সাম্প্রতিক বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সনাতনীদের উপর ধারাবাহিক হামলা ও অত্যাচারের সব সীমা অতিক্রম করেছে, সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণদাস প্রভুকে গ্রেপ্তার ও জেল বন্দীর ঘটনা। জাতীয় পতাকার অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তারের গাজোয়ারি শুধু অন্যায় নয়, নগ্নভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত। অথচ এই দেশটার সংখ্যাগুরু নাগরিক যারা ধর্মেও সংখ্যাগুরু, মনে করেন তাঁরা আগে মুসলিম পরে বাংলাদেশী, আগে ধর্ম পরে দেশ। জাতীয় পতাকার উপর বসে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়, দেশের পতাকা পাতিয়ে তাতে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের খানাপিনার জমজমাট আসর বাংলাদেশের এক পরিচিত দৃশ্য। সনাতনীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ও সমাবেশে গেরুয়া ধ্বজ রেখে জাতীয় পতাকা অবমাননার বিএনপির অভিযোগ যে সম্পূর্ণ মিথ্যা তা এখন প্রমানিত। আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার মিথ্যা অভিযোগ এনে দেশের মিলিটারি ও পুলিশ প্রশাসনকে সংখ্যালঘু হিন্দুদের পেছনে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে, চলেছে ব্যাপক ধরপাকড় পুলিশি সন্ত্রাস ঘরবাড়ি ভাঙচুর গ্রেফতার। আইনজীবী হত্যার অভিযোগও যে কতটা পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা প্রমান হয় আদালত চত্বরের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আটক হওয়াদের ধর্মীয় পরিচয়ে। সেই ছ’জনের কেউই ধর্মে সনাতনী নয়, বরং তারা মুসলমান সম্প্রদায়ের। বাংলাদেশে ইস্কন সংগঠনকে অবৈধ ঘোষণা করার ষড়যন্ত্র ও চিন্ময় প্রভুর অন্যায় গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে-আন্দোলনের পরেই স্বাধীন বাংলাদেশে ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ করে রাখা সংখ্যালঘুরা তাদের পরিবার, পরিজন, বাড়ির উঠোন, ঘরের মেয়ে-মানুষ, তুলসির তলা, দুর্গা-মন্ডপ, কালী-বাড়ী আগলে চরম আতঙ্কে রাত জাগছে। প্রতিদিন ভাঙচুর হচ্ছে হাজার হাজার সংখ্যালঘু ঘর-বাড়ি। আগুন জ্বলছে হিন্দু পাড়ায়, ভেঙে দেওয়া হয়েছে মন্দির, ভগবানের উঠোন। আগেই পুড়ে শেষ হয়ে গেছে বাংলাদেশের গর্বের জাতীয় সংগ্রহশালা। সাড়ম্বরে ইফতার পার্টি দেওয়া হিন্দু সংগঠন ইস্কন, সেই রোজা পালনকারীদের হাতেই মৃত্যুর প্রহর গুনছে আজ। আগেই ধ্বংসাবশেষে পরিনত হয়েছে জয়নুল আবেদীনের ভাস্কর্য। যাদের নেতৃত্বে ও আস্কারায় আজ এই গনহত্যার জতুগৃহ তৈরী হয়েছে, তাদের অগ্রমুখ ‘আন্দোলনকারী ছাত্র’দের লুট করা হাঁস, মাছ, ছাগল, চেয়ার, টেবিল, ফুলের টপ, ব্লাউজ, অন্তরবাস নিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে অভূতপূর্ব উল্লাস অবাক বিষ্ময়ের লক্ষ্য করেছে গোটা বিশ্ব। এতকিছুর পরও বাংলাদেশের সনাতনী নির্মূলীকরণে সক্রিয় রাষ্ট্রীয় আয়োজন যজ্ঞের নিরাপদ দূরত্বের প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ কিংবা দেশ ভারতের, একটি স্বাধীন দেশের ‘অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি’ নিয়ে ‘উদ্বিগ্ন’ হওয়ার সত্যিই কি কিছুই নেই? বরং আছে এক সীমাহীন আতঙ্ক, যা শুধু বাঙালি নয়, শুধু ভারতীয় নয়, বিশ্ব মানবতার অস্তিত্ব জুড়ে।
বাংলদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ঠিক কিভাবে ভারতের আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে দিচ্ছে দিন দিন, সেটা বুঝে রাখাটা জরুরী। আওয়ামী শাসকের বিরুদ্ধে ‘কোটা বিরোধী’ আপাত ‘ছাত্র আন্দোলন’ কেন একাত্তরের স্বাধীনতা বিরোধী আন্দোলন হয়ে উঠলো? বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রমুখ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি যারা ভাঙলো, তারা কারা? একটা আলাদা দেশের ছাত্র আন্দোলন কি করে ও কেন ভারত বিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত হলো- “ছাত্ররা যদি রাজাকার / দেশটা তবে কার ইন্ডিয়ার?”, “ভারত যাদের মামা বাড়ি, বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি।” কাদের মদতে এবং ভবিষ্যতের কোন বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে আপাতত ছাত্র আন্দোলন প্রতিবেশী রাষ্ট্র বিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়? উদ্বিগ্নতা সেখানেই। ধর্মীয় উন্মাদনাকে একমাত্র লক্ষ্যতে পরিণত করা এবং ‘হিন্দু শূন্য বাংলাদেশ’ এজেন্ডাকে সফল করা বাংলাদেশের শাসক ও মৌলবাদীদের দীর্ঘদিনের এক ঐতিহাসিক পরম্পরা। যাদের এ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা আছে, এই ঘটনায় তারা উদ্বিগ্ন হবেন নিশ্চিত।
না কোন অর্থে দাঙ্গা বা Riot নয় এটি, বরং একতরফা হিংসা আক্রমণ বা Pogrom। বাংলাদেশের সামগ্রিক ব্যবস্থাকে একেবারে নিজেদের কব্জায় রাখার জন্যপ্রায় চোদ্দ বছর ধরে নিষিদ্ধ থাকা জামাতে ইসলামিকে নতুন করে সক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে। জেল থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে হত্যা-ধর্ষণ-সন্ত্রাসে অভিযুক্ত জেল বন্দি অপরাধীদের। রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার ইসলামিক উন্মাদ ফতোয়ার এই জামাতে ইসলামি, বোকা জনগণের উচ্চকিত কন্ঠে “আমার সোনার বাংলা” সুরের পেছনে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ শূন্য, সঙ্গীতহীন, শিল্পহীন, ভাস্কর্যহীন ইসলামিক রাষ্ট্র তৈরীর ঘুঁটি সাজিয়েছে। হিন্দু হত্যাযজ্ঞের এই ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হচ্ছে, কিছু জায়গায় ‘সম্প্রীতির নিদর্শন’ রেখে কেউ কেউ নাকি পাহারা দিচ্ছিলেন মন্দির, বৌদ্ধমঠ। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে কিছু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ ঠিক কাদের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন মন্দিরগুলোকে, তাদের ধর্ম পরিচয় কী? অথচ আজ যাদের বাড়িঘর লুট হচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে ঠাকুরবাড়ির দালান, ধর্ষিত হচ্ছেন বাড়ির মা-বোন- তারাও বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র আন্দোলনের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে সমবেত কণ্ঠে গেয়েছেন দেশের জাতীয় সংগীত, জেলে গেছেন, পুলিশের নির্মম অত্যাচার সহ্য করেছেন, রক্ত ঢেলে দিয়েছেন ‘ধর্মীয় নিপিড়নহীন’ এক স্বাধীন দেশের আকাঙ্ক্ষায়। ঠিক যেমন ১৯৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলনে এদেরই পূর্বপুরুষদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। অথচ ইতিহাসের নির্মম পরিহাসে স্বাধীন দেশে এদেরই লুঠ হয়েছে কয়েক কোটি বাড়ি, ধর্ষিত হয়েছেন অগণিত নারী। ৫ কোটির বেশি হিন্দু উদ্বাস্তু হয়ে, বাপ-ঠাকুরদার ভিটে ছেড়ে প্রাণভয়ে পরদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। আজও ঠিক তেমনি ধর্ম ও প্রাণ বাঁচানোর কঠিন ও নির্মম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের কয়েক কোটি সংখ্যালঘু হিন্দু। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর একতরফা এই আক্রমণ-হত্যা-ধর্ষণের একটি বিস্তৃত ও পর্যায়ক্রমিক পরম্পরা রয়েছে।
১৯৪৬ সালের ১০ই অক্টোবরের কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার রাতে নোয়াখালীতে হিন্দু শূণ্য পূর্ববঙ্গ তৈরীর উদ্দেশ্যে লাখো লাখো হিন্দু গৃহহীন ও ভিটেহীন হয়েছিলেন। দাঙ্গার বীভৎসতা এমনই ছিল, সুচেতা কৃপালিনীকে নিয়ে গান্ধীজি’র নোয়াখালী যাত্রাকালে সুচেতা কৃপালিনি স্বয়ং ধর্ষিত হয়ে যাবেন এই আশঙ্কায় পটাশিয়াম সায়ানাইডের ট্যাবলেট সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন। ১৯৪৯ এর আগস্ট থেকে ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত পাকিস্তানিদের হাতে ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, সিলেট, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও যশোর ৫ লক্ষ হিন্দু খুন হয়, দেশ ছাড়া হয় তারও কয়েক গুন (প্রায় ৪৫ লক্ষ)। ১৯৬৪ সালে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে হযরতবাল তীর্থক্ষেত্রে হযরত মহম্মদের সংরক্ষিত চুল চুরি হয়েছে এই অজুহাতে বাঙালি হিন্দুদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার নারকীয় হত্যা লীলা চলে বাংলাদেশ জুড়ে। ঐতিহাসিক ১৯৭১। সময়কাল ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ থেকে ওই বছরের ১৬ই ডিসেম্বর। পাকিস্থানের সশস্ত্র বাহিনী, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস ও জামাতে ইসলামির টার্গেট ছিল মূলত বাঙালি হিন্দু। খুন হয়েছিল ৩ লক্ষ বাঙালি, ধর্ষিত হয়েছিল ৪ লক্ষ নারী এবং উদবাস্তু হয়েছিলেন ৩ কোটি হিন্দু। ২০০১ থেকে ২০০৬ এর খালেদা জিয়া সরকারের শাসন এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লিগ সরকারের আমালে বারবার টার্গেট হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়। জমি দখল, হত্যা, ধর্মান্তকরণ প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশকে ‘হিন্দু শূন্য’ করার এই লক্ষ্য নিয়ে যারা নিরবচ্ছিন্নভাবে হিন্দুদের আক্রমণ করেছে, হত্যা-খুন-সন্ত্রাস চালিয়েছে তারাও একটি আদর্শে (কোরআন) অনুপ্রাণিত- “তারা ইসলামীয় কর্তব্য সম্পাদন করছে এবং পুরস্কার হিসেবে তারা জান্নাতে যাবে এবং ‘হুর’ (আনত নয়না অনাঘ্রাতা মেয়ে, যৌনসঙ্গমের জন্য) উপভোগ করা সুযোগ পাবে।” তেমনি ভাবে আপাতত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী বামপন্থী, যারা চুপ থেকে পরোক্ষভাবে এই হিংসা কাণ্ডে সমর্থন দিচ্ছে তারাও একটি আদর্শে অনুপ্রাণিত। তারা মনে করেন, “এ-বিশ্বে সব লড়াই অর্থনৈতিক লড়াই, শাসকের বিরুদ্ধে শোষিতের লড়াই।” এ কেবল মিথ্যাচার নয়, বরং ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতা লিপ্সার নৃশংস অস্ত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারাকাত তাঁর ‘দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব রিফর্মিং এগ্রিকালচার: ল্যান্ড ওয়াটার বডিজ্ ইন বাংলাদেশ’ (২০১৬) বইয়ে সাবধান বাণী দিয়েছেন অনেক আগেই- “৩০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে আর কোনো হিন্দু অবশিষ্ট থাকবে না… গত ৪৯ বছর সেই দিক নির্দেশ করে।” সাম্প্রতিক বাংলাদেশের গতিপ্রকৃতি সেই আশঙ্কাকেই আরো দৃঢ় করেছে। অধ্যাপক বারাকাত পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছেন যে, ১৯৬৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে প্রায় ১১.৩ মিলিয়ন হিন্দু বাংলাদেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। অথচ এ দেশের কমিউনিস্ট ভেগধারী ধর্মনিরপেক্ষ মুখোশধারীরা নিশ্চুপ।
ধান্ধাবাজ ধর্ম ব্যবসায়ী মানবতা বিরোধী আপাত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার সময় নয় এখন। নয় একটা স্বাধীন দেশের তদারকি সরকারের প্রধানের রাজধর্ম পালনের প্রতিশ্রুতি পেয়ে চুপ করে বসে থাকার। সময় এটা নয় নিরপেক্ষতার নামে নিজের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার। নয় এটা প্রকৃত সমস্যা থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করে নপুংসকদের ইতিহাসে নাম লেখাবার। বরং আরও বেশি করে দায়িত্ব নেওয়ার সময় এটা, বিশেষ করে এপার বাংলার। কারণ প্রতিবেশীর এই হিংসার আঁচ পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগবে না তার যাপনে। দুই প্রতিবেশী যে একই ভাষায় কথা বলে, গান গায়, খিস্তি দেয়, চিৎকার করে। স্লোগানের সুরও বাঁধে একই ভাষায়।
এরপরও একদল আপাত শিক্ষিত-বুদ্ধিজীবী পরোক্ষভাবে এই ভয়ঙ্কর হত্যাকান্ডে নির্লজ্জ মদত যোগাচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতার গোল গোল বুলি আউড়ে বীভৎসতা থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। নাস্তিকতার দিশাহীন ও বিভ্রান্তিকর প্রচার করে বরাবরের মতো ফায়দা নেওয়ার মতলব করছে। আবার কেউ কেউ তো বিষয়টাকে লঘু করার জন্য নিজের দেশ ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক ভূমিকাকে ছোট করে দেখানোর প্রতিযোগিতা শুরু করেছেন। এরাই পরিস্থিতির প্রকৃত ইতিহাস ভুলিয়ে, আরও অসংখ্য দাঙ্গা সম্ভাবনা ও সম্প্রীতির অন্ধকার ভবিষ্যৎ তৈরির বিকৃত মানসিকতার প্রধান নেতা। কারণ ভারতবর্ষ গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষতার যে উজ্জ্বলতম পরম্পরা বহন করে এসেছে তা এদের অজানা নয়, অজানা নয় যে দেশভাগ কেবল ধর্মের ভিত্তিতে হয়েছে। ভুলিয়ে দিতে চাইছে, এই সকল খুন-হত্যা-ধর্ষণ-উদবাস্তুর কারণ যে একমাত্র ধর্ম ও ইসলাম আগ্রাসন। আজ বরং সেই ইতিহাস খুঁজে দেখা দরকার, কেন দেশভাগের পর যত ভাগ মানুষ পশ্চিম পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে এ-দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে, তার এক’শ ভাগের এক ভাগও পশ্চিমবঙ্গ থেকে ওই দেশে যায়নি! কেন বাংলার শিল্প-সাহিত্য-ইতিহাস চর্চায় পরিকল্পিতভাবে দেশভাগের প্রকৃত ইতিহাস চেপে যাওয়া হয়েছে? বাংলা সাহিত্যে সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ কিংবা ঋত্বিক ঘটক প্রমুখরা উদ্বাস্তু যন্ত্রণা যতটা দেখিয়েছেন, তার এক খন্ড প্রচেষ্টাও দেশভাগের প্রকৃত কারণে পৌঁছানোয় করেননি!
ধর্মকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা নেতাদের চোখে চোখ রেখে এখনই প্রশ্ন করা প্রয়োজন কেন ১৯৪১ সালের অধুনা বাংলাদেশের ২৮ শতাংশ হিন্দু কমতে কমতে ২০২৪-এ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭.২ শতাংশে? কেন স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় ৫ কোটি হিন্দু বিতাড়িত নিজের জন্মস্থান, নিজের রাষ্ট্র থেকে- কেবলমাত্র ধর্মীয় হিংসার কারণে? কেন এপার বাংলায় ১৯৫১ সালে ১৯ শতাংশ মুসলমান আজ বাড়তে বাড়তে আজ ৩৫ শতাংশে? বোঝা যাবে কেন মুসলমানদের দ্বারা অত্যাচারিত ও কিছু ক্ষেত্রে ধর্ষিত হয়ে পালিয়ে আসা বাঙাল কমিউনিস্ট নেতারা বর্বরোচিত সন্ত্রাস-ধর্ষণের একটাও প্রতিবাদ করেননি কোনদিন। বরং ইসলাম আগ্রাসন ও খুনের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া তসলিমা নাসরিনকে অন্যায়ভাবে বাংলাদেশ যখন বিতাড়িত করেছে, তখন তাঁর প্রিয় শহর কলকাতায় সামান্য আশ্রয়টুকুও দেয়নি ক্ষমতাসীন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বামফ্রন্ট। বোঝা যাবে কেন, এই নারকীয় হত্যায় অভিযুক্ত এযাবৎ একজন মুসলমানকেও শাস্তি দেয়নি বাংলাদেশ প্রশাসন। বরং হাজার হাজার সেইসব মানুষের ‘শাস্তি’ হয়েছে যারা সংখ্যালঘু আক্রমণের প্রতিবাদে পথে নেমেছেন, কলম ধরেছেন, গান গেয়েছেন। দেশছাড়া হয়েছেন শাহরিয়ার কবীর, পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত হয়েছে ‘ভাঙা মঠ’ উপন্যাসের লেখক সালাম আজাদের। খুন হয়েছেন ফয়জাল আরেফিন দীপন, বিজ্ঞানী অভিজিৎ রায়, ওয়াসিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাস, নীলাদ্রি নীলসহ কতশত কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী।
বাংলাদেশ জুড়ে হিন্দু হত্যা ও সনাতনী আন্দোলনের অগ্রমুখ চিন্ময় মহারাজ প্রভুর এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ কোন মুসলমান বিদ্বেষ নয়। বরং ইসলামিক আগ্রাসনের যে চাপা আগুন সংখ্যালঘু হিন্দুদের ভিতর ধিক্ ধিক্ করে জ্বলছে তাকে প্রতিহত করার একমাত্র প্রক্রিয়া, হিন্দুদের অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে যারা রাজনৈতিক অভিসন্ধি তৈরি করতে ব্যস্ত তাদেরকে প্রতিহত করা। এই প্রতিবাদ মানে ধর্মীয় মেরুকরণ নয়, বরং ভারত সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধর্মীয় মেরুকরণের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করার একটি গণতান্ত্রিক উদ্যোগ। আর বিশ্ব হিন্দুর একজোট হওয়ার প্রাসঙ্গিক আহ্বান। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, রংপুর, ঢাকা প্রভৃতি এলাকার জুড়ে লাখো লাখো হিন্দু সনাতনীর স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলন ইসলাম আগ্রাসনের বিপ্রতিপে জ্বলন্ত এক মশাল হয়ে জেগে উঠুক। বিস্তৃত হোক সনাতনীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, তাদের বেঁচে থাকার প্রতিজ্ঞা।