Dr. Syama Prasad Mookerjee Research Foundation

আচার্য রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী এবং লোকসংস্কৃতি ও তাঁর গদ্য বৈশিষ্ট্য

রবীন্দ্র সমসাময়িক প্রাবন্ধিকদের মধ্যে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী অন্যতম। বৈজ্ঞানিক মনন ও চিন্তাভাবনার বিশিষ্ট প্রকাশ রামেন্দ্রসুন্দরের প্রবন্ধের মধ্যে। তাঁর পূর্বে অক্ষয়কুমার, বঙ্কিমচন্দ্র, স্বর্ণকুমার দেবী বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ রচনা করলেও রামেন্দ্রসুন্দর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে অনেক বেশি গভীরতার পরিচয় রেখেছেন। শুধু বিজ্ঞান নয়, দর্শন, ধর্ম, সমাজ, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্য সজ্জিত। সেকালের শিক্ষিত বাঙালি মানসিকতার বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রবণতা রামেন্দ্রসুন্দরের প্রবন্ধে স্থান পেয়েছে। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি তাঁর মধ্যে ‘দর্শনের গঙ্গা, বিজ্ঞানের সরস্বতী ও সাহিত্যের যমুনার’ ত্রিবেণী সঙ্গম লক্ষ করেছেন।

‘নবপর্যায় বঙ্গদর্শনের’ শুরুতেই রামেন্দ্রসুন্দর রবীন্দ্রনাথের মতো যুগধর্মের ব্যাখ্যায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রকৃত স্বরূপ বিশ্লেষণে, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য সন্ধানে, সমকালীন রাষ্ট্রিক ও সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে শিক্ষাসংস্কৃতির ও রীতিনীতির আলোচনায়, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আদর্শগত পার্থক্য ও জাতীয়তাবোধের স্বরূপ প্রভৃতি বিষয়ে রামেন্দ্রসুন্দরের প্রবন্ধ সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। সমাজ ও সংস্কৃতির আলোচনায় তিনি ইওরোপ ও ভারতের মূল প্রবণতার দিকটি উপস্থাপিত করেছেন।

জন্ম-:
মুর্শিদাবাদ জেলার শক্তিপুরের কাছে টেয়া-বৈদ্যপুরগ্রামে রামেন্দ্রসুন্দর জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে। শৈশবকাল থেকেই রামেন্দ্রসুন্দর লেখাপড়ায় কৃতিত্বের পরিচয় রেখেছিলেন। কোন পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন নি, সর্বত্রই তিনি প্রথম স্থান পেয়েছেন। কর্মজীবনে তিনি রিপন কলেজের অধ্যাপক ও পরে অধ্যক্ষ হিসেবে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। বিজ্ঞানের যুক্তিবোধ, দর্শনের সত্যনিষ্ঠা এবং আবেগহীন জাতীয়তাবোধ এই তিনের সমন্বয়ে গঠিত ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

লোক সাহিত্য ও সংস্কৃতি :-

বাংলা সাহিত্যে লোক সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে সময় ও ব্যক্তিত্ব বিচারের মানদণ্ডে রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই সর্বাগ্রগণ্য। যদিও প্রাক রবীন্দ্রযুগে রেভারেন্ড উইলিয়াম মর্টন (১৮০২) রেভারেন্ড জেমস লঙ (১৮৬৮) স্যার জর্জ গ্রেয়ারসন (১৮৭৩) রেভারেন্ড লালবিহারী দে (১৮৭২) প্রভৃতি শ্রুতকীর্তি লোকসংস্কৃতিবিদগণ বৃহৎ বঙ্গে লোক সংস্কৃতির সূচনা করেন। একাজের পেছনে ছিল তাঁদের মিশনারী স্পিরিট! এর পরই বাংলার লোকসংস্কৃতিচর্চার সময়কালকে রবীন্দ্রযুগ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর ২২ বছর বয়সে ‘ভারতী’ পত্রিকায় ‘বাউলের গান’ শীর্ষক আলোচনার মধ্য দিয়ে তাঁর লোকসংস্কৃতিচর্চার সূচনা করেন। ১৮৯০-৯৪ সময়কালের মধ্যে তিনি কলকাতার আশেপাশে থেকে ছড়া ও গ্রাম্য সাহিত্যের উপকরণ সংগ্রহে ব্রতী হন। ১৩০১ বঙ্গ াব্দে তিনি ছেলে ভুলানো ছড়া সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন। এ কাজে অভিজাত পরিবারের কুল রমণীদের এমনকি নিজের স্ত্রীকেও সে কাজে নিয়োজিত করেছিলেন।

লোকসাহিত্য:

১৩০১ বঙ্গাব্দে তিনি ছেলে ভুলানো ছড়া প্রবন্ধটি লেখেন “লোকসাহিত্য” নাম দিয়ে ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দে একটি পুস্তক প্রকাশ করেন। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের ‘লোকসাহিত্য’ আধুনিক বাংলা লোকসাহিত্য গবেষণার ও চর্চার ভিত্তিস্থাপন করেছিল। পরে রবীন্দ্রনাথ জমিদারির কাজে নদীয়ার কুষ্ঠিয়ায় শিলাইদহে (১৮৯১-১৯০১) প্রায় এক দশক অতিবাহিত করেন। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবতঃ সর্বপ্রথম লালনের ২০টি গান সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন। তিনি তাঁর কাব্যে, সঙ্গীতে ও ব্যক্তি জীবনে বাউল তত্ত্ব ও দর্শনের উপর গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

সমকালীন দিকপালবৃন্দ:

রবীন্দ্রনাথের বড় কৃতিত্ব তিনি একাই একাজে নামেননি। সমকালের কয়েকজন দিকপালকে একাজে ব্রতী করে তুলেছিলেন। অনেককে তিনি একাজে আহ্বান জানান তাঁর প্রেরণায় সাড়া দিয়ে ও উদ্বুদ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথের সমকালে গান ছড়া পালা পার্বণ এর বিবরণ সংগ্রহ পুরাতন মন্দির মসজিদের তথ্য সংগ্রহ, পুঁথি সংগ্রহের কাজে অনেকে আত্মনিয়োগ করেন। এ বিষয়ে বিদ্যজন সমাজে আগ্রহ ও উদ্দীপনা দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং লোক সাহিত্য ও সঙ্গীতের গুরুত্ব গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই সে সময় প্রবাদ ও লোককথা সংগ্রহের মধ্য দিয়ে এই চর্চা সম্প্রসারিত হয়।

তিনি ছড়া সংগ্রহ, লোকসঙ্গীত চর্চাকে ও মেয়েলী ব্রতকথা সংগ্রহের কাজকে অনুপ্রাণিত করলেন ও লোকসংস্কৃতি চর্চার জন্য একটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এ বিষয়ে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন। এবং প্রধানত তাঁর উদ্যোগে ও কাশিমবাজার রাজ পরিবারের মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর বদান্যতায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মত একটি সারস্বত প্রতিষ্ঠানের সূচনা হয় (১৮৯৪)।

আমরা জানি ১৩০১ বঙ্গাব্দে বেঙ্গল একাডেমি এন্ড লিটারেচারই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে রূপান্তরিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল এই যে, আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর এই প্রতিষ্ঠানটির শুরু থেকে আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি প্রসারের আন্দোলনে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সৃষ্টি একটি উল্লেখ্য ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পুরাতত্ত্ব ও লোকসংস্কৃতিচর্চার সাংগঠনিক কেন্দ্র হয়ে উঠুক। সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় লোকসমাজ, প্রাচীন পুঁথিপত্র, পুরাতত্ত্ব ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ে অনেক মূল্যবান লেখাপ্রকাশিত হতে শুরু করে। আমাদের অবশ্যই স্মরণ রাখা দরকার, আচার্য্য রামেন্দ্রসুন্দর ১৩০৬-১৩১০ এবং ১৩২৪-২৫ সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এতদক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল সর্ব্বাগ্রগণ্য।

রবীন্দ্র সমসাময়িক তথা রবীন্দ্রযুগের বসন্ত রঞ্জন রায়, রজনীকান্ত গুপ্ত, কুঞ্জলাল রায়, অম্বিকা চরণ গুপ্ত, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, রামপ্রসাদ গুপ্ত, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, সরৎকুমারী চৌধুরানী, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়, আচার্য্য দীনেশ চন্দ্র সেন, গুরুসদয় দত্ত, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, আচার্য্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রভৃতি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক মণ্ডলীকে তিনি একাজে বৃত করে তোলেন। এবং এই জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর তিনি ছিলেন মধ্যমণি। এক্ষেত্রে আচার্য্য রামেন্দ্রসুন্দরের একটি বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল।

যদিও আমরা আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে একজন শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক ও স্বদেশপ্রেমী হিসেবে শ্রদ্ধা করি তবু তাঁর লোক সংস্কৃতি চর্চার দিকটাও যথাযথ মর্যাদায় উদ্‌ঘাটন করা উচিত। অধ্যাপক ডঃ সনৎকুমার মিত্র মহাশয় তাঁর লেখা রবীন্দ্রনাথের লোকসাহিত্য গ্রন্থে এ সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তা সবিশেষ অনুধাবনযোগ্য।

“রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯) ছিলেন পুরোপুরি বিজ্ঞানের ছাত্র। কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি যে স্পৃহা ও শক্তি প্রদর্শন করেছিলেন তা যেন কোন প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যিকের পক্ষেই অন্তরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম কিন্তু তার এই সাহিত্যকৃতির অনেকখানি প্রচেষ্টা বাংলার লোক-সাহিত্য কর্মে ব্যয়িত হয়েছিল। এ আমাদের পক্ষে পরম সৌভাগ্য। তাঁর বিজ্ঞান বুদ্ধিজাত যুক্তিশৃঙ্খলা বাংলা সাহিত্যের এই শাখাকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছিল। ও তৎকালীন বিদ্যজনের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছিলেন।”

১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশিত হল তাঁর ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ (১৯০৫)। প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে বাঙালির অন্তপুরের বার-ব্রতকে অপূর্ব দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মিশিয়ে এই ছোট পুস্তিকাটি রচিত হয়েছিল।

এছাড়াও গুণগ্রাহী রামেন্দ্রসুন্দর এতদবিষয়ে কারো কোনো গুণের পরিচয় পেলে নানাভাবে সেই গুণের উৎসাহ দিতেন। ১৩০৬ সালের আষাঢ়ে লিখেছিলেন যোগীন্দ্রনাথ সরকারের লিখিত ‘খুকুমনির ছড়া’ গ্রন্থের এক দীর্ঘ ভূমিকা। এই ভূমিকায় তিনি বাংলার চির নতুন অথচ চির পুরাতন ছড়াগুলির সমাজতত্ত্ব ও রসের দিক থেকে যে বিচার করলেন তার তাৎপর্য আজও আমাদের কাছে মূল্যবান হয়ে আছে। ১৩১৯ সনে পাঁচথুপি রায়জীবাড়ির জমিদার পূর্ণানন্দ ঘোষ রায়ের পত্নী কিরণবালা ঘোষ রায়ের লিখিত ব্রতকথার ভূমিকাও তিনি লিখেছিলেন। যদিও সে ব্রতকথাটি গুণেমানে উল্লেখনীয় ছিল না। এর কিছুদিন আগে ১৩১৪ বঙ্গাব্দে কান্দি অঞ্চলে ক্ষেত্র গবেষণাভিত্তিক অতি মূল্যবান একটি প্রবন্ধ লেখেন ‘গ্রাম দেবতা’ নামে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায়। এইভাবে রামেন্দ্রসুন্দর বাংলার লোক-ঐতিহ্য ও লোকসাহিত্যকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে বাঙালির সংস্কৃতির শিকড় সন্ধানে ব্রতী হলেন। নিজ পরিবেশ ও পরিজনদের কাছ থেকে অনেকেই লোকসংস্কৃতির উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে থাকাকালীন সময়ে লালন ফকিরের অনেক গান সংগ্রহ করেছিলেন। রবীন্দ্র সংগীতের অনেক সুরেই আছে বাউল সংগীতের সুর।

আচার্য রামেন্দ্রসুন্দরও ঠিক তাই তাঁর পরিচিত পরিবার ও পরিজনদের কাছ থেকে তাঁর লোক সংস্কৃতি চর্চার অনেক উপকরণ সংগ্রহ করতেন। রামেন্দ্র দুহিতা চঞ্চলা দেবীর বাঘডাঙ্গাস্ত বাসভবনে গিয়ে জেনেছি-রামেন্দ্রসুন্দর তাঁর বাড়ির কাজের লোকদের কাছ থেকে সাগ্রহে তাদের ভাষা, আচার, আচরণ প্রভৃতি সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহ করতেন। শুধু তাই নয় তাঁর লোক-ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগের সঙ্গে দেশানুরাগের অত্যাশ্চর্য সম্মিলন ঘটেছিল।

তাঁর পরিবারের মধ্যে এবং গ্রাম্য মহিলাবৃন্দের মধ্যে তা সার্থকভাবে সঞ্চারিত করেছিলেন তিনি। লোক সংস্কৃতির বিষয় ও আঙ্গিককে হাতিয়ার করে স্বদেশ সেবার এতবড় সার্থক পরীক্ষা তাঁর আগে আর কেউ করেননি। পরবর্তীকালে এই ধারার সার্থক অনুসারী ছিলেন-রাইবেশে লোকনৃত্য থেকে ব্রতচারী নৃত্যের প্রবর্তক গুরুসদয় দত্ত মহাশয়। কিন্তু সবদিক থেকে রামেন্দ্রসুন্দর ছিলেন ব্যতিক্রমী ও অনন্য সাধারণ। তাঁর রচিত ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত এই ব্রতকথাটি বঙ্গললনাদের গার্হস্থ্য সুখ-সমৃদ্ধি ও শান্তির প্রত্যাশায় মামুলি কিছু মেয়েলি কামনা বাসনা নয়, যে কামনা বাসনা দেবদেবী, পশুপক্ষী ইত্যাদিদের নিয়ে প্রচলিত ব্রতকথাতে মূর্ত হয়ে
ওঠে। বহুবিধ মেয়েলী ব্রতে এসব ব্রতকথা পাঠের রেওয়াজ আছে।

কিন্তু রামেন্দ্রসুন্দর রচিত এই ব্রতকথা দৃষ্টিভঙ্গী ও রচনা ভঙ্গীতে ছিল সম্পূর্ণ অভিনব ও নতুন। স্বাদেশীকতার উষ্ণ দীপ্তিতে উজ্জ্বল। অথচ রচনা-রীতি ও পরিবেশনার কৌশল ও ব্রতকথার উপস্থাপনা একেবারে প্রবহমান সনাতনী রীতিতে গৃহীত। দূরদর্শী রামেন্দ্রসুন্দর স্পষ্টত অনুভব করেছিলেন গৃহকর্মেসমর্পিত প্রাণা স্বাদেশীকতার আন্দোলনের বাইরে থাকা স্বামী, পুত্র, সংসারমুখী রমণীগণের মধ্যে যদি সার্থক ভাবে স্বদেশ প্রেমের প্রেরণা সঞ্চার করতে হয় তবে তাদের প্রিয় বিষয় তথা তাঁদের মধ্যে প্রচলিত ব্রতকথার আঙ্গিককে হাতিয়ার করেই তাদের মনের অন্দরে প্রবেশ করতে হবে। সে কারণে বঙ্গভঙ্গের সময় তার রচিত ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ জনশ্রুতির মহিমা লাভকরেছিল। ১৩১২ বঙ্গাব্দে পৌষ মাসে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ব্রতকথাটি মুদ্রিত হয়েছিল। পরে পুস্তকাকারে ১৯০৬ সনের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়। রামেন্দ্রসুন্দর রচনা সমগ্র প্রথম খণ্ড ড. বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মহাশয় সম্পাদনা করেছিলেন। (১৩৮২) ওই পুস্তকের ভূমিকায় ড. ভট্টাচার্য লেখেন (৮ই এপ্রিল ১৯৭৫),
“বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ রামেন্দ্র সাহিত্যের এক বিশিষ্ট নিদর্শন। স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি রামেন্দ্রসুন্দরের ভালবাসা যে কত আন্তরিক ছিল, এ থেকে তার প্রমাণ মেলে। ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ রচনার সঙ্গে রামেন্দ্র সুন্দরের জন্মস্থান জেমো কান্দি জড়িত। আর জড়িত বঙ্গ ব্যবচ্ছেদের দিন অপরাহ্নে জেমো কান্দি গ্রামের পাঁচ শতাধিক নরনারী। রামেন্দ্র সুন্দরের মায়ের আহ্বানে তাঁদের বাড়ির বিষ্ণুমন্দিরের আঙ্গিনায় সমবেত হয়েছিলেন তাঁরা। সেখানে রামেন্দ্রসুন্দরের কন্যা গিরিজা দেবী ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ পাঠ করেন। কী ভাষার প্রসাদগুণ কি ভাবনার অকৃত্রিমতা কি একনিষ্ঠ স্বাদেশিকতা সব দিক দিয়ে এই রচনাটি স্মরণীয়।”

“বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা
(১৯০৬ সনের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত)
উৎসর্গ
বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা বঙ্গের গৃহলক্ষ্মীদের করকমলে অর্পণ করিলাম। লেখক

ভূমিকা

গত পৌষের বঙ্গদর্শন হইতে বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা পুনর্মুদ্রিত হইল। বঙ্গ ব্যবচ্ছেদের দিন অপরাহ্নে জেমো-কান্দি গ্রামের অর্ধ সহস্রাধিক নরনারী আমার মাতৃদেবীর আহ্বানে আমাদের বাড়ির বিষ্ণুমন্দিরের উঠানে সমবেত হইয়াছিলেন। গ্রন্থোক্ত অনুষ্ঠানের পর আমার কন্যা শ্রীমতী গিরিজা কর্তৃক এই ব্রতকথা পঠিত হয়। বন্ধুবর্গের অনুরোধে ইহা পুস্তকাকারে প্রকাশ করিলাম।

সম্প্রতি এডুকেশেন গেজেটে ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ সংস্কৃত অনুবাদ বাহির হইতেছে দেখিয়া আনন্দিত হইলাম।

শ্রীরামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী

চৈত্র ১৩১২”

লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের আদেশ প্রচার করলে ১৩১২ সালে স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ হয়। কলকাতা এই আন্দোলনের উৎসকেন্দ্র ছিল। এই আন্দোলনের অভিঘাত মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি অঞ্চলেও প্রসারিত হয়েছিল। এই সময় পূজাবকাশে রামেন্দ্রসুন্দর তাঁর জেমো কান্দির বাসগৃহে আসেন। তাঁর প্রেরণায় এতদঅঞ্চলে দেশানুরাগের আন্দোলন প্রবাহিত হতে শুরু করে। পূজার পর চতুর্দশী তিথিতে বিপুল সমারোহে এক বিরাট জনতা শোভাযাত্রা করিয়া কান্দির দক্ষিণাকালী মন্দির অভিমুখে যাত্রা করে। ১লা নভেম্বর ঘোষণা প্রচারের দিন ওইরূপ বিরাট জনতা শোভাযাত্রা করিয়া ময়ূরাক্ষী নদীতীরের হোমতলায় সমবেত হয়েছিল। এসবের মূলে ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর। তাঁর ব্রতকথাটি তৎকন্যা গিরিজা কর্তৃক ৩০শে আশ্বিন বঙ্গভঙ্গের দিন পঠিত হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গের স্মৃতি জাগরুক রাখিবার জন্য ৩০ এ আশ্বিন দিবসে অরন্ধনের নিয়ম রামেন্দ্রসুন্দর প্রবর্তন করেছিলেন। আমরা তাঁর লিখিত ব্রতকথার কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি:-

“বন্দেমাতরম! বাঙলা নামে দেশ, তার উত্তরে হিমাচল, দক্ষিণে সাগর। মা গঙ্গা মর্তে নেমে নিজের মাটিতে এই দেশ গড়লেন। প্রয়াগ কাশী পার হয়ে মা পূর্ব বাহিনী হয়ে সেই দেশে প্রবেশ করলেন। প্রবেশ করে মা সেখানে শতমুখী হলেন। শতমুখী হয়ে মা সাগরে মিশলেন। তখন লক্ষ্মী এসে সেই শতমুখে অধিষ্ঠান করলেন। বাংলার দেবী বাংলাদেশ জুড়ে বসলেন। মাঠে মাঠে ধানের ক্ষেতে লক্ষ্মী বিরাজ করতে লাগলেন। ফলে ফুলে দেশ আলো হল। সরোবরে শতদল ফুটে উঠল। তাতে রাজ হংস খেলা করতে লাগল। লোকের গোলা ভরা ধান গোয়াল ভরা গরু, গালভরা হাসি হল। লোকে পরম সুখে বাসকরতে লাগল।”…

“১৩১২ সাল, আশ্বিন মাসের তিরিশ। সোমবার কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়া। সেদিন বড় দুর্দিন সেইদিন রাজার হুকুমে বাংলা দুভাগ হবে। দুভাগ দেখে বাংলার লক্ষ্মী বাঙলা ছেড়ে যাবে। পাঁচ কোটি বাঙালি আছাড় খেয়ে ভূমে গড়াগড়ি দিয়ে ডাকতে লাগল-মা, তুমি বাংলার লক্ষ্মী-তুমি বাংলা ছেড়ে যেয়ো না। আমাদের অপরাধ ক্ষমা কর। বিদেশী রাজা আমাদের সুখ দুঃখ বোঝেন না, তাই ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই করতে চাইলেন। আমরা ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই হব না; মা তুমি কৃপা কর আমরা এখন থেকে মানুষের মত মানুষ হব।”…

তিরিশে আশ্বিন, কোজাগরী পূর্ণিমার পর তৃতীয়া। পূর্ণিমার পূজা নিয়ে বাংলার লক্ষ্মী ওইদিন বাংলা ছাড়ছিলেন। ওইদিন বাংলার লক্ষ্মী বাংলায় অচলা হলেন। বাংলার হাট-মাঠ-ঘাট জুড়ে বসলেন। মাঠে মাঠে ধানের ক্ষেতে লক্ষ্মী বিরাজ করতে লাগলেন। ফলে ফুলে দেশ আলো হল।

সরোবরে শতদল ফুটে উঠল। তাতে রাজহংস খেলা করতে লাগল। লোকের গোলাভরা ধান গোয়ালভরা গরু, গালভরা হাসি হল।

বাংলার মেয়েরা ওইদিন বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রত নিলে। ঘরে ঘরে সেদিন উনুন জ্বলল না। হিন্দু মুসলমান ভাইভাই কোলাকুলি করলে। হাতে হাতে হলদে সুতোর রাখি বাঁধলে। ঘট পেতে বঙ্গলক্ষ্মীর কথা শুনলে। যে এই বঙ্গলক্ষ্মীর কথা শোনে, তার ঘরে লক্ষ্মী অচলা হন।

বচ্ছর বচ্ছর ওই দিনে বাঙালির মেয়েরা এই ব্রত নেবে। বাঙালির ঘরে ওইদিন উনুন জ্বলবে না। হাতে হাতে হলুদ সুতোর রাখি বাধবে বঙ্গলক্ষ্মীর কথা শুনে শাঁখ বাজিয়ে ঘটে প্রণাম করে বাতাসা পেটালি প্রসাদ পাবে। ঘরে ঘরে লক্ষ্মী অচলা হবেন। ঘরের লক্ষ্মী ঘরে থাকবেন।

বাঙলার লক্ষ্মী বাংলায় থাকবেন। সবাই বল-

আমরা ভাই ভাই একঠাই ভেদনাই ভেদনাই… মালক্ষ্মী কৃপা কর। কাঞ্চন দিয়ে কাঁচ নেবনা। শাঁখা থাকতে চুড়ি পড়ব না। ঘরের থাকতে পরের নেব না। পরের দুয়ারে ভিক্ষা করব না। ভিক্ষার ধন হাতে তুলব না। মোটা অন্ন ভোজন করব। মোটা বসন সঙ্গে নেব। মোটা ভূষণ আভরণ করব পড়শীকে খাইয়ে নিজে খাব। ভাইকে খাইয়ে পরে খাব। মোটা অন্ন অক্ষয় হোক। মোটা বস্ত্র অক্ষয় হোক। ঘরের লক্ষ্মী ঘরে থাকুন। বাঙলার লক্ষ্মী বাঙলায় থাকুন।

“বাংলার মাটি বাংলার জল

বাংলার বায়ু বাংলার ফল

পুন্য হউক পুন্য হউক পুন্য হউক হে ভগবান।

বাংলার ঘর বাংলার মাঠ

বাংলার বন, বাংলার হাট

পূর্ণ হউক পূর্ণ হউক

পূর্ণ হউক হে ভগবান।

বাঙালির পণ বাঙালির আশা

বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা।

সত্য হউক সত্য হউক

সত্য হউক হে ভগবান।

বাঙালির প্রাণ বাঙালির মন

বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন।

এক হউক এক হউক।

এক হউক হে ভগবান।

বন্দেমাতরম্।…”

অনুষ্ঠান:

প্রতি বৎসর আশ্বিনে বঙ্গ বিভাগের দিনে বঙ্গের গৃহিনীগণ বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রত অনুষ্ঠান করিবেন। সেদিন অরন্ধন। দেব সেবা ও রোগীর সেবা ব্যতিত অন্য উপলক্ষ্যে গৃহে উনুন জ্বালিবে না, ফলমূল চিড়ামুড়ি পূর্বদিনের রাঁধা ভাত ভোজন চলিবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।…””

ব্রতের সাথে সাথে ব্রতাচারের সঙ্গেও দেশানুরাগের সাযুজ্য ঘটালেন রামেন্দসুন্দর। রামেন্দ্র সুন্দরের এই ব্রতকথা মেয়েদের ঐহিক বা পারত্রিক কল্যাণ কামনা নয় এ ব্রত স্বদেশ অনুরাগের ব্রত যার সঙ্গে অন্তপুরের মহিলারাও যুক্ত হলেন। রামেন্দ্রসুন্দরের পক্ষে এ কৃতিত্ব সম্ভব। বঙ্গ লক্ষ্মীর এই ব্রতকথা অল্প শিক্ষিতা বঙ্গললনাদের জন্য সহজ, সাবলীল ও তরতরে ভাষায় লেখা। বিষয়বস্তু সহজবোধ্য ও আটপৌরে। লেখার প্রতিটি ছত্রে স্বদেশানুরাগের আবেগ মেশান। বঙ্গ লক্ষ্মীর ব্রতকথা আচার্য রামেন্দ্রসুন্দরের একটি ঐতিহাসিক কর্তব্য সম্পাদনের অত্যাশ্চর্য দৃষ্টান্ত।

তিনি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত কিরণবালা ঘোষ রায় এর ব্রতকথা ভূমিকা লিখেছিলেন এটি আমরা উল্লেখ করেছি এই ব্রতকথাটি ছিল মেয়েদের মধ্যে প্রচলিত আর পাঁচটি ব্রতকথার মত।

কিন্তু এই অঞ্চলের বিদুষী মহিলা পাঁচথুপি গ্রামের ছোট তরফের জমিদার মধুসুদন ঘোষ মৌলিকের পত্নী ইন্দুমতী দেবী অনেক আয়াসে এই অঞ্চলে প্রচলিত ব্রতকথাগুলিকে সংগ্রহ করে পুস্তকাকারে প্রকাশ করে একটি ঐতিহাসিক সাহিত্যকর্ম সম্পাদন করেছিলেন। তার লিখিত ‘বঙ্গ নারীর ব্রতকথা’ রাঢ় অঞ্চলের ফতেসিং অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে সংকলিত হয়েছিল। ১৯২৬ খৃঃ ২৬শে আগস্ট এই ব্রতকথাটি প্রকাশ করেন পাটনা হাইকোর্টের আইনজীবী ইন্দুমতী দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র বিভূতিভূষণ ঘোষ মৌলিক। ভূমিকা লেখেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহোদয়। তিনি তার মূল্যবান ভূমিকার একটি স্থানে লেখেন,

“স্বর্গীয় রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী মহোদয় বাঙালি মেয়েদের ব্রতকথা যাহাতে ছাপা হইয়া প্রকাশ হয় তাহার জন্য চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাহার দেহান্তের পর আর কেহ একাজে হাত দেন নাই। ইন্দুমতীর সংগ্রহ করা অনেকগুলি ব্রতকথা প্রচার করিয়াছেন। তাহার বাড়ি রামেন্দ্রবাবুর বাড়ির কাছেই।”

পরবর্তীকালে ইন্দুমতী দেবী লিখিত ব্রতকথাটি বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি মূল্যবান সংযোজন হিসেবে গণ্য হয় ও কিয়দংশ হাইনরিখ মোদে ও অরুণ রায় জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। ইন্দুমতী দেবী ব্যক্তিজীবনে এই আলোচকের প্রমাতামহী।

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মহাশয় যোগীন্দ্রনাথ সরকার মহাশয়ের ছড়া সংকলন ‘খুকুমণির ছড়া’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখলেন, (১৩০৬ সালের ৮ই আষাঢ়)।

“এই গ্রন্থের প্রকাশক মহাশয় যখন আমাকে এই ভূমিকা লিখিবার জন আহ্বান করেন তখন আমাদেরও কৃতজ্ঞতার সহিত আমি এই ভার বহন করি। আনন্দের কারণ আমি এইরূপ ছড়া সংগ্রহের অভাব অনুভব করিতেছিলাম। কৃতজ্ঞতার কারণ প্রকাশক মহাশয় সেই অভাব এত সত্ত্বরপূর্ণ করিতেছেন।’

কথাটা একটু খুলিয়া না বলিলে ছড়া সংগ্রহের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে। কিছুদিন হইতে অনন্য সাধারণ প্রতিভার অলংকৃত পরম শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় ঠিক এই জাতীয় কবিতা সংগ্রহের অভাব অত্যন্ত তীব্রভাবে অনুভব করিয়া আসিতেছেন। কয়েক বৎসর হইল তিনি প্রকাশ্য সভায় মেয়েলী ছড়া নামক একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। এই প্রসঙ্গে যে ভাবুকতা, সরলতা ও চিন্তাশীলতায় সহিত এই বিষয় আলোচিত হইয়াছে তাহা অন্যের পক্ষে অনুকরণের অতীত। এই প্রবন্ধটিকেই এই পুস্তকের ভূমিকা স্বরূপ গ্রহণ করিলে আমার নিরক্ত ওকালতি হইতে পাঠকগণ নিস্তার পাইতেন। রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধ পাঠেই ছিলেন না। তিনি স্বয়ং সংগ্রহ কার্যেও নিযুক্ত ছিলেন এবং তাহারই প্ররোচনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ত্রৈমাসিক পত্রিকায় কিছুদিন এই সংগ্রহ প্রকাশিত হইতে আরম্ভ হয়। কিন্তু কি কারণে জানি না কাজটা অধিক না হইয়া থামিয়া যায়।

সম্ভবত পরিষদ পত্রিকার পাঠক সম্প্রদায় অথবা পরিষদের পরিচালকগণ ছেলে ভুলানো ছড়ার সংগ্রহ তাহাদের মত প্রবীণ পণ্ডিত মণ্ডলীর অযোগ্য বলিয়া বিবেচনা করিয়াছেন।

তাহাদের প্রবীণ জনোচিত গাম্ভীর্যে আঘাত লাগে নাই ভাল কথা কিন্তু বঙ্গীয় সাহিত্যে আমার বিবেচনায় একটি একান্ত অভাব বর্তমান রহিয়াছিল। এইসব লুপ্তপ্রায় স্মৃতিচিহ্নগুলিকে ধ্বংসের হাত থেকে ও বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করবার ভার সম্পূর্ণভাবে আমাদের উপরই রয়েছে। এ বিষয়ে অবহেলা করিলে আমরা ভবিষ্যতের নিকট মার্জনার অধিকারী হইব না। এতে সন্দেহমাত্র নাই।

ঐতিহাসিক সত্যের আবিষ্কার এই অজ্ঞাত ছড়া সাহিত্য হইতে সম্ভবপর না হইলেও অন্যবিধ সত্যের পরিচয় এই সাহিত্যে পাওয়া যায়। মনস্তত্ত্ববিদ সমাজতাত্ত্বিক এই সাহিত্য হইতে বিবিধসত্যের আবিষ্কার করিতে পারেন। মনুষ্যজীবনের একটি বৃহৎ অংশের দুর্জেয় রহস্য এই অনাদৃত সাহিত্যের মধ্যে নিহিত রয়েছে। মানুষের শৈশব জীবনের প্রকৃতি পর্যালোচনা করিতে হইলে আমাদিগকে অনেক সময় এই সাহিত্যের আশ্রয় লইতে হইবে।

বাঙালী শিশুর বাঙালী জীবনের স্বাভাবিক চরিত্রে অসাধারণত্ব বজায় থাকুক, কিন্তু সেই জননী ও অন্যান্য প্রতিবেশী প্রতিবেশিনীর চরিত্রে বঙ্গদেশে ও বঙ্গ সমাজে বাস নিবন্ধন যে অনন্য সাধারণত্ব বৈশিষ্ট আছে এই ছড়া সাহিত্যে তাহারও পরিচয় পাওয়া যাইবে এমন নহে।

বস্তুত এই সকল ক্ষুদ্র মহাত্মহীন অসংলগ্ন ভগ্নাংশ গুলির মধ্যে এক এক স্থানে গৃহস্থ বাঙালী গৃহের সুস্পষ্ট ছবি দেখিতে পাওয়া যায়। তাহা অন্য কোথাও পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ।…

বাঙালীর অকৃত্রিম প্রাচীন নিজস্ব সাহিত্যের কথা বলিতেছি এবং এই অকৃত্রিমতার হিসাবে বাহালীর গ্রাম্য সাহিত্য বিশেষত বাঙ্গালীর শিশু সাহিত্য ও ছড়া সাহিত্য যাহা লোকমুখে প্রচারিত হইয়া যুগ ব্যাপিয়া আপন অস্তিত্ব বজায় রাখিয়াছে। কখন লিপি লেখার যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হয় নাই সেই সাহিত্য সর্বতোভাবে অতুলনীয়।

খুকুমনির ছড়ার মধ্যে কোনরূপ তত্ত্ব সংগ্রহ বা আনন্দ সংগ্রহে সমর্থ হউন বা আশা করি যাহাদের জীবন অদ্যপি জগতের কঠিন নিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়া ফুর্তিহীন হইতে পায় নাই যাহাদের নিকট-বিশ্বসংসারে সকলই নতুন সকলই কৌতুকময় সকলই স্বাভাবিক, সকলই উন্মুক্ত বিশৃঙ্খলার কলরবে ও উল্লাসে পরিপূর্ণ তাহাদিগের আনন্দের মাত্র সম্ভবর্ধনে এই গ্রন্থ কৃতকার্য হইয়া প্রকাশকের শ্রম সফল করিবে।”

লোক সাহিত্যের যথার্থ গুণগ্রাহী রামেন্দ্রসুন্দর এক্ষেত্রে অন্যের যে কোন গুণের পরিচয় পেলে উৎসাহ দিতেন। তাঁর এই দীর্ঘ ভূমিকায় তিনি বাংলার চির নতুন অথচ চির পুরাতন ছড়াগুলির সমাজ নৃতত্ব ও রসের দিক থেকে যে বিচার করলেন তার তাৎপর্য আজকেও অম্লান হয়ে আছে। তার দার্শনিকের প্রজ্ঞা বৈজ্ঞানিকের যুক্তি, সাহিত্যিকের রসগ্রাহীতা বাংলা সাহিত্যের এই লোক সংস্কৃতির আলোচানা ও বিশ্লেষণের দিকটিকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে।

লোকসাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে রামেন্দ্রসুন্দর সঙ্গত কারণেই বিশিষ্ট আসন লাভের অধিকারী কিরণবালা দেবীর ব্রতকথার ভূমিকারও আগে ১৩১৪ সনে সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় তার জন্মভূমির রূদ্রদেব ও অন্যান্য ধর্মরাজ মন্দিরের পূজা পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে ‘গ্রামদেবতা’ নামে ক্ষেত্র অনুসন্ধান ভিত্তিক এক অনন্য সাধারণ প্রবন্ধ রচনা করে গিয়েছেন। শতবর্ষ পরেও তার তাৎপর্য বিন্দুমাত্র কমেনি।

‘গ্রাম দেবতা’ প্রবন্ধটি তাঁর জন্মপল্লী জেমো কান্দির একটি প্রাচীন দেবতা রূদ্রদেব (বুদ্ধমূর্তি) ও রূদ্রদেবের গাজন উৎসব নিয়ে বিস্তারিত ও তথ্যভিত্তিক আলোচনা।

এই আলোচনাটি তাঁর অনন্য সাধারণ কর্মোদ্যোগ ও গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগের দৃষ্টান্ত। প্রত্যক্ষ ক্ষেত্র অনুসন্ধানের ভিত্তিতে একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান লোক-সংস্কৃতিবিদের মত করে গ্রাম দেবতা প্রবন্ধের সামাজিক সংস্কৃতি প্রসঙ্গও অনিবার্যভাবে আলোচিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে তিনি শুধু রূদ্রদেব বা চৈত্র মাসের গাজন নিয়ে শুধু আলোচনা করেননি তিনি বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে রাঢ় বঙ্গে অনুষ্ঠিত ধর্মরাজের গাজন নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর এই আলোচনাটি বিজ্ঞসমাজ তত্ত্ববিদদের মতই বিশ্লেষণাত্মক। প্রায় শতবর্ষ পূর্বের এই সমীক্ষার অনেক আচার অনুষ্ঠান আজকে বিলুপ্তির মুখে যদিও তার বর্ণানুসারী অনেক কৃত্যানুষ্ঠান চৈত্র মাসের শেষ কটা দিনে রূদ্রদেবের মন্দিরে ও কান্দির হোমতলার গাজনের মেলায় উপস্থিত থাকলে দেখার দুর্লভ সুযোগ হবে। তার সেদিনের ভূমিকা ছিল সত্যানুসন্ধানী ক্ষেত্র-গবেষকের। প্রায় শতবর্ষ পূর্বের কান্দির বৌদ্ধ-তন্ত্রাচার সমন্বয়ে রূদ্রদেব তথা বুদ্ধদেবের গাজন উৎসবের একটি মনোগ্রাহী বর্ণনা তার গ্রামদেবতা প্রবন্ধ থেকে আমরা পাচ্ছি।

রবীন্দ্রনাথ যেমন বৃহৎ বঙ্গের লোক সংস্কৃতি চর্চার প্রেরণাদাতা মধ্যমণি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের মত একাজে মুর্শিদাবাদ বাসীকে যদিও রামেন্দ্রসুন্দর সংঘবদ্ধভাবে ব্রতী করতে পারেননি এটা ছিল তার ব্যক্তিউদ্যোগ মাত্র। তবুও এ জেলার লোক সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র সমীক্ষক ও অগ্রণী পদাতিক হিসেবে রামেন্দ্রসুন্দরের নাম সর্বাগ্রগণ্য হবে। এর পরেই এক বিদ্যোৎসাহী অভিজাত বংশের কুলবালা ও কুলবধূ হয়েও কান্দি অঞ্চলে তথা সেকালের ফতেসিং পরগণার গ্রামাঞ্চল থেকে প্রচলিত ব্রতকথাগুলি অনেক আয়াসে সংকলন করেছিলেন যিনি তিনি ইন্দুমতী দেবী। এক্ষেত্রে প্রায় শতবর্ষ আগে একজন মহিলার একাজে ব্রতিনী হওয়া কম ব্যাপার ছিল না। তাকেও এ জেলার একজন অগ্রণী ক্ষেত্র-সমীক্ষক ও লোক-সংস্কৃতি ক্ষেত্রের একজন অগ্রচারীর সম্মান দিতে হবে। রামেন্দ্রসুন্দর ও ইন্দুমতী উভয়ে ছিলেন একই অঞ্চলের বাসিন্দা। ইন্দুমতী দেবী রামেন্দ্রসুন্দরের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন কিনা জানি না তবে মহা-মহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর পুস্তকের ভূমিকা লিখে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছিলেন।

তাঁর লেখা ‘গ্রাম দেবতা’ প্রবন্ধটি সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার ১ম সংখ্যা ১৩১৪ প্রকাশিত হয়েছিল। এই মূল্যবান প্রবন্ধে তিনি প্রথমাংশে জেমো কান্দির ভৌগোলিক পরিচয় ও কিছু পরিসংখ্যান দিয়েছেন। সংলগ্ন এলাকায় তন্ত্রবর্ণিত কয়েকটি পীঠ-এর উল্লেখ করেছেন।

এরপর তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রুদ্রদেব এর বিবরণ ও ইতিহাস বিশ্লেষণ করে পূজক ও পরিচালকবৃন্দের বিবরণ ও ব্রতচারীদের নাম তাঁদের বিভৎস নৃত্যানুষ্ঠানের বিবরণ দিয়েছেন। মূর্তির বর্ণনা দিয়েছেন পূজাচারেরও বিবরণ দিয়েছেন। এই আলোচনায় ভক্তদের গীত একটি আচার ভিত্তিক গানের উদ্ধৃতি ও বর্ণনা দিয়েছেন যে গানটিকে আমি আদি বোলান গানের একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য করি। আজও রুদ্রদেবের মন্দিরে মায়ের পাতার ভক্তরা গভীর রাতে তাদের ধর্মাচারের অঙ্গ হিসেবে সেই গান করে থাকেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রুদ্রদেবের আদি মূর্তি প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চলল চুরি হয়ে গিয়েছে। তদ্রুপ একটি মূর্তি নির্মাণ করে বর্তমানে সেই মন্দিরে পূজা হচ্ছে।

আমরা ‘গ্রাম দেবতা’ প্রবন্ধের কিছু কিছু অংশ নিয়ে আলোচনা করছি। তিনি কান্দি মহকুমার (মুর্শিদাবাদ জেলার উত্তর রাঢ় ভূমে অবস্থিত) ভৌগোলিক বিবরণে এই মহকুমার উত্তরাংশে দ্বারকা, মধ্য ভাগে ময়ূরাক্ষী, বীরভূম থেকে প্রবেশ করে ‘বাবলা’ নাম নিয়ে কান্দির এককালীন সুবৃহৎ জলাধার হিজল বিলের ভিতর দিয়ে গিয়ে ভাগীরথীতে পড়েছে। সে সময় কান্দি মহকুমার আয়তন ছিল ৫১২ বর্গমাইল। গ্রাম সংখ্যা ৮৮৪, গৃহসংখ্যা ৭১১৯৮, লোক সংখ্যা ৩,৩৪,০৫৩ থানা ছিল পাঁচটি , কান্দি, বড়োঞা, খড়গা, ভরতপুর ও গোকর্ণ। অধুনা জনসংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গোকর্ণ থানা কান্দির সঙ্গে ভুক্ত হয়েছে-ভরতপুর থানার সালার থানায় বিভক্ত হয়েছে। সে সময় হিন্দু ছিল ২,১৯,৯৭৩ জন, মুসলমান ১,১২,১১৪ জন। আর প্রেতোপাষক (Animist) ১৯১৬। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে এ অঞ্চলে হিন্দু ও বৌদ্ধ তন্ত্রাচারের প্রবল প্রভাব ছিল এবং মাত্র এক শতাব্দী কাল পূর্বেও এই অঞ্চলে বৌদ্ধ হিন্দু তন্ত্রাচারীরা বর্তমান ছিলেন একটি স্বতন্ত্র ধর্মাচারী সম্প্রদায় হিসেবে।

কান্দি, ভরতপুর, বড়ঞা ও গোকর্ণের কিছু অংশ নিয়ে ছিল ফতেসিং পরগণা। আকবর বাদশাহের আমলে ফতেসিং নামে এক হাড়ি সামন্ত রাজার অধিকারে ছিল ওই পরগণা। আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহের সহযোগী বুন্দেলখন্ডের ঝিঝৌটিয়া ‘ব্রাহ্মণ সবিতা চাঁদ দীক্ষিত হাড়ি রাজাকে মুণ্ডমালার যুদ্ধে (বড়ঞা পাঁচথুপির মধ্যবর্তী স্থানে) হাড়ি রাজাকে পরাস্ত করে এই ভূভাগ দিল্লির মোগল শাসনাধীনে আনেন। ইতিমধ্যে এই অঞ্চলে এসে খড়গ্রাম থানার সেরপুরের যুদ্ধে পাঠান সেনাপতি উসমান খানকে পরাজিত করেন মানসিংহ স্বয়ং ও মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

পারিতোষিক হিসেবে সবিতা দীক্ষিত ফতেসিংহ পরগণা লাভ করে এখানে গড় নির্মাণ করে বাস শুরু করেন। জেমো ও কান্দির রাজ বংশ সবিতা চাদের উত্তরসূরী (যদিও বংশধারা লুপ্ত) দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দের আমলে এই জমিদারি দ্বিখণ্ডিত হয়। কান্দি মহকুমায় সহস্র বৎসর কাল থেকে উত্তর রাঢ়িয় কায়স্থ সমাজের বাসভূমি ছিল। দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থ কান্দিতে তাঁর জন্ম। এতদঅঞ্চলের ইতিহাসে কান্দির রাজবংশের একটি উল্লেখ্য ভূমিকা আছে।

এই উত্তর রাঢ়ভূমের সঙ্গে তন্ত্রাচারের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান আছে-কান্দির ১৫/১৬ ক্রোশ মধ্যে অট্টহাস, কিরীটেশ্বরী, নলহাটি, বহুলা, ক্ষীরগ্রাম, নন্দীকেশ্বরী, তারাপীঠ, কংকালীতলা প্রভৃতি স্থানগুলি অবস্থিত।

এছাড়াও স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব রাঢ় ভ্রমণকালে এখানে পরিভ্রমণ করায় ও তাঁর অনুগামীগণ এখানে বৈষ্ণব ধর্ম, কীর্তন ইত্যাদি প্রচারের কারণে ভরতপুর মালিহাটি, টেয়া, ঝামটপুর, উদ্ধারণপুর, জাজিগ্রাম, শ্রীখণ্ড প্রভৃতি গ্রামে বৈষ্ণব শ্রীপাঠ ও বৈষ্ণবধর্ম ও কীর্তন গানের চর্চাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।

কান্দির দেবতা ‘গ্রাম দেবতা’ তিনি ‘রুদ্রদেব’। ফতেসিংহের দুই জমিদার জেমো ও কান্দির রাজবংশ এই দেবতার সেবাইত! অনাবৃষ্টি হলে ভক্তবৃন্দ মন্দিরে বিগ্রহের গায়ে জলসিঞ্চন করলে বৃষ্টি হয় এরূপ বিশ্বাস প্রচলিত আছে। এখানে মানস করে শূল ব্যাধির আরোগ্য হয়। কুকুর
দংশনের নিরাময়ের জন্য অসংখ্য মানুষ আজও এই মন্দিরে পাণ্ডাদের প্রদত্ত ওষুধের উপর ভরসা করে ও নিরাময় হন।

উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থ কুলের আদি পুরুষ অনাদিবর সিংহর বংশধর বনমালী সিংহ বন কেটে কান্দিকে বাসযোগ্য করেন। এই বনমালি সিংহের বংশধর রূদ্রকণ্ঠের সময়ে, ব্রহ্মচারী কামদেব এই বিগ্রহ কান্দিতে স্থাপন করেন। রূদ্রকণ্ঠ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন পরবর্তীকালে ওই রূদ্রদেব (কালাগ্নি রূদ্র মূর্তি) জেমো বাঘডাঙ্গা রাজবংশের হস্তগত হয়। তদুবধি কান্দি মহকুমার আপামর মানুষের তিনি গ্রাম দেবতা হিসেবে পূজিত হচ্ছেন দুটি মূর্তির একটি উদ্ধারণপুর ঘাটে পূজিত হচ্ছে। সবিতা চাঁদ ষোড়শ শতাব্দীতে এখানে এসেছিলেন। তার সমকালীন ছিলেন কামদেব ও রূদ্রদেব।

চৈত্রমাসের শেষদিকে হয় রুদ্রদেবের বাৎসরিক উৎসব ও গাজন উৎসব। ১৯ চৈত্র উৎসবের আরম্ভ।

পরিচালন: এই মন্দির পরিচালনায় বেতনভোগী পূজক ও অবৈতনিক কর্মচারী বৃন্দ এখানে কাজ করেন। মন্দিরের কাজকে এরা পুণ্যকর্ম মনে করেন ও অনেক সম্ভ্রান্ত মানুষ একাজে অংশ নেন।

পূজক ও পরিচারণ ব্রাহ্মণ ভূসম্পত্তি ও বেতন ভোগ করেন। দেয়াশী, বিহয়া, মড়ানা মলমতি, স্বর্ণমতি-এরা নৈমিত্তিক কাজ করেন। কোতোয়াল, থানাদার, চৌকিদার, নকিবদার, ছড়িদার এঁরা শান্তি রক্ষা করেন।

আশাবরদার, শোঠাবরদার, আরানিদার, নিশানবরদার, চামরবরদার এরা-বারের সময় সুসজ্জিতভাবে উপস্থিত থাকেন (দেবতা যখন বাইরে এসে সুসজ্জিত বেশে সিংহাসনে বসেন)। রূদ্রদেবের মিছিল ময়ূরাক্ষী তীরে- হোমতলায় গিয়ে একদিন অধিষ্ঠান করেন ও সেখানে পূজা, হোম, স্নানাদি হয় বৃহৎ মেলা বসে। সে সময় শোভাযাত্রা কালে এঁরা সুসজ্জিত বেশে দেবতাকে পাহারা দিয়ে মিছিলে অংশ নেন।

এছাড়াও আছে মোদ্দা এরা পার্শ্ববর্তী চল্লিশটি গ্রামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।

ভক্ত: ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল যে কেও হতে পারেন। পনেরো দিন ধরে কঠিন নিয়মাচারে ব্রত পালন করতে হয়। এঁরা ‘উত্তরীয়’ ধারণ করেন বেত্রদণ্ড হাতে নেন। বহু মানুষ এখানকার ব্রত ধারণ করেন। এছাড়া আছে বিভিন্ন সন্ন্যাসী।

১। মায়ের পাতা: এরা ডাকিনী সেজে নৃত্য করেন। মুখোশ পরেন।
২। চামুণ্ডার পাতাঃ এরা বিকট পিসাচ বেশ ধারণ করেন, রাঙা কাপড় পড়েন, ফুলের মালা নেন সর্বাঙ্গে গায়ে রূপার গহনা থাকে, মাথায় লম্বা চুল, এরা নৃত্যে অংশ নেন-মুখোশ খেলা করে।

৩। চামুণ্ডার পাতা: এরাও পিসাচ সেজে বিকট রূপ ধারণ করে মুখোশ পরে নৃত্য করে।

৪। লাউসেন পাতা: এরা লাউ, কুমড়া, নিয়ে নাচে।

৫। ধূলসেন পাতা: এরা ধূলি ছড়িয়ে নৃত্য করে।

৬। ব্রহ্মার পাতা: এরা হোমাগ্নি বহন করে।

৭। জলকুমির পাতা: এরা খেচুরি ভোগ জলে ভাসায়।

সন্ন্যাসীর সংখ্যা নির্দিষ্ট থাকে।

১৯ চৈত্র উৎসব (বার) আরম্ভ। সন্ধে বেলায় কাঁটা ভাঙ্গা অনুষ্ঠান। কাঁটাগাছের উপর ভক্ত গড়াগড়ি হয়। সিদ্ধি ভাঙ। ভক্তরা সিদ্ধি খায়। নবম রাত্রে চোরা জাগরণ কিছু পূজাচার হয়। জাগরণ (পরদিন অর্থাৎ দশম রাত্রে) এই দিন মহা সমারোহ।

রাতে শাখ চুরি, মড়া খেলা (আস্ত মড়া বা মড়ার মাথা নিয়ে নৃত্য হয়)। বিভিন্ন পাতার ভক্তরা
ঢাক বাজিয়ে একে একে সারা রাত ধরে রূদ্রদেবের মন্দিরে বিকট নৃত্য প্রদর্শন করেন-বহুলোক সমাগম হয়। ১২৮৮ বঙ্গাব্দে সরকারি নির্দেশে মড়া খেলা নিষিদ্ধ হলেও কোন কোন বছর এখনো মড়া খেলা হয়। (আমি কয়েকবার মড়া খেলা প্রত্যক্ষ করেছি-প্রতিবেদক)।

একাদশ দিনে শোভাযাত্রা সহকারে ময়ূরাক্ষীতীরে পালকি চরে কামদেব ব্রহ্মচারীর সমাধি স্থানে যান ও সারাদিন রাত সেখানে রূদ্রদেব অবস্থান করেন-এদিন মেলা বসে।

অভিষেক, পুজা, হোম, বলিদান, দাদুর ঘাটা অনুষ্ঠান (রূদ্রকণ্ঠ সিংহের বংশধরদের কাছ থেকে আনিত তেল মাথান হয় রূদ্রদেবের গাত্রে)। দেবতাকে স্নান করান হয়। বেদীতে স্থাপন পূজা, ভোগ হয়। দাদুর ঘাটার দিন রূদ্রদেবের রূপপুর জেমো স্থিত মূল মন্দির বন্ধ থাকে। চোরা জাগরণের দিন মন্দিরে রাত্রে বোলান গান হয়। জলকুমির ব্রতানুষ্ঠান মাছ ও খেচুরি ভোগ-জলে অর্পণ করা হয়। এটি একটি কঠিন কৃত্যানুষ্ঠান। পরদিন চৈত্র সংক্রান্তি রূদ্রদেব হোম তলা থেকে শোভাযাত্রা সহকারে মন্দিরে ফিরে আসেন।

জেমোর রূদ্রদেব মূলত বুদ্ধমূর্তি। সমাধিমগ্ন অবস্থায় উপবিষ্ট। পার্শে বোধিসত্বগণ ও দেবগণ বর্তমান পদ্মাসনের নিচে উপাসকেরা উপবিষ্ট। উপরে পালঙ্কের উপর মহাপরি নির্বাণ মুখ বুদ্ধদেব শয্যাশায়ী। গলদেশে নগোপবীত। ললাটে তৃতীয় লোচনের চিহ্ন। (নগোপবীত ও তৃতীয় লোচন সম্ভবত পরবর্তীকালে অঙ্কিত।) বুদ্ধমূর্তিকে এইভাবে অনেক স্থানে মহাদেব মূর্তিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। পরবর্তী অংশে রামেন্দ্রসুন্দর ধর্মরাজ পূজার বিবরণ প্রদান করেছেন। আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর তৎকালীন কৃত্যানুষ্ঠানের একটি গান যা ঢাক বাজিয়ে আজও শিবের ও ধর্মরাজের ভক্তবৃন্দ মন্দিরে দেবতার সামনে করে থাকেন। এটি তাদের অবশ্যকৃত্য অনুষ্ঠান, এটি আদি বোলানের দুর্লভ দৃষ্টান্ত।

১।

ওরে সালে-

ধুল-ধুল-ধুল সাজলে ধুল-ধুল-ধূল।

পড়েছে মায়ের পাতা উদম করে চুল।। (উদম মুক্ত)

২।

ওরে সাজলে-

শ্মশানে গিয়েছিলাম মশানে গিয়েছিলাম

সঙ্গে গিয়েছিলকে? কার্তিক গণেশ দুটি ভাই

সঙ্গে সেজেছে।।

৩।ওরে সাজলে-

কাল বাছা খেয়েছিলে টুকুই ভরা মুড়ি।

আজ বাছারে মুণ্ড যায় ধুলায় গড়াগড়ি।

( টুকুই-তালপাতার নির্মিত মুড়ি খাবারপাত্র)

৪। ওরে সাজলে-

সোলার আঁচির সোলার পাঁচির সোনার সিংহাসন।

তার উপরে বসে আছেন ধর্ম-নিরঞ্জন।

৫।ওরে সাজলে-

কার গাছেতে কেটেছিলাম খণ্ড কলার বাল।

আজ, পুত্রশোকে আকুল হোলেন কেবা দিলে গাল।।

(বাল=বাইল শাখা, গাল-গালি)

৬।ওরে সাজলে-

জলশুদ্ধ স্থলশুদ্ধ শুব্ধ তামার কাঠি

আড়াই হাত মৃত্তিকাশুব্ধ, শুদ্ধ ঢাকের কাঠি।।

৭।ওরে সাজলে-

তুইতো মেরা ভাই, সাজলে তুই তো মেরা ভাই।

তোর সঙ্গে খেলে সাজলে, শিব দরশন পাই।।

(মেরা-আমার)

৮।ওরে সাজলে-

ভাল বাজালি ঢেকো ভেয়ে তোর মা আমার মাসী।

এনোদ্ করে বাজা সাজলে বেনোদ করে নাচি।।

(ঢেকো=ঢাক=বাদক, ভেয়ে ভাইয়া ভাই, এনোদ্-আনন্দ, বেনোদ-বিনোদ)

ধর্মরাজ পূজার কৃত্যানুষ্ঠানের বিবরণ প্রদান করেছেন তিনি। ধর্মরাজ মন্দিরে কয়েকদিনের জন্য বেত্রদণ্ড, উত্তরীয় ধারণ করেন। কামিয়ে স্নান করে ভক্ত হন। ভক্তরা কঠোরভাবে ব্রতের আচার অনুষ্ঠান পালন করেন। ধর্মরাজ পূজাতে জাগরণের রাত্রে ও চোরা জাগরণের রাত্রে বোলানগান হয়। মন্দিরে শোভাযাত্রা সহকারে দেবতার স্নান হোম পূজা বলিদান হয়। মড়ার মাথা খেলা, ভাজল নাচান, গাছ কামান, কাঠা ঝাপ, আগুন ঝাপ, বানফোঁড়া, ভর, দাদুর ঘাটা, শঙ্গান প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণত বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায় কান্দি অঞ্চলে ও জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ধর্মরাজ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সারা বছর অব্রাহ্মণ পুরোহিত বা দেবাংশীগণ এই মন্দিরের পূজাদি করেন। ব্রাত্যজনেরা ব্যাপক সংখ্যায় ধর্মরাজের ভক্ত হন।

প্রসঙ্গত পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে রামেন্দ্রসুন্দর বর্ণিত আদি রূদ্রদেব অপহৃত হয়েছে ও অধুনা অনুরূপ মূর্তি নির্মাণ করে মন্দিরে নিত্য পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী তাঁর গ্রাম-দেবতা প্রবন্ধটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন কিন্তু সেটি পূর্বেই মুদ্রিত হয়নি। আশুতোষ বাজপেয়ী মহাশয় ‘রামেন্দ্রসুন্দর জীবনকথা’ গ্রন্থে (প্রথম প্রকাশ ১৩৩০ চৈত্র) সেটি প্রকাশ করেছেন- ‘A note on traces of Buddhism found in pergana fatehsing of the district Murshidabad’ এই নামে।

লোক সমাজ তথা বৈষ্ণব সমাজের একটি ঐতিহাসিক ঘটনার দলিল উদ্ধার করেছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর। সেটা তার রচনা সমগ্রে স্থান পেয়েছে ও রাঙ্গামাটি বা কর্ণসুবর্ণ ইদানীং খনন কার্যের ফলে সেখানকার অনেক পুরা ইতিহাস উন্মোচিত হয়েছে যা রামেন্দ্রসুন্দরের পরবর্তী কালের কথা। রামেন্দ্রসুন্দর রাঙ্গামাটি কর্ণসুবর্ণ বিষয়ে একটি লোক কাহিনী প্রকাশ করেছিলেন সেটি নিয়ে কিছু আলোকপাত করা দরকার।

প্রথমটি বৈষ্ণব সমাজের বিষয় হলেও লোক সমাজেরই বিষয়। তিনি একটি দলিলের প্রতিলিপি থেকে একটি বৈষ্ণব জগতের ইতিহাস উন্মোচন করেছেন।

জয়পুরের মহারাজ সেওয়াঞ জয় সিংহের সভায় কয়েকজন বঙ্গদেশীয় বৈষ্ণবদের সহিত তদ্দেশীয় পণ্ডিতদের ধর্ম সংক্রান্ত বিচার হয়। বিষয়টি ছিল স্বকীয়ভজন ও পরকীয়া ভজন। কোনটা ‘প্রশস্ত কোনটা প্রশস্ত নয়’। সেটি ছিল বিচারের বিষয়। পশ্চিম দেশীয় পণ্ডিতরা স্বকীয়মতের পক্ষপাতী ও বঙ্গদেশীয়রা পরকীয়া মতের সমর্থক। কিন্তু সেখানকার তর্কযুদ্ধে পরাজিত হয় তারা লিখিতভাবে পরাজয় স্বীকার করে দেশে ফিরে আসেন। পরে তাদের অনুরোধে মহারাজ জয়সিংহ সেখানকার পণ্ডিত কৃষ্ণদেব ভট্টাচার্যকে বঙ্গদেশে প্রেরণ করেন। বাংলার পরাজিত পণ্ডিতরা বঙ্গ দেশীয় পণ্ডিতদের একত্রিত করে ওই বিষয়ে বিচারার্থে উপস্থিত হন। তখন জাফর খাঁর শাসনকাল। (মুর্শিদকুলি খাঁ) তাঁর অনুমোদনক্রমে এই বিচারসভা বসে। এবং এখানে বাঙ্গালী পণ্ডিতরা জয়লাভকরেন।

শ্রীনিবাস আচার্য্যের বংশধর রাধামোহন ঠাকুর (পদকর্তা বৈষ্ণব শাস্ত্রজ্ঞ, কীর্তনগায়েন এবং পরকীয়া মতের সংস্থাপক) এই বিচারে বঙ্গীয় পণ্ডিতকুলের প্রধান ছিলেন। ইনি পদামৃত সমুদ্র সংকলন করেন। তিনি মালিহাটি গ্রামে বাস করতেন। এই বিচারসভায় রাধামোহনের দুই শিষ্য টেয়া নিবাসি গোকুলানন্দ ও কৃষ্ণকান্ত মজুমদার উপস্থিত ছিলেন। এঁরা নিজেদের বৈষ্ণব দাস ও উদ্ভব দাস নামে পরিচিতি দিতেন। সে সময় রাধামোহন ঠাকুরের বয়স ছিল চল্লিশ বছর। তিনি

মহারাজ নন্দকুমারের গুরু ছিলেন।

রাঙ্গামাটি কর্ণসুবর্ণ নিয়ে তিনি যে লোকশ্রুতি প্রকাশ করেছেন সে কাজটি একজন পাকা লোকসংস্কৃতিবিদের কাজ। লোকশ্রুতি ইতিহাস নয়- লোক সাধারণের মধ্যে প্রচারিত কাহিনী কিন্তু তার মধ্যে ইতিহাসের সত্য থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে- সেটি আলাদাভাবে বিচার্য। আমরা তার আবিষ্কৃত বিষয়টি ইতিহাস নয় লোককথার দৃষ্টিতে উল্লেখ করছি।

“রাঙ্গামাটি অতি প্রাচীনকালে কোন সমৃদ্ধ রাজ্যের রাজধানী ছিল, তাহা রাঙ্গামাটি সম্বন্ধে স্থানীয় প্রবাদ হইতে বুঝা যায়। রাঙ্গামাটির নৈসর্গিক অবস্থান ‘প্রকৃতই একটা রাজধানীর উপযুক্ত। পূর্বের ভাগীরথী পশ্চিমে একটা বহু ক্রোশ বিস্তৃত নিম্ন জলাভূমি বা বিল এই স্থানকে একটা নৈসর্গিক দুর্গে পরিণত করিয়াছে। এই বিলের মধ্য দিয়া প্রাবহিত বাঁকি নদী ও দ্বারকা নদী পরিখার আকারে রাঙামাটি ও সন্নিহিত গ্রামগুলিকে উত্তর ও পশ্চিমদিক হইতে দুর্গম করিয়া রাখিয়াছে। রাঙ্গামাটি অতি উন্নত রক্তবর্ণ মৃত্তিকার উপর অবস্থিত। এই রক্তবর্ণ মৃত্তিকাকে ছোটনাগপুর বীরভূম প্রদেশের রক্তমৃত্তিকার পূর্বসীমা হিসেবে গ্রহণ করা যাইতে পারে।

রাঙ্গামাটি যে প্রাচীন কর্ণসুবর্ণ রাজ্যের রাজধানী সে বিষয়ে সন্দিহান হইবার কিছু নাই। কর্ণ সেনের সঙ্গে কর্ণসুবর্ণের নাম কিভাবে জড়িত হইল বলা যায় না। সম্ভবত কর্ণসুবর্ণ নাম থেকে কর্ণ সেনের প্রবাদ উৎপন্ন হইয়া থাকিবে। চাঁদপাড়া ব্যতীত অন্যান্য স্থানের সহিত চাঁদসদাগরের কাহিনী জড়িত আছে। দ্বারকা নদীর তীরবর্তী পাটনের বিল বাহিয়া ময়ূরাক্ষী পার্শ্বস্থ নবদুর্গা গোলাহাট গ্রামের পার্শ্বদিয়া চাঁদ সদাগরের নৌকা গিয়াছিল এরূপ কিংবদন্তী আছে।”

নবদুর্গা গোলাহাট বামেতে রাখিয়া

চলিল সাধুর ডিঙা পাটন বাহিয়া।”

মনসামঙ্গল কাব্যে এটি উল্লিখিত হয়েছে (প্রতিবেদক)। কান্দির অন্তর্গত বাঘডাঙ্গা গ্রামের নীচে যেখানে চাঁদ সদাগরের নৌকা বাঁধা হইয়াছিল, এখনও লোকে সে স্থান দেখায়।

দীঘাপাতিয়া রাজ বংশধর কুমার শরৎ কুমার রায় সংগৃহীত পদ্যে একটি উপাখ্যান (খণ্ডিত অংশবিশেষ) রামেন্দ্রসুন্দর উদ্ধৃত করেছেন-

মদনপাল গেলরণে হইল হড়বড়
বেড়িয়া লইল দলে কর্ণসিংহের গড়।
করিল অনেক যত্ন যুদ্ধ অতিশয়
কদাচ তাহার গড় নহে পরাজয়
মরিল অনেক সৈন্য না হইল কাজ
তাহা দেখি মদন পাল মনে পান লাজ।
চাঁপাকর্ণ নামে পাত্র কহিল তাহায়
কিরূপে লইবে গড় চিন্তহ উপায়
যদি এহি রাজ্য তুমি পার লইবার
সর্বথা তোমাকে আমি দিব অধিকার।

(সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা ১৩০৭)

গদ্য রচনার বৈশিষ্ট্য :-

এখন দেখা যাক, রামেন্দ্রসুন্দরের গদ্যরচনার বিশিষ্ট লক্ষণগুলি।
প্রথমেই বলা যেতে পারে, রামেন্দ্রসুন্দরের রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য সর্বক্ষেত্রে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। প্রবন্ধের নামকরণ থেকে আরম্ভ করে বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা ও উপসংহার পর্যন্ত এই নিরপেক্ষতা বিদ্যমান। যেমন ‘সুখ না দুঃখ’ প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এখানে নামকরণে যেমন সুখ ও দুঃখ উভয়কে স্থান দিয়েছেন তেমনি প্রবন্ধের আলোচনায় নিরপেক্ষভাবে একদিকে সুখবাদীদের যুক্তি অন্যদিকে দুঃখবাদীদের যুক্তিকে গ্রথিত করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত নেননি। বলেছেন “মীমাংসা হইল না। নিরপেক্ষভাবে দুই দিক দেখাইতে গিয়া লেখক যদি অজ্ঞাতসারে কোন দিকে বেশী টান দিয়া থাকেন, পাঠকেরা মার্জনা করিবেন।” বস্তুত আলোচনার শেষে কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার ফলে পাঠকের উপর একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া তাদের অস্বস্তির কারণ যেমন হয়নি তেমনি পাঠকও স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।

অবশ্য এই ধরনের নিরপেক্ষতার পশ্চাতে তার বিজ্ঞানপাঠের প্রভাব একদিকে যেমন কাজ করেছে তেমনি অন্যদিকে সমসাময়িক বিষয়ে বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছে। সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সমসাময়িক কালে যে অজস্র আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছিল তার প্রেক্ষিতে কোন বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করেছেন এবং সেজন্য তিনি নিরপেক্ষ থেকেছেন।

দ্বিতীয়ত,
তার সর্বত্র একটা লজিক্যাল সিকোয়েন্স (Logical Sequence) যা যৌক্তিক ভারসাম্যের প্রকাশ। তত্ত্ব ও তথ্যের সমন্বয়ে তাঁর বক্তব্য কখনও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেনি। প্রতিটি প্রবন্ধকেই যুক্তির পারম্পর্য অনুযায়ী সাজিয়েছেন। যেমন ‘সুখ না দুঃখ’ প্রবন্ধে (ক) ভূমিকা, (খ) সুখবাদীদের যুক্তি, (গ) দুঃখবাদীদের যুক্তি, (ঘ) লেখকের নিজস্ব যুক্তি- এইভাবে সাজিয়েছেন। আবার ‘মহাকাব্যের লক্ষণ’ প্রবন্ধে (ক) মহাকাব্য কি? (খ) দুই শ্রেণির মহাকাব্য, (গ) মহাকাব্য রচনার উৎস, (ঘ) লেখকের নিজস্ব মত ইত্যাদি এই কাঠামো বজায় রেখেছেন।

তৃতীয়ত,
গভীর তত্ত্ব বা বিষয় নিয়ে আলোচনা ও মতবাদ প্রতিষ্ঠার সময় উদাহরণের সাহায্য নিয়েছেন। এই দৃষ্টান্ত তিনি চয়ন করেছেন মূলত দুটি ধারা থেকে (১) ইতিহাস, সাহিত্য ও বৈজ্ঞানিকদের রচনা থেকে ফলে প্রবন্ধ পাঠের সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক রচনা, সাহিত্য ও ইতিহাস পাঠের আনন্দও লাভ করা যায়। (২) প্রাত্যহিক ও লৌকিক জীবনের ঘটনাপুঞ্জ ও অভিজ্ঞতা থেকে ফলে দুরূহ দার্শনিক তত্ত্ব বা সমাজতত্ত্ব বোঝা সহজ ও সাবলীল হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ‘মহাকাব্যের লক্ষণ’ প্রবন্ধে ইতিহাসের প্রসঙ্গ তুলে মহাকাব্যে মনুষ্যত্বের চিত্রকে কিভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছেন- “সিডান ক্ষেত্রে বিসমার্ক লুই নেপোলিয়নকে হস্তগত করিয়াছিলেন সত্য, কিন্তু তাহার বুক চিরিয়া নেপোলিয়ন বংশে শোণিতের আস্বাদ গ্রহণ আবশ্যিক বোধ করেন নাই।” অন্যদিকে ‘বৈরাগ্য’ প্রবন্ধে ইতিহাস থেকে উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, “আমাদের ভারতবর্ষে বুদ্ধদেবের পর হইতে দুইশত বৎসর ধরিয়া গৃহধর্মের উপরে সন্ন্যাস ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা যে ঐতিহাসিক ফল প্রসব করিয়াছে তাহা আলোচনার বিষয়।”

চতুর্থত,
পরিহাসরসিকতা। বাকভঙ্গিতে ও উদাহরণ চয়নে এই পরিহাসরসিকতা রামেন্দ্রের প্রবন্ধগুলিকে অতিরিক্ত প্রসাদগুণে ঋদ্ধ করেছে। বলাবাহুল্য এই পরিহাসপ্রিয়তা বিচ্ছিন্ন নয়-যুক্তি ও প্রজ্ঞার আলোকে উজ্জ্বল এবং তা ভাবের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেনি। যেমন ‘মহাকাব্যের লক্ষণ’ প্রবন্ধে মহাকাব্যের যুগে সামাজিকতার নিদর্শন দিতে গিয়ে যে উদাহরণ চয়ন করেছেন তার মধ্যে তার পরিহাসপ্রিয়তা প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন, “এ কালের রাজারা মালকোঁচা মারিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে গদা হস্তে অবতীর্ণ হন না সত্য বটে, কিন্তু ভীমরতিগ্রস্ত পিতার একটা কথা রাখিবার জন্য ফিজি দ্বীপে নির্বাসন গ্রহণ করিতে প্রস্তুত থাকেন কিনা বলিতে পারি না।”

‘বৈরাগ্য’ প্রবন্ধে পরিহাসছলে বলেছেন, “দারা সুত পরিবার, কে বা কার, কে তোমার, কেহ সঙ্গে আসে নাই, কেহ সঙ্গে যাবেও না, কেবল চক্রান্ত করিয়া তাহারা তোমাকে সংসার কারাগারে মোহের শিকলে বাঁধিয়া রাখিয়াছে, যদি বুদ্ধি থাকে ও কল্যাণ চাও সত্বর শিকল কাটিয়া আপনার পথ দেখ।” সমগ্র উক্তি জুড়ে রয়েছে হাস্যরসের ঊর্মি-কম্পন।

প্রাবন্ধিকের পরিহাস রসিকতা সম্বন্ধে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “বিষয়বস্তুর গুরুত্ব ও মনীষার সমন্বয় কুশলতা ছাড়াও তাঁহার সরসভঙ্গীই তাঁহার প্রবন্ধের প্রাণস্বরূপ ও ইহার সাহিত্যিক উৎকর্ষের প্রধান আকর। তিনি দুরূহ তত্ত্বসমূহ উপস্থাপনা করিয়াছেন অতিশয় চিত্তাকর্ষক প্রণালীতে, নানা দৃষ্টান্ত উদাহরণের সার্থক সমাবেশে, নানা কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্নের চতুর ইঙ্গিতে, কল্পনা স্ফুরণের নানা ফন্দিফিকিরে, রসসৃষ্টির সুপরিকল্পিত আয়োজনে।” (বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা – দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩৪)

পঞ্চমত,
নেতি নেতি করে যুক্তি পরম্পরায় অস্তির দিকে পৌঁছানো রামেন্দ্রসুন্দরের রচনার আর একটি বৈশিষ্ট্য। ‘সৌন্দর্যবুদ্ধি’ প্রবন্ধে এর প্রমাণ মেলে।

ষষ্ঠত,
রামেন্দ্রসুন্দর সাধুভাষায় প্রবন্ধ লিখেছেন- ক্রিয়াপদও সাধু ভাষায়। তাছাড়া বহু অপ্রচলিত শব্দ, তদ্ভব শব্দ ও অব্যয় এবং প্রত্যয়ের মিশ্র প্রয়োগ ঘটেছে। তাঁর ভাষার কাঠামোটি সহজ ও মৌখিক বাক্রীতির অনুসারী। বঙ্কিমের তুলনায় তা উন্নতমানের। বাংলা বাক্যের ইংরেজি শব্দের ব্যবহারে তার কোন সংস্কার ছিল না। তাই তিনি বাক্যের চারুতা প্রকাশের জন্য ফাইন, আর্ট, ইসথেটিক প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করেছেন।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষাদর্শের সমন্বয়, একনিষ্ঠ স্বদেশপ্রীতি, সুতীব্র মানবিক অনুভূতি প্রভৃতিও তাঁর গদ্যরচনার অন্যতম উপাদান। প্রবন্ধের বিষয়বস্তু যতই গুরুগম্ভীর ও তত্ত্বমূলক হউক না কেন এর প্রকাশে একটা সাহিত্যের ছোঁয়া আমরা লক্ষ করি।

সপ্তমত,
অতিকথন দোষ তত্ত্বের ভারাক্রান্ততা অনেক সময় তাঁর রচনারীতিকে ত্রুটিমুক্ত করেছে। কমা ও সেমিকোলনের সাহায্যে দীর্ঘ দীর্ঘ বাক্য রচনা তাঁর আর একটি ত্রুটি বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

সামগ্রিকভাবে বক্তব্যের সহজ সরল ও যুক্তিনিষ্ঠ উপস্থাপনায়, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিক মনন ঋদ্ধ আলোচনায়, পরিহাসপ্রিয়তা ও সহানুভূতির কোমল স্পর্শে প্রবন্ধগুলি ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যান্যদের থেকে স্বতন্ত্র- যাতে রামেন্দ্রসুন্দরের ব্যক্তিত্বেও প্রকাশশৈলীর মৌলিক বিকাশ ঘটেছে। তাই রথীন্দ্রনাথ রায় বলেছেন, “বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও দার্শনিক গভীরতাকে সাহিত্যের অমৃতরসে পরিণত করার দুর্লভ শিল্প কুশলতা তাঁর ছিল।” বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি অক্ষয় সম্পদ রেখে গেছেন।

তথ্য সূত্রঃ-

১। রামেন্দ্রসুন্দর জীবন কথা-আশুতোষ বাজপেয়ী

২। রামেন্দ্রসুন্দর রচনা সমগ্র।

৩। অনুবাদ পত্রিকা (কলিকাতা)।

৪। লোকসংস্কৃতিবিদ রামেন্দ্রসুন্দর (বাংলা ও হিন্দী)-পুলকেন্দু সিংহ (অনুবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত আকারে)।

৫। সংসদ বাংলা চরিতাবিধান।

৬। রামেন্দ্রসুন্দর লিখিত বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা।

৭। রামেন্দ্রসুন্দর লিখিত গ্রাম দেবতা প্রবন্ধ।

৮। কান্দি রূদ্রদেব মন্দির ও মেলা প্রাঙ্গণে প্রতিবেদকের ক্ষেত্রানুসন্ধান।
৯। মুর্শিদাবাদ অনুসন্ধান প্রথম খন্ড।

Author

  • Suman Kumar Mitra

    Suman Kumar Mitra is a Researcher at Murshidabad Zilla Itihas & Sanskriti Charcha Kendra. He did his MA in Bengali from Rabindra Bharati University and is a Guest Lecturer at D.I.E.T Murshidabad, Berhampur, West Bengal. Views expressed are personal.

    View all posts

(The views expressed are the author's own and do not necessarily reflect the position of the organisation)