর্শ এবং
স্বামী বিবেকানন্দের তেজোদৃপ্ত ও অগ্নিগর্ভ বাণীই সৃষ্টি করেছিল স্বদেশি বাংলা
ও ভারতের।

এই যুগে প্রচুর স্বদেশি সংগীতের পুস্তক ও বহু জাতীয়তাবাদী পত্র-পত্রিকা,
উপন্যাস ও নাটক প্রকাশিত হয়। ১৩১২ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৯০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে
কলকাতার সিটি বুক সোসাইটি থেকে সখারাম গণেশ দেউস্করের ভূমিকা সংবলিত
শ্রীযোগীন্দ্রনাথ সরকার সংকলিত ‘বন্দে মাতরম্’ নামক একটি সংগীত-সংকলন প্রকাশিত
হয়। মূল্য’ চার আনা। গ্রন্থটি এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে মাত্র এক মাস অর্থাৎ
সেপ্টেম্বরের মধ্যেই গ্রন্থটির তিনটি সংস্করণ নিঃশেষিত হয়ে যায় এবং পরবর্তী
মার্চে প্রকাশিত হয় এর চতুর্থ সংস্করণ। এর দাম ছিল ছয় আনা। এই সংকলনে মোট ৯৩টি
গান ছিল। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপ্রেমমূলক গানের সংখ্যা ছিল ২২।
গ্রন্থের ভূমিকায় সখারাম গণেশ দেউস্কর লিখছেন:

“মুসলমান-শাসনকালেও আমরা স্বদেশকে কখনও হারাই নাই।… ইংরাজের আমলে আমাদের
অন্য উন্নতি যতই হউক, ভারতবর্ষের উপর আমাদের যে জন্মস্বত্ব ছিল, তাহা আমরা
ক্রমেই হারাইতেছি।….এক কথায়, আমরা ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’ হইয়াছি। এইরূপ
চারিদিক হইতে স্বদেশকে হারাইতে বসিয়া আমাদের এখন স্বদেশের প্রতি একটা টান
জন্মিয়াছে। আমরা হৃদয়ে স্বদেশের প্রতি প্রীতি অনুভব করিতেছি।
“সঙ্গীতের শক্তি অসীম। ‘গানাৎ পরতরং ন হি’। সঙ্গীতে মানবের চিত্তবৃত্তিনিচয়
একতান হয় ও অসীম শক্তি লাভ করে। সঙ্গীতের মোহিনী শক্তি তড়িৎ প্রবাহের ন্যায়
মুমূর্ষু সমাজ শরীরে নবপ্রাণের সঞ্চার করে। জাতীয়-সঙ্গীত ভিন্ন জাতীয়-চিত্তের
অবসাদ দূরীভূত হয় না, জাতীয়-ভাব যথোচিত বল-বেগ লাভ করে না। এই মহৎ উদ্দেশ্য
সাধনের আশায় বর্তমান সঙ্গীত-গ্রন্থের প্রকাশক মহাশয় ‘বন্দে মাতরম্’ প্রচার
করিতেছেন।৩

কেবলমাত্র এই নয়-এ সময় একের পর এক প্রকাশিত হচ্ছে স্বদেশি গানের সংকলন।
রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অমৃতলাল বসু, রজনীকান্ত সেন, বিজয়চন্দ্র
মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখের রচনা ছাড়াও বেশ কয়েকটি সংগীত সংকলন এ
সময় প্রকাশিত হয়। সেগুলির মধ্যে রজনীকান্ত পণ্ডিত সংকলিত ‘স্বদেশী
পল্লী-সংগীত’, যোগেন্দ্রনাথ শর্মার ‘স্বদেশী সংগীত’, ‘হুঙ্কার’, এবং
নলিনীরঞ্জন সরকারের ‘বন্দনা’ উল্লেখযোগ্য।

সেদিন বাঙালির বিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও গানেও ‘বন্দে মাতরম্’। বিয়ের দিন ভোরে
এয়োরা জল সওয়ার সময় গাইতেন:

সই লো সই মকর গঙ্গাজল,
আজ হবে সীতার বিয়ে সইতে যাব জল।
‘বন্দে মাতরম্’ বল।

উলু দিয়ে শাঁখ বাজায়ে
বরণ ডালা মাথায় লয়ে
জলের ঝারা হাতে করে
জল সইতে চল।
‘বন্দে মাতরম্’ বল।

ছাতনাতলায় বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর নতুন বর-বধূকে নিয়ে বাসর ঘরে ঢোকার সময় এয়োরা
গাইতেন:

পাটি বিছাও মাইঝ্যালে
‘বন্দে মাতরম্’ বলে।

পূর্ববঙ্গের কথ্য-ভাষায় ‘মাইঝ্যাল’ হল মেঝে বা বাসগৃহের মধ্যস্থল।৪

দেশের আকাশে-বাতাসে এবং দেশবাসীর হৃদয়ে সেদিন ধ্বনিত হচ্ছে শুধু দেশপ্রেম,
দেশমাতৃকা, জননী-জন্মভূমি, দেশের মুক্তি, আত্মত্যাগ এবং দেশপ্রেমই ধর্ম-এই সব
আদর্শ। ‘বন্দে মাতরম্’ মন্ত্র এবং ‘আনন্দ মঠ’ সেদিন জাতির হৃদয়-মন দখল করে
আছে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন সেদিন স্পষ্টতই ছিল একটি ধর্মীয় আন্দোলন-দেশনেতাদের
বক্তৃতা ও রচনাদিতে বারংবার একথা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে। অরবিন্দ, বিপিন
পাল, তিলক থেকে শুরু করে অতি সাধারণ পর্যায়ের নেতা-এমনকি জনসাধারণও তাই মনে
করতেন। এ কারণে স্বদেশি সভাগুলি প্রায়শ মন্দির প্রাঙ্গণেই অনুষ্ঠিত হত, মন্দির
প্রাঙ্গণেই দেশ ও ঈশ্বরের নামে জনসাধারণ স্বদেশির শপথ নিতেন এবং লাঠিখেলা,
ব্যায়ামচর্চা প্রভৃতিও অনুষ্ঠিত হত মন্দির প্রাঙ্গণেই। ১৯০৫ সালের ২৮
সেপ্টেম্বর
কালীঘাটের মন্দিরে এক সর্বজনীন পূজা ও হোমের মাধ্যমে পূজারি ব্রাহ্মণেরা সমবেত
পঞ্চাশ হাজার লোককে আহবান জানান যেঃ “অন্য সকল দেব-দেবীর পূর্বে
জননী-জন্মভূমিকে পূজা করিবে; সাম্প্রদায়িকতা,ধর্মভেদ, বৈরিতা, স্বার্থপরতা
বিস্মৃত হও; সকলে শপথ কর-মাতৃভূমির সেবা করিবে এবং তাঁহার দুঃখদুর্দশা দূর
করিবার জন্য প্রাণপণ আত্মনিয়োগ করিবে।” পঞ্চাশ হাজার মানুষ সেদিন কালীঘাটের
নাটমন্দিরে মাতৃমূর্তির সম্মুখে স্বদেশির শপথ গ্রহণ করে।৫ কালীঘাটের পুরোহিতরা
সেদিন গলায় পোস্টার লাগিয়ে ঘুরতে লাগলেন। তাতে লেখা-“অন্য দেব-দেবীর পূজার
পূর্বে জন্মভূমির পূজাই প্রশস্ত॥”৬ বলাবাহুল্য, এ সবই ‘আনন্দ মঠ’-এর প্রভাব।
ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, স্বদেশি যুগে ‘আনন্দ মঠ’-ই জাতীয় জাগরণের
মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে- “the famous novel of Bankim Chandra Chatterji, entitled
Ananda- math, formed the basis of this new spirit.”৭ তিনি লিখছেন-
“বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠে’ দেশোদ্ধারব্রতী ‘সন্তান’ বা একদল সংসারত্যাগী
সন্ন্যাসীর যে অপূর্ব কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে তাহা বাঙ্গালার আদর্শ হইল।৮
সুধীরচন্দ্র সরকার স্বদেশি যুগে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাবকে ‘বঙ্কিম আন্দোলন’ বলে
আখ্যায়িত করেছেন। তিনি লিখছেন, “অমর ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের
‘আনন্দমঠ’ তখন ঘরে ঘরে পঠিত হত। ‘বন্দে মাতরম্’ সঙ্গীতকে তখন থেকে আমরা, জাতীয়
সঙ্গীতরূপে গ্রহণ করেছিলাম। অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ তখন
গীতা-বাইবেলরূপে পরিগণিত হতো।৯ স্বদেশি আন্দোলনে যোগদানকারী, স্কুলের ‘নাম
কাটা সিপাই’-রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখছেন-স্বদেশি যুগে
“বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ তখন প্রায় অবশ্য-পাঠ্য গ্রন্থ হয়ে উঠেছে দেশের
মধ্যে। ১০ ‘আনন্দ মঠ’ সেদিন কেবলমাত্র ‘অবশ্য পাঠ্য’ গ্রন্থই নয়-দেশপ্রেমের
অনুপ্রেরণাও। সে যুগের তরুণ গোপাল হালদার লিখছেন-“আমরা দু’ভাই বাবার আলমারী
থেকে বঙ্কিম-গ্রন্থাবলী দু’খণ্ড চুরি করে পড়তে লাগলাম, সেদিন সেই নেশার ডাকের
সঙ্গে ‘নিশির ডাকে’ও আমাদের পেয়ে বসল। ‘আনন্দমঠ’! স্বপ্ন যখন ভাঙ্গল তখন
একবারও মনে হয়নি শেষাংশে ইংরেজ রাজ্যের প্রশস্তি-প্রয়োজনীয় সাফাই ছাড়া আর
কিছু-লেখকের অভিপ্রেত। যে রাজত্বে ঘরে অরবিন্দ ও তিলকের ছবি রাখা নিষিদ্ধ,
গীতা বিপজ্জনক, সে রাজ্যে সন্ন্যাসী-বিদ্রোহের কাহিনী অন্য রূপে শেষ করা,
মুদ্রিত করা ও প্রকাশিত করা যে অসম্ভব একথা আমাদের কিশোর মন অবাধে মেনে নিতে
পেরেছিল। ১১

‘আনন্দ মঠ’-এর বিক্রিও তখন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল, দেশনায়কেরা এবং ‘আনন্দ
মঠ’-এর প্রকাশকও তখন জনসাধারণকে এই পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করতে উৎসাহ দিতেন।
এ সময় ‘কাজের লোক’ (১৩১৩) পত্রিকায় ‘আনন্দ মঠ’-এর বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে:১২
——————————————————————–
বঙ্গচ্ছেদ, রাখীবন্ধন উপলক্ষে ঘরে ঘরে ছড়াই

৩০শে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত
এই সুযোগ
অমর বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ আট আনায় পাইবেন।
যে আনন্দমঠের বন্দে মাতরম্ মন্ত্রের এত প্রভাব, যে মহা উপন্যাস জাতীয়
জীবনের লক্ষ্য সেই অদ্বিতীয় গ্রন্থ হিন্দু মুসলিম খ্রীস্টান সকলের গৃহে গৃহে
গীতা, কোরাণ ও বাইবেলের ন্যায় বিরাজিত হউক।
বসুমতী পুস্তক বিভাগ
শ্রীউপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ১১৫/৪ গ্রে স্ট্রীট, কলিকাতা।
—————————————————————–
১৩১৩ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যা ‘বঙ্গদর্শন’ থেকে ‘আনন্দ মঠ’-এর আরেকটি
বিজ্ঞাপন তুলে দেওয়া হলঃ
——————————————————————
বঙ্গচ্ছেদে (রাখী) প্রীতিবন্ধন স্মরণার্থ ৩০শে আশ্বিন পর্যন্ত এই শুভযোগ!
বন্দে মাতরম্ মহামন্ত্রের ঋষি-বঙ্কিমচন্দ্রের

‘আনন্দমঠ’

কেবল ||০ আনায় পাইবেন। আবার ইহার সহিত ১ম উপহার-বঙ্কিমচন্দ্রের মধুর উপন্যাস
যুগলাঙ্গুরীয়

২য় উপহার, বঙ্কিমচন্দ্রের কাব্য-উপন্যাস
ললিতা ও মানস

৩য় উপহার, বঙ্কিমচন্দ্রের গীতাবলী। ইহা নূতন ও সুন্দর এবং সর্বজনপ্রিয়

আনন্দমঠ ও উক্ত তিনখানি উপহার কেবল ॥০ আনা।

ডাঃ মাশুল তিন আনা।

শ্রীউপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বসুমতী কার্যালয়, ১১৫/৪ গ্রে স্ট্রীট, কলিকাতা।
—————————————————————-
বলাবাহুল্য, বিক্রি বৃদ্ধির জন্যই এ ধরনের উপহারের ব্যবস্থা। হয়তো এ সময় তাঁর
গ্রন্থাবলির সুলভ সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছিল, কারণ ১৮৮২ সালেই ‘আনন্দ মঠ’-এর
মূল্য ছিল-এক টাকা দুই আনা। ১৮৮২-তে ইন্দিরা, যুগলাঙ্গুরীয় ও রাধারাণী একত্রে
বিক্রি হত আট আনায় এবং তাঁর কবিতা পুস্তক অর্থাৎ গীতাবলির দাম ছিল দশ আনা ১৩
সুতরাং মাত্র আট আনায় চারটি বই এমনি দেওয়া হত না।

‘বন্দে মাতরম্’ হল ‘আনন্দ মঠ’-এর ভাবাদর্শেরই বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গভঙ্গের দিন থেকে
(১৬ অক্টোবর, ১৯০৫) বহুদিন পর্যন্ত বরিশাল জেলার মাহিলাড়ায় প্রতি সন্ধ্যায়
প্রায় প্রত্যেক বাড়ির ঠাকুরঘরের সামনে সমবেত হয়ে পরিবারের সকলে রবীন্দ্রনাথের
‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটি গাইতেন এবং গানের পূর্বে ও শেষে ‘বন্দে মাতরম্’
ধ্বনি দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু ও শেষ করতেন। ১৪ প্রখ্যাত দেশনায়ক মনোরঞ্জন
গুহঠাকুরতার উৎসাহে বরিশালের বানারিপাড়া ও জেলার অন্যান্য স্থানে বট ও অশ্বত্থ
বৃক্ষতলে ‘বন্দে-মাতরম্ তলা’ নামে একটি করে বেদী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল১৫।
বানারিপাড়ার ‘বন্দে-মাতরম্ তলা’-য় প্রতি বৎসর ১ পৌষ দেশমাতৃকার উদ্দেশে উৎসব,
মেলা, শোভাযাত্রা, দেশমাতৃকা পূজা এবং মাতৃসেবার শপথ গ্রহণ ও সংকল্পবাক্য পঠিত
ও গৃহীত হত। এই উপলক্ষে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটেছে বহুবার।১৬
১৯৩২ সালে এই ‘বন্দেমাতরলা’ বেআইনি বলে ঘোষিত হয়। ১৭

পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, স্বদেশি যুগে বঙ্কিমের নবমূল্যায়ন শুরু হয়
সভা-সমিতি ও পত্র-পত্রিকায় বঙ্কিম সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা চলতে
থাকে, বঙ্কিম ‘জাতীয় বীরে’ পরিণত হন এবং তাঁর জন্মস্থান কাঁঠালপাড়া পরিণত হয়
জাতীয়তা বাদীদের পবিত্র তীর্থস্থানে। ১৯০৬ সালের এপ্রিল মাসে জাতীয়তাবাদী
সন্ন্যাসী ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের উদ্যোগে কাঁঠালপাড়ায় বঙ্কিমের পৈতৃক
বাসভবনে শুরু হল জাতীয়তার মহান পথপ্রদর্শক বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতি উৎসব। ‘বন্দে
মাতরম্ সম্প্রদায়’ এই অনুষ্ঠানে যোগদান করে এবং বিভিন্ন স্বদেশি সংগীত গায়।
কলকাতা থেকে কয়েক হাজার লোক এই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো
থেকেও যোগ দেয় প্রচুর মানুষ। বঙ্কিম স্মৃতিসভায় সভাপতিত্ব করেন বঙ্কিম-সুহৃদ
অক্ষয়চন্দ্র সরকার। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী এবং আরও
অনেকে বঙ্কিম সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। সন্ধ্যায় বঙ্কিমচন্দ্রের পূজার দালানে
‘আনন্দ মঠ’ অভিনীত হয় এবং তাতে সত্যানন্দের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন স্বয়ং
ব্রহ্মহ্মবান্ধব উপাধ্যায়।১৮’বন্দে মাতরম্ সম্প্রদায়ের’ সদস্য নরেন্দ্রনাথ শেঠ
লিখছেন:

“কাঁঠালপাড়ায় ১৩১৩ সালের চৈত্র মাসে বঙ্কিমোৎসবে ঐ গান (বন্দে মাতরম্)
রাধাবল্লভকে শুনাইয়া তাঁহার আশীর্বাদ লইয়াছি, অক্ষয়চন্দ্র, হরপ্রসাদ প্রভৃতি
সকলেই তাহাতে যোগদান করেন-ঐ উৎসব সর্ব্বাঙ্গসুন্দর করিতে সকলেই একপ্রাণে
চেষ্টা করেন। আজও মনে পড়ে, বঙ্কিমচন্দ্রের ঠাকুরদালানে পট-ভূষণে ত্রিধা
চিত্র-মা যা ছিলেন, মা-যা হইয়াছেন, মা-যা হইবেন।”১৯

১৯০৬ সালের ১৯ জুন মহারাষ্ট্রের জাতীয় জাগরণের প্রধান পুরোহিত বাল গঙ্গাধর
তিলক সদলবলে কাঁঠালপাড়ায় তীর্থদর্শনে যান এবং মহামন্ত্রের স্রষ্টা
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি প্রাণের ভক্তি উজাড় করে দেন।২০
‘অনুশীলন সমিতি’-র বিশিষ্ট নেতা পুলিনবিহারী দাসের লেখা থেকে জানা যায় যো
তিনি ঢাকায় ‘বঙ্কিম উৎসব’-এর আয়োজন করেছিলেন। ২১

নিষেধাজ্ঞা: ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীত ও ধ্বনি এবং ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাস তখন প্রবল
জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সভা-সমিতি, বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিজয় মিছিল,
শোকযাত্রা-সর্বত্র ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি উঠছে। বিভিন্ন সংগীতেও ঘুরে ফিরে
বারংবার ‘বন্দে মাতরম্’ কথাটি আসছে। ‘আনন্দ মঠ’-এর আদর্শে উপন্যাস নাটক
গ্রন্থাদি রচিত হচ্ছে। সরকারের কাছে এসব চরম রাজদ্রোহমূলক বলে বিবেচিত হয়েছিল।
জাতীয়তাবাদ প্রচারের অভিযোগে এর অনেকগুলিই বাজেয়াপ্ত হয়েছিল-লেখক, প্রকাশক ও
মুদ্রাকরকে রাজরোষে পড়তে হয়। ২২

‘সন্তান শিক্ষা’, ‘মাতৃপূজার গান’, ‘দেশের গান’, ‘মাতৃপূজা’, ১৯০৯ সালে
চট্টগ্রাম থেকে মুদ্রিত ‘বন্দে মাতরম্’ সঙ্গীত প্রভৃতি গ্রন্থের লেখক, প্রকাশক
ও মুদ্রাকরকে শাস্তি পেতে হয়।২৩ এই সময় ‘ওঁ’ বন্দে মাতরম্’ বলে একটি পত্রিকাও
প্রকাশিত হয়, এবং প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা বাজেয়াপ্ত হয়। ২৪
১৩১৪ বঙ্গাব্দে (১৯০৭ খ্রিঃ) বরিশাল থেকে প্রকাশিত হয় গঙ্গাচরণ নাগ কর্তৃক
লিখিত ও প্রকাশিত ‘রাখী কঙ্কন’ উপন্যাসের প্রথম খণ্ড। মূল্য দশ আনা। প্রথম
খণ্ডের দ্বিতীয় সংস্করণও প্রকাশিত হয়। ১৩১৪ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যা
‘প্রবাসী’-তে প্রথম খণ্ডের সমালোচনাও প্রকাশিত হয়। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ৫
সেপ্টেম্বর সরকার বইটি বাজেয়াপ্ত করেন। এর গোড়ার দিকের কাহিনীতে ‘আনন্দ মঠ’-এর
সুস্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়। ২৫

‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি সরকারের কাছে ছিল রাজদ্রোহের সামিল। গোপন গোয়েন্দা
রিপোর্টে বলা হচ্ছে- “It may be noted that this song in Ananda math is
wholly responsible for the introduction of the cry of Bande Mataram now so
much favoured by Indians.”২৬ সরকারপক্ষ ‘বন্দে মাতরমের’ অর্থ করেছিল-‘বেঁধে
মার’। বিশেষত কোনো শ্বেতাঙ্গকে পথে ঘাটে দেখলে ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনির মাত্রা ও
জোর বৃদ্ধি পেত। জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম সভাপতি অম্বিকাচরণ মজুমদার তাঁর
‘Indian National Evolution’ গ্রন্থে লিখছেন-“লাল রং-এর জিনিস দেখলে ষাঁড়েরা
যেমন ক্ষেপে ওঠে, একশ্রেণির আমলারাও সেই রকম ‘বন্দে মাতরম্’-এর মতো নির্দোষ
শব্দ শুনে ক্ষেপে যেত। কেউ কেউ আবার শব্দটির অর্থ করেছিল, ‘বাঁদরকে ধরে মার’।
অনেকের সন্দেহ হয়েছিল যে শব্দটি হিংসামূলক কাজ করবার সাংকেতিক নির্দেশ।”

(“like the red rag to the Bull the Innocent expression Vande Mataram become
almost intolerable to a certain class of officials.Some interrupted it to
mean seize and beat the monkey others suspected it to be a secret watchword
for committing violence “)।২৭

সমগ্র বাংলা-বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে এই ধ্বনি শাসক সম্প্রদায়ের মনে তীব্র ভীতির
সঞ্চার করেছিল। ১৯০৭ সালের ১৫ আগস্ট পূর্ববঙ্গ থেকে এক পত্রলেখক ‘ইংলিশম্যান’
পত্রিকায় লিখছেন, “এই ন্যাশনাল ভলিন্টিয়াররা পথে পথে ‘বন্দে মাতরম্’ বলে
চিৎকার করে বেড়ায়, পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাধাবার অজুহাতের বা শক্তির অন্ত নেই
এদের। বিশেষ করে অপরপক্ষ যদি শ্বেতচর্মধারী হয়। এদের উপদ্রবে মফস্সল শহরে
রাস্তায় বেরোবার উপায় নেই (কখন কী ফ্যাসাদ বাধিয়ে বসে)। অ-ভারতীয়দের পক্ষে এরা
দস্তুরমত উপদ্রবের কারণস্বরূপ হয়ে পড়েছে।”২৮
১৯০৫ সালের অক্টোবর মাস থেকেই একের পর এক নানা সার্কুলার জারি করে প্রকাশ্য
রাজপথে ও সভা সমিতিতে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি নিষিদ্ধ করা হয়। আইন ভঙ্গ করলে
জেল, জরিমানা, বেত্রদণ্ড, প্রহার চলত, ফৌজদারি মামলা রুজু করা হত, স্কুল-কলেজ
থেকে নাম কাটা যেত, বিদ্যালয়ের অনুমোদন বাতিল হত এবং সরকারি নোকরি মিলত না।
জারি করা হল কার্লাইল সার্কুলার (১০ অক্টোবর, ১৯০৫), ফুলার সার্কুলার (১৬
অক্টোবর ১৯০৫), পেডলার সার্কুলার (২১ অক্টোবর, ১৯০৫), হলওয়ার্ড সার্কুলার (১
নভেম্বর, ১৯০৫), লায়ন সার্কুলার (৮ নভেম্বর, ১৯০৫)। নানা বক্তব্যের মধ্যে
প্রতিটিতেই ‘বন্দে মাতরম্’ সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা ছিল। বস্তুত একটি সংগীত বা
ধ্বনির প্রতি শাসকের এমন আক্রোশের তুলনা পৃথিবীর আর কোথাও মিলবে না। এই সব
ফতোয়ার বিরুদ্ধে দেশময় প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে। ছোটো ছোটো বালক-বালিকাও দণ্ডের
ভয় অগ্রাহ্য করে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি দিতে থাকে-ইংরেজদের দেখলে ধ্বনির মাত্রা
বৃদ্ধি পেত। কৃষ্ণকুমার মিত্র বলেছেন যে, এই ধ্বনি শুনে ইংরেজরা
বালক-বালিকাদের ধরবার জন্য ধাবমান হতেন, কিন্তু “তাহারা ‘বন্দে মারতম্’ ধ্বনি
করিতে করিতে অদৃশ্য হইয়া যাইত। ইংরেজদিগকে ক্ষেপাইবার নিমিত্ত অনেকেই ‘বন্দে
মাতরম্’ ধ্বনি করিত।”২৯

এ যুগে বহু স্বদেশি গানে ‘বন্দে মাতরম্’ কথাটি বারেবারে এসেছে বলে সরকার এইসব
গানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনেছে। “আমরা গাব সদা বন্দে ‘মাতরম্”,
“বল ‘বন্দে মাতরম্’ ‘বন্দে মাতরম্’ সঘনে”, “বল বল বন্দে মাতরম্, স্বদেশি
ভ্রাতৃগণ” প্রভৃতি গানের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ ক/১৫৩ ক ধারা লঙ্ঘনের
অভিযোগ আনা হয়। ৩০

সরকার ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও ‘বন্দে মাতরম্’ ছিল
দেশবাসীর কাছে মাতৃমন্ত্র-মুক্তিমন্ত্র। নানা নির্যাতন সত্ত্বেও এই
মাতৃমন্ত্রের উচ্চারণ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। স্কুলের ছাত্রের ওপর বেতের পর বেত
পড়েছে, কিন্তু প্রতিটি বেত্রাঘাতের সঙ্গে সেই কিশোর চিৎকার করে ধ্বনি দিয়েছে
‘বন্দে মাতরম্’। এ যুগেই রচিত হয়েছে মুকুন্দ দাসের:

ফুলার-আর কি দেখাও ভয়?

দেহ তোমার অধীন বটে!

মন তো তোমার নয়।….

অথবা রজনীকান্ত সেনের:-

ফুলার কল্লে হুকুম জারি-

মা ব’লে যে ডাকবে রে তার শাস্তি হবে ভারি।…

অথবা, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের:

মাগো যায় যেন জীবন চলে
শুধু জগৎ মাঝে তোমার কাজে
‘বন্দে মাতরম’ বলে।
আমার যায় যেন জীবন চলে।।….

প্রভৃতি বিখ্যাত জাতীয় সংগীত। কাব্যবিশারদের ‘অতীব জনপ্রিয়’ এই গানটির
বিরুদ্ধে ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। সরকারি রিপোর্টে বলা হচ্ছে—“This
song falls within the perview of section 124A, Indian Penal Code and
Section4 (1), 19103/4LR I, 31 October 1910 ( file no.558 of 1910। “৩১

১৯০৬ সালের এপ্রিল মাসে বরিশালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সমিতির অধিবেশনে
‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিকে কেন্দ্র করে সরকার নির্লজ্জ দমননীতির পরিচয় দেন।
বরিশালের রাজপথে ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি নিষিদ্ধ হয়। সরকারি হঠকারিতায় অধিবেশন
পরিত্যক্ত হয়-সারাদেশে প্রবল বিক্ষোভের সঞ্চার হয়। এ সম্পর্কে স্বয়ং বড়োলাট
মিন্টো পর্যন্ত বলতে বাধ্য হন যে, “…declaring the slogan of Bande Mataram
illegal was a misconstruction of Law.”৩২ এই অধিবেশন উপলক্ষে রাজা বাহাদুরের
হাভেলি থেকে মিছিল বেরোবার সময় তা পুলিশের দ্বারা আক্রান্ত হয়। জনসাধারণ তাই
উক্ত হাভেলিতে সভাসমিতির জন্য ‘বন্দে মাতরম্ হল’ তৈরির প্রস্তাব করে।
পরবর্তীকালে এই হল ‘অশ্বিনীকুমার হল’ নামে অভিহিত হয়।৩৩ এই উপলক্ষেই রচিত হয়
মনোমোহন চক্রবর্তীর বিখ্যাত গান:

বল সিংহনাদে জয় জয় রবে বন্দেমাতরম্।

উঠুক ভবে, শুনুক সবে মন্ত্র গভীরম্-

বন্দেমাতরম্ বন্দেমাতরম্ ।।…

এবং কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের:

আজ বরিশাল পুণ্যে বিশাল হল লাঠির ঘায়ে।

ঐ যে মায়ের জয় গেয়ে যায় ‘বন্দে মাতরম্’ বলে।……

বলাবাহুল্য, সেদিন বিপিনচন্দ্র পাল, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, অশ্বিনীকুমার
দত্ত, সুন্দরীমোহন দাশ প্রমুখ দেশপ্রেমিক ও বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকেরা ‘বন্দে
মাতরম্’-কে নিয়ে অসংখ্য গান রচনা করেছিলেন। ৩৪

এ সম্পর্কে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গে ইতি টানা হবে, যদিও ঘটনাটি
পরবর্তী আমলের। তখন দেশজুড়ে লবণ আইন অমান্য আন্দোলন চলছে। মেদিনীপুর জেলার
খেজুরি থানার অজয়া গ্রামে লবণকেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে মধুসূদন সাহু নামে
আশি বছরের এক বৃদ্ধ আশ্রয় নিয়েছেন। তিনকুলে তাঁর কেউ নেই। ওই লবণকেন্দ্র বা
ক্যাম্পে তিনি দুবেলা খেতেন এবং পাচকের ফাইফরমাশ খাটতেন। তিনি সর্বদাই
ইষ্টমন্ত্রের মতো ‘বন্দে মাতরম্’ জপ করতেন। এছাড়া, তিনি মুখে অন্য কোনো কথা
বলতেন না। মুখে খাওয়ার গ্রাস তোলার সময়, শোওয়ার সময়, টিকটিকি শব্দ করলে, কেউ
হাঁচলে বা কাশলে, হোঁচট খেলে সর্বদাই তিনি ‘বন্দে মাতরম্’ উচ্চারণ করতেন।
এইভাবে ‘বন্দে মাতরম্’ তাঁর জীবনের সমগ্র সত্তার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। সর্বদা
সব কাজে ‘বন্দে মাতরম্’ বলার জন্য সকলে তাঁকে ‘বন্দে মাতরম্-বুড়ো’ বলে ডাকত।
‘বুড়ো’ বলায় তিনি ক্ষুব্ধ হতেন। এ কারণে তিনি হলেন সবার ‘বন্দে মাতরম্ খুড়ো’।
একদিন রাতে পুলিশ এসে ক্যাম্পের সবার সঙ্গে তাঁকেও গ্রেফতার করে পাশের একটি
মধ্য-ইংরেজি স্কুলে আটকে রাখে। সারাদিন পরিশ্রমের পর খাওয়া-দাওয়া সেরে পুলিশ
বাহিনী সবে ঘুমোতে গেছে, হঠাৎ ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি। খোদ পুলিশের আস্তানায়
‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি! জানা গেল যে, ‘বন্দে মাতরম্ খুড়ো’ ঘুমের মধ্যে হাই তুলে
‘বন্দে মাতরম্’ বলেছেন। শুরু হল প্রহার। মার খেয়ে বুড়োর রোখ চেপে গেছে। তিনিও
চিৎকার করছেন ‘বন্দে মাতরম্’ বলে। পুলিশ যত মারে, তিনি ততো চেঁচান-‘বন্দে
মাতরম্’। সহবন্দিরা জানালেন যে, এটা বুড়োর অভ্যেস। ওর কোনো অন্যায় নেই।

ক্ষুব্ধ পুলিশ অফিসার গর্জে উঠলেন-“এখানে সব শালাই ভলান্টিয়ার। মারো শালাদের।”
প্রহার চলল সবার ওপর। রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে উঠল করুণ আর্তনাদ। তখনও বৃদ্ধের
ক্ষীণ কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে-‘বন্দে মাতরম্’। ৩৫

বাংলার বাইরে:-
______________
কেবলমাত্র বাংলার অভ্যন্তরেই নয়, সারা ভারত-এমনকি সুদূর ইউরোপ, আফ্রিকা ও
আমেরিকার নানা দেশে স্বদেশি আন্দোলনের কালেই ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি প্রতিধ্বনিত
হয়েছিল। মতিলাল নেহরু, জওহরলাল, গোখলে, গান্ধিজি-সকলেই এই ধ্বনির দ্বারা
অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর মতিলাল নেহরু হ্যারোতে শিক্ষণরত পুত্র জওহরলালকে
লিখছেন: “আমরা ভারতে ব্রিটিশ ইতিহাসের এক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে দিন
কাটাচ্ছি।… এমনকি এলাহাবাদেও ‘বন্দে মাতরম্’ হল এখন অভিনন্দন জানানোর সাধারণ
পদ্ধতি।…এই আন্দোলন চলতে থাকলে তুমি দেশে ফিরে এক নতুন ভারতকে দেখতে পাবে-যে
ভারত তোমার দেশত্যাগের সময় ছিল না।” (“We are passing through a most critical
period of British Indian history…Bande Mataram has become the common form
of salutation even in Allahabad….If this movement only continues, you
will on your return, find an India different to the India you left”) ।৩৬

বাংলা ও এলাহাবাদের মতো পঞ্চনদের মানুষও পরস্পরের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হলে
‘বন্দে মাতরম্’ বলে পরস্পরকে অভিবাদন জানাত। ১৯০৫ সালের ২৫ নভেম্বর ‘ট্রিবিউন’
(The Tribune) পত্রিকা লিখছে, “সরকারি স্বৈরাচারের দ্বারা কি ‘বন্দে
মাতরম্’-কে ধ্বংস করা যাবে? এমনকি পাঞ্জাবেও শিক্ষিত লোকদের মধ্যে দেখা হলে
এখন পরস্পরে ‘বন্দে মাতরম্’ বলে একে অন্যকে অভিবাদন জানায়। কর্তৃপক্ষের কত
সৈন্য আছে যার দ্বারা কোটি কোটি ভারতবাসীর মুখ বন্ধ করতে পারে?” (“…Can
Bande Mataram be abolished by help of terrorism? Even in the Punjab when
educated gentlemen meet each other, his salutation now-a-days frequently is
Bande Mataram. How many soldiers the authorities must have to stop the
mouths of countless millions of India? The people of East Bengal have
sympathy of all India”) |৩৭

১৯০৫ সালের ২ ডিসেম্বর গান্ধিজি The Indian Opinion পত্রিকায় ‘বন্দে মাতরম্’
সংগীতের প্রশংসা করে একটি প্রবন্ধ লেখেন।৩৮ তিনি লিখছেন-“প্রত্যেক পাশ্চাত্য
জাতির জাতীয় সংগীত আছে। তারা গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলিতে ওই গান গেয়ে থাকে।
ব্রিটিশ জাতির সংগীত ‘গড সেভ দি কিং’-এর কথা সবাই জানেন। কোনো ইংরেজ যখন এই
গান গায় তখন সে বীরত্বে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। জার্মানদেরও বিখ্যাত গান আছে।
ফ্রান্সের ‘লা মিজারেবল’ গানটি এত উঁচুদরের যে, ফরাসিরা এই গান গাওয়া-মাত্র
উল্লসিত হয়ে ওঠে। এইটি উপলব্ধি করে বাঙালি কবি বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা দেশের
জনগণের জন্য একটি সংগীত রচনার কথা ভেবেছিলেন। তাঁর রচিত ‘বন্দে মাতরম্’ গান
সারা বাংলায় খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। স্বদেশি আন্দোলনের সময় বাংলাদেশে বড়ো বড়ো সভা
হয়েছে। সেখানে লক্ষ লক্ষ লোক একত্র জমা হয়ে বঙ্কিমের গান গেয়েছেন। বলা হতে
থাকে যে, এই গান এত জনপ্রিয় হয়েছে যে, তা আমাদের জাতীয় সংগীত হয়ে যাবে।
অন্যান্য জাতির গানগুলি অপেক্ষা এই গান ভাবের দিক থেকে মহত্তর এবং বেশি
মিষ্টি। অন্য সব গানে অপরের প্রতি অপমানসূচক কথা আছে, কিন্তু ‘বন্দে মাতরম্’
এই জাতীয় ত্রুটিমুক্ত। এর একমাত্র লক্ষ্য হল আমাদের মধ্যে দেশপ্রেমের বোধ
জাগ্রত করা। এই গানে ভারতবর্ষকে জননীরূপে দেখা হয়েছে এবং তাঁর প্রশংসা কীর্তিত
হয়েছে। আমরা মায়ের ভেতর যতগুলি গুণ দেখি, কবি ভারতমাতার প্রতি সেই সব গুণ আরোপ
করেছেন। আমরা যেমন মাকে পুজো করি, এ গানটিতেও তেমনি ভারতবর্ষকে গভীরভাবে
আরাধনা করা হয়েছে। এতে বেশির ভাগ সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তবে তা
সহজবোধ্য। এর ভাষা যদিও বাংলা, তবুও তা সকলের বোধগম্য। গানটি এত উঁচুস্তরের
যে, আমরা নীচে সেটিকে গুজরাটি লিপিতে এবং হিন্দি বিভাগে দেবনাগরী লিপিতে
মুদ্রিত করলাম।” অন্যত্র তিনি বলছেন-” ‘বন্দে মাতরম্’ হল ভারতমাতার প্রতি
প্রার্থনা। বাঙালি ভাইদের
এই গানটি এত শক্তিশালী যে ভারতবর্ষের কোথাও এর সমতুল্য গান খুঁজে পাওয়া যাবে
না।”৩৯ চিঠিপত্রের শেষে তিনি ‘Vande Mataram from Mohandas’ বলে সই করতেন এবং
১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি এইভাবেই চিঠিপত্র লিখতেন।৪০ মাদ্রাজে এই ধ্বনি ভয়ঙ্কর
প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। ৪১

বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী গোবিন্দ বল্লভ পন্থ ১৯০৬-০৭ সালে তাঁর কৈশোরে
ছাত্রাবস্থায় পড়াশুনার খাতায় ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীতটি লিখে রাখেন এবং এর
অনুকরণে কুমায়ুনী ভাষায় একটি গান রচনা করেন। পরবর্তীকালে তাঁর ব্যক্তিগত
কাগজপত্রের মধ্যে এই খাতাটি আবিষ্কৃত হয়েছে। ৪২

১৯০৬ সালের ১৮ নভেম্বর বোম্বাই নগরীতে প্রায় দশ হাজার লোকের এক বিপুল সমাবেশে
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘স্বাদেশিকতা’ (‘Swadeshism’) সম্পর্কে বক্তৃতা
করেন। তিলক এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। অপরাপর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে
গোখলে,এম. জি. দেশমুখ, অধ্যাপক এন. বি. রানাডে এখানে উপস্থিত ছিলেন। ‘বন্দে
মাতরম’ সংগীত দ্বারা সভার উদ্বোধন হয়, এবং ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি দিয়ে জনতা বিপল
হর্ষে সুরেন্দ্রনাথকে অভিনন্দিত করে। সুরেন্দ্রনাথ তাঁর ভাষণে বলেন যে, ‘বন্দে
মাতরম’ বাংলার ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে। এটা বোম্বাই-এরও ধ্বনি। এই মন্ত্র
দাক্ষিণাত্যের শেষ সীমায় পৌঁছেছে এবং ভারতের উত্তর সীমার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত
বিস্তৃত হয়েছে।

নাগপুরের নীলসিটি স্কুলের ছাত্ররা সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে একটি সরকারি
সভায় যোগ দেয় এবং ‘বন্দে মাতরম্’ গান করে। এর ফলে বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ তাদের
‘রিজলি সার্কুলার’ পড়ে শোনান, যেখানে ছাত্রদের এই ধরনের সকল কার্যকলাপ থেকে
বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য জনৈক ইনস্পেক্টর
বিদ্যালয়ে যান এবং তিনি দশম শ্রেণিতে প্রবেশ করা মাত্র ছাত্ররা সমবেতভাবে
‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি দিতে থাকে। এর পরের ক্লাসেও ওই একই ঘটনা ঘটে। ক্রোধান্ধ
ইনস্পেক্টর প্রথম ধ্বনি দেওয়া ছেলেটির নাম জানতে চান। তা আবিষ্কার করা সম্ভব
না হওয়ায় নবম ও দশম শ্রেণির সব ছাত্রকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেওয়া হয়। ছাত্ররা
আনন্দে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি দিতে দিতে স্কুল থেকে চলে যায়। মাস দুই পরে অবশ্য
অধ্যক্ষ তাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হন।

এ সময় পুণা থেকে ‘বন্দে মাতরম্’ বলে একটি পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। লালা লাজপত
রায় পাঞ্জাবে উর্দু ভাষায় ‘বন্দে মাতরম্’ বলে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন।

১৯০৭ সালের এপ্রিল মাসে চরমপন্থী নেতা বিপিনচন্দ্র পাল মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে
এলে সেখানে ঝড়ের সূত্রপাত হয়। রাজনৈতিক সভা-সমিতি ও পথে-ঘাটে শুধু ‘বন্দে
মাতরম্’ আর ‘বন্দে মাতরম্’। রাস্তায় ইংরেজদের দেখলেই ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি
দেওয়া হতো। জনৈক ইউরোপীয় মিশনারি অভিযোগ করেন যে, রাজমুদ্রির একজন স্থানীয়
মানুষ কিছু ভবঘুরে ছেলেকে এই শর্তে কিছু টাকা দেন যে, তারা ইংরেজদের দেখলে
‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি দেবে। রাজমুদ্রিতে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি ও সংগীত প্রবল
উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল। সরকারি দমননীতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করলে সেখানে ‘বন্দে
মাতরম্ রক্ষা সংঘ’ (‘Vande Mataram Protection league’) গঠিত হয়। ৪৩

১৯০৭ সালের ৩১ মে কোকনাদের জেলা মেডিকেল অফিসারের উদ্দেশ্যে একটি ছেলে ‘বন্দে
মাতরম্’ ধ্বনি দেয়। এতে সাহেব খেপে গিয়ে ছেলেটিকে মারধর করে। ব্যাপারটি এখানেই
মিটে যায়নি। সেদিন রাতে ওই ইংরেজ ভদ্রলোক যখন স্থানীয় ইউরোপীয় ক্লাবে নৈশ্যভোজ
সারছিলেন, তখন এক উন্মত্ত জনতা প্রবল ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি-সহ ক্লাবটির ওপর
আক্রমণ চালায় ও ভাঙচুর করে।৪৪

১৯০৫ সালের আগেই ‘বন্দে মাতরম্’ গান কর্ণাটকে বহুল প্রচলিত ছিল। মাদ্রাজের
বিশিষ্ট দেশপ্রেমিক চিদাম্বরম পিল্লাই “বন্দে মাতরম্ পিল্লাই” বলে পরিচিত
ছিলেন।

১৯১২ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার জোহানেসবার্গ, নাটাল, প্রিটোরিয়া, ও অন্যান্য
স্থানের ভারতীয় জনসাধারণ গান্ধিজির রাজনৈতিক গুরু গোখলেকে ‘বন্দে মাতরম্’
ধ্বনি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ৪৫

নাটকে ‘আনন্দ মঠ’-এর প্রভাব ও সরকারি নিষেধাজ্ঞা:
_____________________________________
স্বদেশি যুগে কেবলমাত্র ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি বা সংগীতই নিষিদ্ধ হয়নি-১৯০৮
সালের ৯ ডিসেম্বর তারিখের ‘সন্ধ্যা’ থেকে জানা যায় যে, পুলিশ ‘বন্দে মাতরম্’,
‘আমার দেশ’ প্রভৃতি সংগীত এবং ‘সিরাজদ্দৌলা ও অপরাপর নাটকের উত্তেজক অংশ
সম্বলিত রেকর্ড বিক্রির ওপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে।৪৬
১৯০৯ সালে ‘মডার্ণ রিভিউ’ পত্রিকা লিখছে- “It has reported that in Calcutta
the Commissioner of Police has prohibited the singing in theatres of
Bankim’s “Bande Mataram” (“I salute thee, Mother”), D. L. Roy’s “Amar Desh”
(“My country”), and some other songs, as well as the sale of the gramaphone
records of some songs”. ৪৭
বিখ্যাত নট, নাট্যকার ও প্রযোজক অমরেন্দ্রনাথ দত্তের জীবনী থেকে জানা যায় যে,
১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘চন্দ্রশেখর’, ‘মৃণালিনী’, ‘আনন্দ মঠ এবং
গিরিশচন্দ্র, অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, ক্ষীরোদপ্রসাদ ও মনোমোহন গোস্বামীর কয়েকটি
নাটকের অভিনয় পুলিশ কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়।৪৮
১৯১২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসের নাট্যাভিনয়ের বিরুদ্ধে
রাজদ্রোহের অভিযোগ ওঠে। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবদ্দশা থেকে এই অভিনয় চলছিল। তখন
কিন্তু এর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ওঠেনি। তৎকালীন পুলিশ কমিশনার স্যার এফ. এল
হ্যালিডে ‘মৃণালিনী’ নাটক সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘আনন্দ মঠ’ সম্পর্কে লিখছেন-“এ
সম্পর্কে একথা মনে রাখা দরকার যে, এই বইটির লেখকই ‘আনন্দ মঠ’ এবং ওই ধরনের
অন্যান্য বইয়েরও লেখক, যে-সব বই বাংলার মৃতপ্রায় দুরভিসন্ধিমূলক আন্দোলনে এত
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। আমার মনে হয় লেখকের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে কী করে
ভারতকে বিদেশির কবল থেকে মুক্ত করা যায়, স্বাধীন করা যায়, এবং তা ধর্মীয়
কর্তব্য-এই সব বলা।”৪৯

স্বদেশি যুগে দেশাত্মবোধের প্রেরণায় অসংখ্য নাটক রচিত ও অভিনীত হয়েছিল।
দেশমাতৃকার জয়গান এবং বিদেশি শাসনের বন্ধন থেকে মুক্তির প্রচেষ্টাই এগুলির
বিষয়বস্তু। এই সব নাটকের অনেকগুলিতেই ‘আনন্দ মঠ’-এর প্রভাব দেখা যায়। ১৯০৪
সালে গিরিশচন্দ্র ঘোষ রচিত ‘সৎনাম’ নাটকটি বঙ্কিমের ‘আনন্দ মঠ’-এর আদর্শে
সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিকায় রচিত এবং ‘আনন্দ মঠ’-এর ঘটনা ও চিন্তার অনুগামী
ঘটনা ও চিন্তায় সমৃদ্ধ।”৫০ ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকেও
‘আনন্দ মঠ’-এর প্রভাব স্পষ্ট। বিশিষ্ট নাট্য-বিশেষজ্ঞ মন্মথনাথ রায় লিখছেন যে,
‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকে “মাতৃমন্ত্রের সাধনা সোচ্চার। দিল্লী-প্রত্যাগত প্রতাপ
একাকী প্রবেশ করলেন জন্মভূমিতে। দীর্ঘদিনের মাতৃ-অদর্শনের পর দেশের মাটির এই
স্পর্শ তাঁকে ব্যাকুল করে তুললো-

‘মা বঙ্গভূমি! তোমার এই প্রাণোন্মাদক নামের ভিতর এত মধুরতা, এমন কোমলতা, এরূপ
ঐশ্বর্য, সৌন্দর্য ছড়ানো আছে তা’ তো জানতুম না। মা! তোমাকে নমস্কার, কোটি কোটি
নমস্কার-আবার নমস্কার। কিন্তু কি করি? কেমন করে যশোরের মর্যাদা রক্ষা করি?
করতেই হবে-যেমন করে হোক করতেই হবে। মান থাক, যশ থাক, তথাপি বঙ্গভূমিকে
শত্রুপদদলন থেকে রক্ষা করতেই হবে।”৫১

স্বদেশি যুগ এবং স্বদেশি-পূর্ববর্তী যুগের নাট্যকারদের দৃষ্টিকোণের মধ্যে বেশ
কিছু পার্থক্য দেখা যায়। স্বদেশি যুগের নাটকে সংগঠনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা
পূর্ববর্তী যুগে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। স্বদেশি যুগে দেশপ্রেম ও
স্বাধীনতা-প্রীতিকে তরুণ-তরুণীর প্রেম ও স্বাধীনতা-প্রীতির সঙ্গে এক করবার
চেষ্টা করা হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে যে, স্বদেশপ্রেম ও স্বাধীনতা ব্যাহত হলে
ব্যক্তিগত প্রেম-প্রীতি পরিপূর্ণতা লাভ করে না। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের
‘সাজাহান’ ও ‘মেবার পতন’, শচীন সেনগুপ্তের ‘গৈরিক পতাকা’ ও ‘সিরাজদ্দৌল্লা’
এবং মন্মথ রায়ের ‘কারাগার’ প্রভৃতি নাটকে এ বক্তব্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
প্রসিদ্ধ নাট্যকার ও সাংবাদিক শচীন সেনগুপ্তের মতে, বঙ্কিমচন্দ্রই হলেন এই
বিষয়গুলির পথিকৃৎ।৫২ মাইকেল, দীনবন্ধু এবং গিরিশচন্দ্রের যুগে বাংলা নাটকে
তেমন রোমান্টিকতা ছিল না, কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের কালে বাংলা নাটকে
রোমান্টিকতা বৃদ্ধি পায়। তাঁর মতে, এর মূলেও আছে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব এবং এর
ফলেই বাংলা নাটক দ্বারে দ্বারে মুক্তির বাণী পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়। ৫৩

‘বন্দে মাতরম্’ এবং ‘আনন্দ মঠ-এর ওপর এত ক্রোধ থাকা সত্ত্বেও ‘আনন্দ মঠ’
কিন্তু কখনোই সরকারি বিজ্ঞপ্তি দ্বারা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়নি। তবে এ কথাও
ঠিক যে, পুলিশ কোথাও তল্লাশি করতে এসে বন্দুক, ছোরা-এমনকি সামান্য লাঠি না
পেয়েও যদি ‘আনন্দ মঠ’, স্বামীজির ‘ভাববার কথা’, গিরিশচন্দ্রের ‘সিরাজদ্দৌল্লা’
বা দ্বিজেন্দ্রলালের ‘রাণা প্রতাপ’ পেত, তা হলেই পুলিশ গ্রন্থের মালিককে থানায়
নিয়ে গিয়ে মারধর করত, গারদে আটকে রাখত, সদর থেকে গোয়েন্দা আসত-এমনকি মনে করলে
বিনাবিচারে বন্দি করে রাখত। ৫৪ অধ্যাপক প্রিয়রঞ্জন সেন লিখছেন যে, সে সময়
“লোকে ভয়ে ভয়ে আনন্দমঠ পড়িত। পাছে পুলিশ ধরে, যদি গোয়েন্দা দেখে, এমনি সাত
পাঁচ কত কি ভাবিত।… সেদিনও মনে পড়ে, কারাপ্রাচীর ভেদ করিবার পক্ষে আনন্দমঠের
কত বাধাই ছিল। একখানি স্কুলপাঠ্য পুস্তকে ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি দেওয়া ছিল
বলিয়াই তাহা পুস্তক রচয়িতার নিকটে পৌঁছিবার ‘অনুমতি পায় নাই, লেখক তখন জেলে।”
৫৫

তথ্যসূত্র:-
———–

১।আত্মচরিত, কৃষ্ণকুমার মিত্র, ১৩৮০, পৃঃ ২৪৬-৪৭। টহলরাম সম্পর্কে বিস্তৃত
আলোচনার জন্য ‘ভারত ও সমাজতান্ত্রিক জি. ডি. আর’, শারদীয়া, ১৩৮৬-এ বর্তমান
গ্রন্থকারের প্রবন্ধ ‘টহলরাম গঙ্গারাম-এক বিস্মৃত দেশপ্রেমিক’ প্রবন্ধ
দ্রষ্টব্য।
২। Bande Mataram, 16.4.1907; also vide, Bankim-Tilak-Dayananda, Sri
Aurobindo, 1955, P.12.
৩।বন্দে মাতরম্, যোগীন্দ্রনাথ সরকার গ্রন্থে সখারাম গণেশ দেউস্করের ভূমিকা।
৪।আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯/৪/১৯৯৯, ‘সম্পাদক-সমীপেষু’ কলমে সত্যগোপাল পালের
চিঠি।
৫।বাংলা দেশের ইতিহাস, ৪র্থ খণ্ড, মজুমদার, পৃঃ ৩৩-৩৪।
৬।বন্দেমাতরম্ সংগীতের প্রভাব’ প্রবালকান্তি হাজরা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি,
রবীন্দ্র সংখ্যা, ১৩১৪।পৃ -৮২।
৭।History of Freedom Movement in India, Vol II, R.C. Majumdar, 1975, P. 49.
৮।১৩১৪। পৃঃ ৮২। সংস্কৃতি, রবীন্দ্র সংখ্যা,বাংলা দেশের ইতিহাস, ৪র্থ খণ্ড,
মজুমদার, পৃঃ ৩০।
৯।আমার কাল আমার দেশ, সুধীরচন্দ্র সরকার, ১৩৭৫, পৃঃ ১৮।
১০।ফিরে ফিরে চাই, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, ১৩৮৫, পৃঃ ১০৬।
১১।রূপনারায়ণের কূলে, প্রথম খণ্ড, গোপাল হালদার, ১৯৬৯, পৃঃ ৮৯।
১২।ইতিহাস অনুসন্ধান (২১), রাজীব কুণ্ডুর প্রবন্ধ পৃঃ ৩৪৯।
১৩।রঙ্গমঞ্চে বঙ্কিমচন্দ্র, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, ১৯৮২, পৃঃ ১০০।
১৪।স্বাধীনতা সংগ্রামে বরিশাল, দ্বিতীয় খণ্ড, হীরালাল দাশগুপ্ত ও মনোরঞ্জন
গুপ্ত, ১৯৭৬, পৃঃ ২২৪।
১৫। ঐ, প্রথম খণ্ড, ১৯৭২, পৃঃ ১১৬।
১৬।ঐ, দ্বিতীয় খণ্ড পৃঃ ১৮৮।
১৭।ঐ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ১৯৯।
১৮।জাতীয় আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্লকুমার সরকার, ১৩৭০, পৃঃ ৫৫-৫৬।
প্রফুল্লকুমার সরকারের মতে “বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন একটা নবযুগের স্রষ্টা-নবীন
বাঙালী জাতির পথপ্রদর্শক।”-পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ১৬।
১৯।প্রবর্তক, ১৩৪৫, শ্রাবণ, পৃঃ ৩৫৪।
২০।ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, দ্বিতীয় খণ্ড, হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, ১৯৪৭, পৃঃ ৬৮।
২১।আমার জীবনকথা, পুলিনবিহারী দাস, সম্পাদনা-অমলেন্দু দে, ১৯৮৭, পৃঃ ৭৬-৭৮।
২২।জাগরণ ও বিস্ফোরণ, ১ম খণ্ড; নিষিদ্ধ বাংলা, শিশির কর, ১৯৭৬; নির্বাসিত
সাহিত্য, হিরন্ময় ভট্টাচার্য, ১৯৮২ এবং পরিচয়, ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৭ দ্রষ্টব্য।
২৩।জাগরণ ও বিস্ফোরণ, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২০৩-০৫।
২৪।ঐ, পৃঃ ২২৫।
২৫।গ্রন্থটি সম্পর্কে আরও তথ্যের জন্য ‘স্বদেশী আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য’
সৌমেন্দ্র
গঙ্গোপাধ্যায়, ১৩৬৪, পৃঃ ১৯১-৯৩ এবং নিষিদ্ধ বাংলা, শিশির কর দ্রষ্টব্য।
২৬।বন্দে মাতরম্, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, ১৯০৭-এ অশোক কুমার মুখোপাধ্যায় রচিত
‘মুখবন্ধ’-এ উদ্ধৃত, পৃঃ বারো।
২৭। Bankim Chandra Chatterjee, S.K. Bose, New Delhi, 1974, P. 83.
২৮।জাগরণ ও বিস্ফোরণ, ১ম, পৃঃ ১১৮।
২৯।আত্মচরিত, কৃষ্ণকুমার মিত্র, ১৩৮১ সং, পৃঃ ২১০-১১।
৩০।বন্দে মাতরম, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, সম্পাদনা-বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়, ২০০৭,
গ্রন্থে অশোক মুখোপাধ্যায়ের মুখবন্ধ, পৃষ্ঠা বারো।
৩১।ঐ।
৩২।India under Morley and Minto: Politics Behind Revolution, Repression and
Reform, M.N. Das, London, 1964, P.39.
৩৩। স্বাধীনতা সংগ্রামে বরিশাল, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ৪১।
৩৪।বন্দে মাতরম্’ সম্পর্কে যাবতীয় আলোচনা, পুলিশী নির্যাতন, প্রতিক্রিয়া
সম্পর্কে বিশদ আলোচনার জন্য জাগরণ ও বিস্ফোরণ (১ম ও ২য়), রমেশচন্দ্র মজুমদারের
বাংলা দেশের ইতিহাস, ৪র্থ খণ্ড দ্রষ্টব্য।
৩৫। যুগান্তরের জীর্ণ স্মৃতি, বসন্ত কুমার মাইতি, পৃঃ ৫৯-৬১;
দ্রষ্টব্য-সাহিত্য ও সংস্কৃতি, কার্তিক-চৈত্র, ১৪১৫, পৃঃ ৮৭-৮৮।
৩৬।Quoted in: Vande Mataram, Directorate of Advertising and Visual
Pub-licity, Ministry of I and B. Govt. Of India, 1976.
৩৭।মুখোপাধ্যায় জীবন,আনন্দমঠ ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ।
৩৮।Collected Works of Mahatma Gandhi, vol. IV, Govt. of India, P. 156.
৩৯।Do, Vol. XIX, P. 121.
৪০।Yuva Bharati, Feb. 1977, P. 46
৪১।Political Trouble in India 1907-17, Ker, P. 11 এবং ভারতের বৈপ্লবিক
সংগ্রামের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, সুপ্রকাশ রায়, ১৯৭০, পৃঃ ৩১১-১২।
৪২।Vande Mataram: The Biography of a song, Sabyasachi Bhattacharya, 2003,
P. 24.
৪৩।do, P. 57.
৪৪।Political Trouble in India 1907-1917, James Campbell Ker, 1973, P.13.
৪৫।বিশদ বিবরণের জন্য ‘বন্দেমাতরম্ শতবর্ষের স্মৃতি’ দ্রষ্টব্য।
৪৬।জাগরণ ও বিস্ফোরণ, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২২৬ এবং Modern Review, 1909 January, P.
77.
৪৭। Modern Review, 1909, January-June, Vol. V.
৪৮।রঙ্গালয়ে অমরেন্দ্রনাথ, রমাপতি দত্ত, ১৩৪৮, পৃঃ ৪৭৮-৮৯।
৪৯।ব্রিটিশ শাসনে বাজেয়াপ্ত বাংলা বই, শিশির কর, ১৯৮৮, পৃঃ ৮৭।
৫০।স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলা নাটক ও নাট্যশালা, মন্মথ রায়, ১৩৮৫, পৃঃ ২৩।
৫১।স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলা নাটক ও নাট্যশালা, মন্মথ রায়, ১৩৮৫, পৃঃ ২১-২২।
৫২।বাংলা নাটক ও নাট্যশালা, শচীন সেনগুপ্ত, ১৩৬৪, পৃঃ ৩৫-৩৬।
৫৩।ঐ।
৫৪।জাগরণ ও বিস্ফোরণ, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২২৬।
পৃঃ ১৫৬।
৫৫। ‘বঙ্কিম সাহিত্যের ভূমিকা’ গ্রন্থে (সম্পাদকের নাম নেই) প্রিয়রঞ্জন সেনের
রচনা, ১৩৬০।

Author

  • Suman Kumar Mitra

    Suman Kumar Mitra is a Researcher at Murshidabad Zilla Itihas & Sanskriti Charcha Kendra. He did his MA in Bengali from Rabindra Bharati University and is a Guest Lecturer at D.I.E.T Murshidabad, Berhampur, West Bengal. Views expressed are personal.

    View all posts

(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)