জাতীয় চেতনা হলো জাতীয়তাবাদের উৎস। ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়ার দিকে ভারতে কোনো জাতীয়তাবাদী চেতনা ছিল না। বিদেশি শাসনের ফলশ্রুতি হিসেবেই আধুনিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ শুরু হয়। পৃথিবীর তাবৎ পরাধীন দেশে স্বৈরাচারী পরাজিত বিদ্বেষ ও দেশের গৌরব এর উপর ভিত্তি করেই দেশ প্রেম জেগে ওঠে। পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ভারতে যে স্বাজাত্যবোধ সৃষ্টি হয় তারও ভিত্তি ছিল তাই। আর স্বাজাত্যবোধে উদ্বুদ্ধ ভারতবাসী বিদেশী শোষক ইংরেজদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় তাঁদের বহুকাঙ্খিত স্বাধীনতা। ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট স্বাধীন হ্য় ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ৭৫ বছরের দোরগড়ায় দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে চাইলে বোঝা যায় সহজ ছিল না এই ছিনিয়ে নেওয়াটা, আপাতনিরীহ , বহুধা বিভক্ত, মেরুদন্ডহীন সাধারণ ভারতীয়ের মনে জাতীয়তাবাদের আগুন জ্বালানোটা ছিল অলিক স্বপ্ন। এই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ যিনি দেন, যাঁর দ্বারা জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের ধারনায় ভারতবাসী উদ্বুদ্ধ হয়ে ঝাপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে- তিনি হলে ভারতবর্ষের প্রথন গ্র্যাজুয়েট সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
উনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে আমাদের শিক্ষা এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রে যে কয়টি শুভ লক্ষণ দেখা গিয়েছিল, প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির আলোচনা তাদের অন্যতম । আমাদের জীর্ণ এবং ক্ষয়িষ্ণু সমাজের সম্মুখে যখন ইউরোপীয় জীবনের প্রাণবন্ত আদর্শ এসে পড়ল, স্বভাবতই তখন চেষ্টা হয়েছিল আমাদের জীবনের আদর্শকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য। এই উদ্যমেই ইতিহাসচর্চা দেখা দিল এবং সেই উদ্যমেই প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য এবং ধর্মশাস্ত্রের পুনর্বিচার এবং পুনরনুসন্ধান চলেছিল।
নবজাগ্রত মনের ইতিহাসচর্চার জন্যই উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইতিহাস-গ্রন্থ রচনার প্রাচুর্যই চোখে পড়ে এবং সে-ইতিহাস পৃথিবীরই ইতিহাস। বহির্বিশ্বের সঙ্গে জ্ঞানের যোগে সম্পর্ক স্থাপিত হওয়া অবশ্যই কল্যাণকর ; কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এই যে,আমাদের দেশের ইতিহাস সম্বন্ধে আলোচনা ও অধ্যয়ন তখনও সর্বজনীন হয়ে ওঠে নি।১
ভারতের জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত রামমোহন রায় ও তাঁর অনুগামী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয় কুমার দত্ত, তত্ত্ববোধিনী সভা, ইয়ংবেঙ্গল সম্প্রদায়, রাজনারায়ণ বসু, নবগোপাল মিত্রের কার্যকলাপ, ঈশ্বর গুপ্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখ কবি সাহিত্যিকদের রচনা, সামাজিক – ধর্মীয় আন্দোলন,জাতীয় রঙ্গমঞ্চের নিত্য নতুন চমক দেশে প্রবল জাগরণের সৃষ্টি করেছিল। বঙ্কিম চন্দ্র তখন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক। বঙ্কিমচন্দ্রইচ্ছেকরলে তখন অনায়াসেই ইংরেজি ভাষাকে কাজে লাগিয়ে নিজের চাহিদা পূরণ করে সফল জীবন যাপন করতে পারতেন। বাঙালী তথা ভারতবর্ষের জাতীয় চেতনা ও ইতিহাস বোধ নিয়ে মাথা না ঘামানোটাই ছিল স্বাভাবিক। সেভাবেই, সেপথেই তিনি কিছুটা অগ্রসরও হন, তাই ১৮৬০ সালে খুলনায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাঁকে দেখা যায় ইংরেজীতে Rajmohan’s Wife উপন্যাস রচনায় ব্যপৃত থাকতে। ১৮৬১ সাল পর্যন্ত এই রচনা চলে,এবং ১৮৬৪ সালে কিশোরীচাঁদ মিত্র সম্পাদিত ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ড’ পত্রে এটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ১৮৬৪ সালের পূর্বেই বঙ্কিম-মানসে এক আকস্মিক রূপান্তরিত সাধিত,-অবজ্ঞাত অশিক্ষিতের বাহন বাংলা শিক্ষিতের বাহন ইংরেজীর আসন অধিকার করে বসে। যে বাংলাভাষা চর্চা সম্পর্কে,তার কার্যকারিতা সম্পর্কে স্বয়ং বঙ্কিম ছিলেন সন্দিগ্ধ, যে বাংলার চর্চা তাঁর কাছে ছিল অপমানকর ,এই রূপান্তরের ফলে এই বাংলাই চিরস্থায়িত্বের ও সত্যের দাবী নিয়ে বঙ্কিম-মানসে আবির্ভূত হয়। তাঁর মনের ইংরেজি-বাংলা বিরোধ যায় মিটে, বাংলাকেই তাঁর সাহিত্যজীবনের কথা বলার বাহন নির্বাচন করেন তিনি। তাঁর মানসিক আন্দোলন নতুন সৃষ্টির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন,যার ফল ‘দুর্গেশনন্দিনী’। ২
বঙ্কিম উপলব্ধি করেন যে বাংলা তথা ভারতবর্ষের মানুষের আত্মজাগরণ সবার আগে প্রয়োজন, তাই তিনি তাঁর লেখনী প্রতিভাকে হাতিয়ার করেন দেশের মানুষের জাতীয়তা বোধ জাগ্রত করার জন্য। বঙ্কিম বলেন-“বাঙ্গালার ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙ্গালার ভরসা নাই। কে লিখিবে? তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে। যে বাঙ্গালী, তাহাকেই লিখিতে হইবে।”
বঙ্কিমচন্দ্রের মানসিক পরিবর্তন ঃ
১৮৬৪ সালের কিছু পূর্বে জাতীয়তাবাদী ধারণার অঙ্কুরোদগম বঙ্কিমচন্দ্রের মনে হয়েছিল তার বেশ কিছু কারণ ছিল।বেশ কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর এই যুগান্তকারি রুপান্তর ছাত্রজীবনের বন্ধু দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ ১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয়,তার প্রভাব বঙ্কিম-মানসে পড়েছিল। ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মিনী উপাখ্যানের’ ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়?’গোপনে বঙ্কিমচন্দ্রকে বাংলায় সচেতন করেছিল । ১৮৬১ সালে পাদ্রী লং-এর কারাদন্ড এবং মরেলগঞ্জের নীলকর সাহেবদের দমনে স্বয়ং বঙ্কিমের সক্রিয় অংশগ্রহন তাঁকে বিচলিত ও ভবিষ্যৎ সংগ্রামের সিদ্ধান্তে উদ্দিপীত করে তুলেছিল । সম্ভবত মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ’ বাংলা ভাষার অপরিমেয় সম্ভাবনার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল।
১৮৫৯ সালের নীল হাঙ্গামা বঙ্কিমচন্দ্রকে বিচলিত করেছিল। পরবর্তীতে ঘটে যাওয়া উপরিউক্ত ঘটনা যেমন তাঁকে বাংলা ভাষায় আকৃষ্ট করেছিল পাশাপাশি দেশপ্রেমের সুপ্ত বাসনাও ধীরে ধীরে তাঁর অবচেতনে গড়ে উঠছিল। এই দেশপ্রেম তাঁর সামনে সত্য রূপে ধরা দেয় ১৮৬৪-৭৪ সালের মধ্যে। এই সময় বঙ্কিম-মানসের প্রচণ্ড পরিবর্তন ঘটে। সমসাময়িক ঘটনার প্রভাব বঙ্কিমচন্দ্রের মানস পটে কিভাবে পরিবর্তন আনে তা আলোচনা করলে বিষয়টি আমাদের কাছে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
১৮৬৪ সালঃ
১)কার্ল মাক্সের First International -এর আবির্ভাব।
২)রাশিয়ার শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈপ্লবিক ভাবধারার প্রসার এবং জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার কর্তৃক জেলা ও প্রাদেশিক পরিষদ গঠনে স্বীকৃতি দান।
৩)হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের “বীরবাহু” গ্রন্থের আবির্ভাব।
বঙ্কিমচন্দ্র বদলি হলেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার বারুইপুর মহকুমাতে।৭৪
কার্ল মার্ক্সের প্রভাব পরবর্তীকালে বঙ্কিম রচনায় আমরা দেখতে পাই,এবং তাঁর মানস পটেও যে এ প্রভাব পড়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
‘বীরবাহু’-কাব্যগ্রন্থে দেশপ্রেমের যে ব্যাখ্যা,তা বঙ্কিমচন্দ্রের মানসিকতায় স্বদেশপ্রীতির শুকনো বীজ রোপণের কাজ করেছিল।
১৮৬৫ সালঃ
১)আমেরিকার গৃহ যুদ্ধের অবসান।
২)মিলের Comte and Positivism গ্রন্থের প্রকাশ।
৩)বঙ্কিমচন্দ্রের ভাতৃবিরোধ শুরু হয়। কাঁঠালপাড়ার সম্পত্তি বণ্টনের সময় শ্যামাচরণ ও বঙ্কিমচন্দ্র প্রাপ্য অংশ থেকে বঞ্চিত হন। ভাতৃবিরোধ বঙ্কিমচন্দ্রকে মনঃকষ্ট দিয়েছিল ।৩
১৮৬৬ সালঃ
১)জার্মানির একীকরণের জন্য বিসমার্কের নতুন পদক্ষেপ; অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার যুদ্ধ।
২)জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের প্রাণনাশের চেষ্টা।
৩)উড়িষ্যার দুর্ভিক্ষ; চল্লিশ লক্ষ অধিবাসীর গৃহে হাহাকার ও আনুমানিক একতৃতীয়াংশের মৃত্যু।
৪)ভোলানাথ চন্দ্র প্রভৃতির এই দুর্ভিক্ষের কারণ অনুসন্ধানের জন্য তথ্য আলোচনা। বিদ্যাসাগর, প্যারীচরণ সরকার প্রভৃতির প্রশংসনীয় সেবাকার্য।
বঙ্কিম মানসে একাত্মবোধের বিকাশ গড়ে উঠতে থাকে, দেশবাসীর দুর্দশা ইংরেজ আধিকারিক বঙ্কিমের মনেও দোলা দেয়। ৪
১৮৬৭ সালঃ
চৈত্র অথবা হিন্দু মেলার প্রতিষ্ঠা। জাতীয় ভাবধারার উদ্বোধনে নবগোপাল মিত্রের উদ্যম। উত্তেজনার প্রাবল্যে তাঁহার নূতন নামকরণ হয়, ‘ নেশনাল নবগোপাল ’ অথবা ‘ নেশনাল মিত্র’।৫
১৮৬৮ সালঃ
১)কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁহার অনুগামী ব্রাহ্মদের নগর কীর্তনঃ “ তোরা আয়রে ভাই, এতদিনে দুঃখের নিশি হলো অবসান, নগরে উঠিল ব্রাহ্মনাম।“ ইত্যাদি।
২)যশোহরে পোলুয়া-মাগুয়া হইতে শিশির কুমার ঘোষের ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকা প্রকাশ।৭৮
জন স্টুয়ার্ট মিলের Subjection of Women গ্রন্থ প্রকাশ।
স্ত্রী-স্বাধীনতার ওপর রচিত এই পুস্তকের প্রভাব বঙ্কিম মানসে পরেছিল,তার নিদর্শন আমরা ‘ আনন্দমঠের নারী চরিত্র শান্তির মধ্যে পাই। ৬
১৮৭০ সালঃ
১) ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়ান যুদ্ধ।
২) আইরিশ হোমরুল লীগের প্রতিষ্ঠা, ও আইরিশ জাতীয়তাবাদের ব্যাপক প্রসার। আয়ারল্যান্ডকে ইংল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও আয়ারে গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা।
৩) ইটালীতে পোপ তন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতিয়তাবাদীদের সংঘর্ষ ও চরম জয়লাভ। ইটালী একীকরণের কার্যের সুসমাধান।
৪) সাঁওতাল পরগণায় অরাজকতা ও ব্যাপক কৃষি-বিদ্রোহ।
৫ )বঙ্কিমচন্দ্রের বহরমপুর আগমন।
৬) ভুদেব মুখ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘ এডুকেশন গেজেট’-এ হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভারত সঙ্গীত’ প্রকাশ।৭
ইতিমধ্যে বঙ্কিম মানসে যে শুকনো বীজ রোপিত হয়েছিল তা তখন অঙ্কুরোদগম শুধু নয়, চারা গাছে পরিনত হয়ে পড়েছিল।
১৮৭১ সালঃ
১)ফ্রান্সের পরাজয়; প্যারিসে শ্রমজীবী জনসাধারনের বিদ্রোহ এবং “প্যারিস কমিউন” প্রতিষ্ঠা; ব্যপক অরাজকতা ও রক্ত ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে কমিউনের ধ্বংস; ঐক্যবদ্ধ জার্মানি আন্দোলনের চরম সাফল্য ও নূতন জার্মান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা।
২)চার্লস ডারউইনের Decent of Man গ্রন্থের প্রকাশ।
৩)বিদ্যাসাগর মহাশয়ের “ বহু বিবাহ” প্রথম পুস্তকের প্রকাশ।
৪)স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে বঙ্কিমচন্দ্রের পরিচয় ঘনিষ্ঠতা। ৮
১৮৭২ সালঃ
১)হার্বাট স্পেন্সরের Principles of psychology গ্রন্থের প্রকাশ।
২)আন্দামানের শের আলি নামক জনৈক কয়েদির হাতে বড়লাট লর্ড মেয়-র প্রাণ বিসর্জন।
৩)রাজনারায়ন বসুর ‘ সেকাল আর একাল ’ বক্তৃতা।
৪)বিদ্যাসাগর মহাশয়ের “ বহু বিবাহ” দ্বিতীয় পুস্তকের প্রকাশ।
৫)‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশিত হওয়ার পর বহরমপুরেই রমেশ চন্দ্র দত্তের সহিত বঙ্কিমচন্দ্রের পরিচয়।৯
১৮৭৩ সালঃ
ভার্নাকুলার প্রেস সম্পর্কিত বিতর্কে দেশি সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের মতজ্ঞাপন; ফলে, বিভিন্ন মহলে তাঁর কঠোর সমালোচনা; তার মধ্যে প্রধান ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ অন্যতম। পত্রিকায় বলা হয়েছিল, “ Before concluding this we would make the remark regarding Bunkim Baboo which the late.Mr. Anstey made of Mr. Paul eulogizing Lord Mayo. “ I hope my learned colleague will meet his reward in after life as surely as he is to receive the reward here”-23 octr.1873. ১০
উপরিউক্ত ঘটনা বঙ্কিমচন্দ্রকে ভাবতে বাধ্য করছিল ইংরেজ শাসনের সমস্তই সঠিক নয়, তার গলদ ও পরাধীনতার গ্লানি সাধারণ মানুষকে কোন যন্ত্রণায় পিষ্ট করছিল তা তিনি উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলেন, আর ঠিক এই সময় ঘটে বহরমপুরের ঘটনা ।
১৮৭৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বরঃ
১৮৭৩ সালের ডিসেম্বর মাস,তারিখ ১৫ ,বঙ্কিমচন্দ্র তখন বহরমপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র কোর্ট থেকে পাল্কি করে আসছিলেন মাঠের মধ্য দিয়ে। সেই সময়ে মাঠে ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত গোরা সৈন্য ও তাদের দলের অধ্যক্ষ কর্নেল ডাফিন বঙ্কিমচন্দ্রকে অপমান করতে উদ্যত হলে মহজারাজা যোগীন্দ্র নারায়ণ উচ্ছৃঙ্খল গোরা সৈন্যদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ১১
এ বিষয়ে হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে শুনে তাঁর ‘ ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র’ গ্রন্থে লিখেছেন,” আজকাল যেখানে বহরমপুরের ফৌজদারি কাছারি, সে সময়ে উহা এখানে ছিলনা, আরও দক্ষিণে জজ কোটের নিকটে ছিল। বঙ্কিম নদীর পার দিয়া পাকা রাস্তায় প্রত্যহ পাল্কী করিয়া আসিয়া কোণাকুণি একটি পায়ে চলা রাস্তা দিয়া স্কোয়ার ল্যান্ড পার হতেন।একদিন ডিসেম্বর মাসে বৈকালে ফিরিবার সময় কর্নেল ডাফিন প্রমুখ কয়েকজন সাহেব ক্রিকেট খেলিতেছিলেন। জজ বেনব্রিজ, রেভারেন্ড বার্লো, প্রিন্সিপাল রবার্ট হ্যান্ড, রাও(পরে রাজা রাও যোগেন্দ্র নারায়ণ রায় (লালগোলা),দুর্গাচরণ ভট্টাচার্য প্রভৃতি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। দূর হইতে পাল্কী আসিতে দেখিয়া কর্নেল ডাফিন কাছে গিয়া বঙ্কিমচন্দ্রকে ফিরিয়া যাইতে বলেন। বঙ্কিম অস্বীকার করেন, সাহেব বঙ্কিমচন্দ্রকে পাল্কী হইতে নামাইয়া অপমান ও আক্রমণ করেন। বঙ্কিম তৎক্ষণাৎ সাহেবদের জানাইয়া রাখিলেন। বেনব্রিজ বলিলেন, ’ আমি চোখে কম দেখি, অতদূর দৃষ্টি যায়নি।‘ রবার্ট হ্যান্ড বলিলেন তিনি ঘটনাটি দেখিয়াছেন। রেভারেন্ড বার্লো,রাজা রাও যোগেন্দ্র নারায়ণ,দুর্গাচরণ ভট্টাচার্য হ্যান্ডকে সমর্থন করিলেন। পরদিন বঙ্কিমচন্দ্র মামলা রুজু করিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মি. উইন্টার। তিনি কর্নেলকে তলব করিলেন শহরে এক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাইল । সমস্ত উকিল-মোক্তাররা বঙ্কিমচন্দ্রের ওকালত নামায় সহি করিয়াছেন।আসামীর তরফে কাহাকেও পাওয়া গেলনা। অগত্যা কর্নেল কে কৃষ্ণনগর হইতে উকিল আনিতে হইল।”১২
১৮৭৪ সালের ৮ই জানুয়ারী অমৃত বাজার পত্রিকা এ বিষয়ে লিখেছে ,-“ we are grieved to learn from moorshidabad patrika that babu Bankim Chandra chatterjee, the Dy.Magt.while returning home form office on the 15th December last, was assaulted by one Lt. Colonel Duffin on the Berhampur cantonment, and received several violent pushes at his hands.It appears that Babu was passing in a palkee across a cricket ground where Mr. Duffin and some Europeans were playing.This was deemed a great beadubee on the part of the Babu and Mr.Duffin felt himself fully justified in chastising him with blow.The Patrika says that the Babu was brought a criminal case against his aggressor and it has caused as it ought great sensation in berhampore……..”১৩
১৮৭৪ সালের ১২ই জানুয়ারী। উইন্টার সাহিব বিচারে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, হঠাৎ জজ বেসব্রীজ আসিয়া-“ M.r. Winter will you mind coming to the chamber “বলিয়া খাস কামরায় লইয়া যান। বঙ্কিমচন্দ্র ও কর্নেলকে কিছুক্ষণ পর তাঁহারা ডাকিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র নাছোড়বান্দা , কিছুতেই মোকদ্দমা উঠাইতে রাজি হইলেন না। পরে স্থির হইল কর্নেল প্রকাশ্য আদালতে ক্ষমা চাহিবেন; তারপরে বঙ্কিমচন্দ্র মোকদ্দমা উঠাইয়া লইবেন।
উইন্টার সাহিব পুনরায় আদালতে উপবেশন করিলে ডাফিন ক্ষমা চাহেন ,কিন্তু হঠাৎ কি বলিতে কি বলিয়া ফেলিলেন,আর সকলে হাসিয়া উঠিল।যুবকগণ হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিল। ভাগ্যিস তখনও বন্দেমাতরম রচিত হয় নাই, নইলে আরও কাণ্ড ঘটিয়া যাইত।“১৪
১৮৭৪ সালের ১৫ ই জানুয়ারী অমৃত বাজার পত্রিকায় কর্নেল ডাফিনের বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে সর্বসমক্ষে ক্ষমা চাওয়ার ঘটনাটি ফলাও করে প্রকাশিত হয়।অমৃত বাজার লিখেছে,-…It appears that the Colonel and the Babu( Bankim candra) were perfect strangers to each other, and he did not know who he was when affronted him. On being informed afterwords of the position of the Babu, Col. Duffin expresssed deep contrition and a desire to appologi. Thw apology was made in due formin open court where about a thousands spectators, native and Europeans were assembled.১৫
তৎকালীন বিক্ষুব্ধ সমাজ পরিবেশ, যখন বিদেশী শাসন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস ও সন্দেহ ঘনিয়ে উঠেছে,যখন পরাধীনতার চেতনা জেগে উঠতে শুরু করেছে, সেই কাল বৈশাখীর মত ক্ষুব্ধ আবহাওয়ায় ব্যক্তিজীবনের এই দুর্ঘটনাকে জাতীয় অপমানের ক্ষত চিহ্ন স্বরূপ গণ্য করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র।৮৪ আর তার ফল স্বরূপ রচিত হয় জাতির মহামন্ত্র, স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ‘বন্দেমাতরম্’ সঙ্গীত।
বঙ্কিমচন্দ্রের যুগে বাঙ্গালীর দেশপ্রেম উপন্যাসে,নাটকে কাব্যে। যে উন্মাদনায় শত সুরে বেজে উঠেছিল তাঁর একটি পূর্ব ভূমিকা ছিল। ইংরেজের প্রভাবেই ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে যে দেশপ্রেম মানুষের মনে জেগে উঠেছিল বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সুস্পষ্ট রূপ দিয়েছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের প্রকাশঃ
উনবিংশ শতকের সাহিত্য জগতের নক্ষত্র ও বাংলা উপন্যাসের প্রথম সার্থক স্রষ্টা যে তাঁর সাহিত্য রচনার মাধ্যমেই ভারতবর্ষের জাতীয় জাগরণ ও মুক্তি সংগ্রামকে আলোড়িত করবেন সেটাই কাম্য।বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমযুগের সুচনার সাথে সাথেই ধর্ম, সামাজিক আদর্শ, ও দেশ প্রিতী নতুন রূপে ধরা দিল। বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত ‘ভারত-কলঙ্ক’ ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রবন্ধে তাঁর প্রগাঢ় দেশ প্রীতির নিদর্শন মেলে।মৃণালিনীতে সূচনা হয় স্বাজাত্যবোধের। বিশিষ্ট সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বলেছেন মৃণালিনীতেই বঙ্কিমচন্দ্র প্রত্যক্ষ পূজক রূপে গৈরিক উত্তরিয় পরিধান করে মন্দিরে প্রবেশ করেন। দেশের জন্য উপন্যাসের নায়ক হেমচন্দ্রের স্বার্থত্যাগ- তাঁর আত্মোৎসর্গের প্রবল আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই নবযুগের মহিমান্বিত ঋষির ধ্যানযোগের রুপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশ মাতৃকার পূজায়োজনের সূত্রপাত এখানেই। সে আয়োজনের পুজা সার্থক হয়ে উঠেছে ‘ আনন্দমঠে’।মৃণালিনীতে সাধকের কাছে মাতৃপূজার যোগের পন্থা ,নিয়ম, মন্ত্র যেন অস্পষ্ট- সেজন্য সেখানে প্রবল হয়ে উঠেছে দেশানুরাগের প্রবল উচ্ছ্বাস। অন্যদিকে আনন্দমঠে ঋষি যেন সিদ্ধপুরুষ। আনন্দমঠে দেশপুজা-পদ্ধতী পাশ্চাত্য পদ্ধতীর অনুকরণ নয়- ভারতীয় সংস্কৃতির চিরাচরিত নিষ্কাম স্বদেশ প্রেম। ১৬
বঙ্কিম ইংরেজদের চিন্তা ভান্ডার থেকে সংরহ করে আনেন স্বাতন্ত্র্য প্রিয়তা ও জাতি প্রতিষ্ঠার আইডিয়া।আর সেই আইডিয়াকে সাহিত্যে বাণী মূর্তি দিলেন আনন্দমঠে,দেবীচৌধুরানীতে, কৃষ্ণতত্বে।Ideas rules the world- একথা যদি সত্য হয় তবে এটা স্বীকার্য দেবীচৌধুরানী, আনন্দমঠ, কৃষ্ণচরিত্র ও ধর্মতত্ব বর্তমান ভারতবর্ষকে সৃষ্টি করেছে তাঁর কানে ন্যাশনালিজমের মহামন্ত্র শুনিয়ে।তাই বলা যেতেই পারে বিষবৃক্ষ আর কপালকুণ্ডলার বঙ্কিম আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সূচনা করলেও নব্য ভারতের স্রষ্টার যে গৌরব- সেই গৌরবের দাবী করবে আনন্দমঠ ও কৃষ্ণতত্বের বঙ্কিম।১৭ দেশপ্রীতি তাঁর কাছে দেখা শুধু শুকনো কর্তব্য হিসেবে ধরা দেয়নি, স্বদেশ প্রেম তাঁর কাছে ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুতর ধর্ম। ‘ধর্ম্মতত্বে’- লেখা আছে” আরো বুঝিয়াছি,আত্মরক্ষা হইতে স্বজনরক্ষা গুরুতর ধর্ম , স্বজন রক্ষা হইতে দেশ রক্ষা গুরুতর ধর্ম। যখন ঈশ্বরে ভক্তি এবং সর্ব্বালোকে প্রীতি এক তখন বলা যাইতে পারে যে, ঈশ্বরে ভক্তি ভিন্ন দেশপ্রীতি সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর ধর্ম।”১৮ ঋষিঅরবিন্দের মতে,-“ The religion of patriotism-This is the master idea of Bunkim’s writing. ১৯
ঈশ্বরে ভক্তি ভিন্ন দেশপ্রীতিই যে জীবনের পরম ধর্ম- সাহিত্যকে আশ্রয় করে এই বাণী প্রচারে বঙ্কিম আত্মনিয়োগ করেছিলেন কেন? কারণ বঙ্কিম সমস্ত চিত্ত দিয়ে ভালোবেসেছিলেন তাঁর স্বদেশের লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত, অর্ধনগ্ন, মেরুদন্ডহীন নরনারীকে। বাস্তবের হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখেচিত্ত তাঁর অত্যন্ত বিচলিত হয়েছিল-
“ আজি দেশের সর্বত্র শ্মশান তাই মা কঙ্কালমালিনী। আপনার শিব আপনার পদতলে দলিতেছেন, হায় মা!”-এই বলে আনন্দমঠের ব্রহ্মচারী যেখানে দরদরধারায় কেঁদে চলেছেন-সেখানে সেই কান্নার মাঝে কি আমরা শুনতে পাই না বঙ্কিমেরই অশ্রুজড়ানো কন্ঠস্বর?২০
প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে বলা হচ্ছে- “ জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী ”-অর্থাৎ জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। নবীন বাংলার মন্ত্রগুরু বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘আমার দুর্গোৎসব’- প্রবন্ধে দেশকে বললেন মা দুর্গা, আহ্বান জানালেন গৃহে ফিরে আসার। তিনি বললেন যে দেশই মা, দেশই স্বরগ,দেশই ধর্ম, দেশইদেবতা ,দেশই হল জ্ঞান, ভক্তি, ধর্ম, প্রাণ, হৃদয় ও শক্তি।দেশ শুধু মা নন তিনি দুর্গতি নাশিনী দুর্গা। তিনি লিখলেন, “ যে মনুষ্য ‘জননীকে স্বর্গাদপী গরীয়সী’ মনে না করতে পারে, সে মনুষ্য, মনুষ্য-মধ্যে হতভাগ্য। যে জাতি জন্মভূমিকে ‘স্বর্গাদপী গরিয়সী’ মকনে না করিতে পারে , সে জাতি , জাতি-মধ্যে হতভাগ্য। ”২১
বঙ্কিমচন্দ্রের জাতিয়তাবাদি চেতনার সোনালী ফসল হল ‘আনন্দমঠ’। আনন্দমঠের মাধ্যমে বঙ্কিম যে কেবল দেশপ্রেম জাগ্রত করেছিলেন তাই নয়- এই মহা গ্রন্থের মাধ্যমে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন এক নতুন দরশন ও আদর্শবাদ। আনন্দমঠ-এর সন্তান্দলের এক্মাত্র দেবতা হলেন-জননী জন্মভুমি। হিন্দুর তেত্রিশ কোটি দেবতাকে স্থানচ্যুত করে তাঁদের শূন্য আসনে বসানো হয়েছে জননী জন্মভূমিকে। নতুন এই ধর্ম , হিন্দু ধর্ম বা মুসলিম ধর্ম নয়- তা দেশধর্ম । ২২ ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেন যে, “ Bankim chandra converted ptariotism into religion and religion into ptriotism.”২৩
দেশপ্রেমকে ধর্মের স্তরে উন্নীত করা কেবলমাত্র ভারত ইতিহাসেই নয়—সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে বঙ্কিমচন্দ্রের এক মহত্তর মৌলিক অবদান। স্মরণাতীত অতীত থেকে ঈশ্বরকে ভালােবেসে ভারতবাসী গৃহত্যাগী হয়েছে, সমগ্র বিশ্বকে আত্মার আত্মীয় জেনে জগৎহিতের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছে, কিন্তু ভারতবাসীর বিশ্বপ্রেমের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের কোন স্থান ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, এটা প্রতিবৃত্তির সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুশীলন নয়। দেশপ্রীতি ও সার্বলৌকিক প্রীতি—দুইয়েরই অনুশীলন ও পরস্পর সামঞ্জস্য চাই, এবং তাহলেই ভবিষ্যতে ভারতবর্ষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতির আসন গ্রহণ করতে সক্ষম হবে (ধর্মতত্ত্ব, ২৪ অধ্যায়)।
বঙ্কিমচন্দ্রের এই হিন্দুধর্ম বা এই ধর্মের আদর্শ পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু হিন্দুর কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ও অভূতপূর্ব ছিল। আসলে যুগপ্রয়ােজনে বঙ্কিমচন্দ্র পৌরাণিক ধর্মের সঙ্গে পাশ্চাত্য যুক্তিবাদের সমন্বয় ঘটিয়ে নয়া-হিন্দুত্বের বনিয়াদ খাড়া করবার চেষ্টা করেছিলেন। হিন্দুদের কোন জীবনমুখী নীতি নেই। যুগপ্রয়োজনে বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দুদের জন্য একটি জীবনমুখী নীতি রচনা করতে প্রয়াসী হন। তার মতে ধর্ম হল মনুষ্যত্বের বিকাশ এবং তার ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থটিও হল সেই মনুষ্যত্ব বিকাশেরই আলোচনা। তিনি লিখছেন—“জাতীয় ধর্মের পুর্জ্জীবন ব্যতীত, ভারতবর্ষের মঙ্গল নাই, ইহা আমাদিগের দৃঢ়বিশ্বাস।” ভারতবর্ষের মঙ্গল সাধনের জন্যই তার ধর্মসংক্রান্ত নতুন ব্যাখ্যা। নানা ধর্মাবলম্বীর দেশ ভারতবর্ষে তিনি একটি অসাম্প্রদায়িক, সার্বভৌমিক ও সর্বজনীন ধর্মমত প্রচারে ব্রতী হন। এই ধর্মে সাকারবাদ, জাতিভেদ, অনুষ্ঠান-সর্বস্বতা বা বৈদিক যাগযজ্ঞের কোনো স্থান নেই শাস্ত্রীয় বিধিও তাঁর মতে অভ্রান্ত বা অপরিবর্তনীয় নয়। তাঁর মতে, “বেদে ধর্ম নাই—ধর্ম লোকহিতে” (ধর্মতত্ত্ব, চতুর্থ অধ্যায়)।
কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন যে, দেশের নৈতিক এবং রাজনৈতিক পুনর্জ্জীবন, ধর্মপ্রচার এবং ধর্মরাজ্য-সংস্থাপনই ছিল তার আদর্শ পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের লক্ষ্য। ধর্মের উন্নতি ঘটলেই সমাজের আর্থিক উন্নতি ঘটে। তার মতে “রাজনৈতিক উন্নতিরও মূল ধর্মের উন্নতি। অতএব সকলে মিলিয়া ধর্মের উন্নতিতে মন দাও (কৃষ্ণচরিত্র, চতুর্থ খণ্ড, চতুর্থ পরিচ্ছেদ)।”
ভারত ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল Renaissance preceeds revolution, আর এই Renaissance হল ‘Spiritual Renaissance’ বা ‘আধ্যাত্মিক নবজাগরণ।’ ইতিহাসের মননশীল পাঠকমাত্রই জানেন যে, ভারত ইতিহাসে ধর্মীয় বিপ্লবের পরেই সাধিত হয়েছে রাজনৈতিক বিপ্লব। প্রাচীন ভারত থেকে শুরু করে আধুনিক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্ম ও জাতীয় আন্দোলনের প্রসার—সেই একই ইতিহাস। রামদাস ছাড়া শিবাজি অচল, গুরু গােবিন্দ সিং-কে বাদ দিয়ে শিখ জাগরণ অসম্ভব। আবার আধুনিক যুগে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের পরেই দেখা গেল জাতীয়তার প্রস্রবণ ‘আনন্দ মঠ’-এর প্রকাশ ও ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা, ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দের দেহত্যাগের পর জাতীয়তাবাদী সন্ন্যাসী ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় শুরু করলেন। ‘ফিরিঙ্গী জয় ব্রত’, দেখা দিল স্বদেশি আন্দোলন ও বিপ্লববাদী কার্যকলাপ।২৪
চরমপন্থী রাজনীতির অন্যতম প্রধান প্রবক্তা, বঙ্গীয় বিপ্লববাদী আন্দোলনের মন্ত্রগুরু শ্রীঅরবিন্দের মতে—“বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয়তাবাদী কর্মে ধর্মীয় চেতনার সঞ্চার করেন।আধ্যাত্মিক জাতীয়তাবাদই (religion of patriotism’) হল বঙ্কিমচন্দ্রের রচনার প্রধান। উপজীব্য বিষয়।…এই (ধর্মীয়) চিন্তাই হল সমগ্র ‘আনন্দ মঠ উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু। (বন্দেমাতরম, ১৬.৪.১৯০৭)।”২৫
কবি ও সমালোচক মােহিতলাল মজুমদারের মতে- “ভারতের সেই প্রাচীন ধর্মতত্ত্বকেই ভিত্তি করিয়া বঙ্কিমচন্দ্র যে নবধর্ম প্রণয়ন করিয়াছিলেন—তাহার দৃঢ়তম খিলান হইল এই দেশপ্রীতি। …ভারতীয় ধর্মের অঙ্গীকৃত করিয়া এই স্বদেশপ্রীতিকে এতবড় স্থান দিবার কল্পনাও পূর্বে কেহ করে নাই।২৬
নবোন্মোষিত জাতীয়তার দিনে ভারত ইতিহাস বঙ্কিমচন্দ্র মহাপ্রতিভাধর এক অন্যন্য- সাধারণ নায়ক। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সকল ধারা ও চেতনার পূর্ণ বিকাশ তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়—বহুলাংশে তিনি নিজেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা। পরাধীনতার নাগপাশে জর্জরিত হৃতসর্বস্ব ভারতবর্ষের মাতৃরূপ প্রতিষ্ঠিত করে দেশবাসীকে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানান, দেশবাসীর মনে দেশের অতীত গৌরববােধ জাগ্রত করে দেশবাসীকে স্বাবলম্বন ও আত্মবিশ্বাসের শিক্ষা দেন, প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি দেশবাসীকে শ্রদ্ধাশীল করে তুলে বলেন যে, দেশপ্রেম ও ধর্ম এক এবং অভিন্ন—আপামর দেশবাসী স্বাজাত্যবােধে উদ্বুদ্ধ হলেই দেশমাতৃকার মুক্তি আসবে।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন—“বঙ্কিমবাবু যাহা কিছু করিয়াছেন, ইচ্ছায় করুন বা অনিচ্ছায় করুন, জানিয়া করুন বা না জানিয়া করুন—সব গিয়া এক পথে দাঁড়াইয়াছে। সে পথ জন্মভূমির উপাসনা—জন্মভূমিকে মা বলা—জন্মভূমিকে ভালবাসা—জন্মভূমিকে ভক্তি করা। তিনি এই যে কাৰ্য্য করিয়াছে ইহা ভারতবর্ষের আর কেহ করে নাই।সুতরাং তিনি আমাদের পূজ্য, তিনি আমাদের নমস্য, তিনি আমাদের আচাৰ্য, তিনি আমাদের ঋষি, তিনি আমাদের মন্ত্ৰকৃৎ, তিনি আমাদের মন্ত্রদ্রষ্টা। সে মন্ত্র বন্দে মাতরম্।”২৭
মনীষী হীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতে ‘আনন্দমঠ’- বঙ্কিমচন্দ্রের স্বাজাত্যবােধ ও স্বদেশানুরাগের মহোজ্জ্বল মূর্তি। ”২৮ তাঁর মতে সমগ্র ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাসটি মহোজ্জ্বল স্বাজাত্যবোধের ঝঙ্কারে মুখরিত’ এবং ‘অতুল্য স্বদেশানুরাগের সুষমায় মণ্ডিত।২৯ বঙ্কিমচন্দ্রকে তিনি “The real Father of Indian Nationalism’ বা স্বাজাত্যবোধের আদ্যাচার্য’ অভিধায় ভূষিত করেছেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ও তাকে “ভারতের নব জাতীয়তার ঋষি’ বলে চিহ্নিত করেছেন।”৩০
আজ ভারতীয় স্বাধীনতার ৭৫ বছরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে দেশের সাধারণ মানুষের একাংশের মাঝে জাতীয়তাবাদকে উপেক্ষা করার যে প্রবণতা দেখা দিচ্ছে, বিদেশী শত্রুর উদ্দেশ্য প্রণোদিত অঙ্গুলিহেলনে দেশের আভ্যন্তরীণ শান্তি বিঘ্নিত হয়ার মুখে বার বার পড়ছে সেখানে একমাত্র সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেম মূলক সৃষ্টি ও তাঁর জীবনচরিত দেশের অখন্ডতা, দেশপ্রেমের সম্যক ধারণা কে নতুন করে সমগ্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরলে আপামর ভারত বাসীকে উজ্জিবীত করা যাবে এ কথা বলাই বাহুল্য।
তথ্যসূত্রঃ
১। যোগেশ চন্দ্র বাগল, বাংলার জনশিক্ষা।
২। পোদ্দার অরবিন্দ, বঙ্কিম মানস। ইন্ডিয়ানা লিমিটেড,২/১ শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট। কলিকাতা-১২, পৃ-১৭৫
৩।ঐ , পৃ-১৭৫।
৪। ঐ, পৃ-১৭৬।
৫। ঐ, পৃ-১৭৬।
৬। ঐ, পৃ-১৭৬।
৭। ঐ, পৃ-১৭৭।
৮। ঐ, পৃ-১৭৭।
৯। ঐ, পৃ-১৭৭।
১০। অমৃতবাজার পত্রিকা ২৩ শে অক্টোবর ১৮৭৩।
১১। চট্টোপাধ্যায় সুধাকর,মহামানব জাতক, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স। ২০৩/১/১, কর্ণওয়ালিস ষ্ট্রীট, কলিকাতা।
১২। দাশগুপ্ত হেমেন্দ্রনাথ। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র।
১৩। অমৃতবাজার পত্রিকা ৮ ই জানুয়ারী।
১৪। দাশগুপ্ত হেমেন্দ্রনাথ। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র।
১৫।অমৃতবাজার পত্রিকা ১৫ ই জানুয়ারী।
১৬। শনিবারের চিঠি, বঙ্কিম সংখ্যা, সম্পাদনাঃসজনীকান্ত দাস,নাথ পাব্লিশিং,১৯৯৯,পৃ-৫৮-৫৯।
১৭। চট্টোপাধ্যায় বিজয়লাল, মুক্তি পাগল বঙ্কিমচন্দ্র পৃ-১১।
১৮।ঐ। পৃ-১১।
১৯। ঐ পৃ-১২।
২০। ঐ -পৃ-১২।
২১। Three years in Europe- সমালোচনা, বঙ্গদর্শন, ১২৭৯।
২২। আনন্দমঠ ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ- ডঃ জীবন মুখোপাধ্যায়,দ্বিতীয় সংস্করণ ১৫ইনভেম্বর,২০১০, ,পৃ-৭৩।
২৩। Studies in Bengal Renaissance, Edited by Atul Chandra Gupta, Second Revised and enlarged edition 1977.p189. এবং History of the Freedom movement in India.VOL. I, R.C.Majumdar, 1962, P.364.
২৪। আনন্দমঠ ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ- ডঃ জীবন মুখোপাধ্যায়, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৫ইনভেম্বর,২০১০, পৃ-৭৬।
২৫। “….. he pereceived the the third element of moral strength must be the infusion of religious feeling into patriotic work.The religion of patroitism,-this is the master idea of Bankim’s writings.”- Bankim-Tilak-Dayananda, Sri Aurobindo, Pondicherry,1955,P-11.
২৬।মজুমদার মোহিতলাল, বঙ্কিম বরণ,১৩৮৫, পৃ-৩৭।
২৭। বঙ্কিম প্রসঙ্গ , সুরেশ চন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত,১৯২২,পৃ-১৭৩।
২৮। দত্ত হীরেন্দ্রনাথ , দার্শনিক বঙ্কিমচন্দ্র, ১৩৪৭,পৃ-২২২।
২৯। ঐ ।
৩০। বঙ্কিম প্রতিভা ,বিমল চন্দ্র সিংহ সম্পাদিত,১৩৪৫,পৃ-২।
(লেখক হলেন গবেষক, মুর্শিদাবাদ জেলা ইতিহাস ও সংস্কৃতি কেন্দ্র এবং এমএ (বাংলা বিভাগ) রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। মতামত এবং বিশ্লেষণ লেখকদের নিজস্ব)।